“রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনীর একটি ভূমিকার মুখবন্ধে” (১৮৫৯) মার্কস ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক ও বস্তুবাদী ধারণার এক চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন :

“মানব-জীবনের সামাজিক উৎপাদনের মধ্যে মানুষ জড়িত হয় কতগুলো অনিবার্য ও ইচ্ছা-নিরপেক্ষ নির্দিষ্ট সম্পর্কে, উৎপাদন-সম্পর্কে, যা মানুষের বৈষয়িক উৎপাদন-শক্তির বিকাশের একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ের অনুরূপ। এই উৎপাদন-সম্পর্কগুলোর সমষ্টি হল সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো, সেই আসল বুনিয়াদ, যার ওপর গড়ে ওঠে আইনগত আর রাজনৈতিক উপরিকাঠামো এবং সামাজিক চেতনার নির্দিষ্ট রূপগুলো হয় তারই অনুরূপ।

বৈষয়িক জীবনের উৎপাদন-পদ্ধতিই সাধারণভাবে মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও বৌদ্ধিক জীবন প্রক্রিয়াকে নির্ধারণ করে। মানুষের সত্তা তার চেতনা দ্বারা নির্ধারিত নয়, বরং ঠিক বিপরীতভাবে, মানুষের সামাজিক সত্তাই নির্ধারিত করে তার চেতনাকে।

সমাজের বৈষয়িক উৎপাদন-শক্তি বিকাশের এক নির্দিষ্ট পর্যায়ে এলে তার সঙ্গে সংঘাত লাগে প্রচলিত উৎপাদন-সম্পর্কের অর্থাৎ আইনি ভাষা ব্যবহার করলে বলতে হয়, সংঘাত লাগে এতদিন যে সম্পত্তি-সম্পর্কের মধ্যে উৎপাদন-শক্তি সক্রিয় ছিল তারই সঙ্গে। সে সম্পর্ক উৎপাদন-শক্তির বিকাশের রূপ থেকে পরিবর্তিত হয়ে পরিণত হয় উৎপাদন-শক্তির শৃঙ্খলে।

তারপর শুরু হয় সামাজিক বিপ্লবের এক যুগ। অর্থনৈতিক বুনিয়াদ পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বিরাট উপরিকাঠামোও কম-বেশি দ্রুত রূপান্তরিত হয়ে যায়। এই রূপান্তরগুলো বিচার করতে গেলে, উৎপাদনের অর্থনৈতিক যে পরিস্থিতির বৈষয়িক রূপান্তর প্রাকৃতিক বিজ্ঞানসুলভ সূক্ষ্মতার সঙ্গেই নিরূপণ করা যায় তা থেকে পৃথক করে দেখতে হবে আইনগত, রাজনীতিগত, ধর্মগত, নন্দনতত্ত্বগত বা দর্শনগত, সংক্ষেপে বলতে গেলে ভাবাদর্শগত রূপগুলোকে, যার মাধ্যমে মানুষ এ সংঘাত সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠে ও সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তার নিষ্পত্তি করে। যেমন ব্যক্তিবিশেষ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা নির্ভর করে না সে ব্যক্তি নিজের সম্বন্ধে কী ভাবে তার ওপর, তেমনি কোনও রূপান্তরের সময়কালকে সে যুগের স্বকীয় চেতনা দিয়ে আমরা বিচার করতে পারি না; বিপরীত পক্ষে, সেই চেতনাকে ব্যাখ্যা করতে হবে বৈষয়িক জীবনের দ্বন্দ্বগুলো দিয়েই, সামাজিক উৎপাদিকা-শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যেকার সংঘাত দিয়ে।

কোনও সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে যতটা উৎপাদিকা-শক্তির জায়গা হতে পারে তার সবটার বিকাশ না হওয়া পর্যন্ত সে সামাজিক ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘটে না; আর নতুন উন্নততর উৎপাদন-সম্পর্কের আবির্ভাবও ঘটতে পারে না যতক্ষণ না পুরনো সমাজের গর্ভের মধ্যেই তেমন সম্পর্কের অস্তিত্বের বৈষয়িক শর্ত পরিপক্ক হয়ে উঠছে। সুতরাং মানবজাতি সর্বদা সেই কর্তব্যেই প্রবৃত্ত হয় যার সমাধান সম্ভব; কেননা বিষয়টির প্রতি আরও গভীর দৃষ্টি দিলে সর্বদাই দেখা যাবে যে, কর্তব্যটা দেখা দেয় শুধু তখন যখন তার সমাধানের বৈষয়িক শর্তগুলো ইতিমধ্যেই বিদ্যমান কিংবা অন্তত গড়ে উঠতে শুরু করেছে।

সাধারণ রূপরেখা হিসাবে এশীয়, প্রাচীন, সামন্ততান্ত্রিক ও আধুনিক বুর্জোয়া উৎপাদন-পদ্ধতিগুলোকে সমাজের অর্থনৈতিক রূপগঠনের ক্রমাগ্রসর পর্যায় বলে অভিহিত করা যেতে পারে। বুর্জোয়া উৎপাদন-সম্পর্কগুলো হচ্ছে সামাজিক উৎপাদন-প্রণালীর শেষ বৈরভাবাপন্ন রূপ – ব্যক্তিমানুষের বিরোধের অর্থে বৈরভাব নয়, ব্যক্তিদের জীবনযাত্রার সামাজিক অবস্থার মধ্য থেকে উদ্ভূত বৈরভাব – এর সঙ্গে সঙ্গেই বুর্জোয়া সমাজের গর্ভে বিকাশমান উৎপাদিকা-শক্তিসমূহ সেই বৈরভাবের সমাধানের বস্তুগত শর্তও সৃষ্টি করে। সুতরাং, এই সামাজিক শক্তি মানবসমাজের প্রাক-ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটায়।”

কত সংক্ষিপ্ত পরিসরে চিন্তার কী বিপুল সম্পদ এখানে আমরা পেয়ে যাচ্ছি, তাই না? এর মধ্যে অন্তত কয়েকটি বিষয়ে দু'চার কথা বলা দরকার।

উৎপাদন সম্পর্ক এবং উৎপাদিকা শক্তি বলতে কী বোঝায়? উৎপাদন-সম্পর্ক হল উৎপাদনে (এবং বণ্টনের ক্ষেত্রেও, যার মধ্যে বিনিময় অর্থাৎ ক্রয়-বিক্রয়ও পড়ে) নিযুক্ত মানুষের মধ্যেকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক। এ বিষয়ে একটা বাস্তবসম্মত ধারণা আমরা চারিদিকে তাকালেই পেতে পারি। একটি কারখানায় আপনি দেখতে পাবেন ১০ জন, ১০০ জন বা ১০০০ জন শ্রমিক কাজ করছেন মালিকের ছোট-বড় নানান যন্ত্রপাতি নিয়ে, আর মালিক সরাসরি বা তাঁর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে অর্থাৎ সুপারভাইজার, ইঞ্জিনিয়ার, ম্যানেজার – এঁদের সাহায্যে সেই উৎপাদনের তদারকি করছেন। এখানে, একদিকে শ্রমিকরা আর অন্যদিকে মালিক বা মালিকরা – এই দুইয়ের মধ্যেকার সম্পর্ক হল উৎপাদন সম্পর্ক। এ সম্পর্ক হল শোষণ ও সংগ্রামের। আবার শ্রমিকদের নিজেদের মধ্যেকার সম্পর্কও এক ধরনের উৎপাদন সম্পর্ক – সহকর্মী ও  সহযোদ্ধার সম্পর্ক। এইভাবেই শ্রেণীবিভক্ত সমাজে উৎপাদন সম্পর্ক শ্রেণী-সম্পর্কের রূপ নেয়। আর এই সব সম্পর্ক যুক্তভাবে সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো (একে বুনিয়াদ বা “ভিত”ও বলা হয়) গঠন করে। এরই ওপরে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক “উপরিসৌধ”। এইভাবে দেখা যায় সামন্ততান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থার ওপর গড়ে ওঠে রাজতন্ত্র আর ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি আমাদের দেয় সংসদীয় ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের সমস্ত রূপই শোষিতদের ওপর শোষকশ্রেণীর শাসনকে (যেমন কৃষকের ওপর সামন্তপ্রভুদের, মজুরি শ্রমিকদের ওপর শিল্পপতিদের) সুব্যবস্থিত করে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা পাই এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু মূল্যবোধ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ইত্যাদি (যেমন আমরা বলে থাকি “সামন্ততান্ত্রিক মূল্যবোধ”, “বুর্জোয়া সংস্কৃতি” ইত্যাদি ইত্যাদি)।

অন্যদিকে উৎপাদিকা শক্তি বলতে বোঝায় উৎপাদনের উপকরণসমূহ (যেমন যন্ত্রপাতি, উৎপাদনক্ষেত্র ও কারখানা, হাতুড়ি ও লাঙল থেকে শুরু করে কম্পিউটার ও ট্রাক্টর পর্যন্ত নানা ধরনের শ্রমের উপকরণ), উৎপাদন পদ্ধতি বা প্রযুক্তি এবং উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা রয়েছে এমন শ্রমিকবাহিনী (কৃষক, শ্রমিক, কারিগর ইত্যাদি)। উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন সম্পর্ক যুক্তভাবে “উৎপাদনের ধরন” (যেমন সামন্ততান্ত্রিক, ধনতান্ত্রিক ইত্যাদি) গঠন করে।

ইতিহাস সম্পর্কে যে প্রভাবশালী ভাববাদী ধারণা প্রচলিত রয়েছে, যেখানে ঐতিহাসিক পরিবর্তনকে ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন থেকে উদ্ভূত বলে দেখানো হয়, উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে মার্কস তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তিনি উপরিসৌধের চেয়ে ভিত এবং মানুষের সামাজিক চেতনার চেয়ে তার জীবনের বস্তুগত অবস্থার প্রাধান্যকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কিন্তু এই ব্যাপারটাকে একপেশেভাবে দেখা ঠিক হবে না। এ প্রসঙ্গে এঙ্গেলস ১৮৯০-এর ২১-২২ সেপ্টেম্বর যোসেফ ব্লজ-কে লেখা একটি চিঠিতে ব্যাখ্যা করেছেন :

“… শেষ বিচারে, বাস্তব জীবনের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদনই ইতিহাসের নির্ণায়ক বিষয়। এর চাইতে বেশি কিছু আমি বা মার্কস কোনওদিন বলিনি। সুতরাং এখন যদি কেউ এটাকে বিকৃত করে এই বক্তব্যে দাঁড় করিয়ে দেয় যে অর্থনৈতিক ব্যাপারটাই একমাত্র নির্ণায়ক ব্যাপার, তবে সে আমাদের সূত্রায়নকে এক অর্থহীন, উদ্ভট কথায় পরিণত করেছে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতিটা ভিত্তি অবশ্যই, কিন্তু উপরিসৌধের নানা উপাদান – শ্রেণীসংগ্রামের রাজনৈতিক রূপ ও তার ফলাফল যেমন সফল লড়াইয়ের পর বিজয়ী শ্রেণী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সংবিধান, ইত্যাদি, বিচার ব্যবস্থার রূপ, বিশেষত, শ্রেণীসংগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের চিন্তায় এইসব বাস্তব সংগ্রামের প্রতিফলন, রাজনৈতিক, আইন-বিষয়ক ও দার্শনিক তত্ত্বসমূহ, বিভিন্ন ধর্মীয় মতামত এবং কট্টর ধর্মীয় ব্যবস্থায় তাদের পরবর্তী বিকাশ – ইত্যাদি বহু কিছুই ঐতিহাসিক সংগ্রামগুলোর ওপর তাদের ছাপ রেখে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর নির্দিষ্ট রূপ অনেকটাই নির্ধারণ করে দেয়।” (মার্কস ও এঙ্গেলস-এর নির্বাচিত পত্রাবলী, পৃঃ ৩৯৪-৯৫)

সমাজ কখন উৎপাদনের একটি ধরন থেকে উন্নততর ধরনে এগিয়ে যায়? এটা ঘটে তখনই, যখন “উৎপাদিকা শক্তিসমূহের বিকাশের রূপ বা আঙ্গিক” থেকে উৎপাদন সম্পর্কগুলো “পরিণত হয় তাদের শৃঙ্খলে”। ব্যাপারটা এইভাবে হয়। কোনও নতুন উৎপাদনের ধরনের প্রথম পর্যায়ে (ধরা যাক দাসপ্রথার পরে সামন্ততন্ত্রের কথা) উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যেকার সামঞ্জস্য বা সাযুজ্য ঢেকে রাখে এ দুয়ের মধ্যে অন্তর্নিহিত সংঘাতের দিকটিকে। কিন্তু যে অনুপাতে আলোচ্য উৎপাদন ধরন বা সমাজব্যবস্থায় উৎপাদিকা শক্তির ধারাবাহিক বিকাশের জায়গাটা সঙ্কুচিত হয়ে আসে, সেই অনুপাতে সংঘাতের দিকটি বাড়তে থাকে এবং ক্রমে ক্রমে তা “বিপরীতের ঐক্য”র মধ্যে প্রধান দিক হয়ে ওঠে। তখনই (তার আগে নয়) শুরু হয় বিপ্লবের যুগপর্ব (লক্ষ্যণীয় – বিপ্লবকে কয়েক দিনের ঘটনা নয়, দীর্ঘায়িত ব্যাপার বলে দেখিয়েছেন মার্কস)। এইভাবে ইউরোপে বুর্জোয়া বিপ্লবগুলো সংঘটিত হয়েছিল তখনই, যখন পুরনো সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন সম্পর্ক (যার নিদর্শন ছিল সামন্তপ্রভু ও ভূমিদাস, গিল্ড মালিক ও অস্থায়ী কারিগর) নতুন উৎপাদিকা শক্তির (যেমন বৃহৎ উৎপাদনমুখী মেশিনপত্রের) পক্ষে, তার ধারাবাহিক বিকাশের পক্ষে, অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ প্রতিপন্ন হয়েছিল। এরকমই এক পরিস্থিতি আজ আবার পেকে উঠেছে। এবং তা ঘটছে এক নির্দিষ্ট রূপে, যেমনটি মার্কস পুুঁজি গ্রন্থে দেখিয়েছেন :

“একজন পুঁজিপতি সর্বদাই অন্য অনেক পুঁজিপতিকে শেষ করে দেয়। এই কেন্দ্রীকরণ অর্থাৎ একজন পুঁজিপতি কর্তৃক অন্য অনেককে গ্রাস করে নেওয়ার সাথে ক্রমবর্ধমান মাত্রায় বিকশিত হতে থাকে যৌথ শ্রম, বিজ্ঞানের সচেতন ব্যবহারিক প্রয়োগ, জমির সুপরিকল্পিত ও সুব্যবস্থিত চাষ। শ্রম উপকরণগুলো পরিবর্তিত হয় একসাথে অনেকে মিলে ব্যবহারযোগ্য শ্রম-উপকরণে, সবরকম উৎপাদন মাধ্যম হয়ে ওঠে যৌথ সামাজিক শ্রমে ব্যবহার্য উৎপাদন মাধ্যম হিসাবে। বিশ্ববাজারের জালে জড়িয়ে পড়ে সবকটি জাতি, সেই সঙ্গে বিকশিত হতে থাকে পুঁজিবাদী জমানায় বিশ্বজনীনতা। এইসব রূপান্তরের সবটুকু সুবিধা একচেটিয়াভাবে আত্মসাৎ করে নেয় যেসব বৃহৎ পুঁজিপতি, তাদের সংখ্যা লাগাতার কমার পাশাপাশি বাড়তে থাকে দারিদ্র, নির্যাতন, দাসত্ব, অবক্ষয় ও শোষণ; কিন্তু আবার সেই সাথে বেড়ে চলে শ্রমিকশ্রেণীর বিদ্রোহ – যে শ্রেণী সর্বদাই সংখ্যায় বাড়ছে, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাই যে শ্রেণীকে সুশৃঙ্খল, ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করে তুলছে। পুঁজির একচ্ছত্র ক্ষমতা উৎপাদন ধরনটির (যা ঐ একচেটিয়ার পাশাপাশি – বা বলা যায় তার অধীনে – গড়ে উঠেছে বেড়ে উঠেছে) ওপর এক শৃঙ্খলে পর্যবসিত হয়। পুঁজির কেন্দ্রীকরণ আর শ্রমের সামাজিকীকরণ বাড়তে বাড়তে শেষপর্যন্ত এমন এক জায়গায় পৌঁছে যায় যেখানে তারা আর ধনতান্ত্রিক বহিরাবরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ থাকতে পারে না। ঐ বহিরাবরণ তখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। পুঁজিবাদী ব্যক্তিগত সম্পত্তির মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠে। অন্যের সম্পদ আত্মসাৎকারীরা হারায় তাদের সবকিছু।” (পুঁজি, খণ্ড ১, পৃঃ ৭১৪-১৫)

আমরা পরে দেখব, এখান থেকেই লেনিন তাঁর সাম্রাজ্যবাদ বিষয়ক তত্ত্বের সূচনা ঘটিয়েছিলেন, দেখিয়েছিলেন যে তা হল পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর তথা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সূচনা। ঠিক যেমন নবোদিত এবং শুরুতে প্রগতিশীল পুঁজিপতিশ্রেণী সামন্ততান্ত্রিক শৃঙ্খল ছিন্ন করে পুঁজির শাসন কায়েম করেছিল, তেমনই উৎপাদন প্রক্রিয়ার সামাজিকীকরণের প্রতিনিধি সর্বহারা একচেটিয়া পুঁজিবাদের আঁটোসাটো বহিরাবরণ ভেঙে দিয়ে সমাজতন্ত্রের সূচনা ঘটাবে।

মার্কসের প্রথম উদ্ধৃতিতে আর একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। তিনি দু-ধরনের রূপান্তরের মধ্যে ফারাক করছেন : অর্থনৈতিক কাঠামোয় রূপান্তর (উদাহরণস্বরূপ,লেনিনের সময়ে রাশিয়ায় যা অল্পকালের মধ্যেই অর্জিত হয়েছিল) – যা সহজেই দেখা যায়, মাপা যায়; আর মতাদর্শগত উপরিসৌধে রূপান্তর, যা অনেক বেশি সূক্ষ্ম, জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এখানে মার্কসের মধ্যে আমরা যেন আভাষ পেয়ে যাচ্ছি লেনিন আর মাও-এর, যাঁরা নিজেদের মতো করে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের গুরুত্বকে জোরের সাথে তুলে ধরেছিলেন।

এগুলোই যদি হয় মানবসমাজের বিকাশের সাধারণ সূত্র, তবে কোন কোন নির্দিষ্ট রূপ ধরে তারা গোটা দুনিয়ায় আত্মপ্রকাশ করেছে? আজ পর্যন্ত সমাজ যে সমস্ত প্রধান প্রধান স্তর বা “যুগপর্বের” মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে তার একটা সাধারণ রূপরেখা (ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্নতার কথা এখানে ধরে নেওয়া হচ্ছে) মার্কস আমাদের সামনে রেখেছেন। এগুলোর মধ্যে সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ধরনের সঙ্গে আমরা পরিচিত। “এশিয়াটিক” ও “প্রাচীন” বলে কথিত দুটি ধরনের মধ্যে প্রথমটি সাধারণভাবে জমির গোষ্ঠীগত (ব্যক্তিগত নয়) মালিকানা, হস্তশিল্প ও কৃষির সমন্বয়ের ওপর গড়ে ওঠা স্ব-নির্ভর ও মূলত পরস্পর-বিচ্ছিন্ন গ্রামভিত্তিক অর্থব্যবস্থা, রাষ্ট্র পরিচালিত বিস্তীর্ণ সেচব্যবস্থা – এইসব বৈশিষ্ট্যের দ্বারা চিহ্নিত। সুদূর অতীতে ভারত, চীন, জাভা এবং আরও অনেক দেশে (অংশত রাশিয়াতেও) এটি দেখা গেছে। আর “প্রাচীন” উৎপাদন ধরন বলতে প্রধানত গ্রীস ও রোমের দাসপ্রথাভিত্তিক সমাজগুলোর কথা বোঝানো হয়েছে। তবে এ প্রসঙ্গে অবশ্যই দুটি কথা মনে রাখতে হবে। এক – মার্কস ও এঙ্গেলস উভয়েই, এবং তাঁদের উত্তরসূরীরাও, প্রাক-সামন্ততান্ত্রিক স্তরগুলোকে বিভিন্ন লেখায় কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বর্ণনা করেছেন (এ নিয়ে কিছুটা ব্যাপকতর ধারণা করার জন্য রাষ্ট্র প্রবন্ধে লেনিনের সহজ সরল বর্ণনা দেখা যেতে পারে, যার অংশবিশেষ নীচে দেওয়া হয়েছে)। দুই – একাধিক উৎপাদন-ধরন অনেক সময় সহাবস্থান করে বা আন্তঃপ্রবিষ্ট হয়, তখন দেখা যায় নানান মিশ্র ধরন। একটা ভালো উদাহরণ হল আমাদের দেশ : এক কৃষিপ্রধান পশ্চাদপদ পুঁজিবাদী সমাজ, যা অনমনীয় সামন্ততান্ত্রিক অবশেষ এবং পুরোদস্তুর ঔপনিবেশিক জেরকে বহন করার করাণে গতিরুদ্ধতায় ভুগছে, আবার সেগুলোকেই শক্তিশালী করে তুলছে এবং বিশ্বপুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদের লোভাতুর আধিপত্যের অধীনে নিষ্পেষিত হচ্ছে।

“প্রাক-ইতিহাস” শব্দটিও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এর তাৎপর্য সম্ভবত  এই যে, প্রকৃত অর্থে মানুষের ইতিহাস পূর্ণ গৌরবে শুরু হতে পারে সমাজতন্ত্রেই – সমাজ যখন বহুযুগের বৈরিতাগুলো থেকে মুক্তি পায়, যখন মানুষ আর সঙ্কীর্ণ শ্রেণী-ছাপের দ্বারা চিহ্নিত বা কলঙ্কিত হয় না এবং এইভাবে দেখলে দাসপ্রথা হতে ধনতন্ত্র পর্যন্ত সমগ্র পর্যায়টাই বৈরিতাপূর্ণ উৎপাদন সম্পর্কগুলোর এক প্রাক-ইতিহাস বলে প্রতিপন্ন হয়।

মার্কসবাদের উদ্ভব ও সাধারণ নীতি সম্পর্কে আপাতত এইটুকু থাক। আমাদের অবশ্যই মূল বিষয়গুলো আয়ত্ত করতে হবে এবং সেজন্য চিরায়ত রচনাগুলো বারবার অধ্যয়ন করতে হবে। কিন্তু এটুকুই যথেষ্ট নয়। আমাদের নিজেদের সমাজকে ও যুগকে বোঝার জন্য এই সব মূল নীতি প্রয়োগ করতেও শিখতে হবে। লেনিন যাকে বলেছিলেন “নির্দিষ্ট অবস্থার নির্দিষ্ট বিশ্লেষণ”, তা আমাদের ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট পরিঘটনা বা প্রক্রিয়াকে লক্ষ্য করুন – দেখুন তা কীভাবে ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয়েছে এবং কোন দিকে এগোচ্ছে। তার বিভিন্ন মাত্রাকে (যেমন অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক) ভালোভাবে পরীক্ষা করুন। তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলো এবং চারপাশের অন্যান্য পরিঘটনা ও প্রক্রিয়ার সাথে তার বহুবিধ আন্তসম্পর্কগুলো পর্যবেক্ষণ করুন। খুব সংক্ষেপে, এটাই হল সাধারণের সাথে বিশেষকে মেলানোর পদ্ধতি।

এরই সাথে প্রয়োজন তত্ত্বকে অনুশীলনের সাথে মেলানো, যেমন মাও বারবার বলতেন :

“অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে সত্যকে আবিষ্কার করুন, আবার অনুশীলনের সাহায্যে সত্যকে পরীক্ষা ও বিকশিত করুন। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান থেকে শুরু করে তাকে সক্রিয়ভাবে ধারণাগত জ্ঞানে বিকশিত করুন; তারপর ধারণাগত জ্ঞান থেকে শুরু করুন এবং সক্রিয়ভাবে বিপ্লবী অনুশীলন পরিচালনা করুন, যাতে বিষয়গত ও বস্তুগত জগৎ দুটোকেই পাল্টানো যায়। অনুশীলন, জ্ঞান, আবার অনুশীলন এবং আবার জ্ঞান। অন্তহীন চক্রে এই রূপটি নিজেকে আবর্তিত করতে চলে এবং প্রতিটি আবর্তনের সাথে অনুশীলন ও জ্ঞান উন্নততর স্তরে পৌঁছে যায়।”