প্লেখানভ অনুসৃত দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিগুলির দুর্বলতাগুলি তুলে ধরার সাথে সাথে লেনিন যার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন তা হল দ্বন্দ্বতত্ত্বের মর্মবস্তু হিসাবে বিপরীতের ঐক্যের নিয়ম। “প্রকৃত অর্থে দ্বন্দ্বতত্ত্ব হচ্ছে বস্তুসমূহের মূলে যে দ্বন্দ্ব রয়েছে তা অধ্যয়ন করা।” পরবর্তীকালে মাও সে তুঙ তাঁর সমৃদ্ধ রচনা 'দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে' শীর্ষক প্রবন্ধে দ্বন্দ্বতত্ত্বের এই মূল বিষয়টি সুশৃঙ্খল ও সামগ্রিকভাবে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। সুতরাং দ্বন্দ্বতত্ত্বের আলোচনায় আমরাও এই মূল বিষয়টি অর্থাৎ বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রাম বা দ্বন্দ্বের উপর মনোনিবেশ করব।

(১) দ্বন্দ্বসমূহ অর্থাৎ পরস্পর বিপরীত সত্তাসমূহ প্রকৃতি বা সমাজের ক্ষেত্রেই হোক অথবা মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রেই হোক, সর্বত্র এবং সকল প্রকার প্রক্রিয়ার মধ্যে উপস্থিত। বিপরীতের মধ্যকার সংগ্রামই কোনো প্রক্রিয়ার বিকাশের কারণ। এঙ্গেলস বলেছেন, “গতি নিজেই একটা দ্বন্দ্ব।” উদাহরণ হিসাবে বলা যায় –

গণিতের ক্ষেত্রে -- যোগ ও বিয়োগ, গুণ ও ভাগ।

তড়িতের ক্ষেত্রে - ধনাত্মক ও ঋণাত্মক।

সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে -- নতুন ও পুরাতন, অগ্রসর ও পশ্চাদপদ, ক্রীতদাস ও দাসমালিক, ভূমিদাস ও সামন্তপ্রভু, শ্রমিক শ্রেণী ও পুঁজিপতি শ্রেণী।

যুদ্ধক্ষেত্রে -- আক্রমণ ও আত্মরক্ষা, এগিয়ে যাওয়া ও পিছিয়ে আসা।

মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে -- বাস্তবতা ও কল্পনা।

এইরূপ আরও অনেক। অর্থাৎ প্রত্যেক ক্ষেত্রে ও প্রত্যেক প্রক্রিয়ায় দ্বন্দ্ব বা বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রাম শুরু থেকে শেষপর্যন্ত থাকে। সুতরাং অধিবিদ্যার প্রবক্তাদের “হ্যাঁ, হ্যাঁ” কিংবা “না, না” রীতি প্রয়োগের বিপরীতে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি কোনো বস্তু ঘটনা বা কোনো প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার ক্ষেত্রে কেবলমাত্র একটা দিক না দেখে বস্তু বা ঘটনার অন্তর্নিহিত বিপরীত সত্তাগুলি ও তাদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক পর্যবেক্ষণ করার দাবি জানায়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, যখন আমরা আমাদের জাতিকে অধ্যয়ন করি তখন তার মধ্যকার পরস্পর বিপরীত শ্রেণীগুলি এবং তাদের মধ্যেকার শ্রেণীসম্পর্ক অনুসন্ধান করা উচিত। শ্রেণীসংগ্রামের ক্ষেত্রে -- আইনি ও বেআইনি সংগ্রাম, গণআন্দোলন ও সশস্ত্র সংগ্রাম এবং উভয় প্রকার সংগ্রামের মধ্যকার সম্পর্ক সম্বন্ধে আমাদের অধ্যয়ন করা উচিত।

যেহেতু সকল বস্তু বা ঘটনার মধ্যে বিপরীতের সংগ্রাম উপস্থিত এবং বিপরীতের সংগ্রামের ফলেই বস্তুর বিকাশ এবং গতি সৃষ্টি হয়, তাই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি সব কিছু দেখার ক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভঙ্গী আয়ত্ত করতে বলে তা হল সব কিছুই সর্বদা গতিশীল, প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল ও সব কিছুরই উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। অধিবিদ্যা এই দৃষ্টিভঙ্গীর বিরোধিতা করে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের কথা ধরা যাক। ২০ বৎসর পূর্বে যখন এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে, তখন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তা পরিচালিত হয়েছিল, কারণ সে সময়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী ভূমিকাই জাতিসমূহের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার পক্ষে ভীতির কারণ ছিল। এই বৎসরগুলিতে সমগ্র বিশ্বপরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে এবং প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে; সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির আপেক্ষিক অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটেছে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ক্রমেই বেশি বেশি করে সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। যাদের দৃষ্টিভঙ্গী আধিবিদ্যক তাঁরা এই ঘটনাকে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের ধারণা হতে বিচ্যূতি বলে মনে করেন কারণ শুরুতে এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল মার্কিন এবং ঐ ব্যক্তিদের মতে আজও তাই থাকা উচিত। কিন্তু দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি অনুসারে পরিস্থিতির পরিবর্তন অনুযায়ী এই পরিবর্তন স্বাভাবিক।

উপরন্তু দ্বন্দ্ববাদ যে কোনো বিকাশকে তার মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের ফল হিসাবে বিশ্লেষণ করতে শেখায়। তাই পোল্যাণ্ডের শ্রমিকদের বিদ্রোহী হয়ে ওঠার মূল কারণ কখনই বিদেশী হস্তক্ষেপ হতে পারে না; মূল কারণ হল পোলিশ সমাজের মধ্যেই নিহিত দ্বন্দ্বসমূহ। সুতরাং 'বাহ্যিক কারণের তত্ত্ব' হাজির করা আধিবিদ্যক চিন্তাধারারই প্রকাশ।

(২) সকল বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়ায় দ্বন্দ্ব উপস্থিত এটা ঠিক, তবে তার অর্থ এই নয় যে প্রত্যেক বস্তুর বিকাশের প্রক্রিয়ায় একই দ্বন্দ্ব থাকবে। যদি তাই হত তবে বিশ্বে কেবলমাত্র একই ধরনের বস্তু থাকত। অর্থাৎ বস্তুর গতির কেবলমাত্র একটাই রূপ থাকত। কিন্তু আমরা বিভিন্ন ধরনের বস্তু ও প্রক্রিয়াসমূহ দেখতে পাই। প্রত্যেকটি বস্তু ও প্রক্রিয়ার মধ্যে তার নিজস্ব বিশেষ দ্বন্দ্ব অর্থাৎ বিশেষ ধরনের বিপরীত সত্তা উপস্থিত থাকে এবং তার ফলে ঐ বস্তু বা প্রক্রিয়াটি অন্য বস্তু বা প্রক্রিয়া থেকে ভিন্ন হয়। গম ও বার্লি -- প্রতিটির মধ্যে বিভিন্ন রূপের দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং এ কারণেই গম ও বার্লির মধ্যে রূপের ফারাক দেখা যায়। জ্ঞানের প্রতিটি শাখার মধ্যেই নিহিত থাকে তার বিশেষ দ্বন্দ্ব এবং এটাই তাকে জ্ঞানের অন্য শাখা থেকে পৃথক করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, গণিতের ক্ষেত্রে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক তড়িৎ, সমাজবিজ্ঞানে উৎপাদিকাশক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক এবং পরস্পর বিপরীত শ্রেণীগুলি, এবং দর্শনের ক্ষেত্রে ভাববাদ ও বস্তুবাদ, অধিবিদ্যা ও দ্বন্দ্বতত্ত্ব প্রভৃতি। প্রত্যেকটি সমাজব্যবস্থাতেই তার নিজস্ব দ্বন্দ্ব বর্তমান। দাস সমাজের দ্বন্দ্ব – দাস ও প্রভুদের মধ্যে, ধনতান্ত্রিক সমাজের দ্বন্দ্ব শ্রমিকশ্রেণী ও পুঁজিপতি শ্রেণীর মধ্যে। তাই অধিবিদ্যার বিপরীতে দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি দাবি করে যে সাধারণভাবে দ্বন্দ্বসমূহের অালোচনাই যথেষ্ট নয়; বরং যা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা হল প্রাকৃতিক বা সামাজিক যে কোনো বস্তু বা ঘটনার অন্তর্নিহিত এই বিশেষ দ্বন্দ্বটি অধ্যয়ন করা। যখন আমরা আমাদের জাতিকে অধ্যয়ন করি তখন কেবলমাত্র সাধারণ দ্বন্দ্বগুলিই নয় বরং সেই বিশেষ দ্বন্দ্বটিও অধ্যয়ন করা উচিত যা আমাদের জাতিকে অন্যান্য জাতি থেকে পৃথক করে। শুধুমাত্র সাধারণ শ্রেণীসংগ্রামই নয় বরং আমাদের দেশে শ্রেণীসংগ্রামের যে বৈশিষ্ট্য আছে তাও অধ্যয়ন করা উচিত; শুধুমাত্র সাধারণভাবে গণআন্দোলনগুলি অধ্যয়ন না করে প্রত্যেকটি গণআন্দোলনের মধ্যকার বৈশিষ্ট্যগুলিও অধ্যয়ন করা উচিত।

(৩) দ্বন্দ্বের বৈশিষ্ট্য স্বীকার করার অর্থ এই নয় যে প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র একটি বিশেষ দ্বন্দ্ব বিরাজ করে। দ্বন্দ্বতত্ত্ব আমাদের শেখায় যে কোনো একটি বস্তুর মধ্যে অনেকগুলি দ্বন্দ্ব উপস্থিত থাকতে পারে। কোনো বস্তুর মধ্যে দ্বন্দ্বের সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পেতে তাকে ততই তা সরল হতে জটিলতর হয়ে ওঠে। সুতরাং যে কোনো সময়েই কোনো বস্তু বা প্রক্রিয়ার মধ্যে যখন একাধিক দ্বন্দ্ব থাকে তখন অবশ্যই একটি দ্বন্দ্বই হয় প্রধান, যার উপস্থিতি ও বিকাশ অন্যান্য দ্বন্দ্বসমূহের উপস্থিতি ও বিকাশকে নির্ধারিত বা প্রভাবিত করে। এই প্রধান দ্বন্দ্বের সমাধানের মধ্য দিয়ে সেই বস্তু বা সমাজব্যবস্থা বা প্রক্রিয়া বিকাশের এক নতুন পর্যায়ে উপনীত হয়। সুতরাং দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি অনুসারে কোনো বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে অধ্যয়ন করার সময় তার মধ্যকার প্রধান দ্বন্দ্বটি খুঁজে বের করতে হবে এবং তার সমাধান করতে হবে। এটা করতে না পারলে আমরা কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যাব। (সমাজের ক্ষেত্রে প্রধান দ্বন্দ্ব নির্ণয় করার প্রশ্নটি 'ঐতিহাসিক বস্তুবাদ' অধ্যায়ে আলোচনা করব)।

(৪) প্রধান দ্বন্দ্বের সমাধানের জন্য পরস্পর বিপরীত দিকগুলির উভয়কেই অধ্যয়ন করা প্রয়োজন। দ্বন্দ্বতত্ত্ব অনুসারে যে কোনো দ্বন্দ্বেই অর্থাৎ এক জোড়া পরস্পর বিরোধী দিকের মধ্যে একটি প্রধান দিক থাকে ও অপরটি থাকে অপ্রধান দিক। মূলত দ্বন্দ্বের এই প্রধান দিকই বস্তুর প্রকৃতি নির্ধারণ করে। যে কোনো ব্যক্তির মধ্যেই ভালো এবং মন্দ উভয় দিকই আছে, যদি ভালো দিকটি প্রধান হয় তবে আমরা তাকে ভালো বলে থাকি। একটি দিক প্রধান বা কর্তৃত্বের ভূমিকায় থাকলেও অপ্রধান দিকটির উপস্থিতি সংগ্রাম ও গতির ধারাবাহিকতা সূচিত করে। বিশেষ অবস্থায় দ্বন্দ্বের দুটি দিক পরস্পর স্থান পরিবর্তন করে (আন্তঃপ্রবিষ্ট হয়)। অর্থাৎ প্রধান দিক অপ্রধান দিকে পরিণত হয় আর অপ্রধান দিক প্রধান হয়ে ওঠে। ভালো লোক খারাপ লোকে রূপান্তরিত হয়, সাহসী ভীরু হয়ে পড়ে এবং শোষিত শ্রেণী হতে আগত কোনো ব্যক্তি শোষকে রূপান্তরিত হয়। এখানে পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সামগ্রিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন। এর অর্থ কেবলমাত্র দ্বন্দ্বের দুটি দিকের পৃথক অধ্যয়নই যথেষ্ট নয়, ঐ দ্বন্দ্বটির সহিত অন্যান্য দ্বন্দ্বসমূহের সম্পর্কেও অধ্যয়ন করা দরকার এবং এই সম্পর্কের পরিবর্তন আর দুটি দিকের উপর পরিবর্তনগুলির মিলিত প্রভাবকেও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। অন্য কথায়, যে কোনো বস্তু বা ঘটনাকে অধ্যয়ন করতে হবে অন্যান্য বস্তু বা ঘটনার সঙ্গে তার পরিবর্তনশীল আন্তঃসম্পর্ক এবং তার নিজস্ব অবস্থানের ওপর এই আন্তঃসম্পর্কের প্রভাবের পরিপ্রেক্ষিত। সুতরাং কোনো দ্বন্দ্বের প্রধান ও অপ্রধান দিকের অবস্থান পরিবর্তন বোঝার জন্য সর্বপ্রথম যা প্রয়োজন তা হল সামগ্রিক বস্তুগত অবস্থার অধ্যয়ন।

সুতরাং বিশেষ অবস্থায় পরিবর্তনটি ঘটে দুটি দিকের আপেক্ষিক অবস্থানের মধ্যে। কিন্তু শুরুতেই এই পরিবর্তন ঘটতে থাকে খুব মন্থর গতিতে; পরিমাণগতভাবে। উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক কোনো ব্যক্তির ভালো ও মন্দ দিকের আনুপাতিক হিসাব ৭০ : ৩০। এই অনুপাত পরিবর্তিত হয়ে ৬০ : ৪০ হল। এই অবস্থায় ঐ ব্যক্তির প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই পরিবর্তন আপাতভাবে বোঝা যায় না অর্থাৎ এখনও ঐ ব্যক্তিকে আমরা ভালো বলব কারণ ভালো দিকটি এখনও প্রধান। কিন্তু বিকাশের প্রক্রিয়ায় ভালো ও মন্দ দিকের অনুপাত আমূল পরিবর্তিত হয়ে ৩০ : ৭০ হল। এখন পরিমাণগত পরিবর্তন রূপান্তরিত হল। অর্থাৎ দ্বন্দ্বের প্রধান ও অপ্রধান দিকের অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে -- অপ্রধান দিক প্রধান দিকের অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং প্রধান দিক অপ্রধান দিকে পরিবর্তিত হয়েছে। ব্যক্তিটির প্রকৃতিও পরিবর্তিত হয়েছে -- সে ভালো লোক থেকে মন্দ লোকে রূপান্তরিত হয়েছে। এই গণগত পরিবর্তনকে বিকাশের প্রক্রিয়ায় একটা উল্লম্ফনও বলা হয়। অধিবিদ্যা বিকাশের প্রক্রিয়ায় এরূপ উল্লম্ফনকে স্বীকার করে না। অধিবিদ্যক ধারণার সব পরিবর্তনই যান্ত্রিক ও পরিমাণগত।

সুতরাং অধিবিদ্যার বিপরীতে, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি দাবি করে যে শুধুমাত্র সাধারণ, বিশেষ এবং প্রধান দ্বন্দ্বের অধ্যয়নই যথেষ্ট নয়, আমাদের দ্বন্দ্বের দুটি দিক সম্পর্কেও অনুসন্ধান করা উচিত, সামগ্রিক পরিবর্তনশীল (গুণগত ও পরিমাণগত) পরিস্থিতির এবং ফলস্বরূপ দ্বন্দ্বের দুটি দিকের উপর তার ক্রিয়া কি হয় তার বিশ্লেষণ করা উচিত। সুতরাং একটি বিপ্লবী পার্টি সর্বদাই পরিবর্তনশীল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং দ্বন্দ্বের (জনগণ বনাম শাসকশ্রেণী) দুটি দিকের উপর তার ক্রিয়া বিশ্লেষণ করে এবং এইভাবে বিপ্লবী পার্টি সর্বদা তার লাইন কর্মনীতিগুলি বা শ্লোগানগুলি সমৃদ্ধ করে বা পরিবর্তন করে। (প্রসঙ্গত স্মরণ রাখতে হবে সে দ্বন্দ্বের দুটি দিকের পরিবর্তন আবার সামগ্রিক পরিস্থিতির উপর প্রভাব বিস্তার করে)। শ্রেণী সংগ্রামের ক্ষেত্রে শাসকশ্রেণীর শাসিতে এবং শাসিত জনগণের শাসকশ্রেণীতে পরিণত হওয়াটা একটা গুণগত পরিবর্তন। কিন্তু এটা একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া এবং এর মধ্যে সর্বদাই শাসক ও শাসিত জনগণের আপেক্ষিক অবস্থানের পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। শ্রেণীসংগ্রামের প্রক্রিয়ায় শাসকশ্রেণীর মধ্যে থেকেই স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির আবির্ভাব ঘটে এবং জনগণের বিভিন্ন অংশের সংগ্রাম এই শক্তির বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়, এখন যদি বিপ্লবী শক্তিগুলি দ্বন্দ্বের দুটি দিকের আপেক্ষিক অবস্থানের এই পরিমাণগত পরিবর্তন মূল্যায়ন না করেন, যদি স্বৈরতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে কেন্দ্রীভূত করার জন্য এবং ব্যাপক বিস্তৃত জনগণের যুক্তফ্রন্ট গড়ে তোলার জন্য তাদের কর্মনীতিগুলি ও স্লোগানগুলি সমৃদ্ধ না করেন তবে তাঁরা শ্রেণী সংগ্রামকে নেতৃত্ব দিয়ে শেষপর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না; অর্থাৎ তাঁরা গুণগত পরিবর্তনটি ত্বরান্বিত করতে সক্ষম হবেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চীন বিপ্লবে মাও-সে-তুঙ ও চারটি গোষ্ঠী (চিয়াং-কাইশেক, টি টি সুঙ, এইচ এইচ সুঙ, চেন-লি-ফু) এবং কুয়োমিন্টাঙের মধ্যকার কিছু কট্টরপন্থীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম কেন্দ্রীভূত করেন এবং সমস্ত শান্তিপ্রিয় গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক বিস্তৃত যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। সুতরাং দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির মধ্যে গোঁড়ামীবাদের কোনো স্থান নেই।

৫। দ্বন্দ্বের পরস্পর বিরোধী দুটি দিকের মধ্যে স্থানান্তর ঘটে থাকে -- তার অর্থ এই নয় যে সর্বদাই একই প্রধান ও অপ্রধান দিক স্থান পরিবর্তন করবে, যদি তাই হত তবে কোনো বস্তুর বিকাশ একই বৃত্তের চারিদিকে আবর্তিত হত। দ্বন্দ্বতত্ত্ব অনুসারে কোনো বস্তুর মধ্যে বিপরীতের সংগ্রামে সর্বদাই বিপরীতগুলি নিজেদের পরিবর্তন সাধন করে; যখন অপ্রধান দিকটি প্রধান দিকে পরিপর্তিত হয় তখন এক নতুন বস্তুর সৃষ্টি হয় এবং এর সাথে সাথে নতুন ধরনের দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়; অর্থাৎ নতুন এক জোড়া বিপরীত সত্তার আবির্ভাব ঘটে। পুরাতন প্রক্রিয়া শেষ হয় শুরু হয় এক নতুন প্রক্রিয়া। নতুন প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে নতুন দ্বন্দ্বসমূহ এবং এই প্রক্রিয়া তার দ্বন্দ্বগুলির বিকাশের নিজস্ব ইতিহাস শুরু করে। প্রত্যেকটি দ্বন্দ্বের সমাধান একই সাথে নতুন ধরনের দ্বন্দ্বের সূচনা বিন্দু। উদাহরণ হিসাবে কৃষকদের সংগঠিত করার কথাই ধরা যাক। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের বিররীত দিকগুলি দেখতে পাওয়া যাবে -- একদিকে দেখা যায় জমির উপর অধিকার লাভ করার জন্য কৃষকদের সংগঠন গড়ে তোলার আকাঙ্খা, অপরদিকে রয়েছে জমির উপর জমিদারদের মালিকানা; কৃষকদের সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা অপরদিকে জমিদারদের বাধা; কৃষকদের অসংগঠিত জীবন এবং সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা -- প্রভৃতি। সুতরাং অসংগঠিত কৃষকদের সংগঠিত করা একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া -- যে প্রক্রিয়ায় জমিদারদের আক্রমণ প্রতিরোধ করার মধ্য দিয়ে এবং সংগ্রাম চলাকালীন নিজেদে নৈরাজ্যবাদী ধারণাগুলি অতিক্রম করার মধ্য দিয়ে কৃষকরা নিজেদের সংগঠিত করেন এবং এ যাবৎকাল তাঁরা যে জমি চাষ করে এসেছেন তার মালিক হন। এরই সাথে সাথে জমিদার শ্রেণী নির্মূল হয়। এইভাবেই বিপরীত দিকগুলির স্থান পরিবর্তন ঘটে -- অসংগঠিত কৃষক সংগঠিত হয়, ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক হয়, শাসিত কৃষক শ্রেণী শাসক কৃষক শ্রেণীতে রূপান্তরিত হয় এবং অপরদিকে শাসক জমিদার শ্রেণী শাসিতে পরিণত হয়। গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন ঘটে এক নতুন সমাজ জন্মগ্রহণ করে। এই নতুন সমাজ ব্যবস্থায় পুরাতন দ্বন্দ্বগুলি অর্থাৎ পুরাতন বিপরীত সত্তাগুলি কিছু সময় পর্যন্ত থেকে গেলেও ক্রমশ তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর নতুন সমাজের সাথে উপস্থিত হয় নতুন দ্বন্দ্বসমূহ – জমির অধিকারী সংগঠিত কৃষক শ্রেণী ও পশ্চাদপদ কৃষি ব্যবস্থার দ্বন্দ্ব, কৃষক শ্রেণীর ক্রমবর্ধমান চাহিদা আর ভোগ্যপণ্যের ঘাটতির মধ্যে দ্বন্দ্ব, নতুন অবস্থায় কৃষকশ্রেণীর নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, নতুন ও পুরাতনের মধ্যে, আর অগ্রবর্তী ও পশ্চাদবর্তী অংশের মধ্যে দ্বন্দ্ব।

শ্রেণীসংগ্রামের ক্ষেত্রে, রাজনৈতিক সংগ্রাম ও সশস্ত্র সংগ্রাম – এই দুটি দিকও তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে, কোনো সময় প্রথমটি আবার কোনো সময় পরেরটি প্রধান দিক হয়ে ওঠে। কিন্তু স্থান পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়ায় দুটি দিকই নিজেদেরও পরিবর্তন করে। তাই এই পারস্পরিক পরিবর্তন বারবার একইভাবে ঘটে না। প্রত্যেকবারেই এই দুটি দিক অামাদের সামনে নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয়। তাই পুরাতন ধরনের সশস্ত্র সংগ্রাম বা পুরাতন ধরনের রাজনৈতিক সংগ্রামের যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তি আধিবিদ্যক ধারণারই প্রকাশ।

(৬) যদি বিকাশের প্রক্রিয়ায় পুরাতন দ্বন্দ্বসমূহ অন্তর্হিত হয় ও নতুন দ্বন্দ্বসমূহের আবির্ভাব ঘটে, যদি প্রকৃতি ও সমাজে এতো বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্বের সমাবেশ থাকে, তবে সব দ্বন্দ্বই কি আমরা একইভাবে সমাধান করতে পারি! অবশ্যই নয়। দ্বন্দ্বতত্ত্ব অনুসারে গুণগতভাবে পৃথক বিভিন্ন দ্বন্দ্বের সমাধানের পদ্ধতিও হবে গুণগতভাবে পৃথক। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সর্বহারা শ্রেণী ও বুর্জোয়া শ্রেণীর মধ্যকার দ্বন্দ্বের সমাধান হয় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দ্বারা, ব্যাপক জনগণ ও সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যকার দ্বন্দ্বের সমাধান ঘটে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে, উপনিবেশ সমূহ এবং সাম্রাজ্যবাদের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সমাধান হয় উৎপাদিকা শক্তিগুলির বিকাশ ঘটানোর সাহায্যে ইত্যাদি। তাই সমাজ বিকাশের প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে হলে শুধুমাত্র বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্বসমূহ জানাটাই যথেষ্ট নয়, আরও যা প্রয়োজন তা হল বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্ব – যেমন জনগণ ও শত্রুর মধ্যকার দ্বন্দ্ব, গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, অগ্রগামী সর্বহারা বাহিনী ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ইত্যাদি সমাধানে বিভিন্ন পদ্ধতি স্থির করা।

এ পর্যন্ত আমরা দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির কতকগুলি প্রধান বৈশিষ্ট্য আলোচনা করেছি। এক কথায় বলতে গেলে, লেনিন যেমনটি বলেছেন, “দ্বন্দ্বতত্ত্বের সারবস্তু হল একটি অখণ্ড বস্তুকে দুই ভাগে বিভক্ত করা এবং তার বিরোধী অংশগুলিকে জানা”। সুতরাং দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিকে “এক ভেঙ্গে দুই” এই ভাবেও বলা যেতে পারে। এই পদ্ধতি হল “হ্যাঁ, হ্যাঁ; না, না; হয় এটা নতুবা ওটা” এই অধিবিদ্যক পদ্ধতির একেবারে বিপরীত। এই পদ্ধতির জন্যই অধিবিদ্যা বিশ্বের পরিবর্তনগুলি ব্যাখ্যা করতে পারে না এবং কোনো বিপ্লবী আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিতে পারে না।

কিন্তু দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির অনুগামীদের মধ্যে কেউ কেউ 'বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রামের' উপর গুরুত্ব আরোপ করেন না। ঠিক এই কারণেই প্লেখানভ অনুসৃত পদ্ধতি সম্পর্কে লেখার সময় লেনিন এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, “সংক্ষেপে, দ্বন্দ্বতত্ত্বকে বিপরীতের ঐক্যের নিয়ম হিসাবে সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে। দ্বন্দ্বতত্ত্বের এটা শাঁস বা সারবস্তু কিন্তু এর ব্যাখ্যা ও বিকাশের প্রয়োজন আছে।” তাই লেনিন শুধুমাত্র নিয়মটির উপরই গুরুত্ব আরোপ করেননি, তিনি তার আরও ব্যাখ্যা ও বিকাশের প্রয়োজনের উপরেও গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অর্থাৎ লেনিন এই নিয়মটিকে আধিবিদ্যক পদ্ধতিতে নয়, দ্বান্দ্বিকভাবেই পর্যালোচনা করেছেন এবং এর আরও ব্যাখ্যা ও বিকাশের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এছাড়া মাও-সে-তুঙ তাঁর রচনার মধ্যে ঠিক এই কাজটিই করেছেন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই আমাদের নিত্য পরিবর্তনশী দুনিয়ায় ঐ নিয়মের ব্যাখ্যা এবং বিকাশের সমস্যাটি এখানেই শেষ হয়ে যায়নি।

উপরন্তু, যাঁরা বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রামের নিয়ম অনুসরণ করেন তাঁদের মধ্যে কিছু কিছু ব্যক্তি ঐক্যের উপর এমনভাবে গুরুত্ব আরোপ করেন যাতে এই নিয়মটিই তার বিপরীতে অর্থাৎ জগাখিচুড়ি মতবাদে (Eclecticism) পরিণত হয়। মাও সে তুঙ বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রাম প্রসঙ্গে বলেছেন, সকল বস্তুর মধ্যে গতির দুটি অবস্থা আছে, আপেক্ষিক নিশ্চলতা এবং দৃশ্যমান পরিবর্তন। উভয়ই বস্তুর মধ্যে নিহিত দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী উপাদানের মধ্যকার সংগ্রাম থেকে উদ্ভূত হয়। যখন বস্তুটি গতির প্রথম অবস্থাটিতে থাকে, তার আগেই প্রথম অবস্থাটির পরিমাণগত পরিবর্তন কোনো চরম বিন্দুতে পৌঁছে যায় এবং একটা একক বস্তুর বিয়োজন সংঘটিত করার এবং অবিলম্বে একটা গুণগত পরিবর্তন উদ্ভূত হয়; অতএব তার দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়। আমরা প্রাত্যহিক জীবনে যেরূপ একত্ব, সংহতি, সংযুক্তি, সামঞ্জস্য, সমক্রিয়া, অচলাবস্থা, বদ্ধাবস্থা, নিশ্চলতা, সুস্থিতি, ভারসাম্য, জমাট অবস্থা ও আকর্ষণের ধ্বংস এবং প্রত্যেকটির বিপরীতে পরিবর্তন – এসবই হল গুণগত পরিবর্তনের অবস্থায়, একটি প্রক্রিয়া থেকে অন্য প্রক্রিয়ায় রূপান্তরকালে বস্তুর বাইরের চেহারা। বস্তু সর্বদাই নিজেদের গতির প্রথম অবস্থা থেকে দ্বিতীয় অবস্থায় রূপান্তরিত করে চলেছে, আর উভয় অবস্থাতেই বিপরীতগুলোর সংগ্রাম চলতে থাকে, এবং দ্বন্দ্বের মীমাংসা হয় দ্বিতীয় অবস্থার মধ্যে দিয়ে। এজন্যই আমরা বলি যে, বিপরীতগুলোর একত্ব হচ্ছে শর্তসাপেক্ষ, অস্থায়ী ও আপেক্ষিক, আর পরস্পর ব্যতিরেকে -- বিপরীতগুলোর সংগ্রাম হচ্ছে অনাপেক্ষিক।

জগাখিচুড়ি মতবাদ কেবলমাত্র গতির প্রথম অবস্থাই বুঝতে পারে, তাই তা কোনো দ্বন্দ্বের সমাধান করতে পারে না।