প্রিকলের শ্রমিকরা শুধুমাত্র নিজেদের জন্য লড়ছেন না। তাঁরা শ্রমিকশ্রেণীর যাবতীয় দাবি, এমনকি সামাজিক নানান বিষয় নিয়ে সোচ্চার হন। এ কারণে প্রিকল সংগ্রাম থেকে উদ্দীপ্ত হয়ে শ্রীপেরমবুদুরের শ্রমিকরা (যাদের প্রায়শই মার্কিন অটোমোবাইল হাব ডেট্রয়ট-এর সঙ্গে তুলনা করা হয়) তাঁদের নিজস্ব ইউনিয়ন গঠন করতে শুরু করেছেন। সর্বপ্রথম হুন্ডাই শ্রমিকরা প্রিকল শ্রমিকদের সাহসিকতার পথ ধরে এগোতে শুরু করেছেন। শ্রীপেরমবুদুরের আরও অনেক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে উঠেছে। তামিলনাড়ুতে শ্রমিক আন্দোলনে প্রিকল শ্রমিকরা তাঁদের নিজস্ব এক জায়গা করে নিয়েছেন।
শ্রমিকদের ওপর যথেচ্ছ মিথ্যা মামলা চাপানো ও কোর্টের আদেশ সত্ত্বেও প্রিকল সংগ্রামের অনন্যসাধারণ বৈশিষ্ট্য হল, শ্রমিকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন আর ইউনিয়নটি দিনের পর দিন শক্তিশালী হয়েছে।
রায় ঘোষণা হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের ওপর নতুন করে হামলা নামানোর তোড়জোড় শুরু করছে। প্রিকল শ্রমিকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁদের সংগ্রামের দশম বার্ষিকীর শুরুটা তাঁরা করবেন ৫ মার্চ ২০১৬, গোটা বছর জুড়ে উৎসব পালনের মাধ্যমে। এই উৎসবটি হবে ট্রেউ ইউনিয়ন স্বীকৃতি ছিনিয়ে নেওয়া, শ্রম-কানুনকে লাগু করতে কোম্পানিকে বাধ্য করার উৎসব। এবং শেষবিচারে সংগ্রামে বিজয়লাভের উৎসব।
প্রিকল শ্রমিকদের ৮ জন নেতা কোয়েম্বাত্তুর জেলে রয়েছেন। এটা হল সেই একই জেলখানা, যেখানে চিন্নিয়ামপালায়ামের শহীদ শ্রমিকদের বন্দি করে পরে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। এটা হল সেই জেলখানা, যেখানে স্বাধীনতা সংগ্রামী ভি ও চিদম্বরাম বন্দি ছিলেন।
প্রিকলের শ্রমিকরা তাঁদের ৮ জন কমরেডের দ্রুত মুক্তির জন্য সম্ভাব্য সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছেন, সংগ্রামের নায়ক হিসাবে যাঁরা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন।
নিজেদের গভীর দুঃসময়ের মধ্যেও প্রিকল শ্রমিকরা দৃষ্টান্তমূলক হিম্মত ও সংহতির ছাপ রেখে অন্যান্যদের যন্ত্রণার পাশে দাঁড়িয়েছেন। জেলবন্দি শ্রমিক ও কমরেডদের পরিবারকে যে তাঁদের সাহায্য করতে হবে – কিন্তু সবার আগে ভাবতে হবে অন্যদের কথা। রায় ঘোষণার পর, বেতন পাওয়ার প্রথম দিনে তাঁরা তামিলনাড়ু ও পুডুচেরির বন্যা দুর্গতদের সাহার্যার্থে ৫ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেন। এর আগে মারুতি মানেসর কারখানার জেলবন্দি শ্রমিক পরিবারদের সাহায্যার্থে তাঁরা তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। বিহারে বণ্যাত্রাণ এবং নেপালে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ত্রাণ তহবিলও তাঁরা সংগ্রহ করে পাঠিয়েছিলেন।
তার সাফল্য, সংগ্রামী চেতনা ও সামাজিক প্রশ্নে উদ্বেগ প্রকাশ করার জন্য ইউনিয়নটি বিশেষভাবে তীব্র হামলার মুখে পড়ে। প্রিকল শ্রমিকদের দেখানো পথে অটোমোবাইল সেক্টরের অন্য শ্রমিকরা অনুপ্রাণিত হয়ে ইউনিয়ন গঠন করে অধিকার আদায়ের লড়াই শুরু করেছেন। কর্পোরেট ঘরানা মনে করছে যে, এই রায় এবার শ্রমিকদের মনোবল ভেঙ্গে দেবে এবং অনুপ্রেরণার বদলে প্রিকলের জন্য তা হাজির করবে এক সতর্কবার্তা। কিন্তু এ সবই হচ্ছে হাওয়ায় তৈরি করা পুঁজিপতিদের অট্টালিকা, বাস্তবের জমিতে যার কোনো স্থান নেই।
প্রিকল শ্রমিকদের সংগ্রাম – এক অনুপ্রেরণা : প্রিকল শ্রমিকরা এখন কোয়েম্বাত্তুরে কন্ট্রাক্ট ও সাফাই শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজে যুক্ত। তাঁরা গ্রামীণ ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সংগঠিত করতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। একইসঙ্গে তাঁরা ব্যাপকভাবে অংশ নিচ্ছেন গণতান্ত্রিক সংগ্রামে। তাঁরা এতটাই সচেতন হয়ে এই কাজ করছেন যে শর্তসাপেক্ষ জামিন পাওয়ার পর পুডুকোট্টাই জেলায় গ্রামীণ গরিবদের মধ্যে থাকতে শুরু করেন এবং তাঁদের সংগ্রামের বার্তা ও লক্ষ্য সম্পর্কে প্রচার সংগঠিত করেন। এক দশক ব্যাপী সংগ্রামের এই রাস্তায় জনগণের দাবি-দাওয়া নিয়ে ১০০-র বেশি বিক্ষোভ সমাবেশ ও জনগণের বিভিন্ন ইস্যুতে তাঁরা সংগঠিত করেছেন সংহতিমূলক আন্দোলন।
আমাদের অবশ্যই প্রিকল, কোয়েম্বাত্তুরের দৃঢ়চেতা কমরেডদের কাছ শিক্ষা নিয়ে তাঁদের বার্তা ও অভিজ্ঞতাগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে গোটা দেশে শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যে।
তাঁদের এখন দরকার আমাদের সংহতি, সমর্থন ও সহযোগিতা – গোটা দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণী ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সমর্থন তাঁদের প্রয়োজন। এই আদেশনামার সুদূরপ্রসারী ফল রয়েছে, যা সারা দেশের শ্রমিক আন্দোলনে প্রভাব ফেলবে।
শিল্প গণতন্ত্রের লক্ষ্যে : কোয়েম্বাত্তুরের মতো ঘটনা ঘটে চলেছে দেশের নানা প্রান্তে। কোয়েম্বাত্তুরের প্রিকলে জর্জের মৃত্যুর এক বছর আগে বৃহত্তর নয়ডায় একই ঘটনা ঘটে, যেখানে ইটালীয় সংস্থা গ্রাজিআনো ট্রান্সমিশনির স্থানীয় কর্তাব্যক্তি ছাঁটাই শ্রমিকদের একটি দল কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এটা জানা যায় যে, গ্রাজিআনোর ঘটনাটা তখনই ঘটে যখন কর্তৃপক্ষের ভাড়া করা গুণ্ডাবাহিনী শ্রমিকদের বেদম পেটাতে শুরু করে, তাঁদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষ কথা বলবে এই অজুহাতে ডেকে আনার পর। গোরখপুরে একই ধরনের ঘটনা ঘটে। মানেসারের মারুতি প্ল্যান্টেও এরকমই ঘটনা ঘটেছিল। গুরগাঁও-এ কর্মী ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলাকালীন কর্তৃপক্ষের বাউন্সাররা একজন শ্রমিককে খুন করে, যারা ইউনিয়ন গঠনের জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পরবর্তীতে তা সর্বাত্মক এক ধর্মঘটের পথে যায়। প্রায়শই পশ্চিমবাংলার চটকলগুলোতে মিল ম্যানেজারদের কেন্দ্র করে কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোর মালিক বিপুল পিএফ বকেয়া রেখেছে এবং চূড়ান্ত মধ্যযুগীয় ও স্বৈরাচারী কায়দায় শ্রম-কানুনকে লঙ্ঘন করে চলেছে।
সমস্ত ক্ষেত্র যেন একই সূতোয় গাঁথা – শিল্পে গণতন্ত্র না থাকা, শ্রম-কানুনের আকছার লঙ্ঘন, ইউনিয়ন গঠন করার অধিকারকে পুরোপুরি অস্বীকার করা, শ্রমিকদের দুঃসহ কাজের ও বসবাসের পরিবেশ এবং বলিয়ে-কইয়ে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের বার বার নামিয়ে আনা অত্যাচার ও শাস্তি প্রদান। কিন্তু এগুলোকে মেনে নেওয়ার বদলে সরকার ও সংবাদ মাধ্যম কর্পোরেটদের সুরে সুর মিলিয়ে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের নিন্দা ও শ্রমকে নিজের অঙ্গুলি হেলনে চালাবার স্বার্থে পুঁজির আরও অবাধ স্বাধীনতার ওকালতি করে।