নকশালবাড়ির প্রকৃত তাৎপর্য বলতে কী বোঝায়? নকশালবাড়ির অর্থ বুনিয়াদী কৃষক জনগণের জাগরণ। সশস্ত্র কিছু স্কোয়াড দিয়ে এদিক ওদিক বিক্ষিপ্ত কিছু কার্যকলাপ বা কিডন্যাপের মতো চমকপ্রদ অ্যাকশন করে বেড়ানো নয়। তার অর্থ কলকাতা, দিল্লী, বোম্বেতে কফি হাউসে বসে বড় বড় বিপ্লবী বুলি আওড়ানোও নয়। নিজেদের ব্যর্থতাকে চাপা দেওয়ার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠী আমাদের যতই গালাগালি দিয়ে বেড়াক না কেন, সত্য এটাই যে নকশালবাড়ির ধারায় এই কৃষক জাগরণ একমাত্র ঘটছে বিহারেই এবং আমাদের পার্টিই রয়েছে তার সামনের সারিতে।

নকশালবাড়ির অর্থ এই কৃষক জনগণের ভিত্তিতে জাতীয় রাজনীতিতে এক বৈপ্লবিক রাজনৈতিক ধারা প্রবর্তন। স্থানীয় ভিত্তিতে কৃষকের কিছু অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া পূরণের মানেই কিন্তু নকশালবাড়ি নয়। পাহাড়ে-জঙ্গলে গিয়ে 'লাল সেনা ও ঘাঁটি এলাকা' গড়ে যারা বিকল্প রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, তাদের সকলেই ব্যর্থ হয়েছেন। এখন সেখানে রাজনীতি বন্দুক চালাচ্ছে না, উল্টে বন্দুকই রাজনীতি চালাচ্ছে।

নকশালবাড়ি মার্কসবাদ বনাম সংশোধনবাদ, সশস্ত্র সংগ্রাম বনাম সংসদীয় পথের মধ্যকার কোনো বিমূর্ত সংগ্রামের সাফল্য নয়। পেটিবুর্জোয়া বিপ্লববাদ কিন্তু তাই ভাবে। কাজেই সে মনে করে বিপ্লবী ভাবাবেগ দিয়ে ও কিছু মৌলিক মার্কসবাদী সূত্র দিয়ে যখন খুশি, যেখানে খুশি নকশালবাড়ি গড়ে তোলা সম্ভব। যাবতীয় নৈরাজ্যবাদী কার্যকলাপ, তদজনিত হতাশা এবং অবশেষে উল্টো পথে যাত্রা – যার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে – এ সবের পিছনে বিপ্লব সম্পর্কে মধ্যবিত্তের সেই কল্পনাবিলাসই কাজ করে।

নকশালবাড়ির শিকড় রয়েছে ভারতের গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার অন্তর্দ্বন্দ্বের মধ্যে, তার পেছনে আছে দীর্ঘ কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস, তেভাগা-তেলেঙ্গানার ধারাবাহিকতা। আছে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে দুই বিপরীতমুখী কৌশলগত লাইনের মধ্যকার দীর্ঘ সংগ্রামের প্রক্রিয়া। একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যার পরিণতি ঘটেছিল নকশালবাড়ির বিদ্রোহে। নকশালবাড়িকে বুঝতে হলে এসবই বুঝতে হবে।

মেহনতি কৃষক জনগণের জাগরণের মধ্যে দিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা হবে নাকি বুর্জোয়াদের কোনো না কোনো অংশের সাথে যুক্তফ্রন্টের স্বার্থে কৃষক জনগণের উদ্যোগকে স্তিমিত করা হবে – এই দুই বিপরীতমুখী কৌশলের লড়াই দীর্ঘ সময় ধরে পার্টিতে চলেছিল। ১৯৬৭ সালের বিশেষ এক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই এই লড়াই তার চরমবিন্দুতে পৌঁছায় – যখন ক্ষমতাসীন যুক্তফ্রন্ট সরকার কৃষক আন্দোলনের ঢেউকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা এগিয়ে যান এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিতে।

(নকশালবাড়ি সম্পর্কে বিনোদ মিশ্র, দেশব্রতী, সেপ্টেম্বর ১৯৯০)