(লিবারেশন সম্পাদকীয়, এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে)

এবারের ২২ এপ্রিল পার্টি তার ২৬তম বার্ষিকী উদযাপন করবে। নিশ্চিতভাবেই পার্টির মৌলিক নীতিমালা ও সাধারণ দিশার প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা পুনর্ঘোষণা করার এ এক উপযুক্ত সময়। কিন্তু আমরা যদি শুধুমাত্র এই ‘পুনর্ঘোষণা’র মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখি তাহলে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী নিছক এক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হবে। আমার মতে, আমাদের বৃদ্ধি কেন মন্থর, অসম এবং কখনও কখনও বিকৃতভাবে হচ্ছে তার পিছনকার কারণগুলি গভীর ও সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে খতিয়ে দেখার ওপরই আমাদের বেশি করে জোর দেওয়া উচিত।

আমাদের মতান্ধদের মতো আচরণ করা উচিত নয়, যারা নিজেদের অনুশীলনের লাগাতার পর্যালোচনা করতে অস্বীকার করে এবং প্রায় ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের মতোই আঁকড়ে ধরে থাকে পুরোনো ও বস্তাপচা সূত্রায়নগুলিকে। ভারতের নির্দিষ্ট অবস্থার সাথে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে একাত্ম করে নেওয়ার জীবন্ত প্রতিমূর্তি হিসাবেই পার্টি লাইনকে বিকশিত করে তুলতে আমরা শপথ নিয়েছি। এর জন্য প্রয়োজন কঠোর এক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে তাত্ত্বিক ধ্যানধারণাগুলি ব্যবহারিক পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়ে পরীক্ষিত ও প্রয়োজনমতো পরিবর্তিত হয়। মাও সে তুঙ বলেছেন, অনুশীলনই সত্যের একমাত্র মানদণ্ড। একথা এর থেকে জোর দিয়ে বলা যায় না।
তাছাড়া, বস্তুগত পরিস্থিতির বাস্তব মূল্যায়ন করা, নির্ভীকভাবে আত্মসমালোচনা করা আর কঠিনতম পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে ও তাকে পাল্টাতে সাহসী হওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে কমিউনিস্টদের শক্তি। আর এর জন্য তাদের কোনো কৃত্রিম মাদকের প্রয়োজন হয় না। কমিউনিজমের চূড়ান্ত লক্ষ্যের প্রতি তাঁদের নিষ্ঠা এবং মানবসমাজ চিরকাল সামনের দিকে এগিয়ে চলবে – এই দৃঢ় বিশ্বাস, এর থেকেই তাঁরা তাঁদের প্রাণশক্তি সঞ্চয় করেন। আমাদের একটি পার্টি মুখপত্রের সঙ্গে জড়িত এক কমরেডকে আমি সবসময়ই আমাদের সাফল্যগুলিকে সর্বোৎকৃষ্ট বলে তুলে ধরতে দেখতে পাই। সাদামাটা এক পার্টি সমাবেশের মধ্যে তিনি ফরাসী বিপ্লবের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। বহুবার চোখে আঙুল দিয়ে এটা আমি তাঁকে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি বোধহয় বিশ্বাস করেন যে পার্টি কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে হলে এই ধরনের কড়া দাওয়াই না হলে চলে না।

প্রতিবারই যখন নির্বাচন এগিয়ে আসে তখন কিছু কিছু লোক আকাশকুসুম সব স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সাম্প্রতিক বিহার নির্বাচনের সময় এক কমরেড তাঁর কেন্দ্রে জয় সুনিশ্চিত করার জন্য তিনি যে চমৎকার পরিকল্পনা নিয়েছেন তার কথা আমাকে শোনান। আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিই যে পার্টি কখনই তাঁকে যেন তেন প্রকারেণ জয় হাসিল করতে বলেনি। আমি বলি, আপনি যদি সম্মানজনক সংখ্যায় ভোট পান তাই-ই কি যথেষ্ট নয়? তাঁর অলীক আকাঙ্খায় আমার ঠাণ্ডা জল ঢেলে দেওয়া তিনি আদৌ পছন্দ করেননি। কিন্তু ফলাফল থেকে দেখা গেছে, কমরেডটি সম্মানজনক ভোট পেতেও ব্যর্থ হয়েছেন।

অন্ধ্র থেকে বিহার পর্যন্ত বর্তমান পর্যায়ে যে বিধানসভা নির্বাচনগুলি হয়ে গেল তার দিকে তাকিয়ে একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে নির্বাচন বয়কটের কৌশল (যাকে কোনো কোনো গোষ্ঠী এমনকি রণনীতির স্তরেও তুলে নিয়ে গেছে) সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই কৌশলকে মরীয়াভাবে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে তারা প্রথমে দুঃসাহসিকতাবাদের আশ্রয় নেয় এবং পরবর্তীকালে নিকৃষ্ট ধরনের সুবিধাবাদের শিকার হয়। এর বিপরীতে আমাদের পার্টি এক জোরদার নির্বাচনী প্রচারাভিযান সংগঠিত করে এবং বিহার বিধানসভায় অন্তত একটা শক্তিশালী কমিউনিস্ট গ্রুপকে পাঠাতে সক্ষম হয়। এটাই আমাদের সাফল্য।

কিন্তু বিহারের বহু জায়গায় তথা অন্ধ্র ও উড়িষ্যায় আমাদের ফলাফল খুব খারাপ হয়েছে। বহু কেন্দ্রে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা আমাদের কাজে দীর্ঘদিনকার স্থিতাবস্থা ও কোনো কোনো এলাকায় এমনকি আমাদের সামাজিক ভিত্তি ক্ষয় হওয়াও দেখিয়ে দিচ্ছে। এটা গভীর উদ্বেগের বিষয় ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় পার্টি সংগঠনের হাল সম্পর্কে বহু প্রশ্ন তুলে ধরে। কোনো কোনো এলাকায় পার্টি সংগঠনকে গোষ্ঠী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে দেখা গেছে আর সাধারণভাবে পার্টির আন্দোলনমুখী গণলাইনের জায়গা নিয়েছে প্রেরণাবিহীন গতানুগতিক কাজের রীতি। জনগণের থেকে বিচ্ছিন্নতা, তাদের দৈনন্দিন সংগ্রাম থেকে দূরে সরে থাকা এবং কোনো কোনো এলাকায় উদ্ধত ক্যাডারদের জনগণকে অবজ্ঞা করা ইত্যাদির জন্য আমাদের গণভিত্তির একেবারে কেন্দ্রস্থলেও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের অনুপ্রবেশের পথ প্রশস্ত হয়েছে। প্রচারের বাগাড়ম্বর বা সুবিধাবাদী আপোশ – এর কোনো কিছুই কখনই কঠোর-কঠিন গণকাজের বিকল্প হতে পারে না। ঐসব অঞ্চলের নির্বাচনী ফলাফলের দুর্বল চিত্রের মধ্যে তারই প্রতিচ্ছবি।

আপনার জনসমর্থন কত বিস্তৃত হচ্ছে তা পরিমাপ করার এক ভালো সূচক হচ্ছে নির্বাচন। তা একইসাথে আপনার মধ্যে কী মাত্রায় সুবিধাবাদ লুকিয়ে রয়েছে তাও দেখিয়ে দেয়।

নির্বাচনী ফলাফলের বিশ্লেষণ আমাদের সম্বিত ফেরাতে ও আমাদের দুর্বল জায়গাগুলি চিহ্নিত করতে সহায়তা করেছে। গোটা পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত করা, পার্টি জুড়ে এক নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করা ও সজীব এক গণলাইন অনুসরণ করার জন্য সংশোধনের ব্যবস্থা নেওয়ার এটাই প্রকৃষ্ট সময়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রস্তাবিত সাংগঠনিক সম্মেলন বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়েছে, যে সম্মেলনে আমরা এই ধরনের সাংগঠনিক সমস্যাবলীর কার্যকরী মোকাবিলা করতে চাই। তবু সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা ও জনগণের সাথে বিচ্ছিন্নতার প্রশ্নের মধ্যেও একটা রাজনৈতিক-কৌশলগত দিক রয়েছে এবং সেটি মনে হয় গুরুত্বপূর্ণ। দেশে প্রগতিশীল রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার যে ধরন-ধারণ ক্রমশ গড়ে উঠছে তার বিষয়বস্তু দলিত, পশ্চাদপদ ও ধর্মীয় তথা জাতীয় সংখ্যালঘুদের আত্মঘোষণা। পার্টির দিক থেকে এই প্রশ্নে সক্রিয় কোনো কমিউনিস্ট কৌশল সূত্রায়িত করা এখনও সম্ভব হয়নি।

যুক্তমোর্চার অনুশীলনের প্রশ্নে, আইপিএফ যেমন একটা সম্পৃক্ত অবস্থার মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল, নীচুতলাবাদী আন্দোলনের ব্যাপক অংশের সাথে আমাদের রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও তেমনই এখনও নির্দিষ্ট কোনো ফসল এনে দিতে পারেনি। এইচএমকেপি, সমতা পার্টি, এসইউসিআই বা অনুরূপ বাম গোষ্ঠীগুলির সাথে আমরা যে রাজনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলাম তার কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যত আছে বলে মনে হচ্ছে না। গণসংগঠনসমূহের মঞ্চকেও রাজনৈতিক সহযোগিতার স্তরে উন্নীত করা যায়নি এবং তা আজ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। পশ্চিমবাংলায় নয়া আর্থিক নীতি অনুসরণ ও বিহারে জনতা দল সরকারের বশ্যতা স্বীকারকে কেন্দ্র করে সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর সাথে আমাদের সম্পর্ক আরও সংঘাতময় হয়েছে।

এভাবে আমাদের পার্টি দ্বৈত কর্তব্যের সম্মুখীন হয়েছে – নিজস্ব শ্রেণীভিত্তিকে সংহত করা ও তার সাথে সাথে বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে নিজেদের সমর্থনভিত্তিকে প্রসারিত করা। এর জন্য প্রয়োজন, আমাদের চোখের সামনে দিয়ে যে সামাজিক আলোড়ন ঘটে চলেছে সে সম্পর্কে এক সক্রিয় প্রত্যুত্তর সূত্রবদ্ধ করা এবং বাম ও গণতান্ত্রিক শিবিরের মধ্যেকার গণভিত্তিসম্পন্ন মিত্রশক্তিগুলোর সাথে রাজনৈতিক সহযোগিতা গড়ে তোলা।

আমাদের সামনে যে জাতীয় দৃশ্য উঠে আসছে তাতে আগামী লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতা দখলের জন্য কংগ্রেস(ই) ও বিজেপির মধ্যে মধ্যে এক মহারণের নিশ্চিত আভাস পাওয়া যাচ্ছে। দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর উভয়েরই জয়ের পরিকল্পনাকে বানচাল করে দিতে পারে এমন সম্ভাবনাময় কোনো তৃতীয় ফ্রন্ট এখনও গড়ে ওঠেনি। আমরা কংগ্রেস(ই)-র বিরুদ্ধে বিজেপির সাথে হাত মেলাতে পারি না বা বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেস(ই)-কেও সমর্থন করতে পারি না। অবশ্য জাতীয় স্তরে কোনো তৃতীয় ফ্রন্ট যদি গড়ে ওঠে তাহলে তাকে আমরা পূর্ণ সমর্থন জানাব। এ ধরনের একটা ফ্রন্টের সাথে আমাদের সম্পর্ক ঠিক কী হবে তা বলে দেওয়া এ মুহূর্তে খুবই কঠিন। আর সিপিআই(এম) যেভাবে জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে আমাদের সামনে আসার বাধা সৃষ্টি করে চলেছে তাতে কাজটা আরও বেশি জটিল হয়ে পড়েছে।

জাতীয় রাজনীতিতে কার্যকরী ভূমিকা নেওয়ার উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সমগ্র পার্টিকে অবশ্যই নিজেকে ও জনগণের সাথে তার সম্পর্ককে পুনর্গঠিত করার ওপর সমস্ত প্রচেষ্টা কেন্দ্রীভূত করতে হবে।

এবারের ২২ এপ্রিল উৎসর্গীকৃত হোক আন্তরিক আত্মানুসন্ধানে ও পার্টি সংগঠনের পুনরুজ্জীবনে।