(১৯৯১ সালে প্রকাশিত একটি পুস্তিকা)
সুবিধাবাদী ও বিপ্লবী ধারার মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ভাঙ্গন হয় ১৯৬৪ সালে এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) নামে একটি নতুন পার্টি গঠিত হয়। কিন্তু বিপ্লবী ধারার প্রতিনিধিদের এটি উপলদ্ধি করতে খুব বেশি সময় লাগেনি যে আন্দোলনের মধ্যপন্থী ধারার প্রবক্তারাই নতুন পার্টির নেতৃত্ব দখল করেছে এবং এই নেতৃত্ব সুবিধাবাদী ধারা অনুসরণ করতে বদ্ধপরিকর। সমগ্র পার্টি জুড়ে এক আন্তঃপার্টি সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল। অবশ্য কেন্দ্রীভূতভাবে এই সংগ্রাম চালিয়ে গেলেন কমরেড চারু মজুমদার ১৯৬৫-৬৬-র মধ্যে লেখা তাঁর বিখ্যাত আটটি দলিলের মাধ্যমে।
দেশব্যাপী গণআন্দোলন ফেটে পড়ার এই পর্যায়ে উত্তর-সাতচল্লিশ ভারতীয় রাজনীতি প্রথম গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিল। পশ্চিমবাংলায় সিপিআই(এম)-এর আধিপত্য সমন্বিত যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসীন হল এবং পার্টি নেতৃত্বের রণনীতিগত দিক থেকে সুবিধাবাদী পথে উত্তরণ সম্পূর্ণ হল। এর বৈপরীত্যে, বিপ্লবী ধারার প্রতিনিধিরা আন্তঃপার্টি সংগ্রামের সীমানা পেরিয়ে গণসংগ্রামগুলিকে, বিশেষত কৃষক আন্দোলনকে, বিপ্লবী রণনৈতিক গতিধারায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালালেন। পার্টির মধ্যে চারু মজুমদারের নেতৃত্বাধীন অংশটি দ্বারা সংগঠিত নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান সিপিআই(এম)-এর মধ্যে দুই রণনৈতিক অবস্থান ও কৌশলগত লাইনের মধ্যে প্রথম চূড়ান্ত সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করল।
সমাজগণতন্ত্রী বিশ্বাসঘাতকতার চিরাচরিত প্রথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ক্ষমতাসীন পার্টি বুলেট দিয়েই প্রত্যুত্তর দিল এবং পার্টির ভিতরকার চাপা বিদ্রোহ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল। সারা ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্টরা পার্টি থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে সারা ভারত বিপ্লবী কমিউনিস্টদের সমন্বয় কমিটি (এআইসিসিসিআর) নামে নতুন কেন্দ্রের চারপাশে সমবেত হওয়ার সাথে সাথে সিপিআই(এম)-এর মধ্যে প্রথম বড় ধরনের ভাঙ্গন ঘটল। ১৯৬৯ সালের ২২ এপ্রিল সিপিআই(এমএল)-এর গঠন এই নতুন কেন্দ্রকে এক সংগঠিত ও কেন্দ্রীভূত রূপ প্রদান করল। ১০৭০ সালে মে মাসে কলকাতায় সিপিআই(এমএল)-এর প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় এবং কমরেড চারু মজুমদার ২১ জন সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
পরবর্তী দু-বছরের ইতিহাস হল ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে অতুলনীয় বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগের কাহিনী। চীন বিপ্লবের আদলে গ্রামাঞ্চলের নির্বাচিত এলাকাগুলিতে গেরিলা যুদ্ধ, লালফৌজ ও ঘাঁটি এলাকা গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা চালানো হল। এর পাশাপাশি সহায়ক আন্দোলন হিসাবে বিশেষত পশ্চিমবাংলায় ও কলকাতা শহরে ছাত্র ও যুবদের এক শক্তিশালী আন্দোলন বিকশিত হয়েছিল এবং এই আন্দোলন তথাকথিত বাংলার নব জাগরণের সময় থেকে গড়ে ওঠা শাসক শ্রেণীর মতাদর্শের সমগ্র ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল।
অবশ্য, চমকপ্রদ বিপ্লবী প্রাণশক্তি এবং তীব্রতা সত্ত্বেও সিপিআই(এমএল) আন্দোলনের এই প্রথম পর্যায় ভারতীয় সমাজের বিপ্লবীকরণের জটিল সমস্যার বিশদ ও সুসংহত সমাধান দিতে পারেনি। অভূতপূর্ব রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মধ্যে আন্দোলন শীঘ্রই বিপর্যয় ও ধাক্কার মুখে পড়ে।
১৯৭২-এর মাঝামাঝি এসে গোটা পার্টি প্রায় পঙ্গু হয়ে গেল। সমগ্র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কার্যত শেষ হয়ে গিয়েছিল। অবশিষ্ট পার্টি শক্তিগুলি বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডিত অবস্থায় পড়ে গেল। আর পার্টি লাইনের প্রশ্নে চারদিকে বিরাজ করছিল বিভ্রান্তি।
এই সন্ধিক্ষণে, ১৯৭৪-এর ২৮ জুলাই কমরেড চারু মজুমদারের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে একটি নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হল। এই কমিটি গঠিত হয় মাত্র তিনজন সদস্যকে নিয়ে – সাধারণ সম্পাদক কমরেড জহর এবং কমরেড বিনোদ মিশ্র ও কমরেড রঘু (স্বদেশ ভট্টাচার্য)। এই নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতি আনুগত্য দেখাল পুনর্গঠিত বিহার রাজ্য কমিটি, যে কমিটি ভোজপুর ও পাটনা জেলার কয়েকটি ব্লকের বিকাশমান কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিল, আর আনুগত্য দেখাল নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গ নেতৃত্বকারী টিম যা তখন পার্টিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম করে চলেছে এবং পূর্ব উত্তরপ্রদেশ ও দিল্লীর কমরেডদের একাংশ।
যদিও খুব শীঘ্রই পার্টি আবার এক বড় ধাক্কা খেল, বিহারে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে পার্টির বহু নেতা, ক্যাডার ও যোদ্ধা নিহত হলেন। ১৯৭৫-এর নভেম্বরে পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড জহরও ভোজপুরের এক গ্রামে পুলিশী আক্রমণের মোকাবিলায় শহীদের মৃত্যু বরণ করলেন। কমরেড বিনোদ মিশ্র সাধারণ সম্পাদক হলেন, আর ১৯৭৬-এর ফেব্রুয়ারি মাসে বিহারের গয়া জেলার একটি গ্রামে অনুষ্ঠিত হল পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস। পার্টি কংগ্রেস ১১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত করল, কমরেড বিনোদ মিশ্র হলেন সাধারণ সম্পাদক। এই পার্টিই পর্যায়ক্রমে তার ইংরেজি কেন্দ্রীয় মুখপত্রের নামানুসারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে।
১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আমরা মূলত পুরোনো লাইনই অনুসরণ করেছিলাম, বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমণ এবং বিপ্লবী কমিটিগুলির মাধ্যমে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা সংগঠিত করার উপর। বিহারের ভোজপুর ও পাটনা জেলা, পশ্চিমবাংলার নকশালবাড়ি ও বাঁকুড়া জেলা এবং উত্তরপ্রদেশের গাজিপুর ও বালিয়া জেলায় আন্দোলনকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য লাগাতার প্রচেষ্টা চালানো হল। কিন্তু বীরত্বপূর্ণ কাজকর্ম ও মহান আত্মত্যাগ সত্ত্বেও পার্টি লাইন স্পষ্টতই ছিল বাম হঠকারী (Left-Adventurist) চরিত্রের এবং গণউদ্যোগের দ্বারকে কোনো উল্লেখযোগ্য মাত্রায় উন্মুক্ত করতে এই লাইন ব্যর্থ হয়েছিল। আমাদের কঠোর প্রচেষ্টাগুলির ফসলকে সংহত করতেও পার্টি পারেনি।
সমগ্র দেশবাসীর কাছে ঐ দিনগুলি ছিল চরম নিপীড়নের অন্ধকারময় দিন, যাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছিল জরুরি অবস্থার মাধ্যমে। আর আমাদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ, বিশেষত ভোজপুরে, বাস্তবে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের আন্দোলনের অংশ হয়ে গিয়েছিল। তত্ত্বগত দিক থেকেও পার্টি কংগ্রেস বিরোধী এক যুক্তমোর্চা গড়ে তোলার ধারণা আঁকড়ে ধরেছিল, যদিও বাস্তবে তা অনুশীলন হতে পারেনি।
যাই হোক, ঐ দিনগুলিতে যখন সিপিআই কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিল, সিপিআই(এম) সম্পূর্ণভাবে অকার্যকরী হয়ে পড়েছিল এবং সিপিআই(এমএল)-এর অন্যান্য গোষ্ঠীগুলি ছত্রভঙ্গ অবস্থায় ছিল, তখন সমগ্র বাম শিবিরের মধ্যে কেবল আমাদের পার্টিই চরম নিপীড়নের কঠিন পরিস্থিতিতেও লাল পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল। অবশেষে ১৯৭৭ সালে যখন পর্দা সরে গেল, ভোজপুরের আকাশে লাল তারা আর আমাদের ছোট্ট সংগঠন, সারা দেশের বিপ্লবীদের এবং নতুন জীবন পাওয়া ভারতীয় সংবাদ জগতের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ইতিমধ্যে আসাম ও ত্রিপুরাতেও পার্টির কাজ বিস্তার লাভ করেছিল এবং অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু ও কেরালা থেকেও কমরেডরা পার্টিতে যোগ দিলেন। ১৯৭৯ সালের মধ্যেই আমাদের পার্টি সর্বভারতীয় চরিত্র অর্জন করল।
১৯৭৮ সালে পার্টি এক শুদ্ধিকরণ আন্দোলন শুরু করে। এটি শুরু হয়েছিল শুধুমাত্র কাজের ধারাকে শুধরে নেওয়ার সীমিত উদ্দেশ্য নিয়ে, কিন্তু শুদ্ধিকরণ আন্দোলনের প্রাণশক্তি রাজনৈতিক লাইনকেও রেহাই দিল না। পার্টি লাইন ও অনুশীলণের মধ্যে বড় বড় পরিবর্তন ঘটতে লাগল এবং এগুলিকে ১৯৭৯-র জুলাই মাসে ভোজপুরের একটি গ্রামে অনুষ্ঠিত এক বিশেষ পার্টি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নির্দিষ্টি রূপ দেওয়া হল। ঐ সম্মেলন গণসংগঠনের মাধ্যমে প্রকাশ্য গণকার্যকলাপের উদ্যোগ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
এই সন্ধিক্ষণে নকশালবাড়ি আন্দোলনের দুই ধারার মধ্যে বিতর্ক তীব্রতর রূপ পরিগ্রহ করে, যে দুটি ধারার প্রতিনিধিত্ব করছিল আমাদের সংগঠন এবং অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কমিটি (পিসিসি)। বিভিন্ন গোষ্ঠীর এক সুবিধাবাদী জোট পিসিসি যে তৎপরতায় অতীতের সমস্ত ভুলগুলি শুধরে নেওয়া শুরু করে তার জন্য সে প্রচুর প্রশংসা ও সমর্থন লাভ করে। এর কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব সত্যনারায়ণ সিং ১৯৭০ সালেই আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে বুর্জোয়া রাজনীতিবিদদের সঙ্গে মাখামাখি শুরু করেন। তিনি জরুরি অবস্থার সময়ে জয়প্রকাশের পিছন পিছন চলার ওকালতি করেন, ১৯৭৭ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চরণ সিং-এর সঙ্গে একটি সমঝোতা করেন এবং হিংসা পরিত্যাগের মুচলেখা দিয়ে নকশালপন্থী বন্দীদের জেল থেকে বেরিয়ে আসতে বলেন, এবং পরিশেষে কংগ্রেস বিরোধী কুলাক ও বৃহৎ বুর্জোয়াদের সঙ্গে ঐক্যের প্রবক্তায় পরিণত হন।
একেবারে শুরু থেকেই আমরা দেখিয়ে এসেছি যে, পিসিসি-র সামগ্রিক প্রেক্ষিত হচ্ছে বিলোপবাদী এবং তারা প্রকৃতপক্ষে আন্দোলনের মৌলিক বিপ্লবী মানসিকতাকে “শুধরে” দিতে চাইছে। আমরা ভবিষ্যৎবাণী করেছিলাম যে বিভিন্ন গোষ্ঠীর এই সুবিধাবাদী আঁতাত দীর্ঘস্থায়ী হবে না। অবশ্য, একটি ঐক্যের চেহারা প্রদর্শন করে এবং দীর্ঘদীন ধরে জমে থাকা সংগ্রাম ও সংগঠনের রূপের পরিবর্তনগুলি করার মাধ্যমে পিসিসি ভালো সংখ্যক বিপ্লবী শক্তিকে শুরুতে তার দিকে টানতে সক্ষম হয়। কিন্তু শীঘ্রই তার স্ব-ঘোষিত তাত্ত্বিকদের হাজির করা অবাস্তব তত্ত্বের গোলকধাঁধায় পিসিসি আটকে পড়ে এবং যত সংখ্যক গোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল তার চেয়েও বেশি সংখ্যক গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায়।
ইতিমধ্যে, আমাদের পার্টি যে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত শুদ্ধিকরণ অভিযান শুরু করে তা ফল দিতে থাকে। বিভিন্ন খোলা রূপের গণকার্যকলাপ শুরু করার ফলে কৃষক জনগণের জঙ্গী প্রতিরোধ সংগ্রাম ব্যাপ্তি ও তীব্রতা উভয় দিক থেকেই নতুন উচ্চতায় পৌঁছয় এবং পিসিসি থেকে বিপ্লবী শক্তি আমাদের পার্টিতে যোগ দিতে শুরু করে। পিসিসি-র চ্যালেঞ্জ ঐখানেই শেষ হয়ে যায়।
অন্য বিলোপবাদী কসরতটি ফেরী করতে থাকেন নকশালবাড়ির আর এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা কানু সান্যাল। তিনি সিপিআই(এমএল) এবং তার ঐতিহ্যকে খোলাখুলি নিন্দা করেন এবং প্রাক-সিপিআই(এমএল) সমন্বয়ের পর্যায়কে পুনর্জীবিত করার কথা বলেন। তিনি কেবলমাত্র পড়ে থাকা কিছু শক্তিকে সমাবেশিত করতে সমর্থ হন এবং আমাদের সংগঠনকে কখনই কোনো গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারেননি।
এই সমস্ত বিলোপবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অবশেষে আমরা সিপিআই(এমএল)-এর সর্বাপেক্ষা বৃহৎ গোষ্ঠী হিসাবে আবির্ভূত হই।
ইতিমধ্যে পার্টি জাতীয় রাজনৈতিক আঙ্গিনায় তার উপস্থিতি ঘোষণার চরম প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে শুরু করে। কেন্দ্রে প্রথম অকংগ্রেসী সরকার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ব্যর্থ হওয়া এবং ইন্দিরা রাজত্বের প্রত্যাবর্তনের পরে জাতীয় রাজনৈতিক বিকল্প নিয়ে জাতীয় স্তরে বিতর্ক শুরু হয়ে যায় এবং এক বিপ্লবী গণতান্ত্রিক প্রেক্ষিত থেকে এই চলমান বিতর্কে হস্তক্ষেপ করার জন্য আমরা একটি গণরাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
অন্যান্য কমিউনিস্ট বিপ্লবী সংগঠনগুলির সহযোগিতা ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে ঐ ধরনের মঞ্চ গড়ে তোলার জন্য দ্বি-পাক্ষিক এবং বহু-পাক্ষিক উভয় স্তরেই আন্তরিক প্রচেষ্টা চালানো হয়। ১৯৮১ সালে আমাদের পার্টি সিপিআই(এমএল)-এর প্রায় সমস্ত বড় গোষ্ঠীগুলি সহ ১৩টি কমিউনিস্ট বিপ্লবী সংগঠনের একটি সভা অহ্বান করে। আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করার সেই ছিল প্রথম এবং শেষ প্রয়াস। একই সাথে আমরা অ-পার্টি গণআন্দোলনের উদীয়মান মধ্যবর্তী শক্তিগুলির সঙ্গে ব্যাপকভাবে আন্তঃক্রিয়া চালানোর প্রক্রিয়াও শুরু করি। এই সমস্ত প্রচেষ্টাগুলির পরিণতি হিসাবে অবশেষে ১৯৮২-র ২৪-২৬ এপ্রিল দিল্লীতে তিনদিন ব্যাপী সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ইন্ডিয়ান পিপলস ফ্রন্ট গঠন হয়।
১৯৮২-র ডিসেম্বরে বিহারের গিরিডি জেলার একটি গ্রামে পার্টির তৃতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই পার্টি কংগ্রেস যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বকারী চরিত্রের ছিল এবং কংগ্রেস ১৭ জন পূর্ণ সদস্য ৮ জন বিকল্প সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচন করে। কেন্দ্রীয় কমিটি কমরেড বিনোদ মিশ্রকে সাধারণ সম্পাদক হিসাবে পুনর্নির্বাচিত করে। এক তীব্র বিতর্কের পর পার্টি কংগ্রেস নির্বাচনে অংশগ্রহণের কৌশল গ্রহণ করে। পার্টি কংগ্রেস অবশ্য কৃষক জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রামকে মূল যোগসূত্র হিসাবে আঁকড়ে ধরার এবং সমস্ত সংসদীয় কার্যকলাপকে অ-সংসদীয় গণসংগ্রামের অধীনে রাখার সংকল্প পুনরায় ঘোষণা করে। পার্টি ১৯৮৫ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনে প্রথম অংশগ্রহণ করে, অবশ্য আইপিএফ-এর পতাকা নিয়ে।
আইপিএফ-এর গঠন পার্টির সামনে রাজনৈতিক উদ্যোগ এবং অগ্রগতির নতুন রাস্তা খুলে দেয়। শীঘ্রই বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানীতে প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতে গণসমাবেশ এবং গণবিক্ষোভ সংগঠিত করা পার্টি অনুশীলনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রথমবার পার্টির ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ব্যাপক জনগণকে রাজনৈতিক সংগ্রামে সমাবেশিত করে পার্টি বিমূর্ততার জগত থেকে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কার্যকলাপের জগতে প্রবেশ করতে বড় আকারে পদক্ষেপ গ্রহণ করে। একদিকে পার্টির রাজনৈতিক পরিচালনার মাধ্যমে এবং দৃঢ় কমিউনিস্টদের বিভিন্ন নেতৃত্বকারী পদে বসিয়ে গণরাজনৈতিক সংগঠনের উপর কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বকে সুনিশ্চিত করা হয়, আর অন্যদিকে গণরাজনৈতিক সংগঠন (MPO) বিভিন্ন ধারার রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলির সঙ্গে ব্যাপকতর আন্তঃক্রিয়া বাড়িয়ে তুলে পার্টিকে তার প্রভাব বাড়াতে ও নিজস্ব সামাজিক ভিত বিস্তৃত করতে সাহায্য করে।
জনপ্রিয় গণবিপ্লবী পার্টির আদলে একটি বিশেষ রূপের যুক্তমোর্চা হিসাবে আইপিএফ তত্ত্ব ও অনুশীলন উভয় দিক থেকেই ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে আমাদের পার্টির বিরল সাফল্যগুলির অন্যতম স্মারক। ভারতীয় রাজনীতিতে আইপিএফ তার নিজস্ব স্থান করে নিয়েছে এবং পার্টির সমস্ত ব্যবহারিক রাজনৈতিক কার্যকলাপ তার মাধ্যমেই চলতে থাকে।
১৯৮৮-র জানুয়ারি মাসে বিহারের হাজারিবাগ জেলার একটি গ্রামে পার্টির চতুর্থ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতি ও তার বর্ধিত উপলব্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পার্টি বেশ কিছু সেকেলে ধ্যানধারণা ও গতানুগতিক অবস্থানের আমূল সংস্কার ঘটায় এবং এইভাবে ভারতীয় রাজনীতির মূল ধারায় প্রবেশ করা ও তাকে নতুন চেহারা দেওয়ার পথ পরিষ্কার করে। কমিউনিস্ট বিপ্লবী অর্থাৎ নকশালপন্থী গোষ্ঠীগুলির ঐক্যের একঘেয়ে বুলি পরিত্যাগ করে পার্টি কংগ্রেস প্রধান প্রধান বাম পার্টিগুলির সঙ্গে আন্তঃক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং বাম ও গণতান্ত্রিক মহাজোটের আহ্বান রাখে। কংগ্রেস ২১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত করে, আর কেন্দ্রীয় কমিটি ৫ সদস্যের রাজনৈতিক ব্যুরো ও সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কমরেড বিনোদ মিশ্রকে নির্বাচিত করে।
১৯৭০ দশকের সিপিআই(এমএল) আন্দোলন এতদিনে দুটি নির্দিষ্ট ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে – একটি ধারার প্রতিনিধিত্ব করছে আমাদের পার্টি, যে ধারা তত্ত্ব ও অনুশীলন উভয় দিক থেকেই নৈরাজ্যবাদী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে ব্যাপক ও ধারাবাহিক সংগ্রাম চালিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে পুনরুজ্জীবিত করেছে এবং পার্টিকে কমিউনিস্ট ঐতিহ্য, বিপ্লবী গণসংগ্রাম ও পুরোমাত্রায় রাজনৈতিক উদ্যোগের পথে ফিরিয়ে এনেছে। অন্য ধারার প্রতিনিধি হল মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র, দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় কমিটি, পার্টি ইউনিটি ও পিসিসি-র কিছু গোষ্ঠী, যারা এই নৈরাজ্যবাদী বিচ্যুতিগুলিকে এক পুরোদস্তুর তাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে পূর্ণতা দিয়েছে। এই নৈরাজ্যবাদী চ্যালেঞ্জ সমগ্র সিপিআই(এমএল) আন্দোলনের মধ্যে গত কয়েক বছরে নিজেকে সংহত করেছে এবং আমাদের পার্টির অগ্রগতির পথে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অবশ্য, আমাদের পার্টির মধ্যে, নৈরাজ্যবাদী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় বিলোপবাদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম চালাতে হয়েছে। চতুর্থ পার্টি কংগ্রেসের পরে পরেই বিলোপবাদী প্রবণতা কুৎসিতভাবে মাথাচাড়া দেয়। এক দক্ষিণপন্থী সমর্পণবাদী অবস্থান থেকে শুরু করে এই প্রবণতা সুবিধাবাদী বামেদের সঙ্গে আমাদের পার্টির মৌলিক পার্থক্যকে মুছে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এই প্রবণতা এখানেই থেমে থাকল না বরং খুব শীঘ্রই বিপ্লবী গণতন্ত্র ও উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মধ্যেকার সমস্ত পার্থক্যই মুছে দেওয়ার কথা বলল। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের ঘটনাবলীর বিকাশে উৎসাহিত হয়ে এই প্রবণতা মার্কসবাদ এবং কমিউনিস্ট পার্টিকেই পরিত্যাগ করার কথা বলল এবং পুরোদস্তুর সংস্কারমূলক এক কর্মসূচির ওকালতি করল। এদের প্রধান প্রবক্তা বর্তমানে এক পরিসংখ্যান কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য সামাজিক অনুসন্ধানে রত আছেন, যার উদ্দেশ্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলির উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে সাহায্য করা।
আমাদের পার্টি দৃঢ়ভাবে এই বিলোপবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করে পার্টিকে ভাঙ্গার সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থ করে দিয়েছে। সত্যি কথা বলতে গেলে, চতুর্থ কংগ্রেসের পরবর্তী বছরগুলিতে পার্টির এক গুণগত বিকাশ লক্ষ্য করা গেছে। ১৯৮৯-এর সংসদীয় নির্বাচনে পার্টি সংসদে প্রথম মার্কসবাদী-লেনিনবাদী প্রতিনিধি পাঠাতে সমর্থ হয় এবং ১৯৯০-এর বিধানসভা নির্বাচনের মাধ্যমে বিহার বিধানসভায় এক ভালো আকারের বিধায়ক গোষ্ঠী গঠন করতে সফল হয়।
১৯৯০-এর ৮ অক্টোবর রাজধানী দিল্লীতে আইপিএফ আহুত জমায়েতের সাফল্য সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বিষয়। এই জমায়েত বিপ্লবী মার্কসবাদের অবিনশ্বর সত্তাকে তুলে ধরেছে এবং জাতীয় রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে বিপ্লবী বামপন্থীদের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতিকে সামনে এনেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের বিশাল জমায়েত বাম শিবিরের অভ্যন্তরে শক্তির পুনর্বিন্যাস শুরু করে দিয়েছে। এই জমায়েত বাম ঐক্যের দুই কৌশলগত লাইন ও অবস্থানের মধ্যেকার সংগ্রামকে সামনে এনেছে – ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর গণতান্ত্রিক রূপান্তরণের জন্য বামপন্থীরা বুর্জোয়াশ্রেণী ও বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করবে, না তাদের নিজেদেরই নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রচেষ্টা চালানো এবং শুধুমাত্র গণসংগ্রামের উপর নির্ভর করা উচিত।
বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবাংলায় ব্যাপক সংখ্যক শক্তি সিপিআই ও সিপিআই(এম) থেকে বিপ্লবী গণতন্ত্রের পতাকাতলে সমাবেশিত হচ্ছে, আর প্রায় সমস্ত প্রধান বামপন্থী পার্টিগুলির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের বিকাশ ঘটানো গিয়েছে এবং যৌথ কার্যকলাপ ও এক বাম মহাজোটের বিকাশ ঘটানোর জন্য পথের অনুসন্ধান চলছে।
সিপিআই(এম) এবং আমাদের পার্টির মধ্যে মৌলিক পার্থক্যগুলির পুনরুল্লেখ করা এখানে হয়তো অসঙ্গত হবে না। ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে সুবিধাবাদী ধারা সর্বাগ্রে চিহ্নিত হয় ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী সম্বন্ধে তার চরিত্রায়ণের দ্বারা। বিভিন্ন শব্দ ও ভাষার কারুকাজের আবরণে সুবিধাবাদী ধারা ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর ‘জাতীয়’ চরিত্রের উপরই মূলত গুরুত্ব দেয় এবং এইভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রামে ও ভারতীয় সামাজের গণতান্ত্রিক রূপান্তর ঘটানোয় বুর্জোয়াশ্রেণীর নেতৃত্ব দেওয়ার সামর্থকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। এই তত্ত্ব রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ক্ষেত্রের মধ্যে দ্বন্দ্বকে বাড়িয়ে দেখার এবং কখনও ফ্যাসিবাদ বিরোধী ফ্রন্ট এবং কখনও গণতান্ত্রিক অথবা ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্টের নামে বিভিন্ন বুর্জোয়া-জমিদার পার্টিগুলির লেজুড়বৃত্তির ওকালতি করার দিকে পরিচালিত করেছে।
সুবিধাবাদী ধারার মতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রধান দ্বন্দ্ব (মার্কিন) সাম্রাজ্যবাদ বনাম (সোভিয়েত) সমাজতন্ত্রের। প্রধান আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্বকে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে টেনে নিয়ে আসায় তা ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর তথাকথিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী তত্ত্বকেই যুক্তিযুক্ত করেছে, কেননা ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণী সোভিয়েত ব্লকের সঙ্গে সবসময়েই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
তৃতীয়ত এবং ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর চরিত্র সম্বন্ধে তার উপলব্ধি অনুসারে, সুবিধাবাদী ধারা গণতান্ত্রিক রূপান্তরণের জন্য প্রধান শক্তি হিসাবে শ্রমজীবী কৃষকশ্রেণীর ব্যাপক জনতাকে সংগঠিত করতে অস্বীকার করে। বিপরীতে, এই ধারা কুলাক লবির সঙ্গে এক সমঝোতা গড়ে তুলেছে, এই সমঝোতাই বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে তার স্থায়ী রাজনৈতিক সম্পর্কের পিছনে কাজ করে চলেছে।
সবশেষে, প্রথম তিনটি নির্দিষ্ট বিষয়ের অবিচ্ছেদ্য অতিরিক্ত অঙ্গ হিসাবে এই সুবিধাবাদী ধারা আমাদের দেশের জরুরি সামাজিক সংস্কার ঘটানোর জন্য বু্র্জোয়া প্রতিষ্ঠানগুলির উপরই প্রচণ্ডভাবে নির্ভরশীল। এটাই সুবিধাবাদী বামকে পঙ্গু করেছে, লেনিন যাকে বলেছেন সংসদ-সর্বস্বতা।
এর বিপরীতে, বিপ্লবী ধারা সবসময়েই ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর মুৎসুদ্দি চরিত্রের উপর জোর দিয়েছে এবং তা থেকে বুঝিয়েছে যে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রামের নেতৃত্ব সর্বহারাকেই দিতে হবে এবং বুর্জোয়াদের উপর নির্ভরতা আমাদের কোনো কাজেই আসবে না। তৃতীয় বিশ্ব বনাম সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্বই প্রধানতম – এই উপলব্ধিই বিপ্লবী ধারাকে ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা’কে পরখ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে সোভিয়েত ব্লকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার পরিমাপের বদলে আঞ্চলিক সংহতি ও তৃতীয় বিশ্বের স্বার্থের প্রতি তার দায়বদ্ধতার স্বাধীন কষ্টিপাথরে। বিপ্লবী ধারা গণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য কৃষি বিপ্লবকেই অক্ষ হিসাবে দেখে এবং কৃষি শ্রমিক ও শ্রমজীবী কৃষক জনতার জঙ্গী গণআন্দোলন সংগঠিত করার উপর সর্বাপেক্ষা জোর দেয়। আর সংসদ-সর্বস্বতার বিপরীতে অ-সংসদীয় সংগ্রামের উপরই বিপ্লবী ধারা মূলত নির্ভর করে।
বিপ্লবী ও সুবিধাবাদী ধারার মধ্যে সংগ্রামের এগুলিই মূল রূপরেখা। একে আমরা ভারতীয় পরিস্থিতিতে মেনশেভিক ও বলশেভিক কৌশলের মধ্যে বিতর্কের ধারাবাহিকতা বলতে পারি।
১৯৬৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত সিপিআই(এম)-এর বিকাশ কেবলমাত্র সুবিধাবাদী পথে তার যাত্রাকে সুনির্দিষ্ট করেছে। সিপিআই তার অবস্থানকে কৌশলগত দিক থেকে কিছুটা ঠিকঠাক করে নেওয়ায়, আন্তর্জাতিক পার্থক্যগুলি পিছনে চলে যাওয়ার এবং প্রায় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে দু-দল একসঙ্গে চলার ফলে ১৯৬৪ সালের যৌক্তিকতা আজ এক বড় প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে, সিপিআই(এম)-এর মধ্যে নতুন করে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে এবং পার্টি থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় সমস্ত বিক্ষুব্ধ শক্তি পার্টি নেতৃত্বকে ১৯৬৪-র কর্মসূচি থেকে বিচ্যুতির জন্য অভিযুক্ত করছে। এইভাবে ১৯৬৪-র ভাঙ্গনের রাজনৈতিক যৌক্তিকতা আজ অর্থহীন হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে, বিপ্লবী অবস্থানকে একেবারে বিপরীত মেরুতে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ভারতীয় বুর্জোয়াদের মুৎসুদ্দি চরিত্রকে প্রসারিত করে বুর্জোয়া শ্রেণীর কোনো অংশের সাথে যে কোনো ধরনের কৌশলগত সমঝোতাকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও বিচ্যুতি দেখা যায় তিন বিশ্বের তত্ত্বকে অন্ধভাবে অনুসরণ করার ফলে, সমস্ত ধরনের মার্কিনপন্থী শক্তিগুলিকে নিয়ে এমনকি কোনো কোনো পরিস্থিতিতে মার্কিনকে নিয়েও, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী একটি ফ্রন্ট গড়ে তোলার কথা বলে ঐ তত্ত্বকে অবাস্তব পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। কৃষি বিপ্লবকে ভাবা হয়েছিল সম্পূর্ণভাবে চীন বিপ্লবের অনুসরণে এবং অ-সংসদীয় সংগ্রামের মুখ্য ভূমিকাকে এইভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছিল যে, সংসদীয় সংগ্রামের সমগ্র ধারা চিরতরে বর্জনীয়। বিপ্লবী জোয়ারের পরিস্থিতিতে এই উপলব্ধিগুলি কিছুটা কাজ দিয়েছিল, কিন্তু আন্দোলনের প্রকৃত পশ্চাদপসরণের সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে ঐ স্লোগানগুলিতে অনড় থাকার প্রাণপণ প্রচেষ্টা শূন্যগর্ভ নৈরাজ্যবাদী বুলিসর্বস্বতা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনি।
সমাজতন্ত্রের ধারাবাহিক গভীর সংকট এবং নবোদ্যমে বুর্জোয়া আক্রমণের মুখে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে রক্ষা করার জন্য পার্টি ১৯৯০-এর জুলাইয়ে দিল্লীতে বিশেষ সম্মেলনে প্রায় কুড়ি বছর বাদে পুনরায় প্রকাশ্য কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেই অনুযায়ী পার্টির কেন্দ্রীয় ও রাজ্য মুখপত্রগুলি খোলাভাবেই প্রকাশিত হতে শুরু করেছে; প্রকাশ্য সমাবেশ ও বিক্ষোভ প্রদর্শনে পার্টি পতাকা উড়ছে; মার্কসবাদের সপক্ষে সেমিনার করা হচ্ছে, ক্রমেই বেশি বেশি সংখ্যক মানুষকে প্রাথমিক মার্কসবাদী শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য এবং গণসংগ্রাম থেকে উঠে আসা বহুসংখ্যক শক্তিকে পার্টিতে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য এক ব্যাপক অভিযান শুরু হয়েছে।
পার্টি সারা ভারত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন কাউন্সিল (এআইসিসিটিইউ) নামে সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন গঠন করেছে এবং রাজ্য স্তরের কৃষক সমিতিগুলির কাজগুলিকে একটি জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে সমন্বয় সাধন করার পরিকল্পনা করেছে। ছাত্রফ্রন্টে অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস এ্যাসোসিয়েশন (এআইএসএ) নামে জাতীয় স্তরের সংগঠন ইতিমধ্যেই গঠন করা হয়েছে এবং আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মহিলা ও সাংস্কৃতিক ফ্রন্টেও জাতীয় স্তরের সংগঠন গড়ে তোলার কর্মসূচি রয়েছে।
পার্টি তার নিজস্ব মুখপত্রগুলি, আইপিএফ মুখপত্র এবং পাটনা থেকে প্রকাশিত হিন্দী সাপ্তাহিক সমকালীন জনমত-এর মতো জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে এক প্রচার ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। ১৯৮৬-তে প্রকাশিত হয় রিপোর্ট ফ্রম দি ফ্লেমিং ফিল্ডস অফ বিহার (Report from the Flaming Fields of Bihar), এটি রাজ্যের পরিবর্তিত কৃষি ও সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে বিহারের বিকাশমান বিপ্লবী কৃষক আন্দোলনের এক বিশ্লেষণমূলক পর্যালোচনা। বইটি ভারত এবং ভারতের বাইরে বিপ্লবী ও বিদ্বৎ সমাজে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়। বর্তমানে পার্টি ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস গভীরভাবে অধ্যয়ন করছে এবং এই ইতিহাস পাঁচখণ্ডে প্রকাশ করার পরিকল্পনা আছে।
পার্টি আসামের কার্বি আংলঙের সংখ্যালঘু জাতিসত্তা অঞ্চলে স্বশাসিত রাজ্য দাবি কমিটি (Autonomous State Demand Committee) নামে একটি গণরাজনৈতিক সংগঠনের বিকাশ ঘটিয়েছে এবং স্বশাসিত জেলা প্রশাসন পরিচালনা সহ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্মই এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। আমরা যেমন জাতীয় সংখ্যালঘুদের বিশেষ বিশেষ সমস্যার উপর নির্দিষ্ট মনোযোগ দিই এবং বিভিন্ন জাতিসত্তা, দলিত ও পশ্চাদপদ জাতিসমূহের এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ন্যায্য ক্ষোভগুলির মর্যাদা দিই, তেমনি আবার আন্দোলনের প্রান্তিকীকরণের তীব্র বিরোধিতা করি এবং ব্যাপক ভারতীয় জনগণের ও দেশ হিসাবে ভারতবর্ষের ঐক্যের জন্য কঠোর প্রচেষ্টা চালাই।
আমাদের পার্টি বিপ্লবী কৃষক সংগ্রামগুলি গড়ে তোলা এবং জমিদার ও কুলাকদের নিজস্ব সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার উপরই সর্বাধিক মনোযোগ দিয়ে থাকে। জনগণের বিপ্লবী চেতনার স্তরকে ক্রমাগত উন্নত করা, তৃণমূল স্তরে জনগণকে সমাবেশিত করা ও তাদের মধ্যে জঙ্গী মেজাজ গড়ে তোলা আমাদের পার্টির মূল লক্ষ্য, এবং এগুলিই সমস্ত ধরনের সুবিধাবাদী, সমাজগণতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক বিচ্যুতির বিরুদ্ধে একমাত্র প্রতিষেধক।
সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আমাদের পার্টি, নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং একে অপরের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার নীতির উপর ভিত্তি করেই এই সম্পর্ক গড়ে উঠেছে এবং একই সঙ্গে পারস্পরিক হস্তক্ষেপ-না-করার নীতি এবং ভারতীয় আধিপত্যের যে কোনো বহিঃপ্রকাশের বিরোধিতা করার আমাদের দায়বদ্ধতা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা হয়েছে।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে আমাদের পার্টির দুটি প্রতিনিধিদল ১৯৭৯ ও ১৯৮০ সালে চীনে গিয়েছিল। ফিলিপাইনস এবং পেরুর কমিউনিস্ট পার্টি ও গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলির সঙ্গে আমরা কমরেডসুলভ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছি। বিদেশের বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্ক সম্প্রসারিত করার অনেক বেশি সম্ভাবনা এখন এসেছে। বিশ্বের সর্বত্র কমিউনিস্ট পার্টি ও বিপ্লবী গণআন্দোলনগুলির সঙ্গে উষ্ণ বন্ধুত্ব ও সংহতির বিকাশ ঘটানোর দিকে আমরা চেয়ে আছি।
আমরা অবশ্য স্বনির্ভরতার নীতিকে সবসময় তুলে ধরেছি এবং ভবিষ্যতেও তা তুলে ধরব। যে কোনো বিদেশী শক্তি অথবা বিদেশী অর্থপুষ্ট দেশীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাছ থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য নিতে আমরা ধারাবাহিক ও সচেতনভাবে অস্বীকার করেছি এবং ভবিষ্যতেও করব। কোনো পার্টি দ্বারা নির্দেশিত হতে আমরা অস্বীকার করি এবং আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা, নীতি ও কার্যপ্রণালী রচিত হয়েছে কেবলমাত্র ভারতীয় পরিস্থিতি সম্বন্ধে আমাদের নিজস্ব অধ্যয়নের ভিত্তিতে।
সিপিআই(এমএল) লিবারেশনই হল সিপিআই(এমএল) গোষ্ঠীগুলির মধ্যে একমাত্র –
ক) যারা ১৯৭৪-এ পুনর্গঠনের পর থেকে ধারাবাহিকতা এবং ঐক্য বজায় রেখেছে।
খ) যাদের আসাম, ত্রিপুরা, পশ্চিমবঙ্গ, দক্ষিণ উড়িষ্যা (কোরাপুট-গঞ্জাম অঞ্চল), উপকূলবর্তী অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, দক্ষিণ কেরালা, বাঙ্গালোর, বোম্বাই, ছত্তিশগড়, দিল্লী, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ ও বিহার সহ সর্বভারতীয় সাংগঠনিক ব্যবস্থা আছে।
গ) যারা নিয়মিত পার্টি কংগ্রেস এবং আঞ্চলিক ও জেলা স্তর পর্যন্ত সম্মেলনগুলি করে আসছে এবং বিভিন্ন স্তরে যথাযথভাবে নির্বাচিত কাঠামোর দ্বারা পরিচালিত হয়।
ঘ) যারা পার্টি কর্মীদের চেতনার স্তরকে উন্নত করার এবং বিভিন্ন পার্টি কাজ পরিচালনায় তাদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত পার্টি শিক্ষা ও শুদ্ধিকরণ ও সংহতকরণ অভিযান চালিয়ে থাকে।
ঙ) যাদের কেন্দ্রীয় মুখপত্র ইংরাজী ও হিন্দিতে নিয়মিত প্রকাশিত হয় এবং তার সঙ্গে আছে আঞ্চলিক ভাষায় রাজ্য মুখপত্রগুলি, পার্টি পুস্তিকা এবং অন্যান্য পত্র-পত্রিকা প্রকাশনার ব্যবস্থা।
চ) যারা সশস্ত্র প্রতিরোধ থেকে সংসদীয় বিক্ষোভ পর্যন্ত সংগ্রামের সমস্ত রূপেরই অনুশীলন করে এবং গোপন থেকে ব্যাপকতর খোলা গণসংগঠন পর্যন্ত বিভিন্ন রূপের সাংগঠনগুলি পরিচালনা করে থাকে, সমস্ত ফ্রন্টে ও জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে গণকার্যকলাপ চালায় এবং বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে যৌথ কার্যকলাপ চালায় এবং এক ক্রমবর্ধমান গণসংগ্রামের স্রোতে এগুলির সমন্বয় ঘটায়।
ছ) যারা কয়েকটি দেশের কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বমূলক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখে।
এ সমস্ত কারণে আমার নিজেদের সাধারণভাবে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের এবং নির্দিষ্টভাবে সিপিআই(এমএল)-এর বিপ্লবী ধারার প্রকৃত উত্তরাধিকারী বলে এবং নিজেদের সিপিআই(এমএল)-এর প্রতিনিধিত্ব করার ও তার হয়ে কাজ করার একমাত্র পার্টি হিসবে দাবি করি।