নেকদিক থেকে বিচার করে বলা যায় যে, সাম্রাজ্যবাদ গ্রন্থে বর্ণিত সাম্রাজ্যবাদের মূল বৈশিষ্ট্যগুলো আজও বজায় রয়েছে। বরং আরও বেশি বেশি করে সেগুলো প্রকট হচ্ছে। লেনিনের সময়কার “ট্রাস্ট ও কার্টেলকে” ছাড়িয়ে গিয়েছে আজকের বহুজাতিক সংস্থাগুলো। “পণ্য রপ্তানির তুলনায় পুঁজি রপ্তানির ওপর অধিকতর গুরুত্ব প্রদান” আরও বেশি বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে শুধু তাই নয়, তা আরও নতুন নতুন আকার ধারণ করেছে – যেমন দেশ-দেশান্তরে পুঁজির অসম্ভব দ্রুতগতিতে চলাচল। সাম্রাজ্যবাদের “পরজীবী চরিত্রের” উল্লেখ করতে গিয়ে লেনিন দেখিয়েছিলেন, স্বল্প সংখ্যক “অগ্রসর” দেশগুলো এবং “আন্তর্জাতিক ব্যাঙ্কার দেশগুলো” তথা “সুদখোরী সাম্রাজ্যবাদ” কীভাবে বিশ্বের ব্যাপক সংখ্যাধিক জনগণের “গলায় আর্থিক ফাঁস পরিয়ে দিয়েছে”। আর আজ এই প্রবণতাই আরও বেশি প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে আই এম এফ, বিশ্বব্যাঙ্ক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাঙ্ক ইত্যাদির মাধ্যমে।

লেনিন শুধুমাত্র ব্যাঙ্ক পুঁজি এবং শিল্প পুঁজির সংমিশ্রণ এবং দৈত্যাকার ব্যাঙ্কগুলোর নতুন ভূমিকার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেই ক্ষান্ত থাকেননি। জমি, শেয়ার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে উদ্ভূত ফাটকাবাজির প্রবণতার কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন যা দেখা দিয়েছিল দ্রুত টাকা উপার্জনের সবচেয়ে লোভনীয় উপায় হিসাবে :

“… ধনতন্ত্রের বিকাশ আজ এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে পণ্য উৎপাদনের 'আধিপত্য' থাকলেও এবং তা অর্থনৈতিক জীবনের মূল ভিত্তি হিসাবে স্বীকৃত হলেও বাস্তবে তার গুরুত্ব অনেক হ্রাস পেয়েছে এবং মুনাফার সিংহভাগ যাচ্ছে পুঁজির ফাটকাবাজির 'প্রতিভাধরদের' কাছেই। এই সমস্ত ফাটকা এবং প্রতারণা টিকে আছে উৎপাদনের সামাজিকীকরণের ভিত্তিতে। কিন্তু মানবজাতির বিপুল অগ্রগতির ফলে অর্জিত এই সামাজিকীকরণের সুফল ভোগ করছে ... ফাটকাবাজরা”। (সাম্রাজ্যবাদ)

লেনিন উপনিবেশ এবং কাঁচামালের উৎসগুলো ইত্যাদির বলপূর্বক পুনর্বণ্টনের জন্য আন্ত-সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অবশ্যম্ভাবীতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি আরও লক্ষ্য করেছিলেন যে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সমঝোতা “যুদ্ধের জমি তৈরি করে আবার যুদ্ধের মধ্য থেকেই গড়ে ওঠে। একটি অপরটিকে প্রভাবিত করে, বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্ব রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী যোগসূত্রগুলোর ভিত্তিতেই দেখা দেয় কখনও শান্তিপূর্ণ, কখনও হিংসাত্মক সংগ্রাম”।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ঠিক এইভাবেই গোটা পৃথিবীর রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিকশিত হয়েছে এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিপ্রেক্ষিতে উপরোক্ত বক্তব্য এখনও প্রাসঙ্গিক।

কিন্তু সেই যুদ্ধ রাজনৈতিক আধিপত্যের রূপগুলোতে এবং আন্তর্জাতিক শক্তি-ভারসাম্যের ক্ষেত্রে এবং ফলস্বরূপ যুদ্ধ ও শান্তির প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদী খেলার নিয়মগুলোতেও কিছু বুনিয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। প্রথমত জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলোর তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরনো এবং ক্ষয়প্রাপ্ত সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি – যেমন গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালি ইত্যাদি – বাধ্য হল কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে শোষণ এবং আধিপত্যের পরোক্ষ পদ্ধতিগুলোর আশ্রয় নিতে। আমাদের মতো অনেক দেশ উপনিবেশ থেকে আধা-উপনিবেশে পরিণত হল – যেখানে সীমাবদ্ধ রাজনৈতিক স্বাধীনতা বেশ কয়েকটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অবাধ অর্থনৈতিক লুণ্ঠনকে আড়াল করে রাখতে সাহায্য করে। এইভাবে, দখলীকৃত উপনিবেশগুলোর পুনর্বণ্টনের জন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ – যা আধুনিক ইউরোপের ইতিহাসের প্রায় সবটাই জুড়ে ছিল এবং “সাম্রাজ্যবাদ” গ্রন্থে গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছিল – ঐতিহাসিক দিক থেকে তা পরিণত হল অতীতের বিষয়ে।

দ্বিতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুদ্ধে যে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকে এক “অতি বৃহৎ শক্তি” (একটি নতুন বর্গ) হিসাবে দেখা দিল। একই সঙ্গে কিছু “বৃহৎ শক্তি” (জার্মানি, ইতালি জাপান) ধ্বংসপ্রাপ্ত হল এবং অন্যান্যরা (বিশেষত ইংল্যান্ড এবং ফ্রান্স) অর্থনৈতিক, সামরিক এবং লোকবলের দিক থেকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল শুধু তাই নয়, উপনিবেশগুলোও তাদের হাতছাড়া হয়ে গেল। পরিস্থিতির এই সুযোগকে সবচেয়ে ভালোভাবে কাজে লাগালো আমেরিকা। কতকগুলো অর্থনৈতিক পদক্ষেপ (যেমন মার্সাল প্ল্যান, আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডার ও বিশ্বব্যাঙ্ক গঠন), ন্যাটো গঠনের মতো সামরিক উদ্যোগ, “লাল বিপদের” বিরুদ্ধে উচ্চমাত্রায় মতাদর্শগত অভিযান (পুঁজিপতিদের চোখে যার প্রাসঙ্গিকতা আরও বেড়ে গিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক চীন এবং কিউবার আত্মপ্রকাশের ফলে) ইত্যাদির মাধ্যমে এবং আরও অনেক পন্থা অবলম্বন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র পুঁজিবাদী দুনিয়ার ওপর এমনই এক আধিপত্য বা হেজেমনি – যা কর্তৃত্ব ও নেতৃত্বের যোগফল – বিস্তার করতে সক্ষম হল, আধুনিক ইতিহাসে যার নজির মেলা ভার। এক বাহ্যিক ঐক্য বিরাজ করতে লাগল। ধীরে ধীরে আধিপত্যবাদী “সোভিয়েত অতি বৃহৎ শক্তির” (আবার একটি নতুন বর্গ) উত্থান আন্ত-সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বগুলোকে সংযত রাখতে সাহায্য করল। সামরিক দিক থেকে, আণবিক অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপক বিস্তৃতি (যা ইতিহাসে এই প্রথম পৃথিবীর সমস্ত প্রাণের অস্তিত্ব কয়েক বার বিলুপ্ত করে দেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে) পারস্পরিক প্রতিষেধক বা “মিউচ্যুয়াল ডেটারেনস” এবং “ঠাণ্ডা যুদ্ধের” মতো অনেক অভিনব তত্ত্বের জন্ম দেয়। অবশ্য অনুন্নত দেশগুলোর বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, পুরনো ধাঁচের যুদ্ধও থাকে অব্যাহত।

কিন্তু এই সমস্ত পরিবর্তনের পিছনেও মূল অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে। লেনিন বৃহৎ কর্পোরেশনগুলোর বৃহৎ মুনাফার উৎস হিসাবে “যুদ্ধচুক্তিগুলো”র কথা উল্লেখ করেছিলেন। আজকে আমরা সর্বাত্মক সমর-অর্থনীতি এবং “সামরিক-শিল্পীয় জোট” (মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার প্রথম এই কথাটি ব্যবহার করেছিলেন) দেখতে পাচ্ছি। আমরা এমনকি “সামরিক কেইনসবাদ”-এর কথা শুনছি – যেখানে যুদ্ধ বাধিয়ে প্রথমে যুদ্ধ সম্পর্কিত শিল্পগুলিকে চাঙ্গা করা এবং তারপর সেই চাঙ্গাভাব গোটা অর্থনীতিতে ছড়িয়ে দেওয়ার ওকালতি করা হচ্ছে। মার্কিন সমরবাদী মহলে, বিশেষত রিপাবলিকানদের মধ্যে এই রণনীতি খুবই জনপ্রিয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে সোভিয়েত শিবিরের পতনের ফলে। যেসব আন্ত-সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব আগে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রকাশ পেত, এই বাধা অন্তর্হিত হওয়ার পরে তা রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করেছে। তবে এই প্রক্রিয়া চলে খুব ধীর গতিতে – সাম্প্রতিক ইরাক যুদ্ধের আগে এবং যুদ্ধ চলাকালে এর লক্ষণগুলো সামনে আসে। ক্রমবর্ধমান মার্কিন ঔদ্ধত্য এবং একাধিপত্যের ফলে এই দ্বন্দ্বগুলো আরও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। অবশ্য অদুর ভবিষ্যতে তার সামরিক সংঘাতের চেহারা নেওয়ার সম্ভাবনা নেই। বরং ফ্রান্স এবং জার্মানি যে সংকীর্ণ আত্মস্বার্থের বশবর্তী হয়ে ইরাকে ইঙ্গ-মার্কিন আগ্রাসনের বিরোধিতা করেছিল তা তাদের গডফাদারকে খুশি রাখতেও বাধ্য করেছে। এজন্যই তো যুদ্ধ-পরবর্তীকালে ইরাক থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার প্রস্তাব রাষ্ট্রসংঘে সর্বসম্মতিক্রম গৃহীত হতে পারল।

এর পরের বছরগুলোতে আন্ত-সাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের কোনো উল্লেখয‍োগ্য বৃদ্ধি দেখা যায়নি। তবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ইউরোর আবির্ভাব ঘটেছে, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ও বাজেট ঘাটতিও লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে আর মার্কিন শিল্পের প্রতিযোগিতার ক্ষমতাও যথেষ্টমাত্রায় হ্রাস পেয়েছে (বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম-এর বিশ্বে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা সূচক সেপ্টেম্বর ২০০৬ দেখুন); এইগুলো সম্মিলিতভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ার ওপর মার্কিনের অর্থনৈতিক আধিপত্য ধীরে ধীরে খর্বিত হচ্ছে এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিপ্রেক্ষিতে তার গুরুতর রাজনৈতিক পরিণাম আমরা দেখতে পারি।

সবশেষে উল্লেখ্য, সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজির কার্যধারায় বিশাল পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে (এবং হয়ে চলেছে)। কিন্তু বিষয়টি এতই সুবিশাল যে তা এখানে আলোচনা করার সুযোগ নেই।