অজ্ঞেয়বাদ : প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞেয়বাদীদের ধারণা হল আগাগোড়াই বস্তুবাদী। তাঁদের মতে সমস্ত বিশ্বপ্রকৃতি নিয়মের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং বাইরে থেকে কোনো শক্তির হস্তক্ষেপকে তাঁরা পুরোপুরি নাকচ করেন। কিন্তু তাঁরা এটাও মনে করেন যে আমাদের জানা জগতের বাইরে কোনো উপায় আমাদের নেই। অজ্ঞেয়বাদীরা স্বীকার করেন যে আমাদের সমস্ত জ্ঞান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথ্যের উপর ভিত্তি করে আছে কিন্তু এ প্রশ্নও তাঁদের আছে “আমরা কিভাবে জানবো যে আমাদের ইন্দ্রিয়, বস্তু সম্বন্ধে আমাদের সঠিক বিবরণ দেয়?” এইভাবে কোনো বস্তু সম্পর্কে জানার ব্যাপারে তাঁরা যতদূর পর্যন্ত দাবি করেন ততদূর পর্যন্ত তাঁরা বস্তুবাদী এবং যে ক্ষেত্র সম্পর্কে তাঁরা কিছুই জানেন না সেইক্ষেত্রে তাঁরা ভাববাদী। তাঁদের মতে যে কেউ কোনো বস্তুর গুণকে (তার স্বাদ, বর্ণ, গন্ধ ইত্যাদি) সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে কিন্তু কেউ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা মনন প্রক্রিয়ার সাহায্যে সঠিকভাবে 'নিজের মধ্যে বস্তুকে' (thing in itself) উপলব্ধি করতে পারে না। যদিও এই দর্শনশাস্ত্র গ্রীস দেশে তৃতীয় এবং চতুর্থ খ্রিস্টাব্দে দেখা গিয়েছিল, কিন্তু কান্ট (১৭২৪-১৮০৪) এবং হিউম (১৭১১-৭৬) এটিকে পুনরুজ্জীবিত করেন। পরবর্তীকালের প্রত্যক্ষবাদীরা এই তত্ত্বকে বিকশিত করেন।

প্রত্যক্ষবাদ (Positivism) : ১৮৪০-এর দশকে ফরাসি বস্তুবাদ ও নাস্তিকতার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষবাদ দর্শনশাস্ত্রের একটি ধারা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। এই ধারা অনুযায়ী বৈজ্ঞানিক চিন্তার প্রধান কাজ হল “বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা”লব্ধ তথ্যগুলিকে সংগ্রহ করা এবং সেগুলিকে সাধারণীকরণ করা। আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে বাস্তব জগতের অস্তিত্ব আছে কি নেই কিংবা বস্তু মুখ্য না গৌণ, এই দার্শনিক সিদ্ধান্তে আমরা পৌঁছাতে পারি না। প্রত্যক্ষবাদীরা দর্শনশাস্ত্রের মধ্যে একটি তৃতীয় ধারা প্রবর্তনের দাবি করেন যা বস্তুবাদীও নয় ভাববাদীও নয় বরং উভয়ের থেকেই যা উন্নততর। আগস্ট কোঁৎ, জন স্টুয়ার্ট মিল, হারবাট স্পেনসার, আর্নস্ট ম্যাক, বারট্রান্ড রাসেল হলেন এই দর্শনশাস্ত্রের অগ্রণী প্রবক্তা -- যদিও গভীরে বিশ্লেষণ করলে তাঁদের নিজেদের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়।

নিয়তিবাদ (Deteriminism) : এটি হল অষ্টাদশ শতাব্দীর অমার্জিত যান্ত্রিক বস্তুবাদের একটি রূপ। এটি হল সেই সময় যখন আধুনিক প্রকৃতি বিজ্ঞান তার বিকাশের প্রথম পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। স্বাভাবিকভাবে এই সময়ে বিজ্ঞান একদিকে যেমন প্রকৃতির গতিশীল ভূমিকাকে ব্যাখ্যা করার স্তরে ছিল না, অপরদিকে তেমনই ধর্মীয় শৃঙ্খলকেও ছিন্ন করতে পারেনি। এর দৃষ্টিভঙ্গীটি হল : প্রকৃতি যেভাবেই সৃষ্টি হোক না কেন, একবার সৃষ্টি হওয়ার পর এর পরিবর্তন হয় না এবং এর মধ্যেকার প্রতিটি বস্তুকেই পূর্বনির্ধারিত ভূমিকা পালন করতে হয় এবং তারা এটা এড়িয়ে যেতে পারে না; বরং বলা যায় নিজেদের ভূমিকা এককভাবে পালন করার জন্য তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। উলফ যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন : ইঁদুরের সৃষ্টি হয়েছে কেবলমাত্র বিড়ালের খাদ্য হিসাবে এবং বিড়ালের সৃষ্টি হয়েছে ইঁদুরকে খাবার জন্য। স্পষ্টতই এই সম্প্রদায় নিষ্ক্রিয়তা প্রচার করে, সমস্ত ধরনের গতিশীলতার বিরোধিতা করে এবং নিজেদের সামাজিক জীবনের পরিবর্তন আনার জন্য জনগণের প্রচেষ্টাকে বাধা দেয়।

ব্যবহারিকতাবাদ (Pragmatism) : বিংশ শতাব্দীর গোড়াতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে উইলিয়াম জেমস (১৮৪২-১৯১০) এটির বিকাশ ঘটান। ব্যবহারিকতাবাদী বা প্রয়োগবাদীদের কাছে কোনো একটি মতবাদ, বিশ্বাস বা তত্ত্বের সঠিকতা নির্ভর করে পৃথিবীর উপর এর প্রয়োগের ফলাফল দ্বারা। তাই শুধুমাত্র ফলাফল এবং অভিজ্ঞতাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাঁরা দেখান যে যেহেতু শুধু বিশ্বাসেও রোগ সারে এবং কিছু লোকের ঈশ্বরের সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতা আছে তাই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা যায় না। অপরদিকে বিজ্ঞানের বিকাশকেও অস্বীকার করা যায় না যদিও তা কয়েকটি ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে পারেনি, তাই বিজ্ঞানকে সম্পূর্ণরূপে বাস্তুবানুগ হিসাবে গ্রহণ করা যায় না। তাই শুধুমাত্র ব্যবহারিকতার উপরই নির্ভর করাই ভালো, শুধুমাত্র সেই জ্ঞানকেই গ্রহণ করা উচিত যা বাস্তব বলে যাচাই ও প্রমাণ করা যায়। কিন্তু সেই জ্ঞানের উপর নির্ভর করা উচিত নয় যা নিছক তর্কশাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে আছে। এইভাবে তাঁরা ভাববাদ ও বস্তুবাদ উভয়কেই খণ্ডন করেন। একটি তৃতীয় বাস্তববাদী ধারার জন্ম দেওয়ার ভান করেন। মর্মবস্তুতে এই ধারা হল বস্তুবাদের একটি নতুন রূপ। ভাববাদের প্রতি এর সুচতুর ঝোঁক এটিকে বিংশ শতাব্দীর সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে।

অস্তিত্ববাদ (Existentialism) : এটি একটি চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী, নৈরাজ্যবাদী দার্শনিক ধারা, আজকের যুগে যার মূল প্রবক্তা ছিলেন জাঁ পল সার্ত্রে। অস্তিত্ববাদ ব্যক্তির অবাধ-বিকাশের ওকালতি করে এবং সমস্ত ধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার বিরোধিতা করে। যেহেতু সাম্রাজ্যবাদ শ্রমিকশ্রেণীর ব্যক্তিগত জীবনকে ধ্বংস করেছে, সাধারণ জনগণের একান্ত নিজস্ব জীবনকে ধ্বংস করেছে, তাই শ্রমিকশ্রেণী ও সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যক্তি স্বাধীনতার এক অকৃত্রিম আকাঙ্খা আছে। তাই দর্শনের এই ধারা ইউরোপীয় যুবকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কিন্তু এই অকৃত্রিম আকাঙ্খাকে কাজে লাগিয়ে এটি এক নৈরাজ্যবাদী তত্ত্ব হাজির করে। সেই জন্য সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তোলার পথে এটি বাধার সৃষ্টি করে।


দর্শনের চক্র

প্রাচীন : ডেমোক্রিটাস থেকে প্লেটো এবং হিরাক্লিটাসের দ্বন্দ্বতত্ত্ব পর্যন্ত।
রেনেসাঁ : দেকার্ত বনাম গ্যাসেন্দি (স্পিনোজা?)
অাধুনিক : হোল বাখ – হেগেল (বার্কেল, ইউম ও কান্টের মধ্য দিয়ে হেগেল-ফয়েরবাখ-মার্কস।


 

পাদটীকা :

১। পূর্বে সমস্ত (পশ্চিম ও মধ্য) ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি 'পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের' অধীনে ছিল। কিন্তু পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে যখন ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলিতে পুঁজিবাদের বিকাশ হতে শুরু করে, সেই সময় উঠতি বুর্জোয়াদের সাহায্যে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় রাজারা 'পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যে'র সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং এই জাতীয় রাষ্ট্রগুলি গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়। আমরা এখানে এই ঘটনারই উল্লেখ করেছি।

সংস্কার (Reformation) : রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে একটি ব্যাপক বিস্তৃত সামাজিক আন্দোলন যা ষোড়শ শতাব্দীতে অনেকগুলি ইউরোপীয় দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এটি ছিল পুঁজিবাদের বিকাশের একটি প্রকাশ। বেশিরভাগ দেশে তীব্র শ্রেণীসংগ্রামের সাথে সংস্কার মিশে গিয়েছিল। এই আন্দোলনের পতাকাতলে জার্মানির কৃষক যুদ্ধ (১৫২৪ – ১৫২৫ খ্রিঃ) চালানো হয়েছিল।

রেনেসাঁ : পঞ্চদশ, ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপে শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান দর্শন এবং জ্ঞানের অন্যান্য শাখার এক অভূতপূর্ব বিকাশের ফল। পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সেলজুক তুর্কীরা কনস্টান্টিনোপল দখল করে এবং এর ফলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের (যার রাজধানী ছিল কনস্টান্টিনোপল বা বাইজান্টিয়ান) পতন ঘটে। পুরনো গ্রীক পুঁজিগুলি সাথে নিয়ে বহু লোক পূর্ব অথবা মধ্য ইউরোপে পালিয়ে যায়। এই সময়ে, ইসলামের পতাকা হাতে আরব কর্তৃক স্পেন দখল এবং ইউরোপীয় রাজাদের দ্বারা স্পেনের বিরাট ভূখণ্ডের পুনরুদ্ধারের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবী সমাজ আরব দর্শনের সংস্পর্শে আসে। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে ভারত ও আমেরিকা আবিষ্কার হয়। পুঁজিবাদের দ্রুত বিকাশ ঘটে। ষষ্ঠদশ শতাব্দীর প্রথম ও মধ্যভাগে অনেকগুলি দেশে সংস্কার আন্দোলন দেখা যায়। এই বিষয়গুলিই রেনেসাঁর ভিত্তি গড়ে তোলে।

২। নব্য হেগেলীয় : এরা হলেন হেগেলর অনুগামী, যাঁরা দ্বান্দ্বিক বিষয়টির উপর জোর দেন। প্রথম দিকে মার্কস নিজেই ছিলেন 'নব্য হেগেলীয়'।

৩। টোরী এবং হুইগ : ব্রিটিশ বুর্জোয়াদের রক্ষণশীল অংশকে (যাদের সামন্ত প্রভুদের সাথে আঁতাত ছিল) টোরী বলা হত – এবং উদারনৈতিক অংশটিকে বলা হত হুইগ।

জিরান্দোঁ : অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ফরাসি বিপ্লবের সময় ফরাসি বুর্জোয়াদের যে দোদুল্যমান অংশটি রাজতন্ত্রের সাথে আপোষ করেছিল তাদের জিরাদোঁ বলা হত। তাদের এই নামে ডাকা হত এই জন্য যে তারা জিরান্দ প্রদেশ থেকে এসেম্বলীতে প্রতিনিধিত্ব করত।

জ্যাকোবিন : অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ফরাসি বুর্জোয়াদের এই বাম অংশটি দৃঢ়ভাবে স্বৈরতন্ত্র ও সামন্ততন্ত্রের বিলোপের পক্ষে ছিল।
এখানে আমরা পুঁজিবাদের বিকাশের পর্যায়ের দুটি ধারার কথা উল্লেখ করেছি। পরবর্তীকালে বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদের যুগে বুর্জোয়াদের জোট বাঁধাবাঁধির ক্ষেত্রে বড় বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে।