ইস্তাহার-এর শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী আবেদনের বিবিধ সূত্রের মধ্যে পাঠককে সর্বাগ্রে যা নাড়া দেয় তা হল, তার সুললিত অথচ জোরালো ও ঋজু কথন, যার মনের গভীরে দাগ কাটার ব্যাপক ক্ষমতা তার বিপুল সমৃদ্ধ বিষয়বস্তুর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। স্বচ্ছন্দ ধারায় প্রবাহিত এর বিষয়ব্স্তু কোথাও ক্ষিপ্রগতি পাহাড়ি ঝর্ণার মতো গান গায়, কোথাও প্রবল জলপ্রপাতের মতো গর্জন করে এবং শেষে গিয়ে সীমাহীন মহাসিন্ধু, বিশ্ববিপ্লবের মহাসমুদ্রের মতো ফুলেফেঁপে উঠে হাতছানি দিয়ে ডাকে। এর অল্প কথায় বিপুল ব্যঞ্জনার সুষমা পাঠককে বিমুগ্ধ না করে পারে না; বিশ্রুত প্রথম বাক্যটি থেকে শুরু করে শেষের আবেগমথিত আহ্বানের ধারায় এই অমূল্য রত্ন আধুনিক সর্বহারার প্রমিথিয়ুস সুলভ মর্মতেজে ঝলসে ওঠে।

এর নির্মাণ অথবা উপস্থাপনাও কম শিক্ষামূলক নয় : সহজ সরল এবং খোলামেলা, প্রায়শই কথোপকথনের ভঙ্গিতে, কোথাও কোনোরকম ভড়ং নেই। ইস্তাহার শুরু হচ্ছে লক্ষ্যের সুস্পষ্ট ও সংক্ষিপ্ত বার্তা দিয়ে : “কমিউনিজমের ভূতের এই আষাঢ়ে গল্পের জবাব দেওয়া উচিত পার্টির একটা ইস্তাহার দিয়েই” (“ভূত” বলতে লেখকরা কী বুঝিয়েছিলেন তার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জোর দেওয়া হয়েছে)। সুসংবদ্ধ ও সুগভীর এই অবতরণিকার পর রয়েছে সংক্ষিপ্ত ও সহজবোধ্য শিরোনাম সহ চারটি অধ্যায় যেগুলো প্রথম আন্তর্জাতিক মার্কসবাদী কর্মসূচীর যুক্তিসিদ্ধ কাঠামোকে নির্দেশিত করে। প্রথম অধ্যায় শ্রেণীসংগ্রামের মতবাদের পরিপ্রেক্ষিতে পুঁজিবাদী সমাজে প্রধান শ্রেণী প্রতিপক্ষদের বিশ্লেষণ করেছে : “বুর্জোয়া ও সর্বহারা”। “সর্বহারা ও কমিউনিস্টরা” সম্পর্কিত দ্বিতীয় অধ্যায়টি সংগঠিত অগ্রণী বাহিনীর সঙ্গে শ্রেণীর আঙ্গিক সম্পর্কের ব্যাখ্যা করেছে এবং একান্ত অসার বুর্জোয়া ধ্যানধারণার বিপরীতে কমিউনিজমের কিছু মূল প্রস্তাবনাকে বিধৃত করেছে। এই প্রস্তাবনাগুলোর সঙ্গে সেসময় প্রচলিত নানান স্থূল সমাজতান্ত্রিক ও ইউটোপীয় কমিউনিস্ট 'ব্যবস্থা'র বৈসাদৃশ্যের ব্যাখ্যাও জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছিল। এটি করা হয়েছে তৃতীয় অধ্যায়ে, যেখানে রয়েছে “সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট সাহিত্য”র সমালোচনামূলক পর্যালোচনা। “অন্যান্য বিরোধী দল সম্পর্কে কমিউনিস্টদের অবস্থান” শীর্ষক চতুর্থ অধ্যায়ে কমিউনিস্টদের রণনীতি, রণকৌশল ও যুক্তমোর্চা নীতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

চারটি অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে বুনিয়াদী প্রস্তাবনাগুলো একের পর এক সাবলীল অথচ সুসম্বন্ধ ধারায় উঠে এসে এক নিটোল তত্ত্বগত সংহতিতে গ্রথিত হয়; এর সাথেই শ্রেণীসংগ্রামের কেন্দ্রীকতা ইতিহাসের পাতা থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত জীবন্ত হয়ে ওঠে এবং শেষপর্যন্ত পৌঁছে যায় তার সর্বোচ্চ চূড়ায় – যাদের শৃঙ্খল ছাড়া হারানোর কিছু নেই, এবং জয় করার জন্য আছে সারা দুনিয়া, তাদের উদ্দেশ্যে যুদ্ধে নামার আহ্বান! ভবিষ্যৎদর্শী মহান এই বীক্ষার মধ্যেই গ্রথিত রয়েছে কিছু ব্যবহারিক পদক্ষেপের রূপরেখা, ক্ষমতায় আসার পরপরই সর্বহারাকে যেগুলোর রূপায়ণ শুরু করতে হবে।

ইস্তাহার, অর্থাৎ গণ প্রচারের জন্য ক্ষুদ্র পুস্তিকা রূপে বার করা হলেও এই দলিলের উদ্দেশ্য ছিল – “১৮৭২-এর জার্মান সংস্করণের মুখবন্ধ” থেকে আমরা যেমন জানতে পারি – “এক বিশদ তত্ত্বগত ও ব্যবহারিক কর্মসূচী” হয়ে ওঠা। রচয়িতাদ্বয় এই বিপরীতমুখী চাহিদাকে চমৎকারভাবে পূরণ করেছেন। তাঁরা দ্বন্দ্বমূলক বিশ্ববীক্ষা, ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা, শ্রেণীসংগ্রামের মতবাদ, বিভিন্ন দেশে ব্যবহারিক দাবির বিশদ সনদ, ইত্যাদি সম্পর্কে ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায় লেখেননি। এই সমস্ত বিষয়কে সমন্বিত করে তাঁরা একটি বহুমাত্রিক কিন্তু একীকৃত, অখণ্ড আখ্যানে পরিণত করেছেন পুস্তিকার শুরুতে উদ্ধৃত লেনিনের মন্তব্যটি দেখুন। এর ফলে বিশ্ব সর্বহারার হাতে এল এক সমৃদ্ধ তাত্ত্বিক বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত এক ব্যবহারিক-রাজনৈতিক কর্মসূচী। এই পুস্তিকাটি ছিল এবং আজও হয়ে রয়েছে অতীতের এক সারসংক্ষেপ, বর্তমানের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এক চিত্রণ এবং ভবিষ্যতের দিকে এক বৈজ্ঞানিক-দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ।

ইস্তাহার চিরকালই যে এক মহান ঐতিহাসিক জলবিভাজিকা রূপে প্রশংসিত হবে তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে এর ব্যবহারিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য কি হারিয়ে যায়নি?

তা হয়েছে আবার হয়ওনি। রচয়িতারা নিজেরাই ১৮৭২ সালে বলেছিলেন যে, সেই সময়ে পুস্তিকাটির কিছু অংশ (সমসাময়িক সমাজতান্ত্রিক সাহিত্যের সমালোচনা, বিরোধী দলগুলোর মূল্যায়ন এবং দশ দফা বিপ্লবী কর্মসূচী) “অপর্যাপ্ত” বা “পুরনো” হয়ে গিয়েছিল। তবে এর মধ্যেও, কমিউনিস্ট রণনীতি ও রণকৌশল সম্পর্কে আলোচনায় আমরা দেখব বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী এবং মৌলিক নীতিগুলো চিরকালের জন্যই মূল্যবান হয়ে রয়েছে।

আরও এগোনোর আগে ইস্তাহারে গৃহীত পদ্ধতির দিকে আমাদের নজর দেওয়া উচিত। এখানে আমাদের বাস্তব পরিস্থিতির প্রতিলিপি বা পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার প্রত্যাশা ঠিক নয়। এক সৃজনশীল শিল্পীর দ্রুত, সাবলীল, সুদক্ষ তুলির টানগুলোর রসাস্বাদনই আমাদের করতে হবে। এমনই এক শিল্পী যাঁর রয়েছে সর্বোৎকৃষ্ট ক্যামেরার লেনসের চেয়েও শক্তিশালী তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, কিন্তু যিনি নিজের বিষয়ব্স্তুর কিছু অংশে নজর না দিয়ে যেগুলোকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রূপরেখা বা বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্য বলে মনে করেন সেগুলোর ওপর গুরুত্ব দেন যাতে উদ্দিষ্ট বার্তাকে পৌঁছে দেওয়া যায়।

আমাদের অধ্যয়নের পন্থা হিসাবে পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলোতে মার্কসবাদের এই রচনাটির ওপর গুরুত্ব প্রদানের সাথে সাথে এখানে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে পরবর্তীকালে মার্কসবাদী চিন্তার বিকাশগুলোর দিকেও কিছুটা নজর দেব। কেননা একমাত্র এভাবেই অনুশীলনের এক জীবন্ত দর্শন হিসাবে আমরা মার্কসবাদের প্রকৃত অধ্যয়ন শুরু করতে পারি, যা চির-পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে আন্তক্রিয়ার প্রক্রিয়ায় নিজেকে সতত সময়োপযোগী ও সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করে চলেছে।