(২৯ থেকে ৩১ জানুয়ারি ১৯৯৭, পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধীন বিহার ইকনমিক অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ। লিবারেশন, এপ্রিল ১৯৯৭ থেকে)

ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাবৃন্দ,

আমার আগে দক্ষিণপন্থীদের প্রতিনিধি হিসাবে বিজেপির পক্ষ থেকে মিঃ সিং আলোচ্য বিষয়বস্তুর ওপর বলেছেন। আমি বোধ হয় এখানে বামপন্থীদের পক্ষ থেকে একমাত্র প্রতিনিধি। যাই হোক, দক্ষিণ দক্ষিণই, আর বাম বামই, কিন্তু এখনও পর্যন্ত বামপন্থীরাই অর্থনীতির বিষয়ে বারবার সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছেন।

আমাকে বিহারের অনুন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপর বক্তব্য রাখতে বলা হয়েছে।

বিহার যে অনুন্নত, এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না। কিন্তু ভারতের অন্যান্য অনেক রাজ্য ও অঞ্চলও একইভাবে অনুন্নত রয়ে গেছে। তাহলে বিহারের অনুন্নতি নিয়ে আলোচনার কী এমন বিশেষ ও নির্দিষ্ট প্রয়োজন আছে?

স্বাধীনতার সময়কালে, সমস্ত রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম মাথাপিছু আয় ছিল বিহারেই এবং সেই ব্যবধানও ছিল বিরাট, যদিও ভারতের মোট উৎপাদিত খাদ্যশস্যের ৮ শতাংশ উৎপন্ন হত এই রাজ্য থেকে, সমস্ত রাজ্যগুলির মধ্যে এই রাজ্য শিল্পীয় উৎপাদনের নিরিখে ছিল চতুর্থ স্থানে এবং কয়লা ও ইস্পাতে ছিল বৃহত্তম উৎপাদক।

এখন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর বাদে এসেও দেখা যাচ্ছে, বিহারে এখনও মাথাপিছু আয় নিম্নতম, দৈনিক ভিত্তিতে মাত্র ১০ টাকার মতো, যা কিনা মূলত কৃষি অর্থনীতিভিত্তিক অন্য এক রাজ্য পাঞ্জাবের চেয়ে এক-তৃতীয়াংশেরও কম। আর এই সম্মেলনে গত দুদিন আগে ডঃ ভাল্লা যা বলেছেন তা যদি বিশ্বাস করতে হয় তবে ভারতের মধ্যে বিহারই একমাত্র রাজ্য যেখানে মাথাপিছু আয় বছরের পর বছর আসলে নীচে নেমে আসছে।

এই চিরস্থায়ী পশ্চাদপদতা, বিহারের অনুন্নতির বা অনুন্নয়নের দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা এক সর্বাঙ্গীন ও গভীর অধ্যয়নের দাবি জানায়।

বিহার একটা ফাঁদে পড়ে গেছে, এক দারিদ্রের ফাঁদে, একটা আবর্তের মধ্যে এবং এখান থেকে তার বের হয়ে আসা মোটেই সহজ কাজ নয়।

বারবার আশা জেগেছিল, যেমন ধরুন ৫০-এর দশকে, যখন অর্থনীতি এক সন্তোষজনক হারে সম্প্রসারিত হয়েছিল, তেমনি ৭০-এর দশকের শেষভাগ থেকে ৮০-র দশকের মধ্যভাগে, যখন খাদ্যশস্যের সামগ্রিক উৎপাদন বেড়ে গিয়েছিল এবং কৃষি থেকে আয়ের পরিমাণ প্রায় ২৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।

৯০-এর দশকেও, পরিসংখ্যান দেখিয়ে দেয় খাদ্যশস্য উৎপাদনে উচ্চবৃদ্ধির হার এবং উচ্চফলনশীল চাষের এলাকায় প্রকৃত অর্থেই বৃদ্ধির চিত্র। একর প্রতি রাসায়নিক সার বিনিয়োগের পরিমাণও ১৯৮৯-৯০-এর ৫৪.১৪ কেজির তুলনায় ১৯৯৪-৯৫ সালে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪.৫১ কেজিতে। পরিবারভিত্তিক সঞ্চয়ের বৃদ্ধি ঘটেছে উল্লেখযোগ্যভাবে, জেভিজি-র মতো নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্সিয়াল সংস্থাগুলির বিস্ময়কর বৃদ্ধিই এর সাক্ষ্য দেয়। ৯০-এর দশকে, আশা বিশেষভাবে জেগেছিল সামাজিক ন্যায়ের শাসকদের ক্ষমতায় অভিষেক হওয়ার সাথে সাথে, যে শাসককূল শক্তিশালী সমর্থন পেয়েছিল জাত-শ্রেণীর বিচারে মধ্যবর্তী জাতগুলির, যারা ছিল প্রধানত মধ্য কৃষক।

এখন ক্ষমতায় থাকার প্রায় ৭ বছর পরে এসে দেখা যাচ্ছে, এই সরকার দেশের বৃহত্তম দুর্নীতিতে টলমল করছে, বিহার রাজনৈতিক অস্থিরতার আর এক পর্বে প্রবেশ করেছে এবং বিহার পূর্বাবস্থাতেই ফিরে এসেছে।

এটা সত্য যে, জনসংখ্যাগত ও প্রযুক্তিগত কারণগুলিও বিহারের অনুন্নতির জন্য দায়ী। ভারতে কেরালার পর উত্তর বিহারেই জনগণের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘনত্ব রয়েছে, কিন্তু এই সমগ্র এলাকায় কোনো খনিজ সম্পদ নেই। আরও বলতে গেলে, এটা একটা বন্যাকবলিত এলাকা। এরপর বর্তমানে কয়লার বদলে বেশি ব্যবহার হচ্ছে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অভ্রের বদলে ফাইবার অপটিকস। এর ফলে ছোটনাগপুরের বিশেষ স্ট্র্যাটেজিক সুযোগ-সুবিধা গুরুতরভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে।

তবুও বিহারের অনুন্নতির জন্য এগুলিই কেবলমাত্র কারণ নয়।

এই চিরস্থায়ী পশ্চাদপদতার অন্যতম বড় দিক হল বাহ্যিক অর্থাৎ জাতীয় অর্থনীতির বিপরীতে বিহারের অর্থনীতির অবস্থান। আন্তর্জাতিক স্তরে উত্তর-দক্ষিণ বিভাজন টানা হয় এইভাবে যে দক্ষিণের অনুন্নত থেকে যাওয়ার সাথে উত্তরের সমৃদ্ধির এক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। একে অপরের শর্তস্বরূপ। একইরকমভাবে কিছু লোক তুলনা টানেন যে বিহারের ব্যাপার অল্প কয়েক রাজ্যের অর্থনীতির সমৃদ্ধির সাথে সম্পর্কযুক্ত। বহু অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী বিহারকে এক অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ বলে আখ্যায়িত করেছেন। বিহার কৃষি ও শিল্পে এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলিতে সস্তা শ্রম ও কাঁচামাল সরবহারকারীতে পরিণত হয়েছে। কয়লা ও ইস্পাতের ক্ষেত্রে অভিন্ন মূল্যনীতির ফলে স্থানীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়া থেকে ছোটনাগপুর শিল্পাঞ্চল বঞ্চিত হয়।

তারপরে আবার গ্যাডগিল সূত্র আসার আগে পর্যন্ত, পরিকল্পনা বণ্টনপ্রণালী বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মতো জনঅধ্যুষিত রাজ্যগুলির বিরুদ্ধেই গেছে। এমনকি তারপরেও, ৭ম যোজনায় পরিকল্পনা বণ্টনের ক্ষেত্রে বিহারের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল মাথাপিছু ৬২২ টাকা, যা জাতীয় গড় মাথাপিছু ৯২০ টাকার চেয়ে অনেক কম। সরকারি ও বেসরকারি – সব ক্ষেত্রেই মাথাপিছু বিনিয়োগ অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বিহারে ৮০-র দশক সহ গত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে নীচেই থেকেছে। সঞ্চয়ের ভালো অংশই রাজ্যের বাইরে চলে যায়। আইডিবিআই গ্রুপ ও ইউটিআই, এলআইসি ও জিআইসি ইত্যাদি সংস্থাগুলির দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ বিহারে সবচেয়ে কম। এমনকি বিশ্বায়ন ও উদারনীতিকরণের পর্যায়ে এখানে বিনিয়োগের চিত্র বড়ই বিবর্ণ। ১৯৯১-এর আগস্ট থেকে ১৯৯৫-এর মে মাস পর্যন্ত বিহারে সবচেয়ে কম, ঠিক ০.১৪ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগ পেয়েছে। কেন্দ্রীয় যোজনা ব্যয়ে গুরুত্ব এখন স্থানান্তরিত করা হয়েছে দারিদ্র্য নির্মূলীকরণ ও কল্যাণ প্রকল্পে যেখানে পুঁজি গঠনের উপাদান খুবই কম।

কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার, বিহারে যারা শাসন করছে সেই একই পার্টির নেতৃত্বেই পরিচালিত হলেও বিহারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে কোনো ভরসা যোগায় না। এই সরকার, বিপরীতে, এগিয়ে থাকা রাজ্যগুলির শক্তিশালী লবিগুলির চাপের প্রভাবেই রয়েছে।

গোদের উপর বিষফোঁড়া এই যে বিহারে অপদার্থ প্রশাসন থাকার জন্য পরিকল্পনা খাতে বরাদ্দ অর্থের অর্ধেকটুকু ব্যয় করা হয় না।

চিরস্থায়ী পশ্চাদপদতা অথবা অভ্যন্তরীণ উপনিবেশের অবস্থা তাহলে স্রেফ কেন্দ্রীয় বরাদ্দ আরও বাড়িয়ে বা আরও বেশি বিদেশী পুঁজি আগমনের প্রতীক্ষায় থেকে ভেঙ্গে ফেলা যাবে না। আঞ্চলিকতাবাদের অনুশীলন প্রান্তিক হয়ে যাওয়া রাজনীতিবিদদের জন্য ভালো রাজনীতি হতে পারে কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তা অবশ্য খুবই খারাপ।

অচলায়তনটি ভেঙ্গে ফেলার ভরবেগকে অবশ্যই আসতে হবে ভিতর থেকে, অভ্যন্তরীণ ব্যাপক সম্পদ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। আর এখানেই আমরা অনুন্নত অবস্থার পিছনে থাকা অন্য প্রধান দিকটির দিকে অভিনিবেশ করব, আর এটিই হল বিহারের অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ গতিসূত্র।

প্রথমত, ভূমি সংস্কারের ক্ষেত্র। উদ্যোগী ক্ষুদ্র চাষিদের হাতে জমি দিতে জমির আমূল পুনর্বণ্টন করা খুবই জরুরি প্রয়োজন। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের আওতায় থাকা ক্ষুদ্র জোতগুলি যাতে অর্থনৈতিকভাবে কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে তার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য-সহযোগিতা করা উচিত।

আমূল ভূমিসংস্কার কার্যকরী করতে, সমগ্র কার্যক্রম নিখুঁতভাবে করে উঠতে, রাজনৈতিক দলকে সমস্ত জমির জাতীয়করণ পর্যন্ত এগোতে প্রস্তুত হতে হবে এবং লিজের ভিত্তিতে উদ্যোগী ক্ষুদ্র চাষিদের হাতে ঐ সমস্ত জমির পুনর্বণ্টন করতে হবে। বড় ও ছোটো চাষি উভয়েই যাতে কৃষি মজুরদের ন্যূনতম মজুরি দেয় তা নিশ্চিত করাও সমানভাবে প্রয়োজনীয়।

দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ এবং আধা-শহরাঞ্চলের সঞ্চয়ের বেশি অংশ অবশ্যই রাজ্য সরকারি সংস্থাগুলির মাধ্যমে পুনরায় চাষাবাদে বিনিয়োগ করার সাথে সাথে পরিকাঠামো গড়ে তোলা ও সামাজিক পরিষেবা উন্নত করার কাজে লাগাতে হবে।

তৃতীয়ত, বিহারে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি যাতে ঋণ-আমানত অনুপাতকে উন্নত করে এবং আইডিবিআই গ্রুপ, এলআইসি, জিআইসি এবং ইউটিআই ইত্যাদি নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক ঋণদানকারী সংস্থাগুলি যাতে তাদের বিনিয়োগ বাড়ায় তার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে হবে।

চতুর্থত, তার পশ্চাদপদতার ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা থাকার দরুণ বিহারের প্রতি অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত।

কেবলমাত্র অভ্যন্তরীণ স্পন্দনের প্রেক্ষিতেই শিল্পীয় বিকাশের জন্য বিদেশী পুঁজি সহ, পুঁজি আকর্ষণ করার ব্যবস্থাগুলি অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে।

বিহারের সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশার ব্যাপারে ভারতের শাসক প্রতিষ্ঠান আদৌ কোনো চিন্তা করে না। ভোগবাদকে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তারা এখনও পর্যন্ত বিহারে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় মারুতি গাড়ি বিক্রি করতে পারে। লুই ফিলিপি এবং মন্টে কার্লোর মতো প্রচণ্ড দামী পোশাক পরিচ্ছদ পাটনাতেই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। বিহারের বেশিরভাগ সঞ্চয় থেকেই দ্রুত গড়ে তোলা হচ্ছে জে ভি জি সাম্রাজ্য। বিহারী সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত মস্তিষ্ক সমবসময়ই জেএনইউ এবং দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে চালান হয়ে যেতে পারে।

বিহারের সাধারণ জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের, যারা বিহারের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক অংশের ভুখা পেটে থেকে যাওয়ার ঘটনায় অত্যন্ত বিচলিত হয়ে উঠছেন, তাঁদেরকেই এই অচলায়তন ভাঙ্গতে উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু আপনি তা এমন একটি রাজনৈতিক দলের কাছে প্রত্যাশা করতে পারেন না যে দুর্নীতিতে আপাদমস্তক ডুবে রয়েছে, এটি আমলাতন্ত্রের মাধ্যমেও অর্জন করা সম্ভব হতে পারে না যারা সামস্ত শক্তিগুলির সঙ্গে গভীর আঁতাতবদ্ধ রয়েছে।

এক দুর্নীতিমুক্ত নেতৃত্ব, যাদের বিহারের বিকাশসাধনের প্রশ্নে বিরাট দূরদৃষ্টি আছে, যারা সুবিধাভোগীদের জাতপাতগত গোষ্ঠীসংঘাতের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেন, যাদের তৃণমূলস্তরের শক্তিশালী গণউদ্যোগের সাথে মেলবন্ধন রয়েছে, তারাই বিহারের দারিদ্র্য-ফাঁদের শৃঙ্খলকে ভাঙ্গতে পারেন।

হয় আপনাকে আমূল সমাধানের রাস্তা নিতে হবে, নয়তো চিরাচরিত পশ্চাদপদতা অনুসরণ করে যেতে হবে, এই দুইয়ের মাঝে কোনো মধ্যবর্তী রাস্তা খোলা নেই। আর বিহারের উগ্রপন্থার উত্থান ঘটছে বলে নাকিকান্না কেঁদেও কোনো লাভ নেই। ইতিহাসে, চরম পরিস্থিতিগুলি চরম সমাধানই দাবি করে।

সংকট যব বিক্রল হো যাতা হ্যায়, মহাভারত তব অনিবার্ষ হোতা হ্যায়! (সংকট যখন বিশাল আকার ধারণ করে তখন মহাভারতও অনিবার্য হয়ে ওঠে!)