ইস্তাহার যে সমস্ত বুনিয়াদী মার্কসবাদী সূত্রের রত্নভাণ্ডার তাদের মধ্যে বিপ্লবী রণনীতি ও রণকৌশলের কয়েকটি মৌলিক নীতিমালার দিকে আমরা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। কেননা, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বহুবিধ পরিবর্তন এবং তার ফলে কমিউনিস্ট কার্যকলাপের প্রকৃতিতে পরিবর্তন সত্ত্বেও এই নীতিমালা এখনও মার্কসবাদী বলে দাবি করা সমস্ত দলের কাছে অমূল্য পথনির্দেশিকা, এবং ঐ দাবি যাচাইয়ের এক নির্ভরযোগ্য কষ্ঠিপাথর হয়ে রয়েছে।

দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম নটি অনুচ্ছেদ দিয়ে শুরু করা যাক। আমাদের সময়ের অনেক 'মার্কসবাদী' পার্টি ও তার নেতাদের আস্ফালন ও ঔদ্ধত্যের বিপরীতে এখানে আমরা প্রকৃত কমিউনিস্টদের স্বভাবসিদ্ধ বিনয় দেখতে পাচ্ছি; আজ বাম আন্দোলনকে দূষিত করে চলা পেটি বুর্জোয়া সংকীর্ণতাবাদের বদলে দেখতে পাচ্ছি সর্বহারার অগ্রণী বাহিনীর মনের প্রসারতাকে; এই প্রসারতা এমনকি সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর স্বার্থ ছাড়া কমিউনিস্ট পার্টির অন্য কোনো বিশেষ স্বার্থ আছে বলেই স্বীকার করে না এবং শ্রমিকশ্রেণীর অন্যান্য পার্টির সঙ্গে লড়াই করার পরিবর্তে পথ দেখিয়ে তাদের সমানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকেই কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা বলে গণ্য করে। এমনকি কমিউনিস্টদের তত্ত্বগত উৎকর্ষকেও কোনো “ভাবী বিশ্বসংস্কারক”-এর মহান আবিষ্কার বলে, সর্বজ্ঞ হওয়ার ক্ষমতা বলে দেখা হয়নি (বিকৃত 'মার্কসবাদীরা' যেমনটা হামেশাই করে থাকেন)। বরং তাকে দেখা হয়েছে “যে শ্রেণীসংগ্রাম, যে ঐতিহাসিক আন্দোলন আমাদের চোখের সামনে চলছে, তা থেকে বাস্তব যে সম্পর্কগুলোর উৎপত্তি, সেগুলোরই সূত্রায়ন মাত্র” বলে দেখানো হয়েছে। তবে সকলেই জানেন যে, এই “নিছক” সাধারণ সূত্রায়ন সমাজ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ঠিক ততটা অগ্রগতিই ঘটিয়েছিল, আধুনিক পদার্থ বিদ্যার ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটিয়েছিল আর একটি “সরল” সূত্রায়ন E = mc2।

এই সংযত ভাব এবং ঐক্যের স্পিরিট কিন্তু ইস্তাহার-এর রচয়িতাদের তৃতীয় অধ্যায়ে সমাজতন্ত্রের বিদ্যমান “প্রতিক্রিয়াশীল” এবং “বুর্জোয়া” ঘরানার বিরুদ্ধে নির্মম আক্রমণ হানা থেকে বিরত করেনি। তারই সঙ্গে ছিল চার্লস ফুরিয়ে, সাঁ-সিমোঁ এবং রবার্ট ওয়েন-এর মতো প্রয়াত সমাজতন্ত্রীদের অনুগামীদের বিরুদ্ধে তুলনামূলকভাবে সম্মানজনক কিন্তু সুস্পষ্ট সমালোচনা। বিদ্বেষপূর্ণ বুর্জোয়া প্রচারের বিরুদ্ধে বুনিয়াদী কমিউনিস্ট অবস্থানগুলোর পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ানোটাকে তাঁরা সর্বহারা কর্মীদের শিক্ষিত করতে একান্ত প্রয়োজনীয় বলে মনে করেছিলেন।

কমিউনিস্ট রাজনীতির আর একটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যকেও ইস্তাহার গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছিল : “উপস্থিত লক্ষ্যসিদ্ধির জন্য, শ্রমিকশ্রেণীর সাময়িক স্বার্থ রক্ষার জন্য কমিউনিস্টরা লড়াই করে থাকে, কিন্তু বর্তমান আন্দোলনের মধ্যে থেকে সেই আন্দোলনের ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব করে, সে সম্পর্কে যত্নশীল হয়” (চতুর্থ অধ্যায়)। এখানে মার্কস ও এঙ্গেলস আশু কর্তব্যকে চূড়ান্ত লক্ষ্যের সঙ্গে, রণকৌশলকে রণনীতির সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন ও দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত করার কথা বলছেন। এই নীতি ভবিষ্যৎ ফলাফলের কথা বিবেচনা না করে সহজে সফল হওয়ার সহজাত প্রবণতাকে কার্যকরীভাবে রুখে দিতে পারে।

কিন্তু বাস্তবে আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করি যে, মার্কসবাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা দলগুলোর মধ্যে অনেকেই কীভাবে অর্থনীতিবাদের তাৎক্ষণিকতার মধ্যেই নিজেদের আবদ্ধ রাখে এবং আশু সংসদীয় লাভের জন্য শ্রমিকশ্রেণীর সুদূরপ্রসারী স্বার্থগুলোকে জলাঞ্জলি দেয়; সংসদীয় ক্ষেত্রে এই লাভ অর্জনে তারা বুর্জোয়া দলগুলোর সঙ্গে অনীতিনিষ্ঠ জোট গড়ে তোলে এবং এইভাবে শ্রমজীবী জনগণের চেতনাকে কলুষিত করে। এইরূপে মার্কসবাদের অলঙ্ঘনীয় এই নীতিকে, সুবিধাবাদকে প্রতিহত করার এই রক্ষাকবচকে বিসর্জন দেওয়ার ফলে যা মাথাচাড়া দেয় তা হল মার্কসবাদের বিপরীত, অর্থাৎ সংশোধনবাদ : “ভিন্নি ভিন্ন ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ, প্রাত্যহিক ঘটনাবলী এবং সংকীর্ণ রাজনীতির ছোটোখাটো পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপখাইয়ে নেওয়া, সর্বহারার বুনিয়াদী স্বার্থ এবং গোটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বুনিয়াদী বৈশিষ্ট্যসমূহ তথা সমগ্র পুঁজিবাদী বিকাশ এ সবকিছুই বিস্মৃত হওয়া, প্রকৃত অথবা কাল্পনিক তাৎক্ষণিক সুবিধার জন্য এই বুনিয়াদী স্বার্থগুলোকে বিসর্জন দেওয়া – এটাই হল সংশোধনবাদের নীতি।” (“মার্কসবাদ ও সংশোধনবাদ” (১৯০৮) রচনায় লেনিন)

এছাড়াও রয়েছে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে সমস্ত সংগ্রামী শক্তির সঙ্গে ঐক্যের এবং সেই সঙ্গে মিত্রদের খোলাখুলি সমালোচনার অধিকার সহ কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতার নীতি। ইংল্যান্ডে চার্টিস্টদের মতো জঙ্গী সংস্কারবাদীদের সঙ্গে, আমেরিকায় কৃষি সংস্কারবাদীদের সঙ্গে, ফ্রান্সে সমাজ গণতন্ত্রীদের সঙ্গে, পোল্যান্ডে অভ্যুত্থানবাদীদের সঙ্গে, এবং এইভাবে আরও অনেকের সঙ্গে ঐক্য ও সংগ্রামের নীতিনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা হয় (চতুর্থ অধ্যায়)। এরপর ব্যাপকতর ঐক্যের পরিধিটি ছিল “সকল দেশের গণতন্ত্রী পার্টিগুলোর মধ্যে ঐক্য ও বোঝাপড়া”। এখানে “পার্টিগুলো” বলতে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দল এবং তার সাথে গড়ে ওঠার পর্যায়ে থাকা শক্তিগুলো/দলগুলোকে বোঝানো হয়েছে, ব্রাসেলস-এর গণতান্ত্রিক সমিতির সহ চেয়ারমান্য হওয়ায় মার্কসের সঙ্গে যাদের অনেকেরই প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল। যারা কেবলমাত্র নামেই গণতান্ত্রিক ছিল কোনোভাবেই তাদের কথা এখানে বলা হয়নি।

বুর্জোয়াদের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্কটা কী রকম হবে? সেটা স্পষ্টতই হবে বৈরী। তবে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগে নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে ঐক্যের কিছু দিকও থাকতে পারে। ইস্তাহার ঘোষণা করেছে, কমিউনিস্টরা জার্মানিতে “বুর্জোয়ারা যখন বিপ্লবী অভিযান করে তখনই তাদের সঙ্গে একত্রে লড়ে” (জোর আমাদের)। একই সঙ্গে ঐ শ্রেণীর সঙ্গে তার যে “বৈর বিরোধ” রয়েছে সে সম্পর্কে সর্বহারাকে শিক্ষিত করার কাজটাও চালিয়ে যায় যাতে বুর্জোয়ারা ক্ষমতায় আসার পরপরই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করা সম্ভব হয়।

বুর্জোয়াদের প্রতি – আমরা যোগ করতে পারি, অথবা তাদের এক বা একাধিক অংশের প্রতি – কমিউনিস্টদের সমর্থনের প্রশ্নাতীত শর্তটা একেবারেই সুস্পষ্ট : তাদের শুধু কথায় নয়, কাজেও নিজেদের বিপ্লবী বলে প্রমাণ করতে হবে। গত ১৬০ বছরেরও বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে, ঐ ধরনের পরিস্থিতি কদাচ উপস্থিত হয়। রাশিয়াতে এই ধরনের পরিস্থিতি দেখা যায়নি, আর সে কারণেই বলশেভিকরা ক্যাডেটদের সঙ্গে ঐক্যের (যেমন, ডুমা নির্বাচনে জারপন্থী ব্ল্যাক হান্ড্রেডদের প্রতিহত করার জন্য) মেনশেভিক লাইনকে কখনই মেনে নেয়নি। চীনে কুয়োমিনটাং জাপানি আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে কিছু সময়ের জন্য বিপ্লবী ধারায় কাজ করেছিল; এই পর্যায়ে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল, আবার তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামও চালিয়ে গিয়েছিল। এই ধরনের ইতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলোর বিপরীতে আমরা ভারতীয় মেনশেভিকদের কোনো ধরনের সমালোচনা ছাড়াই নানা বুর্জোয়া দলের সঙ্গে জোট বাঁধতে দেখি। তাঁরা এটা করে থাকেন “প্রধান শত্রুকে” প্রতিহত করার নামে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আশু নির্বাচনী সুবিধা লাভের সুনির্দিষ্ট হিসাব-নিকাশ থেকে। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের “ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব করা এবং যত্ন নেওয়া”র ব্যাপারে তাঁরা আদৌ ভাবিত নন, তাঁদের কাছে ঐ নির্বাচনী ফায়দাই একমাত্র ও চূড়ান্ত লক্ষ্য। বুর্জোয়ারা রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পরই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর ঐকান্তিক প্রস্তুতি নেওয়া এবং তা “অবিলম্বে শুরু করার” যে নির্দেশ ইস্তাহার দিয়েছে তা একদিক থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিপ্লব অর্থাৎ গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে উত্তরণের ধারণাকে হাজির করছে। আমরা জানি, লেনিন ও মাও নিজ নিজ দেশে ধারাবাহিক ও সফলভাবে এই ধারণাকে বিকশিত করেছেন; অধিকাংশ ভারতীয় মার্কসবাদীও রণনীতিগত-কৌশলগত এই নীতিকে মেনে চলেন। আর তাই বিপ্লবের প্রথম স্তরটিকে তাঁরা জন বা নয়া বা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলেন যাতে বুর্জোয়াদের নেতৃত্বে পুরনো ধরনের গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে এই বিপ্লবের পার্থক্য রচনা করা যায়।

কিন্তু সর্বহারা বিপ্লব কোন পথে এগোবে? ইস্তাহার বুনিয়াদী ধাপগুলোকে নির্দিষ্ট করেছে :

“প্রতিটি দেশের সর্বহারাকে … সর্বাগ্রে নিজ দেশের বুর্জোয়াদের সঙ্গে ফয়সালা করতে হবে”, অর্থাৎ “রাজনৈতিক আধিপত্য অর্জন করবে, দেশের পরিচালক শ্রেণীর পদে উন্নীত হবে, নিজেকেই জাতি হয়ে উঠতে হবে” এবং এইভাবে “গণতন্ত্রের সংগ্রামকে জয়যুক্ত করতে হবে” (দ্বিতীয় অধ্যায়)। অর্থাৎ সর্বহারা তার নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সম্পূর্ণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।

তারপর “সে তার রাজনৈতিক আধিপত্যকে ব্যবহার করবে বুর্জোয়াদের হাত থেকে ক্রমে ক্রমে সমস্ত পুঁজি কেড়ে নেওয়ার জন্য, রাষ্ট্র অর্থাৎ শাসকশ্রেণী রূপে সংগঠিত সর্বহারার হাতে উৎপাদনের সমস্ত উপকরণ কেন্দ্রীভূত করার জন্য” এবং উৎপাদিকা শক্তির দ্রুত বৃদ্ধির জন্য। “শুরুতে” এর সঙ্গে জড়িত থাকবে “সম্পত্তির অধিকার এবং বুর্জোয়া উৎপাদন পরিস্থিতির ওপর স্বৈরাচারী আক্রমণ”। ধাপে ধাপে “এই ব্যবস্থাগুলো নিজ সীমা ছাড়িয়ে যাবে এবং পুরনো সমাজব্যবস্থার ওপর আরও আক্রমণ প্রয়োজনীয় করে তুলবে” এবং অবশেষে “ উৎপাদন পদ্ধতির সম্পূর্ণ বিপ্লবীকরণ” ঘটাবে। (ঐ)

এখানে যা তুলে ধরা হয়েছে তা স্পষ্টতই “নিরন্তর বিপ্লব”-এর ধারণা, ইস্তাহার-এর রচয়িতারা কিছুদিন পরই যে কথাটা বলেছিলেন।কমিউনিস্ট লিগের কাছে কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি (মার্চ ১৮৫০) দেখুন প্রস্তাবিত ব্যবহারিক পদক্ষেপগুলো, অর্থাৎ গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে সেতু রচনাকারী উত্তরণশীল পদক্ষেপসমূহ সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণা দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষে দশটি দফায় বিধৃত হয়েছে। তবে সেখানে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে (ক) সেগুলো কেবল পুঁজিবাদী বিকাশের দিক থেকে “সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর” ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ এবং (খ) প্রকৃত পরিস্থিতি অনুসারে দেশভেদে এবং ১৮৭২ সালের জার্মান সংস্করণের ভূমিকায় যেমন বলা হয়েছে, সময়ভেদে সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য হবে।

এখানে উপস্থাপিত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যাপক বিতর্কিত দুটি বিষয় আলোচনার দাবি রাখে।

একটি হল, ইস্তাহার ঘোষণা করছে : “মর্মবস্তুতে না হলেও, রূপের দিক থেকে বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সর্বহারাদের সংগ্রাম সর্বাগ্রে একটি জাতীয় সংগ্রাম।” এখানে এমন কোনো ইঙ্গিতই নেই যা বোঝায় যে, নির্দিষ্ট কোনো দেশের শ্রমিকশ্রেণী সে দেশের ক্ষমতা দখল করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না অন্ততপক্ষে আরও কয়েকটি দেশের শ্রমিকশ্রেণী ক্ষমতা দখলের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেছে। এর বিপরীতে জার্মানিকে এমন দেশ হিসাবে আলাদা করে বেছে নেওয়া হয় যেখানে “বুর্জোয়া বিপ্লব … অব্যবহিত পরবর্তী সর্বহারা বিপ্লবের ভূমিকাই হবে।”

এই ভবিষ্যৎবাণী যে সত্যি হয়ে ওঠেনি সে এক ভিন্ন প্রসঙ্গ, কিন্তু মার্কস ও এঙ্গেলস এর ওপর যে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তার সাক্ষ্য রয়েছে। ১৯৪৮ সালের মার্চে প্যারিসে বেশ কিছু বিদেশী অভিবাসীদের “বিপ্লব রপ্তানির” পরিকল্পনার বিরুদ্ধে (তাঁদের নিজ নিজ দেশে সশস্ত্র বাহিনী পাঠিয়ে সেখানে বিপ্লব শুরু করা) তাঁরা জোরদার লড়াই চালান এবং কমিউনিস্ট লিগের পক্ষে জার্মানিতে কমিউনিস্ট পার্টির দাবি রচনা করেন, যাতে জার্মানির নির্দিষ্ট পরিপ্রেক্ষিতে ইস্তাহার-এর সংক্ষিপ্ত দশ দফা কর্মসূচীর রূপরেখাকে ব্যাখ্যা করা হয়। এই জাতীয় কর্মসূচীকে ফ্রান্স ও জার্মানিতে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। প্যারিস থেকে (ব্রাসেলসে গ্রেপ্তার হওয়া ও সেখান থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর মার্চ মাসে এসে যেখানে মার্কস থাকছিলেন এবং এঙ্গেলস ও অন্যান্যদের সাথে লিগের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেছিলেন) ৩০০-রও বেশি জার্মান শ্রমিককে একে একে জার্মানিতে পাঠানো হয় বিকাশমান বিপ্লবে অংশগ্রহণের জন্য। এপ্রিলের গোড়ার দিকে মার্কস ও এঙ্গেলস দুজনেই নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে চেষ্টা চালান যাতে বিপ্লবকে সমাজতান্ত্রিক অভিমুখে ঘোরানো যায়। পরবর্তীকালেও কোথাও তাঁরা বলেননি যে একক একটি দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়াসটি ভুল ছিল।

এই সমস্ত কিছু থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মার্কসবাদীরা মনেপ্রাণে আন্তর্জাতিকতাবাদী, তাঁরা জানেন, সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম মূলত একটি আন্তর্জাতিক সংগ্রাম যেটি সমস্ত দেশের, অন্ততপক্ষে সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর সর্বহারাদের যৌথ প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়েই সম্পন্ন হতে পারে। তবে তা কিন্তু অনুকূল পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট কোনো দেশের শ্রমিকশ্রণীকে ঐ সংগ্রামের সূচনা করতে নিবৃত্ত করে না।

দ্বিতীয়ত, ইস্তাহার অামাদের সর্বহারার একনায়কত্ব সম্পর্কে এক ধরনের প্রাথমিক ধারণা দেয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শেষদিকে, দশ দফা কর্মসূচীর ঠিক আগে ও পরে এটি রয়েছে। আমরা দেখতে পাই সর্বহারা একনায়কত্বকে ঐতিহাসিক ঘটনাবলী-বিকাশের সুদীর্ঘ শৃঙ্খলে এক আবশ্যকীয় যোগসূত্র, বস্তুত শেষ যোগসূত্র হিসাবে মনে করা হয়েছে। এর রচয়িতারা বলছেন, শ্রমিকশ্রেণী “পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়” (জোর আমাদের) শ্রেণী হিসাবে সংগঠিত হতে ও লড়াই করতে; এই লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে তারা শাসকশ্রেণী হয়ে ওঠে; পুরনো, নিপীড়নমূলক সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বলপূর্বক ঝেঁটিয়ে বিদায় করে একটি শ্রেণীহীন সমাজের সূচনা ঘটায়, এবং সেই ধারায় “শ্রেণী হিসাবে নিজের আধিপত্য”রও বিলোপ ঘটায়। অন্যান্য শ্রেণীর ওপর শাসন চালানোর জন্য একটি শ্রেণীর (পুঁজিবাদের অধীনে বুর্জোয়া শ্রেণী, সর্বহারার একনায়কতন্ত্রে শ্রমিকশ্রেণী) হাতে সংগঠিত রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তে জনগণের ক্ষমতা তখন ন্যস্ত হয় “গোটা জাতির এক বিশাল সমিতি”র হাতে যেখানে “প্রতিটি মানুষের স্বাধীন বিকাশ হবে সকলের স্বাধীন বিকাশের শর্ত”।

রাষ্ট্রের বিলোপ সম্পর্কে, সমস্ত মানুষের অর্থাৎ ব্যক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সমষ্টির স্বাধীন, সর্বাঙ্গীণ বিকাশের এমন বিপ্লবী অথচ গঠনমূলক ধারণা ইস্তাহার-এর আগে বা পরে কোথাও দেখা গেছে কি?

সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, সামাজিক-ঐতিহাসিক প্রগতির নতুন সূচনা বিন্দু এবং অক্ষ হল শ্রেণীসংগ্রাম এবং চূড়ান্ত গন্তব্য শ্রেণীহীন কমিউনিস্ট সমাজ। হাজার হাজার বছর ধরে ইতিহাসের এগিয়ে চলার এই পথে সর্বহারার একনায়কত্ব হবে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কিন্তু চ্যালেঞ্জে পরিপূর্ণ এক শেষ ধাপ – তা হবে সেই সেতু যা মানবজাতিকে তার, পরবর্তীতে মার্কস যেমন বলেছেন, সংঘাতদীর্ণ “প্রাক-ইতিহাস”রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনায় একটি সংযোজন-এর মুখবন্ধে মার্কস বুর্জোয়া সমাজকে বর্ণনা করেছেন শ্রেণী বৈরিতার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা শেষ সামাজিক সংগঠন রূপে যা “মানব সমাজের প্রাক-ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটায়”। এখানে যা বোঝানো হয়েছে তা হল, পুঁজিবাদকে হঠিয়ে তার স্থানে সাম্যবাদ এলে বৈরিতাদীর্ণ ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটবে, যে সাম্যবাদী সমাজে অবশ্যম্ভাবীরূপেই প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র দেখা যাবে। থেকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সূচনা ঘটাবে মানবজাতির প্রকৃত ইতিহাসের, যে মানবজাতির মধ্যে তখন আর বৈরী শ্রেণীবিভাজন থাকবে না।

প্রাথমিক স্তরের এই সব ধারণাকে পরবর্তীকালে যে সমস্ত রচনায় বিকশিত করা হয় সেগুলো হল ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ, গোথা কর্মসূচীর সমালোচনী (দুটোই মার্কসের রচনা), সমাজতন্ত্র : ইউটোপীয় ও বৈজ্ঞানিক (এঙ্গেলসের অ্যান্টি ড্যুরিং থেকে চয়নিত তিনটি অধ্যায়) – সেই বিকাশ অবশ্য পূর্ণাঙ্গ নয়, কেননা, ইস্তাহার-এর রচয়িতারা নীতিগতভাবেই ভবিষ্যতের সংগীত রচনা করতে রাজি ছিলেন না। যে প্যারি কমিউনে সর্বহারা ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসন প্রতিষ্টা করে, সেটাকেই তাঁরা সর্বহারা একনায়কতন্ত্রের প্রাথমিক মডেল রূপে গ্রহণ করেন। তাঁরা সর্বজনীন ভোটাধিকার, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ফিরিয়ে নেওয়ার জনগণের অধিকার এবং রাষ্ট্রের আইনি ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডকে একীকৃত করে তোলার মতো কমিউনের অ-প্রথাগত, অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর উচ্চ প্রশংসা করেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে মার্কস “সর্বাত্মক প্রসারধর্মী রাজনৈতিক রূপ”কে দেখেন এবং বলেন, এগুলোর স্থানে কোনো আমলাতান্ত্রিক কাঠামো এলে তা কমিউনের স্পিরিটের বিরুদ্ধেই যাবে।

এই ধারণা অনুসারে সর্বহারা একনায়কত্বকে নীতি নির্ধারণে এবং প্রশাসনে জনগণের প্রত্যক্ষ, সক্রিয় ও উদ্দীপনাময় অংশগ্রহণের ভিত্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে সমাজতন্ত্রের বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক নির্মাণের প্রক্রিয়ায় একনায়কত্বের এবং তার ব্যবহারিক মূর্ত রূপ রাষ্ট্রের বিলোপের বা তার থেকে উত্তরণের সম্ভাবনা, প্রতিশ্রুতি এবং আবশ্যিক শর্তাবলীও।