(মূল নিবন্ধটি মেইনস্ট্রীম পত্রিকার ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সংখ্যার জন্য লেখা হয়, যার সংক্ষেপিত এই অংশটি ১৯৯৬-এর অক্টোবরে লিবারেশনে প্রকাশিত হয়।)

(...) ঘটনার পর দিনই দেশের সংবাদপত্রগুলির শিরোনামে এই হত্যাকাণ্ড স্থান পায় এবং প্রধান প্রধান দৈনিকগুলিতে পরপরই সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ও বিশ্লেষণাত্মক লেখাগুলি প্রকাশিত হয়। দূরদর্শন ঘটনাটিকে কদর্যভাবে প্রদর্শন করে এবং বিশেষ যত্নের সঙ্গে একথা বলতে ভুল করে না যে এ পর্যন্ত রণবীর সেনা ও সিপিআই(এমএল)-এর মধ্যে রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষে ২৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। যে সব সংবাদপত্র সংঘ পরিবারের কাছ থেকে মতাদর্শগত প্রেরণা পেয়ে থাকে তাদের সম্পাদকীয় কলমে বিহারের সাধারণভাবে আইন শৃঙ্খলাহীন অবস্থার কথা বলে খুবই হৈ চৈ বাধানো হয়। সাথে সাথেই তারা বিহারের ২৩টি জেলায় বাম উগ্রপন্থীদের তথাকথিত সমান্তরাল সরকার পরিচালনার মুখরোচক কাহিনী পরিবেশন করতে থাকে এবং আধা-সামরিক বাহিনী দিয়ে বিশেষ অভিযান চালিয়ে তাদের দমন করার জন্য খুবই চেঁচামেচি করতে থাকে। সিবিআই-এর এক প্রাক্তন অধিকর্তাও এশিয়ান এজ পত্রিকায় ঠিক একই ধাঁচে কলম ধরেন। আরও বিভিন্ন খবরের কাগজে হিংসা আর পাল্টা হিংসার চক্রাবর্তের শিহরণ জাগানো সব কাহিনী সাজানো হয়। এইসব লেখায় দারুণভাবে অস্ত্র সজ্জিত সামন্তশক্তির দিক থেকে গণসন্ত্রাস সৃষ্টির হাতিয়ার হিসাবে নারী ও শিশুদের উপর সংগঠিত হত্যালীলার সাথে আত্মরক্ষা ও ন্যায্য অধিকারের দাবিতে গ্রামীণ দরিদ্রদের প্রতিরোধ সংগ্রামের মধ্যকার বুনিয়াদী পার্থক্যকেই গুলিয়ে দেওয়া হয়। অদ্ভূত যুক্তির কসরতের সাহায্যে আক্রান্তদেরই নিন্দামন্দ করা হয়।

সিপিআই(এমএল) লিবারেশন যে নৈরাজ্যবাদী গ্রুপগুলির থেকে আলাদা একথা সুবিদিত। এও সুবিদিত যে এটি একটি গণরাজনৈতিক দল যার বিহার বিধানসভায় ছ’জন সদস্য রয়েছে। যার মধ্যে দুজন হলেন সেই এলাকার যেখানে গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে। ১৯৮৯-তে পার্টি আরা সংসদীয় আসন জয় করে এবং ১৯৯৬-এর লোকসভা নির্বাচনে পার্টি সেখানে পায় ১ লক্ষ ৪৬ হাজার ভোট। পার্টি দরিদ্র কৃষকদের এক শক্তিশালী আন্দোলন পরিচালনা করছে এবং পাটনা ও দিল্লীর মতো রাজধানী শহরগুলিতে কয়েকটি বৃহত্তম বাম রাজনৈতিক সমাবেশ সংগঠিত করেছে। পার্টি নির্বিচার হিংসায় বিশ্বাস করে না এবং একান্ত অপরিহার্য না হলে প্রতিশোধমূলক বদলারও আশ্রয় নেয় না। সিপিআই(এমএল) নিরপরাধ নারী ও শিশুদের হত্যা করেছে – এমন অভিযোগ কেউই করতে পারে না। যথেষ্ট প্ররোচনা সত্ত্বেও যে কোনো জাতপাতগত প্রত্যাঘাতকেও পার্টি সবসময় প্রশমিত করে থাকে এবং সেক্ষেত্রে বাথানিটোলাও কোনো ব্যতিক্রম নয়।

দলিতদের দুই স্বঘোষিত মুখপাত্র কাঁসিরাম ও রামবিলাস পাশোয়ান ঘটনার নিন্দাটুকু পর্যন্ত করতে প্রয়োজন বোধ করেননি। দলিতদের ক্ষমতায় নিয়ে আসার সর্বাগ্রগণ্য ভি পি সিং – যিনি মুম্বাইতে রাজেশ কিনির পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাত করতে যথেষ্ট সময় ও উৎসাহ বোধ করেছেন – তিনি সমগ্র ঘটনাপর্ব জুড়ে রহস্যপূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করেছেন। রণবীর সেনা বিজেপিরই এক শাখা সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও এবং ঘটনার যারা শিকার তাঁদের অনেকেই মুসলিম সম্প্রদায়ের হওয়া সত্ত্বেও বা করবস্থান ও কারবালার জমি উদ্ধার করা (সেনাদের) আশু লক্ষ্য জেনেও অথবা হত্যাকাণ্ডের পিছনে জোরালো সাম্প্রদায়িক তাগিদ ছিল জেনেও মুসলিম সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য কোনো নেতা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার গরজ অনুভব করেননি।

কেন্দ্রের কমিউনিস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত ঘটনাস্থলে উড়ে গিয়েছিলেন এবং ভূমিসংস্কার না হওয়াই সমস্যার মূল কারণ – এ ধরনের ধার করা বুলি আউড়ে গেছেন এবং এভাবেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে কোনো কিছু করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যখন কারো নির্দিষ্ট কোনো কিছু করার ইচ্ছা থাকে না তখন এ ধরনের যা খুশি তাই তাত্ত্বিক সূত্রায়নে অসুবিধে হয় না। আর তাই দিল্লী ফিরে যাওয়ার আগে কমিউনিস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথামাফিক বিহারের পুলিশবাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস দিতে পেরেছেন এবং মুখ্যমন্ত্রী ও পুলিশের বড় কর্তাদের দাবি অনুযায়ী আধা-সামরিক বাহিনীর নতুন নতুন ইউনিট মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দিতে পেরেছেন। ভাবতে অবাক লাগে যে পুলিশী নিষ্ক্রিয়তার পিছনে নাকি অস্ত্রশস্ত্রের অভাবই ছিল আসল কারণ! লোকসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিহারে উগ্রপন্থার মাথা চাড়া দেওয়ার কারণ অনুসন্ধানের জন্য অবসরপ্রাপ্ত পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মচারিদের নিয়ে এক টাস্কফোর্স গঠনের কথা ঘোষণা করেন। জেলা প্রশাসনের কর্তব্যে অবহেলার অপরাধ সম্পর্কে একটি কথাও উচ্চারণ করা হয়নি বা কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করা হয়নি এবং এমনকি সাধারণীকরণের আড়ালে এই ধরনের মারাত্মক ঘটনার তদন্ত করতে বিচার বিভাগীয় তদন্তের যে বরাবরের প্রথা তাকেও অস্বীকার করা হয়।

ভূমিসংস্কার না হওয়াই যে মূল কারণ গুপ্তের এই উক্তি সমস্যার অন্তর্বস্তুকে স্পর্শ করতে পেরেছে বলে উদারনৈতিক সংবাদ মাধ্যমগুলির কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে নির্দিষ্ট ক্ষেত্র ও বিশেষ সময় পর্বের নিরিখে এটা ছিল অতীব হাস্যকর এক মন্তব্য। নকশালপন্থার বৃদ্ধির পিছনে ভূমিসংস্কার না হওয়াকেই মূল কারণ হিসেবে দেখিয়ে প্রায়শই সম্পাদকীয় ও নানা সামাজিক বিশ্লেষণ প্রকাশিত হতে দেখা যায়। গুপ্তও একই ধরনের উদ্বেগে আকূল এবং তাই তিনি বাঁধাধরা দাওয়াই-ই বাতলেছেন। তাঁর পণ্ডিতসুলভ ভ্রান্ত দুঃসাহসের আতিশয্যে তিনি বাথানিটোলার মর্মবস্তুকে আয়ত্ত করতে ব্যর্থ হয়েছেন – যা ছিল ক্রমবর্ধমান সামন্ত প্রত্যাঘাতেরই এক পরিঘটনা।

সাধারণভাবে ভোজপুরে এবং নির্দিষ্টভাবে বাথানিটোলার কাছে বরকি খারাওঁ নামে মূল গ্রামটিতে নিজেদের সংগঠিত শক্তি ও বেড়ে ওঠা রাজনৈতিক ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে জনগণ মজুরি ও ভূমি সংস্কারের ফলাফল ইতিমধ্যেই ছিনিয়ে নিয়েছেন। গত সংসদীয় নির্বাচনে বিহারে বিজেপির উত্থানের ঘটনায় বলীয়ান হয়ে সামন্তশক্তির প্রত্যাবর্তনকামীরা এই ফলগুলি কেড়ে নিতে এবং সাবর্ণ আধিপত্যকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চায়। ঘটনাচক্রে রণবীর ছিল অতীতদিনের এক ভূমিহার বীর যে রাজপুত আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল আর তাই রাজপুতরা সাধারণভাবে রণবীর সেনায় যোগ দিতে অনিচ্ছুক। কবরস্থান ও কারবালার যে জমি জোর করে সাবর্ণ জাতের জমিদাররা দখলে রেখেছে এবং যাকে ঘিরে বর্তমান সংঘাত তা থেকে উদ্ভূত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিজেপির লোকজনেরা বরকি খারাওঁ-এ দুই জাতের মধ্যে ঐক্যস্থাপন করে। ১৯৭৮ সালে যখন মুখিয়া পদের জন্য পঞ্চায়েত নির্বাচনে ইউনুস মিঞা কেশো সিং-কে পরাজিত করে এবং অব্যবহিত কাল পরে ইমামবাড়াকে যে ধুলিসাৎ করে দেওয়া হয় এই সংঘর্ষের সূত্রপাত সেই তখন থেকে।

প্রকাশ্য শ্রেণীযুদ্ধের এক বৈশিষ্ট্যমূলক ঘটনা হল বাথানিটোলা। যদিও তার তীব্রতা দেখা গেছে তৃণমূলে, কিন্তু তাকে উপরতলার রাজনৈতিক সংগ্রামের মাপকাঠিতেই বুঝতে হবে। সমসাময়িক ভারতীয় সমাজের দুই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক মানদণ্ড – জাতপাত আর সাম্প্রদায়িক বৈরিতা – তাকে শ্রেণী সংগ্রামের কাঠামোর মধ্যে মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়ার এ এক বৈশিষ্ট্যমূলক ঘটনা। বিপ্লবী বাম শক্তি আর অতি দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি যে এই শ্রেণীযুদ্ধে মুখোমুখি সংঘর্ষে অবতীর্ণ তা কোনো আকস্মিক বিষয় নয় – যে শ্রেণীযুদ্ধ গ্রাস করেছে সমগ্র ভোজুপর জেলাকে এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে বিহারের অন্যান্য অংশেও। আর এও কোনো বিস্ময়জনক ঘটনা নয় যে প্রকাশ্য শ্রেণী সংগ্রাম ফেটে পড়তেই মধ্যপন্থী ও সমাজগণতন্ত্রী শক্তিগুলি নির্বীর্যে পর্যবসিত হয়েছে, প্রায়শই গ্রহণ করছে এমন এক নিরপেক্ষ অবস্থান যা কেবল লুন্ঠনকারীদেরই উপকারে লেগে যায়।

এই শ্রেণীসংগ্রাম – যা জাতপাত ও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদকে নিজের মধ্যে অন্তর্লীন করে নেয় তা একইসাথে অগ্রাধিকারের বিষয়গুলিকে ভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য উত্তর-আধুনিকতাবাদীদের যে আলোচ্যসূচি তাকেও নস্যাৎ করে দেয়।

সংবাদমাধ্যমের সাথে সাথে দলিত ও সংখ্যালঘুদের ক্ষমতাসীন করার সমস্ত প্রবক্তাদেরই নীরব থেকে যাওয়াকে এই প্রেক্ষাপট থেকেই দেখতে হবে। তবুও প্রতিবাদ আন্দোলন থেমে নেই। সিপিআই(এমএল) ধারার প্রথম যে সদস্য ভারতীয় সংসদে প্রবেশ করেছেন এবং বর্তমানে যিনি ভোজপুরের এক বিধায়ক – সেই রামেশ্বর প্রসাদের জেলা প্রশাসনের শাস্তি ও ভোজপুরের সামন্তপ্রভুদের নিরস্ত্র করার দাবিতে আমরণ অনশনকে কেন্দ্র করে বেশি বেশি সংখ্যায় প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবীরা বাথানিটোলায় নামিয়ে আনা মধ্যযুগীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে ও রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তার প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন।

ভোজপুরের পঁচিশ বছরের ইতিহাস যদি কোনো পথনির্দেশ করে থাকে তাহল সংগ্রাম এখানে কখনো মাঝপথে থেমে থাকেনি। পঁচিশ বছর আগের তুলনায় গ্রামের গরিবরা এখানে আর্থ-সামাজিক ফসলগুলি ছিনিয়ে নিয়েছেন এবং রাজনীতিগতভাবেও যথেষ্ট পরিমাণে অগ্রসর হয়েছেন। কোনো বাথানিটোলাই তাদের অর্জিত সাফল্যগুলি থেকে বিন্দুমাত্র আত্মসমর্পণ করাতে পারবে না। যুদ্ধ তাই চলমান এবং সামন্ততন্ত্রের শেষ কণাটুকু চূড়ান্তভাবে মাটিতে মিশিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত লড়াই জারি থাকবে।