(পার্টি স্কুলের জন্য প্রস্তুত একটি সহজবোধ্য রচনা। লিবারেশন, জুন ১৯৯০ থেকে)
বিগত ৭-৮ বছর ধরে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পার্টিতে অধ্যয়নের অভ্যাস গড়ে তোলা ও পার্টি স্কুল ব্যবস্থাগুলিকে পার্টি কাঠামোর এক অখণ্ড অংশে পরিণত করার প্রচেষ্টাগুলি চালিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় পার্টি স্কুলগুলিতে বাছাই করা ক্যাডারদের নথিভুক্ত করা হয়েছে, তেমনি রাজ্য ও অন্যান্য পার্টি কমিটিগুলি নিজ নিজ স্তরে পার্টি স্কুল পরিচালনা করেছে। আশা করা হয়েছিল যে, এই সমস্ত কর্মপদ্ধতিগুলি সমগ্র পার্টির জ্ঞান ও বোঝাপড়ার স্তরকেই শুধু উন্নত করবে এমন নয়, সাথে সাথে অধ্যয়নকেও এক নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করবে। এই লক্ষ্য আমরা কতটা অর্জন করেছি? প্রত্যেকেই বোধহয় স্বীকার করবেন যে সাফল্যের হার আশাব্যঞ্জক নয়। সামান্য কয়েকজন কমরেডই তাঁদের ঝোঁক থেকে অধ্যয়ন চালিয়ে গেছেন আর বাকিরা তাদের পুরোনো জায়গাতেই ফিরে গেছেন।
মার্সবাদের কিছু মৌলিক বিষয়, অ আ ক খ আছে এবং যদি আপনারা তা না জানেন তবে আপনাকে অশিক্ষিত মার্কসবাদীর বর্গে ফেলে দেওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। আমি মনে করি আমাদের পার্টিতে এই ধরনের মানুষের সংখ্যা যথেষ্টই বেশি। যাদের শিক্ষিতের দলে ফেলা যায়, তাঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই আবার প্রাথমিক স্তর অতিক্রম করতে পারেননি। আমাদের অভিজ্ঞ নেতা ও ক্যাডারদের সংখ্যাগরিষ্ঠই মার্কসবাদী মহাবিদ্যালয়ে প্রবেশ করতে পেরেছেন বলে দাবি করতে পারেন না।
এটি অত্যন্ত দুঃখজনক এক অবস্থা এবং তা দেখিয়ে দিচ্ছে যে, আমাদের এক ভালো সংখ্যক কমরেডই হয় অন্ধের মতো নতুবা নিজের মর্জিতে কাজ করে চলেছেন। আপনি যদি অন্ধভাবে কাজ করেন অর্থাৎ নিষ্ঠার সাথে স্লোগানগুলি আউড়ে যান ও উপর থেকে আসা নির্দেশগুলি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন, তাহলে আপনি নির্দেশগুলির প্রাণশক্তি ধরতে ভুল করতে পারেন ও কখনই সৃজনশীল অনুশীলন করতে পারেন না। আর যদি নিজের মর্জি অনুযায়ী কাজ করেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই আপনি পার্টির চিন্তা, পরিকল্পনা ও লাইনের বিরুদ্ধে কাজ করবেন। উভয় অবস্থাই পার্টি ও জনগণের স্বার্থের পক্ষে সমানভাবে ক্ষতিকর।
আমি কিছু মানুষকে দেখতে পাই যারা বেশ সুখী এই ভেবে যে তাঁদের প্রধান কর্মক্ষেত্র হচ্ছে ফ্রন্ট সংগঠন, এবং মার্কসবাদ অধ্যয়নের তাঁদের কোনো প্রয়োজন নেই। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমার মনে হয় না ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ ও ক্যাডাররা বর্তমানে মার্কসবাদ অধ্যয়নে কোনো নজর দেন। এমনকি অনেকের মান বেশ নেমে গেছে। সাম্প্রতিককালে নেতৃবৃন্দ ও ক্যাডারদের একটা অংশের মধ্যে অবিপ্লবী অনুশীলনের প্রবণতা গড়ে ওঠার এটি অন্যতম এক কারণ। এই কমরেডরা বুঝতে পারেন না যে, এই ফ্রন্টের সমগ্র চিন্তা, কর্মসূচি ও কৌশলগুলি অন্যকিছু নয় মার্কসবাদ থেকেই গড়ে উঠেছে ও আমাদের নির্দিষ্ট অবস্থায় নির্দিষ্ট প্রয়োগ থেকেই তা নির্ধারিত হচ্ছে। তার উদ্দেশ্যের সফলতার জন্য সর্বাপেক্ষা অগ্রণী ও বিপ্লবী শ্রেণীকে সমগ্র সমাজের নেতা হিসাবে এগিয়ে আসতে হবে। বুর্জোয়াদের সাথে কমিউনিস্টদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে এবং পরিশেষে সমাজের স্বাভাবিক নেতার আকাঙ্খিত অবস্থান থেকে বুর্জোয়াদের অপসারিত করতে হবে। যে কোনো নির্দিষ্ট সন্ধিক্ষণে যুক্তফ্রন্ট যে রূপই গ্রহণ করুক না কেন, তা হচ্ছে সংক্ষেপে একটি কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যম। সুতরাং যুক্তফ্রন্টের নীতি ও কৌশলগুলি অর্থাৎ সর্বাপেক্ষা অগ্রণী শ্রেণীর লক্ষ্য ও স্লোগানগুলিকে জনগণের সমস্ত শ্রেণীর লক্ষ্য ও শ্লোগানে রূপায়নের দক্ষতা হচ্ছে মার্কসীয় তত্ত্ব ও অনুশীলনের সব থেকে চূড়ান্ত দিক। কমিউনিস্টরা হচ্ছে যুক্তফ্রন্টের নিউক্লিয়াস ও মেরুদণ্ড শক্তি, যদি তাঁরা অশিক্ষিত মার্কসবাদী থেকে যান তাহলে এই দক্ষতা তাঁরা অর্জন করতে পারেন না।
এক ব্যাপক সংখ্যক নতুন শক্তি ফ্রন্ট ও পার্টিতে যুক্ত হচ্ছেন। মার্কসীয় অর্থে তাঁরা শুধু অশিক্ষিতই নন, এমনকি সিপিআই, সিপিআই(এম) ইত্যাদি থেকে আসা অনেকেই নেতিবাচক শিক্ষা পেয়েছেন।
অন্য একদিন, আমার সাথে একজন কমরেডের দেখা হল যিনি দুই ব্যাগ বই ও তল্পিতল্পা নিয়ে পার্টি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন, অবশ্য তাঁর ভাষায় অধ্যয়নের জন্য পার্টি থেকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ছুটি নিচ্ছেন। একজন তরুণ, সম্ভাবনাময় ও ভালো ব্যবহারিক কর্মী এই কমরেড পার্টিতে অধ্যয়নের কোনো উপযুক্ত পরিবেশ নেই ভেবে বীতশ্রদ্ধ। তিনি এও মনে করেন, পার্টি অন্ধ অনুশীলনকে উৎসাহিত করে, একগুচ্ছ জটিল প্রশ্নের তাত্ত্বিক সমাধান না হওয়ার ফলে বর্তমানের সাফল্যগুলি মিথ্যা বলেই প্রমাণিত হবে এবং শেষ পর্যন্ত এক শক্ত দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাবে। আমি ঐ কমরেডকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম ও তাঁকে পার্টিতে থাকবার জন্য বললাম। কমরেড একজন বুদ্ধিমান মানুষ, ফলে অন্যান্য লোকেরা কী কী যুক্তি হাজির করতে পারে অনুমান করে নিজস্ব বিপরীত যুক্তিজাল ইতিমধ্যেই প্রস্তুত করে ফেলেছেন। এজন্য তাঁকে বোঝাতে আমি ব্যর্থ হলাম। তাছাড়া পার্টি ছেড়ে দেওয়ার জন্য যাঁরা মনস্থির করে ফেলেন তাঁদের বুঝিয়ে নিবৃত্ত করার ক্ষেত্রে আমার সাফল্যের হার সত্যিই দুর্বল। যাই হোক, সে অন্য কথা।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এই কমরেডের মূল অবস্থান ছিল ভুল। তাঁর আকাঙ্খা ছিল একজন পণ্ডিত হিসাবে গড়ে ওঠার, একজন পার্টি তাত্ত্বিক হিসাবে নয়। আমি অবশ্য পণ্ডিতদের ভূমিকাকে কোনোভাবেই ছোটো করে দেখছি না। সত্যি বলতে কী, তাঁরা যে সমস্ত প্রয়োজনীয় গবেষণামূলক কাজ করেন, তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন চিন্তার যে সংঘাত ঘটে, যা এই বিদ্বৎ সমাজেই প্রথম নির্দিষ্ট রূপ গ্রহণ করে, সেগুলি ছাড়া বস্তুত বিপ্লবী তত্ত্ব গড়ে তোলা অসম্ভব। তথাপি বলব বিদ্বৎজনদের নিজস্ব সীমাবদ্ধতা আছে, তাঁদের সিদ্ধান্তগুলিতে স্বচ্ছতা ও অভিঘাতের অভাব থাকে এবং কখনও কখনও তা বিভ্রান্তিজনক ও ভুল। তাই সর্বাহারার নিজস্ব বিপ্লবী তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক নেতাদেরই কার্যধারাকে সূত্রবদ্ধ করতে হয়। বুর্জোয়ারা তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক কর্মীদের বিভাজনকে স্বীকার করতে পারে, কিন্তু সর্বহারার নেতারা হচ্ছেন মার্কস, লেনিন, মাও ইত্যাদি ইত্যাদি যাঁরা একাধারে দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক নেতার সমন্বয়।
আমাদের পার্টি ইতিহাসে কিছু ব্যক্তি ও গ্রুপকে আমরা লক্ষ্য করেছি যাঁরা তত্ত্ব ও অনুশীলনের মধ্যে যান্ত্রিক বিভাজন করেন। তাঁদের মতে, প্রথমে একটি দীর্ঘ সময় থাকবে অধ্যয়নের জন্য। যার ভেতর দিয়ে ‘সঠিক’ রাজনৈতিক লাইন তৈরি হবে এবং তার পর শুরু হবে ‘সঠিক’ অনুশীলন পর্ব। বস্তুত ইতিহাস প্রমাণ করেছে, এই সমস্ত ব্যক্তিবর্গ বছরের পর বছর অধ্যয়নের পরও কোনো জায়গায় পৌঁছতে পারেননি, বরং তাঁরা যেখান থেকে শুরু করেছিলেন তার থেকেও বেশি বিভ্রান্তির মধ্যে শেষ হয়েছেন। বিপ্লবী তত্ত্ব তাঁরাই সামনে হাজির করতে পারেন যাঁরা অনুশীলনের উত্তপ্ত আবহাওয়ায় থাকেন এবং ভুল ও ব্যর্থতা থেকে যাঁরা শিক্ষা নেন। তার অর্থ কি এই, ঐ কমরেড যা বলেছেন তার সবকিছুই ভুল ও কেবলমাত্র নিন্দার যোগ্য। আমি তা মনে করি না। আমার মতে, ঐ কমরেড সম্পূর্ণ সঠিক যখন তিনি বলেন একগুচ্ছ জটিল প্রশ্নের তাত্ত্বিক সমাধান অত্যন্ত জরুরি এবং ঐ প্রশ্নগুলি দ্রুততার সাথে সমাধানের জন্য হাতে না নিলে শেষ পর্যন্ত একটি শক্ত দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আমরা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে যাব। ঐ কমরেড আমাদের সংবেদনশীল স্নায়ুগুলিকে আঘাত করতে পেরেছেন যখন তিনি দেখিয়ে দেন যে অধ্যয়নের উপযুক্ত পরিবেশের অভাব থাকছে।
যদি আপনি একমত হন পার্টিতে উপরোক্ত অবস্থা থাকছে, তাহলে সমস্ত পার্টি সভ্যদের মার্কসবাদের অ, আ, ক, খ শিক্ষার জন্য পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি যে গণশিক্ষার অভিযান শুরু করেছে তাকে আপনি অভিনন্দিত করবেন।
আলোচনার শুরুতেই একটি প্রশ্ন সঙ্গতভাবেই উঠতে পারে। বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র যখন সংকটাগ্রস্ত ও মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই যখন প্রশ্ন উঠছে তখন মার্কসবাদের বুনিয়াদী শিক্ষার উপর জোর দেওয়া কি গোঁড়ামিকে আরও শক্তিশালী করবে না?
উত্তম, সাধারণভাবে সমাজতন্ত্রের সংকট ও বিশেষভাবে পূর্ব ইউরোপের ঘটনাবলীর বিকাশ সম্ভাব্য সমস্ত দিক থেকে বিশ্লেষণ করতে হবে – বিশ্বে শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন, সমগ্র ইউরোপে ক্রিয়াশীল জোরালো আর্থ-সামাজিক কারণগুলি, সোভিয়েত পেরেস্ত্রৈকার ভূমিকা, কম্যুনিস্ট পার্টিগুলি যে সমস্ত ভুলগুলি করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি আজ বিচার্য বিষয়।
কিন্তু আমি মনে করি এসব কিছুই এখনও পর্যন্ত সমস্ত কারণগুলির অন্যতম মৌলিক কারণটিকে স্পর্শ করতে পারেনি। পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্টরা ধাক্কা খাওয়ার পর অনেকে আশা করেছিলেন ইউরোপে কমিউনিস্টদের ঐতিহাসিক প্রতিদ্বন্দ্বী সমাজতন্ত্রীরা, যাঁরা ‘একনায়কত্বের’ বিপরীতে, ‘গণতান্ত্রিক নীতিভিত্তিক সমাজতন্ত্রের’ প্রবক্তা, তাঁদের দিকে হাওয়া ঘুরবে। কিন্তু তা হয়নি, এবং পূর্বতন কমিউনিস্টরা সংস্কার ও পুনর্গঠনের মাধ্যমে নিজেদের সমাজগণতন্ত্রী পার্টিতে পরিবর্তিত করার সমস্ত প্রচেষ্টার পরও পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। মধ্য-দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক জোটগুলির উত্থান, চার্চের উত্তরোত্তর ভূমিকা এবং ধনতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের সরাসরি আহ্বান এসব কিছু পূর্ব ইউরোপে ঘটছে। সুতরাং মূর্ত বাস্তবতা হল, পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশেই বিভিন্ন রূপের সমাজতন্ত্রই ব্যর্থ হয়েছে। গণতান্ত্রিক বিপ্লব, জনগণতন্ত্র, সর্বহারার শাসন কেবলমাত্র ধনতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ও বুর্জোয়াদের শাসনের রাস্তা পরিষ্কার করে তুলেছে। মার্কসাবাদের মৌলিক চিন্তাধারায় নিহিত ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণাই একমাত্র এই ধাঁধার সমাধান করতে পারে। মার্কস বলেছেন, “যদি সর্বহারা শ্রেণী বুর্জোয়া শ্রেণীর রাজনৈতিক শাসনকে ধ্বংসও করে, তা হবে এক সাময়িক বিজয় মাত্র, ১৭৯৪-এর মতো, এটি বুর্জোয়া বিপ্লকে সেবা করার জন্য একটি উপাদান মাত্র, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইতিহাসের গতিধারার ও ‘আন্দোলনের’ মধ্য দিয়ে বুর্জোয়া উৎপাদন ধরন-এর অবসান ও বুর্জোয়া রাজনৈতিক শাসনের সুনির্দিষ্ট উৎখাতের জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুগত শর্তাবলী সৃষ্টি হচ্ছে। ফ্রান্সের বুকে সন্ত্রাসের রাজত্ব তাই প্রচণ্ড আঘাত হেনেই ফ্রান্সের মাটি থেকে সামন্তবাদের অবশেষকে মুছে ফেলতেই কার্যকরী হল। উদ্বিগ্ন ও সহানুভূতিশীল বুর্জোয়ারা যা কয়েক দশকেও সম্পন্ন করতে পারত না। জনগণের রক্তাক্ত কার্যকলাপ কেবল এর রাস্তাই প্রস্তুত করল। একইভাবে, স্বৈরতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের পতনও স্বল্পস্থায়ী হত, যদি না বুর্জোয়া শ্রেণী-শাসনের জন্য অর্থনৈতিক অবস্থাগুলি ইতিমধ্যেই পরিপক্ক হত। মানুষ নিজের থেকেই পৃথিবীর ফসলগুলি নিয়ে নতুন জগৎ সৃষ্টি করে না যেমনটি ইতর কুসংস্কার বিশ্বাস করে বরং সেটি হয় তাদের পতনোম্মুখ সভ্যতার ঐতিহাসিক সমাপ্তির মধ্য দিয়ে। বিকাশের গতিধারায় তাদের নিজেদেরই একটি নতুন সমাজের বস্তুগত শর্তগুলি সৃষ্টির মধ্যে দিয়েই শুরু করতে হবে এবং মনন বা ইচ্ছাশক্তির কোনো প্রচেষ্টাই এই নিয়তি থেকে তাদের মুক্ত করতে পারে না।” (ডাই মরালিসীরেন্ডোম ক্রিটিক ... ১৮৪৭)। অধিকন্তু, উদারনৈতিক বুর্জোয়া ও মার্কসবাদী প্রচার মাধ্যমে যে সারি সারি বিশ্লেষণ বের হচ্ছে তা মার্কসবাদকে এত স্থূল করে তুলেছে যে মার্কসবাদের মৌলিক বিষয়গুলি পুনরায় স্মরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব ইউরোপের ঘটনাবলীর উপর ইপিডব্লু-র একজন নিয়মিত নিবন্ধকার বুদ্ধিজীবীর লেখা পড়ছিলাম। বস্তুত তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে গণমানসে ধর্মের প্রগাঢ় প্রভাব বুঝতে ওখানকার কমিউনিস্টরা ব্যর্থ হয়েছিলেন ও তাকে কাজেও লাগাতে পারেননি। বলতে বলতে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে গান্ধীর ধর্মকে জনপ্রিয়রূপে ব্যবহার করার প্রশংসায় পৌঁছেছেন। এর থেকে কমিউনিস্টদের শিক্ষা নেওয়ার উপদেশও দিয়েছেন।
মার্কসবাদের খণ্ডিত ও আংশিক অধ্যয়নের ফলে বেশ কিছু মানুষ মনে করেন যে, মার্কস ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন এবং জনগণের জন্য আফিম বল ধর্মকে শুধু নাকচ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে মার্কস ধর্মের এক পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা হাজির করেছেন। তাঁর লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃত করা যাক, “ধর্ম হচ্ছে এই বিশ্বের এক সাধারণ তত্ত্ব, এর বিশ্বকোষের সংক্ষিপ্তসার, জনপ্রিয়রূপে এর যৌক্তিকতা, এর সৃষ্টির এক আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা, এর উদ্যম, নৈতিক অনুমোদন ও পবিত্র পরিপূরক, সান্তনা ও সমর্থনের এর সাধারণ ভিত্তি।
“ধর্ম হচ্ছে অত্যাচারিত জীবের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন দুনিয়ার করুণার কথা ও ভৌতিক জীবনে আত্মার মোহ। মানুষের জীবনে ধর্ম হচ্ছে আফিম” (মার্কস-এঙ্গেলস পত্রাবলী)। বস্তুবাদী চিন্তার সমগ্র ইতিহাসে কোনো বস্তুবাদী ব্যক্তি কি ধর্ম সম্বন্ধে কখনও এই ধরনের সামগ্রিক ধারণা উপস্থিত করতে পেরেছেন? পেটি বুর্জোয়া বিপ্লবীরা তাঁদের সৌখিন চিন্তায় ধর্মকে সরলভাবে নাকচ করেন। সম্প্রতি ‘জনমত’-এ প্রকাশিত একটি কবিতা আমি পড়লাম যেখানে যতটা সম্ভব নিষ্ঠুরভাবে ধর্মের অর্থকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং আমি জানি আমাদের বহু কমরেডই এই ব্যাখ্যায় হাততালি দেবেন। কবিতায় আপনি এ ধরনের স্বাধীনতা উপভোগ করতেই পারেন, কিন্তু যদি তত্ত্বে অনুদিত হয় তবে তা হবে ক্ষতিকর।
ধর্ম হচ্ছে ওল্টানো জাগতিক চেতনা, যা মানুষের প্রাকৃতিক অস্তিত্ব ও প্রকৃতির জৈবিক অস্তিত্বের নেতিকরণের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে। মার্কস বলেছেন, “ব্যবহারিক জীবনে একবার যখন মানুষ ও প্রকৃতির তাৎপর্য, মানুষের প্রাকৃতিক সত্তা ও প্রকৃতির মানবিক সত্তা উপলব্ধ হবে, অনুভবে সেগুলি ধরা দেবে, তখন মানুষ ও প্রকৃতির বাইরে কোনো ঐহিক সত্তার অনুসন্ধান, যা মানুষ ও প্রকৃতির অবাস্তবতার প্রকাশ্য ঘোষণা, ব্যবহারিকভাবেই অসম্ভব হবে। এই অবাস্তবতাকে অস্বীকার করার জন্য নাস্তিকতা আজ অর্থবহ নয়, কারণ নাস্তিকতা হচ্ছে ঈশ্বরকে অস্বীকৃতি, এই অস্বীকৃতির মাধ্যমেই তা মানুষের অস্তিত্ব ঘোষণা করার চেষ্টা করে। সমাজতন্ত্রে এ ধরনের ঘুরপথের কোনো প্রয়োজন নেই, কেননা তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক দিক থেকে সমাজন্ত্র শুরু করে মানুষ এবং প্রকৃতির বাস্তব অস্তিত্বের উপলব্ধি থেকে। এটা হচ্ছে মানুষের ইতিবাচক আত্মসচেতনতা, কখনই ধর্মের নেতিকরণের উপর এ আত্মসচেতনতা অর্জিত নয়, ঠিক যেমন মানুষের বাস্তব জীবন হচ্ছে ইতিবাচক, ব্যক্তি সম্পত্তির নেতিকরণ (কমিউনিজম)-এর মাধ্যমে তা অর্জিত হয় না। কমিউনিজম হল নেতির নেতিকরণ পর্ব এবং ফলত ঐতিহাসিক অগ্রতির পরবর্তী ধাপ, মানুষের স্বাধীনতা ও পুনর্বাসনের জন্য এক বাস্তব ও প্রয়োজনীয় শর্ত। কমিউনিজম হল অদূর ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয় রূপ ও সক্রিয় নীতিমালা, কিন্তু কমিউনিজম নিজেই মানব অগ্রগতির লক্ষ্য নয় বা মানব সমাজের চূড়ান্ত রূপও নয়।” (ইকনমিক এন্ড ফিলসফিক্যাল ম্যানসক্রিপ্টস)
নাস্তিকতাবাদীদের মতো নেতিবাচক রূপে ধর্মকে নাকচ করা ও তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানো ভুল। অনুরূপভাবে সমাজের আধুনিক সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরণের জন্য ধর্মকে ব্যবহারের সমস্ত কথাবার্তা প্রতারণা মাত্র। পূর্ব-ইউরোপীয় সমাজতন্ত্র মানুষকে তার জীবনের অনিশ্চয়তাগুলি থেকে মুক্ত করতে পারেনি, তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হিসাবে সচেতন করতে পারেনি এবং অপরদিকে এক অত্যাচারী ব্যবস্থায় অধঃপতিত হয়েছিল। এটিই হল পূর্ব ইউরোপে চার্চের দীর্ঘ প্রভাব ও সম্ভবত পুনরুত্থানের পেছনে অপরিহার্য কারণ।
আমি একথা বলতে চাইছি না যে পূর্ব ইউরোপের বিকাশগুলিকে শুধু মার্কসবাদের বুনিয়াদী চিন্তাগুলি দিয়ে ব্যাখ্যা করাটাই একমাত্র কাজ এবং এই সমস্ত বছরগুলির অভিজ্ঞতাসমূহ থেকে মার্কসবাদের উন্নতির কোনো প্রয়োজন নেই। আমার বক্তব্য হল, ঐতিহাসিক অগ্রগতির পথে কখনও কখনও এটা ঘটে যে মানব সভ্যতা বিপ্লবী তত্ত্বের বুনিয়াদী বিষয়গুলি পুনরায় আবিষ্কার করে এবং তারপর তার উন্নতি ঘটায়। আমি স্থির নিশ্চিত সমাজতান্ত্রিক তত্ত্ব শীঘ্রই এক নবজাগরণ প্রত্যক্ষ করবে এবং সেটা হবে মার্কসবাদের বুনিয়াদী চিন্তাগুলির পুনরুজ্জীবনের উপর ভিত্তি করেই।
যখন আমরা মার্কসবাদের বুনিয়াদী চিন্তাগুলির কথা বলি তখন এটা বোঝা ঠিক নয় যে কয়েকটি বই পড়া ও কিছু মৌলিক সূত্রায়নকে আউড়ে যাওয়ার কথা বলা হচ্ছে। অধ্যয়নের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্থির করা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এবং এর উপরই আমাদের সমগ্র অভিযানের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করছে।
আমি প্রায়শই দেখতে পাই কিছু মানুষের কোনো কোনো প্রশ্নে নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে এবং এই চিন্তাভাবনার সমর্থন খোঁজার জন্য তাঁরা মার্কসবাদী বইপত্র অধ্যয়ন করেন। সম্ভবত যে কোনো চিন্তাভাবনার স্বপক্ষে সবসময়ই প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি জোগাড় করা যায়। আমরা বলি মার্কসবাদ আমাদের কাজের পথ প্রদর্শক কিন্তু বাস্তবে তা আমাদের চিন্তা ও কাজের পিছু পিছু চলে। আমি মনে করি, আমরা যখন অধ্যয়ন চালাব তখন আমাদের এই অবস্থান থেকে শুরু করতে হবে যে, আমাদের স্বাভাবিক, স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাগুলি সাধারণভাবে পেটিবুর্জোয়া চরিত্রের। বুর্জোয়া ও পেটি বুর্জোয়া চিন্তাগুলি সমাজে প্রাধান্যকারী অবস্থানে থাকার জন্যই এটা ঘটে এবং আমাদের এমনকি শ্রমিক কমরেডদেরও বিশ্ববীক্ষা, এই চিন্তাগুলির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হতে বাধ্য। মার্কসবাদ অধ্যয়নের সময় নিজের চিন্তার প্রতিপক্ষেই অধ্যয়ন চালাতে হবে এবং মানসিক সংগ্রাম চালিয়ে এক সচেতন প্রক্রিয়ায় প্রত্যেকের নিজের বিশ্ববীক্ষাকে রূপান্তরিত করতে হবে। চীনের পরিপ্রেক্ষিতে মাও বলেছিলেন, “পার্টিতে এমন বহু কমরেড রয়েছেন যাঁরা সাংগঠনিকভাবে পার্টিতে যুক্ত হয়েছেন কিন্তু মতাদর্শগতভাবে যুক্ত নন”। আমি দেখছি আমাদের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি সঠিক। বহু কমরেড আছেন যাঁদের দেহ রয়েছে কমিউনিস্ট পার্টিতে, বিপ্লবের জন্যও তাঁরা উৎসর্গীকৃত প্রাণ, কিন্তু তাদের মন পড়ে আছে উদারনৈতিক বুর্জোয়া চিন্তাজগতে।
কয়েকটি উদাহরণের সাহায্যে আমি ব্যাপারটা স্পষ্ট করব।
আমি দেখি, কিছু কমরেড বুর্জোয়া প্রচারের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন ও সরকারের কোনো না কোনো ঘোষণা যেমন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ইত্যাদি সম্পর্কে মোহগ্রস্ত হন। উদারনৈতিকরা প্রচার করে চলে যে এগুলি ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই ধরনের সংস্কার করা সম্ভব।
আসুন, আমরা দেখি মার্কসবাদ কীভাবে এই প্রশ্নকে দেখছে। মার্কস বলেছেন, “কনভেনশন সাময়িকভাবে সাহস দেখাল দারিদ্র্য-দূরীকরণের আদেশ দিতে, যদিও তৎক্ষণাৎ নয়, ... কিন্তু কেবল জন নিরাপত্তা কমিটিকে প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা ও প্রস্তাবগুলি পেশ করার জন্য দায়িত্ববদ্ধ করার পর, ... কনভেনশনের অর্ডিন্যান্সটির কী ফল হয়েছিল? পৃথিবীতে আরও একটি অর্ডিন্যান্স যুক্ত হল মাত্র। এক বছর পর কনভেনশন অনাহারক্লিষ্ট তাঁতীদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে গিয়েছিল।
“তথাপি এই কনভেনশন সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ক্ষমতা, শক্তি ও বোঝাপড়ার প্রতিনিধিত্ব করেছিল।
“পৃথিবীতে কোনো সরকারই দারিদ্র্যের বিষয়ে তৎক্ষণাৎ আইন তৈরি করতে সক্ষম হয়নি, তাদের অফিসারদের সাথে আলোচনা ব্যতিরেকে ... দারিদ্র্যের প্রশ্নে রাষ্ট্রগুলি যদিও নিজেদের সংশ্লিষ্ট করেছে, তখনও তারা প্রশাসনিক ও দাতব্য কিছু পদক্ষেপ বা তার থেকেও নীচুস্তরের উদ্যোগে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে।
“রাষ্ট্র কি অন্য কোনোভাবে কাজ করতে পারে? রাষ্ট্র কখনই সামাজিক গলদগুলির কারণ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে খুঁজবে না! .. যেখানে রাজনৈতিক পার্টিগুলি রয়েছে, প্রত্যেক পার্টিই এই দুর্ভাগ্যের কারণ নিজে নয়, বিরোধী যে পার্টি শাসন ক্ষমতায় আছে তার জন্যই হয়েছে বলে মনে করে। এমনকি প্রগতিশীল ও বিপ্লবী রাজনীতিবিদরা এই দুর্ভাগ্যের কারণকে রাষ্ট্রের চরিত্রের মধ্য লক্ষ্য করেন না। এই দুর্ভাগ্যের কারণকে রাষ্ট্রের কোনো একটি নির্দিষ্ট রূপের মধ্যে দেখতে পান, যাকে তারা অন্য একটি রূপ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে চান।
“রাজনৈতিক অবস্থান থেকে দেখলে রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামো দুটি ভিন্ন বিষয় নয়। রাষ্ট্র হল সমাজের কাঠামো। যতদূর রাষ্ট্র এই সামাজিক দুর্ভাগ্যের অস্তিত্ব স্বীকার করে, তখন সে তার জন্য দায়ী করে প্রাকৃতিক নিয়মগুলিকে যাকে কোনো মানুষের শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না অথবা ব্যক্তিগত জীবনকে দায়ী করে যা রাষ্ট্রের থেকে স্বাধীন অথবা প্রশাসনিক অক্ষমতাকে দায়ী করে যা তার অধীনস্থ। তাই ইংল্যান্ডে দারিদ্র্য প্রাকৃতিক নিয়মের দ্বারা এইভাবে ব্যাখ্যা হয়, যে নিয়ম অনুযায়ী জনসংখ্যার বৃদ্ধি বেঁচে থাকার উপকরণ থেকে সর্বদাই অনেক বেশি বৃদ্ধি পায়। অন্য আরেকভাবে ইংল্যান্ডে দারিদ্র্যের ব্যাখ্যা করা হয়, গরিবদের অনীতিনিষ্ঠ স্বভাবের জন্য এটা হচ্ছে। যেমন প্রাশিয়ার রাজা ব্যাখ্যা করেন, বড়লোকদের অখ্রিস্টীয় প্রবণতার জন্য দারিদ্র্য হচ্ছে এবং কনভেনশন মনে করে সম্পত্তিবানদের অবিশ্বাসী, প্রতিবিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গির জন্যই দারিদ্র্য হচ্ছে। ফলত ইংল্যান্ডে দরিদ্রদের উপর শাস্তি ধার্য হয়, প্রাশিয়ার রাজা বড়লোকদের ভর্ৎসনা করেন এবং কনভেনশন সম্পত্তিবানদের শিরচ্ছেদ করে।
“সবশেষে, প্রতিটি রাষ্ট্রেই প্রশাসনের অস্বাভাবিক বা উদ্দেশ্যমূলক দিকগুলির মধ্যেই দারিদ্র্যের কারণ খুঁজতে চায় এবং এই দুর্ভাগ্যের সমাধানের জন্য প্রশাসনের কোনো একটি সংস্কারের কথা ভাবে। কেন? সোজা ভাষায় তার কারণ প্রশাসন হল রাষ্ট্রের নিজেরই সাংগঠনিক সক্রিয়তা।
“একদিকে লক্ষ্য ও মহৎ ইচ্ছা, অন্যদিকে উপায় ও সঙ্গতির মধ্যেকার প্রশাসনের দ্বন্দ্বকে রাষ্ট্র নিজেকে বিলোপ করা ব্যতীত দূর করতে পারে না, কেননা রাষ্ট্রের মধ্যেই এই দ্বন্দ্ব নিহিত আছে। সমষ্টি ও ব্যক্তি জীবনের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব এবং সাধারণ ও বিশেষ স্বার্থগুলির দ্বন্দ্বের উপরেই রাষ্ট্র নির্মিত হয়েছে। এজন্যই প্রশাসন আনুষ্ঠানিক ও নেতিবাচক সক্রিয়তা পর্যন্তই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে, কারণ প্রশাসনের ক্ষমতা সেই বিন্দুতেই শেষ হয় যেখানে সভ্য জীবন ও তার কাজ শুরু হয়। সভ্য সমাজের অসামাজিক জীবনযাত্রা, ব্যক্তিগত সম্পত্তি, বাণিজ্য, শিল্প, সভ্য সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলির পারস্পরিক লুণ্ঠন যে পরিণতি নিয়ে আসে, তার মুখোমুখি হতে গিয়ে নপুংসকতাই প্রশাসনের স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দেখা দেয়” (অর্থনৈতিক নোট সমূহ)।
অন্য আর একদিন, আমি একজন কমরেডের সাথে আলোচনা করছিলাম। ঐ কমরেড মনে করেন মার্কসের সমাজের শ্রেণী বিভাজন তত্ত্ব ও শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব বোধহয় ভিত্তিহীন হয়ে পড়েছে। মার্কস সর্বহারা শ্রেণীর নেতৃত্ব ইত্যাদির কথা বলেছিলেন, কিন্তু দেখুন, শ্রমিকরা দেখা যাচ্ছে সব থেকে গোঁড়া ও তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের বাইরে কিছুই তারা দেখতে পাচ্ছে না। এই কমরেড এখানেই ভুল করেছেন যে মার্কসই সমাজ বিভাজন তত্ত্ব হাজির করেছিলেন বা শ্রেণী সংগ্রামের কথা আবিষ্কার করেছিলেন। মার্কস নিজে কিন্তু বলেছেন, “বর্তমান সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর অস্তিত্ব বা তাদের মধ্যে সংগ্রাম আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার নয়। আমার বহু পূর্বে বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরা এই শ্রেণী সংগ্রামের ঐতিহাসিক বিকাশের ধারা এবং বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন শ্রেণীর অর্থনৈতিক গঠনতন্ত্র বর্ণনা করেছেন।” (ভেইডেমায়ার সমীপে মার্কস, মার্চ ১৮৫২)।
এখানেই মার্কসের কৃতিত্ব যে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন সেই শ্রেণীকে যে নিজেকে সহ সমস্ত শ্রেণীরই শেষ পর্যন্ত বিলোপ ঘটাবে। এই শ্রেণীই হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণী যে বস্তুগতভাবে এই কর্তব্যটি সম্পন্ন করার দায়িত্ব পেয়েছে। মার্কস আরও বলেছেন, “যদি সমাজতান্ত্রিক লেখকবর্গ সর্বহারার এই বিশ্ব ঐতিহাসিক ভূমিকার উল্লেখ করতেন, মোটেই তা হওয়ার নয় ... কারণ তাঁরা সর্বহারাকে ভগবান হিসাবে দেখিয়ে থাকেন। একেবারে বিপরীতভাবেই পূর্ণ বিকশিত সর্বহারার থেকে যা কিছু মানবিক এমনকি মানবিক অস্তিত্ব পর্যন্ত মুছে দেওয়া হয়েছে। ... এই বা ঐ সর্বহারা বা এমনকি সমগ্র সর্বহারা একটি নির্দিষ্ট সময়ে কী লক্ষ্য পোষণ করে তা জানার বিষয় এটা নয়। সর্বহারা কে এবং তার চরিত্রের সঙ্গতিপূর্ণ কোনো ঐতিহাসিক কর্তব্যটি সে সম্পন্ন করবে এটাই জানার প্রশ্ন”। (পবিত্র পরিবার)
আমি একজন কমরেডকে দেখেছি পার্টি ও বিপ্লব সম্পর্কে যাঁর সততা ও আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু তিনি গর্বাচভের ‘শান্তিপূর্ণ ও মার্জিত সাম্রাজ্যবাদ’ কল্পতত্ত্বের দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। তিনি যে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের মানুষ এবং জাতি হিসাবে সেই দেশটির প্রধান বাহ্যিক দ্বন্দ্ব যে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সে কথাটি বুঝতে কমরেড ভুল করেছেন। যে তত্ত্ব এই দ্বন্দ্বকে লঘু করে দেখতে ওকালতি করে, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে উন্নতিশীল দেশগুলির সংগ্রামকে কমিয়ে ফেলতে পরামর্শ দেয়, সেই তত্ত্ব আমাদের জাতীয় স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি, বিভিন্ন জনপ্রিয় আন্দোলন ও জাতীয় নেতারা গর্বাচভের এই নতুন চিন্তা অনুসরণ করতে কেন নারাজ? এটা এই জন্যই যে তাঁরা হলেন তাঁদের জাতীয় স্বার্থের সচেতন প্রতিনিধি। উদারনৈতিক বুর্জোয়া প্রচারে আমাদের এই কমরেড বিভ্রান্ত হয়েছেন এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় জাতির মধ্যেকার দ্বন্দ্ব যা আমাদের পার্টির কর্মসূচির অন্যতম একটি স্তম্ভ রচনা করেছে, তার কোনো সচেতন প্রতিনিধি তিনি নন।
বেশ কিছু কমরেডকে আমি দেখেছি তারা অগপ, তেলেগু দেশম প্রভৃতি পার্টিগুলি এবং শারদ যোশী ও টিকায়েতের আন্দোলনগুলির গণচরিত্র দেখে ভেসে গেছেন, এমনকি ঐ সমস্ত পার্টি ও আন্দোলনগুলিতে মিশে যাওয়া অথবা তাদের কর্মসূচি নকল করার ওকালতি করেছেন। ঐ সমস্ত কমরেড ওদের প্রভাবাধীন জনগণ ও আন্দোলনগুলির জঙ্গী রূপগুলিই দেখতে পান কিন্তু ঐ পার্টি বা আন্দোলনগুলির শ্রেণী চরিত্র ও উদ্দেশ্য সবকিছুই ভুলে যান। এটা যথেষ্ট পরিতাপের বিষয়, সারা ভারতবর্ষের বাম ও প্রগতিশীল জনগণের একটা অংশ যখন প্রধানত বিহারে আমাদের আন্দোলনের মধ্যে একটা নতুন আশা দেখতে পাচ্ছেন, তা মূলত এই কারণে যে আন্দোলন গ্রামাঞ্চলের সব থেকে অত্যাচারিত ও বিপ্লবী শ্রেণীগুলির উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে, এর গণচরিত্র ও জঙ্গীরূপ সচেতনভাবেই বিপ্লবী গণতন্ত্রের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যাভিমুখী, তখন আমাদের কমরেডদের একাংশ নিজেদের আন্দোলনকে পরিহাস করে বিজাতীয় শ্রেণী পরিচালিত আন্দোলন সম্পর্কে মোহ বিস্তার করছেন, যে আন্দোলন অ-পার্টি, অ-রাজনৈতিক নৈরাজ্যবাদের কথা বলে বা এই ব্যবস্থার মধ্যে আংশিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের ওকালতি করে।
এই সমস্ত কমরেডদের কেউ কেউ জনতা সরকারকে সমর্থন করার ওকালতি করেছেন, এমনকি তারা চেয়েছিলেন আমরা এই সরকারে যোগ দিই। জনতা সরকারের গণতান্ত্রিক হাবভাব ও গ্রামীণ ক্ষেত্রে জোর দেওয়া ইত্যাদিতে এই সমস্ত কমরেডরা ভীষণ প্রভাবান্বিত। এরা মনে করেন, সামন্ততন্ত্রের অবশেষ ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংগ্রাম জনতা দল ধরনের সরকার দ্বারাই সম্পন্ন করা যায় এবং আমাদের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টিকারী গ্রুপ হিসাবে কাজ করলেই চলবে। এই তত্ত্ব নিজে এখানে থামেনি এবং পরবর্তী যৌক্তিক অগ্রগতি হিসাবে গ্রামাঞ্চলে গরিবদের উপর আমাদের জোর দেওয়া ও তাদের জঙ্গী গণআন্দোলনগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছে। এই তত্ত্ব কমিউনিস্ট পার্টিকে বাতিল করে দেয় এবং এর পরিবর্তে একটা ঢিলেঢালা গণতান্ত্রিক মঞ্চ বানিয়ে শান্তিপূর্ণ সংসদীয় পথে হাঁটা ও বস্তুত জনতা দল এবং সমাজগণতন্ত্রী বামদের ছোটো শরিক হিসাবে কাজ করার জন্য ওকালতি করে। এ পর্যন্তও তাঁরা অগ্রসর হয়েছেন যে নকশালবাড়ি আন্দোলনকেই এরা পরিহাস করেন এবং স্বাধীন বাম জাগরণ ও বিপ্লবী গণতন্ত্রের চিন্তাভাবনাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করেন।
আসলে, এই সমস্ত কমরেড মার্কসবাদী শ্রেণী অবস্থানে দৃঢ় থাকতে ব্যর্থ হয়েছেন। একটি কমিউনিস্ট পার্টি গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র গ্রামীণ জনগণের উপরই একমাত্র ভিত্তি করতে পারে ও মধ্য কৃষকদের জয় করার প্রচেষ্টা চালাতে পারে। জনতা দল সরকার ইত্যাদির প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একমাত্র এই শ্রেণী অবস্থান থেকেই নির্ধারিত হওয়া উচিত। গ্রামাঞ্চলে জনতা দলের সামাজিক ভিত্তি মূলত কুলাক পরিচালিত এবং গ্রামীণ দরিদ্র জনগণ এদের সাথে তীব্র সংঘাতে রয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ ভারতবর্ষে এটিই প্রধান বিকাশমান দ্বন্দ্ব। আমরা যেহেতু গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের উপর ভিত্তি করি ও তাদের স্বার্থেরই প্রধানত প্রতিনিধিত্ব করি, তাই জনতা দলের সাথে আমাদের সম্পর্কও প্রধানত সংগ্রাম ব্যতীত অন্য কিছু হতে পারে না। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে মধ্য কৃষকরাও এই কুলাক লবিকে অনুসরণ করছে এবং জনতা দল ইত্যাদির সামাজিক ভিত্তি তৈরি করছে। আমাদের যেহেতু এই মধ্য কৃষকদের জয় করতে হবে, ধীরে ধীরে কুলাকদের প্রভাব থেকে এদের সরিয়ে আনতে হবে ও গ্রামীণ দরিদ্রদের মিত্র বাহিনীতে পরিবর্তিত করতে হবে, তাই জনতা দলের সাথে আমাদের কোনো না কোনো ধরনের আন্তঃক্রিয়ায় যেতে হবে। এটিই তাদের সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঐক্য ও সংগ্রামের এক জটিল বিষয়, যেখানে সন্দেহাতীতভাবে সংগ্রাম প্রধান ভূমিকা পালন করবে। শ্রেণী স্তরে ক্রিয়াশীল এই বাস্তবতাগুলিকেই জনতা দলের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক নির্ণয় ও জনতা দলের সরকারের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিফলিত করতে আমরা চেষ্টা করছি। সিপিআই, সিপিআই(এম) যেহেতু গ্রামীণ দরিদ্র জনগণ ও উদীয়মান কুলাক লবির দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করে বা ছোটো করে দেখে, যা আমাদের আন্দোলনকে শ্রমিক ও ‘কৃষকের’ মধ্যেকার সংগ্রাম বলে নিন্দিত করার মাধ্যমে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হচ্ছে, ফলে তারা গ্রামাঞ্চলে শ্রেণী শান্তির ওকালতি করে এবং কুলাক লবির সাথে গা মাখামাখি করে।
জনতা দল থেকে শুরু করে তেলেগু দেশম, ডিএমকে সরকারগুলির প্রতি নিঃশর্ত সমর্থন এই দলগুলির শ্রেণী অবস্থানের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ। সাধারণভাবে বলা যায় বর্তমান বাস্তব অবস্থা হল, মধ্য কৃষকরা কুলাক লবিকে অনুসরণ করছে এবং মধ্যপন্থী রাজনৈতিক পার্টিগুলি বা তাদের ‘স্বাভাবিক নেতা’ টিকায়েত, শারদ যোশীর পেছনে সমাবেশিত হচ্ছে। তাই আমাদের দিকে সরে আসাটা কুলাকদের সাথে তাদের দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধির উপরই নির্ভর করছে। বিহারে আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা হল যে, মধ্য কৃষকদের মধ্যে আমাদের ভিত্তিকে কিছুটা প্রসারিত করতে আমরা সক্ষম হয়েছি। আমাদের কর্মনীতিগুলির ও দৃষ্টিভঙ্গির আরও উন্নতি প্রয়োজন কিন্তু সমগ্র প্রক্রিয়াটি ধীর গতি সম্পন্ন হতে বাধ্য। আমাদের প্রত্যক্ষ উদ্যোগুলির সাথে সাথে এদিক ওদিক গড়ে ওঠা কৃষক সংগঠনগুলির সাথে সম্ভাব্য ক্ষেত্রগুলিতে যুক্তমোর্চার কার্যকলাপ চালাতে হবে। মার্কসবাদী শ্রেণী অবস্থান ও নীচুতলার বাস্তব অবস্থা ভুলে গিয়ে যদি কোনো কমিউনিস্ট দ্রুত ও সস্তায় সাফল্য লাভের জন্য টিকায়েত বা শারদ যোশী ধরনের ব্যক্তিদের শুধু নকল করার চেষ্টা করে, তবে আমি আশঙ্কিত যে এই উদ্যোগে তিনি শুধু ব্যর্থ হবেন তাই নয়, এই প্রক্রিয়ায় তিনি এমনকি গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে নিজের সামাজিক ভিত্তিও হারাবেন। রাজনৈতিকভাবেও তিনি বুর্জোয়া ও সমাজগণতন্ত্রী পার্টিগুলির লেজুড়ে পরিণত হয়ে শেষ হবেন। এই পথের ওকালতি করে যে সমস্ত ব্যক্তি আমাদের পার্টি ছেড়েছেন, তারা ইতিমধ্যেই এভাবে অধঃপতিত হয়েছেন।
যে শ্রেণীস্বার্থকে আমরা ঊর্ধ্বে তুলে ধরি, এই সব কমরেডরা তার সচেতন প্রতিনিধি হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং প্রতারক উদারপন্থী বুর্জোয়া ও সমাজগণতন্ত্রীদের প্রচারে প্রভাবিত হয়েছেন।
আমাদের পার্টিতে ছিলেন এমন একজন মহিলা কমরেডের কথায় আসা যাক, যিনি মহিলা আন্দোলনের ইস্যুগুলিতে সক্রিয় থাকতেন। যথেষ্ট সম্ভাবনাময় ও আন্তরিক এই কমরেড একজন মহিলা নেত্রী হিসাবে গড়ে উঠবেন এরকম আশা করেছিলাম। কিন্তু চিন্তার জগতে অর্ধেক সময় তিনি প্রেমের স্বাধীনতার সমস্যাগুলি নিয়ে আলোচনায় ব্যয় করতেন। উগ্র নারীবাদী পেটি বুর্জোয়া মহিলা সংগঠনগুলির প্রতি এই কমরেড আকর্ষণ অনুভব করতেন। আমরা তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করতাম যে এই সব নারীবাদী মহিলা আন্দোলনগুলি সংখ্যালঘিষ্ঠ কিছু মহিলার আন্দোলন এবং যাঁরা পুরুষদের বিরুদ্ধে মহিলাদের লড়িয়ে দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বস্তুত বিশৃঙ্খলাকারীর ভূমিকাই পালন করছেন। আমরা তাঁকে এটা দেখার জন্য বলতাম, হাজার হাজার শ্রমজীবী মহিলা যদি আমাদের পার্টি পরিচালিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মূল স্রোতে উৎসাহে ও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে তবে সেটিই তো প্রমাণ করে নারীমুক্তির প্রশ্ন এই আন্দোলনের এক উল্লেখ্যযোগ্য অংশ এবং অপরদিকে এই আন্দোলনগুলি মহিলা সমাজের মুক্তির প্রশ্নে একটা প্রভাব ফেলছে। যখন বিহারের পঞ্চাশ হাজারের দীর্ঘ মিছিলে মহিলারা ৩০ শতাংশ রয়েছেন, তখন বলাবাহুল্য, গণভিত্তিসম্পন্ন কোনো মহিলা আন্দোলনের ভিত্তি এধরনের ব্যাপক বিস্তৃত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যেই খুঁজতে হবে। অবশ্য আপনাকেও অনুসন্ধান করতে হবে ঠিক কীভাবে নীচুতলাবাদী আন্দোলনগুলি মহিলা প্রশ্নগুলিকে প্রতিফলিত করছে, তাঁদের স্বার্থকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরছে এবং কীভাবে মহিলাদের মুক্তির প্রশ্নে তা ভূমিকা রাখছে। এগুলি অনুসন্ধান ও সূত্রবদ্ধ করেই আপনাকে স্বশাসিত একটি মহিলা সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। ‘স্বশাসন’ শব্দটি নিজেই বলছে এই স্বাধীনতা আপেক্ষিক এবং আন্দোলনের এক অবিভাজ্য অংশ হিসাবেই একে উপভোগ করতে হবে। বিপরীতে, উগ্র নারীবাদীরা এ ধরনের ‘স্বশাসিত মহিলা আন্দোলনগুলিকে’ গণতন্ত্রের জন্য বিস্তৃত আন্দোলনের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। সংশ্লিষ্ট মহিলা কমরেডকে আমরা এ সবই বুঝিয়ে বলেছিলাম, এই ধরনের উগ্র নারীবাদী অবস্থান থেকে সরে থাকার জন্য তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, অন্যথা তা ব্যাপক মহিলাদের থেকেই বিচ্ছিন্নতা ঘটাবে। মহিলাদের চেতনা ও তাঁদের সংগঠনগুলির অবস্থা থেকেই তাঁকে ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে আমরা বলেছিলাম। এটিই কি সমস্ত কমিউনিস্টদের সাধারণ অনুশীলন নয়? জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতা আমাদের ধ্বংস ডেকে আনে, আর অন্যদিকে জনগণের সঙ্গে থেকে ধাপে ধাপে তাদের চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলির সাথে আমরা কিছু সমঝোতা করি না, যাকে আমরা শেষ বিচারে ভাঙতে চাই? এমনকি নির্বাচনে অংশগ্রহণ কি এক ধরনের সমঝোতা নয়? আমাদের সমস্ত ব্যাখ্যাই তাঁকে নিবৃত্ত করতে ব্যর্থ হল এবং বিষয়টি এখানে পৌঁছালো যে, আমরা ঐ মহিলা কমরেডকে পার্টি থেকে বের করে দিতে বাধ্য হলাম, যেহেতু তাঁর উগ্র নারীবাদী চিন্তা-ভাবনাগুলি কমিউনিস্ট পার্টি ও মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
আমি এখানে অধ্যয়নের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করার সাথে সাথে মার্কসবাদের বুনিয়াদী বিষয়গুলি অধ্যয়নের উপর জোর দেওয়ার কথা বললাম এবং অধ্যয়ন সম্পর্কে আমাদের সঠিক মনোভাব কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে আমার বক্তব্য রাখলাম। আমি বেশ কয়েকটি উদাহরণ রাখলাম যার মাধ্যমে দেখিয়েছি কিছু সৎ ও আন্তরিক ব্যবহারিক কর্মী কীভাবে অধ্যয়নকে অবহেলা করার জন্য মার্কসবাদ ও কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছেন, যাঁরা নিজেদের বিশ্ববীক্ষাকে পাল্টে নিতে রাজি হননি।
এই রূপান্তর এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং এজন্য অধ্যয়ন এক নিয়মিত বিষয় হওয়া উচিত। অন্যথায় এই সমস্ত কমরেডের ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছিল ভুল চিন্তাগুলি জমতে জমতে এমন জায়গায় পৌঁছল যখন নিজেদের পাল্টে নেওয়া তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল।
আমার সহকর্মীদের একজন সঠিকভাবেই উল্লেখ করেছেন, উন্নতমানের চিন্তা সর্বদাই সরল জীবনযাত্রার সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং এর সাথে আমি বলব বিনয়ের সঙ্গেও তা যুক্ত।
আমি আশা করব, ব্যবহারিক কর্মীরা যাঁরা কাজের চাপের অজুহাতে অধ্যয়নকে এড়িয়ে চলেন, তাঁরা এই ধরনের নেতিবাচক শিক্ষকদের থেকে কিছু শিক্ষা নেবেন। জনপ্রিয় রূপেই বর্তমান শিক্ষা অভিযান চালাতে চেষ্টা করছি আমরা। পার্টির অভিজ্ঞ নেতারা বিভিন্ন বিষয়ে জনপ্রিয় রূপে লেখা তৈরি করেছেন। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পরিকল্পনা আছে আপনাদের পরামর্শ ও সমালোচনাগুলি পাওয়ার পর এই সমস্ত রচনাগুলির উন্নত সংস্করণ প্রকাশ করবে, যা স্থায়ী পাঠ্য বিষয় হিসাবে কাজে লাগানো যাবে।