(কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষে লেখা শুদ্ধিকরণ আন্দোলনের প্রথম সার্কুলার। লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৭৮ থেকে)

সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, মুৎসুদ্দি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদের প্রতিনিধি প্রতিক্রিয়াশীল ভারত সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের ব্যাপক ভারতীয় জনতার সংযুক্ত মোর্চা গড়ে তুলতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্তব্য সম্পাদনের জন্য আমাদের পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে এবং সশস্ত্র সংগ্রামকে সুদৃঢ় গণভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য পার্টির ভিতরে ও বাইরে সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে জোরদার করতে হবে। সংশোধনবাদ আমাদের পার্টির উপর আক্রমণ চালিয়েছে দক্ষিণ ও বাম দুদিক থেকেই। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এই বছরে সমগ্র পার্টিতে শুদ্ধিকরণ আন্দোলন চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই অভিযান চালিয়ে আমাদের পার্টিকে এক নতুন চেহারা প্রদান করতে হবে এবং সশস্ত্র সংগ্রামে এই বছরের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে হবে এবং আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সমগ্র ভারতবর্ষের পরিস্থিতিকে পাল্টে দিতে হবে।

এই শুদ্ধিকরণ আন্দোলনে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে চিন্তার পদ্ধতির ও কাজের রীতির শুদ্ধিকরণ।

দার্শনিক ফ্রন্টে – এই ফ্রন্টে আমাদের কাজ হল অধিবিদ্যা ও ভাববাদের বিরোধিতা করা এবং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। ‘এক ভেঙ্গে দুই’ চেয়ারম্যানের দ্বান্দ্বিক ধারণা। দুই বিপরীত দিক যেহেতু পরস্পরকে বহিষ্কার করে তাই তাদের মিলিয়ে এক করার চেষ্টা অবশ্যই সুবিধাবাদ, কিন্তু দুই বিপরীত দিক যেহেতু পরস্পর পরিপূরক তাই তাদের ঐক্যকে আমাদের মাথায় রাখতে হবে। এটাই চেয়ারম্যানের ‘দুটি দিকের তত্ত্ব’ যা আমাদের একপেশেপনার বিরুদ্ধে সতর্ক করে। ‘এক ভেঙ্গে দুই’ এবং ‘দুটি দিকের তত্ত্ব’ – এই দুই হল বিপরীতের ঐক্য। দৃষ্টান্তস্বরূপ সঠিক লাইন ও বেঠিক লাইনকে মিলিয়ে একটা লাইন হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা সুবিধাবাদ। কিন্তু অন্য দিকে একটি সঠিক লাইনকে আমাদের গোঁড়ামির দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে তার আজকের দিক এবং বিকাশমান দিক উভয়কেই মাথায় রাখতে হবে। এই দুটি দিকের ঐক্য একটি সঠিক লাইন গঠন করে।

মতাদর্শগত ফ্রন্টে – মার্কসবাদীরা শ্রেণীসংগ্রামের নামে নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণের বিরোধিতা করে। মার্কসবাদীদের কাছে শ্রেণীসংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্য হল সর্বহারা একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা ও তাকে শক্তিশালী করা। পার্টি হল শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রণী বাহিনী যা জনগণের শ্রেণীসংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান করে। শ্রেণীসংগ্রামে জনগণকে সক্রিয় করে তুলতে হবে এবং পার্টি তাতে নেতৃত্ব প্রদান করবে। যে লাইন জনতাকে সক্রিয় করতে পারে না তা কখনই সঠিক হতে পারে না। আমাদের পার্টি গ্রামাঞ্চলে যে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করছে সেই গেরিলা যুদ্ধ হল শ্রেণীসংগ্রামের উন্নত রূপ, আর এই শ্রেণীসংগ্রামের লক্ষ্যই হল গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক কৃষক জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বিপ্লবী কৃষক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা ও তাকে সুদৃঢ় করা। কমরেড চারু মজুমদারের এই দৃষ্টিকোণকে আমাদের দৃঢ়ভাবে আয়ত্ত করতে হবে। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এই বছরেই কমরেড জহরের সংকলিত রচনাবলী প্রকাশ করেছে। এই রচনাবলী গভীর মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করলে আমরা এ সম্পর্কে সংশোধনবাদী মহাদেব চক্রের দৃষ্টিকোণকে খণ্ডন করতে পারব এবং কমরেড চারু মজুমদারের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দৃষ্টিকোণকে আয়ত্ত করতে পারব। মতাদর্শগতভাবে পার্টিকে গড়ে তোলার জন্য মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও সে তুঙ চিন্তাধারা অধ্যয়ন করা ও মার্কসবাদী অবস্থান, দৃষ্টিকোণ এবং পদ্ধতিকে আয়ত্ত করা অবশ্য কর্তব্য। শুদ্ধিকরণ আন্দোলনে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মৌলিক নীতিগুলিকে আয়ত্ত করার জন্য অধ্যয়ন করতে কমরেডদের বিশেষভাবে উৎসাহিত করতে হবে।

কাজের রীতির শুদ্ধিকরণের প্রশ্নে – চেয়ারম্যান মাও-এর কাজের রীতির মূল কথা “তথ্য থেকে সত্যের সন্ধান”। কমরেড চারু মজুমদার সমস্ত সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বদাই অনুসন্ধান ও অনুশীলনের উপর জোর দিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, “জনগণের কাছ থেকে শেখা, এটা খুবই কঠিন কাজ। মনগড়া ধারণা নিয়ে চলাও সংশোধনবাদের দান”। আমাদের এই কাজের রীতিকে আয়ত্ত করে সৃজনশীলভাবে পার্টির লাইনকে প্রয়োগ করতে হবে।

কমরেড চারু মজুমদার আমাদের সর্বদাই গণ-লাইন অনুসরণ করতে বলেছেন। তিনি আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, “পার্টি সভ্যদের প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক প্রচারকে উন্নত করার প্রচেষ্টায় রত থাকতে হবে এবং এ কাজ আমরা করতে চাইব তখনই যখন আমরা দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের চিন্তাভাবনাগুলি বুঝতে শিখব এবং গণ-লাইনের প্রচারের ভিতর দিয়ে তাদের সাথে একাত্ম হতে পারব। প্রতি স্তরে পার্টি নেতৃত্বের দায়িত্ব পার্টির গণ-লাইনকে কতখানি উন্নত করা যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা এবং পার্টি সভ্যদের এই প্রচারে শিক্ষিত করে তোলা।” কমরেড চারু মজুমদারের নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছুই চাপিয়ে দেওয়া চলবে না, সংগ্রামের জন্য কৃষক জনতার সচেতন উদ্যোগের অপেক্ষা করতে হবে, নির্দিষ্ট এলাকাগুলিতে শ্রেণীবিশ্লেষণ, অনুসন্ধান ও অনুশীলনের সাহায্যে প্রতিটি অংশের মানুষের চিন্তা ও ইচ্ছাকে যাচাই করতে হবে। আর এই প্রক্রিয়ায় ক্রমাগত গণ-লাইনকে উন্নত করতে হবে।

আমাদের পার্টির গণতান্ত্রিক কাজের রীতি ও গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে হবে। এ প্রসঙ্গে কমরেড চারু মজুমদারের নির্দেশ হল, “আমরা কোনো কাজই নির্দেশ দিয়ে করি না। আমাদের সমস্ত কাজ হবে নিম্নতর ইউনিটের সাথে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এবং কাজের তাৎপর্য বুঝিয়ে। তাই আমাদের পার্টিতে উচ্চতর ইউনিটের দায়িত্ব হচ্ছে নিম্নতর ইউনিটের সঙ্গে সর্বদা আলাপ-আলোচনা চালানো এবং তাদের মতামত সংগ্রহ করা। এই পথেই পার্টি তার বিপ্লবী কর্মক্ষমতা বাড়াতে পারে ও পার্টি ঐক্য দৃঢ় হয়। চেয়ারম্যান মাও আমাদের শিখিয়েছেন যে প্রত্যেকটি কমিউনিস্টকে সর্বদাই অহমিকা ও দম্ভের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। কারণ অহমিকা ও দম্ভ সমস্ত কমিউনিস্ট গুণাবলী শেষ করে দেয়।” তিনি আরও বলেছেন, “পার্টি সভ্যদের মতামত দেওয়ার ও সমালোচনা করার পুরো গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে হবে। পার্টির কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পার্টি সভ্যদের অনেক ক্ষেত্রেই অভিযোগ আছে। এই অভিযোগগুলি প্রকাশ করার ও আলোচনা করার পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে হবে। তাহলেই পার্টির কর্মকর্তারা তাদের দুর্বলতাকে সংশোধন করতে সমর্থ হবেন।” পার্টির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতা সম্পর্কে কমরেড চারু মজুমদার বলেছেন, “অনেক বিপ্লবী বুলির সাথে অনেকে এ প্রশ্নও তুলেছেন যে কেন্দ্রীয় কমিটিকে মানি, কিন্তু অন্য কোনো কমিটিকে মানি না। বামপন্থী বুলির খোলস থাকা সত্ত্বেও এ ঝোঁক বুর্জোয়া স্বতন্ত্রবাদী ঝোঁক, অতএব সংশোধনবাদী ঝোঁক। বিপ্লবী নেতৃত্বে পরিচালিত পার্টির গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতাকে ক্ষুণ্ণ করার যে কোনো প্রচেষ্টা প্রতিক্রিয়াশীলদেরই শক্তিশালী করে এবং বিপ্লবী সংগ্রামের ক্ষতিসাধন করে।”

বিভিন্ন স্তরের পার্টি কমিটিগুলিকে নিজেদের এলাকায় এই আন্দোলন চালানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কেন্দ্রীয় এবং অন্যান্য স্তরের নেতৃস্থানীয় কমরেডদের নিজেদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে নির্দিষ্ট অঞ্চলের নির্দিষ্ট ইউনিটগুলিতে এই আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হবে। এই অভিযানের অগ্রগতির নিয়মিত রিপোর্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে অবশ্যই পাঠাতে হবে এবং মডেল অভিজ্ঞতাগুলিকে সমগ্র এলাকার, অঞ্চলের, রাজ্যের ও দেশের সমস্ত পার্টি সংগঠনগুলিতে ছড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পার্টির মধ্যে সংশোধনবাদী চক্রগুলি এই আন্দোলন পরিচালনায় বাধা দিয়ে অতীতে আমাদের পার্টি ও সশস্ত্র সংগ্রামের প্রভূত ক্ষতিসাধন করেছে, কাজেই এই আন্দোলন পরিচালনা পার্টিকে শক্তিশালী করা ও সশস্ত্র সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পূর্বশর্ত।