(১৯৯৬-এর অক্টোবর মাসে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় পার্টি স্কুলের সমাপ্তি অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণ)

স্কুল শেষ হওয়ার মুখে। যদিও স্কুলে আমরা পার্টির নীতি নির্ধারণ করি না, তবুও সেগুলি সূত্রায়নের ক্ষেত্রে এই সমস্ত আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

সেই দিক থেকে দেখলে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখানে উত্থাপিত ও আলোচিত হয়েছে। ১৯৯৪-এর পার্টি স্কুলে ‘মার্কসবাদের সংকট’ প্রসঙ্গে আমি কিছু ধারণা প্রকাশ করেছিলাম এবং সে প্রসঙ্গেই আরও কিছু কথা বলতে চাই।

তার প্রায় ১৫০ বছরের ইতিহাসে মার্কসবাদকে এমন দুই অথবা তিনটি সংকটের পর্যায় পার হতে হয়েছে যেখানে তার যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন হাজির করা হয়েছিল। প্রতি ক্ষেত্রেই মার্কসবাদ সে সব কিছুকে কাটিয়ে উঠেছে এবং নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে আরও এগিয়ে গিয়েছে। আজ বিংশ শতাব্দীর একেবারে অন্তিমলগ্নে তাকে আর একবার মৃত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এবারের সংকট সত্যিই খুব গভীর হয়েছে কারণ তার সঙ্গে যুক্ত প্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক দেশ, লেনিনের দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন। সোভিয়েত মডেল মার্কসবাদের সত্যিকারের মূর্তরূপ বলে চিহ্নিত হয়ে এসেছে আর সে কারণেই তার পতন পুরোনো বিতর্কগুলিকে আর একবার সামনে হাজির করে দিয়েছে। বিকল্প হিসাবে দাবি জানাত যে চীনা মডেল তাও নানা কারণেই অনেকাংশে তার জৌলুষ হারিয়েছে আর অবশিষ্ট ছোটোখাটো সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিও তেমন আস্থা জাগাতে পারছে না।

এখন প্রথম যে বিষয়টি মাথায় রাখা উচিত তা হল, পুঁজিবাদের দ্বন্দ্বসমূহকে বিশ্লেষণের প্রক্রিয়াতেই মার্কসবাদ উদ্ভূত হয়েছে এবং একমাত্র মার্কসবাদই পুঁজিবাদের সর্বাঙ্গীন সুগভীর সমালোচনাকে উপস্থাপিত করেছে। শ্রেণীসংগ্রামের এক মতবাদ হিসাবে মার্কসবাদ শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজে অবশ্যই তার প্রাসঙ্গিকতা হারাবে, কিন্তু তার আগে পর্যন্ত তা পুঁজিবাদী দুনিয়ার রূপান্তর ঘটানোর জন্য এবং সমাজতন্ত্রের বিভিন্ন সম্ভাবনাকে ঘিরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর ক্ষেত্রে পথ নির্দেশক মতাদর্শ হিসাবেই বিরাজ করবে। একটি বিশেষ অর্থে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন বাস্তবিকই একটি ইতিহাসের পরিসমাপ্তিকে সূচিত করে কিন্তু একই সাথে প্রতিটি সমাপ্তিই নতুন এক সূচনারও প্রতীক হয়ে ওঠে, আর এই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই মার্কসবাদের বিপ্লবী মর্মবস্তুকে পুনরুদ্ধারের জন্য আমরা সংকল্পবদ্ধ। সেই সঙ্গে আমাদের বিশ্লেষণ, সমালোচনা ও পরিবর্তন ঘটানোর হাতিয়াগুলিকেও আমরা আরও শাণিত করব।

এই স্কুলে বিশেষত উত্তর আধুনিকতা সম্পর্কে অনেক কিছু আলোচনা হয়েছে। উত্তর-আধুনিকতা নিছক মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের উপযোগিতা নিয়েই প্রশ্ন তোলেনি, বরং তা আধুনিকতার সমগ্র যুগকেই প্রত্যাখ্যান করে – যে যুগের উদ্ভব ঘটেছিল বুর্জোয়া ও সর্বহারা, এই দুই আধুনিক শ্রেণীর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। আলোকপ্রাপ্তির (Enlightenment) সমগ্র যুগকেই তা খারিজ করে দেয়, খারিজ করে মানব মুক্তির সমস্ত বৃহৎ মতবাদকেই। এই সমস্ত মতবাদকে মস্ত মস্ত আখ্যান বলে তা চিহ্নিত করে থাকে, যেগুলি সমাজকে তাদের পূর্ব-নির্ধারিত লক্ষ্যে চালিত করবার প্রচেষ্টা থেকে শুরু করে অবশেষে স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় পর্যবসিত হয়। উত্তর আধুনিকতাবাদীরা জাতি, লিঙ্গ, বর্ণ, জনগোষ্ঠী ইত্যাদি ‘কল্পিত সম্প্রদায়কে’ অতিক্রম করে – এমন কোনো শ্রেণীগত বা মানসিক সংহতির অস্তিত্বকে মেনে নিতে অস্বীকার করে।

এখানে আমাদের আলোচনার সময়ে আমরা সাম্প্রতিককালের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলিকে নিয়েও চর্চা করেছি। কিছু কিছু কমরেডের এগুলিকে বুঝতে ভালোই অসুবিধে হয়েছে। হয়তো খুব বিস্তৃতভাবে না জানলেও চলবে, তবুও মার্কসবাদী হিসেবে সাম্প্রতিকতম বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলির গতিবিধি সম্পর্কে আপনাদের অবহিত থাকা প্রয়োজন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা অনুযায়ী পরমাণু থেকেও ক্ষুদ্রতর কণার (sub-atomic) স্তরে বস্তু আর সাধারণ বলবিদ্যার নিয়ম অনুসরণ করে না এমনকি এই স্তরে তার অস্তিত্বের রূপটিও হয়ে দাঁড়ায় এক ধাঁধার মতো। তার অবস্থান, ভরবেগ ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যসমূহকে নিরূপণ করাটা কেবল বেশ অনিশ্চিতই নয়, তা এমনকি পর্যবেক্ষণ-ক্রিয়ার প্রভাবে পাল্টে যেতে পারে।

এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটির এক ধরনের দার্শনিক ব্যাখ্যা আজকাল পশ্চিমী দুনিয়ায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী বস্তুবাদের মূল ভিত্তি অর্থাৎ বস্তুর অস্তিত্ব বা বস্তুজগৎ যে মনের ইচ্ছা নিরপেক্ষ – সে সম্পর্কেই প্রশ্ন তোলা হয়।  ‘কার্যকরী বাস্তবতার’ (virtual reality) তত্ত্বে বলীয়ান হয়ে পশ্চিমী দুনিয়া প্রাচ্যের অতীন্দ্রিয়বাদ সম্পর্কে নতুন করে আগ্রহ দেখাচ্ছে – যে মতবাদ অনুসারে বস্তুজগতকে মায়া অথবা বিভ্রম হিসাবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। ইউরোপীয় রেনেসাঁসের যুগে চার্চের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছিল আর বিজ্ঞানের অগ্রগতি তথাকথিত দৈব বিধানগুলিকে মোক্ষম আঘাত হেনেছিল। অন্ধকারের যুগ থেকে যখন ইউরোপ জেগে উঠল ও আলোকপ্রাপ্তির যুগের সূচনা হল তখন ২০০০ বছরের প্রাচীন গ্রীক দর্শনের পুনরুদ্ধার ঘটল। গ্রীক দার্শনিকদের দ্বন্দ্বতত্ত্ব আধুনিক যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হেগেল কর্তৃক সমৃদ্ধ হল এবং পরবর্তীকালে মার্কস তাকে বস্তুবাদী ভিত্তির উপর স্থাপন করলেন। বিজ্ঞানের অগ্রগতি আবার কিছু মানুষকে প্রাচীনকালের মধ্যে তার দার্শনিক শিকড় খুঁজতে উৎসাহ দিল আর মজার ব্যাপার এই যে তাঁরা প্রাচ্যের অতীন্দ্রিয়বাদের মধ্যেই আশ্রয় খুঁজে পেলেন। স্কুলে আমরা দর্শনের ক্ষেত্রে নয়া-ভাববাদী আক্রমণ ও সমাজবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে উত্তর-আধুনিকতার মধ্যকার সম্পর্কগুলিকে খোঁজার চেষ্টা করেছি।

কয়েকজন কমরেড বলেছেন যে ‘নতুন সামাজিক আন্দোলনগুলি’ বা আরও সাধারণ পরিভাষায় বলতে গেলে আংশিক বিষয়গুলিকে নিয়ে আন্দোলন উত্তর-আধুনিকতার উদ্ভবের আগেও বিদ্যমান ছিল। কথাটা ঠিকই। বস্তুতপক্ষে উত্তর আধুনিকতার গুরুত্ব এখানেই যে তা এই সমস্ত আন্দোলনগুলিকে নতুন অর্থ ও নতুন ভিত্তি সরবরাহ করেছে। উত্তর আধুনিকতা এই সমস্ত আন্দোলনের সায়ত্ততাকে একটা শর্তহীন বা চরম ব্যাপার হিসাবে দেখিয়েছে। তাকে এটা করতে হয়েছে কারণ পুঁজিবাদকে একটা ব্যবস্থা হিসাবে বিশ্লেষণ করাটাকে নিরর্থক প্রমাণ করাই হল উত্তর আধুনিকতার প্রধান দায়।

মার্কসবাদের প্রথম সংকট

বর্তমান পর্যায়ের ‘মার্কসবাদের সংকট’ এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এ নিয়ে আলোচনা করতে হলে সংকটের পূর্ববর্তী পর্যায়গুলির দিকে দৃষ্টিপাত করাটা নিশ্চয় অসঙ্গত হবে না। ১৯ শতকের শেষ আর ২০ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে মার্কসবাদ প্রথম যে সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল এবং যখন সংশোধনবাদের জন্ম হয়েছিল আমি সেই সময়কার কথা এখানে উল্লেখ করতে চাই।

১৯ শতকের একেবারে শেষ দিকে পুঁজিবাদ এক তীব্র সংকটের মুখে পড়ে। এই সংকটের চরিত্র ছিল ধ্রুপদী ধরনের কারণ এই সংকটের প্রতিটি লক্ষণ মার্কসবাদী বীক্ষণের সঙ্গে চমৎকারভাবে মিলে গিয়েছিল। এই সময়কালে শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলন এবং সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টিগুলির (ঐ সময় কমিউনিস্ট পার্টিগুলি এই নামেই অভিহিত হত) বিকাশও লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে জার্মানিতে পার্টি দ্রুত অগ্রগতি ঘটায়।

সংকট দীর্ঘায়িত হয় এবং পুঁজিবাদ ক্রমে ক্রমে তা কাটিয়ে ওঠে, কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় সে তার আমূল রূপান্তর ঘটায়। আগে ছিল মুক্ত পুঁজিবাদ যার মূলকথা ছিল অবাধ প্রতিযোগিতা। এর ফল হিসাবে উৎপাদনে নৈরাজ্য দেখা গিয়েছিল। এবার পুঁজিপতিরা নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হল এবং কার্টেল, ট্রাস্ট ইত্যাদি যা মার্কসের জীবদ্দশায় ছিল নিতান্ত প্রারম্ভিক স্তরে – তা এখন নির্ণায়ক বিধি হয়ে দাঁড়াল। পুঁজিবাদ একটা স্থায়িত্ব লাভ করল, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেল ও সংসদীয় গণতন্ত্র বিকাশলাভ করল। পুঁজিবাদের আসন্ন পতন সম্পর্কে মার্কসবাদীদের আগেকার উচ্ছ্বাস নৈরাশ্যে পরিণত হল। মার্কস সমেত মার্কসবাদীরা পুঁজিবাদী সংকটের প্রতিটি পর্যায়ে অতিরিক্ত আশাবাদ পোষণ করতেন। এটা খুবই স্বাভাবিক এবং ইতিহাসের রূপান্তর ঘটানোর ক্ষেত্রে এর এক গতিময় ভূমিকাও রয়েছে। কিন্তু এক সুগভীর বৈজ্ঞানিক চিন্তন প্রক্রিয়া হিসাবে মার্কসবাদ পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের সমাজ বিকাশের ঐতিহাসিক প্রবণতাকেই কেবলমাত্র চিহ্নিত করেছে। সমাজতন্ত্র বা নৈতিক সমাজের অন্যান্য কাল্পনিক তত্ত্বের বিপরীতে মার্কসবাদ কখনই মনগড়া সমাজতন্ত্রের কোনো মহাপ্রকল্প থেকে শুরু করে না বা এই ধরনের মডেলের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য সমাজকে পুনর্গঠিত করার চেষ্টা করে না।

মার্কসবাদ বরং একথাই বলে যে পুঁজিবাদ তার নিজস্ব দ্বন্দ্বের গতির ফলেই সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলে কারণ তার ভিতরের দ্বন্দ্বগুলির চূড়ান্ত মীমাংসা হয় একমাত্র সমাজতন্ত্রেই। সমাজতন্ত্রে উত্তরণ ঘটার বস্তুগত শর্তগুলিও – যথা বৃহদায়তন উৎপাদনের ঘনীভূত রূপ, সর্বহারা শ্রেণী ইত্যাদি – পুঁজিবাদ জন্ম দিয়ে থাকে। এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে সমাজ আপনা থেকেই, কোনো সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়াই স্বতস্ফূর্তভাবে সমাজতন্ত্রে উৎক্রমণ ঘটাবে। এ কারণেই মার্কস বিখ্যাত সেই মন্তব্যটি করেছিলেন, “প্রশ্ন হল দুনিয়াকে পাল্টানোর”।

মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলস প্রভূত কর্তৃত্বের অধিকারী হন। দুই জার্মান কমিউনিস্ট – বার্ণাস্টাইন ও কাউটস্কি তাঁর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তাঁর শেষ কয়েকটি রচনায় এঙ্গেলস কিছু আত্মসমালোচনা করেন। ১৮৯৫-এর মার্চে, তাঁর মৃত্যুর মাত্র কয়েকমাস আগে, এঙ্গেলস লেখেন, “ইতিহাস আমাদের এবং আমাদেরই মতো যারা যারা ভাবতেন – প্রত্যেককেই ভুল প্রমাণিত করেছে। এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে সে সময় মহাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশের স্তর অনেকাংশেই পুঁজিবাদী উৎপাদনকে উচ্ছেদের জন্য পরিপক্ক হয়ে ওঠেনি; ১৮৪৮ সাল থেকে যে অর্থনৈতিক বিপ্লবের শুরু – যা গোটা মহাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছিল ... এবং জার্মানিকে নিশ্চিতভাবেই এক প্রথম সারির শিল্পোন্নত দেশে পরিণত করেছে – তা থেকেই এটা প্রমাণিত হয়”। ... “সে সময় আমরা য়ে ভুল ধারণা পোষণ করতাম তা ইতিহাস যে ভেঙ্গে দিয়েছে শুধু তাই নয়, সর্বহারাকে যে পরিস্থিতিতে সংগ্রাম চালাতে হয় তাকেও পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। ১৮৪৮-এর সংগ্রামের পদ্ধতিগুলি আজ সবদিক থেকেই অচল আর এটাই হল সেই বিষয় যা বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের নিবিড় পরীক্ষার দাবি রাখে”।

এঙ্গেলসের মত অনুযায়ী, আধুনিক সেনাবাহিনীর আয়তনের পরিপ্রেক্ষিতে রাস্তার লড়াই, অতর্কিত আক্রমণ ইত্যাদি পুরোনো রণকৌশলগুলি সেকেল হয়ে গেছে। জার্মান পার্টির সংসদীয় নির্বাচনে অর্জিত সাফল্যের পরিসংখ্যানকে উদ্ধৃত করে তিনি সার্বজনীন ভোটাধিকারের সুযোগকে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কাজে লাগানোর উপর জোর দেন। এঙ্গেলস এই বলে শেষ করেন, “বিশ্ব ইতিহাসের পরিহাস সব কিছুকেই উল্টে দিয়েছে। আমরা ‘বিপ্লববাদীরা’, ‘উৎখাতকারীরা’ যত না বে-আইনি কাজ ও উচ্ছেদের কাজে সফল হয়েছি তার থেকে অনেক বেশি সাফল্য পাচ্ছি আইনি ধারায়। যারা নিজেদের নিয়মশৃঙ্খলার পার্টি বলে থাকে তারাই তাদের নিজেদের সৃষ্টি আইনি বিধানগুলিতে ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে ... অন্যদিকে আমরা এই আইনি ব্যবস্থায় হৃষ্টপুষ্ট হচ্ছি। আমাদের চেহারা চকচকে হচ্ছে ও মনে হচ্ছে যেন শাশ্বত জীবন লাভ করছি।”

ইউরোপের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এবং সেখানে পুঁজিবাদের বিকাশের এক বিশেষ পর্যায়ে এঙ্গেলস রণকৌশল পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। একই পটভূমি থেকে শুরু করে বার্ণস্টাইন কিন্তু খোদ রণনীতিটাকেই সংশোধনের পরামর্শ দেন এবং এ কারণে তাঁকে সংশোধনবাদের জনক বলাটা খুবই সঠিক।

বার্ণস্টাইনের যুক্তি হল এই যে মার্কসের ভবিষ্যৎবাণীর বিপরীতে পুঁজির কেন্দ্রীভবন এগিয়েছে খুবই ধীর গতিতে। তার থেকেও বড় কথা হল, বৃহদায়তন উৎপাদনের দ্বারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলি উৎখাত হয়ে যায়নি। সর্বোপরি, কার্টেল ও ট্রাস্টসমূহ গঠনের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদ নিজেকে নিয়ন্ত্রণের একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছে এবং এভাবেই তীব্র সংকটকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছে। তিনি আরও যুক্তি দিয়েছেন যে দুই চরম শ্রেণীতে সমাজের মেরুকরণ ঘটাটা বাস্তবায়িত হয়নি এবং মধ্যস্তরটা নিঃশেষিত হয়ে যায়নি তো বটেই বরং পুঁজিপতি, সম্পত্তির মালিক ও অংশীদারদের সংখ্যাই উল্টে বৃদ্ধি পেয়েছে।

তাঁর মতে, আধুনিক জাতিগুলির রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের গণতান্ত্রিকীকরণ ঘটেছে – ফলে পুঁজির শোষণমূলক প্রবণতাগুলি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে এবং শ্রেণীসংগ্রামের ভিত্তিটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। যে সব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রাধান্যলাভ করেছে সে সব দেশে রাষ্ট্র আর শ্রেণী শোষণের হাতিয়ার হিসাবে গণ্য হতে পারে না। তাই বার্ণস্টাইনের যুক্তি হল শ্রমিকদের আর বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের জন্য উদ্যোগী হওয়া উচিত নয় বরং তাদের রাষ্ট্রের সংস্কার সাধনের উপর জোর দেওয়া উচিত।

১৮৯৫ সালে, ফ্রান্সে শ্রেণী সংগ্রাম গ্রন্থের মুখবন্ধে এঙ্গেলস (সেই) শতাব্দীর শেষে পুঁজিবাদের দ্রুত এক অবনতির আশা ব্যক্ত করেছিলেন এবং ভেবেছিলেন, পুঁজিবাদ তার ক্ষমতা কায়েম রাখার জন্য যে আইনি ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিল তাকে শ্রমিকশ্রেণী সাফল্যের সঙ্গে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করতে সক্ষম হবে।

তার ঠিক এক বছর পরে, ১৮৯৬ সালে বার্ণস্টাইন চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্বন্ধেই সন্দেহ প্রকাশ করেন এবং কেবল ‘দৈনন্দিন আন্দোলনের’ মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন। মার্কস তাঁর পুঁজি গ্রন্থে জয়েন্ট স্টক কোম্পানির বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং এঙ্গেলস কার্টেল এবং ট্রাস্ট প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন। কার্টেলগুলি এক উচ্চস্তরে পুঁজির কেন্দ্রীভবনের নিশ্চিত সাক্ষ্য স্বরূপ এবং পুঁজিবাদের বুনিয়াদী নীতি হিসাবে অবাধ প্রতিযোগিতার ‘দেউলিয়াপনা’কে প্রমাণ করে। বার্ণস্টাইন যাকে পুঁজির বিকেন্দ্রীভবন, স্বয়ং-নিয়ন্ত্রণ ও গণতান্ত্রিকীকরণ বলে মনে করেছিলেন তা সর্বোচ্চ পর্যায়ের একচেটিয়া ব্যবস্থা হিসাবে দেখা দেয়, ‘মালিকানা’ এবং ‘পরিচালন ব্যবস্থা’ পৃথক হওয়ার মধ্য দিয়ে পরজীবী বুর্জোয়াদের একটি গোটা শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে যারা ফাটকাবাজির মধ্য দিয়ে ফুলে ফেঁপে ওঠে; এক আগ্রাসী ঔপনিবেশিক নীতির জন্ম হয় এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগোষ্ঠীর মধ্যে এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু হয় যা ইতিহাসে এই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিঘটনা সৃষ্টি করে। লেনিন এই সমস্ত বিষয়গুলিকে তাঁর সাম্রাজ্যবাদ – পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায় গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। ছোটো এবং মাঝারি পুঁজিকে গ্রাস করাটাও হয়ে দাঁড়ায় নিয়মিত ঘটনা। বৃহৎ পুঁজি এগুলিকে সহায়ক শিল্পে পর্যবসিত করে। নতুন নতুন ক্ষেত্র এবং নতুন নতুন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় তার আবার সমৃদ্ধি ঘটতে থাকলে যথাসময়ে বৃহৎ পুঁজি সেখানেও হাত বাড়ায়।

সংসদীয় গণতন্ত্রের বিষয়ে বলা যায়, এটাকে নেহাতই শ্রমিকশ্রেণীকে প্রতারণা করার জন্য, তাদের ফাঁদে ফেলার জন্য একটা ভাঁওতাবাজি বলে দেখাটা হবে নিতান্ত সরলীকরণ। এটা সে ধরনেরই নির্বোধ ধারণা যেখানে মনে করা হয় ধর্ম হল জনগণকে ঠকাবার জন্য পুরোহিতদের চক্রান্ত মাত্র। মানব সভ্যতার অন্যান্য পর্যায়ে কোনো সংসদের অস্তিত্ব ছিল না। শাসনের এই রূপটি কেবল পুঁজিবাদের সময়কালেই উদ্ভব হয় এবং এইভাবে তা বুর্জোয়া শাসনের নির্দিষ্ট রূপ হিসাবে দেখা দেয়। সামন্ততন্ত্রের যুগে শোষণ অর্থনীতি-বহির্ভূত বলপ্রয়োগের রূপ পরিগ্রহ করত এবং তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রাজনৈতিক উপরিকাঠামোতেও রাজা এবং সামন্ত অভিজাতদের বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হত। ধনতন্ত্রে শোষণ চলে উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যেই উদ্বৃত্ত মূল্যের রূপে। রাজনৈতিক উপরিকাঠামো হিসাবে সংসদীয় গণতন্ত্র আদর্শ ধনতন্ত্রের সঙ্গে খুবই সঙ্গতিপূর্ণ।

ফ্রান্সে শ্রেণীসংগ্রাম গ্রন্থে মার্কস লিখেছেন, “এই সংবিধানের[] প্রধানতম স্ববিরোধ পরিস্ফুট হয় এইভাবে : সর্বাহারা, কৃষক, পেটি বুর্জোয়া – এই যে শ্রেণীগুলির সামাজিক দাসত্ব সংবিধানে কায়েম রাখার কথা, সংবিধান সার্বজনীন ভোটাধিকার মারফৎ তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী করছে। আর যে বুর্জোয়া শ্রেণীর সাবেকী সামাজিক শক্তি এতে মঞ্জুর করা হয়েছে সংবিধান তার কাছ থেকে সে ক্ষমতার রাজনৈতিক নিশ্চিতি প্রত্যাহার করছে।” এই হল বুর্জোয়া সাংবিধানিক রাষ্ট্রের মৌলিক দ্বন্দ্ব – সার্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে সকলকেই রাজনৈতিক জীবনের মধ্যে নিয়ে আসা হয়, কিন্তু জনগণের এই সার্বভৌমত্ব নেহাতই আনুষ্ঠানিক, প্রকৃত স্বার্থগুলি শ্রেণী বৈরিতার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়।

সংশোধনবাদীরা প্রজাতন্ত্রের মধ্যে বুনিয়াদী বৈরিতাগুলির নিরসন ঘটেছে বলে মনে করে। তাদের বিপরীতে লেনিনের যুক্তি হল, উপরে বর্ণিত স্ববিরোধিতাগুলির কারণেই সেগুলি খোলাখুলি শ্রেণীযুদ্ধের সবথেকে চমৎকার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়।

এভাবেই সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে বিতর্ক চালিয়ে মার্কসবাদ নিজের অগ্রগতি ঘটিয়েছিল এবং এই প্রক্রিয়াতেই মার্কসবাদ আরও প্রাণশক্তি লাভ করেছে লেনিনবাদের মধ্যে।

বিপ্লবী বিরোধীপক্ষের কৌশল সম্পর্কে

এরপর, এখানে আরও কিছু কিছু প্রশ্নে যে আলোচনা হয়েছে সে ব্যাপারে আমি কিছু মন্তব্য করতে চাই। একজন কমরেড বলেছেন যে বিপ্লবী আন্দোলনের ধীর বিকাশের পরিস্থিতিতে বিপ্লবী বিরোধীপক্ষের কৌশলটি ঠিক খাপ খায় না। বরং অভ্যুত্থানের পরিস্থিতিতেই তা যথার্থভাবে প্রযোজ্য হতে পারে। আমি মনে করি এই যুক্তির ক্ষেত্রে মৌলিক একটা ত্রুটি থাকছে। ‘বিরোধীপক্ষ’ শব্দটি হল একটি সংসদীয় বর্গের পরিভাষা এবং সংসদীয় সংগ্রাম চালায় এমন একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে বিপ্লবী বিরোধী পক্ষের কৌশলটি হল এক নির্দিষ্ট কৌশল। আর বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সময় পার্টির কাছে আশু লক্ষ্য হিসাবে বিপ্লব নিজেই এজেন্ডা হয়ে দাঁড়ায়, তখন বিপ্লবী বিরোধীপক্ষ আর এজেন্ডা হিসাবে থাকে না। অন্যভাবে বলতে গেলে, বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সময় সংসদীয় সংগ্রাম অচল হয়ে পড়তে পারে এবং খুব সম্ভব নির্বাচন বয়কট বা এমনকি বুর্জোয়া সংসদকে বাতিল ঘোষণা করাটাই পার্টির আশু লড়াইয়ের স্লোগান হয়ে দাঁড়াতে পারে। কাজে কাজেই, যখন কোনো সংসদীয় সংগ্রাম থাকবে না বা এমনকি সংসদটাই থাকবে না তখন বিরোধীপক্ষ কথাটিই থাকবে না তা সে বিপ্লবী বিরোধীপক্ষ হোক বা অন্য যে কোনো প্রকারের বিরোধীপক্ষই হোক। একথা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। কেবলমাত্র আজকের বর্তমান পরিস্থিতিতেই, যখন পার্টির কৌশলের মধ্যে সংসদীয় সংগ্রাম এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, তখন বিপ্লবী বিরোধী পক্ষের প্রশ্নটি হাজির হচ্ছে এবং এটাই সংসদীয় সংগ্রামের ক্ষেত্রে পার্টির বুনিয়াদী দিশা নির্ধারণ করছে। এ প্রশ্নে কোনো বিভ্রান্তি থাকা উচিত নয়। অবশ্য নির্বাচনে বেশি বেশি সমর্থনলাভ ও সংসদে শক্তি বৃদ্ধির অবস্থায় এর প্রয়োগ ঘটানোটা নিশ্চিতভাবেই একটা জটিল বিষয়।

যাই হোক, সংসদকে প্রচারের মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করার কথাটা বহুল প্রচলিত আর এ নিয়ে কোনো বিতর্কেরও অবকাশ নেই। কিন্তু বাস্তব জীবনে আপনাদের বহু ধরনের ব্যবহারিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। সেখানে আসন সমঝোতার প্রশ্ন উঠবে। কথা উঠবে ‘সমমনোভাবাপন্ন দলগুলির’ সাথে আঁতাতের। এটাও একটা সংসদীয় পরিভাষা। তারপর আসে সংসদের মধ্যে ব্লক গঠনের প্রশ্ন। আমাদের প্রতিনিধিদের সেখানে নির্দিষ্ট ইস্যুগুলি ও বিলগুলিতে নির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করতে হবে এবং ভোটে অংশ নিতে হবে। আমাদের মিত্র খুঁজতে হবে আর বিভিন্ন বুর্জোয়া সংগঠনের মধ্যে পার্থক্যও করতে হবে। আমাদের প্রতিনিধিরা কি কেবল কিছু মুলতুবি প্রস্তাব উত্থাপন বা সংসদ কক্ষে বা ‘ওয়েলে’ মধ্যে ছুটে যাওয়ার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখবেন কিংবা ওয়াক আউট করার মধ্যে আবদ্ধ থাকবেন? না কী তাঁরা কার্যকরী কিছু আলোচনায় অংশ নেবেন, বিভিন্ন সংশোধনী আনবেন, সংবিধানের নানা সংস্কার দাবি করবেন ও বেসরকারি বিলের রূপে বিকল্প খসড়া হাজির করবেন? বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির সদস্য হিসাবে তাঁদের ভূমিকা কেমন হবে, বিভিন্ন নির্বাচনী ক্ষেত্রভিত্তিক পরিকল্পনা বা উন্নয়ন সংক্রান্ত সংস্থাতেই বা তাঁদের কাজ কেমন হবে? এ সবই হল সংস্কারকে ঘিরে কর্মকাণ্ডের কথা এবং মোদ্দা কথা হল বিপ্লবী বিরোধী পক্ষের অবস্থান থেকেই এই সমস্ত ভূমিকা পালন করতে হবে। এ হল এমন লাখ টাকার প্রশ্ন যার উপর পার্টির সমগ্র ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।

বিপ্লবের কি কোনো সংসদীয় পথ আছে?

যে মৌলিক ভ্রান্তিটির জন্য কমিউনিস্ট পার্টিগুলি সংসদসর্বস্বতা বা জনপ্রিয় ভাষায় অধঃপতনের গাড্ডায় গিয়ে পড়ে তা হল সংসদের বুর্জোয়া চরিত্রটিকেই নস্যাৎ করে বসা ও প্রচলিত সংসদ যে বুর্জোয়া সমাজেরই উপরিকাঠামো তা বেমালুম ভুলে যাওয়া। আপনি যদি সংসদকে নিছক একটা ধাপ্পা বলে মনে করেন, মনে করেন যে এটা জনগণকে প্রতারণা করার জন্য শোষকশ্রেণীর একটা কৃত্রিম সৃষ্টি তাহলে আপনি নিজেকেই ঠকাবেন, অন্য কাউকে নয়। কারণ এই সরল ব্যাখ্যার ফলে আপনি বুর্জোয়া সমাজের গতিসূত্রকে অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করতে ব্যর্থ হবেন। এবং এর ফলে আপনি নির্দিষ্ট স্লোগান ও কৌশল উদ্ভাবন করতে পারবেন না। আপনি চোখ চোখা কথায় পার্লামেন্টকে খারিজ করে দেওয়া বা গালমন্দ করতে পারবেন কিন্তু তার শরীরে একটুও চিড় ধরাতে পারবেন না। এ ধরনের বুলি কপচানো সত্যিই শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা।

অন্যদিকে সংসদকে শ্রেণী বিবর্জিত বা শ্রেণীর ঊর্ধ্বে কোনো প্রতিষ্ঠান বলে মনে করা, যেখানে সর্বহারাকে কেবল ঢুকে পড়তে হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে হবে আর তাকে সমাজের সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগাতে হবে – এভাবে চিন্তা করাটা হল আরও মারাত্মক এক বিচ্যুতি। সংসদ বুর্জোয়া সংবিধানের চৌহদ্দিতেই কাজ করে এবং হাজার একটা উপায়ে তার সুতোটা পুঁজির সাথে বাঁধা। সংসদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সর্বহারার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাতেও দেখেছি সমগ্র ভোটের ব্যবস্থাটাই কীভাবে শক্তিশালী ক্ষমতাগোষ্ঠীর অনুকূলে কাজ করে, কাজ করে টাকার থলির হয়ে এবং এক একটা আসন জয় করাটা বিপ্লবী বামেদের পক্ষে কতটা কঠিন।

তবুও এটাই আমার বক্তব্যের মূল বিষয় নয়। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া গেল সর্বহারাশ্রেণী সংসদে গরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে (খুবই ব্যতিক্রমী কোনো ক্ষেত্রে তা সম্ভব বলেও ধরে নেওয়া যাক) তবুও তাতে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সর্বহারার দাসত্বের অবসান ঘটবে কিনা কিংবা বুর্জোয়া সমাজের ভিত্তিটা তাতে কোনোভাবে আমূল বদলানো যাবে কিনা – সে প্রশ্ন থেকেই যায়। মার্কসবাদ এ প্রশ্নের নেতিবাচক উত্তরই দিয়ে থাকে। শ্রেষ্ঠ কোনো কমিউনিস্ট সরকারও তার মহত্তম আকাঙ্খা থাকা সত্ত্বেও বুর্জোয়া ব্যবস্থার কিছুটা সংস্কার সাধনই করতে পারে মাত্র, তার বেশি কিছুই করতে পারে না। সর্বাহারারা তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিদ্যমান রাষ্ট্রযন্ত্রটাকে ব্যবহার করতে পারে না। পুরোনো রাষ্ট্রটাকে অবশ্যই চূরমার করে দিতে হবে আর নতুন এক রাষ্ট্রযন্ত্র গড়ে তুলতে হবে। কমিউনিস্ট ইস্তাহারের জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় (১৮৭২) প্যারি কমিউনের তিক্ত শিক্ষার পর মার্কস ও এঙ্গেলস কর্তৃক পুনর্বার যা ঘোষিত হয়েছে এবং লেনিনের রাষ্ট্র ও বিপ্লব বইতে যা সুবিস্তৃতভাবে বলা হয়েছে সেটাই রাষ্ট্র সম্পর্কিত মার্কসীয় তত্ত্বের ভিত্তি হয়ে আছে। বস্তুতপক্ষে সমাজতান্ত্রিক সমাজেও – যেখানে মূলনীতি হল “প্রত্যেকের কাছ হতে তার সামর্থ্য অনুযায়ী ও প্রত্যেককে তার কাজ অনুযায়ী” – বুর্জোয়া অধিকারের উপাদান বিদ্যমান থাকে। এমনকি লেনিন একবার একথাও বলেছিলেন যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হল বুর্জোয়াহীন বুর্জোয়া রাষ্ট্র। “প্রত্যেকের কাছ হতে তার সামর্থ্য অনুযায়ী ও প্রত্যেককে তার প্রয়োজন অনুযায়ী” – এই নীতি যখন কার্যকরী হয় কেবল তখনই বুর্জোয়া অধিকারের উপাদান পুরোপুরি নির্মূল হতে পারে। কিন্তু তার অর্থ হল কমিউনিস্ট সমাজের উন্মেষ, যেখানে রাষ্ট্র নিজেই বিলীন হয়ে যায়।

সুতরাং বিপ্লবের জন্য সংসদীয় বা অসংসদীয় পথের গোটা বিতর্কটাই সোজাসুজি এই কারণে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায় যে সংসদীয় পথ বলে কোনো পথই নেই। সর্বহারা বিপ্লবের প্রকৃত অর্থই হল সংসদ সমেত বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অবসান ঘটানো। কাজে কাজেই বিপ্লবের কোনো সংসদীয় পথ থাকতে পারে না। বিপ্লবের অন্তর্বস্তুকে বর্জন করার ভিত্তিতেই কেবলমাত্র এর অস্তিত্ব সম্ভব। সর্বহারা বিপ্লব তার নিজস্ব প্রতিনিধিত্বমূলক পরিষদ সহ সর্বহারা রাষ্ট্র সৃষ্টি করে থাকে। এই প্রতিনিধিত্বমূলক পরিষদ রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে ব্যাপক জনগণের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করে এবং রাষ্ট্রের আইন প্রণয়ন ও প্রশাসনিক কাজকে একটি একক সত্তার মধ্যে গ্রথিত করে। সংক্ষেপে, এক নতুন রাজনৈতিক উপরিকাঠামোকে গড়ে তোলে যা নতুন সমাজের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।

সংসদ সংক্রান্ত সমগ্র কমিউনিস্ট রণকৌশল সংসদকে বিভিন্ন মাত্রায় ব্যবহার করা এবং এই প্রক্রিয়ায় গুণগতভাবে পৃথক এক প্রতিনিধি পরিষদ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তাকে ভাঙ্গার শর্ত সৃষ্টি করাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়।

শান্তিপূর্ণ বনাম সহিংস বিপ্লব

মার্কসবাদী রণকৌশলে অবশ্য শান্তিপূর্ণ অথবা সহিংস বিপ্লবের প্রশ্নকে নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এটা একেবারেই পৃথক প্রশ্ন যার সাথে সংসদীয় পথ বা অসংসদীয় পথ নিয়ে তথাকথিত বিতর্কের কোনো সম্পর্ক নেই। মার্কসীয় বিপ্লবের তত্ত্বে একটি ব্যতিক্রমী ও বিরলের মধ্যে বিরলতম সম্ভাবনা হিসাবে এবং শ্রেণীশক্তিসমূহের ভারসাম্যের কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কথা বলা হয়েছে। আমেরিকায় যখন স্থায়ী সেনাবাহিনী ও আমলাতন্ত্রের উদ্ভব ঘটেনি এমন এক সময় এ ধরনের এক সম্ভাবনার কথা মার্কস উল্লেখ করেছেন। লেনিন ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় এ ধরনের সম্ভাবনা লক্ষ্য করেছিলেন। চীনে জাপ বিরোধী যুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির পরে এমন এক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল এবং মাও গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটানো এবং চিয়াং কাই শেকের সাথে এক যুক্ত সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এই সমস্ত সম্ভাবনার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। তা সত্ত্বেও, তত্ত্বগতভাবে মার্কসবাদ এই সম্ভাবনার কথা একেবারে নাকচ করে দেয় না।

এখানে এটা অবশ্যই বুঝে নেওয়া দরকার যে শান্তিপূর্ণ বিপ্লব সংসদীয় অভ্যুত্থানের সমার্থক নয়। এর সাথেও বুর্জোয়াদের সমূলে উৎপাটনের প্রশ্নটি সবদিক থেকেই জড়িত। যদি ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে বিপ্লব সমাধা হত, তার তাৎপর্য কি অক্টোবর বিপ্পবের থেকে কিছু কম হত? এছাড়াও, এ সম্ভাবনার আদৌ যদি বাস্তবায়ন ঘটে – তবে তা সর্বহারার সর্বোচ্চ পরিমাণ প্রস্তুতি তথা প্রতিক্রিয়াশীল চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার জন্য সশস্ত্র শক্তির উপর নির্ভর করেই ঘটবে। এই প্রস্তুতি ছাড়া শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কথা আকাশ-কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয় এবং তা ইন্দোনেশিয়া বা চিলির চাইতেও বেশি মাত্রায় সর্বহারার রক্তস্নানে পরিসমাপ্তি লাভ করবে।

সুতরাং আমাদের পার্টির কর্মসূচিতে যখন এক ব্যতিক্রমী সম্ভাবনা হিসাবে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের কথা বলা হয় তখন সেটাকে সংসদীয় পথের সঙ্গে এক করে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয় কিংবা তার অর্থ প্রস্তুতিকে শিথিল করাও নয়। বস্তুত, পার্টি যত অ-শান্তিপূর্ণ রাস্তার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে থাকে ততই তার পক্ষে শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের জন্য সম্ভাব্য পরিস্থিতিকে কাজে লাগানো সম্ভব। শান্তিপূর্ণ বিপ্লব শত্রু কর্তৃক বিনা লড়াই-এ আত্মসমর্পণের সাথে তুলনীয় আর সে জন্যই সহজে অনুমান করা যায় যে সেটা কতটা ব্যতিক্রমী এবং আমাদের প্রস্তুতি কোন স্তরে থাকলে তা ঘটা সম্ভব।

এখন কিছু কিছু ব্যক্তি শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের ব্যতিক্রমী সম্ভাবনাকে প্রথম সুযোগেই সাধারণীকরণ করে বসেন। আর তার পরেই তাঁরা শান্তিপূর্ণ বিপ্লবকে সংসদীয় পথের সাথে এক করে দিয়ে এভাবে মোহ ছড়াতে থাকেন যে সর্বহারা শ্রেণী সংসদে গরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে বুর্জোয়া সমাজের বুনিয়াদী কাঠামোকে বদলে দিতে ও সমাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটাতে সক্ষম। এসবই জঞ্জাল এবং সংশোধনবাদ ছাড়া কিছু নয়।

সিপিআই(এম) বনাম সিপিআই(এমএল)

তথাকথিত এমএল গোষ্ঠীগুলির সমালোচনা আমাদের শুনতে হয়। তাঁদের অভিযোগ এই যে আমরা নাকি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী মূল অবস্থানগুলির প্রায় সমস্তই পরিত্যাগ করছি এবং তাদের ভাষায় নয়া-নয়া সংশোধনবাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। তাদের অভিযোগ, আমাদের পার্টির কর্মসূচিকে আমরা এতখানি সংশোধন করেছি যা নাকি আমাদের প্রায় সিপিআই(এম)-এর কাছাকাছি নিয়ে এসেছে এবং তাদের জল্পনা-কল্পনা হল যে আমরা সিপিআই(এম)-এর সাথে মিশে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। কারো কারো আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে আমরা নাকি কিছু বখরা পাওয়ার জন্য বামফ্রন্টে যোগদানের জন্য লালায়িত এবং আমাদের তারা সরকারি নকশাল বলে চিহ্নিত করছে। তারা অনেকদিন ধরেই এসব ভবিষ্যতবাণী করে আসছে। কিন্তু বাস্তবে অবস্থাটা কী? না আমরা বামফ্রন্টে যোগ দিয়েছি, না আমরা সিপিআই(এম)-এর সাথে মিশে গেছি। বিপরীতে আমরা জাতীয়স্তরে পার্টির পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছি, বাম আন্দোলনে এক প্রধান ধারা হিসাবে তাকে পুনঃস্থাপন করেছি এবং বাম শিবিরে সিপিআই(এম)-এর আধিপত্যের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে আবির্ভূত হয়েছি। আর এসব কিছুই আমরা গ্রামাঞ্চলে গরিব মানুষদের প্রবল আন্দোলনের শক্তিতেই অর্জন করেছি – যেখানে আমাদের সামন্ত শক্তির তীব্র আক্রোশের মুখে পড়তে হচ্ছে, তাদের নিজস্ব সেনাবাহিনী, পুলিশ আর বিজেপি থেকে শুরু করে সিপিআই(এম) পর্যন্ত সমস্ত রাজনৈতিক শক্তির মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, এই প্রতিরোধ সংগ্রাম ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণ মারফত জঙ্গী ও সশস্ত্র আকার ধারণ করছে। এটাই হল নকশালবাড়ির সত্যিকার আত্মা এবং আমি আবার ঘোষণা করতে চাই যে আমাদের পার্টি, কেবলমাত্র আমাদের পার্টিই তাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।

যাই হোক, সময়ের পরিবর্তনের সাথে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা বাস্তবিকই আমাদের রণকৌশলে গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন ঘটিয়েছি। এটা একেবারে স্বাভাবিক এবং বলতে কী এটা এক জীবন্ত সত্তারই পরিচায়ক। প্রত্যেক সজীব প্রাণীই পরিবেশের পরিবর্তনে সাড়া দেয় এবং বেঁচে থাকা ও বেড়ে ওঠার তাগিদে তার সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। কেবলমাত্র মৃত বস্তুই পরিবেশের পরিবর্তনে সাড়া দেয় না। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, যে প্রাণী অভিযোজনে ব্যর্থ হয় সে ক্রমে ক্রমে অবলুপ্ত হয়।

আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে আমরা কেবল কয়েকটি স্লোগান এবং রণকৌশলেরই পরিবর্তন ঘটিয়েছি কিন্তু আমাদের রণনীতিগত অবস্থানগুলি অটুট আছে। নকশালবাড়ি আজও আমাদের প্রেরণা, আমাদের পথপ্রদর্শক এবং যা কিছু রণকৌশলগত পরিবর্তনই আমরা ঘটিয়ে থাকি না কেন তা তার বিপ্লবী কাঠামোর মধ্যেই করা হয়েছে। আমাদের পার্টি লাইনের অভ্যন্তরে আমরা কিছু কৌশলগত পরিবর্তন যে ঘটিয়েছি তার প্রথম কারণ বাস্তব পরিস্থিতিই সেগুলিকে আবশ্যকীয় করে তুলেছিল; দ্বিতীয় কারণ সেগুলি সিপিআই(এম)-এর শঠতাগুলিকে উন্মোচিত করার ক্ষেত্রে আমাদের অনুকূল স্থান গড়ে দিয়েছে। উদাহরণ হিসাবে, কোনো কোনো রাজ্যে, কোনো কোনো পরিস্থিতিতে কমিউনিস্টদের সরকার গঠনের সম্ভাবনাকে বাতিল করে দেওয়ার পরিবর্তে, আমরা এই বিতর্ককে এ ধরনের সরকারকে ব্যবহার করার দুটি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যকার বিতর্কের স্তরে উন্নীত করি। একটি হল, শ্রমিক-কৃষককে সমাবেশিত করার কেন্দ্র হিসাবে কাজ করা, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী বিরোধীপক্ষের ভূমিকা পালন করা ও বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থার সংকটকে আসন্ন করে তোলা; আর অপরটি হল বুর্জোয়া-জমিদার ব্যবস্থার মধ্যেই ধীরে ধীরে অঙ্গীভূত হয়ে পড়া, যে পথ সমাজগণতন্ত্রী সিপিআই(এম)-এর পথ। আজকের সন্ধিক্ষণে যখন দীর্ঘদিন বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকার কারণে তার জৌলুষ অনেকটাই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে এবং ক্রমাগত তার প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্র উন্মোচিত হচ্ছে, তখন এই বিতর্ক বাম কর্মীবাহিনীর মধ্যে নতুন মেরুকরণ ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে নকশালবাড়িই বিপ্পবী এবং সুবিধাবাদী ধারার মধ্যে মৌলিক বিভাজন রেখা টেনে দেয়। কেউই মৌলিক এই বিভাজনকে মুছে দিতে পারে না। কিন্তু একথা বারবার নিছক পুনরাবৃত্তি করাটা আমাদের কোনো উপকারেই লাগবে না, বরং এ থেকে বিমূর্ত বুলি কপচে যাওয়ার মতো অধঃপতন ঘটারই সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের পার্টি প্রয়োজনীয় যেসব কৌশলগত পরিবর্তন সাধন করেছে, দীর্ঘ ব্যবধানের পর, তা আমাদের নীচুতলায় সমাজগণতন্ত্রীদের বিরুদ্ধে উদ্যোগ ফিরে পেতে সাহায্য করেছে। সিপিআই(এম)-এর সমাজগণতন্ত্রী অনুশীলন এক কানাগলির দিকে ছুটে চলেছে আর তার দ্বন্দ্বগুলি ক্রমাগত সামনে উঠে আসছে। যুক্তমোর্চা সরকারে যোগ দেওয়া নিয়ে বা যুক্তমোর্চার চরিত্রায়ণ নিয়ে, বুর্জোয়া পার্টিগুলির সঙ্গে জোট বাঁধার ক্ষেত্রে পার্টির কৌশলগত প্রশ্নে, সংসদীয় আঙ্গিনায় তাদের স্থিতাবস্থা ও হিন্দি বলয়ে অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতার প্রশ্নে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনে রণকৌশল নিয়ে ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্নে তাদের পার্টি নেতৃত্বের মধ্যে সাম্প্রতিক গুরুতর বিভাজনের কথা ভেবে দেখুন। এ সমস্ত কিছুই তাদের পার্টির মধ্যে ক্রমবর্ধমান ফাটলকেই দেখিয়ে দিচ্ছে। এই সমস্ত প্রশ্ন ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিপ্পবী ও সুবিধাবাদী ধারার মধ্যে চলমান বিতর্ককে নতুন স্তরে উন্নীত করার দাবি জানাচ্ছে এবং এভাবেই বাম কর্মীবাহিনীর মধ্যে নতুন মেরুকরণের পথ সুগম হবে। আমাদের পার্টি ঠিক এই কাজগুলিই করে চলেছে এবং কৌশলগত পরিবর্তনগুলি আমাদের সুবিধাজনক অবস্থানেই পৌঁছে দিয়েছে।

আমি এ কথা বলছি না যে এ কাজ খুব সহজ। সমাজগণতন্ত্রীরাও তাদের ঐক্যকে ধরে রাখার জন্য এবং বিপ্লবী কর্মীবাহিনীকে প্রভাবিত করার জন্য প্রয়োজনীয় রদবদল ঘটিয়ে থাকে। তাই ১৯৬৭-তে যে সংগ্রামের শুরু তা এভাবেই এগিয়ে চলেছে এবং আগামী দিনগুলিতে তা নতুন ও জটিল রূপ পরিগ্রহ করবে ও সিপিআই(এম)-এর সাথে [বা সিপিআই(এম)-এর বিভিন্ন অংশের সাথে] আমাদের সম্পর্কও নির্ধারণ করবে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক কী রূপ ধারণ করবে আগে হতে বলা মুশকিল, কিন্তু একটা ব্যাপার নিশ্চিত। তা হল এই যে ভারতের কমিউনিস্ট ও বামপন্থী আন্দোলনে সিপিআই(এম) ও সিপিআই(এমএল)-ই মতাদর্শগত ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে থাকবে – প্রত্যেকেই চেষ্টা চালাবে প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে। সমাজগণতন্ত্রীদের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির, আমি মনে করি, এটিই হল সারকথা।

টীকা

১. ১৮৪৮ সালের বিপ্লবের পর ফরাসী সংবিধানসভা যে প্রজাতন্ত্রী সংবিধান তৈরি করেছিল, এখানে তার কথা বলা হয়েছে।