(লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯০ থেকে)
কমরেড ও বন্ধুগণ,
পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে আমি আপনাদের সবাইকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাচ্ছি।
সারা দেশে আজ আগুন জ্বলছে। জাতীয় ঐক্য ও সংহতির তথাকথিত রক্ষাকর্তারা সকলেই দেশের ধ্বংসসাধনেই ব্যস্ত। চূড়ান্ত বিভেদ সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই সুর তুলে শোনানো হচ্ছে অন্তর-মিলনের কাব্য। পাঞ্জাব, কাশ্মীর ও আসামের সমস্যাগুলির রাজনৈতিক সমাধানের সমস্ত কথাবার্তা থেমে গেছে। অন্যদিকে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা সৃষ্টিকারী ফ্যাসিবাদী-সাম্প্রদায়িক ‘রথ’ যাত্রা অব্যাহত। হিন্দি নিয়ে বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে বিভাজনকে বাড়িয়ে তুলছে এবং উত্তর ও মধ্যভারতের ব্যাপক অংশ তীব্র জাতপাতের লড়াইয়ে দীর্ণ হচ্ছে। সর্বব্যাপী এই হতাশার মাঝে আজকের এই জনসমাবেশ অবশ্যই এক নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। আপনাদের আকাশ কাঁপানো স্লোগান আর চারদিকে লাল পতাকার আলোড়ন আমাদের অবরুদ্ধ দেশের কাছে এই একক বার্তা পাঠাচ্ছে যে জনগণের যথার্থ ইস্যুগুলি অবশ্যই আলাদা। এ হল সম্মিলিত সংগ্রামের স্থির সংকল্প, যে সংগ্রাম একসাথে চালাতে হবে। আমাদের শাসকদের কাছে এই হুঁশিয়ারী পাঠাচ্ছে যে তারা যখন তাদের সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ করতেই ব্যস্ত তখন আমরাও নিজেদের অধিকার কায়েম করতে পণ রাখার মতো অবস্থায় পৌঁছাতে শুরু করেছি।
ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সংরক্ষণ ও মণ্ডল কমিশনের সুপারিশগুলির বিরোধিতায় ছাত্ররা উত্তাল। কেউ কেউ আবার আত্মাহুতির মতো চরম পথও বেছে নিচ্ছে। আমরা জানি যে ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রতিক্রিয়ার কিছু হোতা ছাত্রদের এই জনপ্রিয় বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে নিতে উঠে-পড়ে লেগেছে দেশকে মধ্যযুগীয় অন্ধকারে টেনে নিয়ে যেতে। এই সংরক্ষণ বিরোধী দাঙ্গাহাঙ্গামার পিছনে কংগ্রেস, বিজেপি ও জনতা দলের দেবীলাল গোষ্ঠীর কায়েমী রাজনৈতিক স্বার্থ সম্পর্কেও আমরা অবহিত। এ সত্ত্বেও আমরা মনে করি যে, বেকারির বিরুদ্ধে তাদের অসীম ঘৃণা এবং ভবিষ্যৎ নিরাশাই তাদের এই সংরক্ষণ বিরোধী বিক্ষোভের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এই সেদিন পর্যন্ত এই মধ্যবিত্ত যুব সম্প্রদায় ত্রাতা ভি পি সিং-এর নৈতিক আবেদনে সম্মোহিত ছিল, কিন্তু এখন তাদের এই উপলব্ধি হয়েছে যে তিনিও চতুর চাণক্যের ছাঁচে গড়া একজন রাজনীতিবিদ মাত্র, আর তাই তাদের ক্ষোভের সুরাহার কোনো পথ নেই।
বাবরের বর্তমান বংশধরদের উপর প্রতিশোধ নিতে চান এমন রাজনীতিকদের আমরা যেমন স্বীকার করি না, তেমনি তাদের পূর্বপুরুষদের অপরাধের জন্য মনুর বর্তমান প্রজন্মকে শাস্তি দেওয়ার কথা বলেন যে সমস্ত তত্ত্ববিদ আমরা তাদেরও প্রত্যাখ্যান করি। আমরা আবার বলছি, সরকারের উচিত ছিল তাদের নিজেদের নির্বাচন-পূর্ববর্তী প্রতিশ্রুতি পালন করে “কাজের অধিকার”কে মৌলিক অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া এবং ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী পরিকল্পনাগুলি ঘোষণা করা যা ছাত্র ও যুবকদের মনে আশার সঞ্চার করতে পারত। এই ধরনের এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে যদি মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টকে গ্রহণ করা হত তবে এই যুবকদের সামাজিক ন্যায়ের সংগ্রামে সমাবেশিত করা যেত এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের হোতা ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার শক্তিগুলির কবল থেকে তাদের মুক্ত করা যেত। কিন্তু বেকারি সমস্যার মোকাবিলায় বা সামাজিক ন্যায়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তার আন্তরিকতা সম্পর্কে আস্থা জাগাতে এই সরকার শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ভি পি সিং-এর মণ্ডল কসরৎ তার সংকীর্ণ গোষ্ঠীবাজির খেলায় এক চতুর কৌশল ছাড়া অন্য কিছু নয় এবং এভাবেই বিষয়টি উন্মোচিত হয়েছে।
আমরা এটিও বলতে চাই যে ছাত্র-যুব বিক্ষোভ এক নেতিবাচক মোড় নিয়েছে। পশ্চাদপদদের জন্য ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ প্রকল্পের বিরোধিতা করার পরিবর্তে তাদের আন্দোলনের বর্শামুখ রাখা উচিত ছিল কাজের অধিকারের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য। এই জন্যই আমরা ‘কাম দো’ (কাজ দাও) স্লোগানকে কেন্দ্র করেই এই সমাবেশ সংগঠিত করেছি এবং এই মৌলিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তাদের সর্বশক্তি দিয়ে যোগদানের জন্য আমরা ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের কাছে আবেদন জানাই।
দলিত ও পশ্চাদপদ জাতিগুলির জন্য কাজের সংরক্ষণকে আমরা নিশ্চিতভাবে সমর্থন করি। কিন্তু আমাদের এই সমর্থন ভি পি সিং-এর ধূর্ত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সমর্থন নয়, আবার লোহিয়াপন্থী তত্ত্বের প্রতি সমর্থনও বলা যাবে না, যে তত্ত্বে সমাজতন্ত্রের ধারণাকে পশ্চাদপদতার রাজনীতিতে অধঃপতিত করা হয়েছে।
সংরক্ষণের প্রতি আমাদের সমর্থন বলতে আমরা আগ্রাসী পশ্চাদপদ জাতিগুলির জাতপাতের লড়াইয়ের পিছনে দলিতদের সমাবেশিত করার কথা বোঝাই না। তা কখনই লাল পতাকাকে সবুজ পতাকার অধীনস্থ করা – কাস্তে-হাতুড়িকে চক্রের অধীনস্থ করাও নয়।
আমরা লাল পতাকার স্বাধীন আত্মঘোষণার পক্ষে, আমরা লাল কেল্লার উপর লাল পতাকা তোলার স্বপ্ন দেখতে চাই। এই স্বপ্নকে সার্থক করে তোলার জন্যই আমাদের এত আত্মত্যাগ, আর ভবিষ্যতেও ভারতীয় জনগণের এই মহান লক্ষ্যের স্বার্থে আমরা যে কোনো আত্মত্যাগ থেকে বিরত হব না। দলিতদের মধ্যে আমাদের এক দৃঢ় ভিত্তি রয়েছে, কিন্তু কাঁসিরাম ও তার সম্প্রদায়ের ‘দলিতবাদের’ বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়েই এই ভিত্তি বিকাশলাভ করেছে। পশ্চাদপদ জাতিগুলির মধ্যেও আমাদের ভিত্তি বাড়ছে, কিন্তু মুলায়ম সিং ও লালু যাদবের পশ্চাদপদবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভিত্তিতেই তার বিকাশ ঘটছে। দলিতদের মধ্য থেকে উদ্ভূত নব্য ব্রাহ্মণ্যবাদীরা এবং বর্ধিষ্ণু পশ্চাদপদরা – উভয়েই আমাদের আন্দোলনের নিশানা। অপরদিকে আলোকপ্রাপ্ত অংশ এবং উচ্চবর্ণের মধ্যকার দরিদ্র মানুষরাও ব্যাপক সংখ্যায় আমাদের আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছেন। নেহরুর সংস্কারের কল্যাণে আমাদের সমাজ সামন্ততান্ত্রিক-জাতপাত ভিত্তিক বিভাজন থেকে মুক্ত হয়ে গেছে এবং এক আধুনিক সমাজে পরিণত হয়েছে, আর তাই সংরক্ষণ অগ্রগতির ধারাকে পশ্চাদমুখী করবে – এইসব কথাবার্তা যে সমস্ত তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ বলেন তাদের সঙ্গে আমরা সহমত পোষণ করি না। এটিই ঠিক ভারতের বাস্তবতা নয়।
আমরা সংরক্ষণকে সমর্থন করি কেননা আমরা বিশ্বাস করি যে, শুরুতে যথেষ্ট উত্তেজনার সৃষ্টি হলেও শেষ পর্যন্ত তা উন্নত-পশ্চাদপদদের মধ্যে বিদ্যমান বিভেদকে প্রশমিত করবে, পশ্চাদবর্তীতা ও অগ্রগামিতার মানসিকতায় আঘাত হানবে এবং পশ্চাদপদ ও উচ্চবর্ণের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে তথা আমলাতন্ত্রের মধ্যে এক ধরনের সমতা নিয়ে আসবে। আর বিভিন্ন জাতির স্বচ্ছলদের মধ্যে সংহতির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নীচুতলার মানুষের মধ্যেও অনুরূপ এক শ্রেণী সংহতির বিকাশ ঘটবে।
সামন্ততান্ত্রিক, ধর্মান্ধ যে কোনো ধারার প্রতি আঘাত, বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক উদারিকরণের যে কোনো পদক্ষেপ – তা যতই ওপর ওপর হোক না কেন – সমাজে শ্রেণী মেরুকরণের প্রক্রিয়াকে অবশ্যই ত্বরান্বিত করবে, এবং কমিউনিস্ট হিসাবে, শ্রেণী সংগ্রামের রক্ষক হিসাবে আমরা সমাজের অভ্যন্তরে ঐ ধরনের যে কোনো শ্রেণী বিভাজনকে স্বাগত জানাই।
সংরক্ষণ-সমর্থক সকল বাম শক্তির কাছে আমাদের আন্তরিক আবেদন, ভি পি সিং, রাম বিলাস পাসোয়ান বা শারদ যাদব, মুলায়ম সিং বা লালু যাদবের পিছনে পিছনে না চলে আসুন এক স্বাধীন শক্তি হিসাবে আমরা নিজেদের তুলে ধরি, সংরক্ষণের জন্য সংগ্রামকে কাজের জন্য সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ করে তুলি। এই ধরনের জটিল সন্ধিক্ষণে আমরা কমিউনিস্টরা, বিপ্লবী গণতন্ত্রীরা হিন্দি বলয়ে সবসময়েই নিজেদের পরাজিত হতে দেখেছি। কখনও বাস্তবতার নামে লোহিয়াপন্থী বা বিভিন্ন বর্ণের জাতপাতের শক্তিগুলির সামনে উদ্যোগহীন হয়ে থেকেছি অথবা এই সমস্ত মধ্যপন্থী ধারাগুলির পিছু পিছু চলার মধ্যেই আমাদের ভূমিকাকে সীমাবদ্ধ রেখেছি। এই কারণেই দেশের এই অংশে আমরা কমিউনিস্ট, বামপন্থী ধারাকে শক্তিশালী করতে সক্ষম হতে পারিনি। আমাদের কিছু কিছু বন্ধু এই পুরোনো ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন। আইপিএফ-এর মাধ্যমে বিহারে বাম আন্দোলন এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং কাঁশিরামদের দলিতবাদ বা লোকদলের মতো দলগুলির পশ্চাদপদবাদ কোনোকিছুই এই উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিকে রোধ করতে পারেনি। শ্রেণী ঐক্য ও শ্রেণী সংগ্রামের বুনিয়াদী ভিত্তির উপর ভর করে আমরা চিরাচরিত ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে দলিত ও পশ্চাদপদদের এক নতুন সংগ্রামী জোটেরও বিকাশ ঘটাতে শুরু করেছি। বিহারে আমরা যে দৃঢ় ভিত্তি অর্জন করেছি সমস্ত বামপন্থী শক্তিগুলিকে তার চূড়ান্ত সদ্ব্যবহার করে নিতে হবে।
পূর্ব ইউরোপ আর সোভিয়েত ইউনিয়নে যাই-ই ঘটুক না কেন, আমাদের দেশে বাম আন্দোলন, কমিউনিস্ট পার্টির সামনে ভবিষ্যৎ অবশ্যই উজ্জ্বল। গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামেও অবশ্যই বামেদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে। সিপিআই এবং সিপিআই(এম)-এর মধ্যে আমাদের বন্ধুদের আমরা পুনরায় আশ্বস্ত করতে চাই যে আমাদের সংগ্রাম আপনাদের বিরুদ্ধে নয়। রাজনৈতিক লাইন ও কর্মনীতির বিভিন্ন প্রশ্নে আমাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে এবং এই সমস্ত বিষয়ে আমরা সুস্থ বিতর্ক চালাতে চাই। যে সমস্ত রাজ্যে আপনারা সরকার চালাচ্ছেন সেখানে আমরা আপনাদের জনস্বার্থ-বিরোধী পদক্ষেপগুলির বিরোধিতা না করে পারি না এবং আমরা তা করেও যাব, কেননা কমিউনিস্ট হিসাবে আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে জনগণের কাছে এবং আমরা তাদের স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে, কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক-বিরোধী শিল্পনীতি, জনগণের প্রয়োজনীয় সমস্ত ভোগ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি, ত্রিপুরা বা অন্যত্র আপনাদের শক্তিগুলির উপর নিপীড়নের প্রশ্নে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং এই ধরনের প্রশ্নগুলিতে আমরা আপনাদের সঙ্গে যৌথ কার্যকলাপ চালানোর পক্ষে। আমরা বুঝতে পারি না আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে যৌথ কার্যকলাপ চালাতে আপনাদের বাধা কোথায়। হাজারো পার্থক্য সত্ত্বেও আপনারা কখনও কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাবুঝি গড়ে তুলতে পারেন, জনতা দলের সঙ্গে আঁতাত করতে পারেন এবং এমনকি বিজেপির সঙ্গেও কৌশলে কাজ চালাতে পারেন। আমরা যারা সেই একই কাস্তে-হাতুড়ি খোদাই করা লাল পতাকাকে তুলে ধরি, আমরা যারা গ্রাম ও শহরের দরিদ্রতম শ্রমজীবী মানুষের জন্য লড়াই করছি এবং তাঁদের স্বার্থে যে কোনো ধরনেরই আত্মত্যাগে পিছপা হই না, আমরা যারা বুর্জোয়া জমিদার জোটের যে কোনো রাজনৈতিক গঠনের বিরুদ্ধে – তা সে কংগ্রেস, বিজেপি, জনতা দল বা অগপ-ই হোক – সর্বাপেক্ষা দৃঢ়ভাবে লড়াই চালিয়ে আসছি, তবে পৃথিবীতে শুধুমাত্র আমাদেরই কেন আপনারা প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করবেন? যেভাবে সমস্ত কিছু চলছে তাকে নতুনভাবে বিচার বিবেচনার জন্য আমরা বামপন্থী কর্মীবাহিনী এবং তাদের চিন্তাশীল ও নিষ্ঠাবান নেতৃবৃন্দের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে অতীতের অনেক কিছুই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। গত বিশ বছরে আমাদের চারদিকে পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তনই ঘটে গেছে। অতীত পড়ে থাক, আসুন আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকাই। আজকের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের পরিস্থিতিতে সিপিআই, সিপিআই(এম) এবং সিপিআই(এমএল)-এর যতদূর সম্ভব একসাথে চলার জন্য পথ খুঁজে বার করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের তিন দলের মধ্যে যে কোনো ঐক্য জনগণকে এক নতুন আশায় উজ্জীবিত করবে এবং এই সংকট জর্জরিত দেশে, যেখানে সমস্ত ধরনের বুর্জোয়া বিকল্প সম্পর্কে জনগণের ক্রমশই মোহভঙ্গ ঘটছে, তা এক শক্তিশালী বাম আন্দোলনের পুনরুত্থান ঘটাবে। ইতিহাসের এই দাবিতে সাড়া দিতে নাম্বুদিরিপাদ বা ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত কি প্রয়োজনীয় সাহস দেখাবেন?
পশ্চিমবাংলায় সম্প্রতি আমরা এক ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের বিকাশ ঘটানোর জন্য সহযাত্রী বিপ্লবী বামশক্তিগুলির সঙ্গে হাত মিলিয়েছি। পশ্চিমবাংলায় আমাদের আন্দোলন শুধু বামফ্রন্ট সরকারের নিপীড়নমূলক, জনবিরোধী নীতি ও পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধেই নয়, তা একই সঙ্গে দক্ষিণপন্থী বিরোধীপক্ষ, বিশেষত ক্রমবর্ধমান গণঅসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে কংগ্রেস(ই)-র পুনরুত্থানের মরিয়া প্রয়াসের বিরুদ্ধেও এক প্রতিরোধের সুদৃঢ় প্রাচীর খাড়া করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমরা মনে করি পশ্চিমবাংলায় পূর্ব ইউরোপের পুনরাবৃত্তিকে ঠেকাতে এটিই একমাত্র কার্যকরী পথ।
ইতিহাস প্রমাণ করেছে ভারতবর্ষে বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের উত্তরাধিকার একমাত্র আমাদের পার্টির হাতেই সবচেয়ে সুরক্ষিত। কিছু বিমূর্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে যে সমস্ত কমরেড আমাদের ছেড়ে গেছেন, আমাদের বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে ব্যর্থ আশা পোষণ করে যাঁরা ভুল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন, চটজলদি বিপ্লবের দুঃসাহসিক স্বপ্ন যাঁদের বিপথগামী করেছে বা ধাক্কায় হতাশগ্রস্ত হয়ে যাঁরা কোনো না কোনো ধরনের উদারনীতিবাদী কর্মনীতির কবলে চলে গেছেন, তাঁদের কাছে আমাদের আন্তরিক আবেদন বাস্তবের মুখোমুখি হোন, আমাদের পার্টির লাল পতাকাতলে সমাবেশিত হোন, আমাদের প্রিয় কমরেড যাঁরা আমাদের ছেড়ে গেছেন তাঁদের জন্য আমাদের দরজা সব সময়েই খোলা থাকবে।
আইপিএফ হল বিপ্লবী গণতন্ত্রের জন্য সর্বাপেক্ষা দৃঢ় আন্দোলনের অপর নাম, যা শুধু প্রথাগত বামপন্থীদের শক্তি ও সংগ্রামকে, শ্রমিক ও কৃষকদের সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করতেই প্রয়াসী হয়নি, ভারতবর্ষের গণতন্ত্রের সমস্ত ধারাকেই – তা জাতীয় সংখ্যালঘু, মহিলা বা পরিবেশ ইস্যুতে আন্দোলনই হোক অথবা ধর্মীয় সংস্কার বা নাগরিক স্বাধীনতার অভিযানই হোক – এই সবকিছুকেই সমন্বিত করতে সচেষ্ট। আইপিএফ-কে স্বাধীন করে তুলতে আমাদের পার্টি আইপিএফ-এর এই দিশার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এ এক অভিনব পরীক্ষা-নিরীক্ষা। গোঁড়া কমিউনিস্ট বিরোধী নন এমন সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির কাছে আমাদের আন্তরিক আবেদন – এই পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে সফল করে তুলতে আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করুন।
অতীতে আমরা কিছু ভুল করেছি, আর আজ যা করছি তার মধ্যেও কিছু দুর্বলতা ও ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। আমরা সবসময়েই ভুল থেকে শিক্ষা নিতে প্রস্তুত এবং ইতিহাস প্রমাণ করেছে আমরা কোনো গোঁড়ামির দাস নই।
এই সমাবেশ থেকে আপনারা যখন নিজেদের এলাকায় ফিরে যাবেন, ব্যাপক জনগণের কাছে আপনাদের এই বার্তা পৌঁছে দিতে হবে। লাল পতাকার মর্যাদা রক্ষা করা এবং সর্বশক্তি দিয়ে বিপ্লবী গণতন্ত্রের এক নতুন জোয়ার নিয়ে আসার দায়িত্ব আপনাদের কাঁধে। এটি এমন এক জোয়ার যা ভারতবর্ষের প্রকৃত ঐক্য নিয়ে আসবে, যা ভাষা বা জাতিসত্তা, জাতি বা ধর্ম নির্বিশেষে শ্রমজীবী জনতার সমস্ত অংশের আকাঙ্খাকে ঐক্যবদ্ধ করবে।
ভারতীয় বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক!
জনগণের ক্ষমতা দীর্ঘজীবী হোক!