(১) লেনিন বলেছেন, “বিকাশ (বা গতি) হচ্ছে দুটি বিপরীতের সংগ্রাম।” বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গীতে, গতির মধ্যেই বস্তুর অস্তিত্ব। মহাজাগতিক গতি, বিভিন্ন গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যে ক্ষুদ্রতর বস্তুসমূহের যান্ত্রিক গতি, তাপ, চুম্বক বা তড়িৎ প্রবাহরূপে অণুর কম্পন, রাসায়নিক বিয়োজন বা সংযোজন, জৈব জীবন – বিশ্বের প্রতিটি বস্তুর প্রত্যেক পরমাণু, প্রতিটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে গতি কোনো না কোনো রূপের মধ্য দিয়ে অথবা একই সাথে কয়েকটি রূপের মধ্য দিয়ে চলেছে। সুতরাং এই বিশ্বে “চরম আত্মা” বা “সর্বত্র বিরাজমান ঈশ্বরের” অস্তিত্ব নেই, বিশ্বের কোনো “কোনো প্রথম ধাক্কারও প্রয়োজন হয়নি”। কিন্তু সমগ্র বিশ্ব গতিময় বস্তু ভিন্ন আর কিছু নয়।

প্রকৃতি বিজ্ঞান হতে জানা যায় যখন প্রাণের অস্তিত্ব বা মানবজাতি ছিল না তখনও বস্তুজগতের অস্তিত্ব ছিল। সুতরাং বস্তুজগতের অস্তিত্ব আমাদের চেতনা নিরপেক্ষ। পরিমাণগত পরিবর্তন হতে গুণগত পরিবর্তনের বিকাশের প্রক্রিয়ায় অজৈব বস্তু হতে জৈব জীবনের বিকাশ ঘটে এবং ক্রমে ক্রমে জৈব সত্তা থেকে মানুষের উদ্ভব হয়। সুতরাং সমগ্র বিশ্ব এবং মানুষের মস্তিষ্ক বস্তুর দ্বান্দ্বিক বিকাশের ফল। মস্তিষ্ক নিজেই হল বস্তুর সর্বোচ্চ বিকাশ। তাই চেতনার উদ্ভব বস্তু থেকেই।

সুতরাং বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী আমাদের অবশ্যই বাস্তব অবস্থা থেকে শুরু করতে হবে, অবশ্যই নির্দিষ্ট তথ্যাদি এবং বস্তুর মধ্যেকার বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রাম থেকে শুরু করতে হবে এবং আমাদের অবশ্যই মনোগত আকাঙ্খা অথবা ধার করা কোনো ফর্মুলা অনুযায়ী করা উচিত নয়।

(২) বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী বস্তু ও চেতনার মধ্যে বস্তুই মুখ্য ও চেতনা গৌণ। যা আমাদের ইন্দ্রিয়ের উপর ক্রিয়া করে অনুভূতি সৃষ্টি করে কিন্তু যার অস্তিত্ব আমাদের ইন্দ্রিয় বা অনুভূতি নিরপেক্ষ তাকেই বস্তু বলা হয়। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা বস্তুর কোনো একটি রূপ সম্পর্কে জানতে পারি কারণ “বিশুদ্ধ বস্তু” বলে কিছু নেই। যেমন ফলের অস্তিত্ব হিসাবে আমরা দেখি 'আম, আপেল, কলা' প্রভৃতি। কিন্তু শুধু ফল বলে কিছু নেই। সুতরাং 'বস্তু' হল বস্তুর বিভিন্ন রূপে সাধারণ দার্শনিক নাম – যেমন, বিভিন্ন ধরনের ফলের (আম, আপেল, কলা প্রভৃতি) সাধারণ নাম হল ফল।

চেতনা বা চিন্তা হচ্ছে মানুষের মনে বস্তু জগতের প্রতিফলন। এর একমাত্র উৎস বস্তু জগত। এটা হচ্ছে একটা দিক, অপর দিক হচ্ছে একবার চিন্তা বা চেতনার সৃষ্টি হলে তা আবার বস্তুর উপর প্রভাব ফেলে। কোনো বস্তু সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পর আমরা তার পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করি। উপরন্তু বস্তুগত অবস্থার পরিবর্তন ঘটলেও চিন্তা বা চেতনা সঙ্গে সঙ্গে অবলুপ্ত হয় না, বস্তুর বিকাশ ধারাকে প্রভাবিত করতে থাকে। সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্র উচ্ছেদ হওয়ার পর প্রধানত সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক চিন্তার বস্তুগত ভিত্তি মূলত বিলুপ্ত হয় কিন্তু এ সত্ত্বেও সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক চিন্তাগুলি থেকে যায় এবং সমাজের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। একইভাবে, নতুন বস্তুগত অবস্থার উৎপত্তি নতুন চেতনার জন্ম দেয় এবং এই নতুন চেতনা সমাজের বিকাশে নতুন গতি সঞ্চার করে। এই কারণে মার্কস বলেছেন, “যখন জনগণ কোনো ধারণাকে আঁকড়ে ধরেন তখন তা এক বস্তুগত শক্তিতে পরিণত হয়।”

সুতরাং বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী আমাদের “খাঁটি সর্বহারা” “খাঁটি কৃষক” “খাঁটি বুদ্ধিজীবীদের” সন্ধান করা উচিৎ নয়। কারণ “খাঁটি সর্বহারা” হল সর্বহারা শ্রেণীর বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যে যে সমস্ত গুণ দেখা যায় সেগুলির এক সাধারণ নাম এবং এটা “খাঁটি বুদ্ধিজীবীদের” ক্ষেত্রেও সত্য। এর বিপরীতে বিভিন্ন শ্রমিক ও কৃষক কর্মীদের তাঁদের গুণ অনুসারে কাজে লাগাতে আমাদের দক্ষ হতে হবে এবং এই সমস্ত কাজের সাধারণ নাম হল বিপ্লবী কাজ। একইভাবে “বিশুদ্ধ গণ-আন্দোলন” বা “বিশুদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রাম” এর কোনো অস্তিত্ব নেই। আসলে এগুলো হল গণ-আন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রামের বিভিন্ন রূপের সাধারণ নাম। ক্যাডারদের সঠিকভাবে পরিচালিত করা এবং যথাযথভাবে আন্দোলন চালানো বলতে আমরা এটাই বুঝি।

দ্বিতীয়ত আন্দোলন চলাকালে আন্দোলন থেকে উদ্ভূত নতুন চিন্তাগুলিকে ধারাবাহিকভাবে শুধু প্রচার করে গেলেই চলবে না এর সাথে সাথে পুরাতন ধারণাগুলির বিরুদ্ধেও লাগাতার সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। কেবলমাত্র তবেই আন্দোলনের বিকাশে বস্তুগত উল্লম্ফন ঘটানো যায়।

কেউ কেউ “বিশুদ্ধ ক্যাডার” ও “বিশুদ্ধ আন্দোলনের” খোঁজে ঘুরে বেড়ান, ফলে তাঁরা একটি ক্যাডারও রক্ষা করতে বা কোনো আন্দোলন পরিচালনা করতে সক্ষম হন না! তাঁরা নতুন বস্তুগত বিকাশ থেকে উদ্ভূত নতুন ধারণাগুলি আয়ত্ত করতে পারেন না এবং বাঁধাধরা একই ধরনের পুরাতন কথার পুনরাবৃত্তি করে চলেন। অপরদিকে অনেক সময়ে তাঁরা নতুন চিন্তার কথা বলে পুরনো চিন্তাগুলির “বস্তুগত উপস্থিতি” এবং আন্দোলনের বিকাশে ঐ পুরনো ধ্যান-ধারণার “বস্তুগতভাবে নেতিবাচক প্রভাবকে” অস্বীকার করেন। নির্দিষ্ট অবস্থা অনুসারে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনে বিভিন্ন ধরনের শক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো এবং পুরনো ধ্যানধারণার বস্তুগত অস্তিত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নতুন চিন্তার পতাকাকে তুলে ধরাটাই হল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বৈশিষ্ট্য।

৩। বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী বিশ্ব রহস্যময় এমন কিছু নয় যে তাকে জানা যাবে না, অনুশীলনের মধ্য দিয়েই বিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা যায়। মানবজাতির অনুশীলন প্রতিনিয়তই রহস্যের আবরণ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেছে।

অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ প্রথমে ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান অর্জন করে। এরপর তা থেকে পাওয়া তথ্যগুলিকে সাজানো, পুনর্গঠন করা ও বারবার চিন্তা করার মাধ্যমে সেইগুলি সংশ্লেষিত (synthesis) করে মানুষ যুক্তিগ্রাহ্য জ্ঞানে  উপনীত হয়। কিন্তু জ্ঞানের প্রক্রিয়া এখানেই শেষ হয়ে যায় না। জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়ার এটা প্রথম পর্যায় – বস্তু থেকে বিষয়ীগত চেতনায়, অস্তিত্ব থেকে চিন্তায় উপনীত হওয়ার পর্যায়। কোনো ব্যক্তির চেতনা বা চিন্তাধারা বাস্তব অবস্থার সঠিক প্রতিফলন ঘটাচ্ছে কিনা এই পর্যায়ে তা প্রমাণিত হয় না। এরপর আসে জ্ঞানলাভ প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্যায় – চেতনা হতে বস্তুতে, চিন্তা হতে অস্তিত্বে ফিরে যাওয়ার পর্যায়, কারণ অনুশীলনই হচ্ছে সত্যের একমাত্র মাপকাঠি। বারবার এই প্রক্রিয়া চালানোর মধ্য দিয়ে আমরা সঠিক ও নির্ভরযোগ্য জ্ঞানলাভ করতে পারি। কিন্তু যেহেতু বস্তুজগত নিজেই গতিময় তাই প্রায়ই আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে হয়। আর এই কারণে জ্ঞানের প্রক্রিয়া কখনও শেষ হয় না।

জ্ঞানের নির্ভরযোগ্যতা প্রসঙ্গে এঙ্গেলস লিখেছেন, “যদি কোনো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে নিজেরা নির্মাণ করে আমাদের ধারণাকে নির্ভুল বলে প্রমাণ করতে পারি এবং যদি অনুকূল পরিবেশে তাকে প্রস্তুত করে ও নিজেদের প্রয়োজন মতো ব্যবহার করে প্রমাণ করি, যখন কান্টের 'অজ্ঞেয় স্বয়ং সিদ্ধ সত্তা' সেই সঙ্গেই লোপ পায়। ... ... তিনশো বছর ধরে কোপারনিকাসের সৌরমণ্ডল সংক্রান্ত তত্ত্ব একটা অনুমান মাত্র ছিল। ... ... কিন্তু এই অনুমান থেকে সংগৃহীত তথ্যের সাহায্যে যখন লেভেরিয়ে একটা অজানা গ্রহের অস্তিত্বের অবশ্যম্ভাবিতা আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হলেন না, সৌরমণ্ডলে নিশ্চিতভাবে তার স্থান কোথায় তাও গণনার ফলে স্থির করলেন এবং গ্যাল সত্যই ঐ গ্রহকে খুঁজে বের করলেন তখন কোপারনিকাসের তত্ত্ব সত্যই বলে প্রমাণিত হল।”

সুতরাং অনুশীল হচ্ছে সমস্ত জ্ঞানের উৎস, সাঁতার শিখতে হলে অবশ্যই জলে ঝাঁপ দিতে হবে। একইভাবে বারবার অনুশীলনের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক সংগ্রাম ও সশস্ত্র সংগ্রাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান লাভ করা যায় এবং এই পর্যায়ে সংঘটিত ভুলত্রুটিগুলি জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়ারই অপরিহার্য অঙ্গ। সুতরাং দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ কাজে যুক্ত হতে, অনুশীল করতে এবং ঝড়-ঝঞ্ঝার সম্মুখীন হতে অনুপ্রাণিত করে; তা কখনোই আমাদের ভুলের ভয়ে কাজ থেকে বিরত করে না। উপরন্তু বস্তুবাদীরা সর্বপ্রথমে নির্দিষ্ট বাস্তব ঐক্য এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন, অপরদিকে ভাববাদে ভুগছেন যে সব ব্যক্তি, তারা বিমূর্ত তত্ত্ব বা ফর্মুলার গুরুত্ব আরোপ করেন এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় করা পরিহার করে চলেন।