(ডিসেম্বর ১৯৯২-এ পঞ্চম পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

চতুর্থ পার্টি কংগ্রেসে আমরা আমাদের কয়েকটি কর্মনীতির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসার কথা ভেবেছিলাম এবং সাথে সাথে পার্টি কাঠামোর প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ঘটানোর সিদ্ধান্তও নিয়েছিলাম। আমাদের কমরেডদের একাংশ অবশ্য অন্যরকম ভেবেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল – কোনো রকম পুনর্গঠনেই পার্টিতে আর নতুন জীবন সঞ্চারিত করা সম্ভব নয়। কমিউনিস্ট পার্টিকে বিদায় দিয়ে তাই গড়তে হবে একটা গণতান্ত্রিক পার্টি, খুব বেশি হলে একটি উদারনৈতিক বামপন্থী সংগঠন। “এর নাম যদি বিলোপবাদ হয়ে থাকে তাহলে এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিপ্লবের যুগে ইতিমধ্যে দুনিয়ার প্রায় সব কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে তার বীজ বোনা হয়ে গেছে” – বললেন বিলোপবাদের এক প্রবক্তা। তিনি ঠিকই বলেছেন। সত্যিই তা ছিল বিলোপবাদ এবং গর্বাচেভীয় সংস্কারের প্রভাবে তা আন্তর্জাতিক আকারই নিয়ে ফেলেছিল।

ইউরোপে, বিশেষত পূর্ব ইউরোপে অনেক কমিউনিস্ট পার্টিই দল ভেঙে দেওয়া অথবা নিজেদেরকে সমাজগণতান্ত্রিক পার্টিতে রূপান্তরিত করতে শুরু করেছিল। আর, সিপিএসইউ-র পতনের পর ঘটনা চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। সিপিসি-র পক্ষে তা রোধ করা সম্ভব হয় কেবলমাত্র এক বিরাট সামাজিক আলোড়নের মূল্য দিয়ে এবং ইতালিয়ান ও অন্য কয়েকটি পার্টি ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত বিভাজনের শিকার হয়।

বিলোপবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রামও যথেষ্ট ঝড় তোলে। চতুর্থ কংগ্রেসের আগে কেন্দ্রীয় কমিটির এক বৈঠকে পার্টিকে তুলে দেওয়ার ধারণাটি প্রথম উঠে আসে। কিন্তু বিতর্কটি চতুর্থ কংগ্রেসে উঠে আসেনি এবং কংগ্রেসের পরও বেশ কিছু সময় পর্যন্ত বিলোপবাদীরা কোনো সামগ্রিক রাজনৈতিক বিতর্ক থেকে সন্তর্পণে সরেই ছিলেন। বিলোপবাদের মূল প্রবক্তা যখন নিঃশব্দে পার্টি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেন তখন অন্য কিছু লোক সেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পার্টি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়িয়ে গোপনে ষড়যন্ত্রমূলক কায়দায় পার্টির কর্মীবাহিনীর মধ্যে বিভ্রান্তির বীজ বপন শুরু করেন। মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের নিন্দা, পুঁজিবাদের প্রশংসা, বিপ্লবী সংগ্রামকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করা এবং সংস্কারের ললিতবাণী প্রচার করতে সরকারি বা আধা-সরকারি সংস্থায় নিজেদের ভবিষ্যত খুঁজে নেওয়ার ভিতর দিয়ে পরবর্তীতে তাদের সকলকেই খোলাখুলি আত্মপ্রকাশ করতে হয়।

প্রথমত এই সংগ্রাম সমাজতন্ত্রের বিরাট সংকট ও তার সাথে সাথে মার্কসবাদের উপর বুর্জোয়াদের সার্বিক আক্রমণের মধ্যে আমাদের দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করেছে। ভারতবর্ষে আমাদের পার্টিই সবচেয়ে জোরের সঙ্গে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে, তার সুরক্ষায় ও পুনরুজ্জীবনে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে এগিয়ে এসেছে।

এই সংগ্রামের ফলে আমরা পার্টির মধ্যে মার্কসবাদী শিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ও পার্টি সংগঠনকে পুনর্গঠিত ও পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হয়েছি। গতিরুদ্ধতা ভেঙ্গে পার্টি সভ্য সংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধির এক পর্যায় শুরু হয়।

এই সংগ্রামের ফলে আমরা বামপন্থার স্বাধীন উত্থানের পতাকাকে দৃঢ়ভাবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে, প্রধান ধারার সুবিধাবাদী বামপন্থীদের লেজুড়বৃত্তির বিরোধিতা করতে ও ভারতের বাম আন্দোলনের দুই কৌশলের মধ্যকার লড়াইকে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হই। সেই সঙ্গে নীতির ক্ষেত্রে সমঝোতা না করেও ধাপে ধাপে আন্দোলনের ময়দানে মূল ধারার বাম পার্টিগুলির সঙ্গে আমাদের যে সহযোগিতা গড়ে ওঠে তাতে বিভিন্ন পার্টি ও গোষ্ঠীর বামপন্থী কর্মীবাহিনীর উপর আমাদের রাজনৈতিক প্রভাবও বেড়ে ওঠে।

যদিও পার্টি বিলোপবাদের বিরুদ্ধে এক নির্ধারক প্রাথমিক বিজয় অর্জন করেছে তবু লড়াইয়ের শেষ এখনও বহু দূরে। বর্তমান মতাদর্শগত পরিবেশই বিলোপবাদী ধ্যানধারণার জন্ম ও বৃদ্ধির উর্বর জমি হিসাবে কাজ করছে। বিলোপবাদের অর্থ আসলে পার্টি মানসিকতার অবক্ষয় – যে অবক্ষয় কোনো বিমূর্ত জিনিস নয়, বরং তা নিহিত রয়েছে পার্টির বিপ্লবী নীতিমালা ও সুসংবদ্ধ সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে। এইসব নীতির ক্ষেত্রে সমঝোতা করলে ও পার্টিকে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় সংস্থা হিসাবে গণ্য করলে পার্টির লড়াই করার ক্ষমতাই দুর্বল হবে এবং কেন্দ্রবিমুখ প্রবণতা উৎসাহ পাবে।

বিলোপবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আর একটি ক্ষতিকারক প্রবণতা – নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে দুর্বল করবে – এই আশংঙ্কা সম্পূর্ণ অমূলক এবং তা আমাদের পার্টির বিবর্তন সম্পর্কে এক ভ্রান্ত ধারণারই পরিচায়ক। আমাদের পার্টির সমগ্র অনুশীলন সর্বদাই পরিচালিত হয়েছে আমাদের অতীত নৈরাজ্যবাদের অবশেষগুলিকে কাটিয়ে তোলা এবং আমাদের পার্টির কৌশলগত লাইনকে দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে আরও বেশি বেশি সঙ্গতিপূর্ণ করে তোলার লক্ষ্যে। কিন্তু একইসঙ্গে যদি বিলোপবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াই চালিয়ে না যাওয়া হয় তাহলে এই অনুশীলন শুধু পথভ্রষ্ট হতে পারে।

এই দুই ভুল প্রবণতার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে অধিবিদ্যকভাবে দেখলে এবং তাদের মধ্যে যান্ত্রিকভাবে সমন্বয় করতে চাইলে আমরা কোথাও পৌঁছাতে পারব না। বিলোপবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে পার্টির চিন্তাশীল একটা অংশের ভুল ভাবনার উৎস হচ্ছে ঠিক এই গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্রকে ধরতে না পারা। বাস্তব ঘটনা প্রমাণ করেছে যে বিলোপবাদের বিরুদ্ধে নির্ধারক লড়াই পার্টিকে নৈরাজ্যবাদের পথে ফিরিয়ে নিয়ে যায়নি। এটি বরং ব্যবহারিক রাজনীতির বিভিন্ন শাখায় আমাদের জোরালো প্রবেশ ঘটাতেই সাহায্য করেছে। কট্টর নৈরাজ্যবাদী বিশ্ব-দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন যে সমস্ত লোকজন নিজেদের শুধরে নিতে পারেননি, তাঁরা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ও বহু ক্ষেত্রে তাঁরা বিলোপবাদী শিবিরে যোগ দিয়েছেন। আগামীদিনে পার্টি ব্যবহারিক রাজনীতির ময়দানে সাহসের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাবে, আর তাই দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, পার্টি কাঠামোর মধ্যে বিলোপবাদের বিরুদ্ধে লাগাতার পাহারা চালিয়ে যাওয়ার আরও বেশি প্রয়োজন পড়বে।