(২৭ আগস্ট ১৯৯৪ পাটনায় অনুষ্ঠিত বিশেষ কর্মী বৈঠকে প্রদত্ত ভাষণের অংশবিশেষ। লিবারেশন, নভেম্বর ১৯৯৪ থেকে)

কমরেডগণ,

সাত মাস আগে এই একই স্থানে আমরা একটি কনভেনশন করেছিলাম। সেই সময় কেউ কেউ এই অভিমত পোষণ করতেন যে একদিকে এমসিসি অপরদিকে জনতা দলের চাপে আমাদের পার্টি শেষ হয়ে যাচ্ছে। সংবাদপত্রগুলিতেও এই ধরনের ধারণাগুলির প্রচার করা হচ্ছিল। সেই কনভেনশনে আমি বলেছিলাম যে যদি আপনারা দৃঢ়সংকল্প প্রচেষ্টা চালান তাহলে বিহারের পরিস্থিতিকে আপনারা পাল্টে দিতে পারেন। ঐক্যবদ্ধভাবে ও সর্বাত্মক উদ্যোগ নিতে আমরা সাফল্যের সঙ্গে ঐতিহাসিক ১৮ মার্চের সমাবেশ সংগঠিত করেছি। সমাবেশের পর সংবাদপত্রগুলি তাদের মত পাল্টায়। এমসিসি ও জনতা দলের চাপে আমরা শেষ হয়ে গেছি – এইসব বলার পরিবর্তে তারা বলতে শুরু করে যে জনতা দল সম্পর্কে মানুষের মোহ ভাঙ্গতে শুরু করেছে এবং সিপিআই(এমএল) এক শক্তি হিসাবে সামনে উঠে এসেছে।

সুতরাং আমি পুনরায় বলতে চাই যে ঐক্যবদ্ধ হতে ও সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করতে আমাদের কর্মীদের সামর্থ্য আছে। বিহারের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা দৃঢ়ভাবে বিপ্লবী পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। এই সময়কালে আর একটি বিষয় দেখা গেছে যে আমাদের নেতারা এক নতুন কাজের ধারা গড়ে তুলেছেন। এটি এক স্বাস্থ্যকর কাজের ধারা এবং এই লক্ষ্যেই আমরা কিছুদিন আগে শুদ্ধিকরণ আন্দোলন চালিয়েছিলাম। সেই সময় কোনো না কোনোভাবে নেতা ও কর্মীদের মধ্যে এক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। সমাবেশের সময়কালে আমরা যে কাজের ধারা গড়ে তুলেছি তা কঠোরভাবে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

পার্টির বিভিন্ন স্তরে বিদ্যমান সমস্ত মতপার্থক্য সমাধান করতে হবে, তা না হলে বিরুদ্ধ শক্তিগুলি এর সুযোগ নেবে। এই বিষয়টি আমরা অতীতেও ঘটতে দেখেছি। এই কারণে আমি আবার জোর দিয়ে বলতে চাই যে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য থাকতে হবে।

আপনাদের সামনে যে প্রতিবেদন রাখা হয়েছে সে সম্পর্কে আপনারা সকলে মতামত রেখেছেন। অনেক ভালো মতামত ব্যক্ত হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি রাজ্য নেতৃত্ব এই সমস্ত মতামত নিয়ে আলোচনা করবে এবং রাজনৈতিক শক্তিগুলির বাস্তব ও প্রকৃত মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বহু কমরেড যেসব নির্দিষ্ট বিষয় তুলে ধরেছেন সেসব নিয়েও আলোচনা করবেন। প্রতিবেদনে যদি এটি বলা হয়ে থাকে যে জনতা দল(ব) শেষ হয়ে গেছে বা জাতীয় স্তরে তাদের কোনো গুরুত্বই নেই, তাহলে অবশ্যই তা সঠিক মূল্যায়ন নয়। তারা এখনও শক্তিশালী বিরোধীপক্ষ। তাই এই ধরনের কোনো মূল্যায়ন থাকলে তা সংশোধন করা উচিত। বিএসপি সম্পর্কে যদি এই ধরনের মূল্যায়ন থাকে তাও সংশোধন করা উচিত। বিএসপি বিহারে ঢোকার পথ তৈরি করছে। তারা উত্তরপ্রদেশে শক্তিশালী এবং এই শক্তির ওপর ভিত্তি করে তারা বিহারে অগ্রগতি ঘটানোর চেষ্টা চালাবে। তাই তাদের সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

জনতা দল (জর্জ) ও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সঙ্গে রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলা সম্পর্কে অনেক কমরেড এইসব শক্তিগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বিশেষ করে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা অতীতে কংগ্রেসের সাথে মাখামাখি করেছিল। আর, জনতা দল (জর্জ)-এর বর্তমান অবস্থাও সন্দেহজনক। আমি মনে করি কমরেডদের অনুভূতিগুলি সঠিক। বর্তমানে জনতা দল (জর্জ)-এর সঙ্গে জোট গড়া ও সরকার গঠন করা সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা যদি প্রতিবেদনে থাকে তবে তা বাদ দেওয়া উচিত। জনতা দল (জর্জ)-এর সঙ্গে বড়জোর কিছু আসনে বোঝাপড়া নিয়ে আলোচনা হতে পারে এবং বর্তমানে এটাই হল যথাযথ মূল্যায়ন। আসন সংক্রান্ত বোঝাপড়া কতদূর হতে পারে বা আদপেই হবে কিনা সে সম্পর্কে কিছু কমরেড সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। আমি মনে করি এই সন্দেহও সঠিক এবং শেষ পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক বোঝাপড়া নাও হতে পারে। এমনকি আসন নিয়ে বোঝাপড়াও সম্ভবপর না হতে পারে। আমাদের একাই লড়তে হতে পারে। এই সম্ভাবনা আমরা নাকচ করতে পারি না। তাই প্রতিবেদনে রাজনৈতিক জোট নিয়ে কম কথা থাকাই সম্ভবত ভালো। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনে আমাদের যে একা লড়তে হতে পারে সেই সম্ভাবনার কথাও প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকা উচিত এবং তার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা নিশ্চয়ই মিত্র খোঁজার চেষ্টা করব, কিন্তু কোনো রাজনৈতিক জোট বা কর্মসূচি সংক্রান্ত বোঝাপড়া সম্ভব নাও হতে পারে।

ঝাড়খণ্ডে দ্বিতীয় শক্তি হল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা (মারডি গোষ্ঠী) বা বিনোদ বিহারী মাহাতো গোষ্ঠী। তাদের তুলনামূলকভাবে প্রগতিশীল বা বামদের প্রতি ঝুঁকে থাকা বলে মনে করা হত, কিন্তু তারা ক্রমে ক্রমে বর্তমানে জনতা দলের দিকে চলে যাচ্ছে এবং কার্যত ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দাবি ছেড়ে দিয়েছে। আজসু-র মতো অন্যান্য শক্তি যারা বিরাট প্রতিশ্রুতি নিয়ে সামনে এসেছিল, তারা পরবর্তীতে ভেঙে পড়ে এবং বিভিন্ন ধরনের সুবিধাবাদী বোঝাপড়ায় উপনীত হয়। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার দুটি দিক আছে। এদের নেতাদের সম্পর্কে আপনাদের বক্তব্য সঠিক। তারা মাফিয়া ও গুণ্ডা। কিন্তু সাধারণ আদিবাসীরা তাদের এভাবে দেখে না। সাধারণ আদিবাসীদের চোখে তারা ঝাড়খণ্ডের প্রতিনিধিত্বকারী শক্তি। আমাদের সামনে একটি প্রশ্ন হাজির হয়েছে। তারা প্রায়শই কংগ্রেসের দিকে বা কেন্দ্রের সরকারের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং এদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়। তাদের শ্রেণী ভিত্তি ও শ্রেণী অবস্থানের জন্য এটি খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এর আর একটি দিক থাকতে পারে। আমরা তাদের কাছে সরাসরি প্রশ্ন রেখেছি যে, আপনাদের হয় কংগ্রেস না হয় সিপিআই(এমএল)-কে বেছে নিতে হবে। আমরা সেই ধরনের বন্ধুত্বের কথা বলি না যেখানে একই সঙ্গে কংগ্রেস ও সিপিআই(এমএল)-এর সাথে সম্পর্ক রেখে চলা যাবে। যদি আপনাদের কংগ্রেসের সঙ্গে আঁতাত থাকে তাহলে আপনাদের সিপিআই(এমএল)-এর সাথে কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। বন্ধুত্ব বলতে আমরা এটিই বুঝি। সর্বদলীয় কমিটিতে আমরা একথাই তাদের বলেছি। যখন তারা কংগ্রেসের দিকে যেতে শুরু করেছে আমরা তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। তাদের সম্মেলনে, তারা তাদের মতো করে একই প্রশ্ন তুলেছে। তারা একদিকে বলেছে যে, তারা সিপিআই(এমএল)-এর সঙ্গে সম্পর্ক চায়। অপরদিকে তারা কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছে। এতে আমরা আশা করতে পারি যে কংগ্রেসের কাছ থেকে ধাক্কা খাওয়ার পর তারা আমাদের দিকে আসবে এবং তাদের সংগঠনের মধ্যকার বিতর্ক তীব্র হয়ে উঠবে। তারা একটি জনগণের সংসদ আয়োজন করেছিল যেখানে একজন বলেন যে তিনি এই সংসদে কংগ্রেসীদেরও আমন্ত্রণ করেছিলেন। তা উপস্থিত অনেকের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করে। আমি যতদূর জানি সেখানে কংগ্রেস বিরোধী স্লোগানও উঠেছিল। আমার মনে হয় এই প্রশ্নে তাদের মধ্যে বিতর্ক আছে এবং তাদের মধ্যে এই ধরনের কংগ্রেস বিরোধী কিছু শক্তি রয়েছে। আমরা ধারাবাহিকভাবে এই প্রশ্ন তুলে ধরতে চাই এবং তাদের পুরোপুরিভাবে আমাদের দিকে টেনে আনতে না পারলেও অন্ততপক্ষে তাদের মধ্যে বিভাজন ঘটবে। এটি ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ও কংগ্রেসের মধ্যে বন্ধুত্বের প্রশ্ন নয় বরং এটি কংগ্রেসের সঙ্গে আমাদের সরাসরি সংঘাতের প্রশ্ন। আমাদের প্রচেষ্টা হল কংগ্রেসের কাছ থেকে তাদের সরিয়ে এনে বিরোধী শক্তির ঘনিষ্ঠ করে তোলা। দুই দিকের মধ্যে টানাটানির এই তীব্র প্রতিযোগিতায় একপ্রান্তে রয়েছে কংগ্রেস, অপরপ্রান্তে রয়েছি আমরা। তাদের সঙ্গে যৌথ ফ্রন্ট গড়ে তোলা সম্পর্কে এটিই আমাদের কৌশলের অন্তর্বস্তু এবং এই লক্ষ্যে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যেতে চাই।

জনতা দল (জর্জ) সম্পর্কে আমি একটি বিষয় পরিষ্কার করতে চাই। নীতীশের ভাবনা হল যাদব আধিপত্য ও যাদব প্রতিপত্তির বিরোধিতার নামে কুর্মী ও অন্যান্য জাতকে ঐক্যবদ্ধ করা। এই ভাবনার সঙ্গে আমরা একমত নই। আমরা যাদব জাতের বিরোধিতা করার ভিত্তিতে অন্যান্য জাতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার পক্ষে নই। বিহারে যাদবরা সংখ্যায় অনেক এবং তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ হলেন গরিব ও মাঝারি কৃষক। আমাদের নেতা, ক্যাডার ও কর্মীদের এক বড় অংশ যাদব জাত থেকে এসেছেন এবং বিভিন্ন এলাকায় যাদব জনগণের মধ্যে আমাদের রাজনৈতিক কাজ আছে। প্রকৃতপক্ষে যাদবদের ভিতরে একমাত্র আমাদের পার্টিই লালু যাদবকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। এক্ষেত্রে অন্য কোনো পার্টির সেই জায়গা নেই। আমরা যাদব সম্প্রদায়ের মধ্যে মেরুকরণ ঘটাতে চেষ্টা চালাচ্ছি। এই কাজের মধ্য দিয়ে আমরা এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টির আশা করি। কারণ অন্যান্য পার্টি মনে করে যে সমস্ত যাদবেরাই লালু প্রসাদের সঙ্গে আছে, তাই তারা কেবলমাত্র অন্যান্য জাতকে সংগঠিত করার কথা ভাবে। আমাদের পার্টি এভাবে ভাবে না এবং এভাবে ভাবলে আমরা কমিউনিস্ট পার্টি থাকব না। নীতীশের ভাবনার তালে আমরা চলতে পারি না। তাদের সাথে আমাদের মৌলিক মতপার্থক্য আছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা সম্পূর্ণ বিপরীত মত পোষণ করি। তারা যেভাবে কুর্মী সমর্থন সংগ্রহ করছেন সে সম্পর্কে এবং কুর্মী কুলাকদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম রয়েছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে একটা কথা আমি বলতে চাই। গতবার সংরক্ষণ, মণ্ডল ও পশ্চাদপদতার প্রশ্নে লালু এক ঢেউ তুলেছিলেন এবং নির্বাচনে জয়লাভ করেছিলেন। এটি সত্য যে তিনি আবার এই ধরনের চেষ্টা চালাবেন। জনপ্রিয় এক প্রবাদ আছে যে, একই নদীতে দুবার স্নান করা যায় না। একথা বলার পিছনে অনেক কারণ আছে। সেই সময় তাদের পার্টির দেশজুড়ে এক অভ্যুত্থান ঘটেছিল। তাদের জাতীয় স্তরে নেতা ছিল। এখন সেই পার্টি শেষ হয়ে গেছে। ভি পি সিং রাজনীতি থেকে অবসর নিয়েছেন। তাদের সামনে এখন এক বিরাট সমস্যা। তাই এবার তারা আর বড় ঢেউ তুলতে পারবেন না। তারা সংরক্ষণের জন্য যত শতাংশের কথাই বলুন না কেন, আমরা সুবিধাভোগী স্তরের প্রশ্নটি তুলে ধরব, কেননা তাঁরা সবসময়ই সুবিধাভোগী স্তরটির অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। আমরা সবসময়ই বলে এসেছি যে লালু হলেন সুবিধাভোগী স্তরটির প্রতিনিধি এবং এটি স্বাভাবিক যে তিনি তা মেনে নেবেন না। সংরক্ষণের শতাংশ যাই হোক না কেন, আমরা এটি তুলে ধরব যে পশ্চাদপদ জাতের মধ্য থেকে সুবিধাভোগী স্তরের উদ্ভব হয়েছে এবং চাকরির সুযোগ সীমিত হওয়ার কারণে সমস্ত সুবিধা ঐ সুবিধাভোগী স্তর কুক্ষিগত করে। যতটুকু সুযোগ আছে তার সমস্ত কিছুই সুবিধাভোগী স্তরটি ভোগ করবে। কুর্মী হোক আর যাদবই হোক, তাদের বড় অংশই এই সুযোগ থেকে কখনই উপকৃত হবে না। আর সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জাতগুলি কিছুই পাবে না।

বিহারে জাতপাতের বিভাজন রয়েছে এবং কোনো পার্টিই এই বিভাজনকে অস্বীকার করে না। তাই আমাদের কাছে সুবিধাভোগী স্তরের প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেকটি পার্টি জাতপাতের এই বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে নিজেদের কৌশল তৈরি করে। সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর মতো পার্টিগুলির ক্ষেত্রে তফাৎ শুধু এই যে এরা বর্তমান জাতপাতের ধাচাটির উপর ভিত্তি করে বা এখানে বিদ্যমান স্বাভাবিক দ্বন্দ্বগুলির উপর ভিত্তি করে জনতা দলের লেজুড়বৃত্তি করেন। আমরাও জাতপাতের দ্বন্দ্বের কথা বলি, কিন্তু আমরা সর্বদাই শ্রেণী লাইন অনুযায়ী জাতের মধ্যে বিভাজন ঘটানোর লক্ষ্যে চেষ্টা চালাই। অবশ্য সেই সমস্ত জাতের কথা আলাদা যাদের শ্রেণী লাইনে বিভাজন করা যায় না। কিছু জাত আছে যারা সম্পূর্ণতই গরিব কৃষক ও কৃষিশ্রমিক। এটি অন্য এক বিষয়। কিন্তু যেখানেই জাতের মধ্যেই শ্রেণী বিভাজনের সম্ভাবনা বর্তমান আছে, সেখানেই আমাদের তা সামনে আনতে হবে। এখানেই অন্যান্যদের থেকে কমিউনিস্টদের তফাৎ। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুবিধাভোগী স্তরের ধারণাটি সুপ্রীম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে এলেও তা আমাদের কাজে সাহায্য করবে। কেননা বিভিন্ন জাতের মধ্যে শ্রেণীলাইনে বিভাজনের ধারণা আমরা নিয়ে যেতে পারব, তাদের বোঝাতে পারব এবং বিভাজনের জন্য তাদের প্রস্তুত করতে পারব। সেই কারণে অন্যান্য পার্টি যেখানে সুবিধাভোগী স্তরের কথা অস্বীকার করছে আমরা সেখানে সুবিধাভোগী স্তরের কথা সামনে আনব যাতে পশ্চাদপদ জাতের গরিব ও মাঝারি কৃষকদের আমাদের দিকে টেনে আনা যায়। এই কারণে সুবিধাভোগী স্তরকে চিহ্নিত করার জন্য তারা কিছু মানদণ্ডের কথা বলেছে। অনুরূপভাবে আমাদের দিক থেকেও পার্টির নিজস্ব মানদণ্ডের কথা বলতে হবে। আপনাদের এই বিষয়ে ভাবতে হবে। পার্টির রাজ্য কমিটিকে এই কাজে হাত দিতে হবে। এমএলএ, এমপি ও প্রথম শ্রেণীর অফিসারদের পরিবার থেকে এই স্তর শুরু হতে পারে।

আর একটি প্রশ্ন এখানে উঠে এসেছে। একটি মত হল যে যেহেতু আমরা আগে একটি বাম সরকারের জন্য আহ্বান রেখেছি তাই জনতা দল (জর্জ) ও অন্যান্যদের পরিবর্তে বাম দলগুলির সঙ্গে ঐক্যের জন্য আমাদের বেশি চেষ্টা করা উচিত। এই প্রশ্নে আমাদের বুনিয়াদী নীতি থেকে আমরা সরে আসিনি। আমরাও বাম ঐক্য চাই এবং সবসময়ে তা চেয়ে এসেছি। আমাদের এক নম্বর চেষ্টা থেকেছে অন্যান্য বাম শক্তিগুলির কাছাকাছি আসা এবং তাদের সঙ্গে একসাথে এগোনো। এই প্রশ্নে আমরা পিছিয়ে আসিনি। কিন্তু অপরদিক থেকে কোনো ইতিবাচক উত্তর আসেনি। যেখানে ও যে যে বিষয়ে যৌথ কার্যকলাপ সম্ভব, আমরা সবসময়েই তাতে অংশ নেব। কিন্তু বিহারের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমরা পরস্পর বিপরীত অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি। সিপিআই(এম) সম্পর্কে বলতে গেলে, দ্বারভাঙ্গা, কাটিহার, নওদা বা রাঁচী যেখানেই হোক না কেন, অনেক গ্রামীণ এলাকায় তাদের সঙ্গে আমাদের সংগ্রাম চলেছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা রক্তাক্তও হয়ে উঠেছে। অন্য এলাকায় অন্যরকম হতে পারে, কিন্তু বিহারের এই সমস্ত গ্রামীণ এলাকায় সিপিআই(এম) সামন্তশক্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছে। এই কারণে বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে এইসব সংগ্রাম চলছে সিপিআই(এম) ও সিপিআই(এমএল)-এর মধ্যে, কিন্তু গভীরে গেলে দেখা যাবে এই সংগ্রাম হল প্রত্যক্ষ শ্রেণী সংগ্রাম। গরিব কৃষক ও কৃষিশ্রমিকরা রয়েছে আমাদের দিকে, আর তারা রয়েছে সামন্তশক্তির দিকে।

আমরা সিপিআই-এর বিরুদ্ধে কিছু রাজনৈতিক আক্রমণ চালিয়েছি। কিন্তু এর লক্ষ্য সিপিআই-কে পরিত্যাগ করা নয়। আমরা এই কারণেও আক্রমণ চালাইনি যে সিপিআই-এর সঙ্গে আমাদের সব সম্পর্ক চুকে গেছে। বিপরীতে, সিপিআই-এর মধ্যে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে তাকে তীব্র করে তুলতে আমরা এই আক্রমণ চালিয়েছি এবং আমরা কিছু সফলতা অর্জন করেছি। আমরা তাঁদের কিছু নেতার সঙ্গে সাক্ষাত করেছি এবং তাঁরা তাঁদের পার্টির মধ্যকার বিতর্ক সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন। তাঁরা আমাদের জানিয়েছেন যে তাঁদের মধ্যকার একটি অংশ লালু না জর্জ কার সঙ্গে সমঝোতা করা হবে সে সম্পর্কে মাথা না ঘামিয়ে প্রথমে সিপিআই(এমএল)-এর সঙ্গে সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ করে তোলার কথা ভাবেন। তাঁদের মতে উভয় পার্টি একসঙ্গে বসে ঠিক করুক যে কাদের সঙ্গে সমঝোতা করা হবে। আমাদের লক্ষ্য এই বিতর্ককে তীব্র করা। সিপিআই(এম) যেখানে অনেক বেশি কট্টর, সেই তুলনায় সিপিআই তাদের অবস্থানের প্রায়শই পরিবর্তন ঘটায়। তাই কখনও কংগ্রেসের সঙ্গে আবার অন্য কোনো সময়ে অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে চলা তাদের পক্ষে অসুবিধাজনক নয়। এই সুবিধাবাদ  একদিকে যেমন সিপিআই-এর দুর্বল দিক, তেমন অন্য অর্থে ইতিবাচক দিকও বটে। আশা করা যায় সিপিআই আবার একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে যেতে পারে। যদি আমাদের শক্তিবৃদ্ধি ঘটে এবং যদি সিপিআই-এর কাছে মনে হয় যে লালুর পরিস্থিতি টলমল করছে ও আমাদের সঙ্গে জোট গড়া শক্তিশালী হবে, তাহলে তারা লালুর সঙ্গ ছেড়ে সিপিআই(এমএল)-এর দিকে চলে আসবে। তাই সমস্ত স্তরে সিপিআই-এর সঙ্গে আমাদের আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।

এখানে কিছু কমরেড আর একটি বিষয় তুলেছেন; বন্যা, আন্ত্রিক ইত্যাদি সমস্যায় জনগণ ভুগছেন, কিন্তু আমাদের দিক থেকে এইসব ইস্যুতে সাধারণভাবেই উদ্যোগের অভাব থাকছে। আমি মনে করি কমরেডরা ইতিবাচক সমালোচনাই করেছেন। রাজ্য নেতৃত্বকে এ সম্পর্কে ভাবতে হবে এবং আমাদের সেই রকম এক রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে হবে যারা বিহারের জনগণের সমস্ত সমস্যার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এই ধরনের সমস্যা দেখা দিলে নেতৃত্বকে বিবৃতি দিতে হবে এবং পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে নিজেদের টিম পাঠাতে হবে। তা না হলে আমাদের পরিচিতি একপেশে হয়ে পড়বে।

এখন আমাদের কাছে পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হল নির্বাচন। এই নির্বাচনে আমাদের রয়েছে এক সীমিত লক্ষ্য। সীমিত লক্ষ্য বলতে আপাতত আমাদের স্বীকৃত রাজ্য পার্টির মর্যাদা পেতে হবে এবং এই নির্বাচনেই তা নিশ্চিত করতে হবে। এই মর্যাদা পেতে গত নির্বাচনে আমাদের দরকার ছিল ১৪ থেকে ১৫ লক্ষ ভোট এবং এক্ষেত্রে আমাদের ৪-৫ লক্ষ ভোট কম ছিল। এই নির্বাচনে আমাদের লক্ষ্যপূরণ করতে হবে। আমরা কতগুলি আসনে জিতলাম বা হারলাম সেটি অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল গত নির্বাচনে যদি ১০ লাখ ভোট আমাদের লক্ষ্য হয়ে থাকে, তবে এবার লক্ষ্য হওয়া উচিত ২০ লাখ ভোট। বিহারে স্বীকৃত পার্টির মর্যাদা অর্জন করতে আমাদের এই লক্ষ্য থাকা দরকার। রাজ্যে স্বীকৃত পার্টির মর্যাদা পেলে তা জাতীয় ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাবে। আমি তাই এটি এক চ্যালেঞ্জ হিসাবে আপনাদের গ্রহণ করতে বলছি।

পরিশেষে, আমি ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলার কথা আবার বলব। আমি ইস্পাতদৃঢ় ঐক্যের কথা বলছি কেননা যুদ্ধ চালাতে এক বিশেষ ধরনের শৃঙ্খলা প্রয়োজন। যুদ্ধ শুরুর আগে যে কেউ তার অভিমত পেশ করতে পারেন, বিতর্কে অংশ নিতে পারেন, কিন্তু যুদ্ধ একবার শুরু হয়ে গেলে বাহিনী যেভাবে এগোবে অবশ্যই সেই অনুযায়ী প্রত্যেককে এগোতে হবে।