১। সিঙ্গুর আন্দোলনকে ব্যবহার করে ‘কৃষক দরদী’ মমতা ২০১১ সালে সদ্য ক্ষমতায় বসেছেন। সিঙ্গুরের আন্দোলনকারীদের দাবিগুলি নিয়ে সিপিআই(এমএল) রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গে। সিঙ্গুরে আন্দোলনকারীদের উপর থেকে মিথ্যা মামলাগুলি প্রত্যাহারের দাবি উঠল। তৎকালীন আইনমন্ত্রী মলয় ঘটককে ডেকে আনলেন মুখ্যমন্ত্রী, নির্দেশ দিলেন মামলা প্রত্যাহারের। পরবর্তীতে কেটে গেলে সাতটা বছর। মামলা প্রত্যাহারে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি বর্তমান সরকার। এভাবেই সিঙ্গুরের কৃষকদের উপর মামলার জুজু অব্যাহত – আন্দোলনকারীদের চাপে রাখতে। মমতা ব্যানার্জীদের সম্পর্কে দোষারোপ যে মিথ্যা নয় বোঝা যায় যখন দেখি ভাঙড়ের আন্দোলনরত কৃষক ও নেতৃবৃন্দের উপর একের পর এক মিথ্যা মামলা, এমনকি ইউএপিএ ধারাও চাপাচ্ছে নেত্রীর সরকার।

২। কথা ছিল তাপসী মালিক, রাজকুমার ভুল সহ সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে হত্যা ও অত্যাচারের প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত কমিশন করে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হবে এবং নতুন রাজ্য সরকার এদের শাস্তি প্রদান করবে। কেউ শাস্তি পায়নি, কোনো তদন্ত কমিশনও গঠন করা হয়নি। নন্দীগ্রামের হত্যাকারী পুলিশ অফিসাররা অনেকেই বরং পদোন্নতি লাভ করেছে। এ আমলে, এমনকি শিলাদিত্যরা কৃষক স্বার্থে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করার সাহস দেখালে জেলে পোরা চলছে মিথ্যা মামলায়। অপরাধীরা ঘুরছে নির্ভয়ে।

৩। সিঙ্গুর আন্দোলন সামনে এনেছিল এ রাজ্যের অসমাপ্ত ভূমিসংস্কারের প্রশ্নটি। দেখা গিয়েছিল, জমির সাথে সম্পর্কহীন অকৃষক মালিকরা টাটাগোষ্ঠীকে কারখানা গড়তে জমি দিতে এগিয়ে এসেছিল ঐ জমির প্রকৃত কৃষক অনথিভুক্ত বর্গাদারদের বঞ্চিত করে। এই বর্গাদার পরিবারগুলি ছিল জমি রক্ষা আন্দোলনের সামনের সারির সৈনিক। সুপ্রীম কোর্টের রায়ে ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক সমস্ত কৃষক যখন টাকা সহ জমি ফেরতের প্রহর গুনছেন, সেসময় ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে সিঙ্গুরে আসা সজল অধিকারীর নেতৃত্বে সিপিআই(এমএল)-এর এক প্রতিনিধি দলকে অনথিভুক্ত বর্গাদাররা জানান, ‘এই মাঠে আমরাই চাষ করতাম। সেদিন আমাদের বঞ্চিত করে টাটা কোম্পানিকে জমি বেচে অর্থ পেয়েছিল মালিক। আজ সুপ্রীম কোর্টের রায়ে আবার জমি ফেরত পাচ্ছে মালিকরা। এরা অকৃষক। এরা সুযোগ পেলে জমি আবার বেচে দেবে। আবার অর্থ পাবে। জমি রক্ষায় আমরা বর্গাদাররা অনিচ্ছুক জমি মালিকদের সাথে আন্দোলন করলাম। জমি ফিরছে, কিন্তু আমরা কি পাব? কেন বিশেষ ক্যাম্প বসিয়ে এসময়ই অনথিভুক্ত বর্গাদারদের নথিভুক্ত করতে কোনো বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করল না ‘দিদির সরকার’?’

সরকারী ইতিহাসে কেবল লেখা রইল ‘এই আন্দোলন ‘জীবিকা ও সংস্কৃতি’ অভিমুখে গতিলাভ করল, অনিবার্যভাবে এতে উঠে এল এই রাজ্যের ভূমিসংস্কার, কৃষিতে স্বনির্ভরতা, খাদ্য সুরক্ষা ও সংকটের জরুরি প্রশ্নগুলি’। ভূমিসংস্কারের অসমাপ্ত কাহিনি, চোখে আঙুল দিয়ে সিঙ্গুর তুলে ধরলেও উদ্যোগ গ্রহণ করল না তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার – শ্রেণীস্বার্থেই তার এই অবস্থান।

৪। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে জমি ফেরতের সময় সিঙ্গুরের কৃষিমজুর, মেহনতিরা, জমির মালিক না হয়েও জমির উপর নির্ভরশীল বিশাল সংখ্যক আন্দোলনকারী রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলনে তাদের উপস্থিতির স্বীকৃতি ও অধিকার স্বরূপ ‘বিশেষ প্যাকেজ’ নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। ২০১৪ সাল থেকে কার্যকর নতুন ভূমি অধিগ্রহণ আইন জমির উপর নির্ভরশীলদের অধিকারকে স্বীকারও করেছে। আইনি বাধা ছিল না মুখ্যমন্ত্রীর সামনে, ছিল সদিচ্ছার অভাব। এ কারণেই এদের সংগঠিত করতে সারা ভারত কৃষি ও গ্রামীণ মজুর সমিতি বিশেষ উদ্যোগ নিলে, দাবিপত্রে স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে শুরু করলে সংগঠকদের সিঙ্গুর থানায় তুলে নিয়ে চাপ সৃষ্টি করা হয়। জনসভায় দূর্গাপুর হাইওয়ের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী একবার মাত্র ‘কৃষিমজুররাও প্যাকেজ পাবেন’ কথাটি উচ্চারণ করে তখনকার মতো পরিস্থিতি সামলান এবং পরবর্তীতে বেবাক ভুলে যান।

৫। এই সমস্ত প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলি যাতে জমানা বদলের পর সিঙ্গুরের মাটি থেকে না উঠতে পারে এজন্য বুদ্ধবাবু পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীও সমান তৎপর। এ কারণেই ২০১১ পরবর্তীতে সিঙ্গুরে আসা এক সিপিআই(এমএল) প্রতিনিধি দলকে সিঙ্গুর থানায় তুলে নিয়ে যায় নতুন জমানার পুলিশ। দীর্ঘক্ষণ থানায় আটকে রাখা হয় সিপিআই(এমএল) হুগলী জেলা সম্পাদক প্রবীর হালদার সহ অন্যান্যদের। একই সাথে বর্গাদার কৃষিমজুররা বিশেষ প্যাকেজের দাবিতে স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করলে এই ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরেও থানা তুলে নিয়ে যায় স্থানীয় সংগঠক সনাতন মালিককে, ভয় দেখাতে। এইভাবে নতুন মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গুরের মাটিতে গণতন্ত্র হত্যায় তৎপর, অন্যদিকে আন্দোলনকে কখনও বাঁধতে চেয়েছেন আদালত নির্ভরতায়, কখনও বাঁধতে চেয়েছেন সিঙ্গুর লোকালে, কখনও ২ টাকা দরে চাল, ২ হাজার টাকার ক্ষতিপূরণের নাগপাশে।

সর্বোপরি, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের পর সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক কৃষক’ যারা দীর্ঘ ১০ বছর ক্ষতিপূরণের অর্থ নেননি, তারা চেয়েছিলেন সরকার তাঁদের সুদ সহ জমির দাম ফেরত দিক। নীরব সন্ত্রাসে মমতা ব্যানার্জীরা এই সঙ্গত দাবিকেও পদদলিত করেছেন। আজকের সিঙ্গুরে কান পাতলে শোনা যাবে বিশ্বাসঘাতকতার এই কাহিনিগুলি।

টাটা গোষ্ঠীর প্রতি

সিঙ্গুর ছেড়ে যাওয়ার সময় টাটা গোষ্ঠী তার কর্মীদের ‘নিরাপত্তাহীনতা’র প্রশ্নটিকে সামনে এনেছিল। সিঙ্গুরের কৃষকদের জমি থেকে বিতাড়িত করে কারখানা গড়ার জন্য সিঙ্গুরের মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, মহিলাদের সম্ভ্রম, কৃষিজমি ও বাসস্থানের নিরাপত্তা ২০০৬ থেকে বছরের পর বছর পুলিশ ও শাসকদলের আক্রমণে বারবার পদদলিত হয়েছে, রক্তাক্ত হয়েছেন কয়েকশো মানুষ, আড়াই বছরের পায়েল বাগকে নিয়ে জেলে থেকেছেন সিঙ্গুরের মা, জেলবন্দী হয়েছেন অসংখ্য আন্দোলনকারী, মিথ্যা মামলার শিকার হয়েছেন সিঙ্গুরবাসী; রাজকুমার ভুল ও তাপসী মালিকের মতো কৃষিমজুর-বর্গাদার পরিবারের যুবক-যুবতীদের শহীদ হতে হয়েছে, জীবন-জীবিকার অধিকার না থাকায় আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ৮ জন কৃষক ও মেহনতি মানুষ। এসব ঘটনা যখন ঘটেছিল তখন মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারণ করেনি টাটা গোষ্ঠী। নিরাপত্তা নিয়ে এদের দরদ তখন কোথায় ছিল? স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোয় এ এক অনিবার্য প্রশ্ন।

ভাঙড় পর্ব

আজ ভাঙড়ের কৃষিক্ষেত্রে প্রতারণার নতুন নতুন নজির সৃষ্টি করছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী। তিনি বলছেন, তাঁর সরকার ২০১৪ সালের নতুন জমি অধিগ্রহণ আইন বলবৎ করার বিরুদ্ধে। তিনি বলছেন তাঁর সরকার কোথাও কৃষকের জমি অধিগ্রহণ করবে না। অন্যদিকে তাঁরই দলের আরাবুল পিস্তল দেখিয়ে কৃষকের জমি নামমাত্র মূল্যে ক্রয় করেছে কৃষকদের থেকে। ২০১৩ সালে মমতা ব্যানার্জীর আমলেই ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রিড স্থাপনের নোটিশ পড়েছে। ২০১৪ সালের শুরু থেকেই কার্যকর হয়েছে নতুন আইন। এই আইনকে মান্যতা দিয়ে পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব সংক্রান্ত কোনো জনশুনানি (এসআইএ) হয়নি। আইন মোতাবেক ৭০ শতাংশ মানুষের সম্মতি গ্রহণ বাধ্যতামূলক হলেও মমতা ব্যানার্জীর রাজত্বে ভাঙড়ের মাটিতে মানা হয়নি কোনো নিয়ম। ভাঙড়ে শহীদ হয়েছেন মফিজুল, আলমগীরের মতো তরতাজা কৃষক সন্তানরা। সংগ্রামী কৃষক জনগণ ও নেতৃবৃন্দের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন ইউএপিএ আইন। ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার হয়েছেন ২২ জন আন্দোলনকারী।

একই ঘটনাক্রম হুগলীর গোঘাটের ভাবাদিঘিতে, যেখানে মানুষ দিঘি বাঁচানোর দাবিতে ঐক্যবদ্ধ। রেলের প্রকৃত নকশা অনুসারে দিঘির পাশ দিয়েই যাওয়া কথা রেললাইন। স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের কায়েমী স্বার্থে জোর করে রেলপথ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে দিঘির উপর দিয়ে। এখানেও মিথ্যা মামলায় আন্দোলনকারী নেতৃত্বকে জেলে পোরা হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী এখানে সরাসরি হুমকি দিচ্ছেন, ‘এই রেলপথ আমার স্বপ্নের প্রকল্প। দিঘির উপর দিয়েই রেলপথ যাবে। যাবেই, যাবেই, যাবেই’।

সিঙ্গুরকে কেন্দ্র করে কৃষক দরদী সেজেছেন মমতা ব্যানার্জী। এসত্ত্বেও সিঙ্গুর কিংবা ভাঙড়, ভাবাদিঘি -- কোথাও আড়ালে থাকছে না তার কৃষক-বিরোধী প্রকৃত অবস্থান। পারছেন না কৃষক অভ্যুত্থানকে স্তব্ধ করতে। একদা সিঙ্গুর নিয়ে বুদ্ধবাবুর স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছিল। মাপ পাবেন না নয়া মুখ্যমন্ত্রীও, যতই তিনি স্কুলপাঠ্যে নিজেকে ‘উদ্ভাসিত’ ‘আলোকিত’ করতে চাইবেন, ততই সামনে আসবে প্রকৃত ঘটনাবলী, এটাই সিঙ্গুর আন্দোলনের শিক্ষা।