সভ্য দুনিয়ার সর্বত্র বুর্জোয়া বিজ্ঞানের (সরকারী এবং উদারনীতিক উভয় প্রকার) পক্ষ থেকে মার্কসের মতবাদের প্রতি চূড়ান্ত শত্রুতা ও আক্রোশ দেখা যায়। মার্কসবাদকে তারা দেখে এক ধরনের 'বিষাক্ত গোষ্ঠী' হিসাবে। অবশ্যই অন্য মনোভাব আশা করা বৃথা, কেননা শ্রেণীসংগ্রামের ওপর গড়ে ওঠা সমাজে নিরপেক্ষ সমাজবিজ্ঞানের অস্তিত্ব অসম্ভব। সব রকমের সরকারী ও উদারনীতিক বিজ্ঞানেই কোনও না কোনও ভাবে মজুরি-দাসত্বের সমর্থন করা হয়ে থাকে, আর সেই মজুরি-দাসত্বের বিরুদ্ধে ক্ষমাহীন সংগ্রাম ঘোষণা করেছে মার্কসবাদ। পুঁজির মুনাফা কমিয়ে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো উচিত কিনা – এই প্রশ্নে মিলমালিকদের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা আশা করা আর মজুরি-দাসত্বের সমাজে বিজ্ঞানের কাছ থেকে নিরপেক্ষতা আশা করা সমান বাতুলতা।

কিন্তু এইটুকুই সব নয়। 'গোষ্ঠীবাদ' বলতে যদি বোঝায় একটা আত্মবদ্ধ শিলীভূত মতবাদ, যার উদয় হয়েছে বিশ্বসভ্যতা বিকাশের রাজপথ থেকে বহুদূরে, তবে দর্শন এবং সামাজিক বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে পরিষ্কার দেখা যায় যে, মার্কসবাদের মধ্যে তেমন কোনও কিছুই নেই। বরং মার্কসের প্রতিভাটা এইখানে-ই যে, মানব সমাজের অগ্রণী ভাবনায় যে সব জিজ্ঞাসা আগেই দেখা দিয়েছিল মার্কস  তারই জবাব দিয়েছেন। তাঁর মতবাদের উদ্ভব হয়েছে দর্শন, অর্থশাস্ত্র এবং সমাজবাদের মহাচার্যেরা যে শিক্ষা দান করেছিলেন, তারই সরাসরি ও প্রত্যক্ষ ধারাবাহিকতা হিসাবে।

মার্কসের মতবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ তা সত্য। এ মতবাদ সুসম্পূর্ণ ও সুসমঞ্জস্য; এর কাছ থেকে যে সামগ্রিক বিশ্বদৃষ্টি লাভ করা যায় সেটা কােনো রকম কুসংস্কার, প্রতিক্রিয়া অথবা বুর্জোয়া জোয়ালের কোনওরূপ সমর্থনের সঙ্গে আপস করে না। ঊনিশ শতকের জার্মান দর্শন, ইংল্যান্ডের অর্থশাস্ত্র এবং ফরাসি সমাজবাদ রূপে মানবজাতির যা শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তার ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী হল মার্কসবাদ।

মার্কসবাদের এই তিনটি উৎস তথা অঙ্গ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।

মার্কসবাদের দর্শন হল বস্তুবাদ। ইউরোপের সমগ্র আধুনিক ইতিহাস থেকে এবং বিশেষ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, ফ্রান্সে যখন সবরকমের মধ্যযুগীয় জঞ্জালের বিরুদ্ধে, প্রতিষ্ঠান ও ধ্যান-ধারণায় নিহিত সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত সংগ্রাম জ্বলে উঠেছিল, তখন থেকে বস্তুবাদই দেখা দিয়েছে একমাত্র সঙ্গতিপূর্ণ দর্শন হিসাবে, যা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সমস্ত শিক্ষার প্রতি বিশ্বস্ত এবং সমস্ত ধরনের কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও কপটতার শত্রু। গণতন্ত্রের শত্রুরা তাই বস্তুবাদকে 'খণ্ডন করার' জন্য, তাকে ধূলিসাৎ ও নিন্দিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে এবং সমর্থন করেছে নানা ধরনের দার্শনিক ভাববাদকে যা সর্বদাই পর্যবসিত হয় কোনও না কোনও ভাবে ধর্মীয় গোঁড়ামির রক্ষণাবেক্ষণে বা সমর্থনে।

মার্কস ও এঙ্গেলস অতি দৃঢ়তার সঙ্গে দার্শনিক বস্তুবাদের সমর্থন করেছেন এবং এই ভিত্তি থেকে প্রত্যেকটি বিচ্যুতিই যে কী দারুণ ভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে তা বারবার ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন। তাঁদের এই মতামত সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে এবং বিশদে ব্যক্ত হয়েছে এঙ্গেলসের রচনা 'ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ' এবং 'অ্যান্টি-ড্যুরিং' বইতে। 'কমিউনিস্ট ইস্তাহারের' মতো এ বই দুখানিও প্রত্যেকটি সচেতন শ্রমিকের কাছে নিত্যপাঠ্য। অষ্টাদশ শতাব্দীর বস্তুবাদেই কিন্তু মার্কস থেমে যাননি,দর্শনকে তিনি আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এ দর্শনকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন জার্মান চিরায়ত দর্শনের সম্পদ দিয়ে, বিশেষ করে হেগেলীয় দর্শন তত্ত্ব দিয়ে, যা আবার পরিণতি পেয়েছে ফয়েরবাখের বস্তুবাদে। এই সব সম্পদের মধ্যে প্রধান হল দ্বন্দ্বতত্ত্ব, অর্থাৎ একদেশদর্শিতা বর্জিত, সম্পূর্ণ ও গভীরতম রূপের বিকাশের মতবাদ – মানব জ্ঞানের আপেক্ষিকতার মতবাদ যা আমাদের নিরন্তর বিকাশমান বস্তু সম্পর্কে ধারণা দেয়। জরাজীর্ণ পুরনো ভাববাদে 'নব নব' প্রত্যাবর্তন সহ সমস্ত বুর্জোয়া দার্শনিক মতবাদ সত্ত্বেও, রেডিয়াম, ইলেকট্রন, মৌলিক পদার্থের রূপান্তর প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আধুনিকতম আবিষ্কার থেকে মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ চমৎকার-রূপে সমর্থিত হয়েছে।

দার্শনিক বস্তুবাদকে গভীরতর ও বিকশিত করে মার্কস তাকে সম্পূর্ণতা দান করেন, এর প্রকৃতি-বিষয়ক জ্ঞানকে প্রসারিত করেন মানবসমাজের জ্ঞানে। বৈজ্ঞানিক চিন্তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হল মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। ইতিহাস ও রাজনীতি-বিষয়ক মতামতে যে বিশৃঙ্খলা ও খামখেয়ালিপনা এযাবৎ চলে আসছিল তার সমাপ্তি ঘটিয়ে এগিয়ে এল এক আশ্চর্যরকমের সর্বাঙ্গীণ ও সুসমঞ্জস্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা দেখাল কী করে উৎপাদিকা শক্তিগুলোর বিকাশের ফলে সমাজজীবনে একটি ব্যবস্থা থেকে উদ্ভব হয় ভিন্ন ও উচ্চতর ব্যবস্থার – দৃষ্টান্তস্বরূপ, কী করে সামন্ততন্ত্র থেকে বিকশিত হয় পুঁজিবাদ।

মানুষের জ্ঞান যেমন মানুষের অস্তিত্ব-নিরপেক্ষ প্রাকৃতিক জগতের, অর্থাৎ বিকাশমান পদার্থের প্রতিফলন, তেমনই সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিফলনই হল মানুষের সামাজিক জ্ঞান (অর্থাৎ বিভিন্ন দার্শনিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক প্রভৃতি মতামত ও তত্ত্ব)। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো হল অর্থনৈতিক বনিয়াদের উপরিকাঠামো। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখা যাবে যে আধুনিক ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর রাজনৈতিক রূপ যাই হোক, তার কাজ হল সর্বহারার ওপর বুর্জােয়া প্রভুত্ব সংহত করা।

মার্কসের দর্শন হল সুসম্পূর্ণ দার্শনিক বস্তুবাদ – তা থেকে মানবসমাজ, বিশেষ করে শ্রমিকশ্রেণী, তার জ্ঞানার্জনশলাকা লাভ করেছে।

অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই হল বনিয়াদ, তার ওপরেই রাজনৈতিক উপরিকাঠামো দণ্ডায়মান – এ কথা উপলব্ধির পর মার্কস সবচাইতে বেশি মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনায়। মার্কসের প্রধান রচনা 'পুঁজি'তে আধুনিক, অর্থাৎ পুঁজিবাদী সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পর্যালোচিত হয়েছে।

মার্কসের পূর্বে চিরায়ত অর্থশাস্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল পুঁজিবাদী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিকশিত দেশে – ইংল্যান্ডে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পর্যালোচনা করে অ্যাডাম স্মিথ ও ডেভিড রিকার্ডো মূল্যের শ্রম-তত্ত্বের সূত্রপাত করেন। মার্কস তাঁদের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি এ তত্ত্বকে অভ্রান্ত বলে প্রমাণিত ও সুসঙ্গতরূপে বিকশিত করেন। তিনি দেখান যে, পণ্যের উৎপাদনে সামাজিকভাবে আবশ্যক যে শ্রম-সময় ব্যয় হয়েছে, তাই দিয়েই তার মূল্য নির্ধারিত হয়।

বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরা যেখানে দেখছিলেন দ্রব্যের সঙ্গে দ্রব্যের সম্পর্ক (এক পণ্যের সঙ্গে অন্য পণ্যের বিনিময়) মার্কস সেখানে উদ্ঘাটিত করলেন মানুষে মানুষে সম্পর্ক। পণ্য বিনিময়ের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে বাজারের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদকদের পারস্পরিক সম্পর্ক। মুদ্রা দেখায় যে সেই সম্পর্ক ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, বিভিন্ন উৎপাদকদের সামগ্রিক অর্থনৈতিক জীবন বাঁধা পড়ছে একটি অবিচ্ছিন্ন সমগ্রতায়। পুঁজির অর্থ এই সম্পর্কের আরও বিকাশ : মানুষের শ্রম-শক্তি পরিণত হচ্ছে পণ্যে। জমি, কলকারখানা ও শ্রমের যন্ত্রপাতির মালিকের কাছে মজুরি-শ্রমিক তার শ্রম-শক্তি বিক্রি করে। শ্রম-দিনের এক অংশ সে খাটে তার সপরিবার ভরণপোষণের খরচা তোলার জন্য (মজুরি), বাকি অংশটা সে খাটে বিনা মজুরিতে এবং এইভাবে পুঁজিপতির জন্য উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করে, যা পুঁজিপতি শ্রেণীর মুনাফা ও সম্পদের উৎস।

মার্কসের অর্থনৈতিক তত্ত্বের মূল কথা হল এই উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব।

শ্রমিকের মেহনতে গড়া এই পুঁজি শ্রমিকদের পিষ্ট করে, ক্ষুদে মালিকদের ধ্বংস করে এবং সৃষ্টি করে বেকার বাহিনীর। শিল্পের ক্ষেত্রে বৃহদাকার উৎপাদনের জয়যাত্রা অবিলম্বেই চোখে পড়ে, কিন্তু কৃষির ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার দেখা যাবে : বৃহদাকার পুঁজিবাদী কৃষির প্রাধান্য বাড়ছে, যন্ত্রপাতির নিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে, কৃষকের অর্থনীতি এসে মুদ্রা-পুঁজির ফাঁসে আটকে যাচ্ছে, তারপর নিজের পশ্চাৎপদ উৎপাদন কৌশলের বোঝা নিয়ে ভেঙে পড়ছে ও ধ্বংস হচ্ছে। কৃষিতে ক্ষুদ্রাকার উৎপাদনের যে ভাঙন তার রূপগুলি ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু ভাঙনটা তর্কাতীত সত্য।

ক্ষুদ্রাকার উৎপাদনকে ধ্বংস করে পুঁজি শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটায় এবং বৃহৎ পুঁজিপতি সঙ্ঘগুলোর একচেটিয়া কর্তৃত্ব গড়ে তোলে। উৎপাদনটাও উত্তরোত্তর সামাজিক হতে থাকে – লক্ষ লক্ষ এবং কোটি কোটি মজুর বাঁধা পড়ে একটি প্রণালীবদ্ধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় – কিন্তু যৌথ শ্রমের ফল আত্মসাৎ করে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি। বৃদ্ধি পায় উৎপাদনের নৈরাজ্য, সংকট, বাজারের জন্য প্রবল প্রতিযোগিতা এবং জনসাধারণের ব্যাপক অংশের মধ্যে জীবনধারণের অনিশ্চয়তা।

পুঁজির কাছে শ্রমিকদের পরাধীনতা বাড়িয়ে তোলার সাথে সাথে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সম্মিলিত শ্রমের মহাশক্তিও গড়ে তোলে। পণ্য অর্থনীতির ভ্রূণাবস্থা থেকে, সরল বিনিময় থেকে শুরু করে তার সর্বোচ্চ রূপ, বৃহদাকার উৎপাদনের রূপ পর্যন্ত মার্কস পুঁজিবাদের বিকাশ পর্যালোচনা করেছেন।

এবং নতুন পুরনো সবরকম পুঁজিবাদী দেশের অভিজ্ঞতা থেকে মার্কসের এ মতবাদের সঠিকতা বছরের পর বছর বেশি বেশি মজুরের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠছে।

সারা দুনিয়ায় পুঁজিবাদের জয় হয়েছে। কিন্তু এ জয় শুধু পুঁজির ওপর শ্রমের বিজয়লাভের পূর্বাভাস।

সামন্ততন্ত্রের পতনের পর ঈশ্বরের দুনিয়ায় 'মুক্ত' পুঁজিবাদী সমাজের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই এ কথা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, মেহনতি মানুষদের ওপর পীড়ন ও শোষণের একটি নতুন ব্যবস্থাই হল এ মুক্তির অর্থ। ঐ পীড়নের প্রতিফলন ও প্রতিবাদস্বরূপ নানাবিধ সমাজতান্ত্রিক মতবাদ অবিলম্বে দেখা দিতে শুরু করে। কিন্তু গোড়ার দিকের সমাজবাদ ছিল ইউটোপীয় সমাজবাদ। তা পুঁজিবাদী সমাজের সমালোচনা করেছে, নিন্দা করেছে, অভিশাপ দিয়েছে, স্বপ্ন দেখেছে তার বিলুপ্তির, উন্নততর এক ব্যবস্থার কল্পনায় মেতেছে, আর ধনীদের বোঝাতে চেয়েছে শোষণ নীতিবিগর্হিত কাজ।

কিন্তু পরিবর্তনের প্রকৃত পথ দেখাতে ইউটোপীয় সমাজবাদ পারেনি। পুঁজিবাদের আমলে মজুরি-দাসত্বের সারমর্ম কী তা সে বোঝাতে পারেনি, পুঁজিবাদের বিকাশের নিয়মগুলি কী তাও সে আবিষ্কার করতে পারেনি, খুঁজে পায়নি কোন সামাজিক শক্তি নতুন সমাজের নির্মাতা হওয়ার ক্ষমতা ধরে। ইতিমধ্যে সামন্ততন্ত্র, ভূমিদাসত্বের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপের সর্বত্র এবং বিশেষ করে ফ্রান্সে যে সব উত্তাল বিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছিল, তা থেকে উত্তরোত্তর পরিষ্কার হয়ে বেরিয়ে আসে যে শ্রেণীগুলির মধ্যকার সংগ্রামই হল সমস্ত বিকাশের ভিত্তি ও চালিকা শক্তি।

মরীয়া প্রতিরোধের মোকাবিলা ছাড়া সামন্ত শ্রেণীর উপর রাজনৈতিক স্বাধীনতার একটি বিজয়লাভও সম্ভব হয়নি। পুঁজিবাদী সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে মরণপণ সংগ্রাম বিনা কোনও পুঁজিবাদী দেশই মোটের ওপর  মুক্ত ও গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠেনি।

বিশ্ব ইতিহাস থেকে যে শিক্ষা পাওয়া যায়, সে সিদ্ধান্ত সর্বাগ্রে মার্কসই গ্রহণ করেছেন এবং সুসঙ্গতরূপে তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, এই হল মার্কসীয় প্রতিভার বৈশিষ্ট্য। সে সিদ্ধান্তটা হল শ্রেণীসংগ্রামের মতবাদ।

সবকিছু নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বুলি, ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতির পেছনে কোনও না কোনও শ্রেণীর স্বার্থ আবিষ্কার করতে না শেখা পর্যন্ত লোকে রাজনীতির ক্ষেত্রে চিরকাল প্রতারণা ও আত্মপ্রতারণার নির্বোধ বলি হয়ে ছিল এবং চিরকাল থাকবে। পুরনো ব্যবস্থার রক্ষকদের কাছে সংস্কার ও উন্নয়নের প্রবক্তারা সর্বদাই বোকা বনবে যদি না তারা এ কথা বোঝে যে, যত অসভ্য ও জরাজীর্ণ মনে হোক না কেন প্রত্যেকটি পুরনো প্রতিষ্ঠানই টিকে আছে কোনও না কোনও শাসক শ্রেণীর শক্তির জোরে। এবং এই সব শ্রেণীর প্রতিরোধ চূর্ণ করার শুধু একটি উপায়ই আছে; যে শক্তি পুরনোর উচ্ছেদ ও নতুনকে সৃষ্টি করতে পারে – এবং নিজের সামাজিক অবস্থানহেতু যা তাকে করতে হবে – তেমন শক্তিকে আমাদের চারপাশের সমাজের মধ্য থেকেই আবিষ্কার করে তাকে শিক্ষিত ও সংগ্রামের জন্য সংগঠিত করে তোলা।

যে মানসিক দাসত্বের মধ্যে সকল নিপীড়িত শ্রেণীগুলো এতদিন বাঁধা পড়ে ছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসার পথ সর্বহারা পেয়েছে একমাত্র মার্কসের দার্শনিক বস্তুবাদ থেকে। একমাত্র মার্কসের অর্থনৈতিক তত্ত্বেই ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে সামগ্রিকভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে সর্বহারার সত্যিকার অবস্থাটা কী।

আমেরিকা থেকে জাপান এবং সুইডেন থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা – সারা দুনিয়া জুড়ে সর্বহারার স্বাধীন সংগঠনের সংখ্যা বাড়ছে। নিজেদের শ্রেণী-সংগ্রাম চালিয়ে আলোকপ্রাপ্ত ও শিক্ষিত হয়ে উঠছে সর্বহারা; বুর্জোয়া সমাজের কুসংস্কার থেকে তারা মুক্ত হয়ে উঠছে; ক্রমেই নিবিড় হয়ে জোট বাঁধছে, শিখছে কী করে নিজেদের সাফল্যের খতিয়ান করতে হয়; আপন শক্তিসমূহকে তারা পোক্ত করে তুলছে এবং বেড়ে উঠছে অপ্রতিহতভাবে।