আট জন শ্রমিককে দ্বিতীয়বারের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের স্বার্থে লড়াই করার 'অপরাধে' এবং ট্রেড ইউনিয়নে সংগঠিত করার জন্যই তাঁদের দেওয়া হয়েছে এই সাজা। সম্ভবত এটাই হল প্রথম এমন এক ঘটনা, যেখানে শ্রমিক বা ট্রেড ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এরকম এক রায় দেওয়া হয়েছে, আর যেখানে শ্রমিকদের অধিকারের প্রশ্নে পুঁজিপতি/কর্পোরেট ঘরানার তীব্র ঘৃণা, পক্ষপাতদুষ্ট মনোভাব ও শত্রুতা পরিষ্কারভাবেই ফুটে উঠেছে। রায়দানের বার্তা খুবই স্পষ্ট – যদি তুমি মাথা তুলে দাঁড়াও, যদি তুমি তোমার পছন্দমতো ইউনিয়ন গঠন কর, যদি তুমি তোমার অধিকার ও মজুরি সংক্রান্ত ব্যাপারে কথাবার্তা বল, তোমাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে। গোটা দেশজুড়ে লাগাতারভাবেই শ্রমিকশ্রেণীকে এই বার্তা দেওয়া হচ্ছে।
প্রিকল লিমিটেড অটোমোবাইল যন্ত্রাংশের উৎপাদক এবং কোয়েম্বাত্তুর, পুনে, গুরগাঁও ও উত্তরাখণ্ডে রয়েছে তাদের ইউনিট। বিদেশে, যেমন ইন্দোনেশিয়া ও ব্রাজিলেও রয়েছে তাদের ইউনিট। রিয়েল এস্টেট, নির্মাণ, ভ্রমণ, আতিথেয়তা ক্ষেত্রে রয়েছে এদের কারবার।
প্রিকল লিমিটেড-এর শ্রমিকরা (কোয়েম্বাত্তুর) শ্রমকানুন রূপায়ণ এবং আইন মোতাবেক মজুরির দাবিতে অান্দোলন করছিলেন। এজন্য তাঁরা নিজেদের ইউনিয়ন গঠন করেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ এই ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে। ৩ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে কোয়েম্বাত্তুর সেশন কোর্ট (দায়রা আদালত) প্রিকল ইউনিয়নের (কোয়েম্বাত্তুর জেলা প্রিকল ওয়ার্কার্স ইউনিটি ইউনিয়ন) ৮ জন শ্রমিক – গুনাবালান, মনিভান্নান, রাজেন্দ্রন, রামামূর্তি, সম্পত কুমার, সরভান কুমার, শিবকুমার ও ভি ভেলমুরুগন-কে দু-দুবারের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিয়েছে।
শ্রমিক আন্দোলনের ওপর এক পরিকল্পিত আক্রমণ : 'কোনো ধরনের অপরাধ বা এমনকি খুনের সাক্ষ্য না পাওয়া গেলেও এই রায়দানের নির্মমতা প্রমাণ করে যে আর যাই হোক, এটা কয়েকজন অভিযুক্ত শ্রমিকের বিরুদ্ধে সাধারণ এক বিচার নয়। বরং এটা হল, ভারতের শ্রমিক আন্দোলনের ওপর এক পরিকল্পিত সতর্কবার্তা – শ্রমকানুন ও ইউনিয়নের ওপর হালের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক হামলা মেনে নাও, নচেৎ অপরাধে অভিযুক্ত করা হবে।'
স্পষ্টতই বোঝা যায় যে শ্রেণীযুদ্ধে এই রায় কর্পোরেটদের স্বার্থে রচিত হয়েছে সেই একই পথ ধরে, যেখানে বিহারের বাথানিটোলা ও লক্ষ্ণণপুর বাথের দলিত গণহত্যার খুনিরা বেকসুর খালাস পেয়ে যায়, আর বিপরীতে জেহানাবাদে সামন্ত শক্তির হাত থেকে নিজেদের পুকুর (?) বাঁচাতে আন্দোলনরত ১৪ জন কৃষককে ২০০৩ সালে টাডা আইনে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁরা একজনেরও জীবন কাড়েনি। বার্তাটা পরিষ্কার – দরিদ্র, শ্রমিক এবং দলিতদের রক্ত হিসেবের মধ্যে ধরা হয় না। আর, ধনী ও ক্ষমতাবান, পুঁজিপতি ও সামন্তবাদী শক্তিদের অপরাধগুলোকেও আদৌ গণ্য করা হয় না অপরাধ হিসাবে।
এবার এমনই একটা উদ্যোগ নেওয়া হল যাতে ভারতবর্ষের শ্রমিকদের এটা শিক্ষা দেওয়া যায় যে ট্রেড ইউনিয়ন কার্যকলাপকে সংগঠিত অপরাধ বা সন্ত্রাসবাদের সমগোত্রীয় হিসাবেই গণ্য করা হবে – আর শাস্তি দেওয়া হবে নির্মম সাজা ঘোষণা করে। মানেসর (মারুতি), নয়ডা (গ্রাসিআনো) ও শাহিবাবাদ (অ্যালায়র্ড নিপ্পন) সহ গোটা দেশের বহু জায়গায় শ্রমিকদের বছরের পর বছর কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।
শিকাগোর হে মার্কেটে যে ৮ জন শহীদ শ্রমিকের স্মরণে দুনিয়াজুড়ে এখনও ১ মে শ্রমিক দিবস হিসাবে পালিত হয়, তাদেরও ষড়যন্ত্র ও হ্ত্যার মতো মিথ্যা মামলায় শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, কারণ তাঁরা শ্রমিকদের স্বার্থে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে লড়াই করেছিলেন। আজ ১৩০ বছর পরেও আন্দোলনরত শ্রমিকদের একইভাবে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেদিন শ্রমিকশ্রেণী বিজয়লাভ করে এবং অর্জন করে ৮ ঘণ্টা কাজের অধিকার। সমস্ত ধরনের ষড়যন্ত্র এবং পুঁজিপতি শ্রেণী কর্তৃক মিথ্যা মামলা সত্ত্বেও শ্রম ও মজুরির লুঠের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণী আজও বিজয় অর্জন করবে।