বিপ্লবী পার্টি

“বিপ্লব কখনো সফল হতে পারে না বিপ্লবী পার্টি ছাড়া। যে পার্টি দৃঢ়ভাবে চেয়ারম্যান মাও সেতুঙ-এর চিন্তাধারার ওপর প্রতিষ্ঠিত, আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্ত যুবকের দ্বারা গঠিত, যে পার্টির অভ্যন্তরে পুরো গণতান্ত্রিক অধিকার আছে সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার এবং যে পার্টির সভ্যরা স্বেচ্ছায় ও স্বাধীনভাবে শৃঙ্খলা মেনে নিয়েছে, যে পার্টি শুধু ওপরের হুকুম মেনেই চলে না, স্বাধীনভাবে প্রত্যেকটি নির্দেশকে যাচাই করে এবং ভুল নির্দেশকে অমান্য করতেও দ্বিধা করে না বিপ্লবের স্বার্থে, যে পার্টির প্রত্যেকটি সভ্য নিজের ইচ্ছায় কাজ বেছে নেন এবং ছোট কাজ থেকে বড় কাজ সব কিছুকেই সমান গুরুত্ব দেন; যে পার্টির সভ্যরা নিজেদের জীবনে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শকে প্রয়োগ করেন, নিজেরা আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেন, আরও আত্মত্যাগে আরও কর্মোদ্যম বাড়াতে যে পার্টির সভ্যরা কোনো অবস্থাতেই হতাশ হন না, কোনো কঠিন পরিস্থিতি দেখেই ভয় পান না, দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যান তার সমাধানে – এরকম একটা পার্টিই পারে দেশের বিভিন্ন শ্রেণী ও মতের মানুষের ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গড়ে তুলতে। এই রকম একটি বিপ্লবী পার্টিই পারে ভারতবর্ষের বিপ্লবকে সফল করে তুলতে।”

(“এটাই বিপ্লবী পার্টি গড়ার সময়” – লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৬৭ থেকে)।

সিপিআই(এম এল)-এর ঐতিহাসিক শিকড়

আমাদের মনে রাখতে হবে, ভারতবর্ষের বিপ্লবী জনতা কমিউনিস্ট আন্দোলনে বার বার সংগ্রাম করেছেন, অসীম আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন, জীবন দিয়েছেন। পুন্নাপ্রা-ভায়ালার বীর শহীদরা, তেলেঙ্গানার বীর সংগ্রামীরা, ভারতের প্রতিটি প্রদেশের শ্রমিক ও কৃষক সংগ্রামীরা বহু জীবন দান করে যে ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই ঐতিহ্য বহন করে নিয়ে যেতে হবে আমাদের, আমরা তারই উত্তরসাধক। যে কমিউনিস্ট পার্টির নাম করে কায়ুরের বীরেরা ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিলেন, সেই কমিউনিস্ট পার্টিরই প্রতিনিধি আমরা, সেই কমিউনিস্ট পার্টিই আজকের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। সেই মহান ঐতিহ্যকে বহন করার জন্যই আজ আমাদের প্রয়োজন সেই মহান অভিজ্ঞতার সারসঙ্কলন করা এবং ভুল চিন্তাগুলির বিরুদ্ধে তীব্রতম শ্রেণীঘৃণার সৃষ্টি করা।

কমরেডগণ, মনে রাখবেন ভারতবর্ষে কৃষক জনতা বারবার সংগ্রাম করেছে, বহু ত্যাগ স্বীকার করেছে, বহু শহীদের দেশ এই ভারতবর্ষ। ... ভারতবর্ষের বিপ্লবী কৃষককে, দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষককে শ্রদ্ধা করতে শিখুন; তাদের ওপর ভরসা রাখলে কোনোদিন পথের ভুল হবে না।

(“ভারতের বিপ্লবী কৃষক সংগ্রামের অভিজ্ঞতার সারসঙ্কলন করে এগিয়ে চলুন” – লিবারেশন, ডিসেম্বর ১৯৬৯ থেকে)।

যুবদের প্রতি

দুশো বছরের পরাধীন ও শোষিত ভারতবর্ষে ছাত্র ও যুবকরাই হচ্ছেন শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি। সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ব্যাপক জনগণকে অশিক্ষিত ও অন্ধ করে রেখেছে। তাই বিপ্লবী আন্দোলনে এই শিক্ষিত সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। শতসহস্র শহীদ আজ আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁদের কাছে, আজ দিন এসেছে এই রক্তের ঋণ শোধ করবার, দিন এসেছে সাম্রাজ্যবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল শোষকশ্রেণীকে ধ্বংস করার।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) আহ্বান জানাচ্ছে যুব-ছাত্রদের কাছে দৃঢ় আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাও ঐ শ্রমিক এবং দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের কাছে, কারণ তারাই পারে এই লাঞ্ছনা, এই অবমাননার অবসান ঘটাতে।

ছাত্র যুবকদের কাছে পার্টির আজ একটিই আবেদন – শ্রমিক এবং দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের সাথে একাত্ম হও, একাত্ম হও, একাত্ম হও।

(“ছাত্র ও যুবকদের কাছে পার্টির আহ্বান”, লিবারেশন, সেপ্টেম্বর ১৯৬৯)।

শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি

সম্পদ সৃষ্টিকারী শ্রমিক ও কৃষক ঐক্যবদ্ধ হলে যে বিরাট শক্তির জন্ম হবে তাতে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করে শোষণকারী ও শোষণ ব্যবস্থা ধ্বংস করা যায় এবং এই ভারতবর্ষে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করার দায়িত্ব ও নেতৃত্ব নিতে হবে শ্রমিকশ্রেণীকে।

শ্রমিকের লড়াই – মর্যাদার লড়াই, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই। সংশোধনবাদীদের জঘন্যতম অপরাধ হল এই যে, তারা বিপ্লবের নেতা শ্রমিকশ্রেণীকে আটকে রাখতে চায় অর্থনীতিবাদী সংগ্রামের গণ্ডির ভেতর।

ভারতবর্ষের শ্রমিকশ্রেণী মুক্তির জন্য বহু জীবন আহুতি দিয়েছেন। বহু সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তাদের। শহীদদের রক্তরঞ্জিত বিপ্লবী পথে চলতে শ্রমিকশ্রেণী অভ্যস্ত। সংশোধনবাদীরা তাঁদের পথে লক্ষ্যভ্রষ্ট করেছে, তাই ভারতবর্ষের কোটি কোটি মানুষ আজও এই অসহ্য শোষণ ও নিপীড়ন সহ্য করছেন।

(“শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি”, লিবারেশন, মার্চ ১৯৭০)।

পার্টি ও যুক্তফ্রন্ট

আজ আমাদের কর্তব্য হচ্ছে ব্যাপক মূল জনগণের মধ্যে পার্টি গঠন করার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং লড়াইয়ের ভিত্তিতে জনগণের ব্যাপকতম অংশের সাথে যুক্তমোর্চা প্রতিষ্ঠা করা। কংগ্রেস রাজত্বের বিরুদ্ধে ব্যাপকতম যুক্তমোর্চা প্রতিষ্ঠা করা যায়। আজ বামপন্থী দলগুলি সাধারণ মানুষের প্রতি যে অত্যাচার কংগ্রেস চালাচ্ছে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে নেতৃত্ব দিচ্ছে না। সেই সব দলগুলির মধ্যকার শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনগণের তাদের দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ রয়েছে। ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের ভিত্তিতে আমাদের তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এমনকি যারা এক সময় আমাদের প্রতি শত্রুতা করেছে বিশেষ পরিস্থিতিতে তারাও আমাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে এগিয়ে আসবে। এই সব শক্তির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার মতো মনের প্রসারতা রাখতে হবে। মনের প্রসারতা কমিউনিস্টদের গুণ। জনগণের স্বার্থই আজ ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের দাবি জানাচ্ছে। জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ। (“জনগণের স্বার্থই পার্টির স্বার্থ” – এই লেখাটি চারু মজুমদার ১৯৭২ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েকদিন আগে লিখেছিলেন)।