(বেনারসে ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের সমাপ্তি ভাষণ, লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯৭ থেকে)

কমরেড,

আমাদের ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের সফল পরিসমাপ্তি হতে চলেছে। প্রথমেই আমি বলব যে অন্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টির অতিথিদের উপস্থিতি আমাদের উৎসাহিত করেছে। কমিউনিস্ট আন্দোলন সব সময়েই এক আন্তর্জাতিক আন্দোলন। দুনিয়া জুড়ে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মতাদর্শের ভিন্ন ভিন্ন রূপে যে চর্চা চলেছে আমাদের বিদেশী অতিথিরা সেই সমস্ত প্রয়োগেরই প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। আমাদের পার্টি কংগ্রেসে তাঁদের উপস্থিতি আমাদের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির নিদর্শন। এটা এই বিষয়টিকেও তুলে ধরে যে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মধ্যে বিভিন্ন মতপার্থক্য থাকলেও পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদান ও পরস্পর থেকে শিক্ষা গ্রহণ চালিয়ে যেতে হবে।

আর তাই, নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে আমি বিদেশী অতিথিদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।

কমরেড,

গত পাঁচ দিন ধরে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক চালিয়েছি। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল, কখনও কখনও বিতর্ক তীক্ষ্ণও হয়েছে। নির্বাচন হয়েছে, কমরেডরা অংশগ্রহণ করেছেন, কেউ জিতেছেন, কেউ হেরেছেন। পার্টি কংগ্রেসে ও অধিবেশনগুলিতে খোলাখুলিভাবে আলোচনা ও বিতর্ক চালানোই আমাদের পার্টির ঐতিহ্য। তা করতে গিয়ে কিছু ক্ষোভ প্রকাশ হতে পারে, কিছু কমরেডের মনে আঘাত লাগতে পারে, কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমরা সকলেই সেই একই পার্টি কমরেড। আমাদের লক্ষ্য ও নীতিও অভিন্ন। এই লক্ষ্য পূরণে আমরা আমাদের সবকিছু, এমনকি জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই ধরনের কমিউনিস্ট বন্ধন যেখানে রয়েছে আমি মনে করি সেখানে কোনো দ্বন্দ্ব বা তিক্ততা স্থায়ী হতে পারে না। আর তাই সম্পূর্ণভাবেই, আমার এই বিশ্বাস রয়েছে যে আমরা যখন এই কংগ্রেস থেকে ফিরে যাব, আমরা সেই একইরকম অন্তরঙ্গতা, লৌহদৃঢ় ঐক্যের সঙ্গে পরস্পরের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের সংগ্রাম চালিয়ে যাব। এটাই আমাদের পার্টির অতীত ঐতিহ্য, আগামী দিনেও এই ঐতিহ্য বজায় থাকবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।

কমরেড,

আপনারা জানেন, আমাদের পার্টি ভেঙ্গে গিয়েছিল – অনেক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল। গত বিশ-পঁচিশ বছর ধরে অন্য সমস্ত গ্রুপগুলিকে আমরা লাগাতার ভেঙে যেতে দেখেছি। কিন্তু এর বিপরীতে ১৯৭৪-এ পার্টি পুনর্গঠনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের সংগঠনে কোনো ভাঙ্গন ঘটেনি, আমাদের ঐক্য ক্রমাগত সুদৃঢ় হয়েছে। অনেকের কাছেই এটা একটা ধাঁধা হয়ে রয়েছে। অন্য সমস্ত নকশালপন্থী গ্রুপগুলি যখন লাগাতার ভাঙ্গনের মধ্যে দিয়ে চলেছে তখন কী সেই যাদু যার বলে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন গত পঁচিশ বছর ধরে তার ঐক্য অটুট রেখেছে। বিশেষত এমন সময়ে যখন কমিউনিস্ট আন্দোলনে নেতৃত্বের প্রশ্নে যাদের সাথে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সেই সমাজগণতন্ত্রী দল সিপিআই(এম)-এর মধ্যেও সংকট বেড়ে চলেছে। কৌশলগত লাইনের প্রশ্নে তাদের নেতৃত্বের মধ্যে গুরুতর বিভাজন আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের পার্টির গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে।

আমাদের এই লৌহদৃঢ় ঐক্যের মূল কারণ নিহিত রয়েছে আমাদের দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মহান ঐতিহ্যকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরার মধ্যে। ১৯৬৭-র নকশালবাড়ির আন্দোলন থেকে ৭০ দশকের আন্দোলনের বহু বিচ্যুতি ও ভুলভ্রান্তি সত্ত্বেও ঐ ঐতিহ্যগুলিকে আমরা কখনও অস্বীকার করিনি। আমাদের উত্তরাধিকারের মর্যাদা আমরা সব সময়েই দিয়েছি। আমরা কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মহান সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ বা কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্ব কোনো কিছুকেই অগ্রাহ্য করিনি। মহান শহীদ ও নেতৃবৃন্দের মর্যাদাকে সব সময়েই ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছি। সাথে সাথে আমরা সব সময়েই ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। আমাদের ভুলত্রুটিগুলির খোলামেলা সমালোচনা করেছি এবং নতুন উপলব্ধিগুলিকে পার্টি লাইনের মধ্যে একাত্ম করেছি। আমাদের বিপ্লবী ঐতিহ্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা এবং বর্তমানের দাবির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে পার্টি লাইনের প্রয়োজনীয় পুনর্বিন্যাস ঘটানো – আমি মনে করি আমাদের পার্টি সঠিকভাবে এই দুটি কাজের মধ্যে সমন্বয়সাধন করেছে এবং এটাই আমাদের সুদৃঢ় ঐক্যের মূল কথা।

এর সাথে পার্টি পুনর্গঠনের সময় থেকেই আমরা এক পূর্ণাঙ্গ পার্টি ব্যবস্থার বিকাশ ঘটানোরও চেষ্টা করে গেছি। ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত, কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে শুরু করে একদম নীচের কমিটি পর্যন্ত সম্পূর্ণ কমিটি ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি। সমস্ত স্তরেই এক যৌথ নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়েছি। আমরা নিয়মিত আমাদের পার্টি কংগ্রেস সংগঠিত করেছি, প্রয়োজনমতো সর্বভারতীয় সম্মেলন সংগঠিত করেছি। আর এই ব্যবস্থাই কোনো ব্যক্তি বিশেষের উপর পার্টির নির্ভরশীল না হয়ে ওঠাকে সুনিশ্চিত করেছে। আমাদের পার্টি কোনো ব্যক্তি বিশেষের মর্জি অনুযায়ী চলে না, কোনো ব্যক্তির আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব-নির্ভর নয়। দীর্ঘ অনুশীলনের প্রক্রিয়ায় অনেক অভিজ্ঞ কমরেড উঠে এসেছেন, তাদের মধ্যে এক সুদৃঢ় ঐক্য রয়েছে। আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি কয়েকটি গোষ্ঠীর ঢিলেঢালা সহাবস্থান নয়, তা একটি ঐক্যবদ্ধ সংগঠন। কোনো ধরনের কোনো গোষ্ঠীর অস্তিত্ব আমাদের পার্টিতে নেই। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ কমরেডদের নিয়েই আমাদের পার্টি নেতৃত্ব গঠিত, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাঁরা পার্টি কর্মী ও জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন। তাঁদের নিয়েই গঠিত আমাদের পলিটব্যুরো ও যৌথ নেতৃত্ব। আমি মনে করি এটাই সেই কারণ যা গত পঁচিশ বছর ধরে আমাদের পার্টির ঐক্যকে বজায় রেখেছে ও তাকে শক্তিশালী করেছে। আমি বিশ্বাস করি যে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিও আমাদের পুরোনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখবে এবং এগিয়ে নিয়ে যাবে। এই কংগ্রেসে সারা দেশ থেকে আসা প্রায় ৭০০ প্রতিনিধি নতুন কেন্দ্রীয় কমিটির ওপর যে আস্থা প্রকাশ করেছেন, যে দায়িত্ব অর্পণ করেছেন, সেই দায়িত্ব নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি যোগ্যভাবে পালন করার চেষ্টা করবে। জনগণের সংগ্রাম, পার্টির সংগ্রামের সামনের সারিতে আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরাও সামিল থাকবেন এই প্রতিশ্রুতি আমি দিচ্ছি।

কমরেড,

আমাদের সমানের চ্যালেঞ্জগুলি সম্পর্কে আমরা অবহিত। বিভিন্ন দিক থেকেই আমাদের উপর আক্রমণ আসছে। এই সমস্ত চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার শপথ আমরা এই কংগ্রেসে নিয়েছি। কিন্তু এটা আবার এমন একটা সময় যখন আমাদের সামনে প্রচুর সুযোগও রয়েছে। এই সমস্ত চ্যালেঞ্জের মোকাবিলায় আমাদের এই সুযোগগুলির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে হবে। কংগ্রেস আমাদের উপর দায়িত্ব অর্পণ করেছে, ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে সমাজগণতন্ত্রীদের হটিয়ে দিতে হবে এবং সেখানে বিপ্লবী বামপন্থীদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই দায়িত্ব পূর্ণ করার ভার সমগ্র পার্টিকেই নিতে হবে। বর্তমান সময় সেই লক্ষ্যে সুবর্ণ সুযোগ হাজির করেছে, কেননা ক্ষমতার কাঠামোয় অঙ্গীভূত হয়ে পড়ায় সমাজগণতন্ত্রীরা কোথাও গণআন্দোলনের নেতৃত্বে নেই। আর তাই নকশালবাডির সময় থেকেই আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বকে পূর্ণ করার লক্ষ্যে এই সুযোগকে পূর্ণ সদ্ব্যবহারের জন্য আমাদের সর্বশক্তি নিয়ে  এগিয়ে যেতে হবে।

কমরেড,

এছাড়াও সামস্ত সশস্ত্র বাহিনী – তা রণবীর সেনাই হোক বা ঐ ধরনের অন্য কোনো সশস্ত্র বাহিনীই হোক – যারা মনে করে যে বন্দুকের জোরে, খুন ও গণহত্যার মধ্য দিয়ে আমাদের পার্টিকে মুছে দিতে পারবে, তারাও বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসাবে উপস্থিত হয়েছে। পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে তাদের এই উন্মত্ত আক্রমণ তাদের ভবিষ্যৎ, তাদের ক্ষমতার প্রতীক নয়। এগুলি ক্ষয়িষ্ণু শক্তির মরীয়া প্রয়াস মাত্র।

কমরেড,

রণবীর সেনার মতো সামন্ত শক্তিগুলির সশস্ত্র চ্যালেঞ্জের দৃঢ় মোকাবিলার শপথ গ্রহণ করেছে এই কংগ্রেস। কংগ্রেস বারবারই এই সংকল্প ঘোষণা করেছে যে পার্টি তার সমগ্র শক্তিকে সমাবেশিত করে এই ধরনের শক্তিগুলির উপর চূড়ান্ত আঘাত হানবে। এই শক্তিগুলিকে পরাস্ত করতে প্রয়োজনীয় সমস্ত উপায়ই অবলম্বন করতে পার্টি কোনোরকম দ্বিধা করবে না এই সংকল্পও কংগ্রেস নিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জ আমরা গ্রহণ করেছি এবং রণাঙ্গনে তাদের পরাজয় আমরা সুনিশ্চিত করবই। অতীতেও অনেক সশস্ত্র বাহিনী মাথা তুলেছিল, কিন্তু জনগণের প্রতিরোধের মুখে কেউই টিকতে পারেনি। আমাদের পরিপূর্ণভাবে এই বিশ্বাস রাখতে হবে যে নব উদ্ভুত এই সেনারও কোনো ভবিষ্যৎ নেই এবং সিপিআই(এমএল) পরিচালিত গণআন্দোলন এবং জনতার রোষ এই সেনাকে নিশ্চিহ্ন করবে। আমাদের সামনে এটিই হল দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ।

তৃতীয়ত, সমস্ত প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে, যে শক্তিগুলি মানবাধিকারের জন্য লড়ছে তাদের সর্বভারতীয় স্তরের একটি মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ করার সংকল্পও কংগ্রেস নিয়েছে। আমাদের সর্বভারতীয় স্তরের এক যথার্থ গণতান্ত্রিক মোর্চা গড়ে তুলতে হবে। এমনই এক মোর্চা যা প্রকৃত অর্থেই ভারতীয় বিপ্লবের এক যাদুঅস্ত্র হয়ে উঠবে। এই কর্তব্য সম্পন্ন করার নৈতিক অধিকার ও রাজনৈতিক বীক্ষা সিপিআই(এমএল) ছাড়া আর কারুরই নেই।

এই কংগ্রেস আমাদের উপর তিনটি দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তা হল, ভারতীয় বাম আন্দোলনের উপর বিপ্লবী কমিউনিস্টদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা; সামন্ত সেনাদের চ্যালেঞ্জকে সাহসের সাথে মোকাবিলা করা ও তাদের নির্মূল করা; প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি পরিচালিত সংগ্রামগুলি, মানবাধিকার, জাতীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের স্বায়ত্ততা এবং বিভিন্ন দলিত ও পশ্চাদপদ সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রামগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে এক ব্যাপকভিত্তিতে গণতান্ত্রিক মোর্চা গঠন করা। আমার বিশ্বাস এই কর্তব্যগুলি সম্পন্ন করতে এই পার্টি কংগ্রেস সমগ্র পার্টিকে উজ্জীবিত করবে। সবশেষে, পার্টি ও বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আমাদের যে শত শত কমরেড তাঁদের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছেন, আমরা যেন তাঁদের ভুলে না যাই।

শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করার এক উপযুক্ত সময় হল এই কংগ্রেস। আসুন আমরা শপথ নিই, আমাদের শহীদদের অসমাপ্ত স্বপ্ন আমাদের চোখে বেঁচে থাকবে। এই স্বপ্ন যতদিন না পূর্ণ হচ্ছে ততদিন আমরা থামব না।

আমাদের শহীদদের স্মৃতি দীর্ঘজীবী হোক!
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!
ইনকিলাব জিন্দাবাদ!

(বেনারসে ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের উদ্বোধনী ভাষণ, লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯৭ থেকে)

কমরেড ও বন্ধুগণ,

সিপিআই(এমএল)-এর ষষ্ঠ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর একেবারে অন্তিম লগ্নে। বিংশ শতাব্দী বিশ্ব-ঐতিহাসিক তাৎপর্যসম্পন্ন বহু বড় বড় ধরনের আলোড়কারী ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছে – সাম্রাজ্যবাদের উত্থান, পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধ, সমাজতন্ত্রের উত্থান ও ঔপনিবেশিক যুগের অবসান এবং পরিশেষে সোভিয়েত ব্যবস্থার পতন ও বিশ্বায়নের অভ্যুদয়। এই শতাব্দী জুড়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপুল অগ্রগতি ঘটেছে। মানুষ পৃথিবীর বুকে আত্মধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করেছে ও তার পাশাপাশি মহাশূন্যকেও নিজের কব্জায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আর সেই কারণে তথ্য ও পণ্য আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও খুব দ্রুত অগ্রগতি ঘটেছে, যার ফলে গোটা দুনিয়াকে একটা বিশ্বজোড়া দেশের মতো দেখাচ্ছে।

বিরাট বিরাট আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের চলমান প্রক্রিয়া শ্রেষ্ঠ মানব মস্তিষ্কে প্রতিফলিত হয়েছে এবং তার ফলশ্রুতিতে এই শতাব্দী ভাবধারা ও মতাদর্শের মহাসংঘাত ও বিশাল বিশাল ব্যক্তিত্বের আবির্ভাবও প্রত্যক্ষ করেছে।

এই শতকের শুরুর দিকে যে সাম্রাজ্যবাদের জন্ম, শতাব্দীর মাঝামাঝির মধ্যেই সেই সাম্রাজ্যবাদ কুখ্যাত হয়ে পড়ে। আর বর্তমানে, শতাব্দীর অন্তিম পর্যায়ে এসে বিশ্বায়নের ছদ্মবেশে সাম্রাজ্যবাদ তার মর্যাদা পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পুরোনো সাম্রাজ্যবাদ যদি শেয়ার বাজারের ফাটকার ওপর ভিত্তি করে টিকে থাকা এমন একটা শ্রেণীর জন্ম দিয়ে থাকে যারা শেয়ারের কাগজ লেনদেন করে মুনাফা কামায় তবে বিশ্বায়নের ফলে জন্ম নিয়েছে মুদ্রা নিয়ে ফাটকাবাজি চালানো একটা গোটা শ্রেণী, আইএমএফ-এর পরিচালন বোর্ডে যাদের সম্মানজনক প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। মুদ্রার লেনদেন বিপুলভাবে বেড়ে ওঠার ফলে ‘আন্তর্জাতিক টাকাকড়ি’র এক বিশাল পাহাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। একে সঙ্গতভাবেই ‘আপাত টাকাকড়ি’ বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। এ বিষয়ে একজন অর্থনীতিবিদের মন্তব্য, “টাকাকড়ির প্রথাগত সংজ্ঞা – তা সে পরিমাপের মানদণ্ড, মূল্যের ভাণ্ডার অথবা লেনদেনের মাধ্যম যাই হোক না কেন তার মধ্যে একে ফেলা যায় না। কিন্তু এর ক্ষমতাটা বাস্তব”। এই টাকাকড়ির গতিময়তা সর্বব্যাপী, কারণ এর কোনো অর্থনৈতিক ভূমিকা নেই। এই টাকাকড়ির পরিমাণ এত বিপুলাকার যে অর্থ, বাণিজ্য কিংবা বিনিয়োগের প্রবাহের তুলনায় কোনো একটি দেশের মধ্যে এর ঢোকা ও বের হওয়ার প্রভাব অনেক বেশি। ভারতের মতো একটা দেশের জাতীয় অর্থনীতি যেইমাত্র বিশ্ব অর্থনীতির সাথে পুরোপুরি একাত্ম হয়ে যাবে, তার মুদ্রার মাত্র কয়েক সপ্তাহের অবনমনের ফলেই দীর্ঘদিনের অর্জিত আর্থিক সুফলগুলি মুহূর্তে মুছে যেতে পারে।

এই ‘আপাত টাকাকড়ি’র আধিপত্য উৎপাদনমুখী কার্যকলাপ থেকে পুঁজির সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতার প্রতীক স্বরূপ। আজকের বিশ্ব পুঁজিবাদের পরজীবীসুলভ চরিত্র এর দ্বারা আরও জোরদার হচ্ছে। আর সেই কারণে, যদিও বিংশ শতাব্দী অস্ত যাচ্ছে বিশ্ব সমাজতন্ত্রের ধাক্কার মধ্য দিয়ে, আগামী শতাব্দী নিশ্চিতভাবেই এক উন্নততর বিশ্বব্যবস্থা ও সমাজতন্ত্রের এক নতুন সংস্করণের জন্য নতুন নতুন ধ্যানধারণা, নতুন নতুন শক্তি ও নতুন নতুন আন্দোলনের পুনরুজ্জীবনের মধ্য দিয়েই ঘটবে।

অসমাপ্ত স্বপ্ন ও অসমাপ্ত প্রকল্পগুলি আগামী সহস্রাব্দের হাতে তুলে দিয়ে বিংশ শতাব্দী তার অন্তিম লগ্নের দিকে এগিয়ে চলেছে। আসুন, এই কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে আমরা আন্তর্জাতিক সাম্যবাদের এক ঐক্যবদ্ধ, আত্মপ্রত্যয়ী ও শক্তিশালী পার্টি হিসাবে একবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ করি।

আমাদের ষষ্ঠ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে ১৯৯৭ সালে, যখন আমাদের দেশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের জোয়াল থেকে স্বাধীন হওয়ার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করছে। ভারতীয় জনগণের কাছে এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত মোটেই স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসের মুহূর্ত হয়নি। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যেই ভারতের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব আন্তর্জাতিক শোষকদের শক্তিশালী আক্রমণের বিপদের মুখে রয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ দিক থেকে স্বাধীনতা শাসক অভিজাতদের এক সমগ্র শ্রেণীর একচ্ছত্র অধিকারে পর্যবসিত হয়েছে। এই স্বাধীনতা হচ্ছে তাদের লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের স্বাধীনতা।

বুর্জোয়া আধিপত্যের প্রতিষ্ঠানগুলি একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে : বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক শ্রেণী আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে, আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে, সংসদ বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে, নির্বাচন কমিশন সরকারের বিরুদ্ধে ইত্যাদি। নিজেদের স্বনিয়ন্ত্রিত কার্যকলাপের পরিসরকে সম্প্রসারিত করার জন্য সমস্ত প্রতিষ্ঠানগুলি পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে এবং তার চূড়ান্ত ফলাফল দাঁড়িয়েছে প্রত্যেকেরই বিশ্বাসযোগ্যতার হানি।

সর্বব্যাপী বিশৃঙ্খলার পরিবেশের মধ্যে ভারতের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হল। দেশজুড়ে বুদ্ধিজীবীরা ব্যাপক ধরনের আলাপ-আলোচনায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছে এবং জাতীয় এজেন্ডা নির্ধারণ করার জন্য জাতীয় সংসদের এক অভূতপূর্ণ চার দিনব্যাপী অধিবেশন সংগঠিত হয়। দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ও এমনকি অপরাধীকরণ, দুর্নীতি ও নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তীব্র আহ্বান শোনা গেছে। কিন্তু এসবই এক আনুষ্ঠানিক চর্চায় পর্যবসিত হয়েছে এবং দেশ আগে যে রকম দিশাহীন ছিল সে রকমই রয়ে গেছে।

উদারীকরণ ও বিশ্বায়ন সম্পর্কে ভারতীয় শাসককূল এক জাতীয় ঐকমত্য গড়ে তুলেছে। ভারতীয় জনগণ উন্নত জীবনযাত্রার মান বাছাই করে কেনার অধিকার লাভ করার আকাঙ্খা পোষণ করেন এই অজুহাতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী চিদাম্বরম এর স্বপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন। তাঁর মতে, “এক আগে পছন্দ সীমাবদ্ধ ছিল এ্যাম্বাসাডার থেকে এ্যাম্বাসাডার আর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস থেকে ইন্ডিয়ান এরায়লাইনসের মধ্যে।” এর থেকেই স্পষ্ট যে কোন ধরনের জনসাধারণের কথা তিনি বলেছেন এবং তার ওপর, এর দ্বারা উদারীকরণ ও বিশ্বায়নের ভারতীয় সংস্করণের সমগ্র শ্রেণী অন্তর্বস্তুই উদ্ঘাটিত হয়ে যায়।

‘কম্পিউটার চিপস বনাম পটাটো চিপস’ বিতর্কের ওপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে শ্রীচিদাম্বরম জবাব দেন, “বিদেশী বিনিয়োগ (যে কোনো রূপে ও যে কোনো ক্ষেত্রে) যদি কর্মসংস্থান ঘটাতে পারে, আয় সৃষ্টি করতে পারে ও সম্পদের জন্ম দিতে পারে তবে তা ঠিকই আছে।”

বহুজাতিক সংস্থাগুলি ও ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণী উভয়েরই সবচাইতে পছন্দের ব্যক্তি চিদাম্বরম বর্তমান সংযুক্ত মোর্চা সরকারের অর্থনৈতিক দর্শনকে প্রতিফলিত করেন, যে সংযুক্ত মোর্চা সরকার পূর্বতন রাও জমানাকে বহুদূর পর্যন্ত ছাপিয়ে গিয়ে উদারীকরণের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এবং তার ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচি সব ধরনের শাসক অভিজাতদের মধ্যেকার আপোশ ঐকমত্য ছাড়া আর কিছুই নয়।

ভারতের ক্রমবর্ধমান সমস্যাগুলির দক্ষিণপন্থী সমাধানের জন্য এই উন্মত্ত প্রচেষ্টা কেবলমাত্র মৌলবাদী শক্তিগুলির মনোবলকেই বাড়িয়ে তুলেছে এবং এই প্রথমবারের জন্য সত্যিকারের এক গৈরিক বিপদের খাঁড়া ভারতের মাথার ওপর ঝুলছে। এখানে, ভারতের স্নায়ুকেন্দ্র ও ভারতের সবচাইতে জনবহুল রাজ্য এই উত্তরপ্রদেশে, গত নির্বাচনের পর থেকেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চলছে এবং তার কোনো সমাধানই পাওয়া যাচ্ছে না। মাত্র এক দিন আগেই বিজেপি ও বিএসপি-র মধ্যকার অনীতিনিষ্ঠ আঁতাত ভেঙ্গে গেছে এবং রাজ্যের পরিস্থিতি আবার পুরোনো জায়গায় ফিরে এসেছে। কল্যাণ সিং-এর ক্ষমতায় ফিরে আসার অর্থ হল জাতীয় এজেন্ডায় অযোধ্যা আবার ফিরে আসা। তার ওপরে, এর সাথে যুক্ত হয়েছে খুঁচিয়ে তোলা চিত্রকূট ইস্যু এবং স্পষ্ট দলিত-বিরোধী সংকেত ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে।

উত্তরপ্রদেশে দু-দুবার বিজেপির স্বল্পমেয়াদী ক্ষমতারোহণ পরিষ্কারভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে এই দলটি যদি কোনোভাবে কেন্দ্রের ক্ষমতা দখল করতে পারে তাহলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, প্রগতিশীল আন্দোলন, বৌদ্ধিক, নান্দনিক ও শিক্ষাগত স্বাধীনতা, গ্রামীণ গরিবদের সংগ্রাম, দলিত, মহিলা তথা ধর্মীয় ও জাতীয় সংখ্যালঘুদের সামাজিক সাম্য ও প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে সৌভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্কের যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাও সর্বাধিক বিপন্ন হয়ে পড়বে। আমাদের সামনে রয়েছে, সাম্প্রদায়িক-ফ্যাসিবাদী শক্তির দ্বারা ভারতকে কব্জা করে নেওয়াকে প্রতিহত করতে সমস্ত গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির এক জঙ্গী সংহতি গড়ে তোলার এজেন্ডা।

আসুন, এই কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে আমরা জাতীয় মুক্তি ও জনগণতন্ত্রের এক ঐক্যবদ্ধ, আত্মপ্রত্যয়ী ও শক্তিশালী পার্টি হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটনোর সংকল্প গ্রহণ করি।

এই কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে মহান নকশালবাড়ি অভ্যুত্থানের ত্রিংশতিতম বর্ষে, যে অভ্যুত্থান ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে গভীরভাবে গেড়ে বসে থাকা সুবিধাবাদের সাথে এক নির্ধারক বিচ্ছেদের প্রতীকস্বরূপ হয়ে উঠেছিল এবং যে অভ্যুত্থান ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সে পর্যন্ত ৪০ বছরের ইতিহাসে প্রথম বারের জন্য কৃষি-বিপ্লবকে আশু এজেন্ডায় নিয়ে এসেছিল। বর্বর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখে বেশ কয়েকবার এই আন্দোলনকে মনে হয়েছে শেষ হয়ে যাবে কিন্তু প্রতিবারই তা প্রবাদের ফিনিক্স পাখির মতো উঠে দাঁড়িয়েছে।

নকশালবাড়ি যে সামাজিক পরিবর্তনের পথ দেখিয়েছিল ৯০-এর দশকে এসে তা এক নতুন প্রাণ পায়, যার ফলে এক নতুন সামাজিক ও রাজনৈতিক সমীকরণ গড়ে ওঠে। বিরাট সামাজিক মন্থন ও তার ফলশ্রুতি স্বরূপ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রক্রিয়ার মধ্যে পুরোনো স্লোগানগুলি দ্রুত তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে এবং নায়কেরা অচিরেই খলনায়কে পরিণত হচ্ছে।

আমাদের একেবারে চোখের সামনেই এক সর্বব্যাপী সংকট মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং দেশ এক নতুন, আমূল ও প্রথাবহির্ভুত সমাধানের জন্য রব তুলছে। কমিউনিস্ট আন্দোলনের সুবিধাবাদী অংশটি শাসক কেন্দ্রীয় সংস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠার সাথে সাথে বাম আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব পুরোপুরি উঠে এসেছে বিপ্লবী বামপন্থীদের কাঁধে। এটা একই সাথে ভারতের বাম আন্দোলনের নেতৃত্বকারী আসন থেকে সরকারি মার্কসবাদীদের হটিয়ে দেওয়ার সুযোগ আমাদের সামনে হাজির করেছে।

নতুন অবশ্যম্ভাবীভাবেই পুরোনোর জায়গা নেয় – এটা ইতিহাসের অলঙ্ঘ নিয়ম। আসুন, এই কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে আমরা সামাজিক ন্যায় ও বিপ্লবী পরিবর্তনের এক ঐক্যবদ্ধ, আত্মপ্রত্যয়ী ও শক্তিশালী পার্টি হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটাই।

গত পার্টি কংগ্রেসের পরবর্তী পর্যায়টি ছিল পার্টি পুনর্গঠনের পর থেকে আমাদের পার্টির ইতিহাসে সবচাইতে রক্তাক্ত অধ্যায়। রাষ্ট্র, রাষ্ট্রীয় মদতপ্রাপ্ত জমিদারদের ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী তথা সম্পূর্ণভাবে অধঃপতিত নৈরাজ্যবাদী দুর্বৃত্তদল কর্তৃত সংঘটিত একটার পর এক হত্যাকাণ্ডে আমরা দুশোর বেশি পার্টি ক্যাডার ও সমর্থককে হারিয়েছি। শিশুদের বলি দেওয়া হয়েছে, মহিলাদের ধর্ষণ ও হত্যা করা হয়েছে এবং বৃদ্ধ ও যুবক নির্বিশেষ পুরুষদের জঘন্যতম মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। বক্তৃতা দেওয়ার সময় বা বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় সম্ভাবনাময় তরুণ কমরেডদের গুলি করে মারা হয়েছে, জনসমাবেশের ওপর গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছে, পার্টি অফিসের ওপর আক্রমণ হয়েছে ও হাজার হাজার মানুষকে জেলে পাঠানো হয়েছে, এসবই করা হয়েছে সিপিআই(এমএল)-এর অগ্রগতি ঠেকানোর মরীয়া প্রচেষ্টায়।

আমরা আমাদের বীর শহীদদের স্মৃতি ভুলিনি, ভুলিনি ঘাতকদের চেহারাও। কোনোকিছুই সিপিআই(এমএল)-এর সামনের দিকে এগিয়ে চলা ঠেকাতে পারবে না। আসুন, এই কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে আমরা শহীদদের স্বপ্ন ও শত্রুদের বিভীষিকা স্বরূপ এক ঐক্যবদ্ধ, আত্মপ্রত্যয়ী ও শক্তিশালী পার্টি গড়ে তোলার সংকল্প গ্রহণ করি।

(১৯৭২-এর ২৮ জুলাই কমরেড চারু মজুমদারের শহীদের মৃত্যুকে স্মরণ করে ‘লোকযুদ্ধ’ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ। সংক্ষিপ্ত অনুবাদ লিবারেশন সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল)

কমরেড চারু মজুমদার সংশোধনবাদী ও বিপ্লবী পার্টির ক্যাডারদের মধ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যরেখা টেনেছিলেন। যেখানে প্রথমোক্তরা উপর থেকে আসা নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে, শেষোক্তরা নেতৃত্বের দিক থেকে আসা নির্দেশগুলিকে সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ করার জন্য স্বাধীন উদ্যোগ নেয়। এজন্য একজন বিপ্লবী ক্যাডারকে অবশ্যই উদ্যোগী প্রকৃতির হতে হবে এবং তাঁর এলাকার সমগ্র পরিস্থিতির উপর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। তবে এক গভীরতর সামাজিক অনুসন্ধান ছাড়া এটি কিছুতেই সম্ভবপর নয়। কমরেড মাও একসময় মন্তব্য করেছিলেন যে তদন্ত ছাড়া কথা বলার কোনো অধিকার নেই। তৃণমূল স্তরে অনুশীলনের সঙ্গে প্রায়শই সংঘাত ঘটে এমন ভাবধারাগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা ছাড়া, প্রত্যেকটি বিষয় (Phenomenon) সম্পর্কেই ‘কী’ এবং ‘কেন’ প্রশ্ন তুলে জিজ্ঞাসা করা ছাড়া, মানবজ্ঞান কেমন করে এগিয়ে যেতে পারে? ‘সব কিছু ঠিক আছে’ – এমন বলা যাদের স্বভাব সেই কমিউনিস্ট ক্যাডারদের দিয়ে তত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে কী করে নতুন মাত্রা অর্জন করা যাবে?

কাজের ধারার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, কেন্দ্রীভূত কাজের ধারা আয়ত্ত করা। আামদের গণআন্দোলনের সীমান্তগুলি লাগাতার সম্প্রসারিত করে চলতে হবে, জাতীয় ও রাজ্য স্তরে সমস্ত সম্ভাব্য রাজনৈতিক উদ্যোগগুলি নিতে হবে। এই সবই বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট ফলাফল যদি অর্জন করতে হয় তাহলে কিছু বিশেষ এলাকায় কাজকে কেন্দ্রীভূত করতে হবে। অন্যথায় সমস্ত প্রচেষ্টাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে এবং অনুশীলনকে কোনো উন্নত মাত্রায় নিয়ে যাওয়া যাবে না।

সম্প্রতি নির্বাচনগুলিতে আমরা দেখেছি, যে সমস্ত এলাকায় কেন্দ্রীভূতভাবে কাজ হয়েছে সেখানে আমরা আগের চেয়ে ভালো ফলাফল করতে পেরেছি। বিপরীতে, যেখানে মাও-এর ভাষায় কাজের ধারা ‘ঘোড়ার পিঠে চড়ে বাগান পরিদর্শনের’ মতো সেখানে আমাদের ফলাফল আরও খারাপ হয়েছে।

আপনি একটি এলাকার বা একটি গণসংগঠনের ভারপ্রাপ্ত হতে পারেন, সেক্ষেত্রে আপনার অনুশীলনে সাধারণ দিকগুলি সহ এক বিশেষ দিক অবশ্যই থাকতে হবে। এই বিশেষ দিকটি হল প্রকৃত অর্থেই আপনার গবেষণাগার যেখানে একজন বৈজ্ঞানিকের মতো আপনি নতুন নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার কাজগুলি হাতে নেবেন, আপনার ধারণাগুলিকে প্রয়োগের কষ্টিপাথরে যাচাই করবেন এবং সেখান থেকে আপনার সিদ্ধান্তগুলির সাধারণীকরণ করবেন। এইভাবে সাধারণ থেকে বিশেষ এবং পুনরায় বিশেষ থেকে সাধারণ, এই ধরনের বিজ্ঞানসম্মত কাজের ধারাই হল মার্কসীয় কাজের ধারা।

সাধারণ রাজনৈতিক ও বিক্ষোভ সমাবেশগুলি সংগঠিত করার সাথে সাথে, যারা লাগাতার গণআন্দোলনের প্রক্রিয়াগুলির মধ্য দিয়ে উঠে আসছেন সেই সব নতুন উপাদানগুলির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া, তাঁদের পার্টি শিক্ষা দেওয়া ও পার্টি সংগঠনের আওতায় নিয়ে আসা, তৃণমূল স্তরে তাদের মধ্যে থেকে পার্টির সক্রিয় কর্মীদল গড়ে তোলা ও পার্টি শাখা গঠন করা এবং তাঁদের সক্রিয় করে তোলা – এগুলিই কমিউনিস্ট কাজের ধারার আবশ্যিক অঙ্গ। এই সমস্ত উপাদানগুলি যে কাজের ধারায় অনুপস্থিত সেটি সংশোধনবাদী কাজের ধারা ছাড়া আর কিছুই নয়, যা এই চিন্তার ভিত্তিতেই পরিচালিত হয় যে, আন্দোলনই সব, লক্ষ্য কিছুই নয়। আন্দোলনের সমস্ত সুযোগের বিস্তার ঘটিয়ে চলার সাথে সাথে তৃণমূল স্তরে পার্টি সংগঠনকে সক্রিয় করে তোলা – এই আপাত দুই বিপরীতের ঐক্যই কমিউনিস্ট কাজের ধারার সারবস্তু।

পার্টিকে জাতীয় স্তরে সংগঠিত করা এবং নীচেরতলায় এক শক্তিশালী ও গতিশীল পার্টি পরিকাঠামোর বিকাশ ঘটিয়ে চলার মধ্য দিয়েই কমরেড চারু মজুমদারের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে।

(আগস্ট ১৯৯৫ সালে ডিফু সম্মেলনে বিতর্ক চলাকালীন হস্তক্ষেপ করার সময়ে যে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন – তার সংক্ষিপ্তসার)

আমার মতে প্রধান বিষয় হল, আমাদের পার্টির মধ্যে এক ধরনের বিশেষ সমস্য থাকছে। আমি মনে করি যে এক ধরনের প্রবণতা থাকছে, যারা মনে করেন যে রাজনৈতিক বিষয়গুলি ঠিকঠাক থাকলে সাংগঠনিক বিষয়গুলিও স্বাভাবিকভাবে, আপনা-আপনি, কিছুটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই তাকে অনুসরণ করবে। এরকম ভাবনা আসতে পারে, আমাদের পার্টির ‘অত্যধিক রাজনৈতিক চরিত্রধর্মী’ হয়ে ওঠা অথবা এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় আমাদের পার্টি আত্মপ্রকাশ ঘটানোর ফলে সাংগঠনিক বিষয়গুলি সম্পর্কে অবহেলা করা আমাদের পার্টির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। আর যখনই আমরা সংগঠনকে সংহতকরণের কথা বলি, সাংগঠনিক ক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলি, তখনই আমাদের প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়। কেউ কেউ বলতে থাকেন যে রাজনীতি সঠিক থাকলে বাকি সমস্ত কিছুই স্বাভাবিক গতিতে, নিজস্ব নিয়মেই তার পিছন পিছন চলবে। অবশ্য আমরা কমিউনিস্টরা জানি যে যদি আমাদের রাজনৈতিক লাইন সঠিক থাকে এবং আমরা যথাযথ রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকি তবে তা পার্টির সম্প্রসারনের ক্ষেত্রে বিরাট সহায়ক হবে। কিন্তু আমি মনে করি যে তা কোনো স্বয়ংচালিত প্রক্রিয়ায় হবে না। সাংগঠনিক সমস্যাগুলি এক স্বাধীন সত্তা হিসাবেই থাকে। সংগঠন হল এক স্বাধীন বর্গ। আর সংগঠনকে ঠিকঠাক করতে গেলে, বোধহয়, আমাদের কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ, নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কখনও কখনও বিশেষ সম্মেলনও করতে হয়। তাই শুধুমাত্র এই প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমাদের এই বিশেষ সাংগঠনিক সম্মেলন করতে হচ্ছে।

যখনই আমরা সাংগঠনিক সম্মেলন করার কথা বলি, স্বাধীন এক আলোচন্যসূচি হিসাবে সাংগঠনিক প্রশ্নগুলিকে সমাধানের কথা ভাবি তখন অনেকেই অনেক প্রতিরোধ সৃষ্টি করে থাকেন। এমনকি এই সম্মেলনেও এমন মতামত উঠে এসেছে যে সম্মেলনকে নতুনভাবে নামাঙ্কিত করা হোক। কেউ কেউ বলেছেন যে মতাদর্শগত সাংগঠনিক সম্মেলন হিসাবেই এই সম্মেলনের নামকরণ করা উচিত। তাই আমি মনে করি যে এটি আমাদের পার্টির মধ্যে এক ধরনের নির্দিষ্ট সমস্যা। এই বিশেষ প্রবণতা রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংগ্রামের নামে সাংগঠনিক প্রশ্নকে খাটো করে দেয়। এইভাবে এই প্রবণতা রাজনীতি ও সংগঠনকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বুলিসর্বস্বতার রূপ নিয়ে হাজির হয়।

আমি প্রায়শই এমন কিছু লোকজনকে দেখেছি যারা সাংগঠনিক প্রশ্নে, পার্টি গঠনের প্রশ্নে গুরুত্ব দেন না, পার্টি ও সাংগঠনিক কাজে যারা আদৌ মনোযোগী নন, এরাই আবার রাজনীতি ‘প্রচার’ করতে ভালোবাসেন। প্রায়শই তারা যে সমস্ত বুলি আওড়ান তার নমুনা হল : ‘কেন আপনারা সংগঠনের কথাবার্তা বলেন?’ ‘শুধু রাজনীতির কথা বলুন’ ইত্যাদি। তাই রাজনীতি প্রায়শই তাদের কাছে একধরনের বাহানা, একধরনের ছুতো হয়ে দাঁড়ায়। আমার মনে হয় এই প্রবণতাকে মোকাবিলা করতে এবং তার বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। আমাদের পার্টি সংগঠনকে গড়ে তুলতে আন্তরিক প্রয়াস চালাতে হবে। আর এই জন্যই এই সম্মেলন সংগঠিত করা হচ্ছে। আমাদের হাতে পেশ করা দলিলকে কেন্দ্র করে সমস্ত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেছি। এবার আমাদের ফিরে যেতে হবে এক বিশেষ বার্তা নিয়ে। কিন্তু আমাদের চিন্তার মধ্যেই যদি দুর্বলতা থেকে যায় তবে আমরা পার্টি সংগঠনকে ঠিকঠাক ও শক্তিশালী করতে পারব না।

এবার আসা যাক গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার বিষয়ে। এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এ নিয়ে বহু কথাবার্তা বলা হল। এর মধ্যে আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল : বৈধতাপূর্ণ বিরোধীপক্ষ গঠনের অধিকার। যার অর্থ হল : একটি একক বৃহৎ পার্টিতে ভারতবর্ষের নানান গোষ্ঠী ও পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করার পদ্ধতি হিসাবে এক ধরনের ব্লক গঠন করা। হরেকরকম বাম গোষ্ঠী ও বাম পার্টিগুলিকে একটি একক কমিউনিস্ট পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ করার শুধুমাত্র একটি পথ হিসাবে যদি কেউ তার নিজস্ব সূত্রায়নকে আঁকড়ে ধরেন তবে তা ভালোই হবে। যাই হোক, এ প্রশ্নে আমাদের একটা মতপার্থক্য থাকছে। বাম গোষ্ঠী ও কমিউনিস্ট পার্টিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আমাদের অন্যরকম ধারণা আছে। তা হল বাম কনফেডারেশন। আমরা ইতিমধ্যে তা নিয়ে কথাবার্তা শুরু করেছি। বিভিন্ন পার্টিগুলির মধ্যে বর্তমান মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও আমরা ব্যাপক ঐক্যের জন্য বাম কনফেডারেশনের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে পারি। কিন্তু একক কমিউনিস্ট পার্টির ভেতরেই যদি আমরা সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে চাই তবে এখনও পর্যন্ত অভিজ্ঞতা হল তা নেতিবাচক হিসাবেই প্রমাণিত হয়েছে। এর ভিত্তিতেই পিসিসি কাজ করার চেষ্ঠা করে। কমিউনিস্ট আন্দোলন ও এমএল আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করতে ব্লক ভিত্তিক কার্যকলাপ ও বৈধ বিরোধীপক্ষের সমস্ত কর্মরতই শেষ পর্যন্ত বিশৃঙ্খলায় পর্যবসিত হয়েছে। পরিণামে তারা যত না ঐক্যবদ্ধ ছিল তার চেয়ে অনেক বেশি গোষ্ঠীর জন্ম দিয়েছে। এর বিপরীতে, আপনারা যদি আমাদের পার্টির ইতিহাস ও অভিজ্ঞতাগুলির প্রতি নজর দেন তাহলে দেখবেন যে আমরা কখনই ঐক্যের জন্য ঐ প্রেক্ষিতে অগ্রসর হইনি। তা সত্ত্বেও, বিভিন্ন গ্রুপ ও পার্টি থেকে কমরেডরা অনবরত আমাদের পার্টিতে এসে যোগ দিচ্ছেন। আপনারা যদি আমাদের পার্টি সদস্যপদের বিষয়টি খতিয়ে দেখেন তবে দেখবেন যে এক ভালো সংখ্যক কর্মীরাই এসেছেন অন্যান্য পার্টি থেকে এবং আমার মনে হয় যে বোধহয় এই সদস্যরা, ১৯৭৪ সাল থেকে যত সদস্য আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদেরকে সংখ্যাগতভাবে ছাপিয়ে যাবেন। আর, পিসিসি, সিপিআই, সিপিআই(এম)-এর মতো বিভিন্ন গ্রুপ ও পার্টি তথা অন্যান্য পার্টি থেকে আসা সেই সমস্ত বিরাট সংখ্যক কমরেডরা গণতান্ত্রিকভাবে কেন্দ্রীভূত পার্টির অধীনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আজ এই আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমি মনে করি না যে এজন্য পার্টির কার্যকলাপে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আর আমরা যে কাঠামোতে নেতৃত্ব দিচ্ছি তাতে নানান ধারা থেকে আসা কমরেডদের ঐক্যবদ্ধ করতে সমর্থ হয়েছি। কয়েকটি গোষ্ঠী এমনকি তাদের সংগঠনকে ভেঙ্গে দিয়ে আমাদের পার্টির সঙ্গেই ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এভাবেই আমরা বাম ও নকশালপন্থী বিপ্লবীদের এক ভালো সংখ্যক কর্মীদের আমাদের পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছি। এটিই আমাদের ইতিহাস হিসাবে থেকেছে। ভারতবর্ষে অন্য যে কোনো গ্রুপের নেওয়া ঐক্য প্রচেষ্টার তুলনায় আমাদের এই প্রচেষ্টা অনেক বেশি মজবুত ঐক্যের জন্ম দিয়েছে। এখন আমরা যদি বৈধ বিরোধী পক্ষের ভিত্তিতে ঐক্য গড়ে তোলার প্রক্রিয়ার দিকে যাই আমাদের অভিজ্ঞতা কিন্তু তাকে ভুল হিসাবেই প্রমাণিত করেছে। আমি মনে করি, বৃহত্তর ঐক্যের জন্য আমাদের বাম কনফেডারেশনের মতো অনেক ভালো বিকল্প ধারণা রয়েছে। তা সত্ত্বেও, এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিতর্কটি চালানো যেতেই পারে।

গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার প্রশ্নে আমি আরেকটি ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে চাই। আমরা দলিলে এটাই বলেছি যে, গণসংগঠনগুলির কার্যকলাপে পার্টি নেতা ও পার্টি কমিটিগুলি যেন অযথা হস্তক্ষেপ না করে। এর অর্থ হল, গণসংগঠনগুলি যেন নিজের নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে গড়ে উঠতে পারে। কিন্তু কিছু কমরেড এর সাধারণীকরণ করে বলছেন যে ঐসব ক্ষেত্রে যদি তা প্রযোজ্য হয়ে থাকে, তবে একইভাবে নীচুতলার পার্টি কমিটিগুলির কার্যকলাপে উচ্চতর পার্টি কমিটিগুলিও যেন নাক না গলায়। আমার মনে হয় যে দুটি বিষয়কে সমান করে দেখা ঠিক হবে না। পার্টি ও গণসংগঠনগুলির মধ্যেকার সম্পর্কের বিষয়টি অনেক ভিন্ন। পার্টি ও গণসংগঠন হল দুটি আলাদা সত্তা। আমরা গণসংগঠনগুলিতে কাজ করতেই পারি, কিন্তু তাদের সত্তা আলাদা। তাদের রয়েছে নিজস্ব স্বকীয় চরিত্র। আমরা ইতিমধ্যেই একটি সংশোধনী নিয়ে এসেছি যে, গণসংগঠনগুলিকে তাদের সম্মেলনগুলিতে নিজেদের নেতৃত্বকে নির্বাচিত করা উচিত। আর এভাবেই গণসংগঠনগুলি বিকশিত হবে স্বাধীনভাবে। তাই একই পার্টির মধ্যে দুটি পার্টি কমিটি অর্থাৎ উচ্চতর কমিটির সঙ্গে নিম্নতর কমিটির মধ্যকার সম্পর্ক আর গণসংগঠন ও পার্টির ভেতরের সম্পর্ক গুণগতভাবেই অনেক আলাদা। এই দুটি বিষয়কে অবশ্যই গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না, সমানভাবে দেখা ঠিক হবে না।

পার্টি কেন্দ্র সম্পর্কে বলতে গেলে, আমি অবশ্যই বলব, সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠদের মেনেই চলেন। সেটি অন্যতম মূল নীতি যা আমরা অনুসরণ করি। পার্টি কমিটির মধ্যে সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ মতকেই মেনে চলেন, এটিই স্বাভাবিক। আবার নীচুতলার পার্টি কমিটিগুলি উচ্চতর পার্টি কমিটিগুলির অধীন। এটিও খুবই স্বাভাবিক। খুবই বোধগম্য। ব্যক্তি সংগঠনের অধীন। এটিও ভালোভাবেই বোঝা যায়। কিন্তু গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার মৌলিক বিষয় হল সমগ্র পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন। এই বাড়তি সূত্রায়ন কিছু কমরেড প্রায়শই ভুলে যান। এটিই বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সূত্রায়ন বলে দেয় যে সমগ্র পার্টি কেন্দ্রীয় কমিটির অধীন। আর এইভাবে সমগ্র সম্পর্কই উল্টে যায়। সমগ্র পার্টির অর্থ হল বিশাল এক সংখ্যাধিক্য। আর কেন্দ্রীয় কমিটি হচ্ছে ২৫ সদস্যের সংখ্যালঘু। এটি খুবই অস্বাভাবিক ও ভিন্ন ব্যাপার। আর এটিই কমিউনিস্ট পাটির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার মূল কথা। এই বিষয়টি না বুঝতে পারলে বোধ হয় আপনারা গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার অখণ্ডতাকে উপলব্ধি করতে পারবেন না। তাই কেন্দ্রীয় কমিটি শুধু নীচুতলার কমিটিগুলির ক্ষেত্রে নয়, বরং প্রয়োজনে যে কোনো সদস্য, যে কোনো কমিটি, যে কোনো ক্যাডারের ক্ষেত্রে যে কোনো সময়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। এটি কমিউনিস্ট পার্টিতে পুরোমাত্রায় অনুমোদনযোগ্য। এই হল আসলে এক কমিউনিস্ট পার্টি। এই কেন্দ্রীকতা ছাড়া, এই ঐক্য বাদে কোনো লৌহদৃঢ় শৃঙ্খলা থাকে না, গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণী লড়াইয়ে শত্রুর বিরুদ্ধেও আমরা সংগ্রাম করতে পারব না। ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ অংশের এইভাবে ‘সংখ্যালঘু’দের অধীনে থাকাই বোধহয় কমিউনিস্ট পার্টির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাই, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি সম্পর্কে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি বা ক্ষোভ সৃষ্টি করা খুবই ক্ষতিকর। বিভিন্ন ব্যাপারে কেন্দ্রীয় কমিটির হস্তক্ষেপ করার অধিকার সম্পর্কেই প্রশ্ন তোলা, এটা করতে পারবে না – ওটা করতে পারবে না ইত্যাদি বলা কমিউনিস্ট পার্টিতে কখনই চলতে পারে না। এটি খুবই এক অদ্ভূত ধরনের ব্যাপার। কেউ তা পছন্দ করতে পারেন, কেউ না-ই পারেন। কিন্তু একবার যখন আমরা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তখন আমাদের মেনে নিতেই হবে যে কেন্দ্রীয় কমিটি কিন্তু অন্যান্য উচ্চতর কমিটির মতোই হবহু এক নয়। তার সমগ্র কর্মীবাহিনীর উপর রাজ্য কমিটির তাই অধিক কর্তৃত্ব থাকে না। অন্যান্য এলাকা কমিটিরও নয়। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ক্ষেত্রেই এই বিশেষ অধিকার বলবৎ রাখা হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির সংবিধানে এ হল এক বিশেষ দিক। আর আমার মনে হয়, এই ধারণাকে গুলিয়ে দেওয়ার যে কোনো প্রচেষ্টাই পার্টির পক্ষে খুবই ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে।

(লিবারেশন সম্পাদকীয়, এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে)

এবারের ২২ এপ্রিল পার্টি তার ২৬তম বার্ষিকী উদযাপন করবে। নিশ্চিতভাবেই পার্টির মৌলিক নীতিমালা ও সাধারণ দিশার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা পুনর্ঘোষণা করার এ এক উপযুক্ত সময়। কিন্তু আমরা যদি শুধুমাত্র এই ‘পুনর্ঘোষণা’র মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখি তাহলে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিছক এক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হবে। আমার মতে, আমাদের বৃদ্ধি কেন মন্থর, অসম এবং কখনও কখনও বিকৃতভাবে হচ্ছে তার পিছনকার কারণগুলি গভীর ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে খতিয়ে দেখার ওপরই আমাদের বেশি করে জোর দেওয়া উচিত।

আমাদের মতান্ধদের মতো আচরণ করা উচিত নয়, যারা নিজেদের অনুশীলনের লাগাতার পর্যালোচনা করতে অস্বীকার করে এবং প্রায় ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের মতোই আঁকড়ে ধরে থাকে পুরোনো ও বস্তাপচা সূত্রায়নগুলিকে। ভারতের নির্দিষ্ট অবস্থার সাথে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে একাত্ম করে নেওয়ার জীবন্ত প্রতিমূর্তি হিসাবেই পার্টি লাইনকে বিকশিত করে তুলতে আমরা শপথ নিয়েছি। এর জন্য প্রয়োজন কঠোর এক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে তাত্ত্বিক ধ্যানধারণাগুলি ব্যবহারিক পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে পরীক্ষিত ও প্রয়োজনমতো পরিবর্তিত হয়। মাও সে তুঙ বলেছেন, অনুশীলনই সত্যের একমাত্র মানদণ্ড। একথা এর থেকে জোর দিয়ে বলা যায় না।
তাছাড়া, বস্তুগত পরিস্থিতির বাস্তব মূল্যায়ন করা, নির্ভীকভাবে আত্মসমালোচনা করা আর কঠিনতম পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে ও তাকে পাল্টাতে সাহসী হওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে কমিউনিস্টদের শক্তি। আর এর জন্য তাদের কোনো কৃত্রিম মাদকের প্রয়োজন হয় না। কমিউনিজমের চূড়ান্ত লক্ষ্যের প্রতি তাঁদের নিষ্ঠা এবং মানবসমাজ চিরকাল সামনের দিকে এগিয়ে চলবে – এই দৃঢ় বিশ্বাস, এর থেকেই তাঁরা তাঁদের প্রাণশক্তি সঞ্চয় করেন। আমাদের একটি পার্টি মুখপত্রের সঙ্গে জড়িত এক কমরেডকে আমি সবসময়ই আমাদের সাফল্যগুলিকে সর্বোৎকৃষ্ট বলে তুলে ধরতে দেখতে পাই। সাদামাটা এক পার্টি সমাবেশের মধ্যে তিনি ফরাসী বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। বহুবার চোখে আঙুল দিয়ে এটা আমি তাঁকে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি বোধহয় বিশ্বাস করেন যে পার্টি কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে হলে এই ধরনের কড়া দাওয়াই না হলে চলে না।

প্রতিবারই যখন নির্বাচন এগিয়ে আসে তখন কিছু কিছু লোক আকাশকুসুম সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সাম্প্রতিক বিহার নির্বাচনের সময় এক কমরেড তাঁর কেন্দ্রে জয় সুনিশ্চিত করার জন্য তিনি যে চমৎকার পরিকল্পনা নিয়েছেন তার কথা আমাকে শোনান। আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিই যে পার্টি কখনই তাঁকে যেন তেন প্রকারেণ জয় হাসিল করতে বলেনি। আমি বলি, আপনি যদি সম্মানজনক সংখ্যায় ভোট পান তাই-ই কি যথেষ্ট নয়? তাঁর অলীক আকাঙ্খায় আমার ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেওয়া তিনি আদৌ পছন্দ করেননি। কিন্তু ফলাফল থেকে দেখা গেছে, কমরেডটি সম্মানজনক ভোট পেতেও ব্যর্থ হয়েছেন।

অন্ধ্র থেকে বিহার পর্যন্ত বর্তমান পর্যায়ে যে বিধানসভা নির্বাচনগুলি হয়ে গেল তার দিকে তাকিয়ে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে নির্বাচন বয়কটের কৌশল (যাকে কোনো কোনো গোষ্ঠী এমনকি রণনীতির স্তরেও তুলে নিয়ে গেছে) সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই কৌশলকে মরীয়াভাবে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে তারা প্রথমে দুঃসাহসিকতাবাদের আশ্রয় নেয় এবং পরবর্তীকালে নিকৃষ্ট ধরনের সুবিধাবাদের শিকার হয়। এর বিপরীতে আমাদের পার্টি এক জোরদার নির্বাচনী প্রচারাভিযান সংগঠিত করে এবং বিহার বিধানসভায় অন্তত একটা শক্তিশালী কমিউনিস্ট গ্রুপকে পাঠাতে সক্ষম হয়। এটাই আমাদের সাফল্য।

কিন্তু বিহারের বহু জায়গায় তথা অন্ধ্র ও উড়িষ্যায় আমাদের ফলাফল খুব খারাপ হয়েছে। বহু কেন্দ্রে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা আমাদের কাজে দীর্ঘদিনকার স্থিতাবস্থা ও কোনো কোনো এলাকায় এমনকি আমাদের সামাজিক ভিত্তি ক্ষয় হওয়াও দেখিয়ে দিচ্ছে। এটা গভীর উদ্বেগের বিষয় ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় পার্টি সংগঠনের হাল সম্পর্কে বহু প্রশ্ন তুলে ধরে। কোনো কোনো এলাকায় পার্টি সংগঠনকে গোষ্ঠী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে আর সাধারণভাবে পার্টির আন্দোলনমুখী গণলাইনের জায়গা নিয়েছে প্রেরণাবিহীন গতানুগতিক কাজের রীতি। জনগণের থেকে বিচ্ছিন্নতা, তাদের দৈনন্দিন সংগ্রাম থেকে দূরে সরে থাকা এবং কোনো কোনো এলাকায় উদ্ধত ক্যাডারদের জনগণকে অবজ্ঞা করা ইত্যাদির জন্য আমাদের গণভিত্তির একেবারে কেন্দ্রস্থলেও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনুপ্রবেশের পথ প্রশস্ত হয়েছে। প্রচারের বাগাড়ম্বর বা সুবিধাবাদী আপোশ – এর কোনো কিছুই কখনই কঠোর-কঠিন গণকাজের বিকল্প হতে পারে না। ঐসব অঞ্চলের নির্বাচনী ফলাফলের দুর্বল চিত্রের মধ্যে তারই প্রতিচ্ছবি।

আপনার জনসমর্থন কত বিস্তৃত হচ্ছে তা পরিমাপ করার এক ভালো সূচক হচ্ছে নির্বাচন। তা একইসাথে আপনার মধ্যে কী মাত্রায় সুবিধাবাদ লুকিয়ে রয়েছে তাও দেখিয়ে দেয়।

নির্বাচনী ফলাফলের বিশ্লেষণ আমাদের সম্বিত ফেরাতে ও আমাদের দুর্বল জায়গাগুলি চিহ্নিত করতে সহায়তা করেছে। গোটা পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত করা, পার্টি জুড়ে এক নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করা ও সজীব এক গণলাইন অনুসরণ করার জন্য সংশোধনের ব্যবস্থা নেওয়ার এটাই প্রকৃষ্ট সময়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রস্তাবিত সাংগঠনিক সম্মেলন বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে, যে সম্মেলনে আমরা এই ধরনের সাংগঠনিক সমস্যাবলীর কার্যকরী মোকাবিলা করতে চাই। তবু সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা ও জনগণের সাথে বিচ্ছিন্নতার প্রশ্নের মধ্যেও একটা রাজনৈতিক-কৌশলগত দিক রয়েছে এবং সেটি মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ। দেশে প্রগতিশীল রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার যে ধরন-ধারণ ক্রমশ গড়ে উঠছে তার বিষয়বস্তু দলিত, পশ্চাদপদ ও ধর্মীয় তথা জাতীয় সংখ্যালঘুদের আত্মঘোষণা। পার্টির দিক থেকে এই প্রশ্নে সক্রিয় কোনো কমিউনিস্ট কৌশল সূত্রায়িত করা এখনও সম্ভব হয়নি।

যুক্তমোর্চার অনুশীলনের প্রশ্নে, আইপিএফ যেমন একটা সম্পৃক্ত অবস্থার মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল, নীচুতলাবাদী আন্দোলনের ব্যাপক অংশের সাথে আমাদের রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও তেমনই এখনও নির্দিষ্ট কোনো ফসল এনে দিতে পারেনি। এইচএমকেপি, সমতা পার্টি, এসইউসিআই বা অনুরূপ বাম গোষ্ঠীগুলির সাথে আমরা যে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলাম তার কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যত আছে বলে মনে হচ্ছে না। গণসংগঠনসমূহের মঞ্চকেও রাজনৈতিক সহযোগিতার স্তরে উন্নীত করা যায়নি এবং তা আজ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। পশ্চিমবাংলায় নয়া আর্থিক নীতি অনুসরণ ও বিহারে জনতা দল সরকারের বশ্যতা স্বীকারকে কেন্দ্র করে সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর সাথে আমাদের সম্পর্ক আরও সংঘাতময় হয়েছে।

এভাবে আমাদের পার্টি দ্বৈত কর্তব্যের সম্মুখীন হয়েছে – নিজস্ব শ্রেণীভিত্তিকে সংহত করা ও তার সাথে সাথে বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে নিজেদের সমর্থনভিত্তিকে প্রসারিত করা। এর জন্য প্রয়োজন, আমাদের চোখের সামনে দিয়ে যে সামাজিক আলোড়ন ঘটে চলেছে সে সম্পর্কে এক সক্রিয় প্রত্যুত্তর সূত্রবদ্ধ করা এবং বাম ও গণতান্ত্রিক শিবিরের মধ্যেকার গণভিত্তিসম্পন্ন মিত্রশক্তিগুলোর সাথে রাজনৈতিক সহযোগিতা গড়ে তোলা।

আমাদের সামনে যে জাতীয় দৃশ্য উঠে আসছে তাতে আগামী লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতা দখলের জন্য কংগ্রেস(ই) ও বিজেপির মধ্যে মধ্যে এক মহারণের নিশ্চিত আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর উভয়েরই জয়ের পরিকল্পনাকে বানচাল করে দিতে পারে এমন সম্ভাবনাময় কোনো তৃতীয় ফ্রন্ট এখনও গড়ে ওঠেনি। আমরা কংগ্রেস(ই)-র বিরুদ্ধে বিজেপির সাথে হাত মেলাতে পারি না বা বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেস(ই)-কেও সমর্থন করতে পারি না। অবশ্য জাতীয় স্তরে কোনো তৃতীয় ফ্রন্ট যদি গড়ে ওঠে তাহলে তাকে আমরা পূর্ণ সমর্থন জানাব। এ ধরনের একটা ফ্রন্টের সাথে আমাদের সম্পর্ক ঠিক কী হবে তা বলে দেওয়া এ মুহূর্তে খুবই কঠিন। আর সিপিআই(এম) যেভাবে জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে আমাদের সামনে আসার বাধা সৃষ্টি করে চলেছে তাতে কাজটা আরও বেশি জটিল হয়ে পড়েছে।

জাতীয় রাজনীতিতে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়ার উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সমগ্র পার্টিকে অবশ্যই নিজেকে ও জনগণের সাথে তার সম্পর্ককে পুনর্গঠিত করার ওপর সমস্ত প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত করতে হবে।

এবারের ২২ এপ্রিল উৎসর্গীকৃত হোক আন্তরিক আত্মানুসন্ধানে ও পার্টি সংগঠনের পুনরুজ্জীবনে।

(ডিসেম্বর ১৯৯২-এ পঞ্চম পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

চতুর্থ পার্টি কংগ্রেসে আমরা আমাদের কয়েকটি কর্মনীতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসার কথা ভেবেছিলাম এবং সাথে সাথে পার্টি কাঠামোর প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম। আমাদের কমরেডদের একাংশ অবশ্য অন্যরকম ভেবেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল – কোনো রকম পুনর্গঠনেই পার্টিতে আর নতুন জীবন সঞ্চারিত করা সম্ভব নয়। কমিউনিস্ট পার্টিকে বিদায় দিয়ে তাই গড়তে হবে একটা গণতান্ত্রিক পার্টি, খুব বেশি হলে একটি উদারনৈতিক বামপন্থী সংগঠন। “এর নাম যদি বিলোপবাদ হয়ে থাকে তাহলে এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিপ্লবের যুগে ইতিমধ্যে দুনিয়ার প্রায় সব কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে তার বীজ বোনা হয়ে গেছে” – বললেন বিলোপবাদের এক প্রবক্তা। তিনি ঠিকই বলেছেন। সত্যিই তা ছিল বিলোপবাদ এবং গর্বাচেভীয় সংস্কারের প্রভাবে তা আন্তর্জাতিক আকারই নিয়ে ফেলেছিল।

ইউরোপে, বিশেষত পূর্ব ইউরোপে অনেক কমিউনিস্ট পার্টিই দল ভেঙে দেওয়া অথবা নিজেদেরকে সমাজগণতান্ত্রিক পার্টিতে রূপান্তরিত করতে শুরু করেছিল। আর, সিপিএসইউ-র পতনের পর ঘটনা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। সিপিসি-র পক্ষে তা রোধ করা সম্ভব হয় কেবলমাত্র এক বিরাট সামাজিক আলোড়নের মূল্য দিয়ে এবং ইতালিয়ান ও অন্য কয়েকটি পার্টি ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত বিভাজনের শিকার হয়।

বিলোপবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামও যথেষ্ট ঝড় তোলে। চতুর্থ কংগ্রেসের আগে কেন্দ্রীয় কমিটির এক বৈঠকে পার্টিকে তুলে দেওয়ার ধারণাটি প্রথম উঠে আসে। কিন্তু বিতর্কটি চতুর্থ কংগ্রেসে উঠে আসেনি এবং কংগ্রেসের পরও বেশ কিছু সময় পর্যন্ত বিলোপবাদীরা কোনো সামগ্রিক রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে সন্তর্পণে সরেই ছিলেন। বিলোপবাদের মূল প্রবক্তা যখন নিঃশব্দে পার্টি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন তখন অন্য কিছু লোক সেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পার্টি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়িয়ে গোপনে ষড়যন্ত্রমূলক কায়দায় পার্টির কর্মীবাহিনীর মধ্যে বিভ্রান্তির বীজ বপন শুরু করেন। মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের নিন্দা, পুঁজিবাদের প্রশংসা, বিপ্লবী সংগ্রামকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করা এবং সংস্কারের ললিতবাণী প্রচার করতে সরকারি বা আধা-সরকারি সংস্থায় নিজেদের ভবিষ্যত খুঁজে নেওয়ার ভিতর দিয়ে পরবর্তীতে তাদের সকলকেই খোলাখুলি আত্মপ্রকাশ করতে হয়।

প্রথমত এই সংগ্রাম সমাজতন্ত্রের বিরাট সংকট ও তার সাথে সাথে মার্কসবাদের উপর বুর্জোয়াদের সার্বিক আক্রমণের মধ্যে আমাদের দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করেছে। ভারতবর্ষে আমাদের পার্টিই সবচেয়ে জোরের সঙ্গে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে, তার সুরক্ষায় ও পুনরুজ্জীবনে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে এসেছে।

এই সংগ্রামের ফলে আমরা পার্টির মধ্যে মার্কসবাদী শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ও পার্টি সংগঠনকে পুনর্গঠিত ও পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছি। গতিরুদ্ধতা ভেঙ্গে পার্টি সভ্য সংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির এক পর্যায় শুরু হয়।

এই সংগ্রামের ফলে আমরা বামপন্থার স্বাধীন উত্থানের পতাকাকে দৃঢ়ভাবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে, প্রধান ধারার সুবিধাবাদী বামপন্থীদের লেজুড়বৃত্তির বিরোধিতা করতে ও ভারতের বাম আন্দোলনের দুই কৌশলের মধ্যকার লড়াইকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হই। সেই সঙ্গে নীতির ক্ষেত্রে সমঝোতা না করেও ধাপে ধাপে আন্দোলনের ময়দানে মূল ধারার বাম পার্টিগুলির সঙ্গে আমাদের যে সহযোগিতা গড়ে ওঠে তাতে বিভিন্ন পার্টি ও গোষ্ঠীর বামপন্থী কর্মীবাহিনীর উপর আমাদের রাজনৈতিক প্রভাবও বেড়ে ওঠে।

যদিও পার্টি বিলোপবাদের বিরুদ্ধে এক নির্ধারক প্রাথমিক বিজয় অর্জন করেছে তবু লড়াইয়ের শেষ এখনও বহু দূরে। বর্তমান মতাদর্শগত পরিবেশই বিলোপবাদী ধ্যানধারণার জন্ম ও বৃদ্ধির উর্বর জমি হিসাবে কাজ করছে। বিলোপবাদের অর্থ আসলে পার্টি মানসিকতার অবক্ষয় – যে অবক্ষয় কোনো বিমূর্ত জিনিস নয়, বরং তা নিহিত রয়েছে পার্টির বিপ্লবী নীতিমালা ও সুসংবদ্ধ সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে। এইসব নীতির ক্ষেত্রে সমঝোতা করলে ও পার্টিকে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসাবে গণ্য করলে পার্টির লড়াই করার ক্ষমতাই দুর্বল হবে এবং কেন্দ্রবিমুখ প্রবণতা উৎসাহ পাবে।

বিলোপবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আর একটি ক্ষতিকারক প্রবণতা – নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে দুর্বল করবে – এই আশংঙ্কা সম্পূর্ণ অমূলক এবং তা আমাদের পার্টির বিবর্তন সম্পর্কে এক ভ্রান্ত ধারণারই পরিচায়ক। আমাদের পার্টির সমগ্র অনুশীলন সর্বদাই পরিচালিত হয়েছে আমাদের অতীত নৈরাজ্যবাদের অবশেষগুলিকে কাটিয়ে তোলা এবং আমাদের পার্টির কৌশলগত লাইনকে দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে আরও বেশি বেশি সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলার লক্ষ্যে। কিন্তু একইসঙ্গে যদি বিলোপবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াই চালিয়ে না যাওয়া হয় তাহলে এই অনুশীলন শুধু পথভ্রষ্ট হতে পারে।

এই দুই ভুল প্রবণতার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে অধিবিদ্যকভাবে দেখলে এবং তাদের মধ্যে যান্ত্রিকভাবে সমন্বয় করতে চাইলে আমরা কোথাও পৌঁছাতে পারব না। বিলোপবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে পার্টির চিন্তাশীল একটা অংশের ভুল ভাবনার উৎস হচ্ছে ঠিক এই গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্রকে ধরতে না পারা। বাস্তব ঘটনা প্রমাণ করেছে যে বিলোপবাদের বিরুদ্ধে নির্ধারক লড়াই পার্টিকে নৈরাজ্যবাদের পথে ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি। এটি বরং ব্যবহারিক রাজনীতির বিভিন্ন শাখায় আমাদের জোরালো প্রবেশ ঘটাতেই সাহায্য করেছে। কট্টর নৈরাজ্যবাদী বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন যে সমস্ত লোকজন নিজেদের শুধরে নিতে পারেননি, তাঁরা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ও বহু ক্ষেত্রে তাঁরা বিলোপবাদী শিবিরে যোগ দিয়েছেন। আগামীদিনে পার্টি ব্যবহারিক রাজনীতির ময়দানে সাহসের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাবে, আর তাই দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, পার্টি কাঠামোর মধ্যে বিলোপবাদের বিরুদ্ধে লাগাতার পাহারা চালিয়ে যাওয়ার আরও বেশি প্রয়োজন পড়বে।

পার্টি প্রতিষ্ঠা দিবস ২২ এপ্রিল (১৯৮৮) উপলক্ষ্যে

এ বছর ২২ এপ্রিল আমাদের পার্টি ২০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে পদার্পণ করছে। দিনটি পালন করার জন্য গোটা পার্টি জুড়ে বৈঠক সংগঠিত করতে হবে, যাতে প্রতিটি পার্টি সভ্য উপস্থিত থাকবেন। এই মহান দিনে প্রত্যেক পার্টি সভ্যকে বিলোপবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ও পার্টির স্বাধীন পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার শপথ নিতে হবে নতুন করে।

বিলোপবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম খুবই জটিল একটি বিষয়। কারণ পার্টির অগ্রগতির বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে বিলোপবাদ বিভিন্ন রূপ ধরে দেখা দেয়। বিলোপবাদ কী? লেনিনের ভাষায় তা হল, “পার্টির বর্তমান সংগঠনকে বিলোপ করে দিয়ে (অর্থাৎ ভেঙ্গে দিয়ে, ধ্বংস করে দিয়ে, উঠিয়ে দিয়ে, বন্ধ করে দিয়ে) সে জায়গায় আইনিভাবে (অর্থাৎ আইন মেনে, ‘খোলাভাবে’) কাজ চালানোর এক ঢিলেঢালা সংগঠন নিয়ে আসার জন্য পার্টি-বুদ্ধিজীবীদের কোনো গোষ্ঠীর প্রচেষ্টা। যে কোনো মূল্যে, এমনকি পার্টির কর্মসূচি, কৌশল ও ঐতিহ্যগুলিকে (পার্টির অতীত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে) পুরোপুরি খারিজ করে দিয়েও এটা করার জন্য এঁরা চেষ্টা করে থাকেন।”

অতএব বিলোপবাদের আসল বৈশিষ্ট্য কেবল প্রকাশ্য পার্টির সপক্ষে এবং আইনি সুযোগগুলি পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর সপক্ষে যুক্তি হাজির করাই নয়, বরং “পার্টির জায়গায় এমন কিছু নিয়ে আসা, যার কোনো আকারই নেই, যাকে ঠিক পার্টিই বলা যায় না।” চিন্তার এই বিলোপবাদী ধারাটিকে আগে পরাস্ত না করে চতুর্থ কংগ্রেসের তুলে ধরা পার্টি পুনর্বিন্যাসের কাজটিকে ঠিকমতো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

বিলোপবাদের আর একটি দিক হল এই যে তা বিপ্লবী গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের দুর্গ বিপ্লবী কৃষক সংগ্রামের পরিধিকে সাহসের সঙ্গে সম্প্রসারিত করার তাৎপর্যকে ছোটো করে দেখায়। এর পরিবর্তে সে এমন একপ্রস্থ কর্মনীতির ওকালতি করে যা কৃষক সংগ্রামকে সংস্কারবাদের চার দেওয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলার দিকেই নিয়ে যেতে বাধ্য।

কৃষক সংগ্রামের ব্যাপকতা ও গভীরতাকে বাড়িয়ে তোলার যে লাইন চতুর্থ কংগ্রেস গ্রহণ করেছে, চিন্তার এই ধারাটিকে পরাস্ত না করে তা কিছুতেই প্রয়োগে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

‘সমাজগণতন্ত্রীদের পরিচালনাধীন’ বামফ্রন্টগুলির শরিক হওয়া এবং সে জন্য ‘বামফ্রন্ট’ সরকারগুলি সম্পর্কে পার্টির কর্মনীতি পরিত্যাগ করার ওকালতির মধ্যে দিয়েই এই বিলোপবাদী চিন্তাধারা সব চাইতে জোরালোভাবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রথমে সমাজগণতন্ত্রীদের কর্মসূচির ভিত্তিতে ব্যাপক বাম ঐক্য গড়ে তোলা এবং তারপর ভেতর থেকে মেরুকরণের কাজ চালানোর এই বিমূর্ত রাজনৈতিক কৌশলের আসল অর্থ হল, বিপ্লবী কমিউনিস্টদের স্বাধীন পতাকা পরিত্যাগ করা; সমাজতন্ত্রকে উদ্ঘাটিত করা, বিচ্ছিন্ন করা ও পরাস্ত করার যে ঐতিহাসিক ব্রত তাঁদের সামনে রয়েছে তা পরিত্যাগ করা।

বামপন্থী শক্তিগুলির মধ্যে মেরুকরণ ঘটানোর এবং এক নতুন বনিয়াদের ওপর ব্যাপক বাম ঐক্য গড়ে তোলার যে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কৌশল পার্টির চতুর্থ কংগ্রেস গ্রহণ করেছে, উপরোক্ত রাজনৈতিক সুবিধাবাদকে পরাস্ত না করে তা বলিষ্ঠভাবে প্রয়োগে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।

বিহারের বুকে আমাদের পার্টি দৃঢ়তার সাথে স্বাধীন পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে, বিপ্লবী কৃষক সংগ্রামের সামনের সারিতে অবিচল থেকেছে এবং জাতীয় স্তরে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংগ্রামগুলিতে (যেমন, সাম্প্রতিক ‘ভারত বনধে’) সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপক বাম শক্তিগুলির সঙ্গে যুক্ত কার্যকলাপ গড়ে তুলতেও সফল হয়েছে। বিহারের বুকে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে গোটা পার্টিকেই শিক্ষা নিতে হবে এবং পার্টির চতুর্থ কংগ্রেসের পথ ধরে এগিয়ে চলার জন্য দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

(কয়েকটি পার্টি কমিটির সঙ্গে আলোচনার সারসংক্ষেপ। লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৮৬ থেকে)

১। পার্টি কর্মীবাহিনীর রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করে তোলা প্রসঙ্গে

পার্টি স্কুল ব্যবস্থা অনুষ্ঠান-সর্বস্বতায় পর্যবসিত হয়ে পড়ার এক বিপদ থেকে যায়। কতগুলি ক্লাস নেওয়া হল এবং কত বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হল সেই পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখা ভালো এবং চমৎকার, কিন্তু সেটাই বড় কথা নয়। বড় কথা হল – মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক মানের উন্নতি ঘটছে কিনা। যে কোনো বিশেষ অভিযানেই আনুষ্ঠানিকতার প্রবণতা মাথা চাড়া দেয়, আর তাই এর বিরুদ্ধে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।

এই ক্লাসগুলির লক্ষ্য হল বিভিন্ন সামাজিক পরিঘটনাগুলিকে অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করতে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী উপলব্ধির বিকাশ ঘটানো; শ্রেণীগুলি কীভাবে আচরণ করে, শ্রেণী-স্বার্থ কীভাবে কাজ করে, ইত্যাদি।

উদাহরণস্বরূপ, কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকায় কৃষকরা সিপিআই(এম)-এর প্রভাবাধীনে ছিলেন। সেখানে সিপিআই(এম)-এর সংশোধনবাদ, সংসদ-সর্বস্বতা ইত্যাদি সম্পর্কে বিমূর্ত প্রচার চালিয়ে আমাদের কমরেডরা ঐ কৃষকদের আমাদের পক্ষে জয় করে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালান, কিন্তু তাঁরা ব্যর্থ হন। জনগণ সাধারণত তাদের শ্রেণী-স্বার্থ বুঝে ক্রিয়াশীল হন এবং কোনো দল যখন তাদের স্বার্থের কথা বলছে বলে মনে হয় তখন তারা সেই দলকে অনুসরণ করেন। কোনো মানুষই সিপিআই(এম), কংগ্রেস বা ডিএমকে হয়ে জন্মান না। এখন, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলস্বরূপ সিপিআই(এম) ঐ এলাকায় জমিদারদের সঙ্গে সমঝোতা করতে এবং ধনী কৃষকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করে এবং ফলে তার আগের সামাজিক ভিত্তিতে দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে ওঠে। আমাদের কমরেডরা ইতিমধ্যেই নিজস্ব সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন এবং সংগ্রাম পরিচালনা করছিলেন। তাঁরা ঐ দ্বন্দ্ব ধরতে পারলেন, ব্যাপক কৃষক জনতাকে প্রভাবিত করতে পারে এমন স্লোগান ও ইস্যুগুলিকে তুলে ধরলেন এবং সিপিআই(এম)-এর নীচুতলার কর্মীবাহিনী ও তাদের প্রভাবাধীন জনগণের সঙ্গে যৌথ কার্যকলাপের বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা চালালেন। এবার তাঁরা সফল হলেন। জনগণ ক্রমে ক্রমে তাঁদের আনুগত্য পরিবর্তিত করে আমাদের দিকে চলে এলেন।

আপনারা দেখে থাকবেন ভালো সংখ্যক সৎ ও জঙ্গী পেটি বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী সিআরসি, জনযুদ্ধ গোষ্ঠী, ইত্যাদির মতো ‘বামপন্থী’ সংগঠনগুলির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। তাঁদের শ্রেণীগত অবস্থানের গুণেই পেটি বুর্জোয়া নৈরাজ্যবাদী সিন্ডিক্যালিস্ট চিন্তাধারার প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। বাস্তবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংযোগের কারণে শ্রমিকশ্রেণী ও কৃষক জনতা প্রকৃতিগতভাবে রাজনীতি বিমুখ নয়। আর তাই শ্রমিকশ্রেণী ও ব্যাপক কৃষক জনতার মধ্যে ঐ সমস্ত গোষ্ঠীর বা বলতে পারেন নীচুতলাবাদীদের প্রভাব বা গণভিত্তি মোটেই দীর্ঘস্থায়ী হতে দেখবেন না। শুধু বিতর্ক চালিয়ে ঐ সমস্ত গোষ্ঠীর প্রভাবে থাকা বুদ্ধিজীবীদের জয় করে নিয়ে আসা যাবে না। স্বাধীন রাজনৈতিক উদ্যোগ ও শক্তিশালী গণআন্দোলন যত বেশি করে বিকাশলাভ করবে ততই এই সমস্ত বুদ্ধিজীবীরা দিক পরিবর্তন করবেন।

অনেকেই তামিলনাড়ুতে এআইএডিএমকে-র প্রভাবের কারণ হিসাবে রামচন্দ্রনের আকর্ষণীয় ক্ষমতার কথা বলে থাকেন। গভীর বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যাপক সংখ্যক মানুষ যে এই দলকে সমর্থন করেন তার কারণ হল, এই দল তাঁদের কিছু দাবি পূরণ করে থাকে বলে তাঁরা মনে করেন, অথবা তাঁদের অন্ততপক্ষে সে রকম প্রত্যাশা রয়েছে। অপরদিকে, এক ব্যাপকতর সামাজিক ভিত্তিকে বজায় রাখা ও তার বিকাশ ঘটানোর প্রচেষ্টার সঙ্গে এআইএডিএমকে-র বুনিয়াদী শ্রেণীগত অবস্থানের সর্বদাই সংঘাত দেখা দেয়।

এই বাস্তবতাগুলিকে আমাদের অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে এবং তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে স্লোগান, কৌশল ও আন্দোলনের বিকাশ ঘটাতে হবে। এই পথেই আমাদের ব্যবহারিক রাজনীতির অনুশীলনের দিকে যাওয়া উচিত, এইভাবেই উপরোক্ত পার্টিগুলির সামাজিক ভিত্তি ও তাদের শ্রেণীগত অবস্থানের মধ্যেকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে তীব্র করে তুলতে হবে।

আপনারা যদি শুধু হৃদয়বৃত্তি বা আবেগ দ্বারা চালিত হন তবে কেবলমাত্র এই দলগুলিকেই নিন্দা করার অবস্থানেই পৌঁছাবেন। আর আবেগ যেহেতু দীর্ঘস্থায়ী হয় না বা বস্তুগত শক্তিতে রূপান্তরিত হয় না, তাই শেষমেষ সমগ্র ব্যাপারটি আত্ম-ধিক্কারেই পর্যবসিত হবে। আপনাদের মননশীলতার ভিত্তিতেও কাজ করতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট নীতি ও কৌশল, স্লোগান ও কাজের ধারার বিকাশ ঘটাতে হবে যাতে ঐ সমস্ত দলগুলিকে নির্দিষ্ট অর্থে উন্মোচিত করা যায় এবং জনগণকে নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষালাভ করতে সাহায্য করার মাধ্যমে তাদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরানো যায় এবং জনগণকে অবশেষে জয় করে নেওয়া যায়।

আমাদের আন্দোলনের অধিকাংশ লোক মনের দিক থেকে নয়, হৃদয়বৃত্তির দ্বারাই চালিত হন। এর ফলে বিপ্লবী বুলির দিক থেকে তাঁরা সবচেয়ে এগিয়ে থাকেন, আর গণভিত্তির দিক থেকে থাকেন সবার পিছনে। এইভাবে জনগণ প্রতিক্রিয়াশীল, সমাজগণতন্ত্রী ও উগ্র আঞ্চলিকতাবাদীদের প্রভাবাধীনে থেকে যান। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, কিছু মানুষ এ ব্যাপারে একটুও উদ্বিগ্ন হন না, জনগণ তাঁদের স্লোগানগুলিতে প্রভাবিত হলেন কী হলেন না তাতে তাঁদের কিছু যায় আসে না, তাঁরা কিন্তু নিজেদের স্লোগানগুলিকে পরিবর্তন করতে প্রস্তুত নন। এই মানুষগুলি মনে হয় বিশ্বাস করেন যে বিপ্লব সম্পন্ন হয় শুধু কথা দিয়েই, জনগণের দ্বারা নয়। একেই বলা হয় বাম বুলিসর্বস্ততা।

যে বাস্তব নিয়মগুলির দ্বারা সমাজ, শ্রেণীগুলির অবস্থান পরিবর্তন হয় ও তাদের সংগ্রাম পরিচালিত হয়, চিরায়ত মার্কসবাদী সাহিত্যের অধ্যয়ন সেই নিয়মগুলিকে আয়ত্ত করতে আপনাদের সাহায্য করবে।

এই অধ্যয়ন আত্মগত আকাঙ্খার পরিবর্তে বাস্তবতার ভিত্তিতে আপনাদের স্লোগান, নীতি ও কৌশলগুলিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলতে সাহায্য করবে।

২। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ব্যবস্থাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা প্রসঙ্গে

গণতন্ত্র বলতে সাধারণভাবে আমরা যা বুঝি, কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে তার তাৎপর্য কিছুটা আলাদা। এখানে গণতন্ত্র কেন্দ্রীয় পরিচালনার অধীন। কখন এবং কী বিষয়ে বিতর্ক ও আলোচনা চালানো হবে তা ঠিক করে থাকে কেন্দ্রীয় কমিটি। অন্যথায় পার্টি একটি বিতর্ক চালানোর সংস্থায় অধঃপতিত হবে। সিআরসি গোষ্ঠী উগ্র গণতন্ত্রের এক চরম নিদর্শন। তাঁরা নিজেদের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রকৃত অনুগামী হিসাবে দাবি করেন, তথাকথিত দু-লাইনের সংগ্রামকে বিরামহীনভাবে চালিয়ে যান এবং প্রত্যেককে লাগাতার বিতর্কে নিয়োজিত থাকার কথা বলেন। এর ফলে কী দাঁড়াল? তাঁরা কয়েকটি উপদলে বিভক্ত হয়ে গেলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ এখন মার্কসবাদ সঠিক কী সঠিক নয় সেই বিতর্ক চালাচ্ছেন, কেউ কেউ আবার বলছেন যে ‘গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা’ সম্পর্কে লেনিনীয় ধারণা ভুল। অনেকে সিআরসি সংগঠনকে খুবই গণতান্ত্রিক সংগঠন বলে মনে করেন। এই ধারণা ভুল। উগ্র গণতন্ত্র পেটি বুর্জোয়াদের পছন্দের বিষয় হতে পারে, সেক্ষেত্রে কিন্তু সংগঠন বলে কিছু থাকবে না। কেন্দ্রীকতা ছাড়া সংগঠন হতে পারে না। ৭০ দশকের গোড়ার দিকে আমার এক বন্ধু আমাকে বলেন, ‘ব্যক্তি সংগঠনের অধীন’ এবং ‘সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরুর অধীন’ – এই ধারণা অত্যন্ত অবমাননাকর এবং তিনি দাবি করেন ‘সত্য প্রায়শই সংখ্যালঘুর মধ্যেই নিহিত থাকে’ এই কথা ঘোষণা করে সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঐ ধারণাকে ধুলিস্যাৎ করেছে। আমি তাঁকে বলেছিলাম, তাহলে আপনার সংগঠন বলে কিছু থাকবে না।

এই ব্যক্তি পরবর্তীকালে পার্টি ছেড়ে চলে যান, তিনি এখন একটি ‘আন্তর্জাতিকতাবাদী’ কেন্দ্র পরিচালনা করছেন। কিন্তু অবাক ব্যাপার, তাঁর অভিযাত্রায় আজ তিনি একা!

পার্টি কংগ্রেসই পার্টি লাইন নির্ধারিত করে থাকে। তার আগে পার্টি লাইনের সমস্ত দিক সম্পর্কে বিতর্ক ও আলোচনা চালানো হয়। পার্টি কংগ্রেসে সমস্ত বিষয়গুলি নির্ধারিত হয়ে গেলে সমগ্র পার্টিকেই তার প্রয়োগে নামতে হবে। পুনরায় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হবে এবং তখন আবার বিতর্কও চালানো হবে। এর মধ্যবর্তী সময়কালেও নতুন কর্মনীতি, ও কৌশল সংক্রান্ত প্রশ্নে, যে সমস্ত বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে সেই সমস্ত প্রশ্নে সব সময়েই বিতর্ক ও আলোচনা চালানো হয় এবং মতামতগুলি সংগ্রহ করা হয়। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু ভিত্তিতে এবং সংখ্যালঘুরা নিজেদের মতামত সংরক্ষিত রাখতে পারেন।

কেউ কেউ বলেন, আপনাদের পার্টি যথেষ্ট গণতান্ত্রিক না হওয়ার কারণেই আপনারা ভাঙ্গন ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছেন। এই ধারাবাহিক ঐক্য দেখিয়ে দেয় যে আপনারা গণতান্ত্রিক নন। সিআরসি, পিসিসি এবং অন্যান্য সংগঠনগুলির মধ্যে বারবারই যে ভাঙ্গন ঘটছে তার কারণ হল তারা গণতান্ত্রিক। কেউ কেউ আবার এমন অভিমতও ব্যক্ত করেন, আপনারা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পেরেছেন কারণ আপনারা কর্মীবাহিনীকে অন্ধকারে রেখে দেন, আপনারা তাদের রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেন না, তাদের অন্যান্য সংগঠনের পত্রপত্রিকা পড়ার বা অন্যান্য সংগঠনের কর্মীদের সংস্পর্শে আসার অনুমতি দেন না; আর আপনাদের নেতৃত্ব চলছে দুটি বা তিনটি গোষ্ঠীর মধ্যে এক অনীতিনিষ্ঠ ঐক্যের ভিত্তিতে, যে গোষ্ঠীগুলি একেবারে ভিন্নধর্মী বা বিপরীত অবস্থান গ্রহণ করে আছে।

আপনারা জানেন, এ সমস্ত কিছুই ভিত্তিহীন। বস্তুত এই ধরনের মানুষগুলি নিজেদের নৈরাজ্যবাদকে যথার্থ প্রতিপন্ন করতে, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ভিত্তিতে এক সংগঠন গড়ে তুলতে নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকতে ঐ ধরনের আজগুবি কথাবার্তার আশ্রয় নেন। এই সমস্ত গোষ্ঠীগুলি কেন্দ্রীকতাকে ভয় করে এবং নিজেদের নৈরাজ্যবাদকে প্রতিষ্ঠিত করতেই তাঁরা সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও মাও-এর কথা বলে বেড়ান।

কিছু ব্যক্তি বলেন যে, সত্যনারায়ণ সিং-এর মৌলিক অবদান ছিল চারু মজুমদারের আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাকে তুলে ধরা। তাই যদি হয় তবে এক ঐক্যবদ্ধ পার্টি গড়ে তুলতে তিনি নিদারুণভাবে ব্যর্থ হলেন কেন? যখনই কোনো বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে তখনই তাঁর পিসিসি গোষ্ঠীতে ভাঙ্গন ঘটেছে কেন? আর যাঁরা চারু মজুমদারকে ধরে রইলেন তাঁরাই শেষপর্যন্ত এক ঐক্যবদ্ধ পার্টি গড়ে তুলতে সফল হলেন কীভাবে? বস্তুত সত্যনারায়ণ সিং উগ্র গণতন্ত্রের জন্যই লড়াই করেছেন এবং শেষপর্যন্ত কেন্দ্রীকতার বুনিয়াদী মতবাদকেই আঘাত করেছেন, এবং তাও চরম দমন-পীড়নের সময়। চারু মজুমদার যথার্থভাবেই গুরুত্ব দিয়ে বলেছিলেন, যে পার্টি জীবন-মৃত্যুর সংগ্রামে নিয়োজিত তার কাছে গণতন্ত্র ছেলেখেলার বস্তু নয়। শ্বেত সন্ত্রাসের পর্যায়ে তিনি সঠিকভাবেই কেন্দ্রীকতার উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি মূলগতভাবে সঠিক ছিলেন। একথা অবশ্য সত্যি যে, কেন্দ্রীকতার উপর অত্যধিক গুরুত্ব আরোপের ফলে কিছু বিচ্যুতি দেখা দিয়েছিল। এসত্ত্বেও প্রকৃত ও আন্তরিক বিপ্লবীরা চারু মজুমদারের সঙ্গেই ছিলেন এবং ক্রমে ক্রমে তাঁরা ঐ বিচ্যুতিগুলিকে কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র পূর্ণমাত্রায় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সত্যনারায়ণ সিং-এর সব থেকে বড় ব্যর্থতা দেখিয়ে দেয় যে মূলগতভাবে তাঁর অবস্থান ছিল ভুল এবং তাঁর লড়াই ছিল গণতন্ত্রের জন্য নয়, কেন্দ্রীকতার বিরুদ্ধে।

মোটের উপর গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা সফল হয়েছি। তা সত্ত্বেও আমাদের সংগঠনের মধ্যে কিছু ভুল প্রবণতা রয়ে গেছে। গণসংগঠনগুলির ক্ষেত্রে আমরা তাদের স্বাধীন ভূমিকা ও কার্যকলাপের পক্ষে এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির ক্ষেত্রে আমরা তাদের স্বায়ত্ততাকে সমর্থন করি। কিন্তু এই সংগঠনগুলিতে পার্টির কিছু কিছু ব্যক্তি এই স্বাধীনতা ও স্বায়ত্ততার অপব্যাখ্যা করেন। আমরা বলতে পারি, তাঁরা ‘স্বতন্ত্রতার’ জন্য উৎসুক। স্বাধীনতা ও স্বায়ত্ততা হল ব্যাপকতম জনগণের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং কাজের ক্ষেত্রে সৃজনশীলতা ও দক্ষতার বিকাশ ঘটানোর হাতিয়ার। এই স্বাধীনতাকে আপনি ‘আপেক্ষিক স্বাধীনতা’ হিসাবে অভিহিত করতে পারেন। কিন্তু ‘স্বতন্ত্রতা’ হল সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয় : তা পার্টি লাইন, পার্টির পরিচালনা ও পার্টি শৃঙ্খলাকে অমান্য করার অধিকারের দাবি জানায়।

আজকাল অনেকেই পার্টির সিদ্ধান্তগুলিকে লঙ্ঘন করেন, ‘বিক্ষুব্ধ’ হিসাবেই তাঁরা পরিচিত হতে পছন্দ করেন। তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি, এই অজুহাতে তাঁরা পার্টি নেতৃত্বের কাছ থেকে আসা সমস্ত পদক্ষেপগুলির, সমস্ত ধারণাগুলির সমালোচনা করেন। এমন কিছু সদস্যকে আমি জানি যাঁরা একজন পার্টি সদস্য যে অধিকারগুলির ভোগ করেন সেগুলি সবই চান, কিন্তু সংগঠন তাঁদের যে দায়িত্ব দেয় সেগুলি পালন করতে তাঁরা রাজি নন। যদি কোনো কিছু তাঁদের বিরুদ্ধে যায় তাঁরা তা মানবেন না।

একজন সদস্যের প্রাথমিক কর্তব্য হল সংগঠনের দেওয়া দায়িত্ব অবশ্যই পালন করা। এই দায়িত্ব অর্পণের সময় সংশ্লিষ্ট সদস্যের সঙ্গে অবশ্যই আলোচনা করা হবে ও তাঁর সম্মতি নেওয়া হবে, কিন্তু একবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেলে তা তাঁকে সম্পূর্ণ আন্তরিকভাবেই পালন করতে হবে। এই ন্যূনতম পার্টি-বোধ যদি না থাকে তবে তিনি সদস্য হওয়ার উপযুক্ত নন এবং তার ফলে পার্টি সদস্যের কোনো অধিকারও তাঁর থাকবে না।

এইগুলি হল উগ্র গণতন্ত্রের কিছু বহিঃপ্রকাশ। প্রতিটি সমস্যাকেই আবার উগ্র গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে চিহ্নিত করা ঠিক নয়। কিছু কিছু রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, কঠোর পরিশ্রম না করা হল উগ্র গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ। বিলোপবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম যখন আমরা শুরু করি, আমার মনে আছে তখনকার একটি রিপোর্টের কথা – বৈঠকে দেরীতে আসা বা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময় ঘুমিয়ে পড়াকেও বিলোপবাদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। আমার মনে হয় এগুলি ঠিক নয়। সবকিছুকেই যদি উগ্র গণতন্ত্র বলে চালানো হয় তবে আসল লক্ষ্যবস্তুই নাগালের বাইরে থেকে যাবে।

যাই হোক, কেন্দ্রীকতার ভিত্তি হল গণতন্ত্র। পার্টির মধ্যে যদি আলোচনা ও বিতর্কের অনুমতি না দেওয়া হয়, যদি বিভিন্ন মতামতগুলিকে সংগ্রহ করা ও বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে আলোচনার নিয়মিত ব্যবস্থা না থাকে, গণসংগঠনের প্রতিটি টুকিটাকি  ব্যাপারেই যদি অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ ঘটতে থাকে, তবে কেন্দ্রীকতা আমলাতন্ত্রে পর্যবসিত হবে।

আবার যদি সঠিক নীতিমালা না থাকে, যদি সময়মতো নেতৃত্ব দিতে না পারা যায়, যদি নিয়ম-কানুন না থাকে, কাজের যথাযথ ভাগবিন্যাস না থাকে, তাহলে কেন্দ্রীকতা ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না।

আর সবশেষে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, কেন্দ্রীকতা ও শৃঙ্খলা কার্যকরী করার বিষয়টি কর্মীবাহিনীর চোখে পার্টি নেতৃত্বের মর্যাদার সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। নীচুতলায় যদি ব্যাপক ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকে, যদি বিভ্রান্তি ও মতবিরোধ ব্যাপকভাবে বিরাজ করে, তবে তার মূল কারণ কিন্তু নেতৃত্বের মধ্যেই খুঁজতে হবে। পরিস্থিতি ও মার্কসবাদ-লেনিনবাদ সম্পর্কে নেতৃত্বের যদি ভালোরকম দখল না থাকে, তাঁদের জীবনধারা ও দৃষ্টিভঙ্গি যদি অবক্ষয়ী বুর্জোয়া সংস্কৃতির অনুসারী হয়, তাঁরা যদি বিনয়ী, ভদ্র ও কঠোর পরিশ্রমী না হন, যদি কর্মীবাহিনীর স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে না পারেন, তবে পার্টিতে নিছক উঁচুপদে থাকলেও তা কোনো কাজে লাগবে না। মূল নেতৃত্ব যদি পরিণত ও নিবেদিত প্রাণ হন এবং সেই মতো মর্যাদার উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত হন, তবে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। অন্যথায় ঐ ধরনের সমস্ত প্রচেষ্টাই হিতে বিপরীত হয়ে দেখা দেবে। অতএব, সমস্ত মতবিরোধকেই পার্টি-বিরোধী হিসাবে দেখলে চলবে না, আর প্রতিটি ক্ষেত্রেই সমস্যাকে শৃঙ্খলার শাসন ও তীব্র সমালোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করাও ঠিক নয়। আমার ধারণা, কিছু কিছু জায়গায় কিছু নেতা ও পার্টি কমিটি যথেষ্ট পরিমাণেই তাঁদের মর্যাদা হারিয়েছেন। এই সংহতকরণ অভিযানে আমাদের প্রাথমিকভাবে এই সমস্যার প্রতি নজর দিতে হবে। এটি কিন্তু কেন্দ্রীকতাকে দুর্বল করা নয়, এতে বরং কেন্দ্রীকতা শক্তিশালী হবে। আমি কেন্দ্রীকতার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করছি, কেননা অনেক নতুন কমরেড এর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবহিত নন এবং গুরুত্ব আরোপের আরও কারণ হল, এত বছর ধরে অনেক কষ্টসাধ্য পরিশ্রমের মাধ্যমে পার্টি যে কেন্দ্রীকতা গড়ে তুলেছে তাকে দুর্বল করে তুলতে আমাদের চারপাশে নৈরাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলি বদ্ধপরিকর। এছাড়াও, যে পার্টিকে কিছু কিছু এলাকায় চূড়ান্ত দমনপীড়নের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে এবং অন্যান্য অঞ্চলেও পরিস্থিতি যে কোনও সময়ে ঐ রকম হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেই পার্টির কাছে কেন্দ্রীকতা চূড়ান্তভাবেই গুরুত্বপূর্ণ।

৩। নীচুতলায় পার্টি সংগঠনগুলিকে সংহত করে তোলা প্রসঙ্গে

যথার্থভাবে বলতে গেলে, নীচুতলার পার্টি সংগঠনগুলি একেবারে বিশৃঙ্খল অবস্থায় রয়েছে। যাই হোক, আমাদের একটি কেন্দ্রীয় কমিটি ও কয়েকটি কেন্দ্রীয় বিভাগ রয়েছে। রাজ্য কমিটিগুলিও মোটামুটি নিয়মিতভাবে ও স্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করে। কিন্তু আঞ্চলিক ও তার নীচুতলার কমিটিগুলি এবং ইউনিট ও সেলগুলির প্রসঙ্গ এলেই দেখা যাবে যে সেখানে নিয়মিত ও স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে যথাযথ পার্টি ব্যবস্থার কোনো অস্তিত্ব নেই। নীচুতলায় যে বিভ্রান্তি ও নৈরাজ্য বিরাজ করে এই পরিস্থিতিই তার জন্য দায়ী এবং তা নেতৃত্বের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব, কয়েকজনের হাতে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন এবং গুটিকয়েক ব্যক্তির মাথা থেকেই সমস্ত সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসার উর্বর জমি তৈরি করে দেয়।

এই অবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কমিটি সরাসরি আঞ্চলিক কমিটিগুলির কাছে আহ্বান জানিয়েছে এবং তাদের অগ্রগতি সম্পর্কে পর্যায়কালীন রিপোর্ট সরাসরি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠাতে বলেছে। সংহতকরণের প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি জায়গায় পার্টি সেল, ইউনিট ও কমিটিগুলি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এখন তার মধ্যে অনেকগুলিই অকার্যকর হয়ে গেছে এবং কমরেডরা বুঝতে পারছেন যে এই কাজগুলি করা হয়েছিল অত্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে। অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কমরেডরা তাঁদের পদ্ধতির পরিবর্তন করছেন। বহু জায়গায় তাঁরা পার্টির সেল ও ইউনিট গঠনের সাথে সাথে অধ্যয়ন সংস্থাও গঠন করছেন। যাঁদের উপর ভিত্তি করে এই নীচু স্তরের পার্টি সংগঠনগুলি গড়ে উঠবে সেই সমস্ত সংগঠক ও মূল কমরেডদের গড়ে তোলার উপরই তাঁরা জোর দিচ্ছেন।

কলকারখানা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, অফিস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিতে পার্টি কমিটিগুলি গড়ে তোলার ব্যবস্থার তেমন উন্নতি ঘটেনি, আবার গণসংগঠনগুলির মধ্যে পার্টি কেন্দ্রগুলিকেও স্থিতিশীল করা যায়নি। শুধুমাত্র এলাকাভিত্তিক পার্টি কমিটিগুলির অস্তিত্বের ব্যবস্থা এখনও বিদ্যমান। নেতৃস্থানীয় ক্যাডাররা পার্টি গঠনের এই দিকটির উপর তেমন গুরুত্ব আরোপ করেন না এবং পুরোনো ধারা চলছেই। এর কারণ হল, আমাদের পার্টির কার্যকলাপের ক্ষেত্রে যে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে পার্টির কাজের যে বৈচিত্র্যপূর্ণ বিস্তার ঘটেছে অনেক কমরেডই তার সম্পূর্ণ তাৎপর্য এখনও অনুধাবন করতে পারেননি। পার্টির পুরোনো গড়ন দিয়ে আর সমগ্র কাজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সম্ভব নয় : হয় কাজের সমগ্র ধারা থেকে পার্টি বিচ্ছিন্ন থাকে অথবা কয়েকজন মাত্র নেতা সর্বত্র ছোটাছুটি করে নির্দেশ জারি করেন এবং অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ করতে থাকেন। পার্টির কর্মকাণ্ডের ব্যাপক অংশই এখন আইনি ক্ষেত্রের মধ্যে পড়ে এবং অনেক নতুন মানুষ পার্টির দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। পার্টি সংগঠনের পুরোনো ধাঁচার পক্ষে এই সমস্ত নতুন বিকাশগুলির সঙ্গে তাল রাখা সম্ভব নয়। নতুন কাঠামোর কেন্দ্রে থাকবে এক সম্পূর্ণ গোপন ও বেআইনি নিউক্লিয়াস, যার চারপাশে থাকবে পার্টি ইউনিট, সেল ও গোষ্ঠীর সুবিস্তৃত জাল, যাদের মধ্যে অনেকগুলিই কাজ করবে আধা-আইনি এবং এমনকি আইনি অবস্থায়। নীচুতলায় পার্টি সংগঠনগুলিকে শক্তিশালী করার অর্থ শুধু আরও অনেক কমিটি, ইউনিট ও সেল গঠন করা নয়; বরং তার অর্থ হল তাদের কাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও বিভিন্ন রূপের মধ্যে ঐ কাঠামোগুলিকে সক্রিয় ও কার্যকরী করে তোলা। এই বিষয়টি এতদিন সম্পূর্ণভাবে অবহেলা করা হয়েছে।

৪। বিশেষ এলাকায় কাজ কেন্দ্রীভূত করা প্রসঙ্গে

এখানে প্রশ্ন হল শুধু নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমানার মধ্যে কাজকে কেন্দ্রীভূত করার কথা বুঝলে চলবে না, বরং এক বিশেষ কাজের ধারাকে, বলা যায় ‘সচেতন কাজের এলাকাকে’ বুঝতে হবে। বেশিরভাগ রিপোর্টেই স্বতঃস্ফূর্ত কাজের ধারা, ঘটনাবলীর পিছনে ছোটার কথা বলা আছে। কোথাও মন্দির থেকে সোনাদানা চুরির ঘটনা, কোথাও দেখা যায় কাবেরীর জল বণ্টন নিয়ে একটি ইস্যু সামনে এসেছে, আর তখনই সে সব নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য ছোটাছুটি করা হয়। এই সমস্ত ঘটনাবলীর পিছনে দৌড়াদৌড়ি করা হয় এবং এই কাজের ধারার ভিত্তিতে যে কর্মীবাহিনী গড়ে উঠবে তারা হবে আংশিক চরিত্রের মরশুমি কর্মী। কোনো বড় ধরনের ঘটনা ঘটার পর তারা সক্রিয় হয়ে উঠবে। অন্য সময়ে তারা নিষ্ক্রিয় থাকবে।

‘কেন্দ্রীভূত কাজের এলাকাগুলিকে’ এক সুনির্দিষ্ট কাজের ধারার মডেল হিসাবে বিকশিত করতে হবে। সেখানে আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি থাকবে, কাজের এক দীর্ঘকালীন পরিপ্রেক্ষিত, কর্মনীতি ও কৌশল থাকবে, এমন কাজের ধারা অনুসরণ করা হবে যেখানে কর্মীবাহিনী দৈনন্দিন গণকার্যকলাপে যুক্ত থাকবেন। এই রকম পরিকাঠামো থাকলে আপনারা পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তনের মুখেও সময়োচিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারবেন।

অনেক রিপোর্টে আমি দেখেছি কর্মনীতি ও কাজের পরিকল্পনার কোনো উল্লেখ নেই। আপনাদের যদি কোনো কর্মনীতি থেকে থাকে, প্রথমত সেগুলি প্রয়োগের মাধ্যমে আপনারা কী অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন? দ্বিতীয়ত, এই অভিজ্ঞতা কি কর্মনীতির কোনো পরিবর্তনের দাবি জানায়? এই সমস্ত প্রশ্নে অনেক রিপোর্টই নীরব, আর এটিই আমাদের কাজের ধারার সব থেকে বড় ঘাটতি। অনেক জায়গায় হয় কোনো কর্মনীতি বা পরিকল্পনা ছিল না, বা থাকলেও শুধু কাগুজে থেকে গেছে। অন্ধভাবে কাজ করার অর্থ হল ভুল কর্মনীতির ভিত্তিতে কাজ করা। আপনাদের যদি কোনো সঠিক ও সচেতন কর্মনীতি না থাকে, তবে রয়েছে ভুল স্বতঃস্ফূর্ত কর্মনীতি, এবং এইভাবে চলার মধ্যে নিহিত বিপদ সম্পর্কেও আপনারা ওয়াকিবহাল থাকবেন না। একটি পার্টি কমিটির সংহতকরণ সব সময়েই তার কর্মনীতি, ঐ কর্মনীতির প্রয়োগ ও সেগুলির লাগাতার পর্যালোচনাকে ঘিরেই আবর্তিত হয়। নেতৃবৃন্দ এই দিকটির উপরও যথেষ্ট মনোযোগ দেননি। তাঁদের কাজ হল বিশেষ এলাকা বা ক্ষেত্রে কাজকে কেন্দ্রীভূত করা, কর্মনীতির বিকাশ ঘটানো, বিশেষ বিশেষ ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ করা এবং এই সমস্ত অভিজ্ঞতার আলোকে সমগ্র সংগঠনকে পরিচালিত করা।

৫। শ্রেণী ও বিভাগীয় সংগঠনগুলিকে শক্তিশালী করা প্রসঙ্গে

এই সমস্ত সংগঠনগুলির মাধ্যমেই পার্টি জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ জীবন্ত সম্পর্ক বজায় রাখে। এই সংগঠনগুলির কাজ হল জনগণের একেবারে প্রাথমিক দাবিগুলিকে তুলে ধরা, জনগণের সঙ্গে সংযোগকে নিয়তই বাড়িয়ে চলা।

আমরা লক্ষ্য করেছি যে রাজ্য স্তরের বা সর্বভারতীয় সংস্থা হিসাবে নিজেদের বিকশিত করতে গিয়ে এই সমস্ত সংগঠনগুলি তাদের গতিময়তা অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলে এবং তৃণমূল স্তরে জনগণের সঙ্গে তাদের সংযোগ অনেক শিথিল হয়ে পড়ে। আংশিক চরিত্রের সংগ্রামগুলিকে তৎক্ষণাৎ রাজনৈতিক সংগ্রামে পরিণত করার আমাদের অতি উৎসাহের ফলে ঐ সমস্ত সংগঠনগুলিকে বহু জায়গায় গণরাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিকল্পরূপে পরিণত করা হয়েছে। একদিকে শ্রেণী ও বিভাগীয় সংগঠনগুলি এবং অন্যদিকে গণ-রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে সঠিক আন্তসম্পর্ক বজায় রাখা উভয়ের বিকাশের পক্ষেই গুরুত্বপূ্র্ণ। উভয়েরই সক্রিয়ভাবে উভয়কে সাহায্য করা উচিত, কিন্তু একটি সংগঠন অন্য সংগঠনের ভূমিকা পালন করবে না। গণরাজনৈতিক সংগঠনকে যেখানে প্রথমে জাতীয় স্তরে শক্তিশালী করে তোলার পর রাজ্য স্তরে শক্তিশালী করতে হবে, সেখানে শ্রেণী ও বিভাগীয় সংগঠনগুলিকে সর্বপ্রথম ও সর্বাগ্রে শক্তিশালী করতে হবে স্থানীয় ও আঞ্চলিক স্তরে এবং তারপর রাজ্য বা জাতীয় স্তরে।

(১৯৮৪-৮৫ সালে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পার্টি স্কুলে সমাপ্তি ভাষণের অংশবিশেষ। লিবারেশন, মার্চ ১৯৮৬ থেকে)

শুদ্ধিকরণ আন্দোলনের পর কেন্দ্রীয় পার্টি স্কুল একই লক্ষ্যে অগ্রগতির আরও একটি ধাপকে সূচিত করছে। সেই সময়ে আমরা নানা ধরনের ভুল ও বিচ্যুতিগুলিকে শুধরে তোলার প্রশ্নেই বেশি মাথা ঘামাতাম, এই প্রক্রিয়ায় অনেক বিতর্ক সামনে উঠে আসে, পার্টি লাইনের গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ হয়, আর এই সমস্ত বিতর্ককেই পরে একটা পর্যায়ে সারসংকলন করা হয় ‘পার্টি লাইন সম্পর্কে বিতর্ক’-এর মধ্যে দিয়ে। এখন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মধ্যেকার বিতর্কগুলিকে এক নতুন স্তরে উন্নিত করার প্রচেষ্টা আমরা নিচ্ছি। নতুনভাবে উঠে আসা প্রশ্নগুলিকে কেন্দ্র করে পুরোদস্তুর খোলা মনে অধ্যয়ন এবং এই সমস্ত প্রশ্নগুলিকে ধরে প্রাণবন্ত বিতর্ক চালানোর জন্য আমরা উদ্যোগী হয়েছি। আর সেজন্যই আপনাদের কাছে প্রশ্নমালা পাঠানো হয়েছিল অনেকাংশেই প্ররোচনামূলক ভঙ্গিমায়। এমনভাবেই তা করা হয়েছিল যাতে আপনারা নতুন করে ভাবতে বাধ্য হন। অবশ্য গভীর গবেষণা চালানোর পর, প্রশ্নগুলিকে নতুনভাবে যাচাই করে আপনি হয়তো আগেকার সূত্রায়নেই এসে পৌঁছলেন। কিন্তু আমরা যদি এখান থেকে শুরু করি যে যেহেতু নতুন সূত্রায়নগুলি পার্টি লাইনের উপর ‘আক্রমণ’ তাই তা খারিজ করা উচিত, তবে আর এগোনো যাবে না। কার্যত ঐ ধরনের ভুল মনোভাবকে ঝেড়ে না ফেললে, নতুন তত্ত্বগত সাফল্য নিয়ে আসা কখনই সম্ভবপর নয়। তাই আপনাদের কাছে পেশ করা নতুন সূত্রায়নগুলি গুরুত্বপূর্ণ এবং আসল মতামত হিসাবেই পাঠানো হয়েছিল। ফলে আপনারা নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছেন। আর আপনাদের জমা দেওয়া কিছু উত্তরপত্রই দেখিয়ে দেয় যে আপনাদের প্ররোচিত করার যে প্রচেষ্টা আমাদের ছিল তা কাজ দিয়েছে। বেশ কিছু নতুন চিন্তা ও ধ্যানধারণা এসেছে, যদিও তা চূড়ান্ত রূপ নিতে পারেনি।

অতীতে আমাদের পার্টিতে এমন কয়েকজন উঁচু মাপের বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী ছিলেন যারা অবিভক্ত সিপিআই এবং সিপিআই(এম)-এর দিনগুলি থেকে আন্তঃপার্টি সংগ্রাম চালানোয় রীতিমতো অভিজ্ঞ ছিলেন। পরবর্তীতে, হয় তারা শহীদ হয়ে যান অথবা ধাক্কার পর মূল স্রোত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। আজ, আমরা যারা পার্টিকে পুনর্গঠিত করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি তাদের মধ্যে আমাদের আন্দোলনের সেই গৌরবময় অতীতের কোনো দিকপাল আর নেই। তাই, হাতে কলমে কাজ করেন এমন ক্যাডারদের মধ্যে থেকেই নতুন এক তাত্ত্বিক বাহিনী গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ আমাদের নিতে হচ্ছে। অবশ্য, এই প্রক্রিয়ায় এহেন তাত্ত্বিকদের পুনরায় আত্মপ্রকাশ ঘটবে, ভারতবর্ষে কোনোদিনই মহান ব্যক্তিত্বদের প্রাদুর্ভাব ঘটেনি, কিন্তু এখন তাত্ত্বিক অগ্রগতি ঘটানোর দায়িত্ব এসে পড়েছে আমাদের মতো ব্যবহারিক ক্যাডারদের কাঁধে। যেহেতু আমাদের সকলকেই হাত কলমে কাজ করতে হয়, ব্যবহারিক দায়দায়িত্ব দিনের পর দিন ক্রমাগতই বাড়তে থাকবে। আর যেহেতু আমাদের পার্টি এখনও তরুণদের পার্টি হয়ে রয়েছে, আমাদের শক্তিকে আরও উজাড় করে দিতে হবে। বিপুল অনাবিষ্কৃত সম্ভাবনাগুলিকে অবশ্যই পুরোমাত্রায় কাজে লাগাতে হবে। একইসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবহারিক কাজকর্ম করার সাথে সাথে বেশি বেশি তাত্ত্বিক কাজকর্ম করার দায়িত্ব নিতে হবে। বর্তমানের বস্তুগত পরিস্থিতি আমাদের কাছে এই দাবি জানাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হল, আমাদের দিক থেকে তত্ত্বগত ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটানোর বিরাট প্রয়োজনীয়তা আসছে কোথা থেকে? আপনারা জানেন যে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মধ্যে অন্য কোনো গোষ্ঠীই তাদের সমগ্র কর্মীবাহিনী, ক্যাডার ও নেতাদের সামিল করিয়ে পার্টি গঠনের কাজকে এক সচেতন প্রক্রিয়া হিসাবে গুরুত্ব সহকারে হাতে নেয়নি। ফলে ফাঁকা ময়দানে সিপিআই(এম)-ই এখনও একমাত্র সবচেয়ে সংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে টিকে আছে। এর বিপরীতে, আমরা নিজেদের শৃঙ্খলাপরায়ন, ঐক্যবদ্ধ, সর্বভারতীয় চরিত্রসম্পন্ন এক গণপার্টি হিসাবে গড়ে তোলার কঠোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আর এই প্রশ্নে এবং জঙ্গী বিপ্লবী সংগ্রামের দিক থেকে অন্য সব কমিউনিস্ট বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলির তুলনায় আমাদের অনেক বেশি সাফল্য ও অনুকূল শক্তিগুলি রয়েছে। কিন্তু আজকের ভারতকে যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক সমস্যাগুলির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, আমরা যদি সে সব শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে না পারি, যদি না সেই প্রশ্নগুলির সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে পাই তবে এ সমস্ত প্রচেষ্টা ও শর্তগুলি বিফলে যাবে। এই প্রশ্নেই আমরা সংগঠিত উদ্যোগ নেওয়া শুরু করেছি যাতে তৃতীয় শিবিরের পক্ষ থেকে, সিপিআই(এমএল)-এর তরফ থেকে সিপিআই(এম)-এর কাছে আমরা ছুড়ে দিতে পারি এক শক্তিশালী তত্ত্বগত চ্যালেঞ্জ।

আর এ সবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভারতবর্ষে সিপিআই(এম)-এর মধ্যে আরও একটি বড় ধরনের ভাঙ্গনের সম্ভাবনা রয়েছে। নেতৃত্ব সহ কর্মীবাহিনীর এই ভাঙ্গনের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একথা ঠিক যে, সিপিআই(এম) হল এক মৃতপ্রায় শক্তি। তবে পৃথিবীতে কোনো বস্তুই চূড়ান্তভাবে মৃত নয়। সুতরাং হতেই পারে যে, সিপিআই(এম) যে সমস্ত বহুমুখী সংঘাত, চাপ ও ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে চলেছে, তা শেষমেষ বাড়তে থাকবে এবং এমনই এক পরিণতিতে পৌঁছাবে যখন মুমূর্ষু পার্টির ভেতর থেকে জীবন্ত অংশটি ঐক্যবদ্ধ হতে এগিয়ে আসবে, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের জীবন্ত অংশের সঙ্গে কোনো না কোনো রূপে সংযুক্ত হয়ে পড়বে। অন্যদিকে, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের কিছু কিছু অংশ আর এগোতে না পেরে অধঃপতিত হবে। সর্বভারতীয় স্তরে নানা ধরনের উদ্যোগ এবং গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগত প্রশ্নে শাণিত আক্রমণ চালিয়ে আমাদেরই অগ্রগতি ঘটানোর শর্ত সৃষ্টি করতে হবে। তাত্ত্বিক বাহিনী গড়ে তোলার সময়ে এই পরিপ্রেক্ষিত কখনই ভুলে গেলে চলবে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে তাত্ত্বিকরা পার্টি স্কুল থেকে তৈরি হন না। একমাত্র কঠোর শ্রমের মধ্যে দিয়েই তারা উঠে আসেন। অদম্য প্রত্যয়ের উপর ভর করেই প্রখ্যাত মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা নিজেদের তাত্ত্বিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। কয়েকজন বাদে, বেশিরভাগ বিপ্লবী তাত্ত্বিক নেতারই তেমন বিশেষ ধরনের উজ্জ্বল শিক্ষাগত প্রেক্ষাপট ছিল না। অন্যদিক থেকে পার্টি স্কুলের এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে। নিজের অধ্যয়নের তুলনায় স্কুলের উপরই অত্যধিক নির্ভরতার মনোভাব শুরু হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে নিজে অধ্যয়ন করাই আসল ব্যাপার। এক তাত্ত্বিক হিসাবে যদি আপনি সত্যিই নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, তাহলে আপনি তাই-ই করবেন। পার্টি স্কুলে আপনার থাকা না থাকায় কিছুই আসে যায় না। তাত্ত্বিক অগ্রগতি ঘটাতে কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়ায় নিজস্ব অধ্যয়ন এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব – এগুলিই হচ্ছে নিয়ামক শর্ত। এগুলিই হল আসল বিষয়।

(লিবারেশন, ডিসেম্বর ১৯৭৯ থেকে)

বর্তমানে আমাদের সামনে যে কর্তব্য হাজির হয়েছে তা হল কিছুটা নতুন পরিস্থিতিতে পার্টিকে গঠন করা। পরিস্থিতির এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে বোঝার জন্য আমাদের পার্টির গড়ে ওঠার ইতিহাসের এক সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা জরুরি। পার্টি গঠনের শুরুতে আমরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের বুনিয়াদী নীতিমালাগুলির প্রশ্নে দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়েছিলাম এবং সংশোধনবাদের প্রভাব থেকে হাজার হাজার অগ্রণী কর্মীবাহিনীকে আমাদের দিকে জয় করে নিতে সমর্থ হয়েছিলাম। সেই সময়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে যে পুরোনো রূপের সংগ্রামগুলি প্রচলিত ছিল পার্টি সেগুলিকে প্রত্যাখ্যান করে এবং বিপ্লবের অগ্রগতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নতুন রূপের সংগ্রামগুলির বিকাশ ঘটানোর চেষ্টা চালিয়েছিল। পার্টি বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্ন মাত্রায় জনগণকে বিপ্লবী সংগ্রামে সমাবেশিত করেছিল।

কিন্তু তখনও বেশ ভালো সংখ্যক মানুষ সংশোধনবাদী দলগুলির প্রভাবে থেকে যায়। কয়েক বছর পর, আমাদের নিজস্ব কর্মীবাহিনীর মধ্যেই বিভ্রান্তি ও বিভাজন দেখা দেয় এবং পার্টি তার ঐক্যবদ্ধ সর্বভারতীয় চরিত্র হারিয়ে ফেলে। মূলত আঞ্চলিক ও রাজ্যভিত্তিতে ভালো সংখ্যক গোষ্ঠীগুলি মাথাচাড়া দেয়। কেবলমাত্র কয়েকটি রাজ্যেই পার্টির বিপ্লবী শাখাগুলি সংগঠিত থাকতে পারে। সাম্প্রতিককালে যখন সর্বভারতীয় স্তরে পার্টির কর্মীবাহিনীকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা শুরু হল, প্রথম পর্বে সুবিধাবাদীরাই বাজিমাৎ করল। অবশ্য, কেন্দ্রীয় কমিটি শুদ্ধিকরণ আন্দোলন চালানো ও সঠিক কৌশল গ্রহণ করার ফলে আমরা ক্রমে ক্রমে উদ্যোগ ফিরে পেতে শুরু করি। এখন দ্বিতীয় পর্বে, পরিস্থিতি কী রকম? সুবিধাবাদীদের মধ্যে স্পষ্টতই ভাঙ্গন ঘটছে এবং একমাত্র আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি সিপিআই(এমএল)-এর দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ কেন্দ্র হিসাবে উঠে এসেছে। এই কেন্দ্রীয় কমিটি এক সর্বভারতীয় চরিত্র পেয়েছে এবং দৃঢ়ভাবে সশস্ত্র সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।

স্বাভাবিকভাবেই সর্বত্রই পার্টি কর্মীরা এই কেন্দ্রের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছেন। জনগণের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এখন অনেক বিস্তৃত এবং বিভিন্ন জায়গায় এখন হাজার হাজার মানুষ আমাদের সঙ্গে এগোচ্ছেন। কিন্তু এখনও বিভিন্ন রঙের সুবিধাবাদী ও সংশোধনবাদীদের প্রভাবাধীনেই ব্যাপক জনগণ রয়ে গেছেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে শাসক শ্রেণীগুলি যখন গুরুতর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি এবং তারা যখন জনগণের সঙ্গে সম্মুখ সমরের দিকে এগিয়ে চলেছে, সংশোধনবাদীরা তখন দ্রুতই উন্মোচিত হয়ে পড়ছে।

কাজেই সংশোধনবাদীদের ব্যাপক গণভিত্তিকে আমাদের পক্ষে জয় করে নেওয়ার মতো অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের সর্বভারতীয় পার্টি সম্মেলন (১৯৭৯) সঠিকভাবেই আমাদের নির্দেশ করেছে যে, অগ্রণীবাহিনীর সংগ্রামের পরিবর্তে শত শত বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাজার হাজার মানুষকে সমবেত করে জোর দিতে হবে তুলনামূলকভাবে আরও ব্যাপক জনসমাবেশের উপর, ন্যূনতম পক্ষে দশ-বিশ হাজার এবং তাকে আরও বাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে লক্ষাধিক তা তার দশ-বিশ গুণে। (তুলনামূলকভাবে কম সংখ্যক মানুষকে সমাবেশিত করার দিকটি ছিল আমাদের অতীত সংগ্রামগুলির বৈশিষ্ট্য। এখানে এটি উল্লেখ্য যে, বিপ্লবী সংগ্রামের বিকাশের প্রক্রিয়ায় এই অবস্থা ছিল অনিবার্য। আমাদের দৃষ্টিকোণ হল, জনগণের চেতনার বিষয়টি সংগ্রামের বিভিন্ন স্তরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই দৃষ্টিকোণ সেই সমস্ত গোষ্ঠীর দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা যারা ‘জনগণ’, কথাটি বলা ছাড়া কখনই মুখ খোলে না, কিন্তু বাস্তবে গণভিত্তিশূন্য বুদ্ধিজীবীদের ক্ষুদে চক্র মাত্র। আমাদের দৃষ্টিকোণ সেই সমস্ত গোষ্ঠীর থেকেও ভিন্ন যারা সাময়িভাবে ভালো সংখ্যক জনগণকেই সংস্কারের সংগ্রামে এমনভাবে সমাবেশিত করে যা আদতে জনগণের বিপ্লবী চেতনাকেই ভোঁতা করে দেয়।) এর জন্য বুনিয়াদী নীতিমালা সম্পর্কে মতাদর্শগত সংগ্রাম ও প্রচারই যথেষ্ট নয়। আমাদের ব্যাপকতম জনগণের আরও কাছাকাছি যেতে হবে, তাদের মানসিকতাকে বুঝতে হবে, তাদের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং তাঁরা যাতে নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে উপলব্ধিতে পৌঁছতে পারেন তার জন্য ধৈর্য্য সহকারে তাঁদের সাহায্য করে যেতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘বাম’ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। আমাদের সামনে যে কর্তব্যকর্ম রয়েছে তার জন্য সমগ্র পার্টিকে সমাবেশিত করতে হলে পার্টির অভ্যন্তরে বাম বুলিসর্বস্বতার বিরোধিতা অবশ্যই করতে হবে, যা সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়।