মার্কস ইতিমধ্যে রচনা করে ফেলেছিলেন বিখ্যাত গ্রন্থ পবিত্র পরিবার (১৮৪৫ সালে এঙ্গেলসের সাথে যৌথভাবে লেখা) এবং দর্শনের দারিদ্র (১৮৪৭) আর এঙ্গেলস রচনা করেছিলেন ইংল্যান্ডে শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা (১৮৪৪) এবং কমিউনিজমের নীতিমালা (১৮৪৭)। দুই বন্ধু ১৮৪৪ সাল থেকেই বিভিন্ন তাত্ত্বিক প্রকল্প নিয়ে (উদারহণস্বরূপ, জার্মান মতাদর্শ রচনা) এবং রাজনৈতিক সাংগঠনিক উদ্যোগ নিয়ে (উপরে যেমন বলা হয়েছে) ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছিলেন। উভয়েই গণতান্ত্রিক-সমাজবাদী পত্রিকা ডয়েস-ব্রিসেলার-সাইটুং-এ কাজ করছিলেন। প্রসঙ্গত এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জনৈক সন্দেহজনক পুলিশের চর (তাঁরা অবশ্য একথা জানতেন না)। তাঁরা পত্রিকাটিকে লিগের অঘোষিত মুখপত্রে পরিণত করেছিলেন। তাঁদের শ্রমকিদের মধ্যে কাজ করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, বিভিন্ন ধারার গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে মতের আদান-প্রদান, ওয়‍েটলিং, বাকুনিন এবং অন্যান্যদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে চালানো বিতর্ক – এই সমস্ত কিছুই তাঁদের বিশিষ্ট বিশ্ববীক্ষা এবং রাজনৈতিক-সাংগঠনিক অভিমতকে রূপায়িত করতে সাহায্য করেছিল। তাঁদের যৌথ চিন্তারাজিকে প্রকৃষ্টভাবে সুনির্দিষ্ট রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে কংগ্রেসের পরপরই তাঁরা দিনের পর দিন লন্ডনে ও ব্রাসেলসে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে গেলেন। এরপর মার্কস একমাস নিমগ্ন রইলেন দলিলটি লেখার কাজে। একাজে তিনি নীতিমালা থেকে বেশ কিছু রসদ সংগ্রহ করলেন।

কেন্দ্রীয় কমিটি লন্ডন থেকে তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিল যে, তিনি যদি ১৮৪৮-এর ১ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে দলিলটি লিখে উঠতে না পারেন তাহলে তা লেখার ভার অন্য কারুর হাতে দেওয়া হবে, এবং সেই নির্দিষ্ট সময়সীমা যখন শেষ হতে যাচ্ছে তখনই তিনি সেটি সম্পন্ন করলেন। পুস্তিকাটি ১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ লন্ডন থেকে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হল, তারপর প্রকাশিত হল তার পোলিশ, দিনেমার, ফরাসি ও ইংরাজি সংস্করণ, আর প্রথম রুশ সংস্করণ প্রকাশিত হল ১৮৬০-এর গোড়ায়।

ইস্তাহার-কে মার্কসের একক রচনা বলে বলার চল কিছু পণ্ডিত মানুষের মধ্যে দেখা যায়। ওপরে যা বলা হল এবং তার সঙ্গে মার্কসের নিজের কথা ইস্তাহার “এঙ্গেলস আর আমার যৌথভাবে রচনা”রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনায় একটি সংযোজন-এর মুখবন্ধ (১৮৫৯), মার্কস ও এঙ্গেলসের নির্বাচিত রচনাবলী, খণ্ড ১। পড়লে ঐ সমস্ত পণ্ডিতদের কথা ভুল বলে প্রমাণিত হয়। এঙ্গেলসের স্বাধীন তত্ত্বগত চিন্তার বিকাশ তাঁর নিজের চিন্তার বিকাশের সঙ্গে মিলে যাওয়ার কথা মার্কস এই মুখবন্ধে বলেছেন এবং বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন “অর্থনৈতিক বর্গগুলোর সমালোচনা সম্পর্কে তাঁর (এঙ্গেলসের) মনীষাঋদ্ধ রূপরেখা”র কথা। ইস্তাহার অতএব সুনিশ্চিতভাবেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের যুগ্ম প্রতিষ্ঠাদের যৌথ রচনাই ছিল, ১৮৮৩ সালের জার্মান সংস্করণের মুখবন্ধ-তে এঙ্গেলস বিনম্রভাবে যাই লিখে থাকুন না কেন।

তীক্ষ্ন এবং বহুধা-বিস্তৃত এই দলিল প্রকাশিত হওয়ার পর সমাজতন্ত্র আর মনোরম কল্পলোকের ব্যাপার রইল না। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের যুগ শুরু হয়ে গেল।

ইস্তাহার প্রকাশিত হওয়ার পর তার “নিজস্ব একটা ইতিহাস তৈরি হল”, যেমনটা এঙ্গেলস ১৮৯০-এর জার্মান সংস্করণের মুখবন্ধে লিখেছিলেন। এঙ্গেলস দেখিয়েছেন, শ্রমিক আন্দোলনের জোয়ার ও ভাঁটার সঙ্গে তার জনপ্রিয়তা কখনও বেড়েছে আবার কখনও কমেছে, তবে সামগ্রিক প্রবণতা ছিল তার ব্যাপকতর স্বীকৃতির দিকে। রচয়িতাদের মৃত্যুর পর চিরায়ত এই গ্রন্থ সারা বিশ্বে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতেই ছাপা হয়, অনেক ক্ষেত্রে নতুন সংস্করণ হিসাবে, এবং আজও প্রতি বছর সর্বত্রই তা নতুন নতুন পাঠকদের আকর্ষণ করে চলেছে। সর্বাধিক পঠিত ও সবচেয়ে বেশি প্রভাবসম্পন্ন রাজনৈতিক দলিল হিসাবে এবং দ্বিতীয় সর্বাধিক বিক্রিত বই হিসাবে (বাইবেল-এর পর) তা বাম মহলের বাইরেও মতাদর্শগত প্রতিপক্ষ সহ বিশ্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করেছে।