১৮৮৩ সালের জার্মান সংস্করণের প্রথম ভূমিকা লেখার পর থেকে ইস্তাহার-এর নতুন একটা জার্মান সংস্করণের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ইস্তাহার-এর ক্ষেত্রেও তারপর থেকে অনেক কিছু ঘটেছে যার উল্লেখ প্রয়োজন।

ভেরা জাসুলিচ অনুদিত রুশ ভাষায় দ্বিতীয় সংস্করণ জেনেভা থেকে প্রকাশিত হয় ১৮৮২ সালে; ঐ সংস্করণের ভূমিকা মার্কস ও আমি দুজনে লিখেছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত, মূল জার্মান পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে গেছে; আমাকে তাই রুশ সংস্করণ থেকেই অনুবাদ করতে হবে এবং তা কোনোভাবেই মূল লেখাটির উৎকর্ষসাধন করবে না। সেটা এরকম :

(১৮৮২ সালের রুশ সংস্করণের পুনর্মুদ্রণ)

প্রায় ঐ একই দিনে জেনিভা থেকে পোলিশ ভাষায় একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় : ম্যানিফেস্ট কমিউনিস্তিজনি।

এছাড়াও, ১৮৮৫ সালে কোপেনহাগেন থেকে সোশ্যালডেমোক্র্যাতিস্ক বিবলিওথেক দিনেমার ভাষায় একটি অনুবাদ প্রকাশ করে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, সেটা সম্পূর্ণ নয়; মনে হয়, অনুবাদকের কাছে কঠিন লাগার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে, এবং এরই সাথে কোথাও কোথাও অমনোযোগের চিহ্নও পরিলক্ষিত হয় যেগুলো দৃষ্টিকটুভাবে প্রকট, কেননা ঐ অনুবাদ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, অনুবাদক আর একটু যত্ন নিলে এক উৎকর্ষ কাজ উপহার দিতে পারতেন।

প্যারিস থেকে লা সোশ্যালিস্টে ১৮৮৬ সালে একটি ফরাসি সংস্করণ প্রকাশ করে; এটাই এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত সবচেয়ে ভালো সংস্করণ।

এই ফরাসি সংস্করণ থেকে ঐ একই বছরে মাদ্রিদ থেকে এল সোশ্যালিস্টাতে প্রকাশিত হয় স্পেনীয় ভাষার এক সংস্করণ, এবং পরে তা পুস্তিকা আকারে পুনরায় প্রকাশিত হয়।

কৌতূহলের বিষয় বলে আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই যে, আর্মেনিয়ান ভাষায় প্রকাশের জন্য তার পাণ্ডুলিপি ১৮৮৭ সালে কনস্টান্টিনোপলের এক প্রকাশনাকে দেওয়া হয়। কিন্তু মার্কসের নামে কোনো রচনা প্রকাশের সাহস ঐ ভদ্রলোকের ছিল না। এর পরিবর্তে লেখক হিসাবে অনুবাদকের নাম দেওয়ার প্রস্তাব তিনি করেন, অনুবাদক অবশ্য তা প্রত্যাখ্যান করেন।

প্রথমে একটা, তারপর আর একটা মোটামুটি নির্ভুল আমেরিকান অনুবাদ ইংল্যান্ডে অনেকবারই পুনর্মুদ্রিত হয়, অবশেষে ১৮৮৮ সালে নির্ভরযোগ্য একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এটি করেন আমার বন্ধু স্যামুয়েল মুর, এবং ছাপতে দেওয়ার আগে আমরা দুজনে এটাকে ভালোভাবে দেখে নিই। এর শিরোমান ছিল কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার, কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস রচিত। এটা ছিল ফ্রেডারিক এঙ্গেলস সম্পাদিত ও টীকাযুক্ত লন্ডন থেকে ১৮৮৮ সালে প্রকাশিত নির্ভরযোগ্য ইংরাজি অনুবাদ, যার প্রকাশক ছিলেন উইলিয়াম রিভস, ১৮৫ ফ্লীট স্ট্রীট, ইসি। ঐ সংস্করণে থাকা কিছু টীকা বর্তমান সংস্করণেও আমি রেখেছি।

'ইস্তাহারের' একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে। সংখ্যায় তখন পর্যন্ত বেশি নয়, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের এহেন অগ্রণীদের কাছ থেকে এর প্রকাশকালে জুটেছিল সোৎসাহ অভ্যর্থনা (প্রথম ভূমিকায় উল্লিখিত অনুবাদগুলোই তার প্রমাণ), কিন্তু ১৮৪৮ সালের জুনে প্যারিস শ্রমিকদের পরাজয়ের পর যে প্রতিক্রিয়া আরম্ভ হয়, তার চাপে বাধ্য হয়ে একে আড়ালে চলে যেতে হল; এবং ১৮৫২ সালের নভেম্বরে কলোন কমিউনিস্টদের দণ্ডাজ্ঞার পর শেষপর্যন্ত 'আইন অনুসারে' তাকে বে-আইনি করা হয়। ফেব্রুয়ারী বিপ্লব থেকে যে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল, লোকচক্ষু থেকে তার অপসারণের সঙ্গে সঙ্গে 'ইস্তাহার'ও অন্তরালে যায়।

শাসকশ্রেণীর ক্ষমতার ওপর নতুন আক্রমণের পক্ষে পর্যাপ্ত শক্তি যখন ইউরোপের শ্রমিকশ্রেণী আবার সংগ্রহ করতে পারল তখন আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী মানুষের সমিতির উদয় হয়। তার লক্ষ্য ছিল ইউরোপ ও আমেরিকার গোটা জঙ্গী শ্রমিকশ্রেণীকে একটি বিরাট বাহিনীতে সুসংহত করা। সুতরাং 'ইস্তাহারে' লিপিবদ্ধ নীতি থেকে তা শুরু হতে পারে না। এমন কর্মসূচী তাকে নিতে হয় যা ইংরেজ ট্রেড ইউনিয়ন, ফরাসি, বেলজীয়, ইতালীয় ও স্পেনীয় প্রুুধোঁবাদী এবং জার্মান লাসালপন্থীদের কাছে যেন দরজা বন্ধ না করে। এই কর্মসূচী – আন্তর্জাতিকের নিয়মাবলীর মুখবন্ধ মার্কস রচনা করলেন এমন নিপুণ হাতে যে বাকুনিন ও নৈরাজ্যবাদীরা পর্যন্ত তা স্বীকার করে। 'ইস্তাহারে' বর্ণিত নীতিগুলোর শেষপর্যন্ত বিজয়ী হওয়ার ব্যাপারে মার্কস পুরোপুরি ও একান্তভাবে নির্ভর করেছিলেন শ্রমিকশ্রেণীর বৌদ্ধিক বিকাশের ওপর, মিলিত লড়াই ও আলোচনা থেকে যার উদ্ভব অনিবার্য। পুঁজির সঙ্গে লড়াইয়ের নানা ঘটনা ও বিপর্যয়, সাফল্যের চাইতে পরাজয়ই বেশি করে সংগ্রামীদের কাছে প্রমাণ না করে পারে না যে তাদের আগেকার সর্বরোগহর দাওয়াইগুলো অকেজো, শ্রমিকদের মুক্তির সঠিক শর্তগুলোর সম্যক উপলব্ধির পক্ষে তাদের মনকে তৈরি না করে পারে না। মার্কস ঠিকই বুঝেছিলেন। ১৮৬৪ সালে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠার সময়কার শ্রমিকশ্রেণীর তুলনায় ১৮৭৪ সালে আন্তর্জাতিক উঠে যাওয়ার সময়কার শ্রমিকশ্রেণী সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে ওঠে। ল্যাটিন দেশগুলোতে প্রুধোঁবাদ ও জার্মানির স্বকীয় লাসালপন্থা তখন মরণোন্মুখ; এমনকি চরম রক্ষণশীল ইংরেজ ট্রেড ইউনিয়নগুলো পর্যন্ত ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছিল এমন একটা পর্যায়ে যখন ১৮৮৭ সালে তাদের সোয়ানসি কংগ্রেসের সভাপতি তাদের তরফ থেকে বলতে পারলেন যে : 'ইউরোপীয় ভূখণ্ডে সমাজতন্ত্র আমাদের কাছে আর বিভীষিকা নেই'। অথচ ১৮৮৭ সালের ইউরোপীয় ভূখণ্ডের সমাজতন্ত্র প্রায় পুরোপুরিই 'ইস্তাহারে' ঘোষিত তত্ত্ব মাত্র। সুতরাং কিছুটা পরিমাণে 'ইস্তাহারের' ইতিহাসে ১৮৪৮ সালের পরবর্তী আধুনিক শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের ইতিহাসটাই প্রতিফলিত। বর্তমানে সম্গ্র সমাজতন্ত্রী সাহিত্যের মধ্যে এটি নিঃসন্দেহেই সবচেয়ে বেশি প্রচারিত, সর্বাধিক আন্তর্জাতিক সৃষ্টি, সাইবেরিয়া থেকে কালিফোর্নিয়া পর্যন্ত সকল দেশে লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের সাধারণ কর্মসূচী হয়ে  দাঁড়িয়েছে তা।

তবুও প্রথম প্রকাশের সময় আমরা একে সমাজতন্ত্রী 'ইস্তাহার' বলতে পারতাম না। ১৮৪৭ সালে দুই ধরনের লোককে সমাজতন্ত্রী গণ্য করা হত। একদিকে ছিল বিভিন্ন ইউটোপীয় মতবাদের সমর্থকেরা, বিশেষ করে ইংল্যান্ডে ওয়েনপন্থী ও ফ্রান্সে ফুরিয়ে-পন্থীরা, অবশ্য ততদিনে উভয়েই সংকীর্ণ গোষ্ঠীতে পরিণত হয়ে ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছিল। অন্যদিকে ছিল নানা ধরনের সামাজিক হাতুড়ে যারা সামাজিক অবিচার দূর করতে চাইত নানাবিধ সর্বরোগহর দাওয়াই ও জোড়াতালি প্রয়োগ করে – পুঁজি ও মুনাফার বিন্দুমাত্র ক্ষতি না করে। উভয়ক্ষেত্রেই এরা ছিল শ্রমিক আন্দোলনের বাইরের লোক এবং সমর্থনের জন্য তাকিয়ে ছিল বরং 'শিক্ষিত' সম্প্রদায়ের দিকে। নিতান্ত রাজনৈতিক বিপ্লব যথেষ্ট নয় এ বিষয়ে স্থিরনিশ্চয় হয়ে শ্রমিকশ্রেণীর যে অংশটি সেদিন সমাজের আমূল পুনর্গঠনের দাবি তোলে, তারা সে সময় নিজেদের কমিউনিস্ট বলত। তখন পর্যন্ত এটা ছিল অমার্জিত, নিতান্ত সহজবোধের, প্রায়শই অনেকটা স্থূল সাম্যবাদ মাত্র। তবুও ইউটোপীয় কমিউনিজমের দুটি ধারাকে জন্ম দেওয়ার মতো শক্তি এর ছিল – ফ্রান্সে কাবে-র 'আইকেরীয়' (Icarian) কমিউনিজম এবং জার্মানিতে ভাইতলিং-এর কমিউনিজম। ১৮৪৭ সালে সমাজতন্ত্র বলতে বোঝাত একটা বুর্জোয়া আন্দোলন, কমিউনিজম বোঝাত শ্রমিক আন্দোলন। ইউরোপীয় ভূখণ্ডে অন্তত তখন সমাজতন্ত্র ছিল বেশ সম্মানজনক, আর সাম্যবাদ ছিল ঠিক তার বিপরীত। ততদিন আগেই যেহেতু আমাদের অতি দৃঢ় মত ছিল যে, 'শ্রমিকশ্রেণীর মুক্তি হওয়া চাই শ্রমিকশ্রেণীরই নিজস্ব কাজ', তাই দুই নামের মধ্যে কোনটি বেছে নেব সে সম্বন্ধে আমাদের কোনও দ্বিধা ছিল না। পরেও কখনও নাম বর্জন করার কথা আমাদের মনে আসেনি।

'দুনিয়ার মজুর এক হও'! বিয়াল্লিশ বছর আগে, প্রথম যে প্যারিস বিপ্লবে সর্বহারা তার নিজস্ব দাবি নিয়ে হারিজ হয় ঠিক তারই পূর্বক্ষণে আমরা যখন পৃথিবীর সামনে এই কথা ঘোষণা করেছিলাম, সেদিন অতি অল্প কণ্ঠেই তার প্রতিধ্বনি উঠেছিল। ১৮৬৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর কিন্তু পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ দেশের শ্রমিকরা আন্তর্জাতক শ্রমজীবী মানুষের সমিতিতে হাত মেলায়, এ সমিতির স্মৃতি অতি গৌরবজনক। সত্যকথা, আন্তর্জাতিক বেঁচে ছিল মাত্র নয় বছর। কিন্তু সকল দেশের শ্রমিকদের যে চিরন্তন ঐক্য এতে সৃষ্টি হয়েছিল, সে ঐক্য যে আজও জীবন্ত এবং আগের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী, বর্তমান কালটাই তার সর্বোত্তম সাক্ষ্য। কেননা ঠিক আজকের দিনে এই ভূমিকাটি এঙ্গেলস লেখেন ১৮৯০ সালের ১ মে যখন দ্বিতীয় অান্তর্জাতিকের সিদ্ধান্ত অনুসারে (জুলাই ১৮৮৯) ইউরোপ ও অামেরিকার বিভিন্ন দেশে জনগণের বিক্ষোভ, ধর্মঘট ও জনসভাগুলো সংগঠিত হয়। কংগ্রেসের সূচনা করা ৮ ঘণ্টা শ্রমদিবসের ও অন্যান্য দাবি শ্রমিকরা তুলে ধরেন সেই দিনের পর থেকে সারা দুনিয়ার শ্রমিকরা ১ মে-কে শ্রমিক সংহতি দিবস হিসাবে উদযাপন করে অাসছেন। যখন আমি এই পংক্তিগুলো লিখছি তখন ইউরোপ ও আমেরিকার সর্বহারা তাদের লড়বার শক্তি বিচার করে দেখছে, এই সর্বপ্রথম তারা সংঘবদ্ধ, সংঘবদ্ধ একক বাহিনী রূপে, এক পতাকার নীচে, একটি আশু লক্ষ্য নিয়ে : ১৮৬৬ সালে আন্তর্জাতিকের জেনেভা কংগ্রেসে ও আবার ১৮৮৯ সালে প্যারিস শ্রমিক কংগ্রেসে যা ঘোষিত হয়েছিল সেইভাবে আইন পাশ করে সাধারণ আট ঘণ্টা শ্রমদিবস চালু করতে হবে। আজকের দিনের দৃশ্য সকল দেশের পুঁজিপতি ও জমিদারদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে যে আজ সকল দেশের শ্রমিকরা সত্যই এক হয়েছে।

নিজের চোখে তা দেখবার জন্য মার্কস যদি এখনও আমার পাশে থাকতেন!

ফ্রেডারিক এঙ্গেলস
লন্ডন, ১ মে, ১৮৯০