সংগ্রামের সমস্ত রূপগুলির মধ্যে সমন্বয় ও ব্যাপক কৃষক ঐক্যের ওপর গুরুত্ব আরোপের বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট। কিন্তু সি এম-এর নেতৃত্বে সিপিআই(এমএল) কি দ্রুতই সশস্ত্র কার্যকলাপের ওপর একপেশেভাবে জোর দেওয়ার বিচ্যুতির শিকার হয়নি ? অবশ্যই হয়েছে এবং ভুলগুলি শুধরে নেওয়ার ও ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার*“সংশোধনবাদের নির্দিষ্ট প্রকাশগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করুন” (সেপ্টেম্বর ১৯৬৭) রচনায় তিনি লেখেন, “...বুর্জোয়া মতাদর্শের প্রভাব এই চিন্তার মধ্যেও প্রত্যক্ষ করা যায়, যখন আমরা মানুষের থেকেও অস্ত্রের ওপর বেশি নির্ভর করি। ... বুর্জোয়া মতাদর্শের আর এক প্রকাশ হল অ্যাকশনের ওপরই বেশি গুরুত্ব আরোপ করা, রাজনৈতিক প্রচারের ওপর আদৌ কোনো গুরুত্ব না দেওয়া। একেই চেয়ারম্যান মাও বলেছেন 'সমরবাদ' ...”। “পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করুন” লেখাতেও (অক্টোবর ১৯৭১) তিনি বলেছেন, “সংগ্রাম এগিয়ে চলার সাথে সাথে রাজনৈতিক কাজের গুরুত্বও বৃদ্ধি পায়। এক ধরনের চিন্তার ঝোঁক দেখা যায় যাতে ভাবা হয় রাজনৈতিক কাজ অনেক হয়েছে এখন সামরিক কাজই প্রধান কাজ। খোকন (অসীম চ্যাটার্জী) ও তার অনুগামীদের দলিলে তাই বলা হয়েছে। এই বিচ্যুতি লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যায় না, লড়াইয়ের শক্তিকে তা দুর্বল করে।” জন্য সি এম-এর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও এই অতি মারাত্মক বিচ্যুতির ফলে আমাদের যথেষ্ট মূল্য গুণে দিতে হয়েছে। একথা স্বীকার করে নেওয়ার পরও, যাই হোক না কেন, সপি আই(এমএল) সম্পর্কে তার অতীত ও বর্তমানকে নিয়ে আমাদের আরও গভীরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা ও দুটি মুখ্য বিষয় সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিত।

প্রথমত, 'মাওবাদী' তত্ত্ব ও অনুশীলনের স্পষ্ট বিপরীতে, “সমস্ত বিপ্লবী প্রক্রিয়াটির লক্ষ্য ছিল একটি বিপ্লবী গণলাইনের বিকাশ সাধন। কৃষকদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে প্রচার: 'তাদের নিজেদের গ্রামগুলিকে মুক্ত করার জন্য কৃষকদের সমাবেশিত করা প্রয়োজন এবং তাদের বলা দরকার যে গ্রামের সমস্যাগুলির নিষ্পত্তি করার একান্ত অধিকারী তোমরাই, জোতদাররা নয়; জমি, পুকুর সব তোমাদেরই হবে এবং জোতদার খতমের পর কার জমি কে চাষ করছে তা পুলিশ আন্দাজও করতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি' – তাদের মনস্তত্ত্বকে বোঝা এবং তাদের জাগিয়ে তোলার জ্ন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় ভাষায় ব্যাখ্যা করাটা ছিল চারু মজুমদারের এক গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এই ধরনের প্রচার সংশোধনবাদী প্রচারকার্যের একেবারেই বিপরীত। সিপিআই(এমএল)-এর তৃতীয় কংগ্রেসে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, “কমরেড চারু মজুমদারের 'খতমের' লাইন জনগণের ভূমিকাকে কাপুরুষোচিত বলে নাকচ করে দেওয়া ও কিছু এগিয়ে থাকা মানুষকে 'ব্যক্তিবীর' হিসাবে বিবেচনা করার ভিত্তিতে সূত্রবদ্ধ হয়নি। বরং জনগণের মধ্যে নিহিত প্রচণ্ড সৃজনীশক্তির ওপর অসীম আস্থা রাখার ভিত্তিতেই তা সূত্রবদ্ধ হয়েছিল।”

দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে পার্টি লাইন জটিল এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিপক্ক হয়েছে। “বিপ্লবী লাইন একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই কেবল পরিপূর্ণ আকার লাভ করেছে এবং সংগ্রামের পুরনো রূপকে বর্জনের মধ্য দিয়ে শুরু করে পার্টি কেবলমাত্র একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই পুরনো ও নতুন রূপের মধ্যে নতুন এক বিন্যাস ঘটাতে সক্ষম হয়েছে (সূত্র ঐ)।”

আর ভারতীয় অভিজ্ঞতার এটাই ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্য – যা যথেষ্ট বিভ্রান্তি ও ভুল ধারণারও উৎস বটে – যে এই প্রক্রিয়াটি একই ধাপে এবং একই নেতৃত্বের অধীনে সম্পূর্ণতা লাভ করেনি। প্রারম্ভিক ধাক্কার ফলে যে বিপর্যয় তা প্রথম সারির নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন কিম্বা দ্বিধাবিভক্ত করে দেওয়ায় এক নতুন প্রজন্মের তারুণ্যে ভরা নেতাদের দ্বারা তার পুনর্গঠন সম্ভব হয় (ক্রমে আপাত অর্থে যা সম্পূর্ণতা লাভ করে) – যাঁরা ভগ্নদশা থেকে পার্টিকে পুনর্নির্মাণ করেন, পুরনো ভুলগুলি থেকে পার্টিকে মুক্ত করেন আবার একই সাথে সি এম-এর রাজনৈতিক দর্শনের সারবস্তুকে রক্ষা ও বিকশিত করেন এবং এইভাবে অগ্রগতির এক নতুন ধারার উন্মেষ ঘটান।

পার্টি লাইনের বিবর্তনের একক প্রক্রিয়াটির দুটি পর্যায়কে সংযুক্ত করতে না পারার ব্যর্থতা এক বিকৃত ও খণ্ডিত ধারণার জন্ম দেয় – যার ফলে আমাদের বর্তমান রাজনীতি ও অনুশীলনকে ১৯৭০-এর ঐতিহ্যের বিসর্জন/নেতিকরণ হিসেবে দেখা হয় আর তারই ভিত্তিতে সমর্থন অথবা বিরোধিতা করা হয়ে থাকে; মাওবাদী কার্যকলাপকে অতীতের ধারাবাহিকতা বলে মনে করা হয় এবং তারই ভিত্তিতে প্রশংসা অথবা সমালোচনা বর্ষিত হয়। সুতরাং সিপিআই(এমএল)-এর ইতিহাস সম্পর্কে আগ্রহী যে কোনো ব্যক্তিকে অবশ্যই এই জাতীয় আধিভৌতিক মনোজগৎ পরিহার করতে হবে এবং পার্টির অতীত ও বর্তমান সম্পর্কে এক দ্বান্দ্বিক ও অখণ্ড দৃষ্টিভঙ্গীকে আয়ত্ত করতে হবে।