এই “বুনিয়াদী দিশা” বিখ্যাত আটটি দলিলে সবথেকে চমৎকারভাবে বিধৃত হয়েছে, যেগুলি রচিত হয়েছে ইতিহাসের এমনই এক বিরলতম মুহূর্তে যখন – মার্কসের ভাষায় বলতে গেলে – বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপে একটি পদক্ষেপ নেওয়াটা এক ডজন কর্মসূচীর খসড়া তৈরির থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭-র মধ্যে এগুলি লেখা হয়েছিল (ক) তেভাগা ও তেলেঙ্গানা অভ্যুত্থানের আলোকে (খ) ভারতে বিপ্লবী সংকট উদ্ভুত হওয়ার সমকালীন পরিপ্রেক্ষিতে এবং (গ) সদ্য গঠিত সিপিআই(এম)-এর অভ্যন্তরস্থ দুই লাইনের সংগ্রামে উদ্দেশ্যমূলক হস্তক্ষেপ ঘটানোর জ্ন্য ও আরও সাধারণভাবে বলতে গেলে ক্রুশ্চেভ সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংগ্রামের আবহে। এই দলিলগুলি একটি বিপ্লবী মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির জন্য প্রয়োজনীয় মতাদর্শগত ভিত্তি, কর্মসূচীগত দিশা, রাজনৈতিক লাইন, সাংগঠনিক নীতিমালা এবং কাজের পদ্ধতির ক্ষেত্রে দিশা প্রদানের পথ প্রস্তুত করে এবং এভাবেই নকশালবাড়ি এবং সিপিআই(এমএল)-এর ভিত্তিভূমি রচিত হয়।

এটা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, আটটি দলিলে সি এম নির্বাচন বয়কটের কোনো আহ্বান জানাননি। বরং তিনি বিপ্লবী রাজনীতি প্রচারের উদ্দেশ্যে নির্বাচনকে কাজে লাগানোর পক্ষে দৃঢ় মত প্রকাশ করেন। অভিযোগ করা হয় যে তিনি শুধুমাত্র সশস্ত্র সংগ্রাম ও গোপন সংগঠনের পক্ষেই সওয়াল করেছেন। কিন্তু এই দলিলগুলির মধ্যকার একাধিক নিবন্ধে আমরা তাঁকে সংগ্রামের সমস্ত প্রকার রূপ (বিশেষভাবে তিনি “গণডেপুটেশন”, “আংশিক দাবিতে আন্দোলন” ও এমনকি “সত্যাগ্রহের” কথা উল্লেখ করেছেন) ও বিভিন্ন প্রকার সংগঠনকে (ট্রেড ইউনিয়ন ও কৃষক সভা সহ) স্বীকৃতি দান করতে দেখি যদিও তিনি পরিস্থিতির বিকাশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সংগ্রামের উচ্চতর রূপের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন।

“কী করিতে হইবে” গ্রন্থে লেনিন যেমনটি বলেছেন সেইভাবেই সি এম এই দলিলগুলিতে স্বতঃস্ফূর্ততার বিরুদ্ধে (অর্থনীতিবাদ ও নৈরাজ্যবাদ – উভয়ের বিরুদ্ধে) সংগ্রাম চালিয়ে পার্টির সচেতন ভূমিকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন এবং পেশাদার বিপ্লবীদের নিয়ে গঠিত সুসংবদ্ধ সংগঠন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছেন।

“সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে কৃষক আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে চলুন” প্রবন্ধে সি এম লিখেছেন (অষ্টম দলিল, এপ্রিল ১৯৬৭) :

“... আমরা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের কর্মসূচী নিয়েছি এবং সেই বিপ্লবের কাজই হচ্ছে কৃষকের স্বার্থে ভূমিসংস্কার করা। কৃষকের স্বার্থে ভূমিসংস্কার তখনই হতে পারে যখন আমরা গ্রামাঞ্চলে সামন্ত শ্রেণীগুলির প্রভুত্ব খতম করতে পারব। এ কাজ করতে হলে আমাদের সামন্ত শ্রেণীগুলির হাত থেকে জমি কেড়ে নিতে হবে এবং বণ্টন করতে হবে ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে। তা আমরা কখনই করতে পারব না, যদি আমাদের আন্দোলন অর্থনীতিবাদের আওতার মধ্যে থাকে।

“খাস জমির আন্দোলনের প্রত্যেকটি এলাকাতেই আমরা দেখেছি যে, কৃষক যখন খাস জমির দখল পেয়েছে এবং লাইসেন্স করতে পেরেছে, সে আর কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় থাকে না। তার কারণ কী ? কারণ সেই দরিদ্র কৃষকের এক বছরের মধ্যে শ্রেণী বদলে গেছে – সে এখন মধ্য কৃষকে পরিণত হয়েছে। কাজেই দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষকের অর্থনৈতিক দাবি আর তার দাবি নয়। তাই অর্থনীতিবাদ সংগ্রামী কৃষকের ঐক্যে ফাটল ধরায় এবং ভূমিহীন ও গরিব কৃষককে হতাশাগ্রস্ত করে। অর্থনীতিবাদীরা প্রত্যেকটি সংগ্রামকে বিচার করে কত মন ধান দখল হল বা কত বিঘা জমি কৃষকরা পেল এই হিসাব থেকে। তারা কখনও বিচার করে না কৃষকের সংগ্রামী চেতনা বাড়লো কিনা সেই নিরিখে।

“... স্বভাবতই প্রশ্ন আসে তাহলে কি এই যুগে আংশিক দাবির ভিত্তিতে কৃষকের কোনো গণআন্দোলন করার দরকার নেই? নিশ্চয়ই আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। কারণ ভারতবর্ষ বিরাট দেশ এবং কৃষকও বহু শ্রেণীতে বিভক্ত। কাজেই রাজনৈতিক চেতনার মান সব এলাকার এবং সব শ্রেণীর মধ্যে একই স্তরে থাকতে পারে না, তাই আংশিক দাবির ভিত্তিতে কৃষকের গণআন্দোলনের সুযোগ ও সম্ভাবনা সব সময়ই থাকবে এবং কমিউনিস্টদের সেই সুযোগের পুরো সদ্ব্যবহার সব সময়ই করতে হবে।

“আংশিক দাবির আন্দোলন আমরা কী কৌশলে পরিচালিত করব এবং কিইবা তার লক্ষ্য। আমাদের কৌশলের মূল কথা হল ব্যাপক কৃষকশ্রেণীর জমায়েত হচ্ছে কিনা এবং আমাদের মূল লক্ষ্য হবে কৃষকের শ্রেণী-চেতনা বাড়লো কিনা – ব্যাপক কৃষক সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে এগিয়ে গেল কিনা। আংশিক দাবির ভিত্তিতে আন্দোলন শ্রেণীসংগ্রামকে তীব্র করে তুলবে। ব্যাপক জনতার মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়াবে। ব্যাপক কৃষক জনতা ত্যাগ স্বীকারে উদ্বুদ্ধ হবে, সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়বে নতুন নতুন এলাকায়।

“আংশিক দাবির আন্দোলনের ধরন যে কোনো রূপে হতে পারে কিন্তু কমিউনিস্টরা সব সময় উন্নত ধরনের সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা কৃষক সাধারণের মধ্যে প্রচার করবে। ... এই প্রচার চালানো সত্ত্বেও কৃষক জনতা হয়তো গণ-ডেপুটেশনের সিদ্ধান্ত নেবে এবং আমাদের সেই আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে। শ্বেত সন্ত্রাসের যুগে এই গণ-ডেপুটেশনের কার্যকারিতা কোনো ক্রমেই ছোট করে দেখলে চলবে না, কারণ এই ডেপুটেশনগুলিই সংগ্রামে বেশি করে কৃষককে টেনে আনবে।

“অর্থনৈতিক দাবির আন্দোলন কোনো সময়েই অন্যায় নয় তবে অর্থনৈতিক কায়দায় এই আন্দোলনকে পরিচালনা করা অপরাধ। আর অপরাধ এই প্রচার চালানো যে অর্থনৈতিক দাবির আন্দোলন নিজের থেকেই রাজনৈতিক সংগ্রামে রূপ নেবে কারণ এটা হল স্বতঃস্ফূর্ততার পূজা করা। ...”

“শ্রেণীবিশ্লেষণ, অনুসন্ধান ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে কৃষকদের শ্রেণীসংগ্রাম গড়ে তুলুন” প্রবন্ধে (অক্টোবর ১৯৬৮) তিনি সংক্ষিপ্ত, সাবলীল ভাষায় বিপ্লবী শ্রেণী লাইনকে তুলে ধরেছেন :

“আমরা এতকাল যে কায়দায় কৃষক আন্দোলন করার চেষ্টা করেছি তাকে সংশোধনবাদী কৌশল ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। সংশোধনবাদীরা কৃষক আন্দোলন করে পার্টির প্রকাশ্য কার্যকলাপ অক্ষুণ্ণ রাখার স্বার্থে এবং আন্দোলনের জন্য নির্ভর করে বুদ্ধিজীবী পার্টি নেতাদের ওপর। কাজেই তাদের আন্দোলনের সূত্রপাত হয় বড় বড় নেতার বক্তৃতা সংগঠনের ভিতর দিয়ে এবং কৃষকদের স্কোয়াড ইত্যাদির মারফৎ, প্রকাশ্য প্রচার আন্দোলনের মারফৎ। এই আন্দোলন স্বভাবতই বড় বড় নেতার ওপর নির্ভরশীল, কাজেই সেই বুদ্ধিজীবী নেতারা সংগ্রাম তুলে নিতে বললেই সংগ্রাম শেষ হয়। তাছাড়া সমস্ত প্রচার ও আন্দোলন প্রকাশ্য থাকায় দমননীতির সামনে সমস্ত সংগঠন অসহায় হয়ে পড়ে।

“... যতদিন কৃষক বিপ্লবীরা নিজেরা উদ্যোগ না নিচ্ছেন ততদিন বুঝতে হবে জনতা প্রস্তুত নয়। এবং স্বভাবতই আমরা আমাদের বক্তব্য কৃষক সাধারণের ওপর চাপিয়ে দেব না। দ্বিতীয় বিচ্যুতি যেটা ঘটে তা হল যখন কৃষক ক্যাডাররা কোনো কিছু করতে চান তখন বুদ্ধিজীবী কমরেডটি অত্যন্ত পশ্চাদপদ কমরেডটির কথার ওপর জোর দিয়ে সেটাকেই সাধারণ মত বলে চালান এবং তার ফলেই দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতি ঘটে।

“সুতরাং প্রথম কথা হল, জনতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমরা কোনো কিছু চাপিয়ে দেব না। এই নীতি ভুলে গেলে আমরা অনেকগুলি বিচ্যুতির মধ্যে পড়ব, সেগুলিকে সংকীর্ণতাবাদ, কাস্ত্রোবাদ ইত্যাদি অনেক নাম দেওয়া যেতে পারে। সুতরাং এই বিচ্যুতিগুলির হাত থেকে বাঁচতে গেলে আমাদের অবিরাম কৃষকদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রচার চালিয়ে যেতে হবে। ... প্রত্যেকটি পার্টি কমিটির নির্দিষ্ট এলাকা থাকবে এবং সে এলাকায় শ্রেণীবিশ্লেষণ করতে শিখতে হবে এবং অনুসন্ধান ও অনুশীলনের মাধ্যমে প্রত্যেকটি অংশের মানুষের চিন্তা ও ইচ্ছাকে যাচাই করতে শিখতে হবে। ...

“বিপ্লবী শ্রেণীগুলির মধ্যেও অগ্রণী অংশ ও পশ্চাদপদ অংশ থাকে। অগ্রণী অংশ তাড়াতাড়ি বিপ্লবী নীতি গ্রহণ করে এবং পশ্চাদপদ অংশের রাজনৈতিক প্রচার গ্রহণ করতে স্বভাবতই দেরী হয়। এবং এই জন্যই সামন্তশ্রেণীর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এই জন্যই ফসল দখলের আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই সংগ্রাম কোথায় কী রূপ নেবে তা নির্ভর করছে এলাকার রাজনৈতিক চেতনা এবং সংগঠনের ওপর। এই সংগ্রাম পরিচালিত হবে স্বভাবতই সামন্তশ্রেণীর বিরুদ্ধে অর্থাৎ অ-কৃষক জমির মালিক অর্থাৎ জমিরদার শ্রেণীর বিরুদ্ধে এবং কোনো মতেই মধ্যকৃষকের বিরুদ্ধে নয়।

“কৃষকের ব্যাপক গণআন্দোলনের চেষ্টা না করলে এবং ব্যাপক জনতাকে আন্দোলনে সামিল করতে না পারলে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি কৃষক সাধারণের চেতনায় দৃঢ়মূল হতে স্বভাবতই দেরী হবে। তার ফলে সংগ্রামের ওপর রাজনীতির প্রাধান্য কমে এসে অস্ত্রের প্রাধান্য বাড়বার ঝোঁক দেখা দিতে পারে। ...

“আমাদের দেশের ধনীকৃষক প্রধানত সামন্ত শোষণের ওপরই প্রতিষ্ঠিত, তাই তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক হবে প্রধানত সংগ্রামের সম্পর্ক। কিন্তু যেহেতু তাদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী বাজারের শোষণও আছে তার ফলে সংগ্রামের কোনো কোনো স্তরে তাদের সাথে ঐক্যের সম্ভাবনাও আছে। এই ধনীকৃষক বাদ দিলে অন্যান্য সমস্ত কৃষককেই সমর্থক শুধু নয়, সংগ্রামে সামিল করা যায়। শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষক ব্যাপক কৃষক জনতার সংগ্রামের ঐক্য গড়ে তুলতে পারবে এবং এই ঐক্য যত দ্রুত হবে ততই সংগ্রামের চরিত্র বিপ্লবী রূপ নেবে।