এই প্রেক্ষাপটে সিঙ্গুর আঐন্দোলন তার স্বরূপ ও শিক্ষাগুলি আর একবার ফিরে দেখা প্রয়োজন।

২০০৬ সালের মে মাসে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় (বিধানসভায় ২৯৪ আসনের মধ্যে ২৩৫ আসনে জয়লাভ) ক্ষমতায় পুনপ্রতিষ্ঠিত বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের উন্নত বাম সরকার ‘নয়া অর্থনৈতিক নীতি’র সুযোগকে কাজে লাগাতে সিঙ্গুরের ১০০০ একর কৃষিজমিতে বহুজাতিক টাটা কোম্পানির ন্যানো মোটর গাড়ি কারখানা নির্মাণ করতে চাইল। শুরুতেই ২২ মে ২০০৬ এই প্রচেষ্টা গণরোষের মুখোমুখি হল। কৃষিজীবী মহিলাদের গণপ্রতিরোধের মুখে ফিরতে হল টাটা গোষ্ঠী ও রাজ্য সরকারের প্রতিনিধিদের। শুরু হল কৃষক আন্দোলন। গড়ে উঠল কৃষিজমি রক্ষা কমিটি, তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে। এই কমিটির বাইরে থেকে আন্দোলনে সক্রিয় ছিল সিপিআই(এমএল) লিবারেশন। ২৫ সেপ্টেম্বর জমি দখলের প্রতিবাদে বিডিও অফিসের সামনে কয়েক হাজার কৃষকের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচী চলছিল কৃষিজমি রক্ষা কমিটির ডাকে। পরদিন ভোর রাতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে অন্ধকারে নেমে এল পুলিশের অত্যাচার। মারা গেলেন ২১ বছরের কৃষিমজুর যুবক রাজকুমার ভুল। আন্দোলন এতে থামল না। সিপিআই(এমএল) ও এসইউসিআই যৌথভাবে ২৯ সেপ্টেম্বর বনধ সফল করল সিঙ্গুরের মাটিতে, অত্যাচারের প্রতিবাদে।

কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ আন্দোলন দেখেও পিছু হটতে রাজি হল না বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বাধীন সরকার। জমি দখলের লক্ষ্যে বাড়তে থাকল প্রশাসনিক তৎপরতা। এপিডিআর সহ কিছু সংগঠনের উদ্যোগে কৃষিজমি রক্ষা কমিটি ও সংহতি কমিটির ব্যানারে ২৭ অক্টোবর গোপালনগর গ্রামে হাজার হাজার কৃষকের উপস্থিতিতে সংগঠিত হল গণশুনানি। মহাশ্বেতা দেবী, দীপঙ্কর চক্রবর্তী, মেধা পাটকর, বিচারপতি মলয় সেনগুপ্তর পরিচালনায় গণশুনানি তার রায়ে সিঙ্গুরের কৃষিজমিতে কারখানা স্থাপন বাতিল করে টাটাদের অন্য জমি দিতে সরকারকে আহ্বান জানায়। চাষের জমি, কৃষক ও গণতন্ত্র বাঁচানোর আবেদন জানায়।

রাজ্য সরকার কোনো প্রতিবাদেই কর্ণপাত করল না। টাটা ও রাজ্য সরকারের এই যৌথ জমি হামলায় সমর্থন জানায় আনন্দবাজার পত্রিকা গোষ্ঠী। এই পরিস্থিতিতে জমি দখল রুখতে বাজেমেলিয়া, গোপালনগর, বেড়াবেড়ি, খাসের ভেড়ি, সিংহের ভেড়ি, দোবাঁধিতে কৃষকরা ক্যাম্প করে জমি পাহারা শুরু করল। বাজেমেলিয়ার বারো হাত কালিতলায় এমনই একটি ক্যাম্প সংগঠিত করে সারা ভারত কৃষিমজুর সমিতি এবং পশ্চিমবঙ্গ কৃষক সমিতি। ২ ডিসেম্বর জমি দখলের লক্ষ্যস্থির করল রাজ্য সরকার। অনেক আগে থেকে জারি করা হল ১৪৪ ধারা। সারা বাংলা থেকে পুলিশ এনে আন্দোলনকারী কৃষকদের ‘আউট নাম্বারড’ করতে চাইল সরকার। মাইক নিয়ে ঘোষণা করল সিঙ্গুরে ‘বহিরাগত’দের প্রবেশ নিষেধ। এসব সত্ত্বেও ১ ডিসেম্বর আগের দিনই সিঙ্গুরে উপস্থিত থাকল সিপিআই(এমএল)-এর কয়েকজন রাজ্য কমিটি সদস্য এবং ছাত্র সংগঠন এআইএসএ-র নেতৃত্ব সহ যাদবপুর ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্র। হাজার হাজার কৃষক জমি দখল রুখতে মাঠে নামলেন। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব কৃষকদের প্রতিরোধ থেকে সরিয়ে আনতে চাইল, পিছু হটার পরামর্শ দিল নেতারা। কিন্তু কৃষকরা এই পরামর্শ না মেনে আন্দোলনে এগিয়ে গেলেন। পুলিশের দ্বারা কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট, ধানের গোলা জ্বালিয়ে দেওয়া, বাড়ি বাড়ি পুলিশী জুলুম, নির্বিচার গ্রেপ্তারি (৪৯ জন গ্রেপ্তার হন) চলল। গ্রেপ্তার হলেন বর্গাদার কন্যা দীপা মিত্র, গণআন্দোলনের কর্মী রাংতা মুন্সী, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য স্তরের কৃষক নেতা তপন বটব্যাল প্রমুখ।

একদিকে গ্রামগুলি জুড়ে ৠাফ ও ব্যাপক পুলিশের উপস্থিতিতে হাজার একর কৃষিজমি ঘিরে চলল টাটার প্রাচীর নির্মাণ অন্যদিকে নির্মীয়মান প্রাচীর ঘিরে চলল কৃষক বিক্ষোভ, অবস্থান কর্মসূচী। আন্দোলনকারীদের প্রধান ভূমিকায় ছিলেন হাজার হাজার মহিলা। মেয়েদের ভয় দেখাতে টাটার প্রাচীরের রাতপাহারাদারদের দিয়ে ১৮ ডিসেম্বর নির্মীয়মান প্রাচীরের মধ্যে ভোররাতে ধর্ষণ করে পুড়িয়ে মারা হল বর্গাদার কন্যা -- আন্দোলনের অন্যতম মুখ তাপসী মালিককে। প্রতিবাদে সিঙ্গুর জুড়ে বিরাট মিছিল সংগঠিত হল ঐদিনই, নেতৃত্ব দেন সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতি ও এসইউসিআই সংগঠকরা। ১৯ ডিসেম্বর তাপসীর বাড়ি গিয়ে সংহতি জানালেন মেধা পাটকর।

কৃষক প্রতিরোধের এই কঠিন দিনগুলিতে প্রয়োজন ছিল সিঙ্গুরের মাটিতেই কৃষকদের জমি পুনর্দখল আন্দোলনকে শক্তিশালী করা। নন্দীগ্রাম সেই পথ দেখিয়েছিল। অন্যদিকে রাজ্য স্তরেও আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া দরকার ছিল। সিঙ্গুরের মাটিতে প্রতিরোধের পাশাপাশি ধর্মতলায় অনশন অবস্থানে বসেন সিপিআই(এমএল)-এর নেতৃবৃন্দ। কিন্তু সিঙ্গুরে মাটিতে না থেকে নিরাপদ দূরত্বে ধর্মতলায় অনশনে বসলেন বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জী। কৃষিজমি রক্ষা কমিটির প্রধান নেতৃত্ব তৃণমূল কংগ্রেসের এই পশ্চাদাপসারনের সুযোগ নিয়ে ৠাফ ও পুলিশ দাঁড় করিয়ে ২১ জানুয়ারী ২০০৭ টাটারা সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা জমিতে কারখানার নির্মাণ কাজ শুরু করল। মমতা ব্যানার্জীরা এ সময়ে সিঙ্গুরের আন্দোলনরত কৃষকদের নীরব দর্শকে পরিণত করতে চাইলেন। প্রধান বিরোধী দলের এই ভূমিকায় উৎসাহিত রাজ্য সরকার রাজ্যের অন্যত্রও শিল্পায়নের নামে কৃষিজমি দখলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। রাজ্য সরকারের টার্গেট এক লক্ষ পঁচিশ হাজার একর জমি। ২০০৬ ডিসেম্বরের মধ্যে নোটিশ জারি হয়ে গেল ৪০,০০০ একরের। নন্দীগ্রাম, হরিপুর, বারুইপুর, বারাসাত – সামনে আসতে লাগল নতুন নতুন নাম। হরিপুর সোচ্চার হল পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। ৭ জানুয়ারী ২০০৭, ভরত মণ্ডল সহ ৩ জনকে হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ফেটে পড়ল নন্দীগ্রাম। ১৪ মার্চ নন্দীগ্রাম গণহত্যার ঘটনায় চমকে উঠল গোটা দেশ। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী ‘হাড় হিম করা সন্ত্রাস’-এর নিন্দায় মুখর হলেন। কলকাতায় সংগঠিত হল ঐতিহাসিক মহামিছিল।

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম-লালগড়ের কৃষক আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করলেন মমতা ব্যানার্জী। চমকের রাজনীতিতে অভ্যস্ত মমতা ব্যানার্জী ক্ষমতায় বসেই ২০১১ সালের জুনে বিধানসভায় পাশ করালেন সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন বিষয়ে বিল। যথাযথ দায়বদ্ধতার অভাবে আইনি অসঙ্গতিতে ভরা থাকল বিলটি। পরিণতিতে টাটাদের দায়ের করা মামলায় কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ খারিজ করল বিলটিকে। কৃষকরা সুপ্রীমকোর্টে জমি ফেরতের দাবিতে মামলা করলেন। মামলা পিছতে থাকল বছরের পর বছর। রাজ্যে সরকার বদল করেও জমি ফেরত না পেয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলেন কৃষকরা। মমতা ব্যানার্জী সিঙ্গুর যাওয়া বন্ধ করলেন। বললেন ‘কিছু করার নেই, জমি ফেরতে ৫০ বছরও লাগতে পারে’। মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে দ্রুত মোহভঙ্গের পথে এগোতে থাকলেন কৃষক জনগণ। এমন সময়ই ৩১ আগস্ট ২০১৬ সুপ্রীম কোর্ট রায় প্রকাশ করল। জয় হল কৃষকদের।