মার্কসের ত্রিশতম মৃত্যুবার্ষিকী (১৯১৩) উপলক্ষে লেখা এই রচনায় লেনিন মার্কসবাদের সামগ্রিকতার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। প্রথম চারটি অনুচ্ছেদে যে বুনিয়াদী বিষয়টিকে তিনি তুলে ধরেছেন তা হল, মার্কসবাদ কোনও আত্ম-আবদ্ধ ব্যবস্থা বা শিলীভূত মতবাদ নয়। মার্কসবাদ বিপ্লবী অনুশীলনের চিরসবুজ দর্শন। এটা হঠাৎ আকাশ থেকে পড়েনি, মানবসভ্যতা ও জ্ঞানের বিকাশের প্রক্রিয়াতেই এর জন্ম। “মার্কসবাদ ও সংশোধনবাদ” রচনায় লেনিন বলেছিলনে, মার্কসবাদ কোনও “স্বয়ংসম্পূর্ণ ও অলঙ্ঘনীয়” ব্যাপার নয় – তত্ত্ব-অনুশীলনের এক নিরন্তর স্রােতস্বিনীর মতো তা বিকশিত হয়ে চলেছে। এই গতিশীল বিকাশমান ও সম্মুখদর্শী অর্থের বিচারেই মার্কসবাদ সত্য ও সর্বশক্তিমান। এই বুনিয়াদী দৃষ্টিভঙ্গীকে তুলে ধরেই মাও বলেছিলেন : “মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মোটেই সত্যের শেষ কথা বলে দেয় না, বরং অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে সত্যকে জানার পথ বিরামহীনভাবে খুলে দেয়।” এই বিনম্র, বিজ্ঞানসম্মত, গবেষণামুখী প্রাণসত্তাটিই হারিয়ে যায় যখন কেউ অপ্রাসঙ্গিকভাবে লেনিনকে উদ্ধৃত করেন। যেমন, কলকাতার রাস্তার দেওয়ালে সিপিএম যখন লেখে, “মার্কসবাদ সর্বশক্তিমান কারণ ইহাই সত্য”। (এখানে “ইহা”র পর “ই” প্রক্ষিপ্ত – লেনিনের নয় !)

শুরুর অনুচ্ছেদগুলোর পর তিনটি ভাগে লেনিন তিনটি উৎস-তথা-অঙ্গকে এক এক করে বর্ণনা করেছেন। আমরা দেখতে পাব, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি বাস্তব জীবনের প্রকৃত প্রক্রিয়া বা পর্যায়ক্রমিক স্তরগুলিকে বর্ণনা করেছেন যার মধ্যে দিযে এক পরিণত তত্ত্বগত উপলব্ধি গড়ে উঠেছিল। এমনই পদ্ধতির বিকাশ ঘটিয়েছিলেন মার্কস ও এঙ্গেলস। আর এই ধরনের ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গীই আমাদের এই বিশ্বের সমস্ত কিছুকে বিকাশের একটি প্রক্রিয়া রূপে উপলব্ধি করতে এবং ঐ প্রক্রিয়ার গতিসূত্রগুলোকে অনুধাবন করতে সক্ষম করে তোলে।

মার্কস ও এঙ্গেলসের তাত্ত্বিক সক্রিয়তা শুরু হয়েছিল ছাত্রজীবনে দর্শনশাস্ত্র থেকে; লেনিন প্রথম অধ্যায়ে মার্কসীয় দর্শনের বিকাশকে ব্যাখ্যা করেছেন।

অষ্টাদশ শতাব্দীর বস্তুবাদের (যা বিশেষত ফ্রান্সে অত্যন্ত উন্নত স্তরে পৌঁছেছিল) সাথে জার্মান চিরায়ত দর্শনের (বিশেষত হেগেলের দ্বন্দ্বতত্ত্ব ও ফয়েরবাখের বস্তুবাদ) একাত্মকরণের মধ্যে দিয়ে উদ্ভূত হয় শ্রমিকশ্রেণীর দর্শন, তার বিশ্ববীক্ষা : দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।

বস্তুবাদ কী? বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে দর্শনের ক্ষেত্রে সবথেকে বুনিয়াদী যে বিতর্কটি দেখা গেছে তা হল : বস্তু ও ভাব-এর মধ্যে (অন্যভাবে বললে, প্রকৃতি ও চেতনা বা অস্তিত্ব ও চিন্তনের মধ্যে) কোনটি আগে এবং কোনটি তার থেকে উদ্ভূত? যে সমস্ত দার্শনিক মনে করেন যে ভাব (বা চেতনা, আত্মা, চিন্তনধারা) আগে এবং মূলত সেটাই বস্তুকে (অথবা বাস্তবতা, প্রকৃতি, অস্তিত্বকে) নির্ধারণ করে তাঁরা ভাববাদী বলে পরিচিত, আর যাঁরা এর ঠিক বিপরীত মতটি ধারণ করেন তাঁদের বলা হয় বস্তুবাদী। বস্তুবাদীরা যা বিশ্বাস করেন লেনিনের কথায় তা, “বিশ্ব হল আমাদের চেতনার দ্বারা প্রতিফলিত বাস্তব জগতের গতিময়তা।”

বস্তুবাদ আবার আধিবিদ্যক অথবা দ্বন্দ্বমূলক হতে পারে। আধিবিদ্যক বস্তুবাদ কোনো বস্তুকে অপর বস্তুর থেকে বিচ্ছিন্নভাবে এবং স্থিতিশীল বা অপরিবর্তনীয় রূপে দেখে। তা পরিবর্তনকে দেখে শুধুই স্থানের পরিবর্তন বা পরিমাণের বৃদ্ধি/হ্রাস-এর দিক থেকে। এর বিপরীতে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বস্তুসমূহকে দেখে থাকে তাদের পারস্পরিক আন্তসম্পর্ক এবং নিরন্তর গতিময়তার নিরিখে।

গতি বলতে কী বোঝায়? তা হল বস্তুর অস্তিত্বের ধরন। একটা চলন্ত বাস গতিময়, একইভাবে আমাদের চিন্তাশীল মগজ এবং চারপাশের সমাজও গতিময়। গতির বিভিন্ন রূপ রয়েছে এবং প্রতিটি গতির ক্ষেত্রেই রয়েছে একটা দ্বন্দ্ব। শুধুমাত্র স্থান পরিবর্তন বা যান্ত্রিক গতি হল একটা রূপ, যার মধ্যে নিহিত রয়েছে কোনো বস্তুর নির্দিষ্ট কোনো মুহূর্তে একই স্থানে এবং ভিন্ন স্থানে থাকা, একই স্থানে থাকা এবং না থাকার দ্বন্দ্ব। গতির আর একটা রূপ হল জৈব-জীবন। আপনি নিজের কথাই ভাবুন। প্রতিটি মুহূর্তে আপনার দেহে কিছু পুরনো কোষ মরে যাচ্ছে এবং নতুন কোষের জন্ম হচ্ছে – কাজেই সেই নির্দিষ্ট মুহূর্তে আপনি সেই একই মানুষ আবার তা নন। অন্যভাবে বললে, নবীকরণের এক নিরন্তর ধারা চলছে। একই কথা প্রযোজ্য আপনার চিন্তন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও। এই বইটা যখন আপনি পড়ছেন আপনার দেহ তুলনামূলকভাবে স্থির রয়েছে, কিন্তু আপনি কিছু নতুন ধারণা লাভ করছেন এবং পুরনো কিছু ধারণাকে বর্জন করছেন। বইটা পড়া যখন শেষ হবে তখন আপনি অংশত সেই একই মানুষ থাকবেন আবার হবেন অংশত নতুন মানুষ। দৈহিক এবং মানসিক উভয় জগতেই দ্বন্দ্ব বা পুরনো ও নতুনের মধ্যে সংগ্রাম প্রক্রিয়াটাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। দ্বন্দ্বতত্ত্বের উদ্দেশ্য হল এই সমস্ত দ্বন্দ্ব বা গতি বা আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, সেগুলোর সূত্রগুলোকে অধ্যয়ন করা যা পৃথিবীর সমস্ত কিছুর মধ্যে, প্রতিটি প্রক্রিয়ার মধ্যে পরিব্যাপ্ত রয়েছে।

এঙ্গেলস বলেছেন, “প্রকৃতিতে অগণিত ও জটিল পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সেই সমস্ত দ্বান্দ্বিক গতিসূত্রই আত্মপ্রকাশ করে যেগুলো ইতিহাসে ঘটনাবলীর আপাত আকস্মিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করে; সেগুলোই আবার মানব চিন্তাধারার বিকাশের ইতিহাসের পরম্পরাকে গ্রথিত করে এবং ধাপে ধাপে চিন্তাশীল মানুষের চেতনায় উন্নীত হয়। ...” (মার্কস ও এঙ্গেলস, সংগৃহীত রচনাবলী, খণ্ড ২৫, পৃষ্ঠা ১৩১)

তিনি আরও বলেছেন, দ্বন্দ্বতত্ত্ব হল “গতি এবং প্রকৃতি, মানবসমাজ ও চিন্তাধারার বিকাশের সাধারণ সূত্রগুলোর বিজ্ঞান।”  এই সূত্রগুলোর মধ্যে তিনটি হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ :

“পরিমাণ থেকে গুণ-এ রূপান্তরের (এবং তার বিপরীত) সূত্র;

বিপরীতগুলোর পরস্পরের মধ্যে আত্মপ্রবেশের সূত্র;

নেতির নেতিকরণের সূত্র।” (ঐ, পৃষ্ঠা ৩৫৬)

প্রথম সূত্রটি কিভাবে রূপান্তরণ বা গুণগত পরিবর্তন ঘটে তার ব্যাখ্যা করে। ধীর, ক্রমন্বয়ী, পরিমাণগত পরিবর্তন সঞ্চিত হতে থাকে এবং নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার নির্দিষ্ট অবস্থায় পৌঁছে তা সহসাই গুণগত পরিবর্তন লাভ করে। উদাহরণস্বরূপ, “জল … বায়ু মণ্ডলের স্বাভাবিক চাপে শূন্য ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় তরল থেকে ঘন অবস্থায় পরিবর্তিত হয়, এবং ১০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় তরল থেকে বাষ্পীয় অবস্থায় পরিবর্তিত হয়।” এইভাবে “তাপমাত্রার নিছক পরিমাণগত পরিবর্তন জলের অবস্থায় গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসে” (ঐ, পৃষ্ঠা ১১৭)

উপরের দৃষ্টান্তটি একজন মানুষের ক্ষেত্রে বিচার করলে দেখা যাবে, তার দেহের ধীর, অতি সূক্ষ্ম পরিমাণগত পরিবর্তনগুলোর বিকাশ তাকে শৈশব থেকে কৈশোর ও তা থেকে যৌবনে এবং আরও পরিণত অবস্থায় নিয়ে যায়। মানসিক বা বৌদ্ধিক স্তরের ক্ষেত্রেও দেখা যাবে, পার্টি কার্যকলাপে আরও বেশি করে যুক্ত হওয়ার ফলে আপনি পার্টি দরদি থেকে সদস্য এবং তা থেকে সংগঠকের মতো নানা গুণগত পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছেন। পরিমাণগত পরিবর্তন এইভাবে গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসে। সামগ্রিকভাবে সমাজেও শোষক ও শোষিত শ্রেণীগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব বা সংঘাত সমাজকে বিবর্তনের (ধীর পরিবর্তন) মধ্যে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলে, ঐ বিবর্তন ক্রমান্বয়ে সঞ্চিত হতে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট স্তরে বিপ্লবী রূপান্তরণ ঘটায়।

দ্বিতীয় সূত্রটি সম্পর্কে লেনিন বলেছেন, “একটি একক সমগ্রের বিভাজন এবং তার পরস্পর বিরোধী অংশগুলো সম্পর্কে অবগত হওয়াই … হল দ্বন্দ্বতত্ত্বের সারাৎসার।” (লেনিন, সংগৃহীত রচনাবলী, খণ্ড ৩৮, পৃষ্ঠা ৩৫৭)। আপনার চারপাশের সমাজকে বিভাজিত করুন। আপনি শোষক ও শোষিতদের দেখতে পাবেন। পরস্পর বিরোধী এই অংশ দুটি সম্পর্কে আপনি অবশ্যই একটা দ্বন্দ্বমূলক উপলব্ধি লাভ করবেন। লেনিনকে আবার উদ্ধৃতি করা যাক, “দ্বন্দ্বতত্ত্ব হল সেই শিক্ষা যা দেখায় কিভাবে বিপরীতগুলো হতে পারে এবং হয়েও ওঠে অভিন্ন, – কোন পরিস্থিতিতে তারা অভিন্ন অর্থাৎ একে অপরে রূপান্তরিত হয় – কেন এই বিপরীতগুলোকে মৃত, অ-পরিবর্তনযোগ্য হওয়ার বদলে জীবন্ত, শর্তসাপেক্ষ, গতিশীল বলে, একে অপরে রূপান্তরিত বলে, মানব মনকে আয়ত্ত করতে হবে”। (ঐ, পৃষ্ঠা ১০৯)

“বিপরীতের ঐক্য (সমাপতন, অভেদ, সমক্রিয়া) হল শর্তসাপেক্ষ, সাময়িক, ক্ষণস্থায়ী ঐক্য। পরস্পর ব্যতিরেকী বিপরীতগুলোর সংগ্রাম অনাপেক্ষিক, ঠিক যেমন বিকাশ ও গতি অনাপেক্ষিক।” (ঐ, পৃষ্ঠা ৩৫৮)

এখানে আমরা যা আলোচনা করছি তা হল পরস্পর বিপরীত দিকগুলোর ঐক্য ও সংগ্রাম। প্রতিটি প্রক্রিয়ায় পরস্পর বিরোধী দিকগুলো একে অপরকে দূরে রাখে এবং তার সাথে সংগ্রাম করে – এটা একটা নিরঙ্কুশ নিয়ম। তারা কিন্তু আবার একই প্রক্রিয়ার মধ্যে সহাবস্থান করে, একে অপরের অস্তিত্বের শর্ত হয় (যথা, পুঁজি ও মজুরি শ্রমিক) – এই দিক থেকে তারা ঐক্যবদ্ধ বা অভিন্ন। অন্য একটা দিক থেকেও তারা অভিন্ন হয়। নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে প্রত্যেকটি বস্তুই নিজেকে তার বিপরীতে রূপান্তরিত করে – উদাহরণস্বরূপ, শাসক ও শাসিত, এবং তার বিপরীতটা – এটা হল বিপরীতগুলোর পরস্পরের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হওয়া বা রূপান্তর ঘটা।

তৃতীয় সূত্রটি প্রকৃতি, সমাজ ও চিন্তার বিকাশের আর একটি দিকের ওপর আলোকপাত করে। শ্রেণীভিত্তিক সমাজের আবির্ভাবের ফলে আদিম সাম্যবাদী সমাজ বা শ্রেণীহীন সমাজের নেতিকরণ ঘটে – এটা হল প্রথম নেতিকরণ। সাম্যবাদের উত্থানের মধ্যে দিয়ে শ্রেণীভিত্তিক সমাজের বিলোপ ঘটে – যেটা আদিম, পশ্চাদপদ, প্রস্তর-যুগীয় ধরনের সাম্যবাদ নয়, বরং যা শ্রেণীভিত্তিক সমাজের বস্তুগত এবং বৌদ্ধিক-সাংস্কৃতিক অগ্রগতিগুলোর ভিত্তির ওপর বা সেগুলোকে সমন্বিত করে নির্মিত – এটা হল দ্বিতীয় নেতিকরণ, বা নেতির নেতিকরণ।

এঙ্গেলস বলছেন, “দ্বন্দ্বতত্ত্বে নেতিকরণ বলতে নিছক না বলা বা কোনো কিছু বিদ্যমান নয় ঘোষণা করা বা সেটাকে নিজের খুশিমতো ধ্বংস করা বোঝায় না। … আমাকে শুধু নেতিকরণ করলেই হবে না, নতুন কিছু দিয়ে ঐ নেতিকরণকে প্রতিস্থাপিত করতে হবে। অতএব প্রথম নেতিকরণটিকে এমনভাবে করতে হবে যাতে দ্বিতীয়টি থাকতে পারে বা সম্ভবপর হতে পারে। কিভাবে? সেটা নির্ভর করে প্রতিটি স্বতন্ত্র বিষয়ের সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ওপর।” (মার্কস ও এঙ্গেলস সংগৃহীত রচনাবলী, খণ্ড ২৫, পৃষ্ঠা ১৩১)। আমরা যে উদাহরণটি নিয়ে আলোচনা করছিলাম সেটিকে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে বলা যায়, শ্রেণীভিত্তিক সমাজকে বোমা দিয়ে বিলুপ্ত করা যায় – যে ব্যাপক পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র মজুত করা হয়েছে তা দিয়ে এটা সম্ভবপর – যেখানে “নেতিকরণটি প্রতিস্থাপিত করা” সম্ভব হয় না, যেখানে নেতিকরণটি দ্বন্দ্বমূলক নয়। এঙ্গেলস তাঁর আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বলেছেন, “প্রতিটি প্রকারের বস্তুর নেতিকরণ হওয়ার এমন নিজস্ব পন্থা আছে যাতে তা একটি বিকাশের জন্ম দেয়, এবং প্রতিটি ধরনের ভাবনা বা ধারণার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই রকম ...। অন্যান্য সবকিছুর মতো এটাও একটা শেখার বিষয়।” নৈরাজ্যবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলরা যেখানে “স্বর্ণালী অতীতে” ফিরে যেতে চায়, তার বিপরীতে আমরা – যারা দ্বন্দ্বত্ত্বের অনুশীলন করে থাকি – শুধু পুঁজিবাদ/সাম্রাজ্যবাদ/বিশ্বায়ন “নিপাত যাক” বলে থেমে যাই না, বরং এমনভাবে তাদের নেতিকরণের জন্য কাজ করি যাতে পরবর্তী উচ্চতর সমাজে তাদের সমস্ত ইতিবাচক অবদানগুলোকে বজায় রাখা যায়।

দ্বন্দ্বতত্ত্বের তিনটি সূত্র থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, কিভাবে মূলত অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বগুলোর কারণে বিশ্বের সমস্তকিছুর মধ্যেই বিবর্তনমূলক এবং বিপ্লবী (উল্লম্ফনের মধ্যে দিয়ে) উভয় পরিবর্তনই নিরন্তর ঘটে চলে। এছাড়া, আন্তঃসম্পর্কিত অন্যান্য বিষয়ও, উদারহণস্বরূপ ব্যাহ্যিক পরিস্থিতি, ঐ প্রক্রিয়াকে যথেষ্ট মাত্রায় প্রভাবিত করে। যথা, ভারতীয় বিপ্লবের অগ্রগতি মূলত নির্ধারিত হয় সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সহ অভ্যন্তরীণ শ্রেণীসংগ্রামের দ্বারা, তবে অনুকূল বা প্রতিকূল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক বা প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলে, গোটা বিশ্ব সমগ্রতায় অখণ্ড, যেখানে বস্তু ও বিষয়গুলো আন্তঃসম্পর্কিত ও পারস্পরিকভাবে শর্তসাপেক্ষ।

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ থেকে আমরা জ্ঞানের একমাত্র বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব পাই যেটা ছাড়া আমরা আমাদের আরাধ্য বিপ্লবী কাজকে সফল করে তুলতে পারি না। অনুশীলন সম্পর্কে রচনায় মাও যেমন দেখিয়েছেন (যে রচনাটি এবং তার সঙ্গে দ্বন্দ্ব সম্পর্কে রচনাটি সমস্ত বিপ্লবী কর্মীর “অবশ্য পাঠ্য”) :

“অভিজ্ঞতা থেকেই জ্ঞানের সূচনা – এটাই হল জ্ঞানতত্ত্বের বস্তুবাদ। … জ্ঞানকে গভীরতর করা দরকার … জ্ঞানের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য স্তরকে ধারণাত্মক স্তরে উন্নীত করতে হবে – এটাই হল জ্ঞা‌নতত্ত্বের দ্বন্দ্ববাদ।” অত্যধিক পড়ুয়ারা যেখানে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য দিকটিকে অবহেলা করেন, অভিজ্ঞতাবাদীরা সেখানে ধারণাত্মক স্তরে উন্নীত করার কাজটি অবহেলা করেন, কেননা তাঁরা লেনিনের এই শিক্ষাটিকে আয়ত্ত করতে পারেন না যে, “চিন্তা মূর্ত থেকে এগিয়ে বিমূর্তর স্তরে গেলে – অবশ্য যদি সঠিক হয় – তা সত্য থেকে দূরে সরে যায় না বরং তার আরও কাছাকাছি আসে। বস্তু, প্রাকৃতিক সূত্র, মূল্য – এই সমস্ত বিমূর্তকরণ, সংক্ষেপে বলতে গেলে সমস্ত বিজ্ঞানসম্মত (সঠিক, গুরুত্বপূর্ণ, অবাস্তব নয়) বিমূর্তকরণ প্রকৃতিকে আরও গভীরভাবে, যথার্থভাবে ও সম্পূর্ণরূপে প্রতিফলিত করে। জীবন্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ধারণা থেকে বিমূর্ত চিন্তায়, এবং এর থেকে অনুশীলনে, – এরকমই হল সত্য সম্পর্কে, বাস্তব জগৎ সম্পর্কে ধারণা গড়ে তোলার দ্বান্দ্বিক পথ।” (লেনিন, সংগৃহীত রচনাবলী, খণ্ড ৩৮, পৃষ্ঠা ১৭১)

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এবং তার জ্ঞানতত্ত্ব সম্পর্কে এই হল আমাদের কথা। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ গড়ে তুলেই মার্কস-এঙ্গেলস থামলেন না। কয়েক হাজার বছর ধরে মানব সমাজের বিকাশধারাকে বুঝতে তাকে প্রয়োগ করলেন। এল ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা, যাকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদও বলা হয়। মানব ইতিহাসের কার্যকারণ সূত্রগুলো এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। কেন ও কীভাবে মানবসমাজ আদিম সাম্যবাদ বা শ্রেণীহীন সমাজ থেকে দাসপ্রথা ও সামন্ততন্ত্র পেরিয়ে ধনতন্ত্রে এসে পৌঁছেছে, তার একটা পরিষ্কার ব্যাখ্যা পাওয়া গেল (নীচে দেওয়া মুখবন্ধের প্রাককথন-এর অংশবিশেষ দেখুন)। মানবসমাজের বুনিয়াদী গতিসুত্রগুলো আয়ত্ত হওয়ায় সেগুলোকে সচেতনভাবে কাজে লাগিয়ে সমাজের পরবর্তী উচ্চতর ধাপের দিকে – সমাজতন্ত্রের দিকে – দ্বিধাহীন অগ্রগতির পথ খুলে গেল।

দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সামাজিক বিকাশের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করল। তা দেখাল, মানুষের উপলব্ধি ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞান যেমন প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে, তেমনই সামাজিক ধারণা ও মতবাদ (যেমন, দার্শনিক ব্যাখ্যা, রাজনৈতিক মতবাদ, ধর্মীয় বিশ্বাস) সেই সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা কাঠামোকে প্রতিফলিত করে। উদাহরণস্বরূপ, অধিকাংশ ধর্ম শেখায় যে ঈশ্বর কাউকে ধনী, কাউকে গরিব করেছেন; গরিবরা যদি ধনীদের সম্পত্তি ছিনিয়ে নিয়ে চলতি ব্যবস্থাটার আমূল পরিবর্তন করতে যায় তবে তারা ঈশ্বরের বিরুদ্ধাচারণ করবে অর্থাৎ পাপ করবে। ধর্মের এই উপদেশ আসলে শ্রেণীবিভক্ত সমাজের বাস্তব পরিস্থিতি থেকেই উঠে আসে এবং ধনীদের স্বার্থই চরিতার্থ করে; আর তাই এই উপদেশগুলোর মূল বিষয়টা (ব্যক্তিগত সম্পত্তির অলঙ্ঘনীয় অধিকার) আধুনিক 'ধর্মনিরপেক্ষ' সংবিধানেও সুরক্ষিত হয়।

দর্শনের অধ্যয়ন মার্কসকে যখন বলে দিল যে সামাজিক জীবনে অর্থনীতিই হল মূল বিষয়, তখন তিনি ঐ বিষয়ের ওপরই তাঁর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করলেন। কেননা, তিনি গগনবিহারী ভাবনাবিলাসী 'দার্শনিক' ছিলেন না। “দার্শনিকেরা তো কতভাবেই দুনিয়াটাকে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু আসল কথটা হল তাকে পাল্টে দেওয়া” – মাত্র ২৭ বছর বয়সে একথা বলে তিনি দর্শনের জগতে এক নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছিলেন এবং নিজের জীবনপথ ঠিক করে নিয়েছিলেন। তিনি যখন বুঝলেন অর্থনৈতিক ভিতের গুণগত পরিবর্তন ছাড়া এই নিপীড়নমূলক, অন্যায় রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনসাধন করা যাবে না, তখন দার্শনিক মার্কস হয়ে উঠলেন আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার গবেষক। ২০ বছরের অক্লান্ত মেহনতের প্রধান ফসল হয়ে দেখা দিল পুঁজিগ্রন্থ, যা হল বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক বিধ্বংসী আক্রমণ।

টাকা বাড়ে কীভাবে, অথবা মুনাফা সৃষ্টি হয় কীভাবে? অন্যভাবে বললে, অর্থ কীভাবে পুঁজিতে রূপান্তরিত হয় – যে পুঁজি আসলে ঐতিহাসিকভাবে উদ্ভূত   এক উৎপাদন সম্পর্ক? এর উত্তর রয়েছে উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বে, যা হল মার্কসবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্বের বুনিয়াদ। কিন্তু এই বিষয়ে আলোচনার আগে কয়েকটি প্রাথমিক ধারণার সঙ্গে পরিচিত হওয়া দরকার।

পণ্য : বিনিময় অর্থাৎ বিক্রয়ের জন্য যা কিছুই মানুষের শ্রমের দ্বারা উৎপাদিত হয় তাই হল পণ্য। এই সংজ্ঞা অনুসারে যে ধান ভোগের জন্য উৎপাদিত হয় (তা সে দরিদ্র কৃষক বা জমিদার যেই উৎপাদন করুন না কেন) তা পণ্য নয়। একইভাবে, বনে উৎপন্ন ফলও পণ্য নয়, কারণ তা মানুষের শ্রমের ফসল নয়।

মূল্য : ব্যবহারিক মূল্য ও বিনিময় মূল্যের মধ্যে আমাদের পার্থক্য করতে হবে। ব্যবহারিক মূল্য বলতে বোঝায় কোনও নির্দিষ্ট বস্তুর মধ্যে নিহিত ব্যবহারিক উপযোগিতা (মানুষের চাহিদা মেটানোর সামর্থ্য)। বিনিময় মূল্য হল বস্তুর বিনিময়-যোগ্যতা, অর্থাৎ যে হারে তাকে অন্য বস্তুর সঙ্গে বিনিময় করা যাবে। বাতাস ও সূর্যালোকের অপরিসীম ব্যবহারিক মূল্য রয়েছে, কিন্তু তাদের কোনও বিনিময় মূল্য নেই। অর্থশাস্ত্রে আমরা সাধারণত বিনিময় মূল্য নিয়েই চর্চা করি এবং তাকে শুধুই মূল্য বলি, যা নির্দিষ্ট মুদ্রার মাধ্যমে প্রকাশিত হয় (টাকা, ডলার ইত্যাদি)।

মূল্যের শ্রম-তত্ত্ব : যে কোনও বস্তুর উৎপাদনের জন্য (কৃষি, শিল্প বা অন্য   যা কিছুই হোক না কেন) প্রয়োজন নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের এবং সেটা নির্ভর করে একটি নির্দিষ্ট সমাজে লভ্য যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, দক্ষতা ইত্যাদির গুণমানের ওপর।  একে বলা হয় “সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম সময়”। সংশ্লিষ্ট দেশে প্রতিটি পণ্যের জন্য এর গড় পরিমাণ (অর্থাৎ কত ঘণ্টা বা শ্রম-দিবস) জানা থাকে। কাজেই, এর ভিত্তিতে প্রতিটি পণ্যের মূল্য (বিনিময় মূল্য) কত হবে সেটা সকলেই জানে এবং মেনে নেয়। যদি আমরা বলি একজোড়া জুতোর মূল্য চার মিটার কাপড়ের মূল্যের সমান, আমরা বোঝাই যে উভয় ক্ষেত্রেই সম পরিমাণ সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম ব্যয় করা হয়েছে (সেটা ধরা যাক একজন শ্রমিকের ১৬ ঘণ্টা বা দুটি শ্রমদিবস)। এই বিষয়টাকে আমরা মুদ্রার মাধ্যমেও প্রাকশ করতে পারি (বাস্তব জীবনে আমরা যেমন করে থাকি) যদি আমরা বলি একজোড়া জুতোর মূল্য (ধরা যাক) ৮০ টাকা, আর চার মিটার কাপড়ের মূল্যও তাই।

উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব

স্মিথ ও রিকার্ডোর মতো বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা এই পর্যন্ত এগিয়েছিলেন, মার্কস এগিয়ে গেলেন আরও অনেক দূর।

প্রথমত, তিনি দেখালেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় শ্রমশক্তি (মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা) অন্য যে কোনও পণ্যের মতোই একটি পণ্য। আগে ক্রীতদাস ও ভূমিদাসরা নিজেদের ইচ্ছেমতো শ্রমশক্তি বিক্রি করতে পারতেন না, কিন্তু আজ মজুরি শ্রমিকরা পুঁজিপতিদের কাছে এটা স্বাধীনভাবে বিক্রি করতে পারেন। পুঁজিপতিরা চুক্তিবদ্ধ দামে এটা কেনে, ব্যবহার করে এবং উৎপাদনে কাজে লাগায়। শ্রমশক্তিকে ব্যবহার করার এই প্রক্রিয়া হল শ্রমশক্তির প্রয়োগ, আর শ্রমই মূল্যের সৃষ্টি করে। শ্রমশক্তি নামক পণ্যের এটাই হল সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য। এটা কীভাবে ঘটে, সে সম্পর্কে লেনিনের কাছ থেকে শোনা যাক : “মুদ্রার মালিক শ্রমশক্তিকে কেনে তার মূল্য দিয়ে, অন্যান্য পণ্যের মূল্যের মতোই এ মূল্য নির্ধারিত হয় তার উৎপাদনের জন্য সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রমসময় দিয়ে (অর্থাৎ সপরিবারে শ্রমিকের ভরণপোষণের খরচপরিবারের ভরণপোষণকে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এবং পুঁজিপতি শ্রেণী তার খরচ বহন করতে রাজি থাকে, কেননা এটা না দিলে বর্তমান প্রজন্মের শ্রমিকদের পর শ্রমশক্তির সরবরাহ অার থাকবে না।)। শ্রমশক্তি ক্রয়ের পর মুদ্রার মালিক তা ভোগ করার, অর্থাৎ সারাদিনের জন্য, ধরা যাক, বারো ঘণ্টার জন্য তাকে খাটাবার অধিকার অর্জন করে। অথচ নিজের ভরণপোষণের খরচা তোলার মতো সামগ্রী শ্রমিক তৈরি করে ছয় ঘণ্টার মধ্যেই (“প্রয়োজনীয় শ্রমসময়”) এবং বাকি ছয় ঘণ্টায় (“উদ্বৃত্ত” শ্রমসময়) সে তৈরি করে “উদ্বৃত্ত” সামগ্রী অথবা উদ্বৃত্ত মূল্য, যার জন্য পুঁজিপতি কোনও দাম দেয় না। অতএব উৎপাদন প্রক্রিয়ার দিক থেকে দেখলে পুঁজিকে দুভাগে ভাগ করে দেখতে হবে : স্থির পুঁজি, যা ব্যয় হচ্ছে উৎপাদনের উপকরণসমূহের পেছনে (যন্ত্রপাতি, শ্রমের হাতিয়ার, কাঁচামাল ইত্যাদি) – এ পুঁজির মূল্যে কোনও বদল না হয়ে তা সম্পূর্ণরূপে (একইসঙ্গে অথবা ভাগে ভাগে) উৎপন্ন সামগ্রীর মধ্যে এসে জমা হয়; এবং পরিবর্তনশীল পুঁজি, যা ব্যয় হয় শ্রমশক্তির জন্য। শেষোক্ত পুঁজির মূল্য অপরিবর্তনীয় থাকে না, শ্রমপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে তা বাড়ে এবং সৃষ্টি করে উদ্বৃত্ত মূল্য। সুতরাং, পুঁজি কর্তৃক শ্রমশক্তি শোষণের মাত্রা প্রকাশ করতে হলে উদ্বৃত্ত মূল্যের সঙ্গে পুরো পুঁজির তুলনা না করে তুলনা করতে হবে কেবল পরিবর্তনশীল পুঁজির। এ হিসাবে, পূর্বোক্ত উদাহরণে এই অনুপাত – মার্কস যার নাম দিয়েছেন উদ্বৃত্ত মূল্যের হার – হবে ৬ : ৬, অর্থাৎ শতকরা ১০০ ভাগ।” (কার্ল মার্কস, লেনিনের সংগৃহীত রচনাবলী, খণ্ড – ২১, পৃঃ ৬২)

অত্যন্ত সরল একটা উদাহরণের সাহায্যে এটাকে বোঝার চেষ্টা করা যাক।

ধরা যাক, একজন শ্রমিক ও তার পরিবারের সদস্যরা জীবনধারণের জন্য প্রতিমাসে যে সমস্ত সামগ্রী ব্যবহার করে (খাবার, জামাকাপড়, বাড়িভাড়া ইত্যাদি) সেগুলোর উৎপাদনের জন্য দরকার হয় ২৪০ ঘণ্টা শ্রমসময় বা ১২০০ টাকা। তাহলে শ্রমশক্তি, অর্থাৎ মজুরির মূল্য হল মাসে ১২০০ টাকা বা প্রতিদিন ৪০ টাকা। “জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী” যা অবশ্য অত্যন্ত আপেক্ষিক ব্যাপার, দেশ ও সময়ের বিচারে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু দেখা গেল একটি নির্দিষ্ট দেশে ও সময়ে ঐ সামাজিক গড় প্রতিমাসে ১২০০ টাকা মূল্যের জিনিসপত্র ও পরিষেবা। চাহিদার তুলনায় শ্রমশক্তির যোগান অনেক বেশি থাকলে মালিক চাপ দিয়ে এটাকে কিছুটা কমিয়ে আনতে পারে, অথবা বিপরীত পরিস্থিতিতে বা যৌথ দরকষাকষির মাধ্যমে শ্রমিকরা এটাকে কিছুটা বাড়িয়ে নিতে পারে। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে ও স্থানে এটা ১২০০ টাকার আশেপাশে ঘোরাফেরা করবে।

প্লাস্টিকের ডটপেন (রিফিল ছাড়া) তৈরি করে এমন একটা ছোট কারখানার কথা ধরা যাক। কারখানাটিতে একাধিক মেশিন ও শ্রমিক রয়েছে, আমরা একটি মেশিন ও একজন শ্রমিকের ওপরই মনোনিবেশ করব। ধরা যাক প্রতিটি পেনের মূল্য এক টাকা আর পুঁজি লেগেছে এরকম : একটি মেশিনের দাম ১০০০ টাকা এবং তার উপযোগিতা নিঃশেষিত হওয়ার আগে সেটি ১০০০০ পেন তৈরি করতে পারে। এর অর্থ হল প্রতিটি পেন উৎপাদনের জন্য মেশিনটির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হল  ১০০০ টাকা /১০০০০ = ১০ পয়সা। প্রতিটি পেন তৈরির জন্য ঐ মেশিনে যে বিদ্যুৎ লাগে তার মূল্য ৫ পয়সা আর প্রতিটি পেনের জন্য যে মূল কাঁচামাল, অর্থাৎ প্লাস্টিক লাগে তার মূল্য ৪৫ পয়সা। এই তিনটি যোগ করে দাঁড়ায় ৬০ পয়সা (মেশিনের ক্ষয়ক্ষতি ১০ পয়সা + বিদ্যুৎ ৫ পয়সা + প্লাস্টিক ৪৫ পয়সা), যা হল প্রতিটি পেনের জন্য ব্যয়িত “স্থির পুঁজি”। পেনের মূল্যের বাকি ৪০ পয়সা  (১ টাকা – ৬০ পয়সা) আসে নিয়োজিত শ্রম থেকে (এছাড়া আর কিবা হতে পারে ?)। গোটা বিষয়টার এই অংশটাকে একটু মন দিয়ে ভাবা যাক।

ধরা যাক শ্রমিকটি দৈনিক ৪০ টাকা মজুরিতে ৮ ঘণ্টা খাটেন এবং প্রতি ঘণ্টায় ২৫টি পেন তৈরি করেন। তাহলে ৪ ঘণ্টায় তিনি তৈরি করেন ২৫ x ৪ = ১০০টি পেন। ওপরে আমরা দেখেছি, পুঁজিপতিকে তিনি প্রতিটি পেনের জন্য ৪০ পয়সার নতুন মূল্য দেন, কাজেই এই চার ঘণ্টায় তিনি ঐ নতুন মূল্য দেন ৪০ টাকা (৪০ পয়সা x ১০০), যেটা তাঁর প্রাপ্ত মজুরির সমান। এইভাবে তিনি ৪ ঘণ্টা খাটেন যথার্থ, বা তথাকথিত 'ন্যায্য' মজুরির বিনিময়ে, যেটা হল তিনি যে মূল্য সৃষ্টি করেন তার সমান। এর পরেও তিনি অতিরিক্ত ৪ ঘণ্টা খাটছেন যার জন্য তিনি কোনও অতিরিক্ত পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না – এর মধ্যে দিয়ে তিনি সৃষ্টি করছেন আরও ৪০ টাকার মূল্য, আর এটাই হল উদ্বৃত্ত মূল্য। পুরো ব্যাপারটাকে লেনিন দেখিয়েছেন এইভাবে : “শ্রম-দিনের এক অংশ তিনি খাটেন তাঁর সপরিবার ভরণপোষণের খরচা তোলার জন্য (মজুরি), বাকি অংশটা তিনি খাটেন বিনা মজুরিতে এবং পুঁজিপতির জন্য সৃষ্টি করেন উদ্বৃত্ত মূল্য যা পুঁজিপতি শ্রেণীর মুনাফা ও সম্পদের উৎস”।  (তিনটি উৎস, তিনটি অঙ্গ)

আমরা যে উদারহণ দিয়েছি তাতে ২০০টি পেন উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে ৪০ টাকার উদ্বৃত্ত মূল্য, অর্থাৎ পেন প্রতি ২০ পয়সা (৪০ টাকা /২০০)। একটি পেনের মোট মূল্যের অতএব তিনটি অঙ্গ রয়েছে : প্লাস্টিক, বিদ্যুৎ, মেশিন-ক্ষয় মিলিয়ে ৬০ পয়সা (স্থির পুঁজি, c) + মজুরি ২০ পয়সা (পরিবর্তনশীল পুঁজি, v) + উদ্বৃত্ত মূল্য ২০ পয়সা (s) = ১ টাকা।

প্লাস্টিক ইত্যাদির জন্য বিনিয়োগকৃত ৬০ পয়সাকে বলে স্থির পুঁজি, কারণ এদের মূল্য উৎপাদন প্রক্রিয়া চলাকালীন স্থির থাকে। অপরদিকে, শ্রমশক্তির জন্য  যে পুঁজি ব্যয় হয় তাকে বলে পরিবর্তনশীল পুঁজি, কারণ উৎপাদন চলাকালে এটা  বেড়ে যায়। আমরা যে উদাহরণ দিয়েছি তাতে প্রতি ২০ পয়সার v সৃষ্টি করে ২০ পয়সার s, সেটা পুঁজিপতি মুনাফা হিসাবে পকেটস্থ করে।

এটাকে আমরা মার্কসীয় সূত্র অনুযায়ী এভাবে সাজাতে পারি : একটি পেনের মূল্য = c (৬০ পয়সা) + v (২০ পয়সা) + s (২০ পয়সা) = ১ টাকা।

এখানে পুঁজিপতি ২০ পয়সা v পরিবর্তনশীল পুঁজি বিনিয়োগ করে ২০ পয়সা s উদ্বৃত্ত মূল্য পাচ্ছে , সুতরাং উদ্বৃত্ত মূল্যের হার ১০০ শতাংশ।

পাঠকরা যেন মনে রাখেন যে এটা এক অত্যন্ত সরলীকৃত উদারহণ, যা লেনিনের কার্ল মার্কস এবং মার্কসের পুঁজি গ্রন্থ পড়ার জন্য প্রথম ধাপ হিসাবে কাজে লাগতে পারে। তবে এটা থেকে এটুকু বোঝা যাচ্ছে যে কেমন করে প্রতিটি পুঁজিপতি – এমনকি তিনি যদি যথেষ্ট প্রগতিশীল এবং মহানুভবও হন – উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণ করেন, পুরো ব্যাপারটা ঠিক কীভাবে ঘটছে সে সম্পর্কে শ্রমিক এমনকি পুঁজিপতিও সচেতন থাকেন না। এটা সম্পূর্ণ আইনসঙ্গত এবং 'স্বাভাবিক' প্রক্রিয়া রূপেই প্রতিভাত হয়। মজুরির যত বৃদ্ধিই হোক না কেন তা মূলগতভাবে এই অবস্থাটাকে পাল্টাতে পারে না আর তাই মার্কসবাদীরা মজুরি শ্রমের ব্যবস্থাটারই অবসানের জন্য সংগ্রাম করেন।

শ্রম থেকেই যে পুঁজির সৃষ্টি হয় তা প্রতিপন্ন করার পর মার্কসবাদী তত্ত্ব এগিয়ে যায় শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে বৃহদায়তন উৎপাদনের প্রসারের কথা বর্ণনায়। উদারহণস্বরূপ, আমরা দেখেছি প্রথমে ইংলন্ডে এবং পরে ভারতবর্ষেও সূতিবস্ত্র শিল্পের প্রসারের ফলে আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ তন্তুবায় সর্বস্বান্ত হয়েছে। পুঁজিবাদের জমানায় বৃহদায়তন শিল্পের প্রসার এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন শ্রমের উৎপাদনশীলতাকে বাড়িয়ে তোলে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এক হাজার তন্তুবায়  যে কাপড় উৎপাদন করতেন, সুতাকলের এক হাজার শ্রমিক তার চেয়ে অনেক বেশি কাপড় উৎপাদন করে থাকেন। অপরদিকে বিশাল ও ক্রমপ্রসারমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বাজার ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হাজার হাজার উৎপাদক পারস্পরিক সম্পর্কে বাঁধা পড়ে। উৎপাদন তখন আর আগের মতো ব্যক্তিগত থাকে না (কারিগর, তন্তুবায়, ক্ষুদ্র কৃষক, ইত্যাদিদের ক্ষেত্রে যেমন হত) তখন তা সম্পূর্ণ সামাজিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এই সামাজিক উৎপাদন, এই যৌথ শ্রমের ফসল আত্মসাৎ করে একেবারেই অল্পসংখ্যক পুঁজিপতিরা যারা উৎপাদনের উপকরণগুলোর মালিক। সামাজিকভাবে উৎপাদন এবং ব্যক্তিগতভাবে তার ফসল আত্মসাতের বিষয়টাই হল পুঁজিবাদের মধ্যেকার বুনিয়াদী দ্বন্দ্ব এবং এই দ্বন্দ্বের সমাধান হতে পারে একমাত্র মালিকানার এবং উৎপাদনের উপায়গুলোর সামাজিকীকরণের দ্বারা, অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে। পুঁজিবাদ নিজেই অবশ্য এই দ্বন্দ্বের সমাধানের জমি তৈরি করে। পুঁজির ওপর শ্রমিকদের নির্ভরশীলতা যত বাড়তে থাকে, ততই লাখ লাখ, কোটি কোটি শ্রমিক কারখানা স্তরে এবং শিল্পভিত্তিকভাবেও সারা দেশে ইউনিয়নগুলোতে সঙ্ঘবদ্ধ হয়। ক্রমশ তারা তাদের রাজনৈতিক দলও গঠন করে। শুরু হয় সর্বহারা বিপ্লবের যুগ।

মার্কস ও এঙ্গেলস পুঁজিবাদ সম্পর্কে তাঁদের অধ্যয়ন সম্পন্ন করে বিশ্ব সর্বহারার কাছ থেকে শেষ বিদায় নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা তার উচ্চতর স্তর সাম্রাজ্যবাদে পৌঁছায়। লেনিন পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের সর্বোচ্চ স্তর এবং পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রে ভাঙ্গন-এর মতো রচনাগুলোতে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মর্মবস্তুকে উদ্ঘাটন করেন, এবং এইভাবে তাঁর শিক্ষকদের কাজকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান। এই বিষয়ে আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে আবার ফিরে আসব।

দর্শন এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির মতো সমাজবাদী তত্ত্বের ক্ষেত্রেও মার্কস ও এঙ্গেলসের পূর্বসূরীরা ছিলেন। সেন্ট সিঁমো , ফ্যুরিয়ার ও রবার্ট ওয়েনের মতো স্বপ্নদ্রষ্টারাই সর্বপ্রথম পুঁজিবাদের সুতীব্র সমালোচনা করে সমাজতন্ত্রের মহান আদর্শকে মানুষের সামনে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু সমাজতন্ত্র কীভাবে আসবে, কোন সামাজিক শক্তি তা নিয়ে আসবে সে বিষয়ে কোনও ধারণা তাঁদের ছিল না। তাঁদের সমাজতান্ত্রিক বীক্ষা তাই ছিল 'ইউটোপীয়'।

এখান থেকে “বৈজ্ঞানিক” সমাজতন্ত্রে যে বিরাট উল্লম্ফন ঘটালেন মার্কস ও এঙ্গেলস, তা সম্ভব হয়েছিল ১৮৪৮ সাল নাগাদ যে বিপ্লবী ঝড় ফ্রান্সে তথা গোটা ইউরোপ জুড়ে বয়ে যায় তার মূল্যবান অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। চরিত্রের দিক থেকে এগুলো ছিল বুর্জোয়া বিপ্লব, কিন্তু এতে শ্রমিকশ্রেণীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। এই বিপ্লবগুলো দ্ব্যর্থহীনভাবে দেখিয়ে দিল যে, সমস্ত সামাজিক অগ্রগতির পিছনে রয়েছে শ্রেণীসংগ্রাম (অর্থাৎ, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে বুর্জোয়া ব্যবস্থায় উত্তরণ) এবং এর থেকে মার্কস ও এঙ্গেলস বের করে আনলেন বিশ্ব ইতিহাসের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা : শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব। তাঁদের আগেই বুর্জোয়া তাত্ত্বিকরা শ্রেণী ও শ্রেণীসংগ্রাম নিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন। কিন্তু মার্কস দেখালেন পুঁজিবাদী সমাজে শ্রেণীসংগ্রাম “অনিবার্যভাবে সর্বহারা একনায়কতন্ত্রে পরিণতি লাভ করে”, যেটা আবার “সমস্ত শ্রেণীর অবলুপ্তি ঘটিয়ে শ্রেণীহীন সমাজে উত্তরণের সূচনা ঘটায়”, যে কথা মার্কস ১৮৫২ সালে একটি চিঠিতে যোশেফ ভেইদেমেয়ারকে লিখেছিলেন (শেষে দেওয়া “আরও কিছু কথা” অংশের “শ্রেণী ও শ্রেণীসংগ্রাম”  অংশ এবং “রাষ্ট্র”  নামক অধ্যায় দেখুন)।

এইভাবে মার্কস সমাজতন্ত্রের পথ এবং যে শক্তিটি (সর্বহারা) ঐ লক্ষ্যকে সফল করে তুলতে পারে তাকে নির্দিষ্ট করলেন। বস্তুত সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে সর্বহারা কী নীতি ও কৌশল অবলম্বন করবে সে সম্পর্কে মার্কস ও এঙ্গেলস প্রচুর চর্চা করেছেন। এই জন্যই লেনিন “কার্ল মার্কস” শীর্ষক প্রবন্ধে “সমাজতন্ত্র” শীর্ষক অধ্যায়ের পর “সর্বহারার শ্রেণীসংগ্রামের কৌশল” সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন। সর্বহারার রণনীতি ও রণকৌশল বিকাশলাভ করেছে এবং এখনও বিকশিত হয়ে চলেছে সংস্কারবাদ ও নৈরাজ্যবাদের বিভিন্ন প্রবণতার বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এ সম্পর্কে আমরা একটু পরেই আলোচনা করব (সংস্কারবাদ ও নৈরাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শীর্ষক অধ্যায় দেখুন)।

তিনটি উৎস, তিনটি অঙ্গ প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। এই রচনার শেষ তিনটি অনুচ্ছেদ বিশেষ মনোযোগ দাবি করে, কেননা সেখানে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে রচনাটির পরিসমাপ্তি ঘটছে। লেনিন আমাদের শিখিয়েছেন, “দুনিয়াটাকে পাল্টানোর” একমাত্র রাস্তা হল শাসক শ্রেণীগুলোকে চিহ্নিত করা – যাদের স্বার্থই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ইত্যাদির পিছনে ক্রিয়াশীল থাকে, আর যারা শাসকশ্রেণীগুলোকে পরাস্ত করতে সক্ষম সেই শ্রেণীগুলোকেই খুঁজে বার করা এবং সমাবেশিত করা।

শেষ অনুচ্ছেদে লেনিন বলছেন, মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষার দ্বারা পরিচালিত হয়ে বিশ্বের সর্বহারা সেই লক্ষ্যই অবিচলভাবে এগিয়ে চলেছে। তাই শেষ হয়েও লেখাটি যেন শেষ হল না, শুরু হল এগিয়ে চলার কাহিনি। পাঠক উপলব্ধি করেন, তিনটি অঙ্গ – বোঝার সুবিধার জন্য যেগুলোকে লেনিন আলাদা আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করেছেন – আসলে একটি অখণ্ড সমগ্র এবং একাকার হয়ে ওঠার এই গতিময় প্রক্রিয়ায় মার্কসবাদের উত্তরণ ঘটে তত্ত্ব থেকে অনুশীলনে, যা আবার তত্ত্বকেই সমৃদ্ধ করে।