(ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্ট থেকে)

কংগ্রেসের পতন

১৯৯৬ সালের সংসদীয় নির্বাচনে, ভারতীয় শাসক শ্রেণীগুলির প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস(ই) ভোটে ক্ষমতাচ্যুত হয়। সংসদে এর আসনসংখ্যা কমে গিয়ে নীচে নামার রেকর্ড করে। পরবর্তীকালে এর বেশিরভাগ মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও একটার পর একটা কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার কারণে চার্জশীট পায়। যে সরকার উদারীকরণের নয়া আর্থিক নীতি প্রবর্তন করেছিল, দেখা গেল তাঁরা দুর্নীতিতেই সবচেয়ে বেশি উদার এবং এ পর্যন্ত ভারতের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত কেন্দ্রীয় সরকার বলে উদ্ঘাটিত হয়েছেন।

এই পার্টিটা পুরোপুরি বে-ইজ্জত হয়ে গেছে। বিশেষ করে সবচেয়ে জনবহুল হিন্দিভাষী দুটি রাজ্য উত্তরপ্রদেশ ও বিহারে এর প্রান্তিক হয়ে পড়া এর পুনরুজ্জীবনের যে কোনো আশু সম্ভাবনার উপর গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন লাগিয়ে দিয়েছে। তারপর আছে উপদলীয় সংঘাত ও গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষের ভেঙ্গে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি। নেতৃত্বকে বদলে দিয়ে ও নেহরু বংশকে আহ্বান জানিয়ে এই পার্টি নিজের ভাবমূর্তিকে নতুন করে সাজাবার কঠোর চেষ্টা চালাচ্ছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত জনতার কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করার কোনো লক্ষণ নেই।

যদিও রাজনৈতিক প্রভাব ও সাংগঠনিক কাঠামোর বিচারে এটিই একমাত্র পার্টি যার সর্বভারতীয় উপস্থিতি রয়েছে, তথাপি এই পার্টি নিজে নিজে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখল করার ধারেকাছেও আছে বলে মনে হয় না।

এই অর্থে পরিস্থিতি ১৯৭৭ থেকে এমনকি ১৯৮৯ থেকেও রীতিমতো ভিন্ন। অতএব যুক্তফ্রন্ট সরকারকে যে সমর্থন এই পার্টি দিয়েছে, তা দীর্ঘমেয়াদী, রণনৈতিক প্রকৃতির। যুক্তফ্রন্টে যে দ্বন্দ্বগুলি দেখা দেয়, এই পার্টি সেগুলি কাজে লাগাতে চায় এবং মধ্যপন্থী ও আঞ্চলিক শিবির থেকে সহযোগী পেতে চায়, যাতে পরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংগ্রহ করা যায়। বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য ও বাম, মধ্যপন্থী ও আঞ্চলিক সংগঠনগুলির তথাকথিত তৃতীয় শিবিরে ভাঙ্গন ধরানোর জন্য ও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের রূপে প্রত্যাবর্তন ঘটানোর জন্য বিভিন্ন কৌশল গ্রহণের উল্লেখযোগ্য ক্ষমতা এখনো এই পার্টি রাখে।

বিজেপির অমঙ্গল সংকেত

গত নির্বাচনে বিজেপি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করে। তথাপি তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে কম থাকে এবং তাদের সেরা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তা তারা জোগাড় করতে পারেনি। তবে সহযোগীর খোঁজ পেতে সফল হয়েছে – শিবসেনা ছাড়া, বিএসপি, সমতা, আকালি এবং হরিয়ানা বিকাশ পার্টিতে। কিছু আঞ্চলিক শক্তিকে জয় করে নেওয়ার জন্য এই পার্টি বেপরোয়া চেষ্টা চালাচ্ছে যাতে পাল্লা তার দিকে ঝুঁকে যায় আর অটল বিহারী বাজপেয়ী এক জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের কথাও বলে চলেছেন। চলার পথে একসময় এই পার্টি বুঝতে পেরেছে যে সে তার চরমে পৌঁছেছে এবং উত্তর ও পশ্চিম ভারতের বাইরে বিস্তারে আর সমর্থ হয়নি। তারপরে তার ভাগের বাগেলা ও খুরানারাও আছে।

তার বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা, যা বাবরি মসজিদ ঘটনার পর মার খেয়েছিল, তাকে বাড়ানোর জন্য এই পার্টি দুমুখো রণনীতি গ্রহণ করেছে। প্রথমে এই পার্টি কঠোরভাবে চেষ্টা করছে যাতে স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তরাধিকারকে আত্মসাৎ করতে পারে এবং সেজন্য এই পার্টি নিজেকে কংগ্রেসের গান্ধী-প্যাটেল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হিসাবে তুলে ধরতে চায়। এই পার্টি আশা করে, এর ফলে তার পক্ষে কংগ্রেস ঘাঁটিতে আরও ঢুঁ মারতে সুবিধা হবে। দ্বিতীয়ত, এই পার্টি কঠোর চেষ্টা চালাচ্ছে তার বানিয়া-উচ্চবর্ণের ভাবমূর্তিটি পরিত্যাগ করতে এবং দলিত ও পশ্চাদপদদের এবং সেই সাথে অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যেও, যারা পূর্বে উত্তর ভারতে চরণ সিং-এর ভিত গঠন করত, তাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করতে। তার জন্য এই পার্টি সমতা এবং বিএসপি-র সাথে রণনৈতিক অংশীদারিত্বের ওকালতি করে ও অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে আসা রাজ্য স্তরের নেতাদের তুলে ধরতে চায়।

স্বদেশীর স্লোগান উত্থাপন করার মধ্য দিয়ে এই পার্টি ভারতের শিল্পপতিদের কাছে বহুজাতিকদের সাথে আরও ভালো দরকষাকষির আশ্বাস দিতে চায়। আর ‘শুচিতা’ ও ‘ভয়মুক্ত সমাজ’-এর কথা সদাসর্বদা বলে বিজেপি তার পুঁজি বুদ্ধিজীবী ও শহুরে মধ্যবিত্তি শ্রেণীর মধ্যে ভালোমতো বাড়িয়ে নিতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু এনরন প্রশ্নে তার পূর্বেকার ডিগবাজি যেমন গেরুয়া স্বদেশীর পালিশ তুলে নিয়েছিল, তেমনি উত্তরপ্রদেশের চলমান ঘটনাবলীও, যেখানে কল্যাণ সিং পুরো এক সারি অপরাধীদের নিয়ে নেওয়া সহ সবচেয়ে নির্লজ্জ ধরনের কেনা-বেচার পথ অবলম্বন করছেন, বিজেপির ‘একমাত্র বিশিষ্ট পার্টি’ হওয়ার দাবিকে ধ্বসিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, উত্তরপ্রদেশে কল্যাণ সিং দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার প্রথম দিন থেকেই বিরাটভাবে চোখ খুলে দেওয়ার কাজ করেছে। মুখ্যমন্ত্রীর গদীতে বসতে না বসতেই, তিনি এমনকি অযোধ্যা ধ্বংসকাণ্ড মামলার একজন মূল আসামী হিসাবে চার্জশীট পাওয়া সত্ত্বেও, অযোধ্যা প্রশ্নটিকে খুঁচিয়ে তুলতে কোনো কালক্ষেপ করেননি। উত্তরপ্রদেশে আমাদের কমরেডরা তাঁর দ্বিতীয়বারের শপথগ্রহণ যখন চলছিল, তখন রাজ্য বিধানসভার বাইরে এক বহু বিজ্ঞাপিত ধর্ণা সংগঠিত করে এক সময়োচিত প্রতিবাদ-ধ্বনি তুলেছিলেন।

সংক্ষেপে, আশির দশকের শেষের দিকের অর্থনৈতিক সংকট ও রাজনৈতিক আলোড়নের ফলশ্রুতিতে ভারতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যে দক্ষিণপন্থী ঝোঁক আসে, তা বিজেপির মধ্যে কেন্দ্রীভূত অভিব্যক্তি পায় এবং গেরুয়ার এক প্রকৃত অমঙ্গল ছায়া ভারতের উপর এই প্রথম বড় হয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশে কল্যাণ সিং-এর দ্বিতীয়বারের ক্ষমতায় আসার মধ্যে যার পূর্বাভাষ পাওয়া যায়।

এই পার্টির কর্মসূচিতে রয়েছে ভারতের প্রতিবেশীদের বিশেষত পাকিস্তানের ব্যাপারে উগ্র-জাতিদম্ভের নীতি অনুসরণ করা, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উত্তপ্ত করে তোলা, যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে গণ্য হবেন এখন হিন্দুরাষ্ট্রে ভারতকে রূপান্তরিত করা, যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে হীনবল করা, বর্বরোচিত রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন চালানো, গ্রামীণ দরিদ্রদের কৃষি আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য জমিদারদের নিজস্ব সেনাবাহিনী সংগঠিত করা, চলমান জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনগুলিকে সামরিকভাবে দমন করা; বৌদ্ধিক, নান্দনিক ও শিক্ষাক্ষেত্রে সবধরনের মতভেদকে গুঁড়িয়ে দেওয়া। সংক্ষেপে, ভারতে ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব চাপিয়ে দেওয়া।

এটা অবশ্যই ভুললে চলবে না যে, দেশে বিরাজমান বিশৃঙ্খলা, সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলির বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষয়, কংগ্রেসের পরিপূর্ণ অধঃপতন, সামাজিক ন্যায়ের শিবিরের ভাঙ্গন, বামপন্থীদের মতাদর্শগত বাঁধুনির অবমূল্যায়ন ও বর্তমান যুক্তফ্রন্ট ব্যবস্থার ব্যর্থতা – এসব কিছু বিজেপির জন্য এক প্রশস্ত জায়গা সৃষ্টি করেছে। বাস্তবে, ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী পরবর্তী নির্বাচনের মধ্যে, এমনকি হয়তো বা তার আগেও, বিজেপির ক্ষমতায় আরোহনকে স্বাগত জানাতে পুরো তৈরি হয়ে আছে।

যুক্তফ্রন্ট পরিঘটনা

রাজনৈতিক অচল অবস্থার এক পরিস্থিতিতে ১৩ দলের যুক্তফ্রন্ট রূপ লাভ করে এবং কংগ্রেসের সমর্থনে ক্ষমতাগ্রহণ করে। তারপর থেকে প্রায় দেড় বছর এটা শীর্ষে বসে আছে। যদিও সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রস্তাব বাতিল করে দেয়, তবু হরকিষেণ সিং সুরজিত যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রথম পর্যায়ে মহা-প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তবে কংগ্রেস এক নতুন সভাপতির অধীনে সংহত হয় ও চমৎকার এক অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তনে বাধ্য করে ও উদ্যোগ ছিনিয়ে নেয়। কংগ্রেস সম্পর্কে যুক্তফ্রন্টের নেতাদের ভাষা রাতারাতি পাল্টে যায়। বর্তমানে যুক্তফ্রন্ট সরকার কোনো পরিকল্পনায় চলছে না, চলছে আর কেউ নেই বলে। কংগ্রেস নিজেকে ক্ষমতায় তুলতে পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে।

যুক্তফ্রন্ট পরিঘটনাকে কয়েকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সেগুলির যৌক্তিকতা বিচার করা যাক।

প্রথমে, এটা বলা হয় যে যুক্তফ্রন্ট ভারতীয় রাজনীতিতে কোয়ালিশন যুগের আবির্ভাবের প্রতীক। অবশ্য, ভারতের বহুমুখী বৈচিত্র্য পুরোপুরি প্রদর্শিত হলে যে কোনো একটি পার্টির পক্ষে যথেষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা হাতে রাখা কঠিন হতে পারে এবং এই অর্থে কোয়ালিশন যুগ থাকতেই এসেছে বলে মনে হয়। কিন্তু একটি কোয়ালিশন যাতে কংগ্রেস ও বিজেপি উভয় বড় জাতীয় পার্টি নেই, যারা একত্রে সংসদে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আসন দখলে রাখে, এমন কোয়ালিশন নিয়ম না হয়ে কেবল ব্যতিক্রমই হতে পারে। আগে হোক পরে হোক, বড় দুইটি পার্টির যে কোনো একটি সরকার চালানোর মতো যথেষ্ট সমর্থন নিজেদের পিছনে সমবেত করবে।

দ্বিতীয়ত যুক্তফ্রন্ট রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে আরও বেশি যুক্তরাষ্ট্রীয়তার আবির্ভাব সূচিত করে বলে বর্ণনা করা হয়েছে, যখন আঞ্চলিক পার্টিগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের উল্লেখযোগ্য প্রভাব ভোগ করছে। আঞ্চলিক পার্টিগুলির ভূমিকা রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সত্যিই উদয় হয়েছে, বিশেষত নয়া অর্থনৈতিক নীতির আবির্ভাবের সাথে সাথে। এই নীতি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল করার দ্বারা বেসরকারি বিনিয়োগ সরাসরি আমন্ত্রণ করার ব্যাপারে রাজ্যগুলিকে অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা তাঁদের নিজ নিজ রাজ্যে বিদেশী পুঁজি আনার জন্য সোজা পশ্চিমে চলে যাচ্ছেন। বিনিয়োগকারীদের কর ছাড়ের উৎসাহ দিতে মুখ্যমন্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করছেন।

নবম পরিকল্পনায় (১৯৯৭-২০০২) রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমিয়ে ৩৬ শতাংশ করা হয়েছে, এর মোটা অংশই বেসরকারি সমিতিবদ্ধ ক্ষেত্র (কোম্পানি) থেকে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। বেসরকারি বিনিয়োগ যদি বাস্তবায়িত হয়ও তা কেবল বেশি লাভের ক্ষেত্র ও এলাকায় যাবে। এর ফলে রাজ্যগুলির মধ্যে বৈষম্য আরও বেড়ে যাবে।

প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তিগুলি নিজেদের রাজ্যের মধ্যে ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলির রাজ্যের বা স্বায়ত্ততার দাবি মানতে রীতিমতো অনিচ্ছুক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আঞ্চলিক শক্তিগোষ্ঠীগুলি জমিদার-কুলাক গোষ্ঠীর উপর চূড়ান্তভাবে নির্ভরশীল। ফলে তাঁরা ভূমিসংস্কারকে চালিয়ে যেতে উৎসাহী নন।

সুতরাং, ভারতীয় পরিস্থিতিতে, যুক্তরাষ্ট্রবাদ পরিষ্কার অর্থে, গণতান্ত্রিক সংস্কার চালানোর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অতো স্বর্ণময় নয়। তদুপরি, যুক্তরাষ্ট্রীয়তার পরিপ্রেক্ষেত শক্তিশালী ও দুর্বল রাজ্যের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হয়। যদি পাঞ্জাবে পৃথক খালিস্তানের দাবি ওঠে বা অকালীরা দাবি করে যে, চারটি বিষয় ছাড়া, অর্থাৎ মুদ্রা, বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ছাড়া, আর সব ক্ষমতা রাজ্যের হাতে ন্যস্ত হবে, তবে এটা সফল শক্তির বিচ্ছিন্নতা হবে। আর আসামের ক্ষেত্রে, বেশিটাই দিল্লীর শাসকদের অবহেলা থেকে অনুরূপ দাবি উদ্ভূত হয়।

তৃতীয়ত, যুক্তফ্রন্টকে বিজেপি-বিরোধী অ-কংগ্রেসী ফ্রন্ট হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে, শ্রমিক কৃষক এবং সম্মুখদর্শী বুর্জোয়া শ্রেণীর এক যুক্তফ্রন্ট, এক ঐক্য যা কিনা সর্বহারাশ্রেণীর আধিপত্যের বিকাশের প্রক্রিয়ার সময় কাঙ্খিত জনগণের গণতান্ত্রিক ফ্রন্টে রূপান্তরিত হবে, এবং বামপন্থার যা কিছু শ্রেষ্ঠ ও গান্ধীবাদী উত্তরাধিকারের সম্মিলন হিসাবে ইত্যাদি। এই মতামতগুলি ব্যক্ত করেছেন, আর কেউ নন, কমরেড নাম্বুদিরিপাদ, সিপিআই(এম)-এর সরকারি মুখপাত্র। এইগুলি ছিল ফ্রন্টের গঠনমূলক পর্যায়ে মতামত, যখন সিপিআই(এম) নেতৃত্ব এই কল্পকথা ছড়াতে ব্যস্ত ছিলেন যে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচি রাও সরকারের নয়া আর্থিক নীতিকে বাতিল করেছে এবং কংগ্রেসের সমর্থন নিঃশর্ত ও বাধ্যতা থেকে উদ্ভূত।

এরপর থেকে যমুনা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। কংগ্রেস উদ্যোগ ছিনিয়ে নিয়েছে এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারের উপর বেশি প্রভাব খাটাচ্ছে। অন্যদিকে সিপিআই(এম) প্রান্তিক হয়ে পড়েছে বলে মনে করে এবং কথায় বার্তায় অনেক বেশি সমালোচনামূলক হয়েছে। পরিহাসের বিষয় এই যে, এখন যারা বাধ্য হয়ে যুক্তফ্রন্টে থেকে যাচ্ছে তাঁরা আর কেউ নয়, সিপিআই(এম)।

এটা জানা নেই যে, সিপিআই(এম) নেতৃত্ব কীভাবে তাঁদের আগেকার সূত্রায়নগুলিকে বিচার করে, কিন্তু সব বলা ও করার পর যুক্তফ্রন্টের জনগণের গণতান্ত্রিক ফ্রন্টে রূপান্তরিত হওয়ার আশা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে এবং এখন এটা কেবল এক রাজনৈতিক আবশ্যিকতার প্রশ্ন।

পুনর্বিন্যাস ও স্থান পরিবর্তন

ভারতীয় রাজনীতিতে সবচেয়ে দূরদর্শী বুর্জোয়া দ্রষ্টা শ্রী ভি পি সিং দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। এক, নয়া আর্থিক নীতিকে ঘিরে সমস্ত বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে এক জাতীয় ঐকমত্য গড়ে উঠেছে এবং দুই, যুক্তফ্রন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে সহযোগিতার এক যুগ শুরু হয়েছে। তিনি সম্পূর্ণত সঠিক।

বাস্তব রাজনীতির জগতে এই যুক্তিকে টেনে নিয়ে গিয়ে তিনি এক দাওয়াই নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন এবং বাতলেছেন যে, বিভিন্ন রাজ্যে শাসক ও বিরোধী উভয় স্থানই যুক্তফ্রন্টের বিভিন্ন দলগুলি, কংগ্রেস এবং সামাজিক ন্যায় শিবিরে মোটামুটি পড়ে, এমন অন্যান্য দলগুলির মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে হবে।

এই যুক্তির মূলগত গলদ হল এই যে, তা অগ্রাহ্য করে সংঘাতের লাগাতার প্রক্রিয়া ও তার ফলে বিভিন্ন পার্টিগুলি যারা অন্যভাবে ব্যাপক বিজেপি-বিরোধী সারিতে পড়ে, তাদের তুলনামূলক শক্তিতে পরিবর্তন এবং এই যুক্তি ভুলভাবে ধরে নেয় যে কেন্দ্রে কংগ্রেস স্থায়ীভাবে অধীনস্থ ভূমিকায় থাকবে। কংগ্রেস এখনো একটি প্রধান জাতীয় পার্টি, তার বর্তমান সংকটাবস্থা নিয়ে কংগ্রেস সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। তার বিজেপি এবং সিপিআই(এম) উভয়ের বিরোধিতা করার কর্মসূচি স্পষ্ট করে দিয়ে কংগ্রেস পরিকল্পনা করেছে মধ্যপন্থী শিবিরে কাজ করার, যাতে যুক্তফ্রন্টের পথে বাধা সৃষ্টি করা যায়। ইতিমধ্যে কংগ্রেস রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সাথে এক সমঝোতা গড়ে তুলেছে, মুলায়মের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, টিএমসি ও ডিএমকে-কে লাইনে আনার জন্য যত্ন ও মনোযোগ সহকারে কাজ করে চলেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা ও দুর্নীতির ইস্যুতে যুক্তফ্রন্টের প্রাথমিক কংগ্রেস-সমালোচনার সুর নামিয়ে দিতে বাধ্য করে, কংগ্রেস তার ভাবমূর্তিকে আবার সাজিয়ে নেওয়ার, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মুসলিমদের জয় করে নেওয়ার ও পরবর্তী নির্বাচনে বিজেপি-বিরোধী যুক্তমোর্চার সামনে উঠে আসার আশা করে।

বিজেপি-বিরোধী কংগ্রেস-বিরোধী বিষয়বস্তু ইতিমধ্যেই জলে ধোয়া হয়ে বিজেপি-বিরোধী অ-কংগ্রেসী মোর্চা ও সরকারের শ্লোগানে এসে দাঁড়িয়েছে এবং যুক্তফ্রন্টের শরিকদের অন্তত কিছুর ক্ষেত্রে এটা আরও জোলো হয়ে বিজেপি-বিরোধী কংগ্রেস-ঘেঁষা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। তবে, আমরা জোরের সাথে এই মতের পক্ষে যে, যেহেতু কংগ্রেস ও বিজেপি উভয়েই শাসক শ্রেণীগুলির সর্বভারতীয় দুটি প্রধান পার্টি, আমাদের অবশ্যই উভয়কেই প্রাথমিক শত্রু হিসাবে গণ্য করতে হবে এবং আমাদের বিজেপি-বিরোধী কংগ্রেস-বিরোধী দিশায় দৃঢ় থাকতে হবে।