কমিউনিস্ট ইস্তাহার-এর একটি নতুন পোলিশ সংস্করণ জরুরী হয়ে ওঠার ঘটনাটা নানা ভাবনা জাগিয়ে তুলছে।

প্রথমত, এটা উল্লেখযোগ্য যে, ইস্তাহার ইদানিং যেন ইউরোপ মহাদেশে বৃহদায়তন শিল্পের একটা সূচক হয়ে উঠেছে। নির্দিষ্ট কোনো দেশে বৃহদায়তন শিল্প যে অনুপাতে সম্প্রসারিত হয়, সেই অনুপাতে মালিক শ্রেণীগুলোর সাপেক্ষে শ্রমিক শ্রেণী হিসাবে নিজেদের অবস্থানকে উপলব্ধি করার আগ্রহ ঐ দেশের শ্রমিকদের মধ্যে বেড়ে চলে, তাদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে আর এরই সঙ্গে বেড়ে চলে ইস্তাহার-এর চাহিদা। এইভাবে, ঐ দেশের ভাষায় কত সংখ্যক ইস্তাহার প্রচার হল তার থেকে শুধু শ্রমিক আন্দোলনের অবস্থাই নয়, বৃহদায়তন শিল্পের বিকাশের মাত্রাকেও মোটামুটি নির্ভুলভাবে মাপা যায়।

সুতরাং, নতুন পোলিশ সংস্করণ পোল্যান্ডে শিল্পের সুনিশ্চিত বিকাশকে দেখিয়ে দিচ্ছে। আর এ ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না যে, দশ বছর আগে এর আগের সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে এই বিকাশ বাস্তবে ঘটেছে। রুশ পোল্যান্ড, কংগ্রেস পোল্যান্ড রুশ সাম্রাজ্যের বৃহৎ শিল্পাঞ্চল হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার বৃহদায়তন শিল্প বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে রয়েছে – একটা অংশ রয়েছে ফিনল্যান্ড উপসাগরীয় অঞ্চলে, আর একটা রয়েছে কেন্দ্রীয় অঞ্চলে (মস্কো ও ভ্লাদিমির), তৃতীয় একটা অংশ রয়েছে কৃষ্ণসাগর ও অ্যাজোভ উপসাগর উপকূলে এবং এছাড়া অন্যান্য অঞ্চলেও তা রয়েছে; কিন্তু পোল্যান্ডের শিল্প কেন্দ্রীভূত রয়েছে ছোট একটা অঞ্চলে, এবং ঐ কেন্দ্রীভবন থেকে সুবিধা ও অসুবিধা উভয়ই সৃষ্টি হয়। পোল্যান্ডের জনগণকে রুশ জনগণে রূপান্তরিত করার তাদের ব্যাগ্রতা সত্ত্বেও রাশিয়ার প্রতিযোগী উৎপাদকরা যখন পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে সংরক্ষণমূলক শুল্কের দাবি জানায় তখন তারা এই সুবিধাটাকেই স্বীকার করে। পোল্যান্ডের উৎপাদকদের কাছে এবং রাশিয়ার সরকারের পক্ষে এই অসুবিধাটা দেখা দেয় পোল্যান্ডের শ্রমিকদের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণার দ্রুত বিস্তার এবং ইস্তাহার-এর ক্রমবর্ধমান চাহিদার মধ্যে দিয়ে।

তবে পোল্যান্ডে শিল্পের দ্রুতগতিতে বিকাশ, যা রাশিয়াকে পিছনে ফেলে দিয়েছে, আবার পোল্যান্ডের জনগণের অসীম প্রাণশক্তি এবং অচিরে জাতিগতভাবে নিজেদের পুনপ্রতিষ্ঠিত করার নিশ্চয়তাকে নতুন করে প্রমাণ করে। এবং পোল্যান্ডের পুনরায় স্বাধীন ও শক্তিশালী হয়ে ওঠার মধ্যে শুধু পোল্যান্ডের জনগণেরই নয়, আমাদের সকলের স্বার্থও জড়িয়ে রয়েছে। ইউরোপের জাতিগুলোর মধ্যে আন্তরিক আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্ভব হতে পারে যদি প্রত্যেকটি জাতিই নিজেদের স্বায়ত্ততা লাভ করে। ১৮৪৮-এর যে বিপ্লবে সর্বহারা যোদ্ধারা নিজেদের পতাকাকে তুলে ধরেও বুর্জোয়াদের কাজই করেছিল, সেই বিপ্লব আবার ইতালি, জার্মানি ও হাঙ্গেরির স্বাধীনতাকেও বাস্তবায়িত করল, যদিও তার রূপকার হিসাবে সামনে দেখা গেল লুই বোনাপার্ট ও বিসমার্ককে; কিন্তু যে পোল্যান্ড ১৭৯২ সাল থেকে ঐ বিপ্লবের জন্য ঐ তিনটি দেশ একত্রে যা করেছিল তার চেয়ে বেশি অবদান রেখেছিল, সেই পোল্যান্ড ১৮৬৩ সালে যখন তার দশগুণ বড় রুশ বাহিনীর মুখোমুখি হল তখন তার নিজস্ব সঙ্গতির উপরই তাকে নির্ভর করতে হল এবং সে নতিস্বীকারে বাধ্য হল। অভিজাতরা পোল্যান্ডের স্বাধীনতাকে ধরে রাখতে পারেনি, তার পুনরুদ্ধারও তাদের দ্বারা হয়নি; বুর্জোয়াদের কাছে এই স্বাধীনতা আজ গুরুত্বহীন বললে কমই বলা হয়। এসত্ত্বেও, ইউরোপের জাতিগুলোর মধ্যে আন্তরিক সহযোগিতা একান্ত আবশ্যক। পোল্যান্ডের নবীন সর্বহারারাই স্বাধীনতাকে সম্ভবপর করে তুলতে পারেন, এবং তাঁদের হাতেই এটা সুরক্ষিত। ইউরোপের বাকি দেশগুলোর কাছে পোল্যান্ডের স্বাধীনতা ততটাই জরুরী যতটা জরুরী পোল্যান্ডের নিজের শ্রমিকদের কাছে।

এফ এঙ্গেলস
লন্ডন, ১০ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯২