বুর্জোয়া ও সর্বহারা বুর্জোয়া বলতে অাধুনিক পুঁজিপতি শ্রেণী বোঝায়, যারা সামাজিক উৎপাদনের উপায়গুলোর মালিক এবং মজুরি-শ্রমের নিয়োগকর্তা। সর্বহারা হল অাজকালকার মজুরি-শ্রমিকরা, উৎপাদনের উপায় নিজেদের হাতে না থাকার দরুন যারা বেঁচে থাকার জন্য স্বীয় শ্রমশক্তি বেচতে বাধ্য হয়। (১৮৮৮ সালের ইংরাজি সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা)

আজ পর্যন্ত যত সমাজ দেখা গেছে তাদের সকলের ইতিহাস শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস।অর্থাৎ সমগ্র লিখিত ইতিহাস। ১৮৪৭ সালে সমাজের প্রাগিতিহাস (pre-history), লিখিত ইতিহাসের পূর্ববর্তী কালের সামাজিক সংগঠনের বিবরণ প্রায় অজ্ঞাতই ছিল। তারপরে, হাকস্তহাউজেন রুশদেশে জমির উপর যৌথ মালিকানা অাবিষ্কার করেন, মাউরার প্রমাণ করেন, সকল টিউটনিক জাতির ইতিহাস শুরু হয় এই সামাজিক ভিত্তি থেকে, ক্রমে ক্রমে দেখা গেল যে ভারত থেকে অায়ার্ল্যান্ড পর্যন্ত সর্বত্র গ্রাম গোষ্ঠীই (village communities) সমাজের অাদি রূপ ছিল কিংবা রয়েছে। গোত্রের (gens) অাসল প্রকৃতি এবং উপজাতির (tribe) সঙ্গে তার সম্পর্ক বিষয়ে মর্গানের চূড়ান্ত অাবিষ্কার এই অাদিম সাম্যবাদী ধরনের সমাজের ভিতরকার সংগঠনের বিশিষ্ট রূপটি খুলে ধরল। এই অাদিম গোষ্ঠীগুলো ভেঙে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমাজ ভিন্ন ভিন্ন এবং শেষপর্যন্ত পরস্পর বিরোধী শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়তে থাকে। এই ভাঙনের ধারাটা অনুসরণের অামি চেষ্টা করেছি অামার পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি গ্রন্থটিতে দ্বিতীয় সংস্করণ, স্তুতগার্ত, ১৮৮৬। (১৮৮৮ সালের ইংরাজি সংস্করণ ও ১৮৯০ সালের জার্মান সংস্করণে (যাতে শেষ বাক্যটি বাদ থাকে) এঙ্গেলসের টীকা।

স্বাধীন মানুষ ও দাস, প্যাট্রিশিয়ান এবং প্লিবিয়ান, জমিদার ও ভূমিদাস, গিল্ডকর্তা গিল্ডকর্তা, অর্থাৎ গিল্ড সঙ্ঘের পূর্ণ সদস্য, গিল্ডের অন্তর্ভুক্ত কর্তা, উপরিস্থিত প্রভু নয়। (১৮৮৮ সালের ইংরাজি সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা) আর কারিগর, এক কথায় অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত শ্রেণী সর্বদাই পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে থেকেছে, অবিরাম লড়াই চালিয়েছে, কখনও আড়ালে কখনও বা প্রকাশ্যে; প্রতিবার এ লড়াই শেষ হয়েছে গোটা সমাজের বিপ্লবী পুনর্গঠনে অথবা দ্বন্দ্বরত শ্রেণীগুলোর সকলের ধ্বংসপ্রাপ্তিতে।

ভূতপূর্ব ঐতিহাসিক যুগগুলোতে প্রায় সর্বত্র আমরা দেখি সমাজে বিভিন্ন বর্গের একটা জটিল বিন্যাস, সামাজিক পদমর্যাদার নানাবিধ ধাপ। প্রাচীন রোমে ছিল প্যাট্রিশিয়ান, যোদ্ধা (kinghts), প্লিবিয়ান এবং ক্রীতদাসেরা; মধ্যযুগে ছিল সামন্ত প্রভু, অনু-সামন্ত (vassals), গিল্ডকর্তা, কারিগর, শিক্ষানবিশ কারিগর এবং ভূমিদাস। এইসব শ্রেণীর প্রায় প্রত্যেকটির মধ্যে আবার অভ্যন্তরীণ স্তরভেদ।

সামন্ত সমাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে আধুনিক যে বুর্জোয়া সমাজ জন্ম নিয়েছে তার মধ্যে শ্রেণীবিরোধ শেষ হয়ে যায়নি। এ সমাজ শুধু প্রতিষ্ঠা করেছে নতুন শ্রেণী, অত্যাচারের নতুন অবস্থা, পুরাতনের বদলে সংগ্রামের নতুন ধরন।

আমাদের যুগ অর্থাৎ বুর্জোয়া যুগের কিন্তু এই একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে : শ্রেণীবিরোধ এতে সরল হয়ে এসেছে। গোটা সমাজ ক্রমেই দুটি বিশাল শত্রুশিবিরে ভাগ হয়ে পড়ছে, ভাগ হচ্ছে পরস্পরের সম্মুখীন দুই বিরাট শ্রেণীতে – বুর্জোয়া এবং সর্বহারা।

মধ্যযুগের ভূমিদাসদের ভিতর থেকে প্রথম শহরগুলোর স্বাধীন নাগরিকদের (chartered burghers) উদ্ভব হয়। এই নাগরিগদের মধ্য থেকে আবার বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রথম উপাদানগুলো বিকশিত হল।

আমেরিকা আবিষ্কার ও আফ্রিকা প্রদক্ষিণে উঠতি বুর্জোয়াদের সামনে নতুন দিগন্ত খুলে গেল। পূর্ব ভারত ও চীনের বাজার, আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপন, উপনিবেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য বিনিময় ব্যবস্থার তথা সাধারণভাবে পণ্যের সংখ্যাবৃদ্ধি বাণিজ্যে, 'নৌযাত্রায়', শিল্পে দান করে অভূতপূর্ব একটা উদ্যোগ এবং তদ্দ্বারা টলায়মান সামন্ত সমাজের অভ্যন্তরস্থ বিপ্লবী অংশগুলোর জন্য এনে দেয় দ্রুত একটা বিকাশ।

সামন্ত শিল্প-ব্যবস্থায় শিল্পোৎপাদনের একচেটিয়া ক্ষমতা ছিল গণ্ডিবদ্ধ গিল্ডগুলোর হাতে, নতুন বাজারের চাহিদার পক্ষে তা আর পর্যাপ্ত নয়। তার জায়গায় এল হস্তশিল্প কারখানা। কারখানাজীবী মধ্য শ্রেণী ঠেলে সরিয়ে দিল গিল্ডকর্তাদের। বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট গিল্ডের মধ্যেকার শ্রমবিভাগ মিলিয়ে গেল একই কারখানার ভেতরকার শ্রমবিভাগের সামনে।

এদিকে বাজার বাড়তেই থাকে, চাহিদা বাড়তে থাকে। হস্তশিল্প কারখানাতেও আর কুলাল না। অতঃপর বাষ্প ও কলের যন্ত্রে বিপ্লবী পরিবর্তন ঘটল শিল্পোৎপাদনে। হস্তশিল্প কারখানার জায়গা নিল অতিকায় আধুনিক শিল্প, শিল্পজীবী মধ্য শ্রেণীর জায়গা নিল শিল্পজীবী লাখপতি, এক একটা গোটা শিল্পবাহিনীর হর্তাকর্তা, আধুনিক বুর্জোয়া।

আমেরিকা আবিষ্কার যার পথ পরিষ্কার করে, সেই বিশ্ববাজার প্রতিষ্ঠা করেছে আধুনিক শিল্প। এ বাজারের ফলে বাণিজ্য, নৌযাত্রা, স্থলপথ যোগাযোগের প্রভূত বিকাশ ঘটেছে। সে বিকাশ আবার প্রভাবিত করেছে শিল্প প্রসারকে, এবং যে অনুপাতে শিল্প, বাণিজ্য, নৌযাত্রা ও রেলপথের প্রসার, সেই অনুপাতেই বিকশিত হয়েছে বুর্জোয়া, বাড়িয়ে তুলেছে তার পুঁজি, মধ্যযুগ থেকে আগত সমস্ত শ্রেণীকেই পিছনে ঠেলে দিয়েছে।

এইভাবে দেখা যায় যে আধুনিক বুর্জোয়া শ্রেণীটা একটা দীর্ঘ বিকাশ ধারার ফল, উৎপাদন ও বিনিময় পদ্ধতির ক্রমান্বয় বিপ্লবের পরিণতি।

বিকাশের পথে বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে সমানে চলেছিল সে শ্রেণীর রাজনৈতিক অগ্রগতি। এই যে বুর্জোয়ারা ছিল সামন্ত প্রভুদের আমলে একটা নিষ্পেষিত শ্রেণী; মধ্যযুগের কমিউনে ইতালি ও ফ্রান্সের শহরবাসীরা তাদের সামন্ত প্রভুদের হাত থেকে অাত্মশাসনের প্রাথমিক অধিকার কিনে অথবা কেড়ে নেওয়ার পর নিজেদের নগর-সমাজের এই নাম দিয়েছিল। (১৮৯০ সালের জার্মান সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা) [para] ফ্রান্সে নবোদ্ভূত শহরগুলো সামন্ত মনিব ও প্রভুদের কাছ থেকে স্থানীয় স্বশাসন ও রাজনৈতিক অধিকার অাদায় করে 'তৃতীয় মণ্ডলী' (Third Estate) রূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অাগেই 'কমিউন' নাম গ্রহণ করে। মোটামুটি বলা চলে যে বুর্জোয়া শ্রেণীর অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষেত্রে এখানে ইংল্যান্ডকে অাদর্শ দেশ ধরা হয়েছে, রাজনৈতিক বিকাশের বেলা ফ্রান্সকে। (১৮৮৮ সালের ইংরাজি সংস্করণে এঙ্গেলসের টীকা) যারা দেখা দেয় একটা সশস্ত্র ও স্বশাসিত সংঘ রূপে; কোথাও বা স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক নগর-রাষ্ট্র (যেমন ইতালি ও জার্মানিতে), আবার কোথাও বা রাজতন্ত্রের করদাতা 'তৃতীয় মণ্ডলী' রূপে (যেমন ফ্রান্সে); অতঃপর হস্তশিল্প পদ্ধতির প্রকৃত পর্বে যারা আধা-সামন্ততান্ত্রিক বা নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের কাজে লাগে অভিজাতবর্গকে দাবিয়ে রাখার ব্যাপারে, এবং বস্তুত সাধারণভাবে যারা ছিল বৃহৎ রাজতন্ত্রের স্তম্ভরূপ, সেই বুর্জোয়া শ্রেণী অবশেষে আধুনিক যন্ত্রশিল্প ও বিশ্ববাজার প্রতিষ্ঠার পর আজকালকার প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রের মধ্যে নিজেদের জন্য পরিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব অর্জন করতে পেরেছে। আধুনিক রাষ্ট্রের শাসকমণ্ডলী হল সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণীর সাধারণ কাজকর্ম ব্যবস্থাপনার একটা কমিটি মাত্র।

ইতিহাসের দিক থেকে বুর্জোয়াশ্রেণী খুবই বিপ্লবী ভূমিকা নিয়েছে।

বুর্জোয়াশ্রেণী যেখানেই প্রাধান্য পেয়েছে, সেখানেই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক ও অনাবিল সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে। যেসব বিচিত্র সামন্ত বাঁধনে মানুষ বাঁধা ছিল তার 'স্বভাবসিদ্ধ ঊর্ধ্বতন'দের কাছে, তা এরা ছিঁড়ে ফেলেছে নির্মমভাবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের নগ্ন আত্মস্বার্থের 'নগদ টাকার' বন্ধন ছাড়া অন্য কোনো বন্ধনই এরা রাখেনি। আত্মসর্বস্ব হিসাবনিকাশের বরফজলে এরা ডুবিয়ে দিয়েছে ধর্ম-উন্মাদনার স্বর্গীয় ভাবোচ্ছ্বাস, শৌর্যবৃত্তির উৎসাহ ও কুপমণ্ডুক ভাবালুতা। লোকের ব্যক্তি-মূল্যকে এরা পরিণত করেছে বিনিময় মূল্যে, অগণিত অনস্বীকার্য সনদবদ্ধ স্বাধীনতার স্থানে এরা এনে খাড়া করল ওই একটিমাত্র নির্বিচার স্বাধীনতা – অবাধ বাণিজ্য। এককথায়, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভ্রমে যে শোষণ এতদিন ঢাকা ছিল, তার বদলে এরা এনেছে নগ্ন, নির্লজ্জ, সাক্ষাৎ, পাশবিক শোষণ।

মানুষের যেসব বৃত্তিকে লোকে এতদিন সম্মান করে এসেছে, সশ্রদ্ধ বিস্ময়ের চোখে দেখেছে, বুর্জোয়াশ্রেণী তাদের মাহাত্ম্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। চিকিৎসাবিদ, আইনবিশারদ, পুরোহিত, কবি, বিজ্ঞানী – সকলকেই এরা পরিণত করেছে তাদের মজুরি-ভোগী শ্রমজীবী রূপে।

বুর্জোয়াশ্রেণী পরিবারপ্রথা থেকে তার ভাবালু ঘোমটাটাকে ছিঁড়ে ফেলেছে, পারিবারিক সম্বন্ধকে পরিণত করেছে একটা নিছক আর্থিক সম্পর্কে।

মধ্যযুগে শক্তির যে পাশবিক প্রকাশকে প্রতিক্রিয়াপন্থীরা এতটা মাথায় তোলে, তারই যোগ্য পরিপূরক হিসাবে চূড়ান্ত অলসতার নিষ্ক্রিয়তা কী করে সম্ভব হয়েছিল তা বুর্জোয়াশ্রেণীই ফাঁস করে দেয়। এরাই প্রথম দেখিয়ে দিল মানুষের উদ্যমে কী হতে পারে। এদের আশ্চর্য কীর্তি মিশরের পিরামিড, রোমের পয়ঃপ্রণালী এবং গথিক গির্জাকে বহুদূর ছাড়িয়ে গেছে। এদের পরিচালিত অভিযান অতীতের সকল জাতির দেশান্তর যাত্রা (Exoduses) ও ধর্মযুদ্ধকে (crusades) ম্লান করে দিয়েছে।

উৎপাদনের উপকরণসমূহে অবিরাম বিপ্লবী বদল না এনে, এবং ফলত উৎপাদন সম্পর্কে ও সেই সঙ্গে সমস্ত সামাজিক সম্পর্কে বিপ্লবী বদল না ঘটিয়ে বুর্জোয়াশ্রেণী বাঁচতে পারে না। অপরদিকে অতীতের শিল্পজীবী সকল শ্রেণীর বেঁচে থাকার প্রথম শর্তই ছিল সাবেকী উৎপাদন পদ্ধতির অপরিবর্তিত রূপটা বজায় রাখা। আগেকার সকল যুগ থেকে বুর্জোয়া যুগের বৈশিষ্ট্যই হল উৎপাদনে অবিরাম বিপ্লবী রূপান্তর, সমস্ত সামাজিক অবস্থার অনবরত পরিবর্তন, চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তা এবং এক টালমাটাল অবস্থা। অনড় জমাট সব সম্পর্ক ও তার আনুষঙ্গিক সমস্ত সনাতন শ্রদ্ধাভাজন কুসংস্কার ও মতামতকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়, নবগঠিত সম্পর্কগুলো জমাট বাঁধার আগেই অচল হয়ে আসে। যা কিছু শক্তপোক্ত তাই যেন বাতাসে মিলিয়ে যায়, যা পবিত্র তা হয়ে ওঠে পার্থিব, শেষপর্যন্ত মানুষ বাধ্য হয় তার জীবনের আসল অবস্থা এবং অপরের সঙ্গে তার সম্পর্কটাকে খোলা চোখে দেখতে।

নিজেদের প্রস্তুত মালের জন্য অবিরত বর্ধমান এক বাজারের তাগিদ বুর্জোয়া শ্রেণীকে সারা পৃথিবীময় দৌড় করিয়ে বেড়ায়। সর্বত্র তাদের ঢুকতে হয়, সর্বত্র গেড়ে বসতে হয়, যোগসূত্র স্থাপন করতে হয় সর্বত্র।

বুর্জোয়াশ্রেণী বিশ্ববাজারকে কাজে লাগাতে গিয়ে প্রতিটি দেশেরই উৎপাদন ও উপভোগে একটা বিশ্বজনীন চরিত্র দান করেছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্ষুব্ধ করে তারা শিল্পের পায়ের তলা থেকে কেড়ে নিয়েছে সেই জাতীয় ভূমিটা যার ওপর শিল্প আগে দাঁড়িয়েছিল। সমস্ত সাবেকী জাতীয় শিল্প হয় ধ্বংস পেয়েছে নয় প্রত্যহ ধ্বংস পাচ্ছে। তাদের স্থানচ্যুত করছে এমন নতুন নতুন শিল্প যার প্রচলন সকল সভ্য জাতির পক্ষেই মরা-বাঁচা প্রশ্নের সামিল; এমন শিল্প যা শুধু দেশজ কাঁচামাল দিয়ে নয় দূরতম অঞ্চল থেকে আনা কাঁচামালে কাজ করছে; এমন শিল্প যার উৎপাদন শুধু স্বদেশেই নয় ভূলোকের সর্বাঞ্চলেই ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশজ উৎপন্নে যা মিটত তেমন সব পুরনো চাহিদার বদলে দেখছি নতুন চাহিদা, যা মেটাতে দরকার সুদূর দেশ-বিদেশের ও নানা আবহাওয়ার উৎপন্ন। আগেকার স্থানীয় ও জাতিগত বিচ্ছিন্নতা ও স্বয়ম্ভরতার বদলে পাচ্ছি সর্বক্ষেত্রেই আদান-প্রদান, জাতিসমূহের বিশ্বজোড়া পরস্পর নির্ভরশীলতা। বৈষয়িক উৎপাদনে যেমন, তেমনই মনীষার ক্ষেত্রেও। এক একটা জাতির মানসিক সৃষ্টি হয়ে পড়ে সকলের সম্পত্তি। জাতিগত একপেশেমি ও সংকীর্ণচিত্ততা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ে; অসংখ্য জাতীয় বা স্থানীয় সাহিত্য থেকে জেগে ওঠে একটা বিশ্বসাহিত্য।

সকল উৎপাদন-যন্ত্রের দ্রুত উন্নতি ঘটিয়ে যোগাযোগের অতি সুবিধাজনক উপায় মারফত বুর্জোয়ারা সভ্যতায় টেনে আনছে সমস্ত, এমনকি অসভ্যতম জাতিকেও। যে জগদ্দল কামান দেগে সে সমস্ত চীনা-প্রাচীর চূর্ণ করে, অসভ্য জাতিদের অতি একরোখা বিজাতি-বিদ্বেষকে বাধ্য করে আত্মসমর্পণে তা হল তার পণ্যের শস্তা দর। সকল জাতিকে সে বাধ্য করে বুর্জোয়া উৎপাদন-পদ্ধতি গ্রহণে, অন্যথায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে; বাধ্য করে সেই বস্তু গ্রহণে যাকে সে বলে সভ্যতা – অর্থাৎ বাধ্য করে তাদেরও বুর্জোয়া বনতে। এককথায়, বুর্জোয়াশ্রেণী নিজের ছাঁচে জগৎ গড়ে তোলে।

গ্রামাঞ্চলকে বুর্জোয়াশ্রেণী শহরের পদানত করেছে। সৃষ্টি করেছে বিরাট বিরাট শহর, গ্রামের তুলনায় শহরের জনসংখ্যা বাড়িয়েছে প্রচুর, এবং এইভাবে জনগণের এক বিশাল অংশকে বাঁচিয়েছে গ্রামজীবনের মূঢ়তা থেকে। গ্রামাঞ্চলকে এরা যেমন শহরের মুখাপেক্ষী করে তুলেছে, ঠিক তেমনই বর্বর বা অর্ধবর্বর দেশগুলোকে করেছে সভ্য দেশের উপর, চাষিবহুল জাতিকে করেছে বুর্জোয়া-প্রধান জাতির, পূর্বাঞ্চলকে পশ্চিমের উপর নির্ভরশীল।

অধিবাসীদের, উৎপাদন উপায়ের এবং সম্পত্তির বিক্ষিপ্ত অবস্থাটা বুর্জোয়া শ্রেণী ক্রমশই ঘুচিয়ে দিতে থাকে। জনসংখ্যাকে এরা পুঞ্জীভূত করেছে, উৎপাদনের উপায়গুলো করেছে কেন্দ্রীভূত, সম্পত্তিকে জড়ো করেছে অল্প লোকের হাতে। এরই অবশ্যম্ভাবী ফল হল রাজনৈতিক কেন্দ্রীভবন। বিভিন্ন ধরনের স্বার্থ, আইনকানুন, শাসনব্যবস্থা অথবা করপ্রথা সম্বলিত স্বাধীন কিংবা শিথিলভাবে সংযুক্ত প্রদেশগুলোকে ঠেসে মেলানো হয় এক একটা জাতিতে যাদের একই শাসনযন্ত্র, একই আইন সংহিতা, একই জাতীয় শ্রেণীস্বার্থ, একই সীমান্ত, এবং একই শুল্ক-ব্যবস্থা।

আধিপত্যের এক শতাব্দী পূর্ণ হতে না হতে, বুর্জোয়াশ্রেণী যে উৎপাদিকা-শক্তির সৃষ্টি করেছে তা অতীতের সকল যুগের সমষ্টিগত উৎপাদিকা-শক্তির চেয়েও বিশাল ও অতিকায়। প্রকৃতির শক্তিকে মানুষের কর্তৃত্বাধীন করা, যন্ত্রের ব্যবহার, শিল্প ও কৃষিতে রসায়নের প্রয়োগ, বাষ্পশক্তির সাহায্যে জলযাত্রা, রেলপথ, ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফ, চাষবাসের জন্য গোটা মহাদেশ সাফ করে ফেলা, জলযাত্রার জন্য নদীর খাত কাটা, ভেলকিবাজির মতো যেন মাটি ফুঁড়ে জনসমষ্টির আবির্ভাব – সামাজিক শ্রমের কোলে যে এতখানি উৎপাদিকা-শক্তি সুপ্ত ছিল, আগেকার কোনও শতক তার কল্পনাটুকুও করতে পেরেছিল?

তাই দেখা যাচ্ছে যে উৎপাদন ও বিনিময়ের যে সব উপায়কে ভিত্তি করে বুর্জোয়া শ্রেণী নিজেদের গড়ে তুলেছে, তাদের উৎপত্তি সামন্ত সমাজের মধ্যে। উৎপাদন ও বিনিময়ের এই সব উপায় বিকাশের একটা বিশেষ পর্যায়ে এল যখন সামন্ত সমাজের উৎপাদন ও বিনিময়ের শর্ত, সামন্ত কৃষি ও হস্তশিল্প কারখানার সংগঠন, এককথায় মালিকানার সামন্ত সম্পর্কগুলো আর কিছুতেই বিকশিত উৎপাদিকা-শক্তির সঙ্গে খাপ খেল না। এগুলো তখন শৃঙ্খল হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে শৃঙ্খল ভাঙতে হত এবং তা ভেঙে ফেলা হল।

তাদের জায়গায় এগিয়ে এল অবাধ প্রতিযোগিতা, সেই সঙ্গে তারই উপযোগী সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং বুর্জোয়াশ্রেণীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব।

আমাদের চোখের সামনে আজ অনুরূপ আর এক ধারা চলেছে। নিজের উৎপাদন-সম্পর্ক, বিনিময়-সম্পর্ক ও সম্পত্তি-সম্পর্ক সহ আধুনিক বুর্জোয়া সমাজ – ভেলকিবাজির মতো উৎপাদনের এবং বিনিময়ের এমন বিশাল উপায় গড়ে তুলেছে যে সমাজ, তার অবস্থা আজ সেই যাদুকরের মতো যে মন্ত্রবলে পাতালপুরীর শক্তিসমূহকে জাগিয়ে তুলে আর সেগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। গত বহু দশক ধরে শিল্প বাণিজ্যের ইতিহাস হল শুধু বর্তমান উৎপাদন-সম্পর্কের বিরুদ্ধে, বুর্জোয়াশ্রেণীর অস্তিত্ব ও আধিপত্যের যা মূলশর্ত সেই মালিকানা সম্পর্কের বিরুদ্ধে আধুনিক উৎপাদিকা-শক্তির বিদ্রোহের ইতিহাস। যে বাণিজ্য-সংকট বারবার ফিরে ফিরে এসে প্রতিবার আরও বেশি করে গোটা বুর্জোয়া সমাজের অস্তিত্বটাকেই বিপন্ন করে ফেলে, তার উল্লেখই যথেষ্ট। এইসব সংকটে শুধু যে বিদ্যমান উৎপন্নের অনেকখানি নষ্ট হয়ে যায় তাই নয়, আগেকার সৃষ্ট উৎপাদিকা-শক্তির অনেকটাও এতে পর্যায়ক্রমে ধ্বংস পায়। এইসব সংকটের ফলে এমনই এক মহামারী হাজির হয় অতীতের সকল যুগে যা অসম্ভব গণ্য করা হত – অতি উৎপাদনের মহামারী। হঠাৎ সমাজ যেন এক সাময়িক বর্বরতার পর্যায়ে ফিরে যায়; মনে হয় যেন বা এক দুর্ভিক্ষে, এক সর্বব্যাপী ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে বন্ধ হয়ে গেল জীবনধারণের সমস্ত উপায়-সরবরাহের পথ, শিল্প বাণিজ্য যেন নষ্ট হয়ে গেল; কী কারণে? কারণ, সভ্যতার পরাকাষ্ঠা হয়েছে, জীবনধারণ সামগ্রীতে দেখা দিয়েছে অতিপ্রাচুর্য, অনেক বেশি হয়ে গেছে শিল্প, অনেক বেশি বাণিজ্য। সমাজের হাতে যত উৎপাদিকা-শক্তি আছে, বুর্জোয়া সম্পদের শর্ত বিকাশে তা অার সাহায্য করছে না; বিপরীতে যে শর্তে সে শক্তি শৃঙ্খলিত ছিল তার তুলনায় এ শক্তি হয়ে উঠেছে অনেক বেশি প্রবল; এই শৃঙ্খলগুলোকে ছিন্ন করা মাত্র সমস্ত বুর্জোয়া সমাজে সে এনে ফেলে বিশৃঙ্খলতা, বিপন্ন করে বুর্জোয়া সম্পদের অস্তিত্ব। বুর্জোয়া সমাজ যে সম্পদ উৎপন্ন করে তাকে ধারণ করার পক্ষে বুর্জোয়া সমাজের অবস্থা বড়ই সংকীর্ণ। এই সংকট থেকে বুর্জোয়াশ্রেণী আবার কোন উপায়ে নিস্তার পায়? একদিকে, উৎপাদিকা-শক্তির বিপুল অংশ বাধ্য হয়ে ধ্বংস করে ফেলে, অপরদিকে নতুন বাজার দখল করে এবং পুরনো বাজারকে আরও বেশি মাত্রায় নিংড়ে নিয়ে। অর্থাৎ বলা যায় যে আরও ব্যাপক আরও ধ্বংসাত্মক সংকটের পথ প্রশস্ত করে এবং সংকট এড়াবার যা উপায় তাকেই কমিয়ে এনে।

যে অস্ত্রে বুর্জোয়াশ্রেণী সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধূলিসাৎ করেছিল সেই অস্ত্র আজ তাদেরই বিরুদ্ধে উদ্যত।

যে অস্ত্রে তাদের বিনাশ বুর্জোয়াশ্রেণী শুধু সে অস্ত্রটুকুই গড়েনি; এমন লোকও তারা সৃষ্টি করেছে যারা সে অস্ত্র ধারণ করবে, সৃষ্টি করেছে আধুনিক শ্রমিকশ্রেণীকে, সর্বহারাকে।

যে পরিমাণে বুর্জোয়াশ্রেণী অর্থাৎ পুঁজি বেড়ে চলে ঠিক সেই অনুপাতে বিকাশ পায় সর্বহারা অর্থাৎ আধুনিক শ্রমিকশ্রেণী, মেহনতিদের এ শ্রেণীটি বাঁচতে পারে যতক্ষণ কাজ জোটে, অার কাজ জোটে শুধু ততক্ষণ যতক্ষণ তাদের পরিশ্রমে পুঁজি বাড়তে থাকে। এই মেহনতিদের নিজেদের টুকরো টুকরো করে বেচতে হয়। বাণিজ্যের অন্য সামগ্রীর মতোই তারা পণ্যবই অন্য কিছু নয়। তাই তাদের নিয়তই প্রতিযোগিতার সব ঝড়-ঝাপটা, বাজারের সব ওঠা-পড়া সবকিছুই সহ্য করতে হয়।

যন্ত্রের বহুল ব্যবহার এবং শ্রমবিভাগের ফলে সর্বহারার কাজ আজ সকল ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য হারিয়েছে, এবং সেই হেতু মজুরের কাছে কাজের আকর্ষণ লোপ পেয়েছে। মজুর হয়েছে যন্ত্রের লেজুড়, তার কাছে চাওয়া হয় অতি সরল, একান্ত একঘেয়ে, অতি সহজে অর্জনীয় যোগ্যতাটুকু। সুতরাং মজুরের উৎপাদন খরচটাও সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে প্রায় একান্তই তাকে বাঁচিয়ে রাখার ও তার বংশরক্ষার পক্ষে অপরিহার্য অন্নবস্ত্রের সংস্থানটুকুর মধ্যে। কিন্তু পণ্যের দাম, অতএব শ্রমেরও দাম তার উৎপাদন খরচার সমান। সুতরাং কাজের জঘন্যতা যত বাড়ে, মজুরি তত কমে। শুধু তাই নয়, যে পরিমাণে যন্ত্রের ব্যবহার ও শ্রমবিভাগ বাড়ে, সেই অনুপাতে বাড়ে কাজের চাপ, হয় খাটুনির ঘণ্টা বাড়িয়ে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বেশি কাজ আদায় করে, অথবা যন্ত্রের গতিবেগ বাড়িয়ে দিয়ে, ইত্যাদি।

আধুনিক যন্ত্রশিল্প গোষ্ঠীপতি মালিকের ছোট কর্মশালাকে শিল্প-পুঁজিপতির বিরাট কারখানায় পরিণত করেছে। বিপুল সংখ্যায় মজুরকে কারখানার মধ্যে ঢোকান হয় ভিড় করে, সংগঠিত করা হয় সৈনিকের ধরনে। শিল্পবাহিনীর সাধারণ সৈন্য হিসাবে তারা থাকে অফিসার ও সার্জেন্টদের এক খাঁটি বহুধাপী ব্যবস্থার অধীনে। মজুরেরা কেবলমাত্র বুর্জোয়াশ্রেণীর ও বুর্জোয়া রাষ্ট্রের দাস নয়; দিনে দিনে ক্ষণে ক্ষণে তাদের করা হচ্ছে যন্ত্রের দাস, পরিদর্শকের দাস, সর্বোপরি খাস বুর্জোয়া মালিকটির দাস। এই যথেচ্ছাচার যত খোলাখুলিভাবে মুনাফালাভকেই নিজের লক্ষ্য ও আদর্শ হিসাবে ঘোষণা করে ততই তা হয়ে ওঠে আরও হীন, আরও ঘৃণ্য, আরও তিক্ত।

শারীরিক মেহনতে দক্ষতা ও শক্তি যতই কম লাগতে থাকে, অর্থাৎ আধুনিক যন্ত্রশিল্প যতই বিকশিত হয়ে ওঠে, ততই পুরুষের পরিশ্রমের স্থান জুড়ে বসতে থাকে নারী শ্রম। শ্রমিকশ্রেণীর কাছে বয়স কিংবা নারী-পুরুষের তফাৎটায় এখন আর বিশেষ সামাজিক তাৎপর্য নেই। সকলেই তারা খাটবার যন্ত্রমাত্র; বয়স অথবা স্ত্রী-পুরুষের তফাৎ অনুসারে সে যন্ত্র ব্যবহারের খরচটুকু কিছু বাড়ে-কমে মাত্র।

শিল্পের মালিক কর্তৃক মজুরের শোষণ খানিকটা সম্পূর্ণ হওয়া মাত্র অর্থাৎ তার মজুরির টাকাটা পাওয়া মাত্র, তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বুর্জোয়া শ্রেণীর অন্যান্য অংশ – বাড়িওয়ালা, দোকানদার, মহাজন প্রভৃতি।

মধ্য শ্রেণীর নিম্ন স্তর – ছোটখাট ব্যবসায়ী, দোকানদার, সাধারণত ভূতপূর্ব কারবারিরা সবাই, হস্তশিল্পী এবং চাষিরা – তারা ধীরে ধীরে সর্বহারার মধ্যে নেমে আসে। তার এক কারণ, যতখানি বড় আয়তনে আধুনিক শিল্প চালাতে হয় এদের সামান্য পুঁজি তার পক্ষে যথেষ্ট নয় এবং প্রতিযোগিতায় বড় পুঁজিপতিরা এদের গ্রাস করে ফেলে; অপর কারণ, উৎপাদনের নতুন পদ্ধতির ফলে এদের বিশিষ্ট নৈপুণ্যটুকু অকেজো হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং সর্বহারার সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে জনগণের প্রতিটি শ্রেণী থেকে আগত লোকের দ্বারা।

বিকাশের নানা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে সর্বহারাকে যেতে হয়। বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে এর সংগ্রাম শুরু হয় জন্ম মুহূর্ত থেকে। প্রথমটা লড়াই চালায় বিশেষ বিশেষ মজুরেরা; তারপর লড়তে থাকে গোটা কারখানার মেহনতিরা; তারপর কোনও একটা অঞ্চলের একই পেশায় নিযুক্ত সকল শ্রমিকরা তাদের সাক্ষাৎ শোষণকারী বিশিষ্ট পুঁজিপতিটির বিরুদ্ধে লড়ে। তাদের আক্রমণের লক্ষ্য হয় উৎপাদনের উপকরণ, উৎপাদনের বুর্জোয়া ব্যবস্থাটা নয়; যে আমদানিকৃত পণ্যসামগ্রী তাদের মেহনতের প্রতিযোগিতা করে সেগুলো তারা ধ্বংস করে, কল ভেঙে চুরমার করে দেয়, কারখানায় আগুন লাগায়, মধ্যযুগের মেহনতকারীর যে মর্যাদা লোপ পেয়েছে, গায়ের জোরে চায় তা ফিরিয়ে আনতে।

এই পর্যায়ে মজুরেরা তখনও দেশময় ছড়ানো এলোমেলো জনতামাত্র, পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় ছত্রভঙ্গ। কোথাও যদি তারা অধিকতর সংহত সংস্থায় একজোটও হয়, তবু সেটা তখনও নিজস্ব সক্রিয় সম্মিলনের ফল নয়, বরং বুর্জোয়া শ্রেণীর সম্মিলনের ফলমাত্র। এ শ্রেণী নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য গোটা সর্বহারাকে সচল করতে বাধ্য হয়, তখনও কিছুদিনের জন্য সে চেষ্টায় সফলও হয়। সুতরাং এই পর্যায়ে মজুরেরা লড়ে নিজেদের শত্রুর বিপক্ষে নয়, শত্রুর শত্রু, অর্থাৎ নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের অবশিষ্টাংশ, জমিদার, শিল্প বহির্ভূত বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে। এ অবস্থায় ইতিহাসের সমস্ত গতিটি বুর্জোয়া শ্রেণীর হাতের মুঠোর মধ্যে থাকে; এভাবে অর্জিত প্রতিটি জয় হল বুর্জোয়ার জয়।

কিন্তু যন্ত্রশিল্প প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণী কেবল সংখ্যায় বাড়ে না; তারা কেন্দ্রীভূত হতে থাকে বৃহত্তর সমষ্টিতে, তাদের শক্তি বাড়তে থাকে, আপন শক্তি তারা বেশি করে উপলব্ধি করে। কলকারখানা যে অনুপাতে বিভিন্ন ধরনের শ্রমের পার্থক্য মুছে ফেলতে থাকে আর প্রায় সর্বত্র মজুরি কমিয়ে আনে একই নীচু স্তরে, সেই অনুপাতে সর্বহারা বাহিনীর মধ্যে বিভিন্ন স্বার্থ ও জীবনযাত্রার অবস্থা ক্রমেই সমান হয়ে যেতে থাকে। বুর্জোয়াদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতা এবং তৎপ্রসূত বাণিজ্য-সংকটে শ্রমিকের মজুরি ক্রমেই ওঠা-নামা করতে থাকে। যন্ত্রের অবিরাম উন্নতি ক্রমেই আরও দ্রুততালে বাড়তে থাকে, মজুরের জীবিকা হয়ে পড়ে আরও বিপন্ন; এক একদল মজুরের সঙ্গে এক একজন বুর্জোয়ার সংঘর্ষ ক্রমেই বেশি করে দুই শ্রেণীর দ্বন্দ্বের রূপ নেয়। তখন মজুরেরা মিলিত সমিতি গঠন শুরু করে (ট্রেড ইউনিয়ন) বুর্জোয়ার বিরুদ্ধে; মজুরির হার বজায় রাখার জন্য জোট বাঁধে; মাঝে মধ্যে ঘটা এই বিদ্রোহের আগে থাকতে প্রস্তুতির জন্য স্থায়ী সংগঠন গড়ে। এখানে ওখানে দ্বন্দ্ব পরিণত হয় অভ্যুত্থানে।

মাঝে মাঝে শ্রমিকরা জয়ী হয়, কিন্তু কেবল অল্পদিনের জ্ন্য। তাদের সংগ্রামের আসল লাভ আশু ফলাফলে নয়, মজুরদের ক্রমবর্ধমান একতায়। এই একতার সহায় হয় যোগাযোগের উন্নত ব্যবস্থা, আধুনিক শিল্প যার সৃষ্টি করেছে এবং যার মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার মজুরেরা পরস্পরের সংস্পর্শে আসে। একজাতীয় অসংখ্য স্থানীয় লড়াইকে দেশব্যাপী এক শ্রেণীসংগ্রামে কেন্দ্রীভূত করার জন্য ঠিক এই সংযোগটারই প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রত্যেকটা শ্রেণীসংগ্রামই হল রাজনৈতিক সংগ্রাম। শোচনীয় রাস্তাঘাটের দরুন যে ঐক্য আনতে মধ্যযুগের নাগরিকদের শতাব্দীর পর শতাব্দী লেগেছিল, আধুনিক শ্রমিকরা তা অর্জন করে রেলপথের কল্যাণে মাত্র কয়েক বছরে।

মজদুরদের পরস্পরের মধ্যেই প্রতিযোগিতা আবার তাদের শ্রেণী হিসাবে সংগঠিত হওয়া এবং তার ফলে এক রাজনৈতিক দলে পরিণত হওয়াকে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ করে চলে। কিন্তু প্রতিবারই প্রবলতর, দৃঢ়তর, আরও শক্তিশালী হয়ে সংগঠন মাথা তোলে। এরই চাপে বুর্জোয়াদের মধ্যে বিভেদের ফলে শ্রমিকদের এক একটা স্বার্থকে আইনত মেনে নিতে হয়। ইংল্যান্ডে দশ ঘণ্টার আইন এইভাবে পাশ হয়েছিল।

মোটের ওপর, পুরনো সমাজের নানা শ্রেণীর মধ্যে সংঘাত সর্বহারার বিকাশে নানাভাবে সাহায্য করে। বুর্জোয়া শ্রেণীকে লিপ্ত থাকতে হয় অবিরাম সংগ্রামে। প্রথমে লড়াই হয় অভিজাতদের সঙ্গে; পরে বুর্জোয়া শ্রেণীরই যে যে অংশের স্বার্থ যন্ত্রশিল্প বিস্তারের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় তাদের বিরুদ্ধে; আর সর্বদাই বিদেশের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে। এইসব সংগ্রামেই বুর্জোয়াদের বাধ্য হয়ে শ্রমিকশ্রেণীর কাছে আবেদন করতে হয়, সাহায্য চাইতে হয় তাদেরই কাছে, তাদের টেনে আনতে হয় রাজনীতির প্রাঙ্গণে। সুতরাং বুর্জোয়ারা নিজেরাই সর্বহারাকে তাদের রাজনৈতিক ও সাধারণ শিক্ষার কিছুটা জোগাতে থাকে; অর্থাৎ বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়বার অস্ত্র সর্বহারাকে তারাই জোগায়।

এছাড়া আমরা আগেই দেখেছি যে শিল্পের অগ্রগতির ফলে শাসকশ্রেণীর মধ্য থেকে পুরোপুরি এক একটা অংশ সর্বহারার মধ্যে নিক্ষিপ্ত হতে থাকে, অথবা তাদের জীবনযাত্রার অবস্থা অন্তত বিপন্ন হয়। এরাও আবার সর্বহারাকে জোগায় জ্ঞানলাভ ও প্রগতির নতুন নতুন উপাদান।

শেষপর্যন্ত শ্রেণীসংগ্রাম যখন চূড়ান্ত মুহূর্তের কাছে এসে পড়ে, তখন শাসকশ্রেণীর মধ্যে, বস্তুতপক্ষে পুরনো সমাজের গোটা পরিধি জুড়ে ভাঙ্গনের যে প্রক্রিয়া চলেছে তা এমন একটা প্রখর হিংস্র রূপ নেয় যে শাসকশ্রেণীর একটা ছোট অংশ পর্যন্ত ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে , হাত মেলায় বিপ্লবী শ্রেণীর সঙ্গে, সেই শ্রেণীর সঙ্গে যার হাতেই ভবিষ্যৎ। সুতরাং আগেকার একযুগে যেমন অভিজাতদের একটা অংশ বুর্জোয়া শ্রেণীর দিকে চলে গিয়েছিল, ঠিক তেমনই এখন বুর্জোয়াদের একটা ভাগ যোগ দেয় শ্রমিকশ্রেণীর সঙ্গে, বিশেষ করে বুর্জোয়া ভাবাদর্শীদের কিছু কিছু, যারা ইতিহাসের সমগ্র গতিকে তত্ত্বের দিক থেকে বুঝতে পারার স্তরে নিজেদের তুলতে পেরেছে।

আজকের দিনে বুর্জোয়াদের মুখোমুখি যেসব শ্রেণী দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে শুধু সর্বহারা হল প্রকৃত বিপ্লবী শ্রেণী। অপর শ্রেণীগুলো আধুনিক যন্ত্রিশিল্পের সামনে ক্ষয় হতে হতে লোপ পায়; সর্বহারা হল সেই যন্ত্রশিল্পের বিশিষ্ট ও অপরিহার্য সৃষ্টি।

নিম্নমধ্যবিত্ত, ছোট হস্তশিল্প কারখানার মালিক, দোকানদার, কারিগর, চাষি – এরা সকলে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে লড়ে মধ্যশ্রেণীর টুকরো হিসাবে নিজেদের অস্তিত্বটাকে ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচাবার জন্য। তাই তারা বিপ্লবী নয়, রক্ষণশীল। বলতে গেলে প্রতিক্রিয়াশীলও, কেননা ইতিহাসের চাকা পিছনে ঘোরাবার চেষ্টা করে তারা। দৈবক্রমে যদি এরা বিপ্লবী হয় তবে তা হয় কেবল তাদের সর্বহারা রূপে আসন্ন রূপান্তরের কারণে; সুতরাং তারা তখন রক্ষা করে তাদের বর্তমান স্বার্থ নয়, ভবিষ্যৎ স্বার্থ; নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গী ত্যাগ করে তারা গ্রহণ করে সর্বহারার দৃষ্টিভঙ্গী।

পুরনো সমাজের নিম্নতম স্তর থেকে ছিটকে পড়া যেসব লোক নিষ্ক্রিয়ভাবে পচছে, সেই সামাজিক আবর্জনাটাকে, সেই 'বিপজ্জনক শ্রেণীকে' (লুম্পেন সর্বহারা) শ্রমিক বিপ্লব এখানে ওখানে আন্দোলনের মধ্যে ঝেঁটিয়ে নিয়ে আসতে পারে; কিন্তু এদের জীবনযাত্রার ধরনটা এমনই যে তা প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্রের ভাড়াটে হাতিয়ারের ভূমিকার জন্যই তাদের অনেক বেশি তৈরি করে তোলে।

পুরনো সমাজের সাধারণ পরিস্থিতিটা সর্বহারার জীবনে ইতিমধ্যেই প্রায় লোপ পেতে বসেছে। সর্বহারার সম্পত্তি নেই; স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সঙ্গে তার যা সম্বন্ধ সেটা আর বুর্জোয়া পারিবারিক সম্বন্ধের সঙ্গে মেলে না; আধুনিক শিল্পশ্রম, পুঁজির কাছে আধুনিক ধরনের অধীনতা, যা ইংল্যান্ড বা ফ্রান্স, আমেরিকা অথবা জার্মানিতে একই প্রকার, তাতে তার জাতীয় চরিত্রের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই লোপ পেয়েছে। তার কাছে আইন, নীতি, ধর্ম হল কয়েকটা বুর্জোয়া কুসংস্কার মাত্র যার পিছনে ওঁৎ পেতে আছে বুর্জোয়া স্বার্থ।

অতীতের যে সব শ্রেণী আধিপত্যের স্তরে উঠেছিল তারা সবাই তাদের অর্জিত অবস্থানকে দৃঢ়তর করতে চেয়েছিল গোটা সমাজকে তাদের ভোগদখলের শর্তের অধীনস্ত করে। সর্বহারা কিন্তু সমাজের উৎপাদিকা শক্তিগুলোর নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারে না যদি না সে নিজেদের অধিকারের পূর্বতন ধরনের, এবং সেই সূত্রে পূর্ববর্তী সমস্ত ধরনের অধিকারের বিলোপ ঘটায়। তাদের নিজস্ব বলতে এমন কিছু নেই যাকে রক্ষা অথবা দৃঢ়তর করতে হবে; ব্যক্তিগত মালিকানার সমস্ত পূর্বতন নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা নির্মূল করে দেওয়াই তাদের ব্রত।

অতীত ইতিহাসে প্রতিটি আন্দোলন ছিল সংখ্যাল্পের দ্বারা অথবা সংখ্যাল্পের স্বার্থে আন্দোলন। সর্বহারার আন্দোলন হল বিরাট সংখ্যাধিকের স্বার্থে বিপুল সংখ্যাধিকের আত্মসচেতন স্বাধীন আন্দোলন। সর্বহারা আজকের সমাজে নিম্নতম স্তর; তার ওপর চাপানো সমগ্র সরকারী সমাজকে শূন্যে উৎক্ষিপ্ত না করে সে লড়তে পারে না, উঠে দাঁড়াতে পারে না।

বুর্জোয়া শ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বহারার লড়াইটা মর্মবস্তুতে না হলেও আকারের দিক থেকে হল প্রথমত জাতীয় সংগ্রাম। প্রত্যেক দেশের সর্বহারাকে অবশ্যই সর্বাগ্রে ফয়সালা করতে হবে স্বদেশী বুর্জোয়াদের সঙ্গে।

সর্বহারার বিকাশের সাধারণতম পর্যায়গুলোর ছবি আঁকতে গিয়ে আমরা দেখিয়েছি যে বর্তমান সমাজের ভেতরে কমবেশি প্রচ্ছন্ন গৃহযুদ্ধ চলেছে, যে যুদ্ধ একটা বিন্দুতে এসে প্রকাশ্য বিপ্লবে পরিণত হয় এবং তখন বুর্জোয়াদের সবলে উচ্ছেদ করে স্থাপিত হয় সর্বহারার আধিপত্যের ভিত্তি।

আমরা আগেই দেখেছি যে আজ পর্যন্ত সব ধরনের সমাজ গড়ে উঠেছে অত্যাচারী ও অত্যাচারিত শ্রেণীর বিরোধের ভিত্তিতে। কিন্তু কোনও শ্রেণীর ওপর অত্যাচার বজায় রাখতে হলে তার জন্য এমন কিছুটা অবস্থা নিশ্চিত করতে হয় যাতে সে তার দাসত্বের অস্তিত্বটুকু অন্তত চালিয়ে যেতে পারে। ভূমিদাসত্বের যুগে ভূমিদাস নিজেকে কমিউন-সভ্যের পর্যায়ে তুলেছিল ঠিক যেমন সামন্ত স্বৈরতন্ত্রের পেষণতলেও পেটি বুর্জোয়া পেরেছিল বুর্জোয়ারূপে বিকশিত হতে। পক্ষান্তরে, আধুনিক শ্রমিক কিন্তু যন্ত্রশিল্পের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উপরে ওঠে না, স্বীয় শ্রেণীর অস্তিত্বের যা হাল, তারও নীচে ক্রমশই বেশি করে তাকে নেমে যেতে হয়। মজুর হয়ে পড়ে দুঃস্থ (pauper), আর দুরবস্থা বেড়ে চলে জনসংখ্যা ও সম্পদবৃদ্ধির চেয়ে দ্রুততর তালে। এই সূত্রেই পরিষ্কার প্রতিপন্ন হয় যে বুর্জোয়া শ্রেণীর আর সমাজের শাসক হয়ে থাকার যোগ্যতা নেই, নিজেদের অস্তিত্বের শর্তটাকে চরম আইন হিসাবে সমাজের ঘাড়ে চাপিয়ে রাখার অধিকার নেই। বুর্জোয়া শ্রেণীশাসন চালাবার উপযুক্ত নয়, কারণ তারা দাসত্বের মধ্যে দাসের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে অক্ষম, তাদের এমন অবস্থায় না নামিয়ে পারে না যেখানে দাসের দৌলতে খাওয়ার বদলে দাসকেই খাওয়াতে হয়। এই বুর্জোয়ার শাসনে সমাজ আর বেঁচে থাকতে পারে না , অর্থাৎ অন্য ভাষায় বলতে গেলে তার অস্তিত্ব আর সমাজের সঙ্গে খাপ খায় না।

বুর্জোয়া শ্রেণীর অস্তিত্ব ও আধিপত্যের মূলশর্ত হল পুঁজির সৃষ্টি ও বৃদ্ধি; পুঁজির শর্ত হল মজুরি-শ্রম। মজুরি-শ্রম সম্পূর্ণভাবে মজুরদের মধ্যেকার প্রতিযোগিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। যন্ত্রশিল্পের যে অগ্রগতি বুর্জোয়া শ্রেণী না ভেবেই বাড়িয়ে চলে, তার ফলে শ্রমিকদের প্রতিযোগিতা-হেতু বিচ্ছিন্নতার জায়গায় আসে সম্মিলন-হেতু বিপ্লবী ঐক্য। সুতরাং, যে ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বুর্জোয়া শ্রেণী উৎপাদন করে ও উৎপন্ন দখল করে, আধুনিক শিল্পের বিকাশ তার পায়ের তলা থেকে সেই ভিত্তিটাই কেড়ে নিচ্ছে। তাই বুর্জোয়া শ্রেণী সৃষ্টি করছে সর্বোপরি তারই সমাধি-খনকদের। বুর্জোয়ার পতন এবং সর্বহারার জয়লাভ, দুইই সমান অনিবার্য।