'কমিউনিস্ট পার্টির ইস্তাহার'-এর প্রথম রুশ সংস্করণ, বাকুনিনের অনুবাদে, সপ্তম দশকের গোড়ার দিকে 'কলোকোল' পত্রিকার ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। সেদিন পশ্চিমের কাছে এটা ('ইস্তাহার'-এর রুশ সংস্করণ) মনে হতে পারত একটা সাহিত্যিক কৌতূহল-বস্তু মাত্র। আজ তেমনভাবে দেখা অসম্ভব।

তখনও পর্যন্ত (ডিসেম্বর, ১৮৪৭) প্রলেতারীয় আন্দোলন কত সীমাবদ্ধ স্থান জুড়ে ছিল সেকথা সবচেয়ে পরিষ্কার করে দেয় 'ইস্তাহার'-এর শেষ অধ্যায়টা : বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন বিরোধী দলের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সম্পর্ক। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখই নেই এখানে। সে যুগে রাশিয়া ছিল ইউরোপের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরাট শেষ-নির্ভর, আর দেশান্তরগমনের ভিতর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণ করেছিল ইউরোপীয় প্রলেতারিয়েতের উদ্বৃত্ত অংশটিকে। উভয় দেশই ইউরোপকে কাঁচামাল যোগাত, আর সেই সঙ্গে ছিল তার শিল্পজাত সামগ্রীর বাজার। সে যুগে তাই দুই দেশই কোনও না কোনও ভাবে ছিল ইউরোপের চলতি ব্যবস্থার স্তম্ভ।

আজ অবস্থা কত বদলে গেছে! ইউরোপ থেকে নবাগত লোকের বসতির দরুনই উত্তর আমেরিকা বৃহৎ কৃষি-উৎপাদনের যোগ্য ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে, তার প্রতিযোগিতা ইউরোপের ছোট বড় সমস্ত ভূসম্পত্তির ভিত পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলেছে। তাছাড়া এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র তার বিপুল শিল্পসম্পদকে এমন উৎসাহভরে ও এমন আয়তনে কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছে যে শিল্পক্ষেত্রে পশ্চিম ইউরোপের, বিশেষ করে ইংল্যান্ডের যে একচেটিয়া অধিকার আজও রয়েছে, তা অচিরে ভেঙে পড়তে বাধ্য। এ দুটি ব্যাপার আবার আমেরিকার উপরেই বিপ্লবী প্রতিক্রিয়া ঘটাচ্ছে। গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তিতে যে কৃষকের ছোট ও মাঝারি ভূসম্পত্তি ছিল, তা ক্রমে ক্রমে বৃহদায়তন খামারের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারছে না; সেইসঙ্গে শিল্পাঞ্চলে এই প্রথম ঘটছে গণ সর্বহারার ও অবিশ্বাস্য পরিমাণের পুঁজির কেন্দ্রীভবনের বিকাশ।

তারপর রুশদেশ! ১৮৪৮-৪৯ সালের বিপ্লবের সময় শুধু ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ নয়, ইউরোপের বুর্জোয়াশ্রেণী পর্যন্ত সদ্যজাগরণোম্মুখ সর্বহারার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র উপায় দেখেছিল রাশিয়ার হস্তক্ষেপে। জার-কে তখন ঘোষণা করা হয়েছিল ইউরোপে প্রতিক্রিয়ার প্রধান নেতা হিসাবে। সেই জার আজ বিপ্লবের কাছে গাৎচিনায় ১৮৮১ সালের ১ মার্চ নারোদনায়া লোয়া সংগঠনের সদস্যদের হাতে সম্রাট দ্বিতীয় অালেক্সান্ডারের হত্যার পরবর্তী ঘটনাবলীর কথা বলা হয়েছে। তাঁর উত্তরাধিকারী তৃতীয় অালেক্সান্ডার অারও সন্ত্রাস ঘটার ভয়ে গাৎচিনায় থাকছিলেন। যুদ্ধবন্দির মতো, আর ইউরোপে বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছে রাশিয়া।

আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির অনিবার্য আসন্ন অবসান ঘোষণা করাই ছিল 'কমিউনিস্ট ইস্তাহার'-এর লক্ষ্য। কিন্তু রাশিয়াতে দেখি দ্রুত বর্ধিষ্ণু পুঁজিবাদী জুয়াচুরি ও বিকাশোন্মুখ বুর্জোয়া ভূসম্পত্তির মুখোমুখি রয়েছে দেশের অর্ধেকের বেশি জমি জুড়ে চাষিদের যৌথ মালিকানা। সুতরাং প্রশ্ন ওঠে যে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে এলেও জমির ওপর মিলিত মালিকানার আদি রূপ এই রুশ অবশ্চিনা (obshchina) কি কমিউনিস্ট সাধারণ মালিকানার উচ্চতর পর্যায়ে সরাসরি রূপান্তরিত হতে পারে? না কি পক্ষান্তরে তাকেও যেতে হবে ভাঙনের সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যা পশ্চিমে ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারা হিসাবে প্রকাশ পেয়েছে?

এর একমাত্র যে উত্তর দেওয়া আজ সম্ভব তা হল এই : রাশিয়ায় বিপ্লব যদি পশ্চিমে সর্বহারা বিপ্লবের সংকেত হয়ে ওঠে যাতে দুই বিপ্লব পরস্পরের পরিপূরক হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে রুশদেশে ভূমির বর্তমান যৌথ মালিকানা কাজে লাগতে পারে কমিউনিস্ট বিকাশের সূচনা হিসাবে।

কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস
লন্ডন, ২১ জানুয়ারী, ১৮৮২