২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন পশ্চিমবাংলার বামপন্থী কর্মীবাহিনী ও সমর্থকদের কাছে এক বিরাট প্রশ্ন রেখে গেল। এই প্রশ্নের সঠিক সমাধানের মধ্যেই খুঁজে নিতে হবে আগামীদিনে বামপন্থী রাজনীতি ও আন্দোলনের অগ্রগতির পথনির্দেশ।
নির্বাচনী অভিযান পর্বে ও ফলাফল ঘোষণার প্রাকমুহূর্ত পর্যন্ত বাম-কংগ্রেস জোটের নেতারা সরকার গঠনের দাবিতে সরব থেকেছেন। কিন্তু ফলাফল ঠিক উল্টো কথা বলল। জোট ক্ষমতা থেকে বহু দূরে। বামপন্থী সমর্থনের সুবাদে কংগ্রেস তার আসনসংখ্যা বাড়িয়ে ৪৪-এ পৌঁছে গেলেও বামফ্রন্ট আটকে থাকল মাত্র ৩২টি আসনে। বলতে গেলে ২০১১ সালের তুলনায় প্রায় অর্ধেক। পশ্চিমবাংলার বিধানসভায় এই প্রথম বামপন্থীরা নেমে গেলেন তৃতীয় স্থানে।
এই ফলাফলকে কীভাবে দেখব? শাসক দলের সন্ত্রাস ও কারচুপির প্রতিফলন হিসেবে? সন্ত্রাস ও কারচুপির ঘটনা অবশ্যই অনেক ঘটেছে, বেশ কিছু প্রচারমাধ্যমেও সামনে এসেছে, কিন্তু সামগ্রিক বিশ্লেষণে কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাবাহিনীর সক্রিয় ভূমিকা, নির্বাচন কমিশনের তৎপরতা, সংবাদমাধ্যমের তীক্ষ্ণ নজর, জনগণের সোচ্চার অংশগ্রহণ – সব মিলিয়ে এই নির্বাচনকে সন্ত্রাস ও কারচুপির প্রহসন বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে কি? সন্ত্রাস ও কারচুপিই যদি সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে থাকে তাহলে 'জনগণ ভোট দিতে পেরেছেন এবং জনগণের রায়ে আমরা সরকার গঠন করতে চলেছি' এই দাবি জোটের নেতারা কেন করলেন? নিছক সন্ত্রাস ও কারচুপির পরিণাম নয়, নির্বাচনী ফলাফলকে পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক শক্তির বর্তমান ভারসাম্যের প্রতিফলন হিসেবে দেখাটাই হবে বাস্তবোচিত।
ভোটের গাণিতিক বিশ্লেষণে যদি নজর দেওয়া যায় তাহলে আমরা দেখব জোটপন্থী নেতা ও প্রবক্তাদের দুটো বড় তর্ক ছিল। এক, বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের ভোট যোগ করলে তৃণমূলের ভোটকে অনেক জায়গাতেই ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে, আর দুই, লোকসভা নির্বাচনে মোদী হাওয়াতে বিজেপি যে ১৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল তা বিজেপি ধরে রাখতে পারবে না এবং সে ভোট তৃণমূল-বিরোধী বিক্ষোভে জোটের ঘরে জমা পড়বে। কংগ্রেসের ভোট অত সহজে বামপন্থীদের কাছে কেন আসবে, বিজেপি সমর্থকরা বিজেপি থেকে সরে দাঁড়ালেও তৃণমূলকে ছেড়ে কংগ্রেস আর সিপিএমকে কেন ভোট দিতে যাবেন এই সব প্রশ্নকে তাঁরা গ্রাহ্যই করতে চাননি।
ফলাফল দেখাচ্ছে জোটের ফলে ভোট বাড়লেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা তৃণমূলের ভোটকে টেক্কা দিতে পারেনি। অর্থাৎ তৃণমূল বিরোধী মেরুকরণ তৃণমূলের পক্ষে মেরুকরণকেও বাড়িয়ে দিয়েছে। নির্বাচনী গণিত বিশেষজ্ঞরা ভেবে দেখতে পারেন বিরোধী ভোটের মেরুকরণের এই তীব্রতা না থাকলে তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ও আসনসংখ্যা একই মাত্রায় পৌঁছাতো কিনা। বিরোধী ভোটের মেরুকরণের ছবিটা অবশ্যই সর্বত্র একরকম নয়। এক-তৃতীয়াংশ আসনে লড়ে কংগ্রেস ৪৪টি আসনে জয়লাভ করেছে, অন্যদিকে কংগ্রেসের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ আসনে লড়ে বামফ্রন্টের বিজয়ী প্রার্থীদের সংখ্যা ৩২। সাফল্যের হার দেখিয়ে দিচ্ছে সিপিএমের ভোট থেকে কংগ্রেস যে মাত্রায় লাভবান হয়েছে, সে তুলনায় কংগ্রেসের ভোট থেকে সিপিএমের লাভের অঙ্ক খুবই সামান্য।
আসন সমঝোতার গণিতের রাজনৈতিক রহস্যও বোঝা দুষ্কর। লোকসভা নির্বাচনে যখন অধিকাংশ আসনে চতুর্মুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল তখন জলপাইগুড়ি আসনে এগিয়ে ছিল সিপিএম। এবার জোটের নকশায় জলপাইগুড়ি আসনটি চলে যায় কংগ্রেসের হাতে এবং জেলায় মাত্র ওই একটি আসনেই জোট জয়যুক্ত হয়েছে। একইভাবে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় সূর্যকান্ত মিশ্র কংগ্রেস সমর্থন নিয়েও নিজের নারায়ণগড় আসনটি ধরে রাখতে পারলেন না, কিন্তু ২০১৪-র নির্বাচনে যে সবং কেন্দ্রে সিপিএম এগিয়ে ছিল সেখানে সিপিএমের ভোট দিয়ে কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়াকে জিতিয়ে দেওয়া হল।
ভোটের গাণিতিক বিশ্লেষণ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সিপিএম বা বামফ্রন্ট প্রার্থীদের আসনে কংগ্রেসের ভোট অনেক ক্ষেত্রে ভালোমাত্রায় তৃণমূলের দিকে চলে গিয়েছে বা এমনকি নোটার সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটিয়েছে, কিন্তু সিপিএম বা বামফ্রন্ট প্রার্থীদের জয়লাভের সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করেনি। উত্তরবাংলার বহু চর্চিত যে শিলিগুড়ি মডেল থেকে জোটের ফর্মুলা বেরিয়ে এল সেই উত্তরবাংলার পরীক্ষাগারেই জোট বড় ধাক্কা খেল। কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার জলপাইগুড়ি জেলা সহ উত্তরবাংলায় জোটের হিসেবকে পরাস্ত করে তৃণমূল কংগ্রেসের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। মালদহ বাদে অবশিষ্ট উত্তরবঙ্গে জোটের আসন সংখ্যা ১৪, তৃণমূলের ২৪। এমনকি বিগত লোকসভা নির্বাচনে রায়গঞ্জ ও মুর্শিদাবাদে যে সাফল্য বামফ্রন্ট পেয়েছিল জোটের জটে তাও হারিয়ে গেল।
বিজেপির ভোট লোকসভা থেকে অবশ্যই কমেছে, কিন্তু যতটা কমবে বলে জোটপন্থীরা আশা করেছিলেন, বহুক্ষেত্রেই ততটা কমেনি। এতে অবাক হওয়ার কোনো কারণ আছে কি? পশ্চিমবাংলায় বিজেপি ক্রমাগত সাংগঠনিক শক্তি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বাড়িয়ে চলেছে। মমতা ব্যানার্জীকে হারানোর তাগিদে সিপিএম-কংগ্রেস জোটের দিকে বিজেপির রাজনৈতিক-সাংগঠনিক ভিত্তি কেন সরে আসবে? লোকসভা নির্বাচনে মোদী হাওয়ায় যে ভোটাররা পদ্মফুলে আকৃষ্ট হয়েছিলেন তাঁদের একাংশের বিধানসভা নির্বাচনে জোড়াফুলে চলে যাওয়াটাই তো স্বাভাবিক ও বোধগম্য।
আসলে এবারের নির্বাচনে যে নির্মম রাজনৈতিক সত্য আবার স্পষ্টভাবে ফুটে উঠল তা হল শহুরে মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিত যুবসমাজের এক বড় অংশ তৃণমূলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও গ্রামাঞ্চলে কৃষক জনগণ ও খেটেখাওয়া নিম্নবিত্ত মানুষের ব্যাপক অংশ এখনও সিপিএম সম্পর্কে অত্যন্ত বিরক্ত ও বিক্ষুব্ধ এবং তৃণমূল সম্পর্কে যথেষ্ট মোহাচ্ছন্ন। আর এই রাজনৈতিক প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে আমাদের বার বার বামফ্রন্ট জমানার শেষ পর্যায়ে ফিরে যেতে হবে।
পঞ্চায়েতী দুর্নীতি ও সরকারী ঔদাসীন্যে রেশনব্যবস্থা যখন ভেঙে পড়ার মুখে, রেশন বিদ্রোহে গ্রামবাংলা তোলপাড়, একশ দিনের কাজের প্রকল্প আইন বানিয়ে কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার যখন নিজেকে গরিবের বন্ধু সাব্যস্ত করতে উদ্যত, তখনই পশ্চিমবাংলায় বুদ্ধবাবুর নেতৃত্বে সিপিএম 'শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ' বলে পুলিশ নামিয়ে বহুফসলি জমি অধিগ্রহণে নেমে পড়ল। নন্দীগ্রামে ঘটে গেল পুলিশ-ক্যাডার যৌথ আক্রমণে দু-দুটি গণহত্যা, লালগড়ে চলল যৌথ বাহিনী নামিয়ে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। ২০০৬ সালে বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর এভাবেই একদিকে ক্ষমতার ঔদ্ধত্য ও অন্যদিকে আনন্দবাজার থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমের হাততালিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে পশ্চিমবাংলার 'ব্র্যান্ড বুদ্ধ' শিল্পায়নের উন্মাদনায় ২০০৬ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে পশ্চিমবাংলায় ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পটভূমি রচনা করেছিল সিপিএম। অথচ সিপিএমের বঙ্গীয় নেতৃত্বের এক বড় অংশ এই দিবাসত্যকে তখনও স্বীকার করেননি, আর আজও মানতে নারাজ।
২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে আংশিক ধাক্কা ও ২০১১ সালের পূর্ণ বিপর্যয়ের তাঁরা একটাই কারণ খুঁজে বের করেছিলেন – কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়া ও রাজ্যে কংগ্রেসকে তৃণমূলের সঙ্গে জোট গঠনের দিকে 'ঠেলে দেওয়া'। ভুল সংশোধনের নামে তাঁরা তাই এবারের নির্বাচনের আগে এই একটি 'ভুলই' সংশোধন করে নিলেন। কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকার নেই তাই কেন্দ্রে সমর্থন ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না, রাজ্যে কংগ্রেসকে তৃণমূল থেকে আলাদা রেখে সিপিএমের সঙ্গে জোটবদ্ধ করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন এই নেতৃত্ব। যে কোনো কারণেই হোক কংগ্রেস-সিপিএমের এই জোটের কল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে আবার সেই ব্র্যান্ড বুদ্ধ নির্মাতা আনন্দবাজার গোষ্ঠীকেও ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেল। নিজের ভোট কংগ্রেসের ঘরে তুলে দিয়ে নিজে তৃতীয় স্থানে নেমে গিয়ে কংগ্রেসকে প্রধান বিরোধী দলের আসনে বসিয়ে দেওয়াকে জোটের স্বার্থে জরুরি আত্মত্যাগ হিসেবে সিপিএম যতই প্রচার করুক না কেন রাজনৈতিক শক্তির ভারসাম্য পরিবর্তনের নামে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ার কৌশল যে পুরোপুরি ব্যর্থ তা বুঝতে কারুরই অসুবিধে হওয়ার কোনো কারণ নেই।
সিপিএম পলিটব্যুরো নির্বাচন পরবর্তী প্রথম বৈঠকের পরে প্রকাশিত বিবৃতিতে জানিয়েছে যে পশ্চিমবাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ার কৌশল পার্টির রাজনৈতিক লাইন ও কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে, পার্টি লাইন ও কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পশ্চিমবাংলার মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে, সিপিএমের এককালের সবচেয়ে বড় দুর্গে এমনটা কী করে হল? সিপিএমের বিশাখাপত্তনম কংগ্রেসে গৃহীত লাইনে বলা আছে বিজেপি বিরোধিতার নামে কংগ্রেস বা শাসনক্ষমতায় থাকা বা প্রাধান্যমূলক অবস্থানে থাকা আঞ্চলিক দলগুলোর সঙ্গে সিপিএম কোনো আঁতাত বা বোঝাপড়ায় যাবে না। রাজ্যের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে রাজ্যভিত্তিক কৌশল নির্ধারণের প্রসঙ্গে বলা আছে তা যেন ব্যাপক বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। এর ঠিক বিপরীতে বামপন্থী ঐক্যকে শিকেয় তুলে পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়ে তোলা হল।
জোটপন্থী নেতারা কেউ কেউ বলছেন পশ্চিমবঙ্গে ৪০ বছর ধরে ক্ষমতায় না থাকার জন্য কংগ্রেসের শ্রেণীচরিত্রে পরিবর্তন ঘটে গেছে, তাই কংগ্রেসের সঙ্গে এরাজ্যে জোট গড়তে নাকি কোনো অসুবিধে নেই। কেউ কেউ বিশাখাপত্তনম কংগ্রেসে গৃহীত লাইনে অ-সাধারণ পরিস্থিতিতে নমনীয় কৌশলের যে কথা বলা আছে সেই যুক্তি দেখাচ্ছেন। তাই যদি হবে তাহলে খোলাখুলি সে কথা বলা হল না কেন? অ-সাধারণ পরিস্থিতি ও নমনীয় কৌশলের কথা নির্বাচনের আগে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য কমিটির সিদ্ধান্তে কেন সরাসরি উল্লেখ করা হল না?
কেন বলা হল কংগ্রেসের সঙ্গে যে বোঝাপড়া হচ্ছে তা কোনো আঁতাত বা রাজনৈতিক জোট নয়, নীচুতলা থেকে জনগণের ইচ্ছায়, জনগণের দাবিতে, জনগণের চাপে গড়ে ওঠা মানুষের জোট? অথচ বাংলার মানুষ পরিষ্কার দেখলেন দু-দলের নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করে আসন সমঝোতাকে মূর্ত রূপ দিলেন এবং গোটা রাজ্য জুড়ে যৌথ প্রচার চলল। বলা হল বাইরে থেকে আসা কেন্দ্রীয় নেতারা কংগ্রেসের সঙ্গে একই মঞ্চে সভা বা একযোগে প্রচার করেননি, তাই এই জোট রাজনৈতিক জোট নয়। নিছক নীচুতলার স্থানীয় বোঝাপড়া। কোন দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোরকে এভাবে ঘরের নেতা ও বাইরে থেকে আসা নেতা বলে ভাগ করা যায়? মঞ্চ ভাগাভাগি কে করলেন আর কে করলেন না এই কূটনৈতিক তর্ক দিয়ে রাজনীতির চরিত্র নির্ধারণ করা যায়? নির্বাচনে ক্ষমতায় এলে জোটের সরকার তৈরি হবে এই ক্ষমতা ভাগাভাগির কথা ঘোষণা করার পর কে মঞ্চ ভাগ করে নিলেন আর কে করলেন না তাতে কী এসে যায়?
জোটের নির্বাচনী ফলাফলের সমীক্ষা করতে গিয়ে এখন কেউ কেউ বলছেন জোটের ব্যাপারটা জনগণকে ঠিক বোঝানো যায়নি। কী অদ্ভুত কথা। নির্বাচনের আগে বলা হল জনগণের দাবিতে, জনগণের চাপে জোট, আর নির্বাচনের পরে বলা হচ্ছে জনগণকে বোঝানো গেল না! নির্বাচন চলা কালে, এমনকি ফলাফল ঘোষিত হওয়ার প্রাকমুহূর্ত পর্যন্ত সূর্যকান্ত মিশ্র বললেন জোট ডবল সেঞ্চুরি করবে। এখন জোটের পক্ষে যু্ক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলছেন জোট না হলে সিপিএম ডবল ডিজিট বা দুই অঙ্ককেও ছুঁতে পারত কিনা সন্দেহ। এখন শোনা যাচ্ছে এই সংখ্যা নাকি পাঁচ হয়ে যেত। স্বাধীনভাবে লড়লে দু-অঙ্কের নীচে আর কংগ্রেসকে সঙ্গী পেলে ডবল সেঞ্চুরি – মতাদর্শের কথা দূরে থাক, পশ্চিমবাংলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সিপিএম ও কংগ্রেসের প্রকৃত শক্তির মূল্যায়ন সম্পর্কে বাস্তবোচিত বিবেচনাবোধও কি আজ সিপিএম নেতৃত্বের কাছে এতই কঠিন হয়ে পড়েছে? এত ফাঁপা বিশ্লেষণের উপর দাঁড়িয়ে বামপন্থী রাজনীতি কখনও পরিচালিত হতে পারে?
নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগে জোটপন্থীরা যা দাবি করলেন তা তো চূড়ান্ত ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। এখন জোটের পক্ষে ওকালতি করে এই নেতারা যা বলছেন তা যদি তর্কের খাতিরে মেনে নেওয়া যায় তাহলে সেটা নিজেই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হিসেবে পরিগণিত হবে। যে সিপিএম পার্টি ৩৪ বছর লাগাতার ক্ষমতায় থাকল, আজ ক্ষমতা থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর তার ক্রমাগত শক্তিক্ষয়ের হার এত বেশি যে স্বাধীনভাবে নির্বাচনে লড়লে দু-অঙ্কের আসন পাওয়া যাবে কিনা ভাবতে হচ্ছে। এই দুর্বলতা ঢাকার জন্য যদি জোটনীতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে, তাহলে মানতেই হবে যে তাতে সিপিএমের চেয়ে কংগ্রেসই অনেক বেশি লাভবান হয়েছে।
লোকসভা নির্বাচনে এককভাবে লড়ে বামফ্রন্ট প্রার্থীরা যে ২৮টি বিধানসভা আসনে এগিয়ে ছিলেন তার মধ্যে ৬টি আসন বামপন্থীরা বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের হাতে তুলে দিয়েছেন – জলপাইগুড়ি, কালিয়াগঞ্জ, রানীনগর, মুর্শিদাবাদ, বাদুড়িয়া, সবং। বিপরীতে কংগ্রেস ২০১৪ সালে যে ২৮টি আসনে এগিয়ে ছিল তার মধ্যে মাত্র একটি আসনই (মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকল) এবার সিপিএমের পক্ষে এসেছে, তাও কংগ্রেস প্রার্থীকে 'বন্ধুত্বমূলক প্রতিদ্বন্দ্বিতায়' পরাজিত করে। ২০১৪ সালে এগিয়ে থাকা আসনের ২৮টির মধ্যে ২২টি আসনকে ধরে রাখা ছাড়াও বামফ্রন্টের সমর্থনের ভিত্তিতে কংগ্রেস আরও ২২টি আসন বাড়িয়ে ৪৪টি আসনে পৌঁছে গেছে, কিন্তু ২০১৪ সালে এগিয়ে থাকা বামফ্রন্টের ২৮টি আসনের মধ্যে ১২টি আসন জোট সত্ত্বেও চলে গিয়েছে তৃণমূলের দখলে।
নির্বাচনী ফলাফল দেখিয়ে দিচ্ছে দু-একটি জেলা বাদ দিলে গোটা রাজ্য জুড়ে রাজনৈতিক ভারসাম্য তৃণমূলের পক্ষে ঝুঁকে রয়েছে। এর ভিত্তিতে কেউ কেউ বলছেন সারদা কেলেঙ্কারি বা দুর্নীতির প্রশ্ন সেভাবে রাজনৈতিক প্রশ্ন হিসেবে দাগ কাটতে পারেনি। নারদ ঘুষ ভিডিও অপারেশনের তেমন প্রভাব না পড়লেও সারদা কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়নি একথা অবশ্যই বলা যাবে না। সারদা কেলেঙ্কারির অন্যতম দুই খলনায়ক মদন মিত্র ও শ্যামাপদ মুখার্জী এই নির্বাচনে পরাজিত। সব মিলিয়ে মন্ত্রীসভার আটজন সদস্য নির্বাচনে পুনর্নির্বাচিত হতে ব্যর্থ। মুখ্যমন্ত্রী সহ অন্য বহু মন্ত্রী ও নেতা যাঁরা জিতেছেন তাঁদের জয়ের ব্যবধান ২০১১ সালের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
দুর্নীতি বা সন্ত্রাসের প্রশ্ন জনমানসে কতটা ধাক্কা দিয়েছে তা নিয়ে বিভিন্নভাবে বিশ্লেষণ হতে পারে, কিন্তু বামপন্থী কর্মীদের কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল এর বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে দোসর করে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানো যায় না একথা তো বলাই বাহুল্য। সুপ্রীম কোর্টের চাপে অবশেষে মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করলেও দীর্ঘদিন ধরে জেলে থেকেও মদন মিত্র কী করে বহাল তবিয়তে মন্ত্রীসভায় থেকে গেলেন এটা পশ্চিমবাংলায় দুর্নীতি-বিরোধী আন্দোলনের কাছে, বামপন্থী আন্দোলনের কাছে একটা বড় প্রশ্ন। দুর্নীতির চেয়েও বোধ করি আরও জোরালো প্রশ্ন সন্ত্রাস মোকাবিলা ও গণতন্ত্র রক্ষা। গণতন্ত্রের প্রশ্নেই ১৯৭৭ সালে বামপন্থীরা ক্ষমতায় এসেছিলেন, কিন্তু ইতিহাসের নির্মম প্রহসনে ২০১১ সালে গণতন্ত্রের নামেই পশ্চিমবাংলায় সরকার পরিবর্তন হয়। আর তাই বিগত পাঁচ বছরে গণতন্ত্রের প্রশ্নে সিপিএম সরব হলেও তা সিপিএম জমানার সন্ত্রাস ও দলতন্ত্রের স্মৃতিকেই আবার উস্কে দিয়েছে। সাম্প্রতিক অতীতের বড় বড় ভুলভ্রান্তি ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্য আন্তরিকভাবে আত্মসমালোচনা না করলে গণতন্ত্রের প্রশ্নে সিপিএমের পক্ষে বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরে পাওয়া অসম্ভব।
দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের কারণে একদিকে যেমন তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করেছে, অন্যদিকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে বিভিন্ন অনুদান ও সহায়তা প্রকল্প এবং পরিকাঠামোগত কিছু উন্নয়নের ফলে জনগণের একাংশের মধ্যে সরকার সম্পর্কে আস্থা এবং আশারও সঞ্চার হয়েছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে যে সংবাদমাধ্যম তৃণমূল শাসনের সমালোচনায় সরব হয়ে উঠেছিল, ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর আজ আবার সেই সংবাদ মাধ্যমেই মমতা-মহিমা কীর্তনে বুদ্ধিজীবীদের মুখর হতে দেখা যাচ্ছে। দুটি কথা আজ বিশেষভাবে চর্চিত। এক, পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে 'ভদ্রলোক' সমাজের চিরাচরিত আধিপত্যের বিপরীতে মমতা ব্যানার্জী হয়ে উঠেছেন নিম্নবর্গের মানুষের উত্থানের প্রতীক; দুই, তৃণমূল সরকার জনকল্যাণমুখী উন্নয়নের এক সফল মডেল রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করেছে। এই দুটি দাবিকেই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
গ্রাম-শহরে গরিব শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস এক ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে তা অনস্বীকার্য। এক দশক আগেও গ্রামাঞ্চলে এই ব্যাপক প্রভাব ছিল বামপন্থীদের। দীর্ঘদিনের শ্রেণীসংগ্রাম ও গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই গণভিত্তি, গণপ্রভাব গড়ে উঠেছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে সরকার ও দল মিলেমিশে প্রায় একাকার হয়ে যাওয়া ক্ষমতাতন্ত্রের মাধ্যমে এই গণসমর্থন ও প্রভাবকে স্থায়ী নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা, অন্যদিকে শ্রেণীসংগ্রাম ও গণআন্দোলনে শিথিলতা ও আনুষ্ঠানিকতা, আর সবচেয়ে বড় কথা সরকারের দিশা ও অগ্রাধিকারে স্পষ্ট কর্পোরেটমুখী পরিবর্তন-এর ফলে গণভিত্তিতে যে ক্ষয় ও ফাটল দেখা দেয় তা আজ মমতা ব্যানার্জী এবং তৃণমূল কংগ্রেসের গণসমর্থন এবং রাজনৈতিক পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
পশ্চিমবাংলায় শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যমেই সামাজিক-রাজনৈতিক জগতে বড় পরিবর্তন ঘটেছে, হিন্দী বলয়ের মতো আলাদা করে সামাজিক ন্যায় রাজনীতির ধারা পশ্চিমবাংলায় গড়ে ওঠেনি। সামাজিক দৃষ্টিতে তৃণমূল কংগ্রেসের আবির্ভাবের আগে অবধি কংগ্রেস ও বাম আমলে বাংলার রাজনীতিতে একইভাবে অভিজাত আধিপত্য বজায় থেকেছে এমন বক্তব্যের কোনো ঐতিহাসিক বাস্তব ভিত্তি নেই। শ্রেণীগতভাবে রাজনৈতিক ভারসাম্য পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন স্তরের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের সামাজিক পৃষ্ঠভূমিতেও অনিবার্যভাবেই পরিবর্তন ঘটেছে। জোতদার-জমিদারের আধিপত্যের রাজনীতি ও শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের রাজনীতির সামাজিক গঠন ও অভিব্যক্তি অবশ্যই এক জায়গায় আটকে থাকেনি।
কিন্তু অপারেশন বর্গার পর সিপিএম আমলে ভূমিসংস্কার কর্মসূচী আর না এগোনোর ফলে অবশ্যই গরিব কৃষক, ক্ষেতমজুর বা সামাজিক ও শ্রেণীগত বিচারে যাঁদের নিম্নবর্গ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে তাঁদের সামাজিক-রাজনৈতিক উত্থানের প্রক্রিয়াটিও বাধাপ্রাপ্ত হয়। আর বিশেষ করে বাম জমানার শেষ পর্যায়ে পঞ্চায়েতী দুর্নীতি, প্রোমোটার রাজ ও শিল্পায়নের নামে কর্পোরেট তুষ্টিকরণের নীতির ফলে শ্রেণীগত ও সামাজিক বিচারে নিম্নবর্গের সঙ্গে বাম জমানার এক ক্রমবর্ধমান দূরত্ব তৈরি হয়, বামপন্থী রাজনীতির আকর্ষণ ও প্রভাব ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং বাম-বিরোধী শিবির দীর্ঘদিনের বামপন্থী গণভিত্তির মধ্যে একটা বড় জায়গা করে নেয়।
বাস্তব ছবিটা এটাই। এই রাজনৈতিক বাস্তবিকতার উপর রং চড়িয়ে মমতা ব্যানার্জীকে কেন্দ্র করে নিম্নবর্গের উত্থানের কাহিনী গড়ে তুললে তা হবে প্রতিবেশী রাজ্য বিহারের লালুপ্রসাদের তথাকথিত 'সামাজিক ন্যায় বিপ্লবের' মতোই আর একটি কল্পকথা। অবশ্যই নিম্নবর্গের মধ্যে মমতা ব্যানার্জীর আকর্ষণ ও সমর্থনের আজকের এই বাস্তবচিত্রকে স্বীকার করে এই প্রক্রিয়াকে পাল্টানোর জন্য বামপন্থীদের আবার শ্রেণী রাজনীতি ও শ্রেণীসংগ্রামে মনোযোগী হতে হবে। আর শ্রেণী রাজনীতি ও শ্রেণী সংগ্রাম বলতে অবশ্যই নিছক আর্থিক সংগ্রাম নয়, যাবতীয় নিপীড়ন ও উপেক্ষার বিরুদ্ধে সামাজিক সম্মান ও অগ্রগতি অর্জনের প্রশ্নটিকেও শ্রেণী রাজনীতি ও শ্রেণী সংগ্রামের অবিভাজ্য ও অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবেই দেখতে হবে।
জনকল্যাণ ও উন্নয়নের রাজনীতির প্রশ্নটি এবার বিবেচনা করা যাক। পশ্চিমবঙ্গে যে প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে মমতা ব্যানার্জী আজ বড় সমর্থন আদায় করে নিয়েছেন, এই প্রকল্পগুলো আজ কমবেশি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেই বিভিন্ন নামে চালু রয়েছে, কেন্দ্র সরকারও এ ধরনের একগুচ্ছ প্রকল্প বিভিন্ন নামে চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রকল্পগুলোতে সরাসরি কিছু অনুদানের আশু প্রতিশ্রুতি থাকে বলে এই প্রকল্পগুলোকে ঘিরে জনগণের মধ্যে উৎসাহ ও আকাঙ্খা যেমন দেখা যায় তেমনি বিক্ষোভ এবং অসন্তোষ ধূমায়িত হতেও আমরা বার বার দেখেছি। বিগত তিন দশকে একদিকে যেমন পঞ্চবার্ষিকী যোজনাকে খাটো করতে করতে অবশেষে তুলে দেওয়া হয়েছে এবং অর্থব্যবস্থার সমস্ত লাভজনক ক্ষেত্র দেশী-বিদেশী কর্পোরেট হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে, জল-জঙ্গল-জমি ও খনিজ সম্পদের উপর জনগণ ক্রমেই অধিকার হারিয়েছে এবং কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ, লুণ্ঠন ও মুনাফার জালে প্রাকৃতিক সম্পদ বন্দী হয়ে পড়েছে, অন্যদিকে তারই পাশাপাশি ও পরিপূরক হিসেবে সম্পদ ও অধিকার থেকে বঞ্চিত ও অসংগঠিত জনগণকে অনুদানের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ করে ফেলার প্রক্রিয়া চলেছে।
কিন্তু ২১ শতকে বেসরকারীকরণ, বাজারিকরণ ও বিশ্বায়নের নতুন অর্থনীতিকে আড়াল করতে ভারতীয় শাসকশ্রেণী ও কেন্দ্রীয় সরকার যখন এই অনুদানের জাল বিছিয়ে গণঅসন্তোষকে নিয়ন্ত্রিত ও প্রশমিত করার চেষ্টা করে গেছে, তখনই সিপিএম 'কৃষি অামাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ' বলে নতুন নীতির নেতৃত্বে কর্পোরেট পুঁজিকে খুশি করে শিল্পায়নের ফানুস ওড়াতে মশগুল হয়ে উঠেছে। সিপিএম শাসনের শেষ পর্যায়ে পঞ্চায়েত উপেক্ষিত থেকেছে এবং অনুদানভিত্তিক প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণকে আশু সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার পরিবর্তে বড় কারখানা, বড় শিল্প, নামী-দামি কোম্পানির পুঁজি বিনিয়োগের গল্প শোনাতেই (আসলে সস্তা জমি, বিদ্যুৎ ও যাবতীয় কর ছাড়ের মাধ্যমে যে বিপুল অনুদান এবং অনিয়ন্ত্রিত মুনাফার ছাড়পত্র কর্পোরেট হাতে তুলে দেওয়া হয় তা এই তথাকথিত পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে অনেক বেশি) ব্যস্ত থেকেছে বুদ্ধবাবুর বামফ্রন্ট সরকার।
এই ফাঁকা মাঠে মমতা ব্যানার্জী তাঁর বিভিন্ন জনমোহিনী খয়রাতি প্রকল্পের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। এই প্রকল্পগুলোকে সঠিকভাবে সমালোচনা ও মোকাবিলা করা, প্রকল্পকে ঘিরে দলবাজি ও দুর্নীতিকে উন্মোচিত করা এবং বুনিয়াদী গণতান্ত্রিক সংস্কার ও অধিকারের আন্দোলন গড়ে তোলার পরিবর্তে সিপিএম এখনও ন্যানো কেন হল না, বড় কোম্পানিরা কেন এল না এই সমস্ত প্রশ্ন-বোমা ছুঁড়তেই ব্যস্ত থেকেছে। নির্বাচনের দিন ঘোষণার আগে সিঙ্গুর থেকে শালবনি পদযাত্রা, প্রচার পর্বে হলুদ ন্যানোতে চড়ে সিঙ্গুরে সিপিএম প্রার্থীর ভোটপ্রচার বা রাহুল গান্ধীর পার্ক সার্কাসের জনসভায় কারখানা খোলার নামে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নিষ্ফলা আস্ফালন – এসবই দেখিয়ে দিল পশ্চিমবাংলার সিপিএম নেতৃত্ব বাংলার মাটিতে হারিয়ে যাওয়া রাজনৈতিক জমি, গণভিত্তি ও উদ্যোগ ফিরে পাওয়ার জন্য নতুন করে পথে নামার পরিবর্তে এখনও সেই ব্যর্থ সিঙ্গুর মডেলেই আটকে রয়েছে।
২০১১ সালের পরাজয়ের পরে পশ্চিমবাংলায় সিপিএম ও বামফ্রন্টের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল ৩৪ বছরের ক্ষমতার আসন থেকে গণআন্দোলনের মেঠো পথে নেমে এসে বিরোধী দল হিসেবে নিজেকে আবার প্রতিষ্ঠিত করা। কেরালায় বাধ্যতামূলকভাবে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সিপিএমকে এই অনুশীলনই করতে হয়। দেশ জুড়ে বামপন্থী কর্মীবাহিনীর কাছে এটাই বামপন্থী রাজনীতির মূল রাস্তা। সরকার পরিচালনার জন্য ক্ষমতা নির্ভর বাম ঐক্যের চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে এসে গণসংগ্রামের পথে বৃহত্তর সংগ্রামী বাম ঐক্য গড়ে তোলার আকাঙ্খায় পশ্চিমবাংলায় বামপন্থী কর্মীবাহিনী ও জনগণ যখন তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির বিরুদ্ধে নতুন আশা ও দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেছিলেন তখনই সরকার গড়ার মিথ্যা স্বপ্ন নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধলেন সিপিএম নেতৃত্ব। বাংলার বামপন্থী রাজনীতি ও কর্মীবাহিনীর সাথে এ এক নতুন প্রবঞ্চনা। আর এর দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া হল জনগণ ও কর্মীদের উপর। বলা হল জোট না হলে আর ক্ষমতায় ফিরে আসার আশু সম্ভাবনা না দেখাতে পারলে নাকি কর্মীদের আর রাস্তায় নামানো যাবে না। বামপন্থী কর্মী ও জনগণের উপর নেতৃত্বের এত বড় অনাস্থার উদাহরণ কি আগে আমরা দেখেছি?
আজ জোটপন্থী নেতাদের অনেককেই বলতে শোনা যাচ্ছে কংগ্রেসের সাথে জোট করে তৃণমূলকে হারানো না গেলেও বিজেপিকে নাকি ঠেকানো গেছে। আজ যখন ২০১১ সালের তুলনায় (বিধানসভা নির্বাচনের তুলনা বিগত বিধানসভার সঙ্গেই করা উচিত) বিজেপি বাংলার বুকে ভোটের হিসেবে প্রায় দ্বিগুণ শক্তিবৃদ্ধি করেছে, তিনটি আসন জিতে বিধানসভায় রাজ্য রাজনীতির এক বিকাশমান রাজনৈতিক ধারা হিসেবে সামনে চলে এসেছে তখন বিজেপিকে ঠেকিয়ে রাখার মিথ্যে স্তোকবাক্য না শুনিয়ে সিপিএম নেতৃত্বের বোঝা উচিত যে বামপন্থার পিছু হটার ফলে বিজেপির এগিয়ে যাওয়ার রাস্তাই আরও প্রশস্ত হয়েছে। যে কংগ্রেস কেন্দ্রে এবং রাজ্যে রাজ্যে বিজেপির হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়েছে তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিজেপিকে রোখার কথা বলা বাতুলতা ছাড়া আর কিছু নয়। বিজেপির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে সংগ্রামী জনগণ – কৃষকরা খারিজ করে দিয়েছেন ভূমি অধিগ্রহণের অর্ডিন্যান্স, শ্রমিকরা প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রভিডেন্ট ফান্ডে কর চাপানো ও বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা জারির ফরমান, পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়ে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন প্রথিতযশা সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা আর হায়দ্রাবাদ থেকে জেএনইউ, যাদবপুর থেকে বেনারস, একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর থেকে শহরের রাজপথে সংঘ পরিবারের হামলার বিরুদ্ধে ব্যারিকেড গড়ে তুলেছেন ভগৎ সিং ও আম্বেদকারের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছাত্রসমাজ।
পশ্চিমবঙ্গে ২০১৪ সালের মোদীহাওয়ার তুলনায় বিজেপির যেটুকু ভোট কমেছে তা সিপিএম-কংগ্রেস জোটের সৌজন্যে নয়, বরং দেশজুড়ে এবং পশ্চিমবাংলার বুকে চলমান এই বামপন্থী প্রগতিশীল আন্দোলন ও আলোড়নের সুবাদে। বিজেপিকে পশ্চিমবাংলায় নিছক তৃণমূল-বিরোধী একটি দল হিসেবে দেখা এবং বিরোধী ভোটের ঐক্যের চাপে তাকে কোণঠাসা বা দুর্বল করে দেওয়ার পরিকল্পনা মুর্খের স্বর্গে বসেই করা যায়, বাস্তব রাজনীতিতে এই অন্তঃসারশূন্য অরাজনৈতিক গাণিতিক বিশ্লেষণ বামপন্থী রাজনীতির জন্য কেবল বিপদই ডেকে আনতে পারে। সেই বিপদের এক প্রকাশ্য অভিব্যক্তি পশ্চিমবাংলার এবারের নির্বাচনেই আমরা দেখলাম দার্জিলিং জেলায়। তৃণমূলকে ঠেকানোর নামে সিপিএম খোলাখুলি পাহাড়ের বুকে তিনটি আসনেই বিজেপির সহযোগী দল গোর্খা জনমুক্তি মোর্চাকে সমর্থন করে বসল। এই চূড়ান্ত বিচ্যুতি ও আত্মসমর্পণের বিপরীতে সঠিক বামপন্থী কৌশল তুলে ধরলেন দু'দশক আগে সিপিএম থেকে বেরিয়ে আসা সিপিআরএম-এর কমরেডরা। বিজেপি-জনমুক্তি মোর্চা জোট ও তৃণমূল শিবির উভয়ের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তাঁরা উঠে এলেন উল্লেখযোগ্য তৃতীয় শক্তি হিসেবে।
মজার কথা হল পশ্চিমবাংলায় যখন সিপিএম কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে বিজেপিকে রোখার কথা বলছে তখনই কেরালায় সীতারাম ইয়েচুরি কংগ্রেস ও আরএসএসের মধ্যে পরোক্ষ বোঝাপড়া ও গোপন আঁতাতের অভিযোগ তুলেছেন। কেরালার বুকে এবার সিপিএম ও বাম-গণতান্ত্রিক মোর্চার ব্যাপক জয়ের পেছনে শুধু কংগ্রেস বিরোধী বিক্ষোভ নয়, বিজেপির সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট রাজনীতির মোকাবিলা করার নির্দিষ্ট তাগিদেরও যথেষ্ট অবদান রয়েছে।
তেভাগা আন্দোলন, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের খাদ্য আন্দোলন, নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান, ষাটের দশকের শেষ ও সত্তরের দশকের শুরুতে বিপ্লবী স্পর্ধায় উজ্জীবিত ছাত্র-যুবদের বিরাট আলোড়নের সূত্র ধরে এবং সিদ্ধার্থ জমানার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের তীব্র তাগিদের উপর ভিত্তি করেই ১৯৭৭ সালে বামপন্থীরা সবচেয়ে বড় ও বিশ্বাসযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে রাজ্য রাজনীতিতে উঠে এসেছিলেন। অপারেশন বর্গা, আংশিক ভূমিসংস্কার ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সেই বাম রাজনীতি অর্জন করেছিল এক দৃঢ় গণভিত্তি।
২০১১ সালের পরাজয় সেই ভিত্তিকে দুর্বল করেছিল ঠিকই, কিন্তু ২০১৬ সালের আত্মসমর্পণবাদী, আত্মহননকারী কৌশল ও নিজেরা ভুল সংশোধন না করে জনগণকে ২০১১ সালের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে বলার উদ্ধত, উন্নাসিক রাজনীতি বাংলার বামপন্থী শিবিরকে আরও বড় সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। বামফ্রন্ট ইতিমধ্যেই জোটের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে, বামপন্থী ভোট নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে এসেছে কংগ্রেস। শোনা যাচ্ছে কংগ্রেস বিধায়কদের একাংশ নাকি তৃণমূলে যোগ দিতে পা বাড়িয়ে আছেন, আর ২০১৯ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে সম্ভাব্য রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাসে কংগ্রেস জাতীয় স্তরে যদি তৃণমূল কংগ্রেসকেই নতুন জোটসঙ্গী হিসেবে পেতে চায় তাতেও অবাক হওয়ার কোনো কারণ ঘটবে না।
এই অবস্থায় পশ্চিমবাংলার সচেতন সংগ্রামী বামপন্থী জনগণ ও কর্মীবাহিনীকে অবশ্যই এই জোটের জট থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তৃণমূলী সন্ত্রাস ও বিজেপির বিভাজনকারী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে বামপন্থী চেতনা ও ঐক্য নিয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে, গণতন্ত্র ও জনজীবনের প্রতিটি প্রশ্নে জনগণের সঙ্গে থেকে এগিয়ে যেতে হবে শ্রেণীসংগ্রাম ও গণআন্দোলনের পথে। ভ্রান্ত নির্বাচনী কৌশল ও বিপরীত নির্বাচনী ফলাফলে হতোদ্যম না হয়ে, আসুন আমরা বর্তমান সন্ধিক্ষণকে নতুন সম্ভাবনা ও সংগ্রামের সাহস এবং আশা নিয়ে আঁকড়ে ধরি।
দীপঙ্কর ভট্টাচার্য,
সাধারণ সম্পাদক,
সিপিআই(এমএল) লিবারেশন