(দেশব্রতী, বিশেষ সংখ্যা, অক্টোবর ১৯৮৯ থেকে)

পার্টির চতুর্থ কংগ্রেসে বাম শক্তিগুলির অভ্যুদয়কে বর্তমান ভারতীয় রাজনীতির এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়েছিল এবং কংগ্রেস বিরোধী লড়াইয়ে বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের মোকাবিলায় তথা বামপন্থী শক্তিগুলিকে এক স্বতন্ত্র রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে দাঁড় করানোর কর্তব্যকর্ম নির্ধারিত করা হয়েছিল। বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের পেছনে না চলে, বরং রাজনৈতিক নেতৃত্বদানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার জন্য বামপন্থী শক্তিগুলির কাছে আহ্বান জানানো হয়েছিল। বাম গণতান্ত্রিক কনফেডারেশন গড়ে তোলার যে কর্তব্য ‘পার্টি কংগ্রেস’ সূত্রবদ্ধ করে, তা ছিল এই দিশাতেই এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।

এই আহ্বান ও তার থেকে বেরিয়ে আসা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্তব্য বামপন্থী আন্দোলনের অন্য দুটি প্রধান শক্তি সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর সাথে আমাদের আন্তঃক্রিয়া ও ঐক্যের সম্ভাবনার দ্বার যেমন খুলে দিল, তেমনি তাদের সাথে আমাদের ঐতিহাসিক সংগ্রামকে এক নতুন পর্যায়ে উন্নীত করল।

বাম কনফেডারেশনও একটি যুক্তফ্রন্ট মাত্র। এই যুক্তফ্রন্টে মূল অংশীদারদের মধ্যে যেহেতু সিপিআই, সিপিআই(এম) ও সিপিআই(এমএল)-এর কথাই ভাবা হয়েছে, তাই শেষ বিচারে রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তিনটি পার্টির মধ্যেই পরিবর্তন ও রূপান্তর ঘটতে পারে, তারা আরও কাছাকাছি আসতে পারে, ১৯৬৪ ও ১৯৬৭-র ঐতিহাসিক বিভাজনগুলির পুর্নমূল্যায়নের এবং ভারতের একক কমিউনিস্ট পার্টি পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রশ্ন সামনে চলে আসতে পারে। তবে এই সম্ভাবনা সুদূর ভবিষ্যতের গর্ভে রয়েছে, কাজেই তা নিয়ে আজকেই মাথা ঘামানো তত্ত্বের ক্ষেত্রে আমাদের বিমূর্ততায় ঠেলে দেবে এবং ব্যবহারিক নির্দিষ্ট কর্তব্য থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেবে।

এই মুহূর্তে বাম কনভেডারেশন-এর স্লোগান তিনটি পার্টির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকেই এক নতুন স্তরে দাঁড় করিয়েছে। ‘নতুন স্তরে’ বলছি, কারণ এই প্রথম সমাজগণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে বিমূর্ততার সীমা থেকে টেনে নিয়ে আসা হয়েছে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কৌশলের প্রশ্নে, কারণ এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন চলবে ব্যাপক আন্তঃক্রিয়া ও ঐক্যবন্ধ ফ্রন্ট গড়ার লক্ষ্যে।

বাম কনফেডারেশন-এর স্লোগান যে কয়টি প্রশ্নের সুস্পষ্ট উত্তরের দাবি জানায়, তা হল :

১) সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর সাথে আজকের স্তরে আমাদের নির্দিষ্ট সম্পর্ক কী হবে?

২) সাধারণভাবে রাজ্যগুলিতে বামপন্থী সরকার গঠনের প্রশ্নে ও নির্দিষ্টভাবে সিপিআই(এম) পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকারের প্রশ্নে আমাদের মনোভাব কী হবে? এবং

৩) কনফেডারেশনের প্রশ্নে আমরা কীভাবে ও কোথায় শুরু করব?

আমি এই প্রশ্নগুলি সম্পর্কে আমার মত এখানে রাখার চেষ্টা করব।

শুরুতে বলে রাখি, সমাজগণতন্ত্রীর নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আচরণ সম্পর্কে শেষ কথা নিশ্চয়ই বলা যায় না। তারা বুর্জোয়া ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির এজেন্ট ও গণসংগ্রামের শত্রুশক্তি, নাকি কমিউনিস্টদের ও গণসংগ্রামের স্বাভাবিক মিত্র – ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’তে এই প্রশ্নের উত্তর বোধহয় দেওয়া সম্ভব নয়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক পর্যায়ে, তাঁরা পুরোপুরি ভিন্নভিন্ন ভূমিকা পালন করেছেন ও করতে পারেন। বাস্তব অবস্থা, রাজনৈতিক ঘটনা সমাবেশ, তাঁদের নেতৃত্বের বিভিন্ন অংশের ও স্তরের মধ্যকার শক্তির ভারসাম্যের ওপর তা নির্ভর করে থাকে।

এখানে আমরা সিপিআই-এর দৃষ্টান্ত নিতে পারি। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত তার বিকাশের এক প্রক্রিয়া আছে যা ক্রমে ক্রমে তাকে কংগ্রেসের সাথে জুড়ে দেয়, তারা কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশন গভর্ণমেন্ট পরিচালনা করে ও জরুরি অবস্থার একমাত্র সমর্থক হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃত অর্থে ইন্দিরা কংগ্রেস ও সিপিআই-কে আলাদা করে চেনা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে মালিকশ্রেণীর দালালি থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী কমিউনিস্টদের বিরোধিতায় শ্রেণী শত্রুদের সাথে হাত মেলানো পর্যন্ত তাঁদের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। ১৯৭৭-এর রাজনৈতিক ঘটনাক্রম এই পার্টির সামনে অস্তিত্বের সংকট এনে দাঁড় করায় এবং তারপর থেকে ক্রমে ক্রমে এই পার্টি তার পুরোনো অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করে। তার জন্য তাকে তীব্র আন্তঃপার্টি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ডাঙ্গে, মোহিত সেন ও কল্যাণসুন্দরমরা বিতাড়িত হয়। কংগ্রেস বিরোধী অবস্থান নিয়ে সে বামপন্থার মূল স্রোতে ফিরে আসার চেষ্টা করে। মৌলিক কর্মসূচি নিয়েও পার্টির অভ্যন্তরে শুরু হয়েছে বিতর্ক। গণআন্দোলনের কিছু কিছু কর্মসূচি নেওয়ার তাঁরা চেষ্টা করছেন। সিপিআই(এম)-এর বিরোধিতা আগ্রাহ্য করে অন্ধ্রে তেলেগু দেশম সরকারের বিরুদ্ধে তাঁরা আন্দোলনে নামেন, বামফ্রন্ট সরকারের অংশীদার হয়েও তার কোনো নীতির বিরোধিতা করা ও প্রয়োজনে আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং আমাদের সাথে সম্পর্ক বিকশিত করতে এগিয়ে আসে। তাঁদের তত্ত্বে ও প্রয়োগে এখনও বহু কিছু আছে, যা তাঁদের কংগ্রেসের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আমাদের সাথে সম্পর্ককে বামফ্রন্টের মধ্যে সিপিআই(এম)-এর সাথে দরকষাকষির জন্যই হয়তো ব্যবহার করতে চান তাঁরা। এ সমস্ত সত্ত্বেও ১৯৭৭ ও ১৯৮৯-র সিপিআই-এর ভূমিকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন যে এসেছে, তা বোধহয় কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না।

সিপিআই-এর আমাদের আন্তঃক্রিয়া, যা ক্রমেই এগোচ্ছে, উভয়ের মধ্যে সম্পর্ককে বিভিন্ন স্তরে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে। আবার অন্যদিকে, সিপিআই(এম)-এর সাথে তারা আগেই এক ঘনিষ্ঠ প্রাতিষ্ঠানিক রূপে আবদ্ধ। সিপিআই একদিকে সিপিআই(এম)-এর বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে আমাদের সাথে সম্পর্ক বিকশিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তেমনি অন্যদিকে সে আমাদের বামফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে মনোভাব পাল্টানোর ও বামফ্রন্টের শরিক হওয়ার জন্য লাগাতার চাপ দিচ্ছে। এটি দেখার বিষয় যে আমাদের ও সিপিআই(এম)-এর মধ্যে মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা নেওয়ার তাঁরা যে চেষ্টা করছেন তাতে তাঁরা সফল হবেন নাকি দুটি বিপরীত দিকের চাপে তাঁরা আরও সংকটে পড়বেন। বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় তাঁদের আগামী পদক্ষেপ কী হবে, তার ওপরই অনেকাংশে নির্ভর করবে আমাদের মধ্যকার অগ্রগতি।

সিপিআই(এম) বৃহত্তম বামপন্থী পার্টি ও তাঁরা দুটি রাজ্যে সরকার পরিচালনা করছেন। এই শক্তির ভিত্তিতে সাম্প্রতিককালে তাঁরা জাতীয় রাজনীতিতেও এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছেছেন। তাঁরা নিজেদের বাম শক্তিগুলির স্বাভাবিক নেতা বলেই মনে করেন এবং অপরিহার্যভাবেই তাঁদের নেতৃত্বে পরিচালিত বামফ্রন্টই তাঁদের কাছে বাম ঐক্যের নির্দিষ্ট রূপ। বামফ্রন্ট পরিচালিত দুটি রাজ্য সরকারকে তাঁরা তাঁদের কৌশলগত লাইনে কেন্দ্রীয় অবস্থান রাখেন যাদের ধরেই তাঁরা জাতীয় রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটাতে চান। তাঁদের ভাষায়, এই মেরুকরণের নির্দিষ্ট রূপ বাম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির সংযুক্ত মোর্চা।

পশ্চিমবাংলা ও কেরলের কথা বাদ দিলে, যেখানে সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত, জাতীয় পর্যায়ে তার নিজস্ব শক্তি সীমিত ও খুব বেশি হলে তা এক শক্তিশালী প্রেসার গ্রুপ গঠন করতে পারে। জাতীয় ক্ষেত্রে সংসদীয় রাজনীতিতে তাকে একটা বিরোধী অবস্থান নিয়েই থাকতে হবে। সংসদীয় বিরোধী অবস্থানের এই শক্তিশালী অবস্থার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে দেশব্যাপী এক ব্যাপক গণআন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি করার কাজে সে এগিয়ে যেতে পারতো। তবে এই বিপ্লবী পথে এগোনোর কোনো ইচ্ছাই সিপিআই(এম)-এর নেই। তাঁরা তাঁদের পার্টির শক্তি বৃদ্ধির জন্য অন্য পথই গ্রহণ করেছেন।

অন্ধ্রে তেলেগু দেশম, তামিলনাড়ুতে ডিএমকে ও হিন্দি বলয়ে জনতা দলের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে নিজেদের সংসদীয় শক্তি বৃদ্ধি ঘটানোকেই তাঁরা বামপন্থার শক্তিবৃদ্ধি হিসাবে দেখতে চান। সংসদ ও বিধানসভায় এইভাবে অর্জিত প্রতিটি আসন যে জনগণের রাজনৈতিক চেতনাকে কলুষিত করার ও বিপ্লবী আন্দোলনে তাঁদের ক্ষমতাকে দুর্বল করার বিনিময়ে হাসিল হয়, তা সিপিআই(এম) নেতৃত্ব ভালোভাবেই জানেন। বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের এই তাবড় তাবড় শক্তিগুলি যারা নিজের নিজের প্রভাবাধীন ক্ষেত্রে বুর্জোয়া জমিদার সমন্বয়কে প্রতিনিধিত্ব করেন, তাঁদের সাথে নিজের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক সমঝোতাকে প্রাতিষ্ঠানিক করার স্বার্থেই ‘বাম গণতান্ত্রিক’-এর সাথে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দ জুড়ে দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ মোর্চার তত্ত্ব আনা হয়েছে। এ যেন সিপিআই-এর সাথে কংগ্রেসের আঁতাতের সেই আগেকার অনুশীলনেরই উল্টোপিঠের পুনরাবৃত্তি।

এই ধর্মনিরপেক্ষ বিকল্পে সিপিআই(এম) যে নেতৃত্বকারী ভূমিকায় থাকবে না তা স্পষ্ট। কাজেই এই বিকল্পে পার্টির অবস্থান কী হবে ও কংগ্রেসকে সরিয়ে এই বিকল্পের সরকার গঠন হলে সিপিআই(এম) তাতে অংশ নেবে নাকি বাইরে থেকে সমর্থন জানাবে – এই সমস্ত প্রশ্নে তাঁদের পার্টির অভ্যন্তরে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তবে এটুকু দেখাই যাচ্ছে যে, ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের’ পথে বর্তমান পর্যায়ে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের সীমানাকে বর্ধিত করার যে কর্মসূচি তাঁদের রয়েছে, নির্দিষ্ট অর্থে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাসের দাবি যার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু, তাতে তাঁরা বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষকে স্বাভাবিক নেতা হিসাবে মেনে নিয়েছেন ও নিজেরা হয়ে উঠেছেন তাঁদের স্বাভাবিক মিত্র। বর্তমান স্তরে, যারা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের বিপ্লবী বিস্তারের জন্য কোনো শক্তি ভারতের বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের মধ্যে খুঁজে পান না বরং তার জন্য নির্ভর করেন গ্রামাঞ্চলের ব্যাপক দরিদ্র ও মেহনতি কৃষক সম্প্রদায়ের উপর, সেই বিপ্লবী গণতন্ত্রের শক্তিগুলি সিপিআই(এম)-এর কাছে ‘বাম শক্তি’ হিসাবে গণ্য হন না, বিপরীতে তারা গ্রামাঞ্চলে ‘কৃষক ঐক্যে' ভাঙ্গন সৃষ্টিকারী নৈরাজ্যবাদী শক্তি হিসাবেই গণ্য হন। এটি খুবই স্বাভাবিক, কেননা গ্রামাঞ্চলে আমাদের সংগ্রাম অপরিহার্যভাবে তাঁদের ধর্মনিরপেক্ষ বন্ধুদের সামাজিক ভিত্তিতেই আঘাত হানে।

বাম কনফেডারেশনের আমাদের স্লোগান কৌশলগত লাইনের প্রশ্নে তাঁদের সাথে বস্তুগত বৈপরীত্যকেই প্রতিফলিত করে। এমন এক পরিস্থিতিতে তাঁদের সাথে সংগ্রামই বস্তুগতভাবে প্রধান দিক হয়ে আছে। এই স্লোগান তাঁদের সাথে রাজনৈতিক বিতর্কের সুনির্দিষ্ট ও ধারালো করার এবং সেই ভিত্তিতে তাঁদের কর্মীবাহিনী ও প্রভাবিত জনগণের সাথে আন্তঃক্রিয়া বাড়াতে অবশ্যই সাহায্য করবে। এই পর্যায়ে তাঁদের সাথে কোনো বড় আকারে ঐক্যবদ্ধ কার্যকলাপ চালানো ও সম্পর্ককে কোনো সংস্থাবদ্ধ রূপ দেওয়ার আশু সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে বিহারে রাজ্যস্তর পর্যন্ত ও অন্য কোথাও কোথাও স্থানীয় স্তরে ঐক্যবদ্ধ কার্যকলাপ সম্ভব হয়েছে। পশ্চিমবাংলাতেও স্থানীয় স্তরে তাঁদের কর্মীবাহিনীর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক ও এমনকি কিছু কিছু যৌথ কার্যকলাপ যে চালানো যায় তা কয়েকটি এলাকার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে। সর্বত্রই তাঁরা শুরু করেন আমাদের বিচ্ছিন্ন করার বা যেখানে তাঁরা শক্তিশালী সেখানে আমাদের আক্রমণ করে উৎখাত করার মরীয়া প্রচেষ্টা দিয়ে। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে যেখানেই আমরা এই প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে টিকে থাকতে পেরেছি, সেখানেই পরবর্তীকালে তাঁদের মনোভাব পাল্টেছে ও সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে অবশ্যই আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু তাঁদের মনোভাবে কোনো আমূল পরিবর্তনের জন্য আমাদের অবশ্যই রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের পরবর্তী বিকাশের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পরবর্তীকালের পরিবর্তিত সম্পর্কের শর্ত সৃষ্টি হতে পারে আজকের এই নীচুতলার কাজের মধ্য দিয়েই। নীচুতলার কাজের এই কঠিন, কঠোর ও দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে গিয়ে কিছু স্লোগান বা কৌশলগত পরিচালনা দিয়ে সিপিআই(এম)-এর মতো আমাদের সাবেকী প্রতিদ্বন্দ্বীর অবস্থান পরিবর্তনের আশা করা নিছক কল্পনাবিলাস। বিশেষত যখন সে রাজনৈতিক উত্থানের স্তরে আছে ও নেতৃত্ব তাঁদের কৌশলগত লাইনের সাফল্য সম্পর্কে কর্মীবাহিনীর মধ্যে মোহ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর বলা যায় যে, সংসদীয় সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় কোনো কোনো রাজ্যে বামপন্থী সরকার গঠনের প্রশ্ন দেখা দিতে পারে ও আমরা সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে পারি। চতুর্থ কংগ্রেস পার্টির কৌশলগত লাইনে এই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ঘটিয়েছে।

এতদিন ধরে কমিউনিস্ট বিপ্লবী মহলে এই প্রশ্ন অচ্ছুৎ হয়েই ছিল। আমরা এই প্রশ্ন তোলার সাথে সাথে ‘সব গেল-গেল’ রব পড়ে গেল। সমাজগণতন্ত্রের সাথে পার্থক্যরেখার শেষ স্তম্ভটিও খসে গেল। পার্টির অভ্যন্তরে একই ভিত্তিভূমির উপর দাঁড়িয়ে চরম দক্ষিণপন্থী অবস্থান থেকে প্রশ্ন উঠল, সিপিআই(এম) পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকারের শরিক হওয়ার চেষ্টা করতে বাধা কোথায়!

কোনো কোনো রাজ্যে সরকার গঠনের প্রশ্ন ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে সেই ১৯৫৭ থেকে সংসদীয় সংগ্রামের সর্বোচ্চ রূপ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। নকশালবাড়ি আন্দোলনের আগেও পার্টির অভ্যন্তরীণ সংগ্রামে সরকার গঠনের কৌশলকে বিপ্লবী কমিউনিস্টরা নাকচ করেননি। এই সরকারকে গণআন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বার্থে ব্যবহার করার কৌশল নিয়ে পার্টির মধ্যে ঐকমত্যই ছিল। সংঘাত বাধল তখনই, যখন সিপিআই(এম) নেতৃত্ব যুক্তফ্রন্ট সরকারকে ব্যবহার করলেন নকশালবাড়ি আন্দোলনকে দমন করার জন্য। তার পরবর্তী সময় ছিল আমাদের কাছে প্রত্যক্ষ বিপ্লবী সংগ্রামের সময়, যেখানে সংসদীয় সংগ্রাম ছিল বর্জিত এবং ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের মুখে সিপিআই(এম)ও সরকার গঠনের সুযোগ পায়নি।

সংগ্রামের এই বিশেষ রূপের ক্ষেত্রে আমাদের অবশ্যই এগোতে হবে সতর্কতার সাথে ও ধাপে ধাপেই, তাই চতুর্থ কংগ্রেস এই প্রশ্নে কিছু সাধারণ দিশাই দিয়েছে এবং বিষয়টিকে আরও সুনির্দিষ্টভাবে বিবেচনার ভার ভবিষ্যতের উপরই নির্দিষ্ট করেছে। বিপ্লবী আন্দোলনের বিকাশের কোন পর্যায়ে আমরা এই প্রশ্ন তুলব, দৃষ্টান্তস্বরূপ বিহারের আজকের অবস্থায় এই প্রশ্নে কী সম্ভাবনাগুলি রয়েছে, এসব নিয়ে পার্টির মধ্যে অবশ্যই বিচার-বিবেচনার ও বিতর্কের সূত্রপাত হওয়া উচিত। তবে চতুর্থ কংগ্রেস যেমন আমাদের নির্দেশ দিয়েছে, এ প্রশ্নে আমরা আমাদের অনুশীলনের বিকাশ ঘটাবো সিপিআই(এম) পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকারগুলির দ্বান্দ্বিক নেতিকরণের ভিত্তিতেই।

একথা অবশ্যই সঠিক যে, কেন্দ্রের কংগ্রেসী শাসনের বিরোধিতা ও সামগ্রিকভাবে ভারতীয় রাষ্ট্রযন্ত্রে কিছুটা হলেও ফাটল সৃষ্টির ক্ষেত্রে বিরোধী রাজ্য সরকারগুলির একটি ভূমিকা আছে। কিন্তু ঠিক এই অবস্থাই তো ব্যাপক গণজাগরণের শর্তও সৃষ্টি করে। অ-বাম সরকারগুলি কর্তৃক এই গণজাগরণকে আঞ্চলিকতার খাতে বইয়ে দেওয়ার যুক্তি ও প্রয়োজন বোঝা যায়। কিন্তু একটি বাম সরকারও যদি একই পথ অবলম্বন করে তাহলে ‘বামপন্থী’ ছাপ থাকলেও আমরা তার বিরোধিতা না করে পারি না।

ঐ সব কারণে কেন্দ্র বিরোধী সংগ্রামে বামফ্রন্ট সরকারগুলির সমালোচনামূলক সমর্থন ও রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিপ্লবী বিরোধীপক্ষ, এটিই আমাদের বুনিয়াদী অবস্থান হতে পারে।

এখানে তৃতীয় প্রশ্নে এসে পৌঁছচ্ছি। বাম কনফেডারেশন-এর কথা আমরা বলেছি নির্দিষ্টভাবে রাজীব হঠাও স্লোগান-কে ধরে। একই স্লোগান থাকলেও বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের চেয়ে বাম শক্তিগুলির যে এক গুণগত আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি আছে, জনগণের মৌলিক দাবিগুলি নিয়ে গণআন্দোলনের সাথে যে রাজীব হঠাও-এর প্রশ্নকে বামপন্থীরা জুড়তে চায়, বুর্জোয়া বিরোধীদের সাথে বামেদের সমঝোতা শুধু যে ইস্যুভিত্তিক ও ক্ষণস্থায়ী – বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের সাপেক্ষে বামেদের এই স্বাধীনতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার স্বার্থেই বাম কনফেডারেশনের প্রয়োজন।

বামফন্ট ও জাতীয় ফ্রন্টের মধ্যে পার্থক্য শুধু যে বিজেপির সাথে জোট করা না করা নিয়ে, জনগণের চেতনায় প্রশ্নটি এইভাবেই যাচ্ছে। তা বামেদের স্বাধীন অস্তিত্বকে নিছক সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ করে দিচ্ছে।

আমাদের প্রচারের ধারা এটিই হতে পারে যে এই কনফেডারেশনে সিপিআই(এম)-এর সাথে আমাদের ঐক্য অবশ্যই সম্ভব যেহেতু জাতীয় পরিপ্রেক্ষিতে বামফন্ট সরকারের এক প্রাসঙ্গিকতা আমরা মেনেই নিয়েছি, এই সরকারগুলির কেন্দ্র বিরোধী সংগ্রামকে আমরা সমর্থন জানাই ও এই সরকারকে ভেঙ্গে  দেওয়ার কেন্দ্রের যে কোনো চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আমাদের কোনো বাধা নেই। পশ্চিমবাংলার অভ্যন্তরে এই সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপের আমাদের বিরোধিতা বা অন্যদিকে বিহারে আমাদের কৃষক সংগ্রামের প্রতি সিপিআই(এম)-এর বিরোধিতা কনফেডারেশনের অভ্যন্তরে বিতর্কের বিষয়বস্তু হয়ে থাকতে পারে। ন্যূনতম যে সাধারণ বিষয়গুলি আমাদের মধ্যে আছে সেখান থেকেই আমাদের শুরু করা উচিত ও শুরু করা সম্ভবও বটে।

বিহারে আমরা দেখেছি, বামফন্ট সরকার সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা আমাদের কৃষক সংগ্রাম সম্পর্কে সিপিআই(এম)-এর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে উভয়পক্ষই অবিচল থাকলেও রাজ্য স্তরেও যৌথ কার্যকলাপ সম্ভব হয়েছে। এমনকি, বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের সাথে একসাথে যৌথ কার্যকলাপ চালালেও সিপিআই, সিপিআই(এম), আইপিএফ-এর মতো বাম পার্টিগুলির নিজেদের মধ্যে এক পৃথক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত – এই প্রস্তাব তিনটি পার্টির মধ্যেই চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। বিহারে আজকে যে বীজ পোঁতা হচ্ছে, সেটিই আগামীদিনে একটি বাম কনফেডারেশনের রূপ নিতে পারে।

এই বাম কনফেডারেশনের উদ্যোগ অবশ্যই আসবে সাধারণভাবে হিন্দি বলয়ে, বিশেষ করে বিহার থেকে। আইপিএফ-এর মাধ্যমে যে নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের সূত্রপাত আমাদের পার্টি আজ থেকে সাত বছর আগে করেছিল, তা হিন্দি এলাকায় নির্দিষ্ট অবস্থায় যে বামপন্থার পুনরুত্থানের বার্তা বহন করে আনছে তার ইঙ্গিত আমরা পেতে শুরু করেছি। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ও ভারতীয় রাজনীতির স্নায়ুকেন্দ্রে, যেখানে বামপন্থী আন্দোলন শিকড় গাড়তে পারেনি, আজ এক নতুন হাওয়া বইতে শুরু করেছে। বামপন্থী আন্দোলনের তিনটি প্রধান ধারার সম্মিলন-ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে এই এলাকাই। বিহার ও উত্তরপ্রদেশে সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর কর্মীবাহিনী ও প্রভাবিত জনগণের বড় সংখ্যায় আইপিএফ-এ যোগদান এই সম্মিলনের একটি রূপ। প্রথমে সিপিআই-এর সাথে, ক্রমে ক্রমে সিপিআই(এম)-এর সাথে যৌথ কার্যকলাপের সূত্রপাত এই সম্মিলনের দ্বিতীয় রূপ। এই ধারা অবশ্যই এগিয়ে যাবে ও জাতীয় পর্যায়ে বাম কনফেডারেশনের ভিত্তি রচনা হবে এই এলাকাতেই – কনফেডারেশনে থাকবে আমাদের স্বাধীন উদ্যোগের গ্যারান্টি।

আশ্চর্যজনক শোনালেও দ্বান্দ্বিক সত্য এটিই যে, কনফেড়ারেশন গঠনের এই প্রচেষ্টায় পশ্চিমবাংলার বিপ্লবী কমরেডরা তাঁদের অবদান রাখতে পারেন সম্পূর্ণ বিপরীতভাবেই, অর্থাৎ বামফ্রন্ট সরকারের জনবিরোধী নীতি ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বিপ্লবী বিরোধীপক্ষের পতাকা হাতে তুলে নিয়ে।