(১৯৯৪-এর মার্চে সাউথ এশিয়া সলিডারিটি গ্রুপের পক্ষ থেকে এই সাক্ষতকার নেন কল্পনা উইলসন)

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে সমাজতন্ত্রের তথাকথিত সংকট সম্পর্কে আপনার ব্যাখ্যা কী?

প্রধানত, আমি মনে করি সমাজতন্ত্র নিজেই এক স্বয়ংসম্পূর্ণ বা স্থিতিশীল ব্যবস্থা নয়। সমাজতন্ত্র হল পুঁজিবাদ ও সাম্যবাদের মধ্যে এক উত্তরণশীল ব্যবস্থা। তাই এটি এক বিশিষ্ট পরিঘটনা। এর মধ্যে অবশ্যই সাম্যবাদের – অর্থাৎ যে সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে – তার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, আবার এর মধ্যে পুঁজিবাদেরও কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য এই অর্থে বজায় থেকে যায় যে – মার্কস যেমন বলেছেন – প্রত্যেককে তার কাজ অনুযায়ী দেওয়ার ‘বণ্টনের নীতি’ও কার্যত অপরিপর্তিত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক কোনো সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের মালিকানাধীন একটি কারখানা রয়েছে। সেখানে একজন শ্রমিকের মনে হতে পারে যে তিনি জনগণেরই অংশ এবং সেই অর্থে তিনিও কারখানাটির মালিক। অন্যদিকে তিনি যেহেতু তাঁর কাজ অনুযায়ী পারিশ্রমিক পেয়ে থাকেন, তাঁর মনে হয় যে তিনি একজন মজুরি শ্রমিক। সুতরাং এই দ্বৈত সত্তাই একজন শ্রমিকের চেতনায় ক্রিয়াশীল থাকে।

মালিকানার প্রশ্নে, একাধারে এটি সমগ্র জনগণের মালিকানা; অপরদিকে এই মালিকানা রাষ্ট্রীয় মালিকানার দ্বারা পরিচালিত হয় (কারণ সমাজতান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব তখনও থেকে যায়) এবং রাষ্ট্র-নিযুক্ত পরিচালকরা তা কার্যকরী করে থাকেন। সুতরাং মালিকানার চরিত্রও দ্বৈত স্বরূপ বিশিষ্ট এবং তা আমলাতন্ত্রে অধিঃপতিত হয়ে যেতে পারে। শ্রমিক এবং মালিকানা এই দ্বৈত সত্তা উত্তরণকালীন সমাজের বৈশিষ্ট্য।

এটিও ঘটনা যে আমরা সমাজতন্ত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছি কোনো উন্নত পুঁজিবাদী দেশে নয়, কয়েকটি পশ্চাদপদ দেশে। উৎপাদিকা শক্তি পিছিয়ে পড়া, তাই চটজলদি কোনো উন্নততর মালিকানাব্যাবস্থার প্রবর্তন করা সম্ভব নয়। নানা ধরনের মালিনাকার অস্তিত্ব এখানে বিদ্যামান থাকে – সমগ্র জনগণের মালিকানা, যৌথ মালিকানা, ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত উদ্যোগসমূহ ... কেবলমাত্র ক্রমে ক্রমেই অন্য পর্যায়ে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। পণ্য সম্পর্কগুলি, মুদ্রা – এসবের অস্তিত্ব কেবলমাত্র যে বহাল থাকে শুধু তাই নয়, এগুলির যথেষ্ট ভূমিকা থেকেই যায়, কারণ পুঁজিবাদ তখনও নিঃশেষিত হয়নি। বেশ কিছু বিনিময় আসলে পণ্য বিনিময় বা বাজার বিনিময়ই রয়ে যায়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, জনগণের মালিকানাধীন উদ্যোগ ও যৌথ মালিকানাধীন উদ্যোগের মধ্যে বিনিময় তথা বিভিন্ন স্তরে উদ্যোগগুলির মধ্যে বিনিময় – সবই মূলত পণ্য বিনিময়। সমাজতান্ত্রিক সমাজের এই বৈশিষ্ট্যের কারণে, বিশেষত পিছিয়ে পড়া দেশগুলিতে সমাজতন্ত্রের অনুশীলনের ফলে সমাজতন্ত্রের দুটি সম্ভাবনাই থেকে যায় – তা সাম্যবাদের দিকেও এগিয়ে যেতে পারে অথবা পুঁজিবাদের পিচ্ছিল পথেও ফিরে যেতে পারে।

শুরুতে ধারণা ছিল যে, সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুকাল পরে তা সাম্যবাদে পৌঁছে যাবে। কিন্তু পরবর্তীতে মার্কসবাদের তাত্ত্বিক বিকাশ ঘটেছে। লেনিন বলতে থাকেন যে, এই উত্তরণ দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ এবং তারপরে চীন দেশে মাও বলেন যে, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মধ্যে কে জিতবে তা এখনো নির্ধারিত হয়নি এবং এটি নির্ধারিত হতে কয়েকশো বছর সময় লাগতে পারে। নির্দিষ্ট যেসব পরিস্থিতিতে সমাজতন্ত্র গড়ে তুলতে হয়েছে সেই কারণেই এই পরিবর্তন সাধিত হয়। আর সমাজতান্ত্রিক সমাজেও শ্রেণীদ্বন্দ্ব, শ্রেণীসংগ্রামের অস্তিত্বের সূত্রায়নগুলি উপস্থিত হতে থাকে অথচ মার্কসবাদের আদি প্রবক্তারা সমাজতন্ত্র বলতে শ্রেণীহীন সমাজের কথাই ভেবেছিলেন। তাই আমি মনে করি মার্কসের মূল তত্ত্বে কেবল এক সাধারণ রূপরেখা প্রদান করা হয়েছিল। কারণ তাঁর সমগ্র ধারণা গড়ে উঠেছিল পুঁজিবাদী সমাজের বিশ্লেষণের ওপর ভিত্তি করে, তাও আবার বিমূর্ত স্তরে, আদর্শ পুঁজিবাদী সমাজের প্রেক্ষিতে। নির্দিষ্ট অর্থে, এমনকি অত্যন্ত উন্নত পুঁজিবাদী সমাজের সাথেও মার্কসের আদর্শ মানদণ্ডগুলি পুরোপুরি মিলে যায় না। সুতরাং পুঁজিবাদের অধ্যয়ন সম্পূর্ণ হয়েছে – একথা বলতে আপনি পারেন না। কারণ পুঁজিবাদ আজও বিদ্যমান, তা অত্যন্ত দ্রুত বেড়ে উঠছে এবং এর দৌড় শেষ হয়ে যায়নি। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, সমাজতন্ত্র ও তার অর্থনৈতিক নিয়মগুলি সম্পর্কে অধ্যয়ন আজও রয়ে গেছে খুবই আদিম ও প্রাথমিক স্তরে। এইসব কারণে আমার মনে হয় মার্কসবাদের পুনর্জাগরণের জন্য বর্তমানে যা দরকার, জনপ্রিয় ভাষায় বলতে গেলে তা হল নতুন দাস ক্যাপিটাল। এজন্য সময়ও পরিপক্ক হয়ে উঠেছে। মূল ভিত্তিগুলি রয়েছে, সেগুলির কার্যকারিতাও অব্যাহত, কিন্তু পুঁজিবাদের অধ্যয়ন সম্পূর্ণ হয়নি। এমনকি লেনিনও একচেটিয়া পুঁজিবাদ সম্পর্কে অধ্যয়ন করার সময়ে এই ধারণা পোষণ করতেন যে একচেটিয়া পুঁজিবাদ হল পুঁজিবাদের শেষ পর্যায় এবং তা মুর্মূষু ও ধ্বংসোন্মুখ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, একচেটিয়া পুঁজিবাদ নতুন নতুন রূপ পরিগ্রহ করছে ও টিকে থাকছে। তাই নতুন করে অধ্যয়নের প্রয়োজন। সেইসঙ্গে প্রয়োজন রাশিয়ার ৭৫ বছরের অভিজ্ঞতা ও পরবর্তীতে চীনের অভিজ্ঞতা থেকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির নিয়মগুলিকে অধ্যয়নের গুরুত্ব। ... সেজন্যই আমার মনে হয় মার্কসবাদের জন্য পুঁজি গ্রন্থের তুলনীয় এক বিস্তৃত অধ্যয়নের প্রয়োজন – বিশেষত যখন দেখা যাচ্ছে যে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবই চলছে চীন, ভিয়েতনাম ইত্যাদি পিছিয়ে পড়া দেশগুলিতে। সমাজতন্ত্র যদি কয়েকশো বছর ধরে এক উত্তরশীল সমাজ হিসাবে থেকে যায় তাহলে তার অর্থ হল পণ্য, মুদ্রা ও বাজারকে নিছক এক বাধ্যতা হিসাবে দেখলে এবং এগুলিকে অতিক্রম করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করলেই চলবে না। বরং এমনকি সমাজতান্ত্রিক সমাজেও এগুলির আরও বিকাশের প্রয়োজন হতে পারে, সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থেই এগুলিকে বিশেষভাবে কাজে লাগিয়ে নিতে হতে পারে। এগুলি নিছক বর্জনীয় ব্যাপার নয় বা ক্ষতিকারক হলেও আপাতত মানিয়ে নিয়ে চলতে হচ্ছে, এমন বিষয় নয়। পরিকল্পনাকে সমাজতন্ত্রেরই এক বৈশিষ্ট্য বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে, অথচ আমরা দেখেছি যে পুঁজিবাদী সমাজ তার অঙ্গস্বরূপ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নৈরাজ্যকে ঠেকানোর জন্য পরিকল্পনাকে ব্যবহার করেছে। অনুরূপভাবেই তাই, কমিউনিস্টদেরও সমাজতন্ত্র গঠনের জন্য পণ্য, মুদ্রা ও বাজারকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে নেওয়ার কথা ভাবতে হবে।

মার্কস যখন বলেন সমাজতন্ত্র হল এক উত্তরণকালীন ব্যবস্থা, তখন তিনি আরও একটি বিষয়ের উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, সর্বহারার একনায়কত্ব একেবারেই অপরিহার্য। সে কারণেই আমার মনে হয়, যেখানে সর্বহারা একনায়কত্বকে দুর্বল করে ফেলা হয় সেখানে এই উত্তরণশীল ব্যবস্থা থেকে পিছলে পুঁজিবাদের দিকে ফিরে যাওয়া অবধারিত। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, যদি আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে তাকাই, আমরা দেখব যে তার পতনের আগে যে অর্থনৈতিক মডেল সেখানে চালু ছিল তা মোটের উপর চিরাচরিত সমাজতান্ত্রিক মডেলই ছিল। সবই ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের আওতায়,  বেসরকারিকরণ ও বিদেশী পুঁজি ছিল কার্যত অনুপস্থিত। কিন্তু ক্রুশ্চেভের আমল থেকেই সেখানে সর্বাহারা একনায়কত্ব শিথিল হতে শুরু করে এবং আমরা দেখি যে সেখান থেকেই কোনো না কোনোভাবে পুঁজিবাদের প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বিপরীতে আমার মনে হয়, মাও সমাজতন্ত্রের পুঁজিবাদে প্রত্যাবর্তনের এই বিপদ সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছিলেন, পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার যে সম্ভাবনাকে রাশিয়ানরা অস্বীকার করেছিল তা নিয়ে তিনি চিন্তাভাবনা করেছিলেন।

সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধারণাকে মাও সমাজতন্ত্রের অর্থনৈতিক নিয়মগুলি উপেক্ষা করার উদ্দেশ্যে সামনে আনেননি বা পিছিয়ে থাকা উৎপাদিকা শক্তিকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে কোনো এক ধরনের অগ্রণী সাম্যবাদী উৎপাদন সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কল্পনা করা হয়নি। এর মধ্যে দিয়ে মাও আসলে সর্বহারা একনায়কত্বকে জোরদার করতে চেয়েছিলেন। ৯০ শতাংশ জনগণের গণতন্ত্রেরই অপর নাম হল সর্বহারার একনায়কত্ব। আর এটিই তিনি সাংস্কৃতিক বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন : অল্প কিছু লোকের ওপর একনায়কত্ব ও ৯০ শতাংশ জনগণের জন্য গণতন্ত্র। তাই সাংস্কৃতিক বিপ্লব বড় হরফের পোস্টার, গণউদ্দীপনা ইত্যাদির উপরেই জোর দিয়েছিল। রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে সর্বহারা একনায়কত্বকে বোঝা হত নিছক একনায়কত্ব হিসাবে। অন্য দিকটি অর্থাৎ ৯০ শতাংশের জন্য গণতন্ত্র – সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের এই প্রশ্নকে সর্বহারার একনায়কত্বের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে তাঁরা উপলব্ধি করেননি। তাই গণতন্ত্রের প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এল অন্য শক্তিগুলি। চীনেও সবসময়ই এই প্রশ্ন ছিল এবং সমাজতন্ত্রের অধীনে এই গণতন্ত্রের সাধারণীকরণের জন্য মাও সর্বপ্রথম প্রচেষ্টা চালান। গণতন্ত্রের জন্য এই আকাঙ্খারই পুনঃপ্রকাশ ঘটেছিল তিয়েন-আন-মেনে, আর আমার তো মনে হয়, প্রতি দশ বছর কিংবা প্রতি পাঁচ বা সাত  বছর অন্তর আমরা জনগণের কোনো না কোনো বড় ধরনের আন্দোলন প্রত্যক্ষ করছি। এই বিষয়টিকে যদি সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে হাতে নেওয়া না হয় তাহলে লোকে বুর্জোয়া কাঠামোর মধ্যে এটি তুলে ধরবে।

যাই হোক, সাংস্কৃতিক বিপ্লব ছিল এ প্রশ্নেই একটি পরীক্ষা। একথা সত্যি যে, কিছু পেটি বুর্জোয়া সামাজিক শক্তির আবির্ভাব ঘটে এবং সমগ্র সাংস্কৃতিক বিপ্লব পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। আর কিছু কিছু ব্যক্তি সমাজতন্ত্রের মৌলিক অর্থনৈতিক নিয়মগুলি লঙ্ঘন করে কিছু উচ্চতর সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা চালাতে শুরু করে। এই বিপ্লবে যার হাতিয়ার হওয়ার কথা সেই পার্টিই অসংগঠিত হয়ে পড়ে। এভাবে ব্যর্থতার মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু আমার বক্তব্য হল, সাংস্কৃতিক বিপ্লব সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলি উত্থাপন করেছিল। জনগণের মধ্যে তা বিপুল উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল, যদিও তাকে যথাযথভাবে সংগঠিত করা যায়নি, আর সেটিই ছিল এক সমস্যা।

চীনে বর্তমানে তাঁরা অর্থনৈতিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন আর কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বকেও অটুট রেখে চলেছেন। আমি অবশ্যই একে ভালো মনে করি এবং এক গবেষণা হিসাবে এটি পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়নের দাবি রাখে। কিন্তু অন্য দিকটিও, গণতন্ত্রের জন্য আকাঙ্খাও, সেখানে বর্তমান। চীনে পুনরায় কোনো না কোনো ধরনের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দেখা দেবে। কোনো দেশ কেবলমাত্র কিছু অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকতে পারে না। আমার মনে হয় সেখানে আবারও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের শিক্ষাগুলি কাজে লাগবে, অন্তত প্রসঙ্গক্রমেও তার উল্লেখের দরকার হবে। সমজতন্ত্রের সংকট বা সমাজতন্ত্রের সমস্যাগুলিকে এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই আমি দেখে থাকি।

ভারতের পটভূমিতে বাজার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করেন? এই অনুশীলনকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সিপিআই(এমএল)-এর দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে?

চীনের ক্ষেত্রে দেখবেন, এমনকি গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর্যায়েও মাও বুর্জোয়াদের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া ও জাতীয় বুর্জোয়া – এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিলেন। এজন্য তাঁকে প্রচণ্ড সমালোচিত হতে হয়। তিনি মুৎসুদ্দি আমলাতান্ত্রিক পুঁজির কথা বলেছিলেন। এরা ছিল বিপ্লবের লক্ষ্যবস্তু। মাও দুটি জিনিসের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন : একটি হল কৃষকদের সঙ্গে মৈত্রী, আর এই প্রক্রিয়ায় তিনি কৃষকদের এক বিপ্লবী শক্তিতে রূপান্তরিত করেন। এ ছিল মার্কসবাদে, অন্ততপক্ষে বিপ্লবী রণনীতিতে এক নতুন অবদান। তাঁর অবদানের অপর দিকটি হল জাতীয় বুর্জোয়াদের সাথে মৈত্রী স্থাপন। গণতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সমাজতন্ত্র গড়ে তুলতে গিয়ে তিনি জাতীয় বুর্জোয়াদের রূপান্তরসাধনের বিষয়টি ধাপে ধাপে এক দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। নিছক তাদের মালিকানাস্বত্ব বিলোপের পরিবর্তে তিনি তাদের ব্যবহার করে নিতে এবং রূপান্তর করতে প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। এজন্য তাঁকে নিন্দা করা হয়, কারণ এটি নাকি সত্যিকারের সমাজতন্ত্র নয়। কিন্তু আমি মনে করি ভারতবর্ষের পরিস্থিতিতেও এই প্রশ্নের বিরাট গুরুত্ব থেকে যাবে। চীনের জাতীয় বুর্জোয়ারা ছিল খুব দুর্বল ও গুরুত্বহীন। ভারতে যখন বিপ্লব বিজয় অর্জন করবে ততদিনে বুর্জোয়াদের মধ্যে খুব সম্ভব ভাঙ্গন দেখা দেবে বলে আমি মনে করি। আর সেক্ষেত্রে বুর্জোয়াদের একাংশের সাথে – যারা ততদিনে জাতীয় বুর্জোয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে – আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা চালাতে হবে। আর ভারতীয় পরিস্থিতিতে ঐ জাতীয় বুর্জোয়ারা হবে রীতিমতো শক্তিধর। এমনকি কৃষকদের সাথে মৈত্রীর ক্ষেত্রেও, মধ্য কৃষক অথবা চাষিদের মধ্যেও একটি বড় অংশের উদ্ভব ঘটেছে যাদের মধ্যে রয়েছে পুঁজিবাদী প্রবণতা। রাজনৈতিক ফ্রন্টে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরসাধনের প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে এই সমস্ত শক্তির সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং সমাজতন্ত্রের স্বার্থে তাদের কাজে লাগিয়ে নেওয়া – ভারতে আমরা এইসব বিশেষ প্রশ্নের সম্মুখীন।

কেউ কেউ বলে থাকেন, যেহেতু ভারতের বুর্জোয়ারা মুৎসুদ্দি, আর মুৎসুদ্দি মানে সাম্রাজ্যবাদের দালাল, তাই ভারতে রাষ্ট্রক্ষমতা রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের হাতে। সিপিআই(এমএল) গড়ে তোলার সময়ে, ১৯৬৯-৭০ সালে, যখন তার কর্মসূচির খসড়া তৈরি হচ্ছিল তখন আমরা এ প্রশ্নে এঁদের সাথে মতপার্থক্য রেখেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, এটি ভুল। আমরা মনে করি ভারতে রাষ্ট্রক্ষমতা হয়েছে ভারতীয় বুর্জোয়া ও জমিদারদের হাতে। ক্ষমতা হস্তান্তরের এটিই হল সামগ্রিক মর্মবস্তু – এটি নিছক কোনো টেকনিক্যাল বিষয় ছিল না। শ্রেণীগত অর্থে তারা সাম্রাজ্যবাদের কাঠামোর মধ্যে থেকেই কাজ করে, কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা রয়েছে তাদেরই হাতে। যাঁরা মনে করেন যে সাম্রাজ্যবাদ ভারতীয় রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাঁদের সূত্রায়ন হল সাম্রাজ্যবাদের সাথে দ্বন্দ্বই ভারতের প্রধান দ্বন্দ্ব। তাই তাঁরা বলেন যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এক ব্যাপক ফ্রন্টের প্রয়োজন। হ্যাঁ, সাম্রাজ্যবাদের সাথে আমাদের এক মৌলিক দ্বন্দ্ব আছে – কিন্তু তা আছে এক বাহ্যিক অর্থে – জাতি বনাম সাম্রাজ্যবাদ হিসাবে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ দিক থেকে আমরা একে প্রধান দ্বন্দ্ব বলে মনে করি না।

স্বভাবতই এখন যে প্রশ্ন উঠে আসে তা হল, এই মুৎসুদ্দিদের আসল চরিত্র কী? আমরা বলেছি যে এই বিষয়টি আমাদের নতুনভাবে দেখতে হবে। যদি আপনি তাদের অত্যন্ত মোটা দাগে, নিছক দালাল হিসাবে সূত্রায়িত করেন সেটি সঠিক হবে না। আমরা বলেছি যে ভারতীয় বুর্জোয়ারা একটি শ্রেণী হিসাবেই কাজ করে, তাদের বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন দেশের সাথে সম্পর্ক থাকতে পারে, কিন্তু তাদের মধ্যে এক সাধারণ যোগসূত্র রয়েছে। ভারতীয় বুর্জোয়াদের রয়েছে এক একক রণনীতি এবং তারা কিছুটা আপেক্ষিক স্বাধীনতা ভোগ করে। এটি বজায় রাখা হয় বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে সম্পর্ক রেখে চলার মধ্য দিয়ে। এই স্বাধীনতা কোনো চরম অর্থে নয়, তারা সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ থেকেও মুক্ত নয়। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা রয়েছে মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া ও জমিদারদের হাতে – এ বিষয়টি বোঝার মধ্য দিয়ে এবং তাদের দরকষাকষি করার তথা এক ধরনের স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখার সামর্থকে স্বীকার করে নেওয়ার মাধ্যমে, আমাদের পার্টি পুরোনো সূত্রায়নগুলি থেকে সরে আসতে এবং বাস্তব পরিস্থিতির সাথে আরও উপযোগী হয়ে ওঠার প্রয়াস চালিয়েছে।

বর্তমানে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে এবং ভারতীয় বুর্জোয়ারা পশ্চিমী শক্তি ও আইএমএফ/বিশ্ব ব্যাঙ্কের সাথে ঘনিষ্ঠতর সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আবার পরামর্শ আসছে যে ভারত তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব হারিয়ে ফেলে কমবেশি এক নয়া উপনিবেশে পরিণত হয়েছে আর রাষ্ট্রক্ষমতা এখন রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের হাতে, আর তাই সাম্রাজ্যবাদের সাথে ভারতীয় জাতির দ্বন্দ্বই বর্তমানে প্রধান অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, সুতরাং আমাদের তার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য ব্যাপকতম মোর্চা গড়ে তোলা উচিত। লোকে বলতে শুরু করেছে যে আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারসাম্য রক্ষাকারীর ভূমিকা পালন করত এবং তার সাথে সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই ভারত পশ্চিমী দেশগুলির সাথে দরকষাকষি করতে পারত। কিন্তু এখন সোভিয়েত ইউনিয়ন বিদায় নেওয়ায় ভারত আর তা করতে পারে না। সত্যিই, পরিস্থিতির এইসব পরিবর্তন ও ভারতীয় নীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তনের কারণে সামগ্রিকভাবে সাম্রাজ্যবাদী অনুপ্রবেশ অনেক গভীরতর হয়েছে। কিন্তু তবু আমি মনে করি যে ভারতীয় বুর্জোয়াদের আপেক্ষিক স্বাধীনতা আছে। তা শেষ হয়ে যায়নি। ব্যাপক সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মোর্চায় জনপ্রিয় সমাবেশ সংগঠিত করার জন্য কেউ ‘ভারতের রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বিপদের’ কথা, ‘স্বাধীনতার সংকটের’ কথা বলতেই পারেন। কিন্তু বিষয়টি খুব আক্ষরিক অর্থে ধরা উচিত নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিদায় নিয়েছে, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে আজও দ্বন্দ্ব রয়েছে। তাই ভারত তার সম্পর্কগুলিকে কিছু ভিন্ন ধরনে বিন্যস্ত করার চেষ্টা চালাতেই পারে। যতদূর সম্ভব এইসব দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে নেওয়ার সামগ্রিক কৌশল আজও বিরাজ করছে। সোভিয়েতের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোনো সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে ছিল না, তা ছিল নেহাতই দরকষাকষির হাতিয়ার। সাধ্যমতো, রাশিয়ার সঙ্গেও তারা এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারে, জাপান, জার্মানী ইত্যাদির সঙ্গেও তারা এই প্রয়াস চালিয়ে যেতে পারে। কারণ ভারতের বুর্জোয়া অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলি খুবই বৈচিত্রপূর্ণ, আর সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যেও রয়েছে দ্বন্দ্ব, সংকট আর প্রতিযোগিতা। তাই এই দরকষাকষির সামর্থ, দ্বন্দ্বিগুলিকে কাজে লাগিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা, এই আপেক্ষিক স্বাধীনতা বর্তমানে অনেকখানি সীমাবদ্ধ হতে পারে, কিন্তু আমি মনে করি না যে এই ক্ষমতা লোপ পেয়ে গেছে। আজও রাষ্ট্র ক্ষমতা ভারতীয় বুর্জোয়াশ্রেণীর হাতেই আছে। এই বিষয়টি আয়ত্ত করা অপরিহার্য – নতুবা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব উপেক্ষিত হবে।

আমি একটি ব্যবহারিক উদাহরণ দিতে পারি, যেমন ধরুন বিহারের কথা। বিহার বর্তমানে এক পিছিয়ে পড়া রাজ্য – যেখানে সামন্ততন্ত্র যথেষ্ট পরিমাণে বিদ্যমান এবং জমি ইত্যাদির প্রশ্নে সংগ্রাম অব্যাহত। তাই আমরা জমির প্রশ্নে সংগ্রামের বিষয়টি উত্থাপন করেছি এবং এমনকি সিপিআই, সিপিআই(এম)ও এইসব ইস্যু গ্রহণ করেছে। এখানে যে সরকার রয়েছে – লালু যাদবের জনতা দল সরকার – ভূমিসংস্কার করার অবস্থায় নেই। এর জন্য না আছে তার রাজনৈতিক সদিচ্ছা না আছে কোনো কাঠামো। তাহলে তাঁদের কৌশলটি কী? হঠাৎই তাঁরা ‘ডাঙ্কেলের’ কথা বলতে শুরু করেছেন, বলতে শুরু করেছেন যে ডাঙ্কেল খুব সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার, এটি কৃষক বিরোধী ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে তাঁরা সিপিআই এবং সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছেন। আর, সিপিআই-সিপিআই(এম)ও গুরুত্ব সহকারে জমির লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অবস্থায় নেই। কারণ জমির লড়াই গুরুত্বের সঙ্গে ধরতে গেলেই উত্তেজনা ও সশস্ত্র সংঘাত বেড়ে চলতে থাকে। এসব ব্যাপারে শুধুমাত্র আইনি উপায়ে সমাধান করা সহজ নয়। তাঁরা এরকম কঠিন পরিস্থিতি এড়াতে চান, আবার এক বিপ্লবী ভঙ্গিমাও বজায় রাখতে চান। ঠিক তখনই লালু ডাঙ্কেল নিয়ে আবির্ভূত হলেন আর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার নায়ক বনে গেলেন। কিন্তু কেন তিনি এই সমস্ত জিনিসকে সামনে আনছেন? লোকটি ডাঙ্কেলের ব্যাপারে কিছুই বোঝেন না। ডাঙ্কেল হল এক গাধা – এইটুকু বলে তিনি গাধাদের নিয়ে একটি মিছিল বের করলেন। এই হল তাঁর কর্মসূচি। বিহারের পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি না যে ডাঙ্কেল খুব বেশি হৈ চৈ ফেলতে পারবে, কারণ পুঁজিবাদী চাষাবাদ এখানে সেভাবে বিকশিত হয়নি। অবশ্য, আমরাও প্রশ্নটি সামনে নিয়ে আসছি এবং এমনকি বিহারেও এবিষয়ে আমরা কর্মসূচি নিয়েছি। কিন্তু তাঁরা যেভাবে প্রশ্নটি আনছেন, তাতে বেশ বোঝা যায় যে তাঁদের সমগ্র উদ্দেশ্য হল অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে লঘু করে দেওয়া। আর, সিপিআই-ও ডাঙ্কেল প্রশ্নে জনতা দলের সঙ্গে যৌথ কার্যকলাপ শুরু করে দিয়েছে এবং জমির জন্য সংগ্রাম ত্যাগ করেছে। এসবের বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আমি যা বলতে চাইছি তা হল এই যে, বাস্তবে সত্যিই বিপদটি রয়েছে এবং আমরা ব্যাপক এক মোর্চা গঠনেরও চেষ্টা চালাচ্ছি, কিন্তু আপনি যদি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান যে ভারত ইতিমধ্যেই এক Banana Republic-এ পরিণত হয়েছে, তাহলে আমরা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বকে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বলে গুলিয়ে ফেলব, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলির আর কোনো গুরুত্ব থাকবে না এবং নিশ্চিতভাবেই আমরা সমস্ত ধরনের জোটের মধ্যে আটকা পড়ে যাব। আমাদের অনুশীলনের ধারা যদি এইভাবে নির্ধারিত হয় তবে সেটি আমাদের পরিস্থিতিতে সঠিক হবে না বলেই আমি মনে করি।

আপনি প্রকৃত এক জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভবের সম্ভাবনার কথা বলছিলেন। কোথা থেকে এর উদ্ভব ঘটবে? ভারতীয় বুর্জোয়াদের বাকি অংশের সাথে তার দ্বন্দ্বগুলিই বা কী হবে?

ভারতীর কমিউনিস্ট আন্দোলনে জাতীয় বুর্জোয়াদের অন্বেষণ এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে রয়েছে। কারণ সোভিয়েত প্রভাবের ফলে একেবারে শুরু থেকেই সিপিআই বলতে শুরু করেছিল যে ভারতে একটি জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী রয়েছে, আর তা হল এক সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি। কখনও কখনও নেহরুকে এই শক্তির প্রতিনিধি হিসাবে দেখা হয়েছে, কখনও দেখা হয়েছে অন্য কোনো ব্যক্তিকে। ফলস্বরূপ, যত জোর গিয়ে পড়ে জাতীয় বুর্জোয়াদের সঙ্গে সম্পর্কের বিকাশ ঘটানোর ওপরে, আর সিপিআই বলতে শুরু করে দেয় যে তারাই (জাতীয় বুর্জোয়ারা – অনু) নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করবে। এই চিন্তা কমিউনিস্ট আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়। আমাদের অভিমত হল যে, আগেভাগে খুঁজে বেড়ানোর পরিবর্তে এবং তাদের প্রতিনিধিদের সনাক্ত করার পরিবর্তে প্রশ্নটিকে বরং সংগ্রামের মধ্য দিয়েই নিরসন করা যাক। আসুন, আমরা নিজেদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও সেই সঙ্গে সামন্তবাদ বিরোধী সংগ্রামের মাধ্যমে এগিয়ে চলি এবং দেখা যাক বাস্তবে কোন কোন শক্তি উঠে আসছে এবং আমাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছে। সিপিআই(এমএল) শুরু থেকেই এই কাজ করে আসছে এবং আমি নিজে আজও মূলগতভাবে অনুরূপ ধারণা পোষণ করি।

জাতীয় বুর্জোয়াদের এক অর্থে আপনি ছোটো বা মাঝারি বুর্জোয়া বলে একটি পার্থক্যরেখা টানতে পারেন : মতাদর্শগতভাবে তাদের মধ্যে জাতীয়তা বলে কোনো কিছু নেই, কিন্তু বাস্তবে তারা জাতীয় বুর্জোয়ার মতো আচরণ করতে বাধ্য হতে পারে কারণ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে সকলকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব নয়। কিন্তু যদি জাতীয় বুর্জোয়াদের রাজনৈতিক প্রতিনিধি খুঁজে বেড়াতে শুরু করে দেন তাহলে আরএসএস-কেও তার স্বদেশী কর্মসূচি ও ডাঙ্কেল বিরোধিতার জন্য সেরকমই এক প্রতিনিধি বলে মনে করতে পারেন। বোম্বাই-এর ব্যবসাদারদের কিছু কিছু অংশ পর্যন্ত গ্যাট ও ডাঙ্কেলের বিরোধিতা করেছে এবং ভারতে বহুজাতিকদের প্রবেশের বিরোধিতা করেছে।

ব্যাপারটি এমন নয় যে জাতীয় বুর্জোয়ারা কোথাও রয়েছে আর আপনার কাজ তাদের খুঁজে বের করা। আমরা বরং এই সূত্রায়ন থেকে শুরু করেছি যে তারা সকলেই মুৎসুদ্দি এবং আসুন আমরা দেখি মুৎসুদ্দিদের ভিতর থেকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের ধারায় এক জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্ভব কীভাবে ঘটে। এই অর্থে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী সৃষ্টি করতে হবে।

আমরা গণতন্ত্র সম্পর্কে কথাবার্তা দিয়ে শুরু করেছিলাম। এই পরিপ্রেক্ষিতে পার্টির অনুশীলন কেমন চলছে? পার্টি আর গণসংগঠনগুলির মধ্যকার সম্পর্কই বা কীরকম থাকছে?

গণসংগঠনগুলি সম্পর্কে বলতে গেলে, আমরা মনে করি সেগুলি নিছক পার্টি শাখার থেকে বেশি কিছু হওয়া উচিত। বিভিন্ন গণসংগঠন জনগণের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব করে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে। উদাহরণস্বরূপ, ছাত্র/যুব সংগঠনের থাকে নিজস্ব গতিময়তা, নিজস্ব চলার পথ ও নিজস্ব ভাবপ্রবণতা। পার্টি যদি কিছু সূত্র বেঁধে দেয় এবং সংগঠনটিকে তার সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ রেখে কাজ করার কথা বলে তাহলে তা ছাত্র/যুব সংগঠনের সমস্ত প্রাণশক্তি, উদ্যোগ ও গতিকে বিনষ্ট করে দিতে পারে। অনুরূপভাবে, মহিলা সংগঠনগুলির কাজের নিজস্ব ধরন রয়েছে, তাঁরা বিশেষ ধরনের নিপীড়নের মুখোমুখি হন, আর তাঁদের অভিব্যক্তিও তাই হবে আলাদা ধরনের। তাঁদের তাই আপেক্ষিকভাবে স্বাধীনরূপে কাজ করার সুয়োগ দিতে হবে। আমরা দেখেছি বিশেষত সিপিআই(এম)-এর গণসংগঠনগুলি অনেকটাই পার্টি শাখার অনুরূপ। তা চিরায়ত রুশ, এমনকি চীনা অনুশীলনের মতো। গণসংগঠনগুলি নেহাত কাগুজে সংগঠন হয়ে দাঁড়ায়। তাদের কেবলমাত্র সদস্য সংখ্যার হিসাবে – ৪০ লাখ, ৫০ লাখ এভাবে দেখা হয়। তাদের কর্মসূচিতে অনর্গল হস্তক্ষেপ করা হয়। তাই আমরা এমন এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর চেষ্টা করছি – যাতে তাদের বেশি বেশি স্বাধীনতা দেওয়া যায়, তাদের বৈশিষ্ট্যগুলিকে স্বীকার করা হয় ও তাদের উৎসাহিত করা যায়। এটি হচ্ছে একটি দিক। আর দ্বিতীয়ত, আমরা মনে করি যে সেক্ষেত্রে এক দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক থাকতে হবে যেখানে একদিকে পার্টি তাদের নেতৃত্ব দেয় অপরদিকে তারা নিজেরাও পার্টির ওপর এক ধরনের নজরদারির কাজ করে। এমনকি পার্টি যখন ক্ষমতায় নেই তখনও পার্টির ভিতরে আমলাতন্ত্রের মতো কিছু কিছু বিকৃতি ও প্রবণতার উদ্ভব হতে পারে।

উদাহরণ হিসাবে, ধরুন, কোনো পার্টি ক্যাডার কোনো মহিলার সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন। পার্টি কমিটিতে বিষয়টি আলোচিত হল কিন্তু প্রতিক্রিয়া ঘটার আশঙ্কায় গোটা ব্যাপারটি চেপে যাওয়া হল। অভিযোগটি মহিলা সংগঠনের কাছে গেল। তাঁরা বিষয়টি গ্রহণ করলেন এবং পার্টির ওপর চাপ দিয়ে বললেন যে এটি অন্যায় হচ্ছে। আমরা মনে করি, এতে ভালোই হয় কারণ পার্টি ব্যবস্থায় সাধারণত বিষয়গুলিকে মহিলাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয় না। সংশ্লিষ্ট মহিলা তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করার, অবিচারের প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ পাওয়ার মতো অবস্থায় নাও থাকতে পারেন। কিন্তু মহিলা সংগঠন যদি বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করে স্বভাবতই পার্টিকে চাপের মুখে পড়তে হয়।

কোথাও আমাদের হাতে কিছুটা ক্ষমতা থাকলে, যেমন ধরা যাক কার্বি-আংলং জেলা পরিষদে কিম্বা ভবিষ্যতে কোনো সরকার চালাতে গেলেও, আমরা এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখি যাতে কৃষক সমিতি ও অন্যান্য (গণ)সংগঠনগুলি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং তারা যাতে কর্মকর্তাদের ওপর, পার্টির ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এই হল গণসংগঠনগুলি সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিকোণ – একদিকে তাদের স্বাধীনতাকে উৎসাহিত করা, যাতে যে অংশের তারা প্রতিনিধিত্ব করছে সেই অংশের বৈশিষ্ট্যগুলিকে তারা যথাযথভাবে প্রতিফলিত করতে পারে। এটা তাদের প্রাণময়তা ও গতিশীলতা জোগাবে। পার্টির উচিত কেবল নেতৃত্ব দেওয়ার কাজে নিজেকে আবদ্ধ রাখা আর অন্যদিকে গণসংগঠনগুলির উচিত পার্টির ওপর নজরদারি বহাল রাখা।

যে উদ্যোগটি খুবই দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হল ইনকিলাবী মুসলিম কনফারেন্স গঠন। এক ধর্মীয় পরিচিতিকে ঘিরে সংগঠন গড়তে বামপন্থীরা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?

আমরা এ ব্যাপারে হাত লাগিয়েছি কারণ সম্প্রতি দেশকে এরই ভিত্তিতে বিভাজিত করা হয়েছে। সামনে এসেছে হিন্দুত্ব আর মুসলিমরাই হলেন এর লক্ষ্যবস্তু। ওরা বলতে শুরু করেছে, হিন্দুত্ব হল ধর্মের থেকেও বেশি, এটি এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক বর্গ। তাই ওরা বলছে যে মুসলিমরাও হিন্দুদের অংশ কারণ তারা ভারতে বসবাস করে – ঐতিহাসিকভাবে এবং সংস্কৃতিগতভাবেও। ওরা  ‘মহম্মদীয় হিন্দু’ কথাটি চালু করে বলছে : মুসলিমরা যদি তাদের পৃথক পরিচিতি ত্যাগ করে ও বৃহত্তর হিন্দু পরিবারের অংশ হয়ে ওঠে তাহলে মুসলিমরা ভারতে থেকে যেতে পারে, আর তাদের মহম্মদীয় হিন্দু বলে গ্রহণ করতে আমরা প্রস্তুত। তারা আরও বলছে যে, শিখ, জৈন ও বৌদ্ধরাও হিন্দু। কেউ ভগবানের – একেশ্বরের, কেউ দশ দেবতার, কেউ কোটি কোটি দেবতার পূজো করছে, আবার কেউ বা কোনো দেবতারই পূজো করছে না – তবুও তারা সবাই হিন্দু! হিন্দুত্ব হল এক ব্যাপকতর সামাজিক-সাংস্কৃতিক বর্গ আর মুসলিমরা সহ সকলেরই  এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। এটি মেনে নেওয়ার সদিচ্ছার মধ্যে দিয়েই তাদের দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের যাচাই হবে। তাই মুসলিমদের তাদের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিচিতিকে ত্যাগ করতে বলার দাবি হল এক বিশেষ আক্রমণ। এই আক্রমণ ধর্মের উপরই নয়, বরং এক সামাজিক-সাংস্কৃতিক আক্রমণও বটে। সম্প্রদায়গতভাবেই মুসলিমরা বিপদের মুখে। তাই প্রতিক্রিয়াও হচ্ছে সম্প্রদায়েরই ভিত্তিতে। এখন এই মুসলিম প্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে এক মৌলবাদী উপাদান – যা বিজেপির প্রতিপক্ষ। কিন্তু অন্যান্য মুসলিমরা মনে করেন যে ভারতের মতো দেশে যেখানে মুসলিমরা সংখ্যালঘু আর জনসংখ্যার ৮০-৮৫ শতাংশ হল হিন্দু সেখানে এটি সঠিক হবে না। তাই ভারতের পটভূমিতে তাঁরা মনে করেন ধর্মনিরপেক্ষতাই আরও ভালো।

এর অর্থ এই নয় যে ভারতীয় মুসলিমদের মধ্যে বুর্জোয়াকরণ ঘটে গেছে এবং সেই অবস্থান থেকেই তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলছেন। তাঁদের ধর্মীয় বিশ্বাস ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিপরীতে যায়। কিন্তু ভারতের নির্দিষ্ট পরিস্থিতি তাঁদের ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে যেতে উৎসাহিত করেছে।

দ্বিতীয়ত, মুসলিমরা বামপন্থীদের সাথে এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। নির্বাচনের সময় তাঁরা কোনো না কোনো বুর্জোয়া দলের পক্ষ নিলেও তাঁদের মধ্যে সাধারণভাবে এই ধারণা গড়ে উঠেছে যে বামপন্থীরাই হল প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ।  আগে মুসলিমদের একাংশ বামেদের সঙ্গে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রগতিশীল, কমিউনিস্টরা ছিলেন। বহু গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিস্ট ছিলেন মুসলিম ও বহু মুসলিম শ্রমিক শ্রেণী হিসাবে সামিল হয়েছিলেন। তারপর ছিলেন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা, বহু প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী। কিন্তু সমগ্র সম্প্রদায়গতভাবে বামেদের প্রতি এ ধরনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ কিছুটা নতুন ব্যাপার। আগে ভাবাবেগ ছিল অনেকটাই পাকিস্তানের অনুকূলে। কিন্তু এখন আর নতুন করে দেশকে বিভাজনের কোনো আকাঙ্খা নেই।

তাই এগুলি হল পরিবর্তনের দিক। সম্প্রদায়গতভাবেই যখন মুসলিমরা আক্রমণের মুখোমুখি তখন তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমর্থন জানাচ্ছেন এবং বামেদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলছেন।

আমরা এই সম্পর্ককে সংহত করতে চাই। কিন্তু একে কীভাবে এক সাংগঠনিক রূপ, প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায়? সামগ্রিকভাবে সেই ভাবনা থেকেই ইনকিলাবী মুসলিম কনফারেন্সের জন্ম। সম্প্রদায়গত দিক আর ইনকিলাবী দিক – দুটি দিককেই মাথায় রাখা প্রয়োজন। এর মধ্যে মুসলিম বিচ্ছিন্নতাবোধকে শক্তিশালী করার কোনো অভিপ্রায় নেই, বরং বিজেপি ইত্যাদির বিরুদ্ধে মুসলিম স্বার্থগুলি তুলে ধরতে হবে। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক পরিবর্তন ঘটানোর ওপরেও গুরুত্ব আরোপ করা দরকার। তাই ইনকিলাবী বিজেপির বিরুদ্ধে নয়, বরং তা সম্প্রদায়ের নিজের মধ্যেই ইনকিলাবী। তাই আমরা মুসলিম মহিলাদের অবস্থাকে উন্নত করার বিষয়টির ওপর বিরাট জোর দিয়েছি। এই প্রশ্ন তাঁদের নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেই উঠে এসেছে।