(লিবারেশন, এপ্রিল ১৯৯৮ থেকে)
বেনারস কংগ্রেস কেন্দ্রের ক্ষমতায় বিজেপির উত্থানের বিপদকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথেই তুলে ধরেছিল। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, “গৈরিক শক্তি কর্তৃক ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার বিপদকে আমরা স্বীকার করি। যুক্তফ্রন্টের পতন ঐ পরিণামের অনুঘটক হিসাবে কাজ করতে পারে। নিজের দিক থেকে বিজেপির যদিও সমস্যা রয়েছে – যেমন অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও দেশের বিভিন্ন অংশে তার বিস্তৃতির সীমাবদ্ধতা, তবুও এই বিপদের যথেষ্ট বাস্তব ভিত্তি রয়েছে এবং আমাদের এটি খাটো করে দেখা উচিত নয়। আর তা যদি সত্যিই ঘটে, তবে নির্দিষ্ট পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে কর্মনীতির পুনর্বিন্যাস ঘটাতে হবে।”
একথা আমরা বলেছিলাম ১৯৯৭-এর অক্টোবরে, যখন কংগ্রেসের সমর্থনের আশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার সাবলীলভাবেই চলছিল। পাঁচ মাসেরও কম সময়ে আমাদের আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। রিপোর্ট অবশ্যই দেশের বিভিন্ন অংশে বিজেপির বিস্তৃতির সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরেছিল এবং ১৯৯৮-এর নির্বাচনী ফলাফলও দেখিয়ে দেয় যে, সংসদে তার শক্তির তেমন কোনো বৃদ্ধি ঘটেনি। এসত্ত্বেও আমরা ঐ বিপদকে যদি বাস্তব বলে মনে করে থাকি, তবে মূলত তা ছিল যুক্তফ্রন্টের সম্ভাব্য পতনের ধারণা থেকেই, যে পতন ঐ পরিণামের অনুঘটক হিসাবে কাজ করতে পারে। আর ঠিক তাই ঘটেছে।
পরিহাসের বিষয় হল, পরিস্থিতির খলনায়ক হিসাবে কাজ করেছিল সে কংগ্রেস, যে দুবছরের মধ্যেই দেশকে আবার এক নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল, বিজেপির এক শক্তিশালী আক্রমণের মুখে যে দ্রুতই ভেঙ্গে পড়ছিল বলে মনে হচ্ছিল, সেই কংগ্রেসের কিন্তু শেষমেষ কোনো ক্ষতি হয়নি। সে নিজের আসন সংখ্যা শুধু বজায় রাখতেই সক্ষম হয়নি, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানে বিজেপির উপর প্রবল আঘাত হেনেছে। এই নির্দিষ্ট ঘটনা বিজেপির শাসন করার নৈতিক অধিকারে যথেষ্ট ঘা দিয়েছে।
অপরদিকে যে যুক্তফ্রন্ট এবার এক সাধারণ ইস্তাহারের ভিত্তিতে এবং এক শহীদের ভাবমূর্তিকে সম্বল করে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়, আশ্চর্যজনকভাবে সেই যুক্তফ্রন্টের শক্তি কমে অর্ধেক হয়ে যায় এবং বাকি অর্ধেক অংশ চলে যায় বিজেপি শিবিরে।
যুক্তফ্রন্টের সব থেকে বড় শরিক জনতা দল কর্ণাটকে চরম পরাজয় বরণ করে এবং উড়িষ্যায় তার ব্যাপক অংশ বিজেপি-শরিক বিজেডির দিকে চলে যায়। চরম সুবিধাবাদের নিদর্শন রেখে প্রধানমন্ত্রী আকালি দলের সমর্থন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং আর এক মহারথী রামবিলাস পাসোয়ান সমতা পার্টির সঙ্গে এক গোপন সমঝোতায় উপনীত হন। ডিএমকে-টিএমসি জোট সর্বাপেক্ষা অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের মুখোমুখি হয় তামিলনাড়ুতে। এ সত্ত্বেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা যখন বিজেপির অধরাই থেকে গেল, তখন ডিগবাজির এক বিরল নিদর্শন রেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন আর কেউ নয়, যুক্তফ্রন্টের আহ্বায়ক চন্দ্রবাবু নাইডু। ন্যাশনাল কনফারেন্স, অগপ-র মতো অন্য কয়েকটি শরিকও নির্ধারিতভাবেই বিজেপির দিকে ঝুঁকেছে। বিজেপির মিত্রদের প্রত্যেকেই তাদের ডিগবাজির পিছনে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের নির্দিষ্ট স্বার্থকেই (বাধ্যবাধকতা!) তুলে ধরছেন। অবশেষে ঝুলি থেকে বিড়াল বেরিয়ে পড়ল। সুনির্দিষ্ট আঞ্চলিক স্বার্থই তাদের যুক্তফ্রন্টের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ করেছিল আর এখন পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ঠিক ঐ বিষয়টিই তাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। এসব ঢাকার জন্য তাদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি আমাদের সমাজগণতন্ত্রী বাক্যবাগীশরাই উদ্ভাবন করেছেন।
সমাজগণতন্ত্রী বামেদের ফলাফলও ভালো হয়নি এবং কলকাতার দেওয়ালের লিখনও যথেষ্ট অশুভ পূর্বাভাসই দিচ্ছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন যে, কংগ্রেসের ভাঙ্গনকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা সমস্ত আসনই জিতে নেবেন। বাস্তব ঘটনা হল, তাঁরা কেবল তাঁদের আসন সংখ্যা ধরে রাখতে পেরেছেন। জয়ের ব্যবধান এবং প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হারও যথেষ্ট কমে গেছে।
তাঁরা অবশ্য উটপাখির মতো, ১৯৯৬-এর পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি প্রত্যাশা করেছিলেন এবং কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার জন্য সাগ্রহে নিজেদের প্রস্তুত করছিলেন। আহত বাঙালি গরিমার পুনরুদ্ধারে জ্যোতি বসু জানিয়ে দেন যে তিনি দিল্লী যেতে প্রস্তুত। ‘ঐতিহাসিক ভুল’ সংশোধনের মরীয়া প্রয়াস সিপিআই(এম)-কে ‘ঐতিহাসিক বোকামির’ পাঁকে নিক্ষেপ করে। যাই হোক, মূল বিষয়ে ফিরে আসা যাক। রাজনৈতিক এবং সংখ্যাগত উভয় দিক থেকেই যুক্তফ্রন্টের পতনে বিজেপিই লাভবান হয়েছে।
খুব কম রাজনৈতিক বিশ্লেষকই অবশ্য যুক্তফ্রন্টের পতন ও বিজেপির ক্ষমতায় উত্থানের মধ্যে প্রত্যক্ষ আন্তসম্পর্কের উল্লেখ করেছেন। তার কারণ অবশ্য সহজেই বোধগম্য। যেহেতু বিজেপি এবং কংগ্রেসই হল দুই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, তাই বিশ্লেষণগুলিও বিজেপি বনাম কংগ্রেস কাঠামোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।
এটা অবশ্য যথেষ্ট কৌতুহলদ্দীপক যে, বিজেপি এবং কংগ্রেস উভয়েই স্থায়ী সরকার ও সুযোগ্য নেতৃত্বের বিষয়টি তুলে ধরে। এর মাধ্যমে যুক্তফ্রন্টকে সরাসরি অভিযুক্ত করা হয় যে, যুক্তফ্রন্ট অস্থায়িত্ব ও অযোগ্য নেতৃত্বের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জনগণের রায় – প্রভাবশালী শাসকবর্গ কর্তৃক নিজেদের অনুকূলে প্রভাবিত করার ক্ষমতাকে হিসেবের মধ্যে ধরেই বলা হচ্ছে – এবার নির্ধারিতভাবেই যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে গেছে। নির্বাচন পরবর্তী পর্যায়ে যুক্তফ্রন্টের ভাঙ্গন এটাই প্রতিষ্ঠিত করেছে।
যুক্তফ্রন্টের ভুল কোথায় হয়েছিল এবং তার পতনের তাৎপর্যগুলিই বা কী? বামেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য এই প্রশ্নগুলির বিচার-বিশ্লেষণ খুবই জরুরি।
প্রথমত, যুক্তফ্রন্টকে বিজেপি-বিরোধী, কংগ্রেস-বিরোধী মঞ্চ হিসাবে – এমনকি তার লঘু রূপ বিজেপি-বিরোধী, অকংগ্রেসী মোর্চা হিসাবেও – তুলে ধরা ছিল এক সমাজগণতন্ত্রী কল্পকথা। একই ধারায় যুক্তফ্রন্টকে জনগণতান্ত্রিক মোর্চার দিকে এক ধাপ হিসাবে – যে মোর্চার মধ্যে শ্রমিকশ্রেণী ও সম্মুখদর্শী বুর্জোয়াদের মধ্যে ঐক্য ও সংগ্রামের প্রক্রিয়া অবশেষে সর্বহারার আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় পরিণতি লাভ করবে – বর্ণনা করাও আর এক তাত্ত্বিক ভোজবাজি হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে, যার একমাত্র লক্ষ্য ছিল তাঁদের সুবিধাবাদী আঁতাতকে যুক্তিযুক্ত করে তোলা। ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮-এর মধ্যে কংগ্রেসকে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতার বাইরে রাখার অবস্থান থেকে সমস্ত উপায়েই কংগ্রেসকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার অবস্থানে সমাজগণতন্ত্রীদের উত্তরণ যথেষ্ট লক্ষ্যণীয়।
দ্বিতীয়ত, ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যুক্তফ্রন্ট প্রগতিশীল আইন তৈরির বিষয়ে চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছে। ক্ষেতমজুর সম্পর্কিত বিল মুলতুবি রাখা হয় এবং বিহারে গণহত্যা সহ দলিতদের উপর নিপীড়ন সরকারের মধ্যে কোনো সাড়াই জাগাতে পারেনি। ‘কমিউনিস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী’ কাশ্মীর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলের জঙ্গী সমস্যার মধ্যেই ডুবে থেকেছেন এবং নির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের সময় বা প্রত্যয় কোনোটিই তাঁর ছিল না। আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব উচ্চবর্ণের মানুষদের তুষ্ট রাখতে দলিত আইনের তীব্র বিরোধিতা করেন।
‘রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নকে’ নিয়ন্ত্রণ করতেও যুক্তফ্রন্ট কিছুই করেনি, যে বিষয়টি চন্দ্রশেখরের হত্যার পর এক শক্তিশালী ইস্যু হিসাবেই সামনে এসেছিল। বাবরি মসজিদ-রাম জন্মভূমি সমস্যার মীমাংসায় যুক্তফ্রন্ট কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করতে পারেনি, আর মসজিদ ধ্বংসের জন্য দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানেও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। লালু ও মহন্তের দুর্নীতিপরায়ন রাজের সঙ্গে সমস্ত ধরনের সমঝোতাই করে গেছে।
তৃতীয়ত, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সে প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে বলি দিয়েছে, আর সেই কারণেই শেষের দিকে দুই ডিএমকে মন্ত্রীকে বরখাস্তের প্রশ্নে তার বীরত্ব প্রদর্শন জনগণকে কোনো অংশেই প্রভাবিত করতে পারেনি।
দেড় বছরের যুক্তফ্রন্টরাজ স্মরণীয় হয়ে থাকবে চিদাম্বরমের ‘স্বপ্নের বাজেট’ ও ভিডিআইএস প্রকল্পের জন্য। অর্থনীতির বৃদ্ধির নির্দেশকগুলির সার্বিক অবনমনের বিচারে স্বপ্নের বাজেট অবাস্তব স্বপ্ন হয়েই থাকে, আর ভিডিআইএস প্রকল্পও ছিল কালো টাকাকে সাদা করার চরম উদারনীতিবাদী প্রস্তাব।
আপাতবিরোধী মনে হলেও, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বাগাড়ম্বরে সিদ্ধহস্ত বামেদের শক্তিশালী অংশের সমর্থনপুষ্ট হয়েও যুক্তফ্রন্ট ছিল বহুজাতিকদের প্রতি অধিকতর বন্ধুভাবাপন্ন। বহুজাতিকদের প্রিয়পাত্রই অর্থনৈতিক বিষয়াবলীর নেতৃত্বে থাকায় ‘জাতীয়তাবাদী’ ভিত্তিটি বিজেপির কাছে হেলায় সঁপে দেওয়া হয়। কর্পোরেট জগৎ ‘জাতীয়তাবাদী সরকার’ এবং ‘প্রতিযোগিতার সমান ক্ষেত্র’ নিয়ে শোরগোল তুলে দেয়। আর এর সঙ্গে স্বদেশীয়ানাকে যুক্ত করে বিজেপির প্রচারযন্ত্র পুরোদমে চলতে শুরু করে।
যুক্তফ্রন্টের একমাত্র শক্তিশালী দিক ও তার মৌলিক পরিচিতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয়তার নীতির প্রতি তার দায়বদ্ধতার মধ্যে। ‘রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা’ থেকে ‘শক্তিশালী রাজ্য ও দুর্বল কেন্দ্রের’ মতো স্লোগানগুলি উঠে আসে। ঠিকই, যুক্তফ্রন্ট জমানায় কেন্দ্র দুর্বল ও অস্থায়ী হয়েই দেখা দিয়েছিল আর ঠিক এই কারণেই তার পতন হল। তার সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদানই তার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হয়ে উঠল। এই বিষয়টি ভারতীয় রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে প্রতীয়মান করে। যখনই কোনো শক্তিশালী কেন্দ্র স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে দেখা দেয়, তখনই শক্তিশালী আঞ্চলিক অর্থনৈতিক স্বার্থগুলি তার বিরোধিতায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে। অবশ্য কেন্দ্র যখন আবার দুর্বল ও অস্থায়ী হয়ে দেখা দেয়, তখন আবার এক শক্তিশালী কেন্দ্রের জন্য আকাঙ্খা জোরালো হয়ে ওঠে। শক্তিশালী আঞ্চলিক অর্থনৈতিক গোষ্ঠীগুলির স্বার্থ ও এক ঐক্যবদ্ধ জাতীয় অর্থনীতির আবশ্যকতার পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সঙ্গে ভারতীয় সমাজের গতিশীলতাকে সম্পর্কযুক্ত করা যেতে পারে। চন্দ্রবাবু নাইডু ছিলেন দুর্বল কেন্দ্রের প্রবক্তা যা তাঁকে যুক্তিযুক্তভাবেই যুক্তফ্রন্টের আহ্বায়ক করে তোলে, সেই চন্দ্রবাবু নাইডুই আবার বিজেপি সরকার পরিচালিত এক শক্তিশালী কেন্দ্রকে স্থায়ী করার ব্যাপারে মূল কারণ হয়ে উঠলেন।
রাজনৈতিক যুক্তিধারা যুক্তফ্রন্টের বিপক্ষে যাওয়ায় কোনো না কোনোভাবে তার পতন হতই। কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মূল বিষয় হল, সে এমন কোনো চিহ্নই রেখে যায়নি যাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে প্রত্যাবর্তন ঘটানো যেতে পারে।
সমাজগণতান্ত্রিক বামেরা ‘ঐতিহাসিক ভুল ও বোকামী’র মধ্যে আন্দোলিত হয়েছে, কিন্তু তার সামনে যে ‘ঐতিহাসিক সুযোগ’ এসেছিল তাকে কাজে লাগানোর পরিপ্রেক্ষিত থেকে সে কখনোই চিন্তা করতে পারেনি। তার তাত্ত্বিকদের উদ্বেগ সীমাবদ্ধ ছিল সমস্ত ধরনের ‘দালাল’, ‘সমঝোতা’ ও ‘পর্দার আড়ালে বোঝাবুঝির’ মাধ্যমে সরকারের স্থায়িত্বকে দীর্ঘায়িত করার মধ্যে। সুরজিৎ এই অখ্যাত মন্তব্য করেন যে, যুক্তফ্রন্ট সরকার যাতে বিপাকে না পড়ে তার জন্য বামেরা তাদের কোনো কর্মসূচি নিয়েই সরকারকে চাপ দেয়নি। কংগ্রেস এবং যুক্তফ্রন্টের অন্যান্য শরিকদের কাছ থেকেও তিনি একই আচরণ প্রত্যাশা করেছিলেন। কিন্তু কেউই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখায়নি। কাজেই বামেদের শক্তিশালী অংশের সমর্থনপুষ্ট প্রথম কেন্দ্রীয় সরকার – তার একটি অংশের হাতে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রক সত্ত্বেও – কোনো বাম ছাপই রেখে যেতে পারল না।
প্রতিটি সুবিধাবাদী অপকর্ম তার নিজস্ব মাশুল গুণে নেয়। যুক্তমোর্চার ধ্বংসস্তুপের মধ্যে কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এক খোলাখুলি সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকার। অর্ধশতাব্দীর স্বাধীনতার পরে কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হয়েছে এমন এক পার্টি ও ব্যক্তির নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে যাদের ভূমিকা খুব কম কথায় বললেও যথেষ্ট সন্দেহজনক ছিল।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের ওপর নেমে আসা এই ট্র্যাজেডি থেকে ভুল শিক্ষা নেওয়া হচ্ছে। বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের একাংশ সহ উদারনৈতিকদের সমগ্র গোষ্ঠী ‘কংগ্রেস নামক মহান প্রতিষ্ঠান’-এর ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করছেন। এ হল আত্মনেতিকরণের এক প্রক্রিয়া যা প্রগতি ও গণতন্ত্রের কংগ্রেস বিরোধী লড়াইয়ের ইতিহাসই নাকচ করে দেয়।
বিজেপি সরকার আস্থা ভোটে জয়ী হয়েছে এবং এই সরকার তথাকথিত জাতীয় এজেন্ডার ভিত্তিতে সরকার চালানোর অঙ্গীকার করেছে। অটল বিহারী বাজপেয়ী বারবার জাতিকে আশ্বস্ত করছেন যে যতদিন তিনি প্রধানমন্ত্রী আছেন ততদিন তাঁর সরকার কোনো গোপন এজেন্ডা অনুসরণ করবে না। বিরোধীপক্ষকে চুপ করিয়ে দেওয়া ও তাকে ভাঙ্গা এবং আরও বেশিসংখ্যক মিত্র সংগ্রহ করার জন্য এ হল এক চতুর কৌশল।
কিছু সমাজবাদী ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ইতিমধ্যেই যুক্তি দেখাতে শুর করেছেন যে বিজেপির ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের সাথে ফ্যাসিবাদের উত্থানকে সমার্থক মনে করা উচিত হবে না। কেউ কেউ এই যুক্তি দেখাচ্ছেন যে চিরায়ত বোধ থেকে ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক ভিত্তি সম্পর্কে যেরকম উপলব্ধি রয়েছে, ভারতে তা অনুপস্থিত।
সঠিক অর্থনৈতিক অর্থে এটা ঠিকই যে ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণী, যে নিজেই চরিত্রগতভাবে নির্ভরশীল, বিশ্ব বাজার দখল করা ও উপনিবেশ স্থাপন করার হিটলারীয় এজেন্ডা অনুসরণ করতে পারে না। কিন্তু কেউ কী ঠিক এ ধরনের কথা বলতে চাইছেন! বেনারস কংগ্রেসের রিপোর্টে ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে : “বিজেপির কর্মসূচিতে রয়েছে ভারতের প্রতিবেশীদের বিশেষত পাকিস্তানের ব্যাপারে উগ্র স্বাদেশিকতার নীতি অনুসরণ করা, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে তোলা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে রূপান্তরিত হবেন এমন এক হিন্দুরাষ্ট্রে ভারতকে রূপান্তরিত করা, যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে দুর্বল করা, বর্বরোচিত রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালানো, গ্রামীণ দরিদ্রদের কৃষি-আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য জমিদারদের নিজস্ব সেনাবাহিনী সংগঠিত করা, চলমান জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের আন্দোলনগুলিকে সামরিকভাবে দমন করা, বৌদ্ধিক, নান্দনিক ও শিক্ষাগত ক্ষেত্রে সব ধরনের ভিন্নমতকে গুঁড়িয়ে দেওয়া। এককথায়, ভারতের ওপর এক ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়া।”
এই একনায়কতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ মাত্রা তথা আঞ্চলিক বৃহৎশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটানোর জন্য তার পরিকল্পনা সাধারণের কাছে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র বলে যা পরিচিত তার সাথে সম্পূর্ণভাবে মিলে যায়।
একথা ভুললে চলবে না যে বিজেপি অবশ্যই এক ভিন্নতর পার্টি। অন্যান্য রাজনৈতিক পার্টিগুলি যেখানে নিজেরাই এক স্বতন্ত্র সত্তা সেখানে বিজেপি আরএসএস-এর সংবিধান বহির্ভূত কর্তৃত্বের সাপেক্ষে এক স্বায়ত্ত অবস্থান ভোগ করে মাত্র। এজেন্ডাটি সঠিক অর্থে আরএসএস-এরই এবং তার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে বিজেপি অবশ্যম্ভাবীভাবে এই লক্ষ্যেই পরিচালিত হবে। তাছাড়া নিজস্ব এজেন্ডাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আরএসএস-এর এক ব্যাপক ধরনের ব্যবস্থাপনা ও অন্যান্য বহু সংগঠন রয়েছে।
ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্রের লক্ষ্যে অগ্রগতিকে বিজেপির তথাকথিত নরমপন্থী নেতৃত্ব বা বিজেপির সহযোগী দলগুলির তথাকথিত নিয়ন্ত্রণমূলক প্রভাবের দ্বারা রোধ করা যাবে না। যুক্তমোর্চার সম্প্রসারণের নামে সবধরনের নিন্দিত শক্তির এক পাঁচমিশেলি জোট গঠন করা এবং কংগ্রেসের পিছনে সমাবেশিত হওয়া গৈরিক বিপদের কোনো প্রত্যুত্তর নয়।
বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির মধ্যে এক ব্যাপকতর বোঝাপড়ার প্রয়োজনীয়তা আমরা অস্বীকার করি না এবং বেনারস কংগ্রেসে নির্দিষ্টভাবে ‘নীতিসমূহের কিছু কিছু পুনর্বিন্যাসের’ কথা বলা হয়েছে। নীতিসমূহের পুনর্বিন্যাসের অর্থ অবশ্যই হবে বিরোধীপক্ষের সরকারগুলির ওপর চাপ সৃষ্টি করা, তাদের ব্ল্যাকমেল করা অথবা বরখাস্ত করার বিজেপি সরকারের অপপ্রয়াসের বিরোধিতা করা, সব ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা ও অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে হাত মেলানো, বিজেপির চক্রান্তকে বানচাল করার জন্য সংসদে ও বিধানসভাগুলির অভ্যন্তরে সমন্বয় গড়ে তোলা ইত্যাদি।
কিন্তু বিহারে আরজেডি-র সাথে কিংবা পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্টের সাথে সরাসরি জোট গড়ে তোলা অবশ্যই এই জটিল প্রশ্নের কোনো সমাধান নয়।
কিছু কিছু রাজনৈতিক ভাষ্যকার লালু প্রসাদের বিরুদ্ধে দু্র্নীতির ইস্যুকে মাত্রাতিরিক্তভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলা ও পরবর্তীকালে লালুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য বামদের তিরস্কার করেছেন। সমাজগণতন্ত্রীরা এই পরামর্শ গ্রহণ করা ও লালুর পক্ষে ফিরে যাওয়ার জন্য খুবই উদগ্রীব। কিন্তু এই ঘটনার ব্যাখ্যা কীভাবে পাওয়া যাবে যে ঠিক লালু আর সরকারি বামদের মধুচন্দ্রিমার পর্যায়টিতেই অন্যান্য দিক থেকে প্রান্তিক অবস্থানে থাকা শক্তি বিজেপি রাজনীতির একেবারে কেন্দ্রস্থলে উঠে এসেছিল? কোনো উচ্চ আদর্শের দ্বারা পরিচালিত হয়ে নয়, ১৯৯৬-এর সংসদীয় নির্বাচনে শক্তিশালী বিজেপি-সমতা জোটের আক্রমণের মুখে লালুর আসনসংখ্যা কমে যাওয়া এবং বামদের গুরুতর ধাক্কাই সমাজগণতন্ত্রী শিবিরকে নতুন করে চিন্তাভাবনা করার পথে নিয়ে যায় এবং তারা লালুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
লালুর জমানা সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও সার্বিক অপরাধীকরণের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবধরনের গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে এবং রাজ্য এক দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক বন্ধ্যাবস্থার মধ্যে পড়েছে। এই পরিস্থিতিই বিজেপি-সমতা জোটের উত্থানের উর্বর জমি হিসাবে কাজ করেছে, যা সামন্ত ও ‘উচ্চবর্ণীয় প্রত্যাঘাত’-এর জন্ম দেওয়া ছাড়াও পশ্চাদপদ ও অত্যন্ত পশ্চাদপদ জাতিগুলির একটা বড় অংশকে তাদের পক্ষে জয় করে নিয়ে এসেছে। বাস্তবে লালুর অপশাসনের বিরুদ্ধে বামদের বিরোধিতা নয়, বরং পরিকল্পিত ও ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতার অভাবই বিজেপির জন্য অনেকখানি গণতান্ত্রিক ক্ষেত্র ছেড়ে দিয়েছে এবং বামদের প্রান্তিক অবস্থানের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
অনুরূপভাবে, মালিকপক্ষের স্বার্থরক্ষাকারী নীতি নিয়ে চলার জন্য শ্রমিকরা যখন বামফ্রন্ট সরকারের পক্ষ ছেড়ে চলে যাচ্ছে এবং যখন নয়া ধনী ও বহুজাতিকদের তোষণ করার জন্য শ্রমজীবী জনগণকে কলকাতার রাস্তা থেকে নির্দয়ভাবে তাদের একমাত্র জীবিকার উৎস থেকে উৎখাত করা হচ্ছে তখন সেই সরকারের পক্ষে দাঁড়ানো আমাদের দায়িত্ব নয়।
বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের পার্টিগুলির সাথে রাজনৈতিক জোট ও নির্বাচনী বোঝাপড়া একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নীতিমালার মূল স্তম্ভ হতে পারে না। ভারতের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে নিজেদের জায়গা করে নেওয়া ও তাকে আরও সম্প্রসারিত করার জন্য আমাদের অবশ্য গণআন্দোলনের ওপরই প্রাথমিকভাবে নির্ভর করতে হবে।
বিজেপির জাতীয় এজেন্ডার নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে ছাত্র ও যুবরা। এর লক্ষ্য হচ্ছে শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়ে তাদের মানসিক গঠনের সাম্প্রদায়িকীকরণ ঘটানো। বেকারত্বের ভয়াবহতাকে বিজেপি তথাকথিত “জাতীয় পুনর্গঠন বাহিনী” গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করতে চাইছে, যে বাহিনী হবে খুব সম্ভবত আরএসএস শাখাগুলির সরকারি সংস্করণ মাত্র।
পার্টিকে অবশ্যই তাই সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে ছাত্র ও যুবদের সমাবেশিত করা ও কর্মসংস্থানের বড় বড় প্রতিশ্রুতির রূপায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে।
মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিলের ব্যাপারে বিজেপি টালবাহানা করতে বাধ্য এবং মহিলাদের বিরুদ্ধে সবধরনের সংস্কারাচ্ছন্ন এজেন্ডা অনুসরণ সে করবেই। গৈরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মহিলাদের সমাবেশিত করা পার্টির সামনে আর একটা বড় ধরনের আশু এজেন্ডা।
সমস্ত গণসংগঠনগুলিকে সক্রিয় করে তুলে তাদের স্বাধীন উদ্যোগ তথা ব্যাপক সংখ্যক বাম ও প্রগতিশীল শক্তিগুলির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রতিটি নির্দিষ্ট ফ্রন্টেই বিজেপির মোকাবিলা করতে হবে।
বিজেপি সরকারের প্রতিটি নির্দিষ্ট নীতিসংক্রান্ত ঘোষণা ও প্রতিটি নির্দিষ্ট ব্যর্থতা ও অপকর্মকে উদ্ঘাটিত করতে পার্টির প্রচারযন্ত্রকে সচল করে তুলতে হবে। গণতান্ত্রিক অধিকারের বা বাকস্বাধীনতার ওপর বিজেপি সরকারের প্রতিটি আক্রমণ এবং সংসদীয় গণতন্ত্রের যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে কলঙ্কিত করার প্রচেষ্টাকেই চ্যালেঞ্জ জানাতে হবে ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে।
পরিশেষে, বিজেপির ক্ষমতায় উত্থানের সাথে সাথে সর্বত্রই সামন্ত শক্তিগুলি আরও দুঃসাহসী হয়ে উঠবে এবং তার ফলে কৃষিশ্রমিক ও গরিব কৃষকদের ওপর আক্রমণ ও দলিতদের ওপর নির্যাতন আরও তীব্রতর হতে বাধ্য। এইসব আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য পার্টিকে তার প্রতিরোধমূলক প্রস্তুতি আরও জোরদার করতে হবে।
সংক্ষেপে, দেশের বুকে এক ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধের জন্য সমস্ত বাম ও প্রগতিশীল শক্তির কাছে এটাই হল জাতীয় এজেন্ডা। আর জনগণের মধ্যে উন্নত চেতনা গড়ে তোলা ও ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আমরা বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের এক মহাজোট গঠনের পথে এগিয়ে যেতে পারি – যা হবে জনগণতান্ত্রিক মোর্চা গঠনের লক্ষ্যে এক প্রকৃত উত্তরণশীল পদক্ষেপ।