সেপ্টেম্বর ২০০৯-এ প্রিকল মানবসম্পদ বিভাগের সহ সভাপতি রায় জে জর্জ-এর মর্মান্তিক মৃত্যু, যা এই মামলায় ষড়যন্ত্রের বনিয়াদ হিসাবে সামনে এল, সেই ঘটনার পূর্বেকার ঘটনাক্রম নিয়ে আলোচনা করব। ইউনিয়ন নেতৃত্ব ও শ্রমিকদের সফল আন্দোলনকে আক্রমণ করতেই ঐ ঘটনাকে একটা অজুহাত হিসাবে সমানে আনা হয়েছে। শ্রমকানুন, আদালতের রায় এবং সরকারী নির্দেশনামা হেলায় লঙ্ঘন করার ব্যাপারে প্রিকল কর্তৃপক্ষ কুখ্যাত। ব্যাপক শ্রমিকের সমর্থনপুষ্ট ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্ন তো দূরস্থান, কর্তৃপক্ষ লাগাতারভাবে শ্রমিকদের ওপর নানান দমন নামিয়েছিল ইউনিয়নকে সমর্থন করার জন্য এই আশা নিয়ে যে এইভাবে তারা ইউনিয়নকে ভাঙ্গতে সফল হবে। 'শাস্তি' হিসাবে বিরাট পরিমাণে মজুরি কেটে নেওয়া হয়। ফলে মাথা পিছু শ্রমিক বঞ্চিত হন দশ হাজার টাকা করে। তা সত্ত্বেও প্রিকলের শ্রমিকরা বুক টান করে সংগ্রামী মেজাজকে অক্ষুণ্ন রেখে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই চালিয়ে যান ধারাবাহিকভাবে।
২০০৭ সাল থেকে প্রিকল কর্তৃপক্ষ বেআইনিভাবে শ্রমিকদের মহার্ঘভাতা ও মজুরি বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত করে। ফলে মাথা পিছু একজন শ্রমিকের প্রতি মাসে লোকসান হয় ৯৫০ থেকে ১৬০০ টাকা। ইউনিয়ন এই বিষয়টা নিয়ে উদ্যোগ নেয়, চাকরি থেকে ইউনিয়ন নেতৃত্বকে বরখাস্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই নালিশ করে শ্রমদপ্তর ও রাজ্য সরকারের কাছে। প্রত্যুত্তরে সরকার ২০০৯-এর মার্চ মাসে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এক নোটিশ জারি করে। এছাড়াও, কর্তৃপক্ষের প্রতিটি বোর্ড সদস্যের বিরুদ্ধে অন্যায্য শ্রম অনুশীলন বা আনফেয়ার লেবার প্র্যাকটিসের জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠায়। জানতে চাওয়া হয় ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য কেন সেই সমস্ত শ্রমিককে মজুরি বৃদ্ধি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সমস্ত নথি ও প্রামাণ্য কাগজপত্র সহ ইউনিয়ন এটাও দেখায় যে সম্পূর্ণ বেআইনি পথে কারখানার মূল উৎপাদন কেন্দ্রে কর্তৃপক্ষ অ্যাপ্রেন্টিস ও কন্ট্রাক্ট শ্রমিককে নিয়োগ করেছে। বাধ্য হয়ে সরকার ১৫ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে আরেকটা বিজ্ঞপ্তি জারি করে কর্তৃপক্ষকে জানায় যে ঐ সমস্ত কাজে যেন অ্যাপ্রেন্টিস বা কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের নিয়োগ না করা হয়। কর্তৃপক্ষ এই বিজ্ঞপ্তির তোয়াক্কা করেনি। ফলে ২১-২২ মে তারিখে কারখানায় আচমকা এক পরিদর্শন হয় আর বেআইনিভাবে অ্যাপ্রেন্টিস ও কন্ট্রাক্ট শ্রমিককে নিয়োগ করার ঘটনায় কর্তৃপক্ষ হাতে-নাতে ধরা পড়ে। এরপর ইউনিয়ন দাবি তোলে, সরকার যেন প্রিকল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে এক আইনি বিজ্ঞপ্তি জারি করে। ১৫ জুন থেকে এই দাবির সমর্থনে প্রিকলের শ্রমিকরা শুরু করেন অনির্দিষ্ট অনশন ধর্মঘট।
এই অনশনের বার্তা গোটা রাজ্য জুড়েই ছড়িয়ে পড়ে। অন্যান্য ইউনিয়ন, এমনকি সাধারণ মানুষও অনশনরত শ্রমিকদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আন্দোলনের সমর্থনে কয়েক লক্ষ প্রচারপত্র বিলি করা হয়। পার্শ্ববর্তী হাইওয়েতে টাঙানো হয় ব্যানার। শ্রমিক, ইউনিয়ন ও জনগণ প্রচণ্ড সাড়া দেয়। সংগ্রামী আবেগ ও লড়াকু মেজাজ বাড়তে থাকে প্রতিদিন। রাজনৈতিক কর্মীবাহিনী, ইউনিয়ন, সামাজিক অনুশীলনরত কর্মী, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ লাইন করে দাঁড়িয়ে সাক্ষাত করেন অনশনরত শ্রমিকদের সঙ্গে। আবেগঘন মুহূর্ত তুঙ্গে ওঠে, যখন দেখা যায় সন্তানরা তাদের অনশনরত মা-বাবার সঙ্গে দেখা করছে।
১২ দিন পর অনশনরত কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ শ্রমিকের শারীরিক অবস্থার বেশ অবনতি ঘটে। অন্যান্য অনশনরত শ্রমিকরা তাঁদের অব্যাহতি দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করেন। কিন্তু তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন যে যতক্ষণ না তামিলনাড়ু বিধানসভায় তাঁদের বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বা তাদের দাবি সুষ্ঠু মীমাংসার পথে যাচ্ছে, ততক্ষণ তাঁরা অনশনে অটল থাকবেন।
ইউনিয়নের এই আন্দোলনের চাপে তামিলনাড়ু সরকার বিধানসভায় আলোচনা সংগঠিত করতে বাধ্য হয় এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে, যে কোনো পরিস্থিতিতেই প্রিকল শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার মীমাংসা করা হবে। বিধানসভায় এই মর্মে এক বিবৃতি জারি হয় যে, ইউনিয়নের দাবিগুলো মেনে নেওয়ায় ইউনিয়নের অনির্দিষ্টকালীন অনশনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হচ্ছে। একদিন আগে, ২৯ জুন ২০০৯ তারিখে শ্রমদপ্তর এক আদেশবলে জানায় যে মূল উৎপাদন কেন্দ্রে কর্তৃপক্ষ অ্যাপ্রেন্টিস বা কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের নিয়োগ করতে পারবে না। একইসাথে শ্রমদপ্তর কর্তৃপক্ষকে এই নির্দেশ দেয় যে, সমস্ত শ্রমিককে মজুরির পাশাপাশি ১ জুন ২০০৯ থেকে মাসিক অন্তর্বর্তীকালীন রিলিফ বাবদ যেন ৫০০ ও ৪০০ টাকা করে দেওয়া হয়।
সারা দেশজুড়ে এই ঐতিহাসিক আদেশনামাটির বিরাট তাৎপর্য রয়েছে। বর্তমান সময়ে যখন কন্ট্রাক্ট শ্রমিকদের খোলাখুলিভাবে নিয়োগ করা হচ্ছে তখন এরকম এক আদেশনামা কোনো ছোটখাটো ঘটনা নয়। প্রিকল শ্রমিকরা তা অর্জন করেছেন এক দীর্ঘস্থায়ী, পরিকল্পিত সংগ্রামের মাধ্যমে।
সরকার ঐ আদেশনামা জারি করলেও কর্তৃপক্ষের দিকেই ছিল তাদের সহানুভূতি। নাছোড় কর্তৃপক্ষ ঐ আদেশনামা রূপায়িত করার বদলে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে যাতে পুরো বিষয়টাকেই বিলম্বিত করা যায়।
এআইসিসিটিইউ-র সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড কুমারস্বামী আবার হাইকোর্টেরও একজন প্রবীণ আইনজীবী। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯ তারিখে তামিলনাড়ু হাইকোর্টে শ্রমিকদের পক্ষে তাঁর দাঁড়ানোর কথা ছিল। এরকমই এক প্রেক্ষাপটে কমরেড কুমারস্বামী সহ ২৬ জনকে খুনের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়, যাতে তাঁরা হাইকোর্টের উপরোক্ত মামলায় প্রকৃত বিচার না পান।
কিভাবে কোর্টে মামলাটা এগোল? পুরো ঘটনায় ইউনিয়ন কর্মী ও নেতা সহ মোট ২৭ জন শ্রমিককে এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে রয়েছেন এআইসিসিটিইউ-র সর্বভারতীয় সভাপতি কমরেড এস কুমারস্বামী, যিনি ঐ ঘটনার দিনে কোয়েম্বাত্তুরের ধারেকাছেও ছিলেন না। প্রিকলে এআইসিসিটিইউ-র নেতা এম গুরুস্বামীকেও এই মামলায় ফাঁসানো হয়, যিনি সেই সময়ে প্রিকল প্ল্যান্ট ১-এ কর্মরত ছিলেন না। এটা জানা যায় যে একেবারে শেষমুহূর্তে তাঁর নাম এফআইআর এবং অভিযোগের তালিকায় যুক্ত করা হয়।
যেহেতু কোর্টের কাছে নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ ছিল না, তাই ২৭ জন অভিযুক্তের মধ্যে ১৯ জনকে বেকসুর খালাস করা হয়। তবে ৮ জনকে কেন অভিযুক্ত করা হল ?
বিচার প্রক্রিয়ায় খুনের ষড়যন্ত্র প্রমাণ করা গেল না। তাহলে তো এটাই স্বাভাবিক, তার ওপর ভিত্তি করে যে সমস্ত অভিযোগ দায়ের করা হয়, তার সবটাই মিথ্যা। এআইসিসিটিইউ-র নেতা কুমারস্বামী ও গুরুস্বামী নিঃশর্তে মুক্তি পান কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোই মিথ্যা প্রমাণিত হয়। কমরেড গুরুস্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো যদি এতই নগ্নভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে থাকে তবে অন্যান্য শ্রমিক সহ গোটা মামলাটি নিয়েই কেন প্রশ্ন উঠবে না?
আরও একটি প্রশ্ন হল – যে সমস্ত ইউনিয়ন নেতারা ২০০৭ সাল থেকে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ আন্দোলনের পরিকল্পনা করে চুক্তি সম্পাদন করতে সফল হন, তারাই বা কেন ষড়যন্ত্রের পথে হাঁটবেন? ইউনিয়ন পরিচালনা করা তো কোনো ষড়যন্ত্রমূলক কাজ নয়। তার সাফল্য নির্ভর করে রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও নেতৃত্বের ওপর, হত্যা সংগঠিত করার ষড়যন্ত্রের ভিত্তিতে নয়।