সমগ্রভাবে সর্বহারাদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের কী সম্বন্ধ?

শ্রমিকশ্রেণীর অন্যান্য পার্টিগুলোর প্রতিপক্ষ হিসাবে কমিউনিস্টরা স্বতন্ত্র পার্টি গঠন করে না।

সমগ্রভাবে সর্বহারার স্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র কোনও স্বার্থ তাদের নেই। সর্বহারা আন্দোলনকে রূপ দেওয়া বা গড়ে পিটে তোলার জন্য তারা নিজস্ব কোনও গোষ্ঠীগত নীতি খাড়া করে না।

শ্রমিকশ্রেণীর অন্যান্য পার্টি থেকে কমিউনিস্টদের তফাতটা শুধু এই : (১) নানা দেশের মজুরদের জাতীয় সংগ্রামের ভেতর তারা জাতি-নির্বিশেষে সারা সর্বহারার সাধারণ স্বার্থটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তাকেই সামনে টেনে আনে। (২) বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর লড়াইকে যে বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে হয় তার মধ্যে তারা সর্বদা ও সর্বত্র সমগ্র আন্দোলনের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে।

সুতরাং কমিউনিস্টরা হল একদিকে বস্তুত প্রতি দেশের শ্রমিকশ্রেণীর পার্টিগুলোর সর্বাপেক্ষা অগ্রসর ও দৃঢ়চিত্ত অংশ – যে অংশ অন্যান্য সবাইকে সামনে ঠেলে নিয়ে যায়। অপরদিকে, তত্ত্বের দিক দিয়ে শ্রমিকশ্রেণীর অধিকাংশের তুলনায় তাদের এই সুবিধা যে শ্রমিক আন্দোলনের এগিয়ে যাওয়ার পথ, শর্ত এবং শেষ সাধারণ ফলাফল সম্বন্ধে তাদের স্বচ্ছ বোধ রয়েছে।

কমিউনিস্টদের আশু লক্ষ্য শ্রমিকদের অন্যান্য পার্টির উদ্দেশ্য থেকে অভিন্ন : সর্বহারাকে শ্রেণী হিসাবে গঠিত করা, বুর্জোয়া আধিপত্যের উচ্ছেদ, সর্বহারা কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা অধিকার।

কমিউনিস্টদের তাত্ত্বিক সিদ্ধান্তগুলো মোটেই এমন কোনও ধারণা বা মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় যা বিশেষ কোনও ভাবী বিশ্বসংস্কারকের রচনা বা আবিষ্কার।

যে শ্রেণীসংগ্রাম, যে ঐতিহাসিক আন্দোলন আমাদের নিজের চোখের সামনে বর্তমান, তা থেকে বাস্তব যে সম্পর্কগুলোর উৎপত্তি, কমিউনিস্ট তত্ত্ব কেবল তাকেই সাধারণ সূত্ররূপে প্রকাশ করে। প্রচলিত মালিকানা সম্পর্কের উচ্ছেদটা মোটেই সাম্যবাদের একান্ত বৈশিষ্ট্য নয়।

ঐতিহাসিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অতীতের সমস্ত মালিকানা সম্পর্কেও ঐতিহাসিক বদল ঘটেছে। যেমন, ফরাসি বিপ্লব বুর্জোয়া মালিকানার অনুকূলে সামন্ত সম্পত্তির উচ্ছেদ করে।

সাধারণভাবে মালিকানার উচ্ছেদ নয়, বুর্জোয়া মালিকানার উচ্ছেদই সাম্যবাদের বৈশিষ্ট্যসূচক দিক। কিন্তু শ্রেণীবিরোধের ওপর, অল্প লোকের দ্বারা বহু জনের শোষণের ওপর প্রতিষ্ঠিত উৎপাদন এবং উৎপন্ন দখলি ব্যবস্থার চূড়ান্ত ও পূর্ণতম প্রকাশ হল আধুনিক বুর্জোয়া ব্যক্তিগত মালিকানা।

এই অর্থে কমিউনিস্টদের তত্ত্বকে এক কথায় প্রকাশ করা চলে : ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ।

আমাদের বিরুদ্ধে – কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে – অভিযোগ আনা হয়েছে যে, ব্যক্তিবিশেষের নিজ পরিশ্রমের ফল হিসাবে নিজস্ব সম্পত্তি অর্জনের অধিকারের আমরা উচ্ছেদ করতে চাই, বলা হয় যে, সকল ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, কর্ম ও স্বাবলম্বনের মূলভিত্তি হল এই সম্পত্তি।

কষ্টলব্ধ, স্বাধিকৃত, স্বোপার্জিত সম্পত্তি ! সামান্য কারিগর ও ক্ষুদে চাষির সম্পত্তির কথাই কি বলা হচ্ছে, যে ধরনের সম্পত্তি ছিল বুর্জোয়া সম্পত্তির আগে? তাকে উচ্ছেদ করার কোনও প্রয়োজন নেই; যন্ত্রশিল্পের বিকাশ ইতিমধ্যেই তাকে অনেকাংশে ধ্বংস করেছে, এখনও প্রতিদিন ধ্বংস করে চলেছে।

নাকি বলা হচ্ছে আধুনিক বুর্জোয়া ব্যক্তিগত মালিকানার কথা?

কিন্তু মজুরি-শ্রম কি মজুরদের জন্য কোনও মালিকানা সৃষ্টি করে? একেবারেই না। সে সৃষ্টি করে পুঁজি, অর্থাৎ সেই ধরনের সম্পত্তি যা মজুরি-শ্রমকে শোষণ করে, নিত্য নতুন শোষণের জন্য নতুন নতুন মজুরি-শ্রমের সরবরাহ সৃষ্টির শর্ত ছাড়া যা বাড়তে পারে না। বর্তমান ধরনের এই মালিকানা পুঁজি ও মজুরি-শ্রমের বিরোধের ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিরোধের দুইটি দিকই পরীক্ষা করে দেখা যাক।

পুঁজিপতি হওয়া মানে উৎপাদন ব্যবস্থার মধ্যে শুধু একটা ব্যক্তিগত নয় , একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন। পুঁজি একটা যৌথ সৃষ্টি; সমাজের অনেক লোকের মিলিত কাজের ফলে, এমনকি শেষ বিশ্লেষণে, সমাজের সকল লোকের মিলিত কর্মেই পুঁজিকে সচল করা যায়।

পুঁজি তাই ব্যক্তিগত নয় , একটা সামাজিক শক্তি।

কাজেই পুঁজিকে সাধারণ সম্পত্তিতে অর্থাৎ সমাজের সকল লোকের সম্পত্তিতে পরিণত করলে, তার দ্বারা ব্যক্তিগত সম্পত্তি সামাজিক সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয় না। মালিকানার সামাজিক রূপটাই কেবল বদলে যায়। তার শ্রেণীগত প্রকৃতিটা লোপ পায়।

এবার মজুরি-শ্রমের কথা ধরা যাক।

মজুরি-শ্রমের গড়পড়তা দাম হল নিম্নতম মজুরি, অর্থাৎ মেহনতি হিসাবে মেহনতির অস্তিত্বটুকু বজায় রাখার জন্য যা একান্ত আবশ্যক, গ্রাসাচ্ছাদনের সেইটুকু উপকরণ। সুতরাং মজুরি-শ্রমিক শ্রম করে যেটুকু ভাগ পায় তা দিয়ে কেবল কোনও ক্রমে এই অস্তিত্বটুকু চালিয়ে যাওয়া ও প্রজননের কাজ চলে। শ্রমের ফসলের ওপর এই ব্যক্তিগত দখলি, যা কেবল মানুষের প্রাণরক্ষা ও নতুন মানুষের জন্মদানের কাজে লাগে এবং অপরের শ্রমের ও‍পর কর্তৃত্ব চালাবার মতো কোনও উদ্বৃত্ত যার থাকে না, তেমন ব্যক্তিগত দখলির উচ্ছেদ একেবারেই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমরা কেবল উচ্ছেদ চাই দখলির এই শোচনীয় প্রকৃতিটার, যার ফলে শ্রমিক বাঁচে শুধু পুঁজি বাড়ানোর জন্য, তাকে ততটুকু বাঁচতে দেওয়া হয় যতটুকু প্রয়োজন শাসকশ্রেণীর স্বার্থসিদ্ধির জন্য।

বুর্জোয়া সমাজে জীবন্ত শ্রম পূর্বসঞ্চিত শ্রম বাড়াবার উপায়মাত্র। কমিউনিস্ট সমাজে কিন্তু পূর্বসঞ্চিত শ্রম শ্রমিকের অস্তিত্বকে বিস্তৃততর, সমৃদ্ধতর, উন্নততর করে তোলার উপায়।

সুতরাং বুর্জোয়া সমাজে বর্তমানের ওপর আধিপত্য করে অতীত; কমিউনিস্ট সমাজে বর্তমান আধিপত্য করে অতীতের ওপর। বুর্জোয়া সমাজে পুঁজি হল স্বাধীন, স্বতন্ত্র-সত্তা, কিন্তু জীবন্ত মানুষ হল পরাধীন, স্বতন্ত্র-সত্তাবিহীন।

অথচ এমন অবস্থার অবসানকেই বুর্জোয়ারা বলে স্বাধীনতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উচ্ছেদ ! কথাটা সত্যই। বুর্জোয়া ব্যক্তিত্ব, বুর্জোয়া স্বাতন্ত্র্য, বুর্জোয়া স্বাধীনতার উচ্ছেদই যে আমাদের লক্ষ্য তাতে সন্দেহ নেই।

উৎপাদনের বর্তমান বুর্জোয়া ব্যবস্থায় স্বাধীনতার অর্থ হল অবাধ বাণিজ্য, অবাধে বেচা-কেনার অধিকার।

কিন্তু যদি বেচাকেনাই লোপ পায়, তবে অবাধ বেচাকেনাও অন্তর্ধান করবে। অবাধ বেচাকেনার সম্পর্কে আমাদের বুর্জোয়াদের এই কথা সাধারণভাবে স্বাধীনতা সম্পর্কে তাদের অন্য সমস্ত 'আস্ফালনের' কোনও তাৎপর্য যদি থেকে থাকে তবে তা মধ্যযুগের নিয়ন্ত্রিত বেচাকেনা শৃঙ্খলিত ব্যবসাদারদের সঙ্গে প্রতি তুলনায়; কেনাবেচার, উৎপাদনের বুর্জোয়া শর্ত ও খোদ বুর্জোয়া শ্রেণীটারই যে উচ্ছেদের কথা কমিউনিস্টরা বলে তার কাছে এগুলোর কোনও অর্থ টেকে না।

আমরা ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান চাই শুনে আপনারা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। অথচ আপনাদের বর্তমান সমাজে জনগণের শতকরা নব্বই জনের ব্যক্তিগত মালিকানা তো ইতিমধ্যেই লোপ পেয়েছে; অল্প কয়েকজনের ভাগ্যে সম্পত্তির একমাত্র কারণ হল ঐ দশ ভাগের নয় ভাগ লোকের হাতে কিছুই না থাকা। সুতরাং আমাদের বিরুদ্ধে আপনাদের অভিযোগ দাঁড়ায় এই যে সম্পত্তির অধিকারের এমন একটা রূপ আমরা তুলে দিতে চাই যা বজায় রাখার অনিবার্য শর্ত হল সমাজের বিপুল সংখ্যাধিক লোকের সম্পত্তি না থাকা।

এককথায়, আমাদের সম্বন্ধে আপনাদের অভিযোগ এই যে আপনাদের সম্পত্তির উচ্ছেদ আমরা চাই। ঠিক কথা, আমাদের সংকল্প ঠিক তা-ই।

যখনই মানুষের শ্রমকে আর পুঁজি, মুদ্রা, অথবা খাজনাতে পরিণত করা চলে না, একচেটিয়া কর্তৃত্বের মুঠির আয়ত্তাধীন একটা সামাজিক শক্তিতে পরিণত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে -- অর্থাৎ যখনই ব্যক্তিগত মালিকানা আর বুর্জোয়া মালিকানায়, পুঁজিতে রূপান্তরিত হতে পারে না, তখনি আপনারা বলেন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য শেষ হয়ে গেল।

তাহলে স্বীকার করুন যে 'ব্যক্তি' বলতে বুর্জোয়া ছাড়া, শুধু মধ্য শ্রেণীভুক্ত সম্পত্তির মালিক ছাড়া অন্য লোক বােঝায় না। এহেন ব্যক্তিকে অবশ্যই পথ থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় দিতে হবে, তার অস্তিত্ব করে তুলতে হবে অসম্ভব।

সমাজের উৎপন্ন জিনিসে দখলির অধিকার থেকে সাম্যবাদ কোনও লোককে বঞ্চিত করে না; দখলির মাধ্যমে অপরের শ্রমকে করায়ত্ত করার ক্ষমতাটাই সে কেবল হরণ করে।

আপত্তি উঠেছে যে ব্যক্তিগত মালিকানার উচ্ছেদ হলে সমস্ত কাজ বন্ধ হয়ে যাবে, সর্বব্যাপী আলস্য আমাদের গ্রাস করবে।

এই মত ঠিক হলে বহুপূর্বেই নিছক আলস্যের টানে বুর্জোয়া সমাজের রসাতলে যাওয়া উচিত ছিল, কারণ ও-সমাজে যারা খাটে তারা কিছু অর্জন করে না, আর যারা সবকিছু পায়, তাদের খাটতে হয় না। সমস্ত আপত্তিটাই অন্য ভাষায় এই পুনরুক্তির সামিল : যখন পুঁজি থাকবে না তখন মজুরি-শ্রমও অদৃশ্য হবে।

বৈষয়িক দ্রব্যের উৎপাদন ও দখলি বিষয়ে কমিউনিস্ট পদ্ধতির বিরুদ্ধে যত আপত্তি আনা হয়, মানসিক সৃষ্টির উৎপাদন ও দখলি সম্পর্কে কমিউনিস্ট পদ্ধতির বিরুদ্ধেও ঠিক সেই আপত্তি তোলা হয়। বুর্জোয়ার কাছে শ্রেণীগত মালিকানার উচ্ছেদটা যেমন উৎপাদনেরই অবসান বলে মনে হয়, তেমনি শ্রেণীগত সংস্কৃতির লোপ তার কাছে সকল সংস্কৃতি লোপ পাওয়ার সমার্থক।

যে সংস্কৃতির অবসান ভয়ে বুর্জোয়ারা বিলাপ করে, বিপুল সংখ্যাধিক জনগণের কাছে তা যন্ত্র হিসাবে কাজ করার একটা তালিম মাত্র।

বুর্জোয়া মালিকানা উচ্ছেদে আমাদের সংকল্পের বিচারে যদি আপনারা স্বাধীনতা, সংস্কৃতি, আইন ইত্যাদির বুর্জোয়া ধারণার আশ্রয় নেন তাহলে আমাদের সঙ্গে তর্ক করতে আসবেন না। আপনাদের ধারণাগুলোই যে আপনাদের বুর্জোয়া উৎপাদন ও বুর্জোয়া মালিকানার পরিস্থিতি থেকেই উদ্ভূত, ঠিক যেমন আপনাদের শ্রেণীর ইচ্ছাটা সকলের ওপর আইন হিসাবে চাপিয়ে দেওয়াটাই হল আপনাদের আইনশাস্ত্র, আপনাদের এ ইচ্ছাটার মূল প্রকৃতি ও লক্ষ্যও আবার নির্ধারিত হচ্ছে আপনাদের শ্রেণীরই অস্তিত্বের অর্থনৈতিক অবস্থা দ্বারা।

আপনাদের বর্তমান উৎপাদন-পদ্ধতি ও সম্পত্তির রূপ থেকে যে সামাজিক রূপ মাথা তোলে, ঐতিহাসিক এই যে সম্পর্ক উৎপাদনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে উদয় হয় ও লয় পায়, স্বার্থপ্রণোদিত ভ্রান্ত ধারণা থেকে আপনারা তাকে প্রকৃতি ও বিচারবুদ্ধির চিরন্তন নিয়মে রূপান্তরিত করতে চান, আপনাদের আগে যত শাসকশ্রেণী এসেছে তাদের সকলেরই ছিল অনুরূপ ভ্রান্ত ধারণা। প্রাচীন সম্পত্তির ক্ষেত্রে যে কথাটা আপনাদের কাছে পরিষ্কার, সামন্ত সম্পত্তির বেলায় যা আপনারা মেনে নেন, আপনাদের নিজস্ব বুর্জোয়া ধরনের সম্পত্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই সে কথা আপনাদের স্বীকার করা বারণ।

পরিবারের উচ্ছেদ ! উগ্র চরমপন্থীরা পর্যন্ত কমিউনিস্টদের এই গর্হিত প্রস্তাবে ক্ষেপে ওঠে।

আধুনিক পরিবার অর্থাৎ বুর্জোয়া পরিবারের প্রতিষ্ঠা কোন ভিত্তির উপর? সে ভিত্তি হল পুঁজি, ব্যক্তিগত লাভ। এই পরিবারের পূর্ণ বিকশিত রূপটি শুধু বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যেই আবদ্ধ। কিন্তু এই অবস্থারই পরিপূরক দেখা যাবে সর্বহারাদের মধ্যে, পরিবার বলতে যা বোঝায় তা কার্যত যাদের নেই এবং প্রকাশ্য পতিতাবৃত্তির ভিতর।

পরিপূরক এই অবস্থার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে বুর্জোয়া পরিবারের লোপও অবশ্যম্ভাবী, পুঁজির উচ্ছেদের সঙ্গেই উভয়ে অন্তর্হিত হবে।

আমাদের বিরুদ্ধে কি এই অভিযোগ যে সন্তানের উপর পিতামাতার শোষণ শেষ করে দিতে চাই? এ দোষ আমরা অস্বীকার করব না।

কিন্তু আপনারা বলবেন যে আমরা সবচেয়ে পবিত্র সম্পর্ক ধ্বংস করে দিই যখন আমরা পারিবারিক শিক্ষার স্থানে বসাই সামাজিক শিক্ষাকে।

আর আপনাদের শিক্ষাটা ! সেটাও কি সামাজিক নয়? সামাজিক যে অবস্থার আওতায় শিক্ষাদান চলে তা দিয়ে, সমাজের প্রত্যক্ষ কিংবা অপ্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ মারফত, স্কুল ইত্যাদির মাধ্যমে কি সে শিক্ষা নিয়ন্ত্রিত হয় না? শিক্ষা ব্যাপারে সমাজের হস্তক্ষেপ কমিউনিস্টদের উদ্ভাবন নয়; তারা চায় শুধু হস্তক্ষেপের প্রকৃতিটা বদলাতে, শাসকশ্রেণীর প্রভাব থেকে শিক্ষাকে উদ্ধার করতে।

আধুনিক যন্ত্রশিল্পের ক্রিয়ায় মজুরদের মধ্যে সকল পারিবারিক বন্ধন যত বেশি মাত্রায় ছিন্ন হতে থাকে, তাদের ছেলেমেয়েরা যত বেশি করে সামান্য কেনাবেচার বস্তু ও পরিশ্রমের হাতিয়ারে পরিণত হতে থাকে, ততই পরিবার ও শিক্ষা বিষয়ে বাপ-মার সঙ্গে ছেলেমেয়েদের পবিত্র পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে বুর্জোয়াদের বাগাড়ম্বর ঘৃণ্য হয়ে ওঠে।

সমস্ত বুর্জোয়া শ্রেণী সমস্বরে চিৎকার করে বলে – কিন্তু তোমরা কমিউনিস্টরা যে মেয়েদের সাধারণ সম্পত্তি করে ফেলতে চাও।

বুর্জোয়া নিজের স্ত্রীকে নিতান্ত উৎপাদনের হাতিয়ার হিসাবেই দেখে থাকে। তাই যখন সে শোনে যে উৎপাদনের হাতিয়ারগুলো সমবেতভাবে ব্যবহার করার কথা উঠেছে, তখন স্বভাবতই সে ধরে নেয় মেয়েদের‍ও সকলের ভোগ্য হতে হবে, এছাড়া আর কোনও সিদ্ধান্তে সে আসতে পারে না।

ঘুণাক্ষরেও তার মনে সন্দেহ জাগে না যে আসল লক্ষ্য হল উৎপাদনের হাতিয়ার মাত্র হয়ে থাকার দশা থেকে মেয়েদের মুক্তিসাধন।

তাছাড়া, মেয়েদের ওপর এই সাধারণ অধিকারটা কমিউনিস্টরা প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করবে এই ভান করে আমাদের বুর্জোয়ারা যে এত ধর্মক্রোধ দেখায় তার চেয়ে হাস্যাস্পদ আর কিছু নেই। মেয়েদের সাধারণ সম্পত্তি করার প্রয়োজন কমিউনিস্টদের নেই; প্রায় স্মরণাতীতকাল থেকে সে প্রথার প্রচলন আছে।

সামান্য বেশ্যার কথা না হয় ছেড়ে দেওয়াই হল, মজুরদের স্ত্রী-কন্যা হাতে পেয়েও আমাদের বুর্জোয়ারা সন্তুষ্ট নয়, পরস্পরের স্ত্রীকে ফুঁসলে আনাতেই তাদের পরম আনন্দ।

বুর্জোয়া বিবাহ হল আসলে অনেকে মিলে সাধারণ স্ত্রী রাখার ব্যবস্থা। সুতরাং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে বড় জোর এই বলে অভিযোগ আনা সম্ভব যে ভণ্ডামির আড়ালে মেয়েদের উপর সাধারণ যে অধিকার লুকানো রয়েছে সেটাকে এরা প্রকাশ্য আইনসম্মত রূপ দিতে চায়। এটুকু ছাড়া একথা স্বতঃসিদ্ধ যে আধুনিক উৎপাদন-পদ্ধতি লোপের সঙ্গে সঙ্গে সেই পদ্ধতি থেকে উদ্ভূত মেয়েদের উপর সাধারণ অধিকারেরও অবসান আসবে, অর্থাৎ প্রকাশ্য ও গোপন দুই ধরনের বেশ্যাবৃত্তিই শেষ হয়ে যাবে।

কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ যে তারা চায় স্বদেশ ও জাতিসত্তার বিলোপ।

মেহনিতদের দেশ নেই। তাদের যা নেই তা আমরা কেড়ে নিতে পারি না। সর্বহারাকে যেহেতু সর্বাগ্রে রাজনৈতিক আধিপত্য অর্জন করতে হবে, দেশের পরিচালক শ্রেণীর পদে উঠতে হবে, নিজেকেই জাতি হয়ে উঠতে হবে, তাই সেদিক থেকে সর্বহারা নিজেই জাতি, যদিও কথাটার বুর্জোয়া অর্থে নয়।

বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশ, বাণিজ্যের স্বাধীনতা, জগৎজোড়া বাজার, উৎপাদন-পদ্ধতি এবং তার অনুগামী জীবনযাত্রার ধরনে একটা সর্বজনীন ভাব -- এই সবের জন্যই জাতিগত পার্থক্য ও জাতিবিরোধ দিনের পর দিন ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে।

সর্বহারার আধিপত্য তাদের আরও দ্রুত অবসানের কারণ হবে। সর্বহারার মুক্তির অন্যতম প্রধান শর্তই হল মিলিত প্রচেষ্টা, অন্তত অগ্রণী সভ্য দেশগুলোর মিলিত প্রচেষ্টা।

যে পরিমাণে ব্যক্তির উপর অন্য ব্যক্তির শোষণ শেষ করা যাবে, সেই অনুপাতে এক জাতি কর্তৃক অপর জাতির শোষণটাও বন্ধ হয়ে আসবে। যে পরিমাণে জাতির মধ্যে শ্রেণীবিরোধ শেষ হবে, সেই অনুপাতে এক জাতির প্রতি অন্য জাতির শত্রুতাও মিলিয়ে যাবে।

ধর্ম, দর্শন এবং সাধারণ ভাবাদর্শের দিক থেকে সাম্যবাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয় তা গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হওয়ারও যোগ্য নয়।

মানুষের বৈষয়িক অস্তিত্বের অবস্থা, সামাজিক সম্পর্ক ও সমাজ জীবনের প্রতিটি বদলের সঙ্গে সঙ্গে তার ধারণা, মতামত ও বিশ্বাস, এককথায় মানুষের চেতনা যে বদলে যায়, একথা বুঝতে কি গভীর অন্তর্দৃষ্টি লাগে?

বৈষয়িক উৎপাদন পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুপাতে বৌদ্ধিক সৃষ্টির প্রকৃতিতেও পরিবর্তন আসে, এছাড়া চিন্তার ইতিহাস আর কী প্রমাণ করে? প্রতি যুগেই যে সব ধারণা আধিপত্য করেছে তারা চিরকালই তখনকার শাসক শ্রেণীরই ধারণা।

লোকে যখন এমন ধারণার কথা বলে যা সমাজে বিপ্লব আনছে, তখন শুধু এই সত্যই প্রকাশ করা হয় যে পুরনো সমাজের মধ্যে নতুন এক সমাজের উপাদান সৃষ্টি হয়েছে, এবং অস্তিত্বের পুরনো অবস্থার ভাঙনের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো ধারণার বিলোপ তাল রেখে চলছে।

প্রাচীন জগতের যখন অন্তিম অবস্থা, তখনই খৃস্টান ধর্ম পুরনো ধর্মগুলোকে পরাস্ত করেছিল। খৃস্টান ধারণা যখন আঠারো শতকে যুক্তিবাদী ধারণার কাছে হার মানে তখন সামন্ত সমাজেরও মৃত্যু সংগ্রাম চলেছিল সেদিনের বিপ্লবী বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে। ধর্মমতের স্বাধীনতা, বিবেকের মুক্তি শুধু জ্ঞানের রাজ্যে অবাধ প্রতিযোগিতার আধিপত্যটাকেই রূপ দিল।

বলা হবে যে “ঐতিহাসিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নিঃসন্দেহে ধর্মীয়, নৈতিক, দার্শনিক এবং আইনি ধারণাগুলোতে পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু সে পরিবর্তন সত্ত্বেও নিয়ত টিকে থেকেছে ধর্ম, নৈতিকতা, দর্শন, রাজনীতি ও আইন।”

“তাছাড়া স্বাধীনতা, ন্যায় ইত্যাদি চিরন্তন সত্য আছে, সমাজের সকল অবস্থাতেই তারা বিদ্যমান। কিন্তু সাম্যবাদ চিরন্তন সত্যকেই উড়িয়ে দেয়, ধর্ম ও নৈতিকতাকে নতুন ভিত্তিতে পুনর্গঠিত না করে তা সব ধর্ম ও সব নৈতিকতারই উচ্ছেদ করে; তাই তা ইতিহাসের সকল অতীত অভিজ্ঞতার পরিপন্থী।”

এই অভিযোগ কোথায় এসে দাঁড়ায়? সমস্ত অতীত সমাজের ইতিহাস শ্রেণী বৈরিতার বিকাশের মধ্যেই নিহিত, বিভিন্ন যুগে সে বিরোধ ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে।

কিন্তু যে রূপই নিক একটা ব্যাপার অতীতের সকল যুগেই বর্তমান যা হল সমাজের এক অংশ কর্তৃক অপর অংশকে শোষণ। তাই এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে অতীত যুগের সামাজিক চেতনায় যত বিভিন্নতা ও বৈচিত্রই প্রকাশ পাক না কেন, তা কয়েকটি নির্দিষ্ট সাধারণ রূপ বা সাধারণ ধারণার মধ্যেই আবদ্ধ থেকেছে, শ্রেণীবিরোধের সম্পূর্ণ লুপ্তির অাগে তা পুরোপুরি অদৃশ্য হতে পারে না।

কমিউনিস্ট বিপ্লব হল চিরাচরিত সম্পত্তি সম্পর্কের সঙ্গে একেবারে আমূল বিচ্ছেদ; এই বিপ্লবের বিকাশে যে চিরাচরিত ধারণার সঙ্গেও একেবারে আমূল একটা বিচ্ছেদ নিহিত, তাতে আর অশ্চর্য কী।

কিন্তু কমিউনিজমের বিরুদ্ধে বুর্জোয়া আপত্তির প্রসঙ্গ যাক।

আগে আমরা দেখেছি যে শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবে প্রথম ধাপ হল সর্বহারাকে শাসক শ্রেণীর পদে উন্নীত করা, গণতন্ত্রের সংগ্রামকে জয়যুক্ত করা।

বুর্জোয়াদের হাত থেকে ক্রমে ক্রমে সমস্ত পুঁজি কেড়ে নেওয়ার জন্য, রাষ্ট্র অর্থাৎ শাসক শ্রেণী রূপে সংগঠিত সর্বহারার হাতে উৎপাদনের সমস্ত উপকরণ কেন্দ্রীভূত করার জন্য এবং উৎপাদিকা-শক্তির মোট সমষ্টিটাকে যথাসম্ভব দ্রুত গতিতে বাড়িয়ে তোলার জন্য সর্বহারা তার রাজনৈতিক আধিপত্য ব্যবহার করবে।

শুরুতে অবশ্যই সম্পত্তির অধিকার এবং বুর্জোয়া উৎপাদন পরিস্থিতির ওপর স্বৈরাচারী আক্রমণ ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন হতে পারে না; সুতরাং তা করতে হবে এমন সব ব্যবস্থা মারফত যা অর্থনীতির দিক থেকে অপর্যাপ্ত ও অযৌক্তিক মনে হবে, কিন্তু যাত্রাপথে এই ব্যবস্থাগুলো নিজ সীমা ছাড়িয়ে যাবে এবং পুরনো সমাজব্যবস্থার ওপর আরও আক্রমণ প্রয়োজনীয় করে তুলবে; উৎপাদন-পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপ্লবীকরণের উপায় হিসাবে যা অপরিহার্য।

ভিন্ন ভিন্ন দেশে অবশ্যই এই ব্যবস্থাগুলো হবে বিভিন্ন।

তা সত্ত্বেও সবচেয়ে অগ্রসর দেশগুলোতে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো মোটের ওপর সাধারণভাবে প্রযোজ্য।

১।      জমি মালিকানার অবসান; জমির সমস্ত খাজনা জনসাধারণের হিতার্থে ব্যয়।
২।      উচ্চমাত্রার ক্রমবর্ধমান হারে আয়কর।
৩।      সবরকমের উত্তরাধিকার বিলোপ।
৪।      সমস্ত দেশত্যাগী ও বিদ্রোহীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।
৫।      রাষ্ট্রীয় পুঁজি ও নিরঙ্কুশ একচেটিয়া সহ একটি জাতীয় ব্যাঙ্ক মারফত সমস্ত ক্রেডিট রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীকরণ।
৬।      যোগাযোগ ও পরিবহনের সমস্ত উপায় রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীকরণ।
৭।      রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কলকারখানা ও উৎপাদন-উপকরণের প্রসার; পতিত জমির আবাদ এবং এক সাধারণ পরিকল্পনা অনুযায়ী সমগ্র জমির উন্নতিসাধন।
৮।      সকলের পক্ষে সমান শ্রমবাধ্যতা। শিল্পবাহিনীর গঠন, বিশেষত কৃষিকার্যের জন্য।
৯।      কৃষিকার্যের সঙ্গে যন্ত্রশিল্পের সংযুক্তি; সারা দেশের জনসংখ্যার আরও বেশি সমভাবে বণ্টন মারফত ক্রমে ক্রমে শহর ও গ্রামের প্রভেদ লোপ।
১০।     সরকারী বিদ্যালয়ে সকল শিশুর বিনা খরচে শিক্ষা। কারখানায় বর্তমান ধরনের শিশু-শ্রমের অবসান। শিল্পোৎপাদনের সঙ্গে শিক্ষার সংযুক্তি ইত্যাদি।

বিকাশের গতিপথে যখন শ্রেণী-পার্থক্য অদৃশ্য হয়ে যাবে, সমস্ত উৎপাদন যখন গোটা জাতির এক বিপুল সমিতির হাতে কেন্দ্রীভূত হবে, তখন সরকারী (পাবলিক) শক্তির রাজনৈতিক চরিত্র আর থাকবে না। সঠিক অর্থে রাজনৈতিক ক্ষমতা হল এক শ্রেণীকে দমন করার জন্য অপর শ্রেণীর সংগঠিত শক্তি মাত্র। বুর্জোয়া শ্রেণীর সঙ্গে লড়াইয়ের ভিতর অবস্থার চাপে যদি সর্বহারা নিজেকে শ্রেণী হিসাবে সংগঠিত করতে বাধ্য হয়, বিপ্লবের মাধ্যমে তারা যদি নিজেদের শাসক শ্রেণীতে পরিণত করে ও শাসকশ্রেণী হিসাবে উৎপাদনের পুরাতন ব্যবস্থাকে তারা যদি ঝেঁটিয়ে বিদায় করে, তাহলে সেই পুরনো অবস্থার সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণীবিরোধ তথা সবরকম শ্রেণীর অস্তিত্বটাই বিলোপ করবে এবং তাতে শ্রেণী হিসাবে তাদের স্বীয় আধিপত্যেরও অবসান ঘটাবে।

শ্রেণী ও শ্রেণীবিরোধের অস্তিত্ব সহ পুরনো বুর্জোয়া সমাজের স্থান নেবে এক সমিতি যার মধ্যে প্রত্যেকটি লোকেরই স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত।