(লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৯৯ থেকে। দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল)

রাজনীতি ছাড়া আরেকটা বিষয়ে আমার বেশ ভালোরকম আগ্রহ আছে – সেটি হল মহাবিশ্বের তত্ত্ব। আমার কাছে রাজনীতি হল এমন এক মাধ্যম যাতে সমাজের সূক্ষ্ম জটিলতাগুলি প্রকাশিত হয়। আর মহাবিশ্বে অনন্ত স্থান ও কালের মধ্যে এই বিশ্বজগৎ নিজেকে প্রকাশ করে – যেখানে প্রতিটি নীহারিকা বিশ্বের ক্রমবিলীয়মান সীমানার মধ্যে দ্রুতই পরস্পরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে; যেখানে এক একটি নক্ষত্র রূপ নিচ্ছে, আলো দিচ্ছে, আবার বিরাট বিস্ফোরণে চরম পরিণতি পাচ্ছে; যেখানে, অত্যন্ত স্পষ্টতই, গতিই হল বস্তুর অস্তিত্বের রূপ।

মানবসমাজের অস্তিত্ব গতি, অর্থাৎ পরিবর্তন ও রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে অভিব্যক্ত হয়। আর এই গতি সবসময়েই আরও বেশি সুসংবদ্ধ হয়ে ওঠার দিকে। কোনও ধারণাই চরম নয়, কোনও সমাজই ত্রুটিহীন নয়। যখনই কোনও সমাজব্যবস্থাকে পরম ধারণার মূর্ত রূপ হিসাবে গণ্য করা হয়েছে, তখন তারই গভীরতম অন্তঃস্থল থেকে এক উত্তাল আলোড়ন এসে তাকে ভিতসুদ্ধ কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে। আর তারপর, সর্বব্যাপী হতাশার মধ্যে আবার জন্ম নিয়েছে নতুন নতুন স্বপ্ন। কিছু স্বপ্ন কখনই বাস্তব হয়ে ওঠে না কারণ সেগুলি আত্ম-আবদ্ধ মানব মনের আকাশ-কুসুম কল্পনা। কেবল সেসব স্বপ্নই বাস্তবায়িত হয় যেগুলি আত্মসচেতন মানব মনের বিমূর্ত রচনা।

আমার স্বপ্নের ভারত এমন এক ঐক্যবদ্ধ ভারত যেখানে কোনও পাকিস্তানি মুসলিমকে তাঁর শিকড়ের সন্ধানে আসতে আগে ভিসার সন্ধানে ছুটতে হয় না। একইভাবে যেখানে একজন ভারতবাসীর কাছে মহান সিন্ধু সভ্যতার ধাত্রীভূমি বিদেশ নয়। যেখানে বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুর মন থেকে শেষ পর্যন্ত মুছে যাবে ঢাকার তিক্ত দিনগুলির স্মৃতি। একজন বাংলাদেশী মুসলিমকে ভারত থেকে বিদেশী নাগরিক বলে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেওয়া হবে না।

কথাগুলি বিজেপির মতো শোনাচ্ছে কি? অথচ বিজেপি কিন্তু মুসলিম পাকিস্তান আর হিন্দু ভারতের (অবশ্য ততটা বিশুদ্ধ নয়) মধ্যে দেশের এই মহাবিভাজনকে মূলধন করেই টিকে আছে। তারা এই বিভাজনকে তার চরম সীমায় নিয়ে যেতে উদ্যত, তার ফলাফল যত মারাত্মকই হোক না কেন। আর এই কারণেই আমি নিশ্চিত যে তিনটি দেশেই দেখা দেবেন মহান চিন্তানায়করা, যাঁরা এক সৌভ্রাতৃত্বময় পুনর্মিলনের পক্ষে জনমতকে ঘুরিয়ে দিতে পারবেন। আর বিজেপির মতো শক্তিগুলির কাছে নিঃসন্দেহে সেই হবে “শেষের সেদিন ভয়ঙ্কর”।

আমার স্বপ্নের ভারতে গঙ্গা ও কাবেরী, সিন্ধু ও ব্রহ্মপুত্র মুক্তধারায় পরস্পর মিলেমিশে বয়ে চলবে। ভারতের সমস্ত মহান সুরসৃষ্টির যুগলবন্দীতে জেগে উঠবে ভোর। কোনও এক রাষ্ট্রনায়ক তখন তাঁর টুকরো লেখাগুলিকে গেঁথে লিখতে বসবেন “ভারতের পুনরাবিষ্কার”।

বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে আমার স্বপ্নের ভারত মাথা তুলে দাঁড়াবে এমন এক দেশ হিসাবে যাকে তার দুর্বলতম প্রতিবেশীও ভয় পাবে না, আবার দুনিয়ার প্রবলতম দেশটিও তাকে ভয় দেখাতে বা ব্ল্যাকমেল করতে পারবে না। এই ভারত থাকবে দুনিয়ার প্রথম পাঁচটি দেশের মধ্যে – অর্থনৈতিক অবস্থার দিক থেকে তো বটেই, অলিম্পিক পদক সংখ্যার দিক থেকেও।

আমার স্বপ্নের ভারত হবে এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, যার নীতি হবে ‘সর্ব ধর্ম সমভাব’ নয়,‘সর্ব ধর্ম বর্জিত’। ব্যক্তির বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ না করেও রাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির প্রসারে সচেষ্ট হবে।

ধর্মকে সঠিকভাবেই পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের অসহায়তার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাই ধর্মের অবসান ঘটাতে গেলে প্রয়োজন মানবজীবনের বস্তুগত ও আত্মিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন, যাতে মানুষ তার পরিবেশের নিয়ন্তা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। ভারতে যখনই রক্ষণশীল কোনও দার্শনিক ধারা জগদ্দল পাথরের মতো মানুষের ওপর চেপে বসেছে, তখনই জন্ম নিয়েছে মহান মহান সংস্কার আন্দোলন। আর তাই আমি স্বপ্ন দেখি যুক্তিবাদী চিন্তাধারার এক মহান পুনরুত্থানের, যখন মানুষের যে অন্তরাত্মা ঈশ্বররূপে মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল তা মানুষের মধ্যেই নিজেকে আবার ফিরে পাবে। আর মানবমনের এই সংস্কার আসবে এক সমাজবিপ্লবের হাত ধরে, যখন সম্পদের স্রষ্টারাই হয়ে উঠবেন সম্পদের প্রকৃত অধিকারীও।

আমার স্বপ্নের ভারতে অস্পৃশ্যদের হরিজন নাম দিয়ে মহিমান্বিত করার পরিহাস বন্ধ হবে, দলিত বলে কোনও বিশেষ বর্গ থাকবে না। সেখানে জাতগুলি মিশে যাবে শ্রেণীতে এবং তারও প্রত্যেক সদস্যের থাকবে নিজের স্বকীয়তাকে অভিব্যক্ত করার পূর্ণ সুযোগ।

আমার স্বপ্নের ভারতের প্রতিটি শহরে থাকবে কফি হাউস, যেখানে বরফঠাণ্ডা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বুদ্ধিজীবীরা চালাবেন গরম গরম আলোচনা। সেখানে কোনও বিরহী হৃদয় ভেসে বেড়ানো সিগারেটের ধোঁয়ায় খুঁজে বেড়াবে তার প্রিয়ার মুখ। শিল্প ও সাহিত্যের বহু বিচিত্র সৃষ্টির নতুনতর ব্যাখ্যা গোগ্রাসে গিলবে কত বুভুক্ষু মন। শিল্প বা সাহিত্যের ওপর রাষ্ট্রের কোনও বিধিনিষেধ থাকবে না , কিন্তু সমস্ত জনবহুল স্থানে ধূমপান হবে নিষিদ্ধ। ব্যতিক্রম – একমাত্র ঐ কফি হাউসগুলি।

যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেই প্রসঙ্গে ফিরে যাই। আমি এমন এক ভারতের স্বপ্ন দেখি, যেখানকার মহাকাশযান ছুটে যাবে গভীর মহাশূন্যে। ভারতের বিজ্ঞানী ও গণিতবিদেরা কষবেন সমীকরণ – প্রকৃতির মৌলিক শক্তিগুলিকে একটি একক সূত্রে গাঁথার চেষ্টায়।

পরিশেষে, আমার সব স্বপ্নের সেরা স্বপ্ন এমন এক মাতৃভূমি যেখানে প্রতিটি নাগরিকের রাজনৈতিক স্বাধীনতা সব থেকে মূল্যবান বলে গণ্য হবে। যেখানে ভিন্নমত পোষণ করা হবে স্বাভাবিক ব্যাপার। যেখানকার তিয়েনআনমেনের মতো ঘটনার মোকাবিলা করবেন নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান রাষ্ট্রনায়করা আর নিরস্ত্র গণমিলিশিয়া।

আমার স্বপ্নের ভারত দাঁড়িয়ে আছে আজকের ভারতীয় সমাজের বুনিয়াদী প্রক্রিয়াগুলির ওপর ভিত্তি করে। আর একে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য আমার মতো বহু মানুষ তাঁদের শেষ রক্তবিন্দুও উৎসর্গ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।