এই বইটি কমরেড বিনোদ মিশ্রের প্রতিনিধি-স্থানীয় রচনাসমূহের এক নির্বাচিত সংকলন। রচনাগুলি মুখ্যত চারটি উৎস থেকে গ্রহণ করা হয়েছে : বিভিন্ন পার্টি সম্মেলনে ও কংগ্রেসে উপস্থাপিত ও গৃহীত দলিলসমূহ; পার্টির মুখপত্রগুলির জন্য লেখা প্রবন্ধসমূহ – যার অধিকাংশই ইংরাজিতে লেখা – যদিও কয়েকটি হিন্দি এবং বাংলাতেও রচিত; প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার সমূহ এবং পার্টি থেকে প্রকাশিত পুস্তক ও পুস্তিকাসমূহের মুখবন্ধ; বিভিন্ন সেমিনার, কনভেনশন, আন্তঃপার্টি সভা ও জনসভা এবং পার্টি স্কুল ও কংগ্রেসে প্রদত্ত অসংখ্য ভাষণ। জরুরি অবস্থার পরবর্তীকালে শুদ্ধিকরণ আন্দোলনের সময়ে যখন পুনর্গঠিত পার্টি বিভিন্ন গণ-রাজনৈতিক উদ্যোগ নিতে থাকে তখন থেকে শুরু করে আইপিএফ আমলে যখন গোপন পার্টি এক প্রকাশ্য ও বহুমাত্রিক সর্বভারতীয় রাজনৈতিক ফ্রন্টের মতাদর্শগত-রাজনৈতিক কেন্দ্র তথা সাংগঠনিক মেরুদণ্ডের ভূমিকা পালন করছিল সেই পর্যায় হয়ে ১৯৯২-এর ডিসেম্বরে কলকাতায় অনুষ্ঠিত পঞ্চম কংগ্রেসে পার্টির প্রকাশ্যে আসার পরবর্তী শেষ ছয় বছর পর্যন্ত এক দীর্ঘ সময়কাল এখানে বিধৃত রয়েছে।

মার্কসীয় তত্ত্ব ও অনুশীলনের যে সুবিস্তীর্ণ জগতে বিনোদ মিশ্রের পদচারণা, তার কিছুটা আভাস দেওয়াই এই নির্বাচিত সংকলনের উদ্দেশ্য। এক ডজনেরও বেশি শাখায় বিধৃত এই রচনাগুলি বিনোদ মিশ্রের স্বপ্নের ভারতের বাণীরূপ দিয়ে শুরু করা হয়েছে এবং শেষ করা হয়েছে তাঁর পরমপ্রিয় পার্টির প্রতি উদাত্ত আহ্বান দিয়ে। একটি মাত্র খণ্ডের মধ্যে বাছাই পর্বকে সীমিত রাখার বাধ্যবাধকতার জন্য অন্তর্ভুক্ত প্রতি বিষয়েই কমপক্ষে চার থেকে পাঁচটি লেখা বাদ পড়ে গেছে। হিন্দি পত্রিকা “শ্রমিক সলিডারিটি” ও “সমকালীন জনমত” এবং ইংরাজি সাময়িকী “ভয়েস অফ অলটারনেটিভ” ও “পিপলস ফ্রন্ট”-এ প্রকাশিত তাঁর সমস্ত রচনাগুলিই বাইরে থেকে গেছে, বাদ গেছে পার্টি সম্মেলন ও কংগ্রেসগুলিতে গৃহীত নানা দলিলসমূহের বিস্তৃত অংশগুলি, কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোর সভার কার্য-বিবরণী ও আরও বেশ কিছু লিখিত নথি।

তৎসত্ত্বেও বর্তমান সংকলন থেকে বিশটি উত্তাল বছর জুড়ে পার্টি-তরণীর কাণ্ডারী হিসেবে বিনোদ মিশ্রের বৌদ্ধিক সৃষ্টির যে বিশাল পরিসর ও বৈচিত্র্য, পাঠকরা তার এক স্পষ্ট ধারণা পাবেন। তদুপরি, তাঁর প্রতিটি রচনায় – তা সে ‘আমার স্বপ্নের ভারত’-এর মতো ভিন্নধর্মী লেখায় হোক কিংবা লিবারেশন ও এম-এল আপডেটের সম্পাদকীয় নিবন্ধেই হোক – যা অনবদ্যভাবে বিম্বিত হয় তা হল প্রখর সৃজনশীল প্রেরণা।

১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকে গোপন ছাপাখানার জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরপতায় এবং গোপন পার্টি জীবনের চরম অনিশ্চয়তা ও কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে হাতে লেখা দুষ্পাঠ্য পাণ্ডুলিপিগুলি এবং ১৯৯০-এর দশকের শেষভাগে অপেক্ষাকৃত ধীরে সুস্থে এবং সময়বিশেষ সরাসরি কম্পিউটারে লেখা রচনাগুলিতে – তাঁর বৌদ্ধিক সৃষ্টিগুলির বস্তুগত পারিপার্শ্বিকতায় অনেক তারতম্যই ঘটেছে। কিন্তু সব সময়ই লেখা তাঁর কাছে ছিল শ্রেণীসংগ্রামের এক সচেতন ক্রিয়া আর লেখক বিনোদ মিশ্রের মধ্যকার সৃজনশীল প্রেরণা হিসেবে থেকেছে বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে তাঁর অফুরন্ত উৎসাহ। মার্কসবাদের বিপ্লবী ঐতিহ্যের অনুক্রমে তিনি বিভিন্ন চিন্তা ও মতাদর্শের সংঘাতকে দেখতেন শ্রেণীসংগ্রামের এক প্রধান উপাদান হিসেবে, আর তাই তাঁর অধিকাংশ রাজনৈতিক রচনাতেই দেখা যায় এক বিতর্কমূলক চরিত্র।

বিষয়বৈচিত্র্যে এই রচনাগুলির ব্যাপ্তি বহুদূর পর্যন্ত প্রসারিত। এতে প্রতিফলিত হয়েছে ১৯৭০ দশকে বস্তুত এক ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়ানো থেকে শুরু করে ১৯৮০ ও ১৯৯০-এর দশকে কঠিন মতাদর্শগত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে চলার সময় পর্যন্ত পার্টির দীর্ঘ পথপরিক্রমা। একাধারে নৈরাজ্যবাদী ও অতিবাম বুলিসর্বস্বতার ঝোঁকের বিরুদ্ধে আর অন্যদিকে সমাজগণতন্ত্রীদের আত্মসমর্পণবাদ ও ক্ষুদে উদারনৈতিক সংস্কারবাদের বিরুদ্ধে যুগপৎ সংগ্রাম চালানোর মধ্য দিয়ে সিপিআই(এমএল)-এর বিপ্লবী লাইনের যে বলিষ্ঠ বিবর্তন ঘটেছে সে সম্পর্কেও পাঠকরা এক স্পষ্ট ধারণা পাবেন।

তাঁর সমস্ত লেখার কেন্দ্রবিন্দু হল পার্টি ও বিপ্লব – কিন্তু তা বিমূর্ত ও বিশুদ্ধ মতাদর্শগত সৃষ্টি নয়, বরং ইতিহাস ও সমাজের গভীর ও জটিল প্রক্রিয়ার ফসল। তাঁর কাছে পার্টি হল সর্বহারা শ্রেণীর সংগঠক ও সংগঠন দুই-ই, আর বিপ্লব হল লক্ষ্য তথা এক ক্রমবর্ধমান সম্ভাবনা যা বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মাধ্যমে সর্বহারাকে আত্ম-আবদ্ধ শ্রেণী হিসেবে গঠনের সময় থেকে আত্ম-সচেতন শ্রেণী হিসেবে বিকাশের পর্যায় পর্যন্ত ধারাবাহিক রূপান্তরের প্রেরণা ও দিশা সঞ্চার করে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াগুলি সরলরেখায় এগিয়ে চলে না। বরং এই গতি হল আঁকা-বাঁকা, ছোটো বৃত্ত থেকে বড় বৃত্তের পথে এগিয়ে চলার সর্পিল গতি, আর এই অগ্রগতি কোনো স্থির ছন্দে মসৃণভাবে একটানা এগিয়ে যাওয়ার বদলে বরং ওঠা-পড়া, ভাঙ্গন ও উল্লম্ফনের মধ্য দিয়েই সংঘটিত হয়।

কমরেড ভি এম বিশ্বাস করতেন, সর্বহারাকে বিপ্লবের নেতা হিসাবে উত্তরোত্তর গড়ে তোলা এবং সর্বহারার অগ্রণী বাহিনীর দ্বারা গণ-রাজনৈতিক কার্যকলাপের হাতিয়ার হয়ে ওঠা – এই দুটি কাজ যদি কমিউনিস্ট পার্টি একসাথে করতে না পারে তবে তার অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই সর্বহারার স্বাধীন রাজনৈতিক আত্মঘোষণাই তাঁর কমিউনিজমের ভিত্তিপ্রস্তর হিসাবে থেকেছে এবং এই সারবস্তুটি যাতে হালকা হয়ে না পড়ে, বিকৃতি ও বিপথগামীতার শিকার না হয়, সে বিষয়ে তিনি সর্বদা সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। যে দেশে জনগণের বিপুল গরিষ্ঠাংশ কৃষিজীবী, সেখানে গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিচালনা করতে গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি যদি সর্বহারা শ্রেণীকে সংহত করার তথা সর্বহারা নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী গড়ে তোলার কাজে কোনোরকম অবহেলা দেখায় তবে শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষকদের মধ্যে তার সম্ভাব্য সহযোগীরা পরিণত হবে বুর্জোয়া-জমিদার জোটের রাজনৈতিক আধিপত্যের এক নিষ্ক্রিয় লেজুড়ে। সর্বহারার স্বাধীন ভূমিকার প্রশ্নে এই অবহেলা সাধারণ সময়ে যদি শ্রেণী-সমঝোতা ও বুর্জোয়া রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে অভিব্যক্ত হয়, তাহলে সংকটের সময়ে তা পুরোদস্তুর পক্ষাঘাতে পরিণতি লাভ করে। ১৯৭০ দশকের জরুরি অবস্থার সময়ে এই বিয়োগান্ত পরিণতিই দেখা গিয়েছিল।

বহু লেখায় বিনোদ মিশ্র বারবার পার্টির বিকাশমান ইতিহাস প্রসঙ্গে আলোচনায় ব্রতী হয়েছেন। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূল তত্ত্বে পার্টি লাইনের শিকড়কে নজরে রেখেই তিনি এর বিবর্তনকে অনুশীলনের কষ্টিপাথরে সমালোচনাত্মকভাবে যাচাই করেছেন। কখনো বিস্তার ঘটানোর আহ্বান জানিয়ে, কখনো সংহতকরণের কথা বলে, তিনি সর্বদাই পার্টির সামগ্রিক পরিমাণগত বৃদ্ধি ও গুণগত বিকাশের লক্ষ্যে সংগ্রাম চালিয়েছেন। সবকিছু খুঁটিয়ে দেখার আগ্রহ তাঁর অপরিসীম, কিন্তু তিনি কখনোই বৃক্ষ দেখতে গিয়ে অরণ্যকে ভোলেননি। ভারতের আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা-ঔপনিবেশিক অবস্থায় একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার মহান কর্মকাণ্ডের প্রতিটি দিকেই – সঠিক কাজের ধারার বিকাশ ঘটানো থেকে শুরু করে পার্টির মধ্যে এক প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে তোলা, তত্ত্ব ও প্রয়োগের সমন্বয়সাধন এবং পার্টির প্রতিটি স্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে তোলা – সমস্ত বিষয়েই তাঁর গভীর মনোযোগ ও যত্ন।

বুনিয়াদ ও উপরিসৌধের জটিল আন্তঃক্রিয়ার দিক থেকে ভারতীয় সমাজ সম্পর্কে অধ্যয়নকে আরও গভীরে নিয়ে যাওয়া এবং তদনুসারে ভারতীয় বিপ্লবের কর্মসূচিগত উপলব্ধিকে আরও নিখুঁত করে তোলার বিষয়ে তিনি সর্বদাই বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন। বিকাশমান পরিস্থিতিকে অধ্যয়ন করার সময়ে, যেসব দ্বন্দ্ব ও প্রবণতা পরিপক্ক হয়ে সামনে চলে আসছে সেগুলি বিশ্লেষণ করার সময়ে, তিনি সর্বদাই চেষ্টা করতেন এসবের পিছনে যে সামাজিক বাস্তবতা রয়েছে সেখানে পৌঁছে যাওয়ার, যাতে পার্টির রণনৈতিক বীক্ষা আরও সমৃদ্ধ হয়। বামপন্থার যে প্রতিপত্তিশালী প্রতিকল্প (ডিসকোর্স) কখনই এক ভাসাভাসা উদারনৈতিক ও সাংবিধানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে পেরিয়ে যেতে পারে না, বিনোদ মিশ্রের এই পদ্ধতি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। জাত-পাত ও শ্রেণীর প্রশ্নে হোক বা ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রসঙ্গে, অথবা জনজাতিদের স্বায়ত্তশাসন কিংবা নারীমুক্তির প্রশ্নে, তিনি সর্বদাই তাঁর গভীর বিপ্লবী মার্কসবাদী অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে ছিন্নভিন্ন করেছেন মামুলি ও পরিশীলিত সবরকমের উদারনৈতিক মোহজাল, ফালাফালা করেছেন উত্তর আধুনিকতার প্রবক্তাদের ছড়ানো বিভ্রান্তিগুলিকে।

তাঁর সমস্ত তাত্ত্বিক রচনায় বিনোদ মিশ্র মার্কসবাদ-লেনিনবাদ ও মাও চিন্তাধারার সার্বজনীন বিপ্লবী মর্মবস্তুর সাথে ভারতের নির্দিষ্ট বাস্তবতাকে সৃজনশীলভাবে একাত্ম করেছেন। বলাবাহুল্য, এই একাত্মকরণ এক কষ্টকর ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া এবং এটা বিশেষত রাশিয়া ও চীনের মতো বিজয়ী বিপ্লবের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার আলোকেই কেবল সম্পন্ন হতে পারে। ভারতে কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা ১৯৬০-এর দশকে যে চীনা মডেল দিয়ে শুরু করেছিলেন তা ছিল খুবই স্বাভাবিক, বিশেষত যেহেতু ভারতের স্বীকৃত কমিউনিস্ট নেতৃত্ব কোনোদিনই চীনের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার বিষয়ে মনোযোগ দেননি। চীনা মডেলকে হুবহু অনুকরণ করার প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে ভারতীয় পরিস্থিতির বৈশিষ্ট্যগুলো খুব প্রকটভাবে সামনে চলে আসে এবং কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পরবর্তী প্রজন্মের কাজ হয়ে দাঁড়ায় এইসব বৈশিষ্ট্যের সাথে সঙ্গতি রেখে পার্টি কর্মসূচি ও কৌশলগত লাইনের যথাযথ বিন্যাস ও বিকাশ ঘটানো। ভি এম বিশ্বাস করতেন যে এভাবেই ভারতীয় বিপ্লব তার নিজস্ব পথ ও মডেল খুঁজে নিতে সক্ষম হবে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন এবং সমাজতন্ত্রের প্রচলিত মডেলগুলির পতন ও সংকট তাঁকে প্রবলভাবে নাড়া না দিয়ে পারেনি। ভারতের কমিউনিস্ট সংগঠনগুলির মধ্যে সিপিআই(এমএল)-ই সোভিয়েত বিপর্যককে বুঝতে পারা ও তার ধাক্কা সামলে নেওয়ার প্রশ্নে সবচাইতে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। সিপিআই ও সিপিআই(এম) সর্বদাই সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের গুণকীর্তনে ব্যস্ত থেকেছে, এমনকি যখন সোভিয়েত ব্যবস্থার অচলাবস্থা ও অধঃপতনের দরুণ শেষ পর্যন্ত সেখানে ধ্বস নামতে শুরু করে তখনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অপরদিকে, সিপিআই(এমএল) বরাবর সোভিয়েত পরিস্থিতির মূল্যায়নে খোলাখুলিভাবেই সমালোচনাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে এসেছে। এ সত্ত্বেও ভি এম কখনোই “আমরা আগেই বলেছিলাম” গোছের কথা বলে সমস্যাটাকে এড়িয়ে যাওয়ার সহজ পথে হাঁটেননি। সোভিয়েত-পতন পরবর্তী বুর্জোয়াদের বিজয়োল্লাসের মুখে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট আন্দোলন যে সংকটের মুখে পড়েছিল তাকে তিনি নিছক ফলিত মার্কসবাদের ব্যর্থতা বলে খাটো করে দেখেননি। আসল সমস্যাকে স্বীকার করে নেওয়ার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মানসিকতা থেকে তিনি সমাজতান্ত্রিক উৎপাদন-ধরনের গতিসূত্রগুলি অধ্যয়নের চ্যালেঞ্জটি আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। এই কাজটিকে তিনি পুঁজিবাদী উৎপাদন-ধরন সম্পর্কে পুঁজি গ্রন্থে মার্কস যে ঐতিহাসিক অধ্যয়ন করেছেন তারই মতো বিরাট ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে করতেন।

এক কথায় বলতে গেলে, বিনোদ মিশ্রের নির্বাচিত রচনা সংকলন হল পরিভাষা-বর্জিত, খোলামেলা, আত্মসমালোচনাত্মক ধারায় লিপিবদ্ধ বিংশ শতাব্দীর শেষ চতুর্থভাগে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সুমহান আত্মকথন। স্বাধীনতা-উত্তরকালের একজন মার্কসবাদী হিসাবে তিনি মার্কস, লেনিন ও মাও-এর পাঠ নিয়েছিলেন নকশালবাড়ির বুকে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষে এবং বিহারের বহ্নিমান খেত-খামারে তার বলিষ্ঠ প্রতিধ্বনির মধ্যে। আর তাই তিনি কখনোই সমাজগণতন্ত্রের লন্ডন স্কুল-মার্কা ধ্যান-ধারণা ও গান্ধী-নেহরু ধাঁচের কংগ্রেস সমাজবাদ ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতিকল্প দ্বারা ভারাক্রান্ত হননি। একজন ব্যবহারিক বিপ্লবী বর্তমান সমাজব্যবস্থার অভ্যন্তরে কাজ করতে যতটুকু বাধ্য হন, বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ভারতীয় সংস্করণের সঙ্গে তিনি ততটুকুই যুক্ত হয়েছেন, কিন্তু কখনোই তিনি তাঁর বিশ্লেষণ ও দৃষ্টিকে বুর্জোয়া উদারতাবাদ ও নিয়মতান্ত্রিকতার ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে থাকা সীমানার মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। এ কারণেই তাঁর সমস্ত রচনা অসামান্য স্পষ্টতা ও বিপ্লবী উদ্দেশ্যের প্রতি বিশ্বস্ততায় ভাস্বর হয়ে আছে।

তাঁর রচনাগুচ্ছ মার্কসীয় দ্বন্দ্বতত্ত্বের এক চমৎকার জীবনমুখী পাঠ। তাঁর দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে একদেশদর্শীতা ও গোঁড়ামি থেকে মুক্ত রেখেছিল। অধ্যয়নের বিষয়বস্তুগুলিকে তিনি প্রাসঙ্গিক প্রেক্ষাপটে নির্দিষ্ট করেন, প্রতিটি দিককে অধ্যয়ন করেন অনন্য বস্তুনিষ্ঠার সঙ্গে। কিন্তু তাঁর এই বস্তুনিষ্ঠা নিরপেক্ষ ও স্থানু নয়, বিপ্লবী ও গতিশীল। প্রতিটি প্রক্রিয়ার ক্ষুদ্র অথচ বিকাশমান ইতিবাচক দিকটিকে আয়ত্ত করা ও তারপর তাকে প্রধান ও নির্ণায়ক দিকে রূপান্তরিত করাই ছিল তাঁর দ্বন্দ্বতত্ত্বের মূল বিষয়।

মার্কসের অন্ত্যেষ্টির সময়ে এঙ্গেলস তাঁর সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রয়াত সহযোদ্ধার বহুমাত্রিক ও বর্ণময় সৃজনশীল ব্যক্তিত্বের সবথেকে অমোঘ বর্ণনা দিয়ে বলেছিলেন যে, মার্কস ছিলেন সর্বোপরি একজন বিপ্লবী। পরবর্তীতে লেনিনও মার্কসবাদের বিকৃতির বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন। মার্কসবাদকে তার বিপ্লবী অন্তরাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললে তা হয়ে দাঁড়ায় নিষ্প্রাণ ও সংশোধনবাদী – এই ছিল তাঁর সাবধানবাণী। বিনোদ মিশ্রও ছিলেন সর্বোপরি একজন বিপ্লবী। মার্কসবাদের বিপ্লবী মর্মবস্তুকে পুনরুদ্ধার ও সমৃদ্ধ করাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় আবেগ, এ লক্ষ্যেই তিনি সর্বদা এগিয়ে চলেছেন।

বিনোদ মিশ্রের এই নির্বাচিত রচনা সংকলন ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক মহত্তম বিপ্লবীর অসমাপ্ত ব্রতেরই এক সংক্ষিপ্ত বিবরণী। ঘনায়মান যে বিপ্লব আগামী সহস্রাব্দে উছলে পড়তে চলেছে তারই প্রাণাবেগে স্পন্দিত এই রচনাগুচ্ছ বিশ্ব জুড়ে বিপ্লবী মার্কসবাদের অপ্রতিহত অগ্রগতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত।

দীপঙ্কর ভট্টাচার্য
সাধারণ সম্পাদক
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)