(জানুয়ারি ১৯৮৮, চতুর্থ পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

এখানে আমরা পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনের কথা বিশেষভাবে মাথায় রেখে সিপিআই(এম)-এর রাজ্যে রাজ্যে সরকার গঠনের কৌশল ও তার নির্দিষ্ট প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করবো।

এই ধরনের সরকার গঠন সম্পর্কে সিপিআই(এম)-এর কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে : (১) গণআন্দোলনের মধ্য থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পার্টির নেতৃত্বে বিভিন্ন রাজ্যে সরকার গঠন করা যেতে পারে। এই কৌশল হল সংগ্রামের এক উত্তরণশীল রূপ। (২) এই ধরনের সরকারগুলি জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার উদ্দেশ্যে কতকগুলি সংস্কারমূলক ব্যবস্থা হাতে নেবে। এই কৌশল জনগণকে এক সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রামে জেগে উঠতে সাহায্য করবে। (৩) এই ধরনের সরকার চালানোর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জনগণ বুর্জোয়া-জমিদার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে শিক্ষিত হয়ে উঠবেন।

এই কর্মসূচি যখন সূত্রবদ্ধ করা হয় তখন পার্টি এই ধরনের সরকারগুলির স্থায়িত্বের সম্ভাবনা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত ছিল না। কর্মসূচিতে তাই কিছু কিছু কল্যাণমূলক ব্যবস্থারই কেবল উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্য দিয়ে জনগণের এক সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠার কথা। কেন্দ্রে এই ধরনের একটি সরকার গঠনের প্রশ্নকে খারিজ করে দেওয়া হয়েছিল আর সিপিআই-এর সঙ্গে বড় পার্থক্যটা ছিল ঠিক এখানেই। কারণ সিপিআই-এর কাছে বিপ্লবের পথ ছিল সম্পূর্ণভাবেই সংসদীয় পথ, যার মূল বিষয়টি হল কংগ্রেসের মধ্যেকার প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কেন্দ্রে একটি সরকার গঠন।

১৯৭৭-এর পরে অবশ্য সিপিআই(এম) এক স্ববিরোধী পরিস্থিতির মধ্যে পড়ল। সে যে পশ্চিমবাংলা, কেরল ও ত্রিপুরা এই তিনটি রাজ্যে সরকার গঠন করতে সফল হল শুধু তাই নয়, ১৯৬৭-৬৯ পর্যায়ের বিপরীতে এই দফায় উপর্যুপরি তৃতীয়বার নির্বাচনে বেশ ভালোভাবে জয়লাভ করে পশ্চিমবাংলার সরকার সমগ্র এক দশক ধরে টিকে রইল। আর যদি অস্বাভাবিক কিছু না ঘটে তাহলে ত্রিপুরা সরকারও পরপর তিনবার বিজয় অর্জন করার জন্য তৈরি হয়েই রয়েছে। এছাড়া পাঁচ বছরের ব্যবধানে কেরলে আবার ফিরে এসেছে বাম ও গণতান্ত্রিক সরকার। ১৯৭৭-এর পর থেকে, কেন্দ্রীয় সরকার অথবা বলা যায় শাসকশ্রেণীগুলির দিক থেকেও এই সব সরকার উৎখাত করার জন্য কোনো সংবিধান-বহির্ভূত পদক্ষেপ দেখতে পাওয়া যায়নি, সংসদীয় খেলার নিয়ম কানুনই বরং মোটামুটি মেনে চলা হচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই নিরবচ্ছিন্ন শাসন ‘উত্তরণশীল সরকারের’ উপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। কিছু কিছু কল্যাণমূলক ব্যবস্থা চালু করা এবং জনগণকে বুর্জোয়া-জমিদার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে শিক্ষিত করে তোলাটাই যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হয়নি। পার্টি তাই কেন্দ্রের কাছ থেকে আরও বেশি অর্থ ও ক্ষমতা এবং কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের দাবির উপরই সবচেয়ে জোর দিয়েছে। বিগত দশ বছর যাবৎ এটাই হয়ে রয়েছে পার্টির কেন্দ্রীয় স্লোগান তথা রাজনৈতিক চরিত্র নির্বিশেষে সমস্ত রাজ্য সরকারগুলির একটি যুক্তমোর্চা রচনা করার জন্য মূল রণনীতি (প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, শ্রী জ্যোতি বসু প্রায়শই বহু কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেও ঐক্যবদ্ধ হন)। জনগণকে যে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তা হল কেন্দ্র বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার বিরুদ্ধেই বৈষম্য করে এবং আরও বেশি অর্থ ও ক্ষমতা থাকলে রাজ্য সরকার জনগণের জন্য সত্যি সত্যিই আরও অনেক বেশি কিছু করতে পারে। এই প্রচার প্রায়শই এই জাত্যাভিমানী প্রচারের কাছাকাছি পৌঁছে যায় যে বাংলা ও বাঙালিরা তাদের ন্যায্য প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলার স্বার্থরক্ষার জন্য তাই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে লড়াই চালাতে এমনকি পশ্চিমবাংলার কংগ্রেস(ই) সংসদ সদস্য ও বিধায়কদেরও সহযোগিতা চাওয়া হয়, যার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে অশোক সেন-এর সঙ্গে সাম্প্রতিক আঁতাত।

তার উপরে বাংলার ‘শিল্পায়নের’ দায়িত্বও পড়েছে সরকারের কাঁধে। এর জন্য, ধর্মঘট ও জঙ্গী শ্রমিক আন্দোলনকে নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি সরকারকে দেশীয় একচেটিয়া ঘরানা ও বহুজাতিক সংস্থাগুলির সহযোগিতা চাইতে হয়েছে। শিল্পের ক্ষেত্রে পশ্চিমবাংলা  গুরুতর সংকটে ভুগছে বলে এই ‘দায়িত্বের’ বোঝা আরও ভারী হয়ে উঠেছে। শিল্পে রুগ্নতার ঘটনা রাজ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত এমন কোনো রাস্তা নেই যাতে বর্তমান অবস্থায় শ্রমিকশ্রেণী নিজের কাঁধে শিল্পায়নের দায়িত্ব তুলে নিতে পারে। কেবলমাত্র একচেটিয়া ও বহুজাতিক সংস্থাগুলির পক্ষেই এখন এই কাজ করা সম্ভব। বিষয়টাই তাই আজ শিল্পে শান্তি বজায় রাখার আহ্বানে এসে ঠেকেছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই আহ্বান পশ্চিমবাংলায় সিটুর চরিত্রকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। শ্রমিকদের দ্বারা সিটুর এই নির্দেশ অমান্য করার ঘটনা প্রায়শই রাজ্য সরকারের দমনের সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘকাল এই নীতি অনুসরণ করে চলার ফল হিসাবে দেখা যাচ্ছে শ্রমিকশ্রেণীর থেকে পার্টির ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা, যার প্রকাশ ঘটেছে পর পর কয়েকটি নির্বাচনী ফলাফলের মধ্যে। পার্টি অবশ্য ইন্দিরা হত্যার পরবর্তী অস্বাভাবিক হাওয়ার অজুহাত দিয়ে ১৯৮৪-র লোকসভা নির্বাচনে প্রায় সমস্ত বড় বড় ট্রেড ইউনিয়ন নেতার পরাজয়ের সাফাই গাইতে চেয়েছে। আর ১৯৮৭-র বিধানসভা নির্বাচনে বেশ কয়েকটি শ্রমিক কেন্দ্রে পরাজয়ের কারণ হিসাবে অবাঙালি শ্রমিকদের মধ্যে বিরাজমান তথাকথিত জাতপাতভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক এবং হিন্দি জাত্যাভিমানী মনোভাবকে দায়ী করা হয়েছে। নিজস্ব অস্তিত্বের বস্তুগত শর্তের চাপে, বামফ্রন্ট সরকার আরও বেশি বেশি করে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ম্যানেজারের মতো আচরণ করছে; অথবা আরও ভালোভাবে বলতে গেলে সে নিজের কাঁধে সংকট সামাল দেওয়ার দায়িত্ব তুলে নিয়েছে।

প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিচালনা করা, শ্রমিক ও কৃষকদের কিছু কিছু অংশের প্রতিক্রিয়া সামাল দেওয়া এবং জুনিয়র ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, জাতীয় সংখ্যালঘু ইত্যাদির মতো সমাজের নানা বিক্ষুব্ধ অংশের আন্দোলনের মোকাবিলা করার দায়িত্ব সরকারের কাঁধে এসে পড়েছে। এই দায়িত্ব পুলিশ প্রশাসনকে মজবুত করা এবং পুলিশ অফিসার ও তাদের দমনমূলক মনোভাবকে সমর্থন করার অপ্রীতিকর রাস্তায় সরকারকে যেতে বাধ্য করেছে। গণআন্দোলন মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে তার দৃষ্টিভঙ্গিও একান্ত গতানুগতিক। গোর্খা আন্দোলন দমন করার জন্য কেন্দ্রের কাছ থেকে সে আরও বেশি বেশি সিআরপিএফ চেয়ে পাঠিয়েছে এবং যে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী আইন পশ্চিমবাংলায় প্রয়োগ করবে না বলে অঙ্গীকার করেছিল, তাও কাজে লাগিয়েছে।

গ্রামাঞ্চলে অবশ্য সিপিআই(এম) এখনও বিপুল গণ সমর্থন ভোগ করে এবং সে তার নিজের সামাজিক ভিত্তিকে বাড়িয়ে নিতেও সফল হয়েছে। অপারেশন বর্গা, পঞ্চায়েত এবং বিভিন্ন ত্রাণ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সে কিছু কিছু কৃষিসংক্রান্ত সংস্কার ঘটিয়েছে এবং ছোটো ছোটো জোতগুলির প্রতি সরকারি সহায়তার মাধ্যমেও কৃষি-উন্নয়ন সংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক কাঠামোয় এই ব্যাবস্থাগুলির একটিই মাত্র ফল হতে পারত এবং হয়েও ছিল তাই, অর্থাৎ পুঁজিবাদী কৃষির বিকাশে উৎসাহ দান।

আর একজন সিপিআই(এম) তাত্ত্বিক অবশ্য ১৯৮৭-র শারদীয়া দেশহিতৈষী-তে রাজ্যের গ্রামীণ চিত্রের ব্যাপারে অনেকটা বাস্তবসম্মত মূল্যায়ন রেখেছেন। তাঁর মতে –

১। গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক বৈষম্য ও আয়ের তারতম্য কমানো যায়নি।

২। প্রতিটি এলাকায় এমন সব ঘটনা দেখতে পাওয়া যাবে যেখানে বর্গাদার জমির মালিককে স্বেচ্ছায় জমি ছেড়ে দিয়েছে এবং যে সব গরিব কৃষকরা পাট্টা পয়েছেন তাঁরা মধ্য কিংবা ধনী কৃষককে বার্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে জমি লিজ দিয়ে দিয়েছেন।

৩। কৃষকদের জমি হারিয়ে ভূমিহীনদের দলে যোগ দেওয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করা যায়নি, বরং সেটা এক জটিল রূপ নিয়েছে।

৪। মজুর ভাড়া করার প্রবণতা বেড়ে গেছে। কৃষিশ্রমিকদের সংখ্যা অনেকখানি বেড়ে গেছে। নিয়মিতভাবে রেল স্টেশনগুলিতে ও গ্রামীণ বাজারে জড়ো হয়ে তারা নিজেদের শ্রমক্ষমতা বিক্রির চেষ্টা করছেন – এটা এক পরিচিত দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই সবই আসলে পুঁজিবাদী অর্থনীতি গড়ে ওঠা এবং আধুনিক জোতদার, ধনী কৃষক ও পুঁজিবাদী ক্ষেতকারীদের আয় বৃদ্ধি পাওয়া তথা তাদের আরও সংহত হয়ে ওঠার লক্ষণ ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের নিজস্ব অধ্যয়ন প্রমাণ করেছে যে পুরোনো ধরনের জমিদারতন্ত্র এবং অংশত বাঁধা মজুর রাখার ব্যবস্থাটি গুরুতরভাবে ধাক্কা খাওয়ার পাশাপাশি পুঁজিবাদী অর্থনীতি কিছুটা চাঙ্গা হয়েছে। সমবায় সংস্থার ঋণ এবং অন্যান্য ঋণ বা কৃষি উপকরণের সিংহভাগই পুঁজিবাদী ক্ষেতকারীরা দখল করে নিচ্ছেন। সিপিআই(এম)-এর নির্দিষ্ট কৃষি কর্মসূচি একটা ভারসাম্য রক্ষা করার প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থাৎ একদিকে ধনী কৃষক অর্থনীতির বিকাশে সহায়তা করা এবং অন্যদিকে কিছুদিন অন্তর কৃষিশ্রমিকদের মজুরি কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া। মধ্য কৃষক অর্থনীতি স্থিতাবস্থার মুখে পড়েছে। মোটের উপরে সিপিআই(এম) সর্বভারতীয় স্তরে ধনী কৃষক সহ সমস্ত কৃষকদের ঐক্য ও লাভজনক দামের দাবির উপরে ইদানিং অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি রয়েছে অন্য জায়গায়। এত বছর ধরে এই সব সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকছে কিসের জোরে? আর শাসকশ্রেণীগুলিই বা কেন নির্বাচনী বিধিনিয়ম মেনে চলছে এবং এই সব সরকারকে “জনগণের সচেতনতা ও সংগঠনের মান উন্নত করতে বা বুর্জোয়া জমিদার রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে তাঁদের শিক্ষিত করে তুলতে দিচ্ছে”? সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দের চটজলদি জবাব হল : বাংলার জনগণের লড়াকু সচেতনতাই সেটা হতে দিচ্ছে না। তাঁরা কখনই ঘটনার অন্য দিকটি অর্থাৎ এই সমস্ত সরকারগুলিকে কাজকর্ম চালাতে দেওয়ার ব্যাপারে শাসকশ্রেণীর নতুন ও উন্নত কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন না।

নিঃসন্দেহে পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট গণভিত্তি ভোগ করে এবং কংগ্রেস(ই) এখনও পর্যন্ত একটি অপদার্থ ও অসংগঠিত শক্তিই হয়ে রয়েছে (যদিও এটা মনে রাখতে হবে যে কংগ্রেস(ই) এখনও নির্বাচনে একাই প্রায় ৪০ শতাংশেরও বেশি ভোট পায় এবং শুধুমাত্র ৫ শতাংশ ভোট এদিক ওদিক হলেই পাল্লাটা তাদের অনুকূলে ঝুঁকে পড়বে)। শাসকশ্রেণীগুলি যে এই সরকারকে চালিয়ে যেতে দিচ্ছে তার পিছনে এটিও এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ। বস্তুত বামফ্রন্টের গণভিত্তি আছে বলেই শিল্পে শান্তি সুনিশ্চিত করার জন্য তাকে বেছে নেওয়াটা হল বেশি বুদ্ধিমানের কাজ। শাসকশ্রেণীগুলির আধিপত্যের ক্ষেত্রে এই বামফ্রন্ট এক বিপদ হিসাবে দেখা দিতে পারে কি? এই প্রশ্নে এইটুকু বলাটাই যথেষ্ট যে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য কিছু কল্যাণমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার একান্ত সাধারণ কর্মসূচি আসলে ভারতবর্ষের প্রায় সবকটি সরকারেরই কর্মসূচি। এধরনের কর্মসূচি কার্যকরী করার হারটিই কেবল বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম হয়। এর বাইরে যে জিনিসটা সিপিআই(এম) প্রচার করে বেড়ায় সেটা হল বুর্জোয়া-জমিদার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে জনগণকে শিক্ষিত করে তোলা। শাসকশ্রেণীগুলি এই সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে শিক্ষিত করে তোলা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। কিন্তু বাস্তবে এই ধরনের সরকারগুলির দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকাটা আসলে জনগণকে সংসদীয় গণতন্ত্রের সীমাহীন সম্ভাবনা সম্বন্ধেই বেশি শিক্ষিত করে তোলে। রাষ্ট্রব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে শিক্ষা ধীরে ধীরে প্রথমে রাজ্য সরকারগুলির সীমিত ক্ষমতার বিষয়ে এবং তারপর সীমিত অর্থভাণ্ডার সংগ্রান্ত শিক্ষায় রূপান্তরিত হয়েছে।

বর্তমান পর্যায়ে শাসকশ্রেণীগুলির রণনীতি এইসব সরকারগুলিকে ফেলে দেওয়ার জন্য চক্রান্ত করা নয় – যেমনটি সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ জনগণকে অনবরত বিশ্বাস করাতে চান। বরঞ্চ রণনীতিটা হচ্ছে তাদের উপর লাগাতার চাপ সৃষ্টি করা যাতে তারা একটা দায়িত্বশীল সরকার হয়ে উঠতে পারে। আর এই প্রশ্নে সমস্ত বুর্জোয় প্রচারের মূল বিষয়বস্তু ঠিক এটাই। অভিজ্ঞতা থেকে তারা শিখেছে যে সিপিআই(এম)-এর উপর এই চাপ দিলে কাজ হবে। নিজস্ব কাঠামোর মধ্যে একটা বাম সরকারকে ধীরে ধীরে একাত্ম করে নেওয়ার মতো চমৎকার নমনীয়তা বুর্জোয়া-জমিদার ব্যবস্থার অবশ্যই রয়েছে এবং বামফ্রন্ট সরকারের ক্ষেত্রে ঠিক এটাই ঘটছে। এই জরুরি প্রশ্নটিই কিন্তু সিপিআই(এম) কখনও তোলে না।

দায়িত্বশীল রাজ্য সরকার চালানো থেকে কর্মসূচির পরবর্তী যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপে চলে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না অর্থাৎ কেন্দ্রে সরকার গঠন করা, যেখানে সমস্ত ক্ষমতা নিহিত রয়েছে। তিনটি রাজ্য সরকার হাতে থাকায় এবং রাজীব সরকারের সংকট তীব্র হতে থাকায় পার্টির কাছে পরবর্তী পর্যায়ের তাত্ত্বিক কসরৎ দেখানোর মতো অবস্থা পেকে উঠেছিল। পশ্চিমবাংলার পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রধান নায়ক এবং নতুন লাইনের প্রধান স্থপতি জ্যোতি বসুর ভাষায় : “কেন্দ্রীয় কমিটি যে শুধু রাজীব সরকারের পদত্যাগ ও নতুন করে নির্বাচন করার দাবি রেখেছে তাই নয়, সে এক বিকল্প সরকার গঠন করার কথাও বলেছে। কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তে এই ধরনের একটা সরকারের চরিত্র কেমন হবে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে”।

এরপরে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন : “কেন্দ্রীয় কমিটির মত হল এই যে আমাদের দেশের জনগণ এমন একটা সরকার চান যার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে, যে সরকার সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলা করতে দৃঢ়সংকল্প এবং কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে, গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করতে ও সমস্ত ধরনের দুর্নীতি নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর; যে সরকার যথাযথ কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক, জোট নিরপেক্ষতা ও বিশ্বশান্তি রক্ষার পক্ষে দাঁড়ায়; যে সরকার জাতীয় ঐক্য রক্ষা করবে ও দেশের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টিকারী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির বিরোধিতা করবে; যে সরকার লাভজনক দাম এবং বেকার ও প্রয়োজনের থেকে কম মজুরি পান এমন লোকজনদের আশু ত্রাণের ব্যবস্থা করবে”।

এর পরেই জ্যাতি বসু ঘোষণা করেছেন, “আমাদের পার্টি এই ধরনের সরকার গঠনের জন্য সবরকম সাহায্য দেবে”।

জ্যোতি বসুর মতে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির এই ঐক্য বা “ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্টের” এই সরকার “জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট”ও নয় কিংবা “বাম ও গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট”ও নয়। এরপরে তিনি পার্টি সভ্যদের আশ্বস্ত করে বলেছেন যে “আমরা আমাদের মূল লক্ষ্য (জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করা) থেকে বিচ্যুত হইনি এবং কখনও তা হবোও না”।

এই ঘটনাটা এড়িয়ে যাওয়ার অবশ্য কোনো উপায় নেই যে এই “ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্ট” হল সিপিআই(এম)-এর কৌশলের ক্ষেত্রে একটা নতুন সংযোজন। আর যেভাবে তারা ভি পি সিং-এর সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে এবং কংগ্রেসের এমপি-দের ও কংগ্রেসের মধ্যকার “নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠের” কাছে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শের জন্য জেগে উঠে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য লাগাতার আবেদন রেখে যাচ্ছে তাতে এই “ধর্মনিপেক্ষ সরকারের” সমগ্র মর্মবস্তুটি বেশ স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে। সংসদীয় পথ ধরে কংগ্রেসের প্রগতিশীল (ধর্মনিরপেক্ষ পড়ুন) অংশের সাথে হাত মিলিয়ে কেন্দ্রে কোয়ালিশন সরকার গঠনের যে অবস্থান সিপিআই-এর রয়েছে, সিপিআই(এম)ও যে তার খুব কাছাকাছি চলে আসছে সেটাই এর থেকে বেরিয়ে আসছে। আর এভাবেই বৃত্তটি সম্পূর্ণ হল।