(১৯৮৪-৮৫ সালে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পার্টি স্কুলে সমাপ্তি ভাষণের অংশবিশেষ। লিবারেশন, মার্চ ১৯৮৬ থেকে)

শুদ্ধিকরণ আন্দোলনের পর কেন্দ্রীয় পার্টি স্কুল একই লক্ষ্যে অগ্রগতির আরও একটি ধাপকে সূচিত করছে। সেই সময়ে আমরা নানা ধরনের ভুল ও বিচ্যুতিগুলিকে শুধরে তোলার প্রশ্নেই বেশি মাথা ঘামাতাম, এই প্রক্রিয়ায় অনেক বিতর্ক সামনে উঠে আসে, পার্টি লাইনের গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ হয়, আর এই সমস্ত বিতর্ককেই পরে একটা পর্যায়ে সারসংকলন করা হয় ‘পার্টি লাইন সম্পর্কে বিতর্ক’-এর মধ্যে দিয়ে। এখন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মধ্যেকার বিতর্কগুলিকে এক নতুন স্তরে উন্নিত করার প্রচেষ্টা আমরা নিচ্ছি। নতুনভাবে উঠে আসা প্রশ্নগুলিকে কেন্দ্র করে পুরোদস্তুর খোলা মনে অধ্যয়ন এবং এই সমস্ত প্রশ্নগুলিকে ধরে প্রাণবন্ত বিতর্ক চালানোর জন্য আমরা উদ্যোগী হয়েছি। আর সেজন্যই আপনাদের কাছে প্রশ্নমালা পাঠানো হয়েছিল অনেকাংশেই প্ররোচনামূলক ভঙ্গিমায়। এমনভাবেই তা করা হয়েছিল যাতে আপনারা নতুন করে ভাবতে বাধ্য হন। অবশ্য গভীর গবেষণা চালানোর পর, প্রশ্নগুলিকে নতুনভাবে যাচাই করে আপনি হয়তো আগেকার সূত্রায়নেই এসে পৌঁছলেন। কিন্তু আমরা যদি এখান থেকে শুরু করি যে যেহেতু নতুন সূত্রায়নগুলি পার্টি লাইনের উপর ‘আক্রমণ’ তাই তা খারিজ করা উচিত, তবে আর এগোনো যাবে না। কার্যত ঐ ধরনের ভুল মনোভাবকে ঝেড়ে না ফেললে, নতুন তত্ত্বগত সাফল্য নিয়ে আসা কখনই সম্ভবপর নয়। তাই আপনাদের কাছে পেশ করা নতুন সূত্রায়নগুলি গুরুত্বপূর্ণ এবং আসল মতামত হিসাবেই পাঠানো হয়েছিল। ফলে আপনারা নতুনভাবে চিন্তা করতে বাধ্য হয়েছেন। আর আপনাদের জমা দেওয়া কিছু উত্তরপত্রই দেখিয়ে দেয় যে আপনাদের প্ররোচিত করার যে প্রচেষ্টা আমাদের ছিল তা কাজ দিয়েছে। বেশ কিছু নতুন চিন্তা ও ধ্যানধারণা এসেছে, যদিও তা চূড়ান্ত রূপ নিতে পারেনি।

অতীতে আমাদের পার্টিতে এমন কয়েকজন উঁচু মাপের বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী ছিলেন যারা অবিভক্ত সিপিআই এবং সিপিআই(এম)-এর দিনগুলি থেকে আন্তঃপার্টি সংগ্রাম চালানোয় রীতিমতো অভিজ্ঞ ছিলেন। পরবর্তীতে, হয় তারা শহীদ হয়ে যান অথবা ধাক্কার পর মূল স্রোত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। আজ, আমরা যারা পার্টিকে পুনর্গঠিত করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছি তাদের মধ্যে আমাদের আন্দোলনের সেই গৌরবময় অতীতের কোনো দিকপাল আর নেই। তাই, হাতে কলমে কাজ করেন এমন ক্যাডারদের মধ্যে থেকেই নতুন এক তাত্ত্বিক বাহিনী গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ আমাদের নিতে হচ্ছে। অবশ্য, এই প্রক্রিয়ায় এহেন তাত্ত্বিকদের পুনরায় আত্মপ্রকাশ ঘটবে, ভারতবর্ষে কোনোদিনই মহান ব্যক্তিত্বদের প্রাদুর্ভাব ঘটেনি, কিন্তু এখন তাত্ত্বিক অগ্রগতি ঘটানোর দায়িত্ব এসে পড়েছে আমাদের মতো ব্যবহারিক ক্যাডারদের কাঁধে। যেহেতু আমাদের সকলকেই হাত কলমে কাজ করতে হয়, ব্যবহারিক দায়দায়িত্ব দিনের পর দিন ক্রমাগতই বাড়তে থাকবে। আর যেহেতু আমাদের পার্টি এখনও তরুণদের পার্টি হয়ে রয়েছে, আমাদের শক্তিকে আরও উজাড় করে দিতে হবে। বিপুল অনাবিষ্কৃত সম্ভাবনাগুলিকে অবশ্যই পুরোমাত্রায় কাজে লাগাতে হবে। একইসঙ্গে অনেক বেশি ব্যবহারিক কাজকর্ম করার সাথে সাথে বেশি বেশি তাত্ত্বিক কাজকর্ম করার দায়িত্ব নিতে হবে। বর্তমানের বস্তুগত পরিস্থিতি আমাদের কাছে এই দাবি জানাচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হল, আমাদের দিক থেকে তত্ত্বগত ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ঘটানোর বিরাট প্রয়োজনীয়তা আসছে কোথা থেকে? আপনারা জানেন যে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মধ্যে অন্য কোনো গোষ্ঠীই তাদের সমগ্র কর্মীবাহিনী, ক্যাডার ও নেতাদের সামিল করিয়ে পার্টি গঠনের কাজকে এক সচেতন প্রক্রিয়া হিসাবে গুরুত্ব সহকারে হাতে নেয়নি। ফলে ফাঁকা ময়দানে সিপিআই(এম)-ই এখনও একমাত্র সবচেয়ে সংগঠিত, শৃঙ্খলাবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে টিকে আছে। এর বিপরীতে, আমরা নিজেদের শৃঙ্খলাপরায়ন, ঐক্যবদ্ধ, সর্বভারতীয় চরিত্রসম্পন্ন এক গণপার্টি হিসাবে গড়ে তোলার কঠোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছি। আর এই প্রশ্নে এবং জঙ্গী বিপ্লবী সংগ্রামের দিক থেকে অন্য সব কমিউনিস্ট বিপ্লবী গোষ্ঠীগুলির তুলনায় আমাদের অনেক বেশি সাফল্য ও অনুকূল শক্তিগুলি রয়েছে। কিন্তু আজকের ভারতকে যে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক সমস্যাগুলির সম্মুখীন হতে হচ্ছে, আমরা যদি সে সব শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে না পারি, যদি না সেই প্রশ্নগুলির সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে পাই তবে এ সমস্ত প্রচেষ্টা ও শর্তগুলি বিফলে যাবে। এই প্রশ্নেই আমরা সংগঠিত উদ্যোগ নেওয়া শুরু করেছি যাতে তৃতীয় শিবিরের পক্ষ থেকে, সিপিআই(এমএল)-এর তরফ থেকে সিপিআই(এম)-এর কাছে আমরা ছুড়ে দিতে পারি এক শক্তিশালী তত্ত্বগত চ্যালেঞ্জ।

আর এ সবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভারতবর্ষে সিপিআই(এম)-এর মধ্যে আরও একটি বড় ধরনের ভাঙ্গনের সম্ভাবনা রয়েছে। নেতৃত্ব সহ কর্মীবাহিনীর এই ভাঙ্গনের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একথা ঠিক যে, সিপিআই(এম) হল এক মৃতপ্রায় শক্তি। তবে পৃথিবীতে কোনো বস্তুই চূড়ান্তভাবে মৃত নয়। সুতরাং হতেই পারে যে, সিপিআই(এম) যে সমস্ত বহুমুখী সংঘাত, চাপ ও ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে চলেছে, তা শেষমেষ বাড়তে থাকবে এবং এমনই এক পরিণতিতে পৌঁছাবে যখন মুমূর্ষু পার্টির ভেতর থেকে জীবন্ত অংশটি ঐক্যবদ্ধ হতে এগিয়ে আসবে, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের জীবন্ত অংশের সঙ্গে কোনো না কোনো রূপে সংযুক্ত হয়ে পড়বে। অন্যদিকে, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের কিছু কিছু অংশ আর এগোতে না পেরে অধঃপতিত হবে। সর্বভারতীয় স্তরে নানা ধরনের উদ্যোগ এবং গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগত প্রশ্নে শাণিত আক্রমণ চালিয়ে আমাদেরই অগ্রগতি ঘটানোর শর্ত সৃষ্টি করতে হবে। তাত্ত্বিক বাহিনী গড়ে তোলার সময়ে এই পরিপ্রেক্ষিত কখনই ভুলে গেলে চলবে না।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে তাত্ত্বিকরা পার্টি স্কুল থেকে তৈরি হন না। একমাত্র কঠোর শ্রমের মধ্যে দিয়েই তারা উঠে আসেন। অদম্য প্রত্যয়ের উপর ভর করেই প্রখ্যাত মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা নিজেদের তাত্ত্বিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। কয়েকজন বাদে, বেশিরভাগ বিপ্লবী তাত্ত্বিক নেতারই তেমন বিশেষ ধরনের উজ্জ্বল শিক্ষাগত প্রেক্ষাপট ছিল না। অন্যদিক থেকে পার্টি স্কুলের এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিতে পারে। নিজের অধ্যয়নের তুলনায় স্কুলের উপরই অত্যধিক নির্ভরতার মনোভাব শুরু হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে নিজে অধ্যয়ন করাই আসল ব্যাপার। এক তাত্ত্বিক হিসাবে যদি আপনি সত্যিই নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন, তাহলে আপনি তাই-ই করবেন। পার্টি স্কুলে আপনার থাকা না থাকায় কিছুই আসে যায় না। তাত্ত্বিক অগ্রগতি ঘটাতে কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়ায় নিজস্ব অধ্যয়ন এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব – এগুলিই হচ্ছে নিয়ামক শর্ত। এগুলিই হল আসল বিষয়।