(ডিসেম্বর ১৯৮২, তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে তীব্র বিতর্ক চলেছে তা হল কমরেড চারু মজুমদার কর্তৃক সূত্রায়িত ‘খতম’-এর প্রশ্ন। অনেকে তর্ক তোলেন যে এর মধ্যে নাকি কোনো মার্কসবাদই নেই, এটা স্রেফ স্থূল ব্যক্তিগত সন্ত্রাসবাদ, এতে কেবল ক্ষতিই হয়েছে, ইত্যাদি। সশস্ত্র সংগ্রাম ও গণসংগ্রামকে অবশ্যই মেলাতে হবে, আর তাই ‘খতম লাইন’কে নিন্দা না করলে চলে না – এমন কথাও শোনা যায়।

সশস্ত্র সংগ্রাম ও গণসংগ্রামকে মেলানোর প্রশ্নটি প্রথমে ধরা যাক। সাধারণভাবে এই কথাটি এক সর্বরোগহর দাওয়াই হিসেবে বারবার আউড়ে গেলে মার্কসবাদী বাস্তব কর্মীর জন্য তা কোনোই তাৎপর্য বহন করে না। ইতিহাসের তথ্য এ কথাই বলে যে অগ্রগতির পথে সমস্ত গণআন্দোলন নতুন নতুন রূপ গ্রহণ করে; লাগাতার চলতে থাকে পুরাতনকে বর্জন করে নতুনের সৃষ্টি আর ঘটতে থাকে নতুন ও পুরোনো রূপের রূপান্তর বা নতুন নতুন বিন্যাস। কমিউনিস্ট হিসাবে আমাদের কর্তব্য হল উপযুক্ত সংগ্রামের রূপ গড়ে তোলার এই প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা নেওয়া। লেনিন বলেছেন, বলপ্রয়োগ ও সন্ত্রাসের প্রয়োজনকে নীতিগতভাবে বিন্দুমাত্র অস্বীকার না করেও আমাদের এমন সব সংগ্রামের রূপের বিকাশ ঘটাতে হবে যাতে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ঘটতে পারে এবং এই অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা হয়েছে।

বীরত্বপূর্ণ নকশালবাড়ি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নয়া-সংশোধনবাদের শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার পর এবং প্রায় দুবছর ধরে গণআন্দোলন গড়ে তোলার বিপ্লবী অনুশীলনে আত্মনিয়োগ করার পর ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা এমনই এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন। সংগ্রামের এক নতুন রূপের জন্য তাঁরা ব্যগ্র হয়ে উঠলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই শ্রীকাকুলাম সংগ্রামের উত্তাপের মধ্যে সূত্রায়িত হল গণসমর্থনের উপর ভিত্তিশীল ‘খতম’ – যার উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা আর জনগণকে ধাপে ধাপে সংগ্রামে সামিল করা – এই দুটি দিককে মেলানো। চারু মজুমদারের লাইনের এই মূল দিশা – গণসংগ্রামের সঙ্গে সশস্ত্র কার্যকলাপকে মেলানো (এক এক সময় এক একটি দিক প্রধান হতে পারে) – এটাই নকশালবাড়ির আগে থেকে জীবনের শেষ পর্যন্ত তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক লাইনে বিধৃত আছে। তাঁর প্রচেষ্টার সাফল্য ও ব্যর্থতাগুলির মূল্যায়ন করা এক জিনিস, প্রকৃত অগ্রগতির পক্ষে একান্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে; কিন্তু তাকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ আখ্যা দেওয়া হবে চূড়ান্ত নির্বুদ্ধিতা ও হীনতার পরিচয়। গণসমর্থনের সামগ্রিক পটভূমিকায় এবং গণআন্দোলনগুলির সঙ্গে মেলানোর দিশায় সংগ্রামের এই বিশেষ রূপের লক্ষ্য ছিল এলাকাভিত্তিক ক্ষমতা দখল। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় অনেকগুলি কৃষক স্কোয়াড ও গণঅভ্যুত্থান গড়ে উঠেছিল। বিপ্লবী কমিটির মাধ্যমে ও কৃষি সংস্কারের কয়েকটি কর্মসূচি নিয়ে এই গণঅভ্যুত্থানকে সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চলে এবং পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনী  তথা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা এ্যাকশন চালিয়ে গণমুক্তি ফৌজের ইউনিট হিসাবে এই স্কোয়াডগুলিকে সংগঠিত করার চেষ্টা হয়, যাতে লাল ক্ষমতার দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। সংক্ষেপে, এই হল ‘খতম লাইন’-এর গোটা প্রক্রিয়া ও ফলাফল। এর সাফল্যের পাল্লায় বহু কিছুই আছে – আর আজ পর্যন্ত ভোজপুরের টিকে থাকা এ সাক্ষ্যই দেয়। তবে এর নেতিবাচক দিকও ছিল, আর ক্রমে ক্রমে সেটাই প্রধান দিক হয়ে দাঁড়ায়। বহু এলাকায় ক্ষতমকে এক অভিযান হিসাবে চালিয়ে বহু নির্বিচার ও অপ্রয়োজনীয় হত্যা করা হল। কৃষকদের শ্রেণীসংগ্রাম থেকে খতম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। পুলিশী দমনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলা গেল না এবং আমাদের সংগ্রামী এলাকাগুলি ধ্বংস হয়ে গেল। যে সব জায়গায় পার্টি তার নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলল, গণআন্দোলন ও প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলা যায়নি সেখানেই এটা ঘটল। খতমের অত্যুৎসাহী সমর্থকরা – অসীম থেকে শুরু করে দীপক এবং শেষে মহাদেব পর্যন্ত – এই ভুলগুলিকে চরমে নিয়ে গেল। ধাপে ধাপে তারা এক বাম সুবিধাবাদী লাইন গড়ে তুলল, যা জনগণ ও বিপ্লবের বিপুল ক্ষতি ডেকে আনল।

দুনিয়া জুড়ে এক আশু ও সর্বব্যাপী বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজ করছে – এইভাবেই তখনকার সময়কে চিহ্নিত করে এক সার্বিক বিপ্লবী আক্রমণের পরিকল্পনা করা হল। বিপ্লবী পরিস্থিতি সম্পর্কে এই অতিরিক্ত মূল্যায়ন তাড়াহুড়োর জন্ম দিল, বিষয়ীগত শক্তির অবস্থাও বিবেচনা করা হল না, আর এইভাবে ভুলগুলি আরও বেড়ে গেল। এটা ঠিকই যে তখন শাসকশ্রেণীগুলি গভীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে ভুগছিল, বিপ্লবী পরিস্থিতিও ছিল আমাদেরই অনুকূলে। তাই যেখানেই সম্ভব সেখানেই কৃষকদের সশস্ত্র সংগ্রামে জাগিয়ে তোলা ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা চালানো সর্বহারার অবশ্য কর্তব্য ছিল। তবে ভারতীয় বিপ্লবের অসম বিকাশের বিষয়কে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়নি। ফলে, সাধারণ কর্মসূচি ও মূল রণকৌশলগত লাইন সঠিক হওয়া সত্ত্বেও, বিপ্লবী পরিস্থিতিকে বাড়িয়ে দেখা এবং ভারতীয় বিপ্লবের অসম বিকাশকে হিসাবে না নেওয়ার দরুণ যা ঘটল তা হচ্ছে – সংগ্রামের যে রূপ ও অগ্রগতির যে পথ কোনো কোনো এলাকার পক্ষে উপযুক্ত তাকে দেশের সর্বত্রই (শুধু তাই নয়, অভিযান হিসাবে) প্রযোজ্য বলে ধরে নেওয়া হল। নিঃসন্দেহে এগুলি ছিল গুরুতর বাম বিচ্যুতি। আর বিকাশের বস্তুগত নিয়ম আমাদের উচিত শিক্ষাও দিল – গণঅভ্যুত্থানের অঞ্চলগুলি মাত্র কয়েকটি জায়গায় সীমাবদ্ধ হয়ে গেল ও একটি মাত্র এলাকায় অব্যাহত রইল।

এই পটভূমিকায় বলা যায়, আমাদের প্রথম পার্টি কংগ্রেসের ঘোষণা – ‘শ্রেণীসংগ্রাম, অর্থাৎ খতমই আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করবে’ – অবশ্যই ভুল ছিল। তবে কোনো কোনো এলাকায় গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত খতম, সেই অভ্যুত্থানকে বিপ্লবী কমিটির মাধ্যমে ও কৃষি সংস্কারের স্লোগান দিয়ে সংগঠিত করার প্রাথমিক প্রচেষ্টাগুলি এবং গেরিলা স্কোয়াডগুলি থেকে লালফৌজ গড়ে তোলার বিভিন্ন প্রচেষ্টা বিপ্লবী অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে গৌরবময় দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। আর এই ভিত্তিতেই অনতিসচেতন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের শুরু করা ও পরবর্তীকালে পার্টি নেতৃত্ব কর্তৃক সংগঠিত ভোজপুরের কৃষক সংগ্রাম গড়ে উঠেছে, কঠিনতম পরিস্থিতিতে ব্যাপকতম আত্মত্যাগের বিনিময়ে টিকে থেকেছে এবং বর্তমানে বৃহত্তর এলাকায় বিতিত্রতম রূপে ছড়িয়ে পড়ছে। আর এই মহান ঐতিহ্যের জন্যই চারু মজুমদার লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত ভারতবাসীর মনে অমর হয়ে আছেন – তাঁর লাইনই ভারতবর্ষের একমাত্র বিপ্লবী লাইনের প্রতীক হয়ে আছে। এর বিপরীতে, অনেক কেতাবী মার্কসবাদী ও সুবিধাবাদী নেতা ‘সশস্ত্র সংগ্রাম ও গণসংগ্রামকে মেলানো’র বুলি আউড়েছেন, কিন্তু কোনোদিনই ব্যাপক জনগণের কাছে পৌঁছতে পারেননি বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেননি – সশস্ত্র সংগ্রাম বা তথাকথিত ‘মেলানো’ তো দূরের কথা। দুনিয়ায় সবকিছুই করা আর সবকিছুই মেলানোর যে পণ্ডিতি মনোভাব কোনো কোনো স্বঘোষিত মার্কসবাদী দেখিয়ে থাকেন তাতে কোনো সমাধন নয়, কেবল সমাধানের প্রহসনই মেলে। এটা হল বাস্তব অভিজ্ঞতাবর্জিত বিশুদ্ধ পুঁথিসর্বস্ব মনোভাব। বিপ্লবী লাইনের পূর্ণাঙ্গ রূপ গ্রহণ একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কেবল সম্ভব ছিল; সংগ্রামের পুরোনো রূপগুলিকে বর্জনের মধ্য দিয়ে শুরু করে একটি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই পার্টির পক্ষে নতুন ও পুরোনো রূপগুলির এক নতুন সমন্বয়ে পৌঁছানো সম্ভব ছিল।

শ্রমিকশ্রেণীর সংগ্রামের প্রশ্নে চারু মজুমদার সঠিকভাবেই সংগ্রামের পুরোনো রূপগুলি বর্জন না করেও নতুন নতুন রূপের বিকাশ ঘটানোর এবং ট্রেড ইউনিয়ন লড়াই নাকচ না করে রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়ে তোলার প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

ছাত্র-যুব আন্দোলনের ক্ষেত্রে, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে তিনিই সর্বপ্রথম শ্রমিক-কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার প্রশ্ন নিয়ে আসেন। আর এজন্য দরকার ছিল ছাত্র-যুবদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগত সংগ্রামের গণ্ডি থেকে বের করে আনা। ছাত্র-যুবকেরা তাঁর আবেদনে প্রচণ্ড উৎসাহের সাথে সাড়া দিয়েছিলেন, আর তিনিও পুরোনো মূল্যবোধ, পুরোনো শিক্ষা-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। সমসাময়িক চীনা যুবকদের লালরক্ষী আন্দোলন ও ফ্রান্সের ‘নয়া বাম’ আন্দোলনের সঙ্গে এ দেশের যুব-ছাত্রদের আন্দোলনের ফারাক কোথায় এবং শেষোক্ত আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাগুলি কী কী তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন ও এই আন্দোলনের ভিত্তি কৃষক সংগ্রামের সঙ্গে তাদের একাত্ম হতে বলেছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি ভারতবর্ষের ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ইতিহাস আরও গভীরভাবে অধ্যয়ন করার জন্য বুদ্ধিজীবীদের কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন – যে কাজ বহু সংখ্যক প্রগতিশীল ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী কাঁধে তুলে নিয়েছেন ও এগিয়ে নিয়ে গেছেন।

আমাদের ভুলগুলির জন্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সেই সময়কার মূল্যায়নকে দায়ী করা অথবা কোনো ভুলই হবে না – এই আশায় তথাকথিত ‘মেলানো’র পণ্ডিতি মনোভাব গ্রহণ করা এক অসুস্থ চিন্তারই প্রকাশ। যে কোনো বিপ্লবী অভ্যুত্থানই দক্ষিণ ও বাম বিচ্যুতিগুলির জন্ম দিতে বাধ্য; “অতীতের গণ্ডি ভাঙতে না পারার দরুণ দক্ষিণ বিচ্যুতি” ও “বর্তমানের সঠিক মূল্যায়নের অভাবে বাম বিচ্যুতি”। আমাদের সমস্ত ভুলের জন্য কেবল আমরাই দায়ী, আর যে কোনো বিপ্লবী অভ্যুত্থানে ভুলত্রুটি অনিবার্য। এসব ভুলের মধ্যে দিয়েই কমিউনিস্টরা শিখতে পারেন, নেতা এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণও হয় এভাবেই – এছাড়া অন্য কোনো রাস্তা নেই।

খতম-যুদ্ধের সামরিক রূপ বা সামরিক লাইনের উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক লাইনের সেবা করা আর সমগ্র বিপ্লবী প্রক্রিয়ার লক্ষ্যই ছিল বিপ্লবী গণলাইনের বিকাশ ঘটানো।  ‘নিজেদের গ্রামগুলি মুক্ত করার জন্য কৃষকদের সামিল করাতে হবে, তাঁদের বলতে হবে – জমিদাররা নয়, আপনারাই হবেন গ্রামের সমস্ত ব্যাপার ঠিক করার একমাত্র কর্তৃত্ব, সমস্ত জমি, সব পুকুর হবে আপনাদের, জমিদাররা খতম হওয়ার পর পুলিশ জানতে পারবে না যে কার জমি কে চাষ করছে ইত্যাদি’ – কৃষকের কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতার এই প্রচার যা তাঁদের মানসিক গঠন অনুসারে ও এমন সহজবোধ্য ভাষায় নিয়ে যাওয়া হত যে তাঁরা বিপ্লবী উদ্দীপনায় জেগে উঠতেন – এটা ছিল কমরেড চারু মজুমদারের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এই প্রচার ছিল সংশোধনবাদী প্রচারের সম্পূর্ণ বিপরীত। কাপুরুষ হিসাবে জনগণের ভূমিকাকে নাকচ করে দিয়ে কয়েকজন অগ্রণীকে ‘ব্যক্তিবীর’ হিসাবে গ্রহণ করার ভিত্তিতে নয়, বরং জনগণের মধ্যে যে প্রচণ্ড সৃজনীশক্তি লুকিয়ে আছে তার ওপর গভীর আস্থার ভিত্তিতেই চারু মজুমদার খতমকে সূত্রবদ্ধ করেছিলেন। তাঁর রচনাগুলি আগাগোড়া  এই ভাবমানসেই উদ্দীপ্ত হয়ে আছে আর তাই গোটা পার্টি জনগণের পরিপূর্ণ আস্থার ওপরেই দাঁড়িয়েছিল। এই আস্থার কণামাত্রও তাঁর বিরোধীদের মধ্যে দেখা যায় না, যারা জনগণ সম্পর্কে অবিশ্বাস থেকে কোনো না কোনো বুর্জোয়া পার্টির সঙ্গে ফ্রন্ট গড়ার ওকালতি করেন।

দেশের রাজনৈতিক জীবনে ভূমিহীন ও গরিব কৃষকদের সামনে নিয়ে আসা – সমস্ত বুর্জোয়া তাত্ত্বিক ও অর্থনীতিবিদ এই ব্যাপারটি মেনে নেন, যখন তারা বলেন যে দরিদ্র গ্রামবাসীদের অসন্তোষ থেকেই নকশালবাদের জন্ম – এবং কংগ্রেস সরকারের ভূমি সংস্কার পদক্ষেপগুলিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে কৃষি বিপ্লবকে আশু কর্তব্য হিসাবে তুলে ধরা, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের ও ভারতীয় সর্বহারার চিন্তার স্তরকে সংশোধনবাদী রাজনীতির টুকিটাকি থেকে মাতৃভূমির মুক্তির স্বপ্নে নিয়ে যাওয়া এবং আন্তর্জাতিক সর্বহারা ও নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে হাজারে হাজারে তরুণ শক্তি নিয়ে আসা এবং যে নকশালবাদ নকশালবাড়ির মাটিতে জন্ম নিলেও যা কেবল পরবর্তীকালেই নির্দিষ্ট ও বিকশিত রূপ নিয়েছিল (কানু সান্যাল ঠিক এই ব্যাপারটিকে বোঝেন না আর সেই কারণেই নিজের ব্যর্থতার মূল কারণও ধরতে পারেন না) এবং যা ভস্মস্তূপ থেকেও এবং তাঁকে ছাড়াই বারবার উঠে দাঁড়ায় তাকে এক দেশব্যাপী রাজনৈতিক ধারা হিসাবে গড়ে তোলা আর সর্বোপরি, ভারতীয় সর্বহারার বিপ্লবী পার্টি সিপিআই(এমএল)-কে গড়ে তোলা – এগুলিই ছিল তাঁর প্রধান প্রধান অবদান তথা তাঁর বিপ্লবী লাইনের মূল বিষয়বস্তু।

যাই হোক, বিপ্লবী পরিস্থিতিকে বাড়িয়ে দেখা, ভারতবর্ষের বস্তুগত পরিস্থিতি সম্পর্কে অসম্পূর্ণ উপলব্ধি ও খতমের সংগ্রামের সাধারণীকরণ এবং সেই সঙ্গে পার্টিতে ভাঙ্গনগুলি ও অসংগঠিত অবস্থা, বাংলাদেশের ঘটনা ও রুশ-ভারত সামরিক চুক্তির মধ্য দিয়ে শাসকশ্রেণীগুলির সাময়িক স্থিতিশীলতা অর্জন – প্রভৃতি কারণে শত্রুর প্রচণ্ড দমনের মুখে আমরা গুরুতর ধাক্কার কবলে পড়লাম।

খতম নিয়ে যে বাড়াবাড়ি চলেছে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে তাকে গণসংগ্রামের সঙ্গে মেলানো যায়নি – চারু মজুমদার একথা উপলদ্ধি করেন এবং ধাক্কা ও পার্টির অসংগঠিত অবস্থা যে পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল তার মূল্যায়ন করেন। তিনি তাই রাজনীতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ পার্টি ও শ্রমজীবী মানুষের, বিশেষত বাম পার্টিগুলির সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবীদের নিয়ে কংগ্রেস রাজত্বের বিরুদ্ধে যুক্তমোর্চা গড়ে তোলার আহ্বান রাখেন। তিনি নির্দিষ্টভাবে সশস্ত্র সংগ্রাম নয়, সাধারণভাবে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ভিত্তিতেই যুক্তমোর্চা গড়ে তোলার কথা বলেছিলেন ও নির্বাচিত এলাকাগুলিতে ভূমিসংস্কারের জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর বিশেষ জোর দিয়েছিলেন। স্পষ্টতই এটা ছিল নতুন পরিস্থিতিতে পিছিয়ে আসারই কর্মনীতি, কিন্তু পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল পশ্চাদপসরণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কারণ, প্রথমত, তখনও এই পশ্চাদপসরণকে খুবই সাময়িক ব্যাপার হিসাবে নেওয়া হয়েছিল এবং অল্পদিনের মধ্যেই আবার ব্যাপক বিস্তৃত গণঅভ্যুত্থানের আশার ওপর এই রণকৌশল নির্ভরশীল ছিল। দ্বিতীয়ত, সংগ্রাম ও সংগঠনের বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করার মধ্যে দিয়ে পিছিয়ে আসার কর্মনীতি ও পদ্ধতিগুলিকে পরিষ্কারভাবে সূত্রবদ্ধ করা হয়নি।

সংগ্রামে ধাক্কা, পার্টিতে ভাঙ্গন ও পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠনের সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে কমরেড চারু মজুমদারের প্রতি অনুগত ব্যাপক সাধারণ কর্মীরা কেন্দ্রীয় কমিটির পুনর্গঠনের সাময়িক পর্যায়ের জন্য তাঁর হাতেই সমস্ত কর্তৃত্ব তুলে দেন। তাঁর চারিদিকে যেসব উচ্চাকাঙ্খী ব্যক্তিরা ছিল তাদের অনেকে এই ব্যাপারটিকে এক সাধারণ চরিত্র দিয়ে বসে, নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ‘ব্যক্তিগত কর্তৃত্বে’র ধারণা প্রচার করতে থাকে এবং কেন্দ্রীয় কমিটিকে পুনর্গঠিত করার পথে বাধা সৃষ্টি করতে থাকে। শেষপর্যন্ত তারা পার্টি ও কমরেড চারু মজুমদারের প্রতিই বিশ্বাসঘাতকতা করে।

সারসংক্ষেপ করে বলা যায় যে পার্টি যে ভুলগুলি করেছিল তা হল – সংগ্রামের রূপ হিসাবে খতমকে সারা ভারতের প্রতিটি বিন্দুতে প্রযোজ্য বলে সাধারণীকরণ করে ফেলা, একে এক অভিযান হিসাবে নেওয়া, যদিও এর এক সামগ্রিক দিশা ছিল এবং কোনো কোনো এলাকায় সাফল্যও এসেছিল, তবুও এই সংগ্রামকে গণসংগ্রামগুলির সঙ্গে মেলানোর জন্য এক পরিপূর্ণ ও সুসঙ্গত কর্মনীতি স্থির করতে না পারা এবং ধাক্কার গুরুতর লক্ষণগুলি দেখা দেওয়ার সাথে সাথে সামরিক আক্রমণ থেকে রাজনৈতিক আক্রমণের দিকে পরিকল্পিত ও সুশৃঙ্খল পশ্চাদপসরণ করতে ব্যর্থ হওয়া। মোটামুটিভাবে স্থায়ী অভ্যুত্থানের অবস্থা বিরাজ করছে – ভারতবর্ষের বিপ্লবী পরিস্থিতিকে এইভাবে বাড়িয়ে দেখা, ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে অসম্পূর্ণ উপলদ্ধি, মনোগত আকাঙ্খা থেকে যে কোনো বিশেষকে সাধারণীকরণ করে ফেলার ভুল পদ্ধতি, পার্টির শৈশবাবস্থা ও সংশোধনবাদী বিশ্বাসঘাতকতার প্রতিক্রিয়া হিসাবে পার্টি নেতৃত্বের অধৈর্যপনা – এগুলিই ছিল উপরোক্ত ভুলগুলির উৎস।

কমরেড চারু মজুমদার শহীদ হওয়ার ফলে পরিস্থিতি এক জটিল মোড় নিল। গুরুত্বের সাথে ভুলগুলিকে শুধরে নেওয়ার কাজ শুরু হতে পারল দীর্ঘ পাঁচ বছর পরেই, অর্থাৎ ১৯৭৭ সালে।

কমরেড চারু মজুমদার শহীদ হওয়ার পর শর্মা ও মহাদেব ১৯৭২ সালের ৫-৬ ডিসেম্বর একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন। লিন পিয়াও ঘটনার সাথে সাথে ১৯৭৩-এর শুরুতে তাঁরা আলাদা হয়ে যান এবং প্রত্যকেই নিজস্ব উপদলীয় স্বার্থে নিজের নিজের কেন্দ্রীয় কমিটির নামে চারু মজুমদারের নীতিহীন নিন্দা অথবা উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে থাকেন। বিশেষত মহাদেব মুখার্জী উদ্ভট উদ্ভট কাণ্ডকারখানায় মেতে ওঠেন। তিনি  ‘চারু মজুমদারের প্রতিটি কথার বিশুদ্ধতা রক্ষা’র নামে পার্টিকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে দাঁড় করান এবং কৃষকদের সংগ্রাম থেকে বিচ্ছিন্নভাবে এ্যাকশন বাড়িয়ে তোলেন। এইভাবে তিনি বিপ্লবী শক্তিগুলির গুরুতর ক্ষতি ডেকে আনেন, বিশেষত পশ্চিমবাংলায় এবং শেষপর্যন্ত নিজেকেই ধ্বংসের পথে নিয়ে যান।

এই সংকট মুহূর্তে বিহার রাজ্য কমিটির কমরেডরা ও নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য নেতৃত্বকারী টিমের কমরেডরা মহাদেব ও শর্মার বিরুদ্ধে সংগ্রামে অভিজ্ঞতাগুলি এবং বিহারের নতুন অভ্যুত্থান ও ধাক্কার পরে পশ্চিমবঙ্গে পুনর্গঠনের অভিজ্ঞতাগুলি বিনিময় করেন। ইতিমধ্যে দিল্লীর কমরেডরাও এই ধারার সাথে যোগ দেন। কমরেড জহরের নেতৃত্বে ১৯৭৪ সালের ২৮ জুলাই কেন্দ্রীয় কমিটি পুনর্গঠিত হয়। সেই সময় বিহারে, বিশেষত ভোজপুর ও পাটনা অঞ্চলে কৃষক সংগ্রাম চলছিল, পশ্চিমবঙ্গেও নতুন করে কৃষক সংগ্রাম সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চলছিল। এই সমস্ত সংগ্রামকে পথ দেখানো ও নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটি কেন্দ্রের একান্ত প্রয়োজন তখন বিশেষভাবে অনুভূত হচ্ছিল। মহাদেব ও শর্মা কোম্পানির হাতে চারু মজুমদারের লাইনের বিকৃতি ঘটার পর তার লাইনের বিপ্লবী মর্মবস্তুকে রক্ষা করাই হয়ে উঠল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য। এই কেন্দ্রীয় কমিটির ঘোষিত লক্ষ্যগুলি ছিল : (ক) কমরেড চারু মজুমদারের বিপ্লবী লাইনের মর্মবস্তুকে রক্ষা করা; (খ) এই ভিত্তিতে পার্টিকে রাজনীতিগতভাবে ঐক্যবদ্ধ করা; (গ) ভারতের কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের ঐক্যবদ্ধ করা।

সেই সময় পর্যন্ত এই কেন্দ্রীয় কমিটির কাজের ক্ষেত্র কেবল বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লী ও উত্তরপ্রদেশের একটি ছোটো অঞ্চলেরই সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে আসামের অনেক কমরেডও এর সাথে যোগ দেন। সেই সময়ে অন্ধ্র, তামিলনাড়ু ও কেরালার কমরেডরাও কৃষকদের মধ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁরা কিছু কিছু জঙ্গী সংগ্রাম গড়ে তুলছিলেন এবং শর্মা ও মহাদেব চক্রের প্রবণতাগুলির মতো বিভিন্ন প্রবণতার বিরুদ্ধেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। বিভিন্ন স্তরের পার্টি কমিটিগুলিতে তাঁরা সংগঠিত ছিলেন। বিশেষত তামিলনাড়ুর কমরেডরা রাজ্য কমিটির অধীনে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু পুনর্গঠিত পার্টি কেন্দ্র তাঁদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি, আর এই কারণে বিপ্লবী দিশায় পুনর্গঠিনের প্রক্রিয়া বিলম্বিত হয়। দেশের সর্বত্রই বিপ্লবী আন্দোলনগুলি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল এবং অনেক কমরেডই হয় শহীদ আর না হয় গ্রেপ্তার হয়ে গিয়েছিলেন। কিছু সময় পরে শর্মা ও মহাদেবের কেন্দ্রীয় কমিটিগুলিও ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ধ্বংস হয়ে গেল। এমন পরিস্থিতিতে বিপ্লবী দিশায় পার্টি-শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করা ও কৃষক সংগ্রাম সংগঠিত করার প্রচেষ্টা চালনার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোনো পথ ছিল না।

কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করার সাথে সাথে বিহারের কৃষক সংগ্রামে এক নতুন প্রাণের সঞ্চার হল। উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর ও বালিয়া জেলায় এবং পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়িতেও সশস্ত্র এ্যাকশন ও কৃষক সংগ্রাম গড়ে তোলা হল। কমরেড জহর সর্বদাই পার্টির স্বার্থ ও কেন্দ্রীয় কমিটির যৌথ নেতৃত্বকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছিলেন ও ব্যক্তিগতভাবে ভোজপুরের কৃষক সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন। তিনি তীব্রতম শ্রেণীসংগ্রামের মধ্য দিয়ে সামনে আসা শক্তিকে সংগঠিত করা ও সামরিক কার্যকলাপে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বিশিষ্ট সংগঠক ও কমাণ্ডার গড়ে তোলার কর্তব্যকর্ম সামনে এনেছিলেন ও শত্রুর ঘেরাও-দমন ভাঙ্গার জন্য ও জনগণের মনোবল বাড়িয়ে তোলার জন্য চলমান শত্রুবাহিনীর ওপর আক্রমণের ওপর জোর দিয়েছিলেন। সংগ্রামের এই এলাকাগুলিকে তিনি কংগ্রেস-বিরোধী যুক্তমোর্চার ভিত্তি হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন।

যাই হোক, সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় কমিটি ও বিশেষভাবে কমরেড জহরের মধ্যে ভালোমাত্রায় অধিবিদ্যা ছিল। সমগ্র পরিস্থিতি বিবেচনা না করা এবং আনুষ্ঠানিক ও বিষয়ীগত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে কোনো বিশেষ ব্যাপারকে সাধারণ চরিত্র দিয়ে ফেলার ভুল পদ্ধতি – উভয়ই অনুসরণ করেছিলেন। কমরেড জহর তাই তাঁর দার্শনিক রচনা ‘এক ভেঙ্গে দুই – দুই মিলে এক নয়’-তে ‘সঠিক লাইন’কে এভাবে সূত্রায়িত করেন যে সঠিক লাইনের মাত্র বুনিয়াদী দিক ও বিকাশমান দিক থাকে। সঠিক লাইন সম্পর্কে এটা ছিল এক যান্ত্রিক সূত্রায়ন। এতে আমাদের ভুলগুলিকে তত্ত্বের স্তরে শুধরে নেওয়ার পথে আরও বাধা সৃষ্টি হল। তার ওপর, চলমান শত্রুবাহিনীর ওপর আক্রমণকে চলমান যুদ্ধের সূচনা হিসাবে সূত্রায়িত করা ও সমস্ত জায়গার জন্যই এর সাধারণীকরণ – যা ছিল যান্ত্রিকভাবে খতমকে উন্নত স্তরে নিয়ে যাওয়া – ভুল সামরিক লাইনের দিকে নিয়ে যায়। যদিও বহু জায়গাতেই বিপ্লবী কমিটিগুলির নেতৃত্বে জনগণকে পুলিশ ও জমিদারদের আক্রমণের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ সংগ্রামে সংগঠিত করা হয়েছিল, কিন্তু গণআন্দোলন গড়ে তোলা ও কৃষি সংগ্রাম গভীরতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো পূর্ণাঙ্গ ও সুসঙ্গত কর্মনীতি গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন জায়গায় গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি ও ব্যাপকতর পরিধিতে জনগণের উদ্যোগ কমে আসার মধ্য দিয়ে ঐ সব ভুল চিন্তার নেতিবাচক ফলগুলি আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে কমরেড জহর ভোজপুরের যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হন। কিছু কিছু বিবেকবোধহীন (unscrupulous) ব্যক্তি আমাদের পার্টিকে ধ্বংস করার বাসনায় কমরেড জহরকে ভোজপুরের নেতা হিসাবে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করার মধ্য দিয়ে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অর্থাৎ পার্টির পুনর্গঠন এবং পার্টিতে যৌথ নেতৃত্ব ও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা ফিরিয়ে আনা – যা ছাড়া ভোজপুরের সংগ্রাম টিকত না – এই ভূমিকাকেই অস্বীকার করেন। এভাবে তাঁরা নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে এই মহান বিপ্লবী নেতার অসম্মান করেন।

১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে বিপ্লবী শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার ব্যাপারে এই কংগ্রেস এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও সেই সময়কার রাজনৈতিক লাইনকেই সঠিক বলে ঘোষণা করল। পুরো ১৯৭৬ সাল জুড়ে আমরা কঠিনতম পরিস্থিতিতে সংগ্রামকে ও পার্টিকে টিকিয়ে রাখলাম। কৃষকদের বিভিন্ন অংশকে সমাবেশিত ও সংগঠিত করার জন্য রাজনৈতিক অভিযান হিসাবে চলমান এ্যাকশন অভিযানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া, মাঝে মাঝে এ্যাকশন করা, কৃষিশ্রমিকদের ধর্মঘটের আকারে গণসংগ্রাম এবং জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রাম – এসব অব্যাহত রইল। পাটনা ও উত্তর বিহারের অন্য কিছু অঞ্চলে, উত্তরপ্রদেশের গাজীপুর ও বালিয়ায় এবং পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ি ও বাঁকুড়ায় আবার সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা চলছিল। বিপ্লবী কমিটিগুলির মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত করার জন্য এবং প্রধানত ভোজপুর ও নকশালবাড়িতে সশস্ত্র ইউনিটগুলিকে আবার গড়ে তোলার জন্যও প্রচেষ্টা চলছিল। ১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৭৬ সালের এই সমগ্র পর্ব জুড়ে আমাদের সর্বপ্রধান ঘাটতি ছিল এই যে প্রথমত, আমরা বিহারে ছাত্র, যুবক ও জনগণের সমস্ত অংশের কংগ্রেস বিরোধী অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত হতে পারিনি, যে অভ্যুত্থান পরবর্তীকালে জয়প্রকাশের নেতৃত্বে চলে যাওয়ায় শক্তিহীন হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয়ত, জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার সময়ে যখন নেতাদের গ্রেপ্তারি ও জনগণের ওপর অত্যাচারের দরুণ আন্দোলন ভেঙে পড়ল তখন আমরা বাকি শক্তির সামনে কোনো পথনির্দেশ রাখতে বা তাঁদের সংগঠিত করতে পারিনি। কংগ্রেস বিরোধী যুক্তমোর্চা গড়ে তোলার লাইন আমরা ধরে রেখেছিলাম এবং আমাদের এলাকাগুলিকে এর মডেল হিসেবে তুলে ধরেছিলাম বটে, কিন্তু কংগ্রেস বিরোধী গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে একে মেলাতে পারিনি। এর কারণ ছিল এই যে কমরেড চারু মজুমদারের ঘোষণার ওপর ভিত্তি করে যুক্তমোর্চার বিকাশ সম্পর্কে আমরা এক যান্ত্রিক ধারণা গড়ে তুলেছিলাম এবং সেই যাত্রিক কাঠামোর বাইরে ঠিক যেভাবে সবকিছুর বিকাশ ঘটছিল তা বিশ্লেষণ করে দেখতে অস্বীকার করেছিলাম। এই শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যৎ পথের ওপর এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রেখে গেছে।

১৯৭৭ সালে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতিতে ও আমাদের আন্দোলনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দেখা গেল। তামিলনাড়ু, অন্ধ্র ও কেরালার কমরেডদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে উঠল এবং এর ফলে আমাদের পার্টি এক সর্বভারতীয় চেহারা পেল। জরুরি অবস্থার সময়ে সংগ্রামের সমস্ত ফ্রন্টই যখন মোটামুটি নীরব ছিল, তখন কেবল আমরাই কঠিনতম পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছিলাম ও ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিলাম; তাই সংবাদপত্রের সেন্সার ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার পর ভোজপুর শিরোনামে স্থান পেতে লাগল। ১৯৭৬ সালের মধ্যে প্রয়োগের দ্বান্দ্বিকতা আর তত্ত্বের ক্ষেত্রে অধিবিদ্যা – এই দুইয়ের মধ্যে দারুণ সংঘাত লাগল এবং প্রয়োজনীয় শর্তগুলি হাজির হলেই পার্টি এক বড় আকারের পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেছিল। এর সূত্রপাত হল ‘পার্টির মধ্যেকার ভুল চিন্তাধারার সংশোধন’ (কেবলমাত্র ফৌজি ইউনিটগুলির ক্ষেত্রে) দিয়ে, আর বড় বড় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিবর্তন এবং কৃষক সংগ্রামের এক নতুন জোয়ারের সঙ্গে মিলে এটা হয়ে দাঁড়াল পার্টি-জোড়া এক পূর্ণাঙ্গ শুদ্ধিকরণ আন্দোলন।

সংক্ষেপে, অতীতকে দেখা সম্পর্কে এই হল আমাদের মূল্যায়ন – আমাদের মূল সফলতাগুলি ও প্রধান ত্রুটিগুলি সম্পর্কে  আমাদের মূল্যায়ন। এছাড়া আরও অনেক ছোটোখাটো দিক আছে যা নিয়ে হয় ১৯৭৯ সালের পার্টি সম্মেলনে আলোচনা হয়েছিল অথবা যেগুলি বর্তমানে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। আমাদের বিশ্লেষণ দেখিয়ে দিচ্ছে যে কীভাবে অতীত সম্পর্কে মূল্যায়ন আমাদের আন্দোলনের মধ্যে বিভিন্ন বিলোপবাদী ও নৈরাজ্যবাদী ধারার জন্ম দিয়েছে আর কীভাবেই বা আমরা অতীতের শিক্ষাগুলিকে বর্তমানের প্রয়োজনের সঙ্গে মিলিয়ে বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে চলেছি।