(পঞ্চম পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

বিগত কয়েক বছর ধরে সাম্প্রদায়িক উত্তাপ বেড়েই চলেছে। বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়ার পর দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক হিংসার তাণ্ডবে হাজারে হাজারে মানুষ মারা যাওয়ায় ও জখম হওয়ায় সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নেহরুর অর্থনৈতিক মডেলের পতন এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি জনগণের ক্রমবর্ধমান বিরক্তি ও জাতীয় ঐক্যের প্রতি প্রকৃত ও কাল্পনিক বিপদ এবং দক্ষিণপন্থা ও মৌলবাদের উত্থানের এক আন্তর্জাতিক মতাদর্শগত পরিমণ্ডল, এই বহুমুখী কারণগুলিই সাম্প্রদায়িক মতাদর্শ ও রাজনীতির উত্থানের এক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে অবদান জুগিয়েছে। এর ওপর কংগ্রেস(ই), জনতা দল, সিপিআই এবং সিপিআই(এম)-এর মতো সমস্ত মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলি বিজেপির প্রতি বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে যে ধরনের সুবিধাবাদী রাজনৈতিক আচরণ করেছে তাতে বিজেপির ফুলে ফেঁপে ওঠার পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে।

এটি পরিষ্কারভাবে বুঝে নেওয়া দরকার যে, রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ বিতর্ক হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো সাধারণ মন্দির-মসজিদ বিতর্ক নয়। আরএসএস এবং বিজেপির চতুর নেতৃবৃন্দ এযাবৎকাল বাবরি মসজিদকে এভাবেই তুলে ধরেছেন যে, বাবরি মসজিদ হল বহিরাগত মুসলমানদের হিন্দু ভারত আক্রমণের স্মৃতিসৌধ এবং হিন্দু গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য এর ধ্বংসের প্রয়োজন। এইভাবে রাম জন্মভূমি আরএসএস-এর দীর্ঘমেয়াদী হিন্দুরাষ্ট্র মতাদর্শের একটি নির্দিষ্ট প্রতীকে পরিণত হয় এবং সরলমনা হিন্দু জনগণের একটি বৃহৎ অংশকে আকৃষ্ট করে। এভাবে সংঘ পরিবারের সুকৌশলী নেতৃত্বে এবং সংগঠিত প্রচেষ্টায় রাম জন্মভূমিকে ধরে প্রকৃতই এক গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। ধর্মীয় মুখোশের আড়ালে এর মূল বিষয়বস্তু হল রাজনীতি ও মতাদর্শ। রামের নাম নিয়ে বিজেপি দ্রুতই দেশের কোণে কোণে পৌঁছে যায় এবং খুব কম সময়ের মধ্যে প্রধান বিরোধীদলে পরিণত হয়ে ওঠে। চারটি রাজ্যে ক্ষমতায় আসার সাথে সাথে স্কুলগুলিকে হিন্দুরাষ্ট্রের মতাদর্শের প্রচার কেন্দ্রে পরিণত করার লক্ষ্যে আরএসএস দ্রুতই স্কুলের পাঠক্রম পাল্টাতে শুরু করে দেয়।
মার্কসবাদী ও অন্যান্য বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক ভাবাদর্শের পশ্চাদপসরণ তথা কংগ্রেস(ই)-র বিশ্বাসযোগ্যতায় বড় আকারের ধ্বস নামার ফলে দেশে যে মতাদর্শগত-রাজনৈতিক শূন্যতা গড়ে উঠেছে তারই সুযোগ নিয়ে বিজেপি সাহসের সাথে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট বিকল্প হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে।

বুর্জোয়া ও জমিদারদের সর্বাপেক্ষা রক্ষণশীল অংশের প্রতিনিধিত্বমূলক চিন্তাধারা ফ্যাসিবাদ স্বভাবতই আক্রমণাত্মক। একটি-দুটি রাজ্যে শাসন ক্ষমতা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার দল বিজেপি নয়। কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের জন্য পরবর্তী লাফ দিতে সে মরীয়া। তাই সে অযোধ্যা ইস্যুতে চাপ বজায় রেখেছে এবং বাবরি মসজিদকে ভেঙ্গে দেওয়ার পর তার পরবর্তী নিশানা এখন কাশী ও মথুরাতে মুসলিম ধর্মস্থানগুলিকে ধুলিসাৎ করে দেওয়া।

এই সাম্প্রদায়িক আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে শাসক দল ও সরকারপন্থীরা উদারনৈতিক হিন্দু অবস্থান থেকে আবেদন নিবেদন ও আইনি পথের আশ্রয় নেওয়ার মধ্যেই আটকে রয়েছে। মূলধারার বামপন্থীদের প্রতিক্রিয়াও এই চৌহদ্দির বাইরে যেতে পারেনি এবং শেষ পর্যন্ত তারা যে স্লোগান নিয়ে আসে তা হল – মন্দিরও হোক, মসজিদও থাকুক – সবাই আইন মেনে চলুক। মার্কস বেঁচে থাকলে মন্তব্য করতেন যে ভারতবর্ষ এমন এক দেশ যেখানে সমস্ত লড়াই, তা সে শ্রেণীগুলির মধ্যকারই হোক কিংবা বিভিন্ন ধ্যানধারণার মধ্যকারই হোক, শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় গিয়ে শেষ হয়। ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।

অনেক মানুষই বিজেপির আর এক ধরনের প্রচারধারায় প্রভাবিত হন যে হিন্দুপ্রধান দেশ বলেই ভারতবর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ হতে পেরেছে। এর মধ্যে প্রচ্ছন্ন যে ইঙ্গিত আছে তা হল ইসলাম ধর্মের অন্তর্নিহিত মৌলবাদের তুলনায় হিন্দু ধর্ম কত সহিষ্ণু ও উদার।

প্রথমত, অযোধ্যার ঘটনাপরম্পরা বেশ ভালোভাবেই এই কল্পকথার অসারতাকে প্রমাণ করে দিয়েছে। অযোধ্যাকে তথাকথিত হিন্দু ভ্যাটিকান বানিয়ে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আদলে হিন্দু ধর্মকে এক সংগঠিত রূপ দেওয়ার সাথে সাথে হিন্দু ধর্মের মহন্তরাও অন্য যে কোনো ধর্মের মৌলবাদীদের মতোই ধর্মান্ধ ও ধর্মোন্মত্ত হিসেবে বেরিয়ে এসেছেন।

দ্বিতীয়ত, ধর্মনিরপেক্ষতার ভারতীয়করণের নামে ভারতের আধুনিক সমাজচিন্তাবিদরা সমস্ত ধর্মের ইতিবাচক আত্তীকরণ বা ‘সর্ব ধর্ম সমভাবের’ যে ধারণা নিয়ে এসেছেন তার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার কোনো সম্পর্কই নেই। ধর্মনিরপেক্ষতার প্রকৃত অর্থ হল, রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ পরিচালনার সঙ্গে ধর্মের কোনো সংশ্রব না রাখা।

তৃতীয়ত, সর্বত্র ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এক সফল গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ফসল হিসাবেই জন্ম নিয়েছে এবং ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে লঘু করে দেওয়ার পিছনে যে বাধ্যবাধকতা কাজ করছে তা ভারতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অসমাপ্ত চরিত্র সম্পর্কে আরও এক স্বীকারোক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। কোনো ধর্মের গোঁড়া অথবা উদারনৈতিক রূপের প্রাধান্যমূলক অবস্থান গ্রহণ যে কোনো নাগরিক সমাজের বিবর্তনের স্তরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। গোঁড়ামিপূর্ণ থেকে উদারনৈতিক স্তরে খ্রীষ্টধর্মের বিবর্তন কিংবা খালিস্তানের উত্থানের সাথে সাথে আপাত উদার শিখধর্মের গোঁড়ামিপূর্ণ হয়ে ওঠা – এ সবই এই সামাজিক নিয়মের দৃষ্টান্ত।

উদারনৈতিক হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়াতে মর্মাহত কারণ তা হিন্দু মতবাদের বিরুদ্ধ-কাজ বলে মনে করা হচ্ছে। একইসঙ্গে তাঁরা এই ভেবে অবাক হন যে মুসলিম নেতৃবৃন্দ কেন এই জরাজীর্ণ কাঠামোর উপর তাঁদের দাবি ছেড়ে দিচ্ছে না, বিশেষত সেই কাঠামোটি যখন আর মসজিদ হিসাবে ব্যবহৃত হয় না। তাদের সুবিধামতো তাঁরা এটা ভুলে যান যে মুসলমান জনগণের কাছেও বাবরি মসজিদ ভারতবর্ষের জটিল সামাজিক-ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে তাঁদের ঐতিহ্য ও অস্তিত্বের প্রতীকস্বরূপ এক স্মারক হয়ে উঠেছে।

ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের সাধারণ মানুষের থেকে বিচ্ছিন্নতার দরুণ সাম্প্রদায়িক আক্রমণের মুখে তাঁরা সহজেই আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন এবং প্রায়ই মন্দিরের বিরুদ্ধে মণ্ডলকে দাঁড় করানোর নেতিবাদী কৌশলের পথেও চলে যান। গত নির্বাচনে এই কৌশল চরম ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছে।

এব্যাপারে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না যে আজকের সাম্প্রদায়িক আক্রমণের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমতকে সমাবেশিত করতে হলে হিন্দু ও ইসলাম উভয় ধর্মের উদারনৈতিক মূল্যবোধ তথা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও আইনি রায় এই সবকিছুকেই ইতিবাচকভাবে কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু এক স্বাধীন বাম মঞ্চ থেকে আধুনিক ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শের ব্যাপক প্রচার ছাড়া সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কোনো পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে উঠতে পারে না। তাছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটিকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্তব্যকর্মের বিপরীতে দাঁড় করানো অথবা ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চার নামে সমস্ত ধরনের সুবিধাবাদী জোটবন্ধনের সপক্ষে যুক্তি খাড়া করলে চলবে না। বরং এই প্রশ্নটিকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত এক বিষয় হিসাবেই দেখতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রশ্নও তুলে ধরতে পারে এমন এক ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চার পরিবর্তে আমাদের অবশ্যই চাই এক গণতান্ত্রিক মোর্চা যার কর্মসূচির মধ্যে এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নটি যথাযথ অগ্রাধিকারের সঙ্গে বিবেচিত হবে। শুধুমাত্র এক নৈতিক প্রশ্ন হিসাবে অথবা ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের ঘোষণা হিসাবে নয়, বরং বাস্তব রাজনীতির প্রশ্ন হিসাবেও, এক আধুনিক ভারত গড়ার চূড়ান্ত পূর্বশর্ত হিসাবেই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিষয়টি আমাদের দেখতে হবে।