দর্শন শাস্ত্রের মৌলিক প্রশ্নগুলির কীভাবে উদ্ভব হয়েছিল তা আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি। কিন্তু দর্শন শাস্ত্রের বিকাশে এমন একটা অবস্থার কথা ধরে নেওয়া হয় যেখানে জনগণের একটা অংশ প্রয়োজনীয় শ্রম করত না এবং শিল্প, বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে মনোনিবেশ করার যথেষ্ট অতিরিক্ত সময় তাদের হাতে ছিল। আদিম সাম্যবাদের শেষের দিকে নতুন উৎপাদিকা শক্তি আবিষ্কার (তামা প্রভৃতি) এবং সাথে সাথে শ্রম বিভাজন, বাণিজ্যের বিস্তার ইত্যাদি বিষয়গুলি প্রভূত পরিমাণে উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়, ফলে মানুষের শ্রমশক্তি নিজের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যা প্রয়োজন তার বেশি উৎপাদন করতে পারত। অতিরিক্ত শ্রমশক্তিকে কাজে নিয়োগ করা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার উপায় পাওয়া গেল। পূর্বে যে সব যুদ্ধবন্দীদের শুধু হত্যা করা হত, এবার থেকে তাদের বাঁচিয়ে রাখা হল ও তাদের শ্রমকে কাজে লাগানো হল। এইভাবে দাস-ব্যবস্থার সৃষ্টি হল এবং শীঘ্রই তা এরকম সকল সমাজেই উৎপাদনের প্রধান ধরন হয়ে দাড়ালো। সুতরাং এমন একটি বিশেষ শ্রেণীর উদ্ভব হল যারা প্রকৃত শ্রম থেকে মুক্তি পেয়েছে। “দাস ব্যবস্থা ছাড়া কোনো গ্রীক রাষ্ট্র, কোনো গ্রীক শিল্প ও বিজ্ঞান সম্ভব ছিল না। আমাদের কখনোই ভোলা উচিত নয় যে আমাদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিমত্তার বিকাশের অপরিহার্য শর্ত ছিল এমন একটা অবস্থা যেখানে দাসব্যবস্থা তার সর্বজনীন স্বীকৃতির মতোই প্রয়োজনীয় ছিল।” (এঙ্গেলস : এ্যান্টি ড্যুরিং)

এইভাবে গ্রীস, ইরান, ভারত, চীন ইত্যাদি দেশে দাসব্যবস্থার সময়েই বিভিন্ন রূপে দর্শন শাস্ত্র গড়ে উঠতে থাকে। এখানে আমরা কেবল গ্রীক দর্শন আলোচনা করব। কারণ এঙ্গেলস বলেছেন, “... ... পৃথিবীতে পরবর্তীকালের দৃষ্টিভঙ্গীর প্রায় সমস্ত ধরনগুলিই গ্রীক দর্শনের বহুবিধ রূপের মধ্যে ভ্রূণ আকারে এবং সদ্যোজাত অবস্থায় পাওয়া যায়।”

গ্রীক দর্শন হচ্ছে দ্বান্দ্বিক দর্শনের প্রথম ঐতিহাসিক রূপ যার মধ্যে দ্বন্দ্ব-তত্ত্ব তার আদিম রূপে দেখা যায়। যেহেতু ঐ সময়ে (খ্রিঃ পূর্ব ৭০০ – ৩০০ খ্রিষ্টাব্দ) গ্রীকরা প্রকৃতিকে কাটাছেঁড়া করা ও বিশ্লেষণ করার মতো যথেষ্ট অগ্রসর হতে পারেনি তাই সাধারণভাবে প্রকৃতিকে সমগ্র হিসাবে দেখা হত। উদাহরণ হিসাবে যদি আমরা প্রকৃতি বা মানুষের ইতিহাস বা আমাদের মানসিক ক্রিয়াকলাপের দিকে তাকাই তবে প্রথমেই আমরা অন্তহীন পারস্পরিক সংযোগ আর ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার এক অন্তহীন গোলকধাঁধা দেখতে পাই। এই গোলকধাঁধায় যেখানে যা ছিল বা যেভাবে ছিল তার কোনো কিছুই আর সেখানে বা সেভাবে থাকে না, বরং সবকিছু কেবলই এগিয়ে চলে, পাল্টে যায়। জন্ম নেয় আর বিনাশ লাভ করে। বিশ্ব সম্পর্কে এই আদি, সরল কিন্তু সঠিক ধারণা স্পষ্টভাবে সুসংবদ্ধ করেন হিরাক্লিটাস : “সবকিছু আছে আবার নেইও, কারণ সবকিছু প্রবহমান, সর্বদাই পরিবর্তনশীল, সর্বদাই উদ্ভূত হচ্ছে ও বিনষ্ট হচ্ছে।” গ্রীসের অপর এক বড় দার্শনিক এ্যারিস্টটল আগেই দ্বান্দ্বিক চিন্তাধারার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় রূপগুলি পরীক্ষা করেন। তাঁকে তর্কবিদ্যার জনক বলা হয়। এবং তিনি জ্ঞানের সমস্ত শাখায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

গ্রীক দার্শনিকদের মধ্যে বস্তুবাদী ও ভাববাদী উভয় দার্শনিকই আছেন, কিন্তু এখানে আমরা গ্রীক দর্শনের সমস্ত ধারাগুলি সম্পর্কে আলোচনায় যাচ্ছি না। আমরা গ্রীক দর্শনের মধ্যে দ্বান্দ্বিক চিন্তাধারার ইতিবাচক দিকগুলি নিয়ে এবং যে দুর্বলতাগুলি অধিবিদ্যাকে নিজের স্থান দখল করতে দিয়েছিল সেগুলি নিয়ে আলোচনা করব।

গ্রীক দর্শন অখণ্ডরূপে প্রকৃতির সাধারণ বর্ণনা সঠিকভাবেই করেছিল কিন্তু প্রকৃতির এক একটি অংশ বিশ্লেষণ করতে সক্ষম ছিল না। ঐ অংশগুলিকে জানার জন্য তাদের প্রাকৃতিক বা ঐতিহাসিক সম্পর্কগুলি থেকে বিচ্ছিন্ন করা প্রয়োজন এবং প্রত্যেকটি বৈশিষ্ট্য, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে পৃথকভাবে অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। এটাই হল প্রকৃতি-বিজ্ঞান এবং ইতিহাসের কাজ। কিন্তু গ্রীকদের এই কাজ করার মতো প্রয়োজনীয় উপকরণাদি ছিল না। এটাই হচ্ছে গ্রীক দর্শনের দুর্বলতা এবং এর থেকেই পরবর্তীকালে পৃথিবীতে দৃষ্টিভঙ্গীর অন্যান্য ধরনগুলি গড়ে ওঠে আলেকজাণ্ডারের সময়কাল থেকে (খ্রিঃ পূঃ ৩য় শতাব্দী থেকে ৭ম খ্রিষ্টাব্দ) গ্রীকদের হাতে প্রকৃতি বিজ্ঞানের কাজ শুরু হয়। ঐ সময় গণিত (ইউক্লিভ), বলবিদ্যা (আর্কিমিডিস), জ্যোতির্বিজ্ঞান, শবব্যবচ্ছেদবিদ্যা, শরীরবিদ্যা, ভূগোল এবং বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার দ্রুত উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীকালে মধ্যযুগে আরবদের হাতে প্রকৃতি-বিজ্ঞানের আরও উন্নতি ঘটে। খাঁটি প্রকৃতি-বিজ্ঞানের সূত্রপাত ঘটে পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগ হতে এবং এর পর থেকে গত পাঁচ-শ বছরে প্রকৃতি বিজ্ঞান ক্রমবর্ধমান গতিতে এগিয়ে চলেছে।

কিন্তু এই অগ্রগতির ভিত্তি কী ছিল? প্রকৃতিকে খণ্ডবিশেষে বিশ্লেষণ করা, ভিন্ন ভিন্ন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াসমূহ ও বস্তুসমূহের নির্দিষ্ট শ্রেণীবিভাগ করা, বিভিন্ন রূপের জৈবিক বস্তুর আঙ্গিক গঠন অধ্যয়ন করা -- এইগুলি ছিল আমাদের প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞানের জন্য বিপুল অধ্যয়নের প্রাথমিক শর্ত। কিন্তু এর ফলে পুরুষানুক্রমে যে অভ্যাস গড়ে ওঠে তা হল – প্রাকৃতিক বস্তুসমূহ ও প্রক্রিয়াগুলি পৃথকভাবে সাধারণ পটভূমি থেকে বিচ্ছিন্নভাবে পর্যবেক্ষণ করা, বস্তুসমূহকে গতিশীল অবস্থায় নয়, স্থিতিশীল অবস্থায় দেখা; তাদের জীবন্তভাবে না দেখে মৃতভাবে দেখা। এবং এটা অধিবিদ্যক চিন্তা পদ্ধতির জন্ম দেয়।

ষোড়শ শতাব্দীতে ব্রিটিশ দার্শনিক বেকন এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে আর একজন ব্রিটিশ দার্শনিক লক ঐ অধিবিদ্যক দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রকৃতি বিজ্ঞান থেকে দর্শনের মধ্যে নিয়ে আসেন এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ (মার্কসের সময়কাল) পর্যন্ত ঐ দৃষ্টিভঙ্গী একটা বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল।

মধ্যযুগে ইউরোপে ধর্ম দর্শনকে প্রায় হাজার বছর ধরে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল। হিবাশিয়াকে (Hibatia – ৪১৫ খ্রীষ্টাব্দে ইজিপ্টের আলেকজান্দ্রিয়ায় এক প্রসিদ্ধা গণিতজ্ঞা মহিলাকে) হত্যা করার সময় থেকেই এই পর্যায়ের শুরু। লাইব্রেরীগুলি পুড়িয়ে দিয়ে এবং বিশেষ আদেশ জারি করে রোমের সম্রাট দর্শন অধ্যয়ন করা বন্ধ করে দেয়। ইউরোপে রেনেসাঁর (পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে) আবির্ভাবে ঐ অবস্থার অবসান ঘটে। শহরের ধনিকশ্রেণীর সাহায্যে রাজপুরুষেরা সামন্ত প্রভুদের ক্ষমতা ধ্বংস করে এবং মূলত জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করে রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করে, এর মধ্য থেকেই আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্র ও আধুনিক বুর্জোয়া সমাজের বিকাশ ঘটেছে। যখন শহরের ধনিকশ্রেণী ও সামন্ত প্রভুরা পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত তখন জার্মানির কৃষক বিদ্রোহ, রঙ্গমঞ্চে কেবল বিদ্রোহী কৃষকদেরই নয়, হাতে লাল পতাকা আর কণ্ঠে সম্পদের সাধারণ মালিকানার দাবি নিয়ে আধুনিক সর্বহারাদের নামিয়ে দেয়; এবং এইভাবেই শ্রেণী সংগ্রামের পূর্বাভাস দেয়।

ইটালিতে শিল্পকর্মের অকল্পনীয় স্ফূরণ ঘটেছিল। ইটালি, ফ্রান্স ও জার্মানিতে নতুন সাহিত্য গড়ে উঠল। এর অনতিকাল পরেই চিরায়ত ইংরাজি ও স্প্যানিশ সাহিত্যের পর্যায় শুরু হয়। কুটির শিল্প থেকে বৃহৎ উৎপাদনে উত্তরণের এবং বিশ্বজোড়া বাণিজ্যের ভিত্তি প্রস্তুত হল আর এর থেকেই ঘটল আধুনিক শিল্পের সূচনা। মানুষের মনের উপর চার্চের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ধ্বসে পড়ল। আরবদের কাছ থেকে অর্জিত এবং বাইজানটিয়ানের পতনের সময়ে রক্ষাপ্রাপ্ত পাণ্ডুলিপি হতে নব-আবিষ্কৃত গ্রীক দর্শনের দ্বারা লালিত 'মুক্ত' চিন্তার এক উৎসাহী জীবন ক্রমেই বেশি বেশি করে লাতিনদের মধ্যে দানা বাঁধতে শুরু করে -- এটাই অষ্টাদশ শতাব্দীতে বস্তুবাদের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। মানবজাতির সেই সময় পর্যন্ত অভিজ্ঞতায় ঐটাই ছিল সর্বাপেক্ষা মহান বিপ্লব। তার মধ্য থেকে গড়ে উঠেছিল কিছু বিরাট ব্যক্তিত্ব যেমন, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, মেকিয়াভেলী, লুথার প্রভৃতি যাঁদের বর্তমান বুর্জোয়া শাসনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে।

সংগ্রামের মধ্য দিয়েই প্রকৃতি বিজ্ঞান নিজের অস্তিত্বের অধিকারকে জয় করে এবং এই জয় আসে অনেক শহীদের জীবনের বিনিময়ে। ইনকুইজিশন (চার্চের আদালত, যা স্বাধীনভাবে প্রকৃতির অনুসন্ধানকে নাস্তিকতা বলে দমন করত) সার্ভেন্টিস ও জিওর্ডানো ব্রুণোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারে। কিন্তু এইসব হত্যা সত্ত্বেও প্রকৃতি বিজ্ঞান তার অগ্রগতিকে অব্যাহত রাখে। কোপারনিকাসের অবিস্মরণীয় রচনার (সৌরজগত সম্পর্কিত) প্রকাশ ধর্মতত্ত্ব হতে প্রকৃতি বিজ্ঞানের স্বাধীনতা ঘোষণা করল।

প্রাচীন যুগ আমাদের দিয়েছে ইউক্লিভ ও টলেমির (Plolemire) সৌরজগতের ধারণা, আরবরা দিয়ে গেছে দশমিক পদ্ধতির ব্যবহার, বীজগণিতের সূচনা, আধুনিক সংখ্যাবিজ্ঞান এবং প্রাচীন রসায়নশাস্ত্র কিন্তু খ্রীষ্টিয় মধ্যযুগ কোনো অবদানই রাখেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একেবারে গোড়া থেকে শুরু করতে হয়েছিল। অনিবার্যভাবেই এই পরিস্থিতিতে মূল বিষয় হিসাবে পার্থিব ও নভোচরী বস্তুসমূহের গতি সম্পর্কিত বলবিদ্যা প্রথম স্থান অধিকার করে, এই যুগে বিজ্ঞানের ঐ শাখাগুলির অগ্রগতিতে নিউটন নির্দিষ্ট অবদান রাখেন। ডেকার্টে, নেপিয়ের, লিবনিজ গণিতশাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, কেপলার গ্রহের গতি সম্পর্কে সূত্র প্রণয়ন করেন, লিম্যুরাস উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণীবিদ্যার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নিয়মগুলি আবিষ্কার করেন।

কিন্তু ঐ পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য ছিল একটা বিশেষ ধরনের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গী, যার মর্মবস্তু হচ্ছে প্রকৃতির চরম অপরিবর্তনশীলতা। প্রকৃতি যেভাবেই সৃষ্টি হোক না কেন, অতীতে যে রকম ছিল যতদিন প্রকৃতি থাকবে সেই একই রকম রয়ে যাবে। গ্রহ ও উপগ্রহগুলি রহস্যময় কোনো “প্রথম ধাক্কা” দ্বারা একবার যে গতি পেয়েছিল তারপর তারা ঘুরতেই থেকেছে। সুতরাং বলতে হয় বর্তমানের “পাঁচটি মহাদেশ” চিরদিনই ছিল ও থাকবে, উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের প্রজাতিগুলি সৃষ্টি থেকেই চিরস্থায়ী -- এই রকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। প্রকৃতিতে সমস্ত পরিবর্তন ও বিকাশ অস্বীকার করা হল। প্রকৃতি বিজ্ঞান – যা প্রথমে এত বৈপ্লবিক ছিল, হঠাৎ তাকে রক্ষণশীলতার জালে আটকে পড়তে দেখা গেল। এটাই হচ্ছে যান্ত্রিক বস্তুবাদ – যা সমস্ত পরিবর্তনকে কেবলমাত্র স্থানের পরিবর্তন হিসাবে দেখে এবং শুধুমাত্র পরিমাণগত পরিবর্তনকেই স্বীকার করে।

১৭৫৫ সালে জার্মান দার্শনিক কান্ট প্রথম প্রকৃতি সম্পর্কে ঐ অনড় দৃষ্টিভঙ্গীকে আক্রমণ করেন। তাঁর “নীহারিকা প্রকল্প” “প্রথম ধাক্কার তত্ত্ব”কে খণ্ডন করে দেয়। পৃথিবী ও সৌরজগতকে মনে করা হল এমন একটা কিছু যা সময়ের গতিপথে সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি গড়ে ওঠা ভূতত্ত্ব পৃথিবীতে কিভাবে ভূস্তর গঠিত হয়েছে এবং একের পর এক সজ্জিত হয়েছে -- শুধুমাত্র এটাই নয়, আরও যা দেখালো তাহল ভূ-স্তরে চাপা পড়া বিপুল প্রাণীদের খোলা ও কঙ্কাল আর বিলুপ্ত উদ্ভিদের গুঁড়ি পাতা ও ফল। সুতরাং সিদ্ধান্ত করতে হল যে কেবলমাত্র সমগ্র হিসাবে পৃথিবীই নয়, পৃথিবীর বর্তমান উপরিস্তর এবং সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলির রয়েছে এক দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস।

প্রকৃতি বিজ্ঞানের একটা নির্দিষ্ট স্তরে অগ্রগতির ফলে অধিবিদ্যার আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী ছিল এবং একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে অধিবিদ্যা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল। বস্তুসমূহকে স্থির ও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিবেচনা করার ফলে তাদের জানার প্রক্রিয়ায় কিছুটা সাহায্য হয়েছিল। যাই হোক প্রকৃতি বিজ্ঞানের উপরোল্লিখিত বিকাশের ফলে অধিবিদ্যক দৃষ্টিভঙ্গী মারাত্মক ধাক্কা খেল, কিন্তু অভ্যাসের শক্তির বলে আরও কিছু সময় পর্যন্ত অধিবিদ্যার প্রাধান্য ছিল। এটার একমাত্র ব্যাখ্যা পাওয়া যায় শ্রমবিভাগের মধ্যে -- যা ঐ সময়ে প্রকৃতি বিজ্ঞান অধ্যয়নে প্রধান দিক হিসাবে ছিল? শ্রমবিভাগ কম বা বেশি মাত্রায় প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার বিশেষ কাজের মধ্যেই নিয়োজিত করে রেখেছিল, শুধুমাত্র কয়েকজনই ছিলেন যাদের একটা সামগ্রিক জ্ঞান থেকে সরিয়ে রাখা যায়নি।

ঊনবিংশ শতাব্দীর তিনটি বিরাট আবিষ্কার অবশেষে অধিবিদ্যার মৃত্যু-ঘণ্টা বাজিয়ে দিল আর প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে আন্তঃসংযোগ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের দ্রুত বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করল।

প্রথমটি হচ্ছে -- উদ্ভিদ এবং প্রাণীর একক হিসাবে কোষের আবিষ্কার। কোষের সংযোজন ও বিয়োজনের ভিতর দিয়েই সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীদেহের বিকাশ ঘটে। এইভাবে সমস্ত উচ্চতর জৈবিক পদার্থের বিকাশ ও বৃদ্ধি একটা সাধারণ নিয়মের অন্তর্গত বলে স্বীকার করা হল। এবং যেহেতু কোষের পরিবর্তনের ক্ষমতা আছে, তাই বোঝা গেল কিভাবে জৈবিক পদার্থ তাদের প্রজাতি পরিবর্তন করে।

দ্বিতীয় আবিষ্কার হচ্ছে -- শক্তির রূপান্তর। “যান্ত্রিক তাপ, আলো, তড়িৎ চৌম্বক ও রাসায়নিক শক্তি -- সব রকমের শক্তিই হচ্ছে গতির বিভিন্ন রূপ এবং তাদের একে অপরে রূপান্তরিত করা যায়।”

তৃতীয়টি হচ্ছে -- ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুসারে মানুষ সমেত সমস্ত জৈবিক পদার্থ হচ্ছে এককোষী জীবাণু থেকে বিবর্তনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফল। ঐ এককোষী জীবাণু আবার রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রোটিন হতে উৎপন্ন হয়েছে।

এই তিনটি মহান আবিষ্কারের ফলে, প্রকৃতিকে পুনরায় তার সর্বদা পরিবর্তনশীল অংশসমূহ ও তাদের মধ্যকার সব আন্তঃসম্পর্ক সমেত সামগ্রিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হল। এতদিন পর্যন্ত অধিবিদ্যা প্রধান স্থান অধিকার করেছিল দ্বন্দ্বতত্ত্ব সেই স্থান গ্রহণ করল।

সুতরাং আমরা আবাস গ্রীক দর্শনের মহান স্রষ্টাদের যে দৃষ্টিভঙ্গী ছিল সেই ধরনটিতে ফিরে গেলাম। গ্রীকদের সাথে আমাদের মূলত যে পার্থক্য তা হল – গ্রীকদের ক্ষেত্রে যা ছিল চমৎকার সহজাত বোধ আমাদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কঠোর বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফল। সুতরাং ঐ জ্ঞান আরও নির্দিষ্টভাবে ও সুস্পষ্টরূপে গড়ে উঠেছে। বিজ্ঞানের পরবর্তী আধুনিক আবিষ্কারগুলি যেমন, পরমাণুর মূল কণিকাগুলির আবিষ্কার বস্তু থেকে শক্তিতে (বস্তুর আর একটি রূপ) রূপান্তর, সাম্প্রতিককালের বিশ্বসৃষ্টির তত্ত্ব, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রভৃতি দ্বন্দ্বতত্ত্বকে আরও নিশ্চিত করে।

এঙ্গেলসের ভাষায়, “সুতরাং অন্য সমস্ত বিজ্ঞানের মতোই চিন্তার বিজ্ঞানও একটি ঐতিহাসিক বিজ্ঞান – মানব চিন্তার ঐতিহাসিক বিকাশের বিজ্ঞান। এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রগুলিতে চিন্তার বাস্তব প্রয়োগের প্রশ্নেও এর গুরুত্ব রয়েছে ...। এ্যারিস্টটলের সময় থেকে আজ পর্যন্ত ঔপচারিক তর্কবিদ্যা নিজেই তীব্র বাদানুবাদের মঞ্চ হিসাবে রয়েছে। এবং এ পর্যন্ত এ্যারিস্টটল আর হেগেল – কেবল এই দুজন চিন্তাবিদ দ্বন্দ্বতত্ত্বকে বেশ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। কিন্তু এই দ্বন্দ্বতত্ত্বই হল বর্তমান যুগে প্রকৃতি বিজ্ঞানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাপদ্ধতি; কারণ একমাত্র এটাই প্রকৃতি জগতের বিবর্তন প্রক্রিয়াগুলির, সাধারণভাবে আন্তঃসম্পর্কগুলির ও অনুসন্ধানের এক ক্ষেত্র থেকে অপর ক্ষেত্রে উত্তরণের প্রতিরূপ হাজির করে আর এই কারণেই এগুলিকে ব্যাখ্যা করার পদ্ধতিকেও সামনে আনে।” (এ্যান্টি ড্যুরিং-এর পুরনো ভূমিকা)