(লিবারেশন, অক্টোবর ১৯৯১ থেকে)

রণনীতীগত পরিপ্রেক্ষিত

আইপিএফ অথবা কমিউনিস্ট পার্টি? আমাদের পার্টির অভ্যন্তরে ও বাইরে বহুল চর্চিত এই প্রশ্নটি দিয়েই শুরু করা যাক। কিছু কমরেড মনে করেন, পার্টি যখন গোপন কাজ করত তখন তার আইনি পরিকাঠামো হিসাবে আইপিএফ-এর তাৎপর্য ছিল। কিন্তু পার্টি ধাপে ধাপে অধিকতর খোলামেলা কাজের দিকে এগোনোর ফলে একটি স্বতন্ত্র আইনি কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। সিপিআই(এম)-এর তাত্ত্বিক নেতা প্রকাশ কারাত আমাদের সঙ্গে বিতর্কে সেই একই প্রশ্নের অবতারণা করেছেন : “সিপিাই(এমএল) ও আইপিএফ-এর মধ্যে ভবিষ্যৎ আন্তঃসম্পর্কের বিষয়টি জট পাকানো। সিপিআই(এমএল) যেহেতু খোলা পার্টি হয়ে আইনি কার্জকর্মের দিকেই এগোচ্ছ এবং সিপিআই(এমএল)-ই যেহেতু আইপিএফ-এর নেতৃত্বকারী শক্তি ও অগ্রবাহিনী, তাই কী উদ্দেশ্যে আইপিএফ-কে টিকিয়ে রাখা হবে।”[১০]

অন্য আর একটি অভিমতের সঙ্গে আমরা সুপরিচিত এবং তাঁদের দাবি পার্টির সমস্ত ব্যবহারিক কাজকর্মই যেহেতু হচ্ছে আইপিএফ-এর মাধ্যমে, তাই পার্টিকে ভেঙ্গে দিতে হবে।

আমাদের পার্টি ধারাবাহিকভাবেই বলে এসেছে যে পার্টি ও আইপিএফ – উভয়ই প্রয়োজনীয়। বিচার্য বিষয় হল উভয়ের কাজের মধ্যে ফারাক কী থাকবে এবং কাজের সমন্বয়ই বা হবে কীভাবে।

একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। কমিউনিস্ট পার্টি হিসাবে আমাদের কাজ হল শহুরে ও গ্রামীণ সর্বহারাদের সংগঠিত করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করা। জনপ্রিয় ভাষায় বলতে গেলে, তা হল পুঁজির শাসনের অবসান ঘটানো ও ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করা। সবক্ষেত্রেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর অতিক্রম করে যেতে হবে এবং আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক বিপ্লব যেহেতু অসমান্ত ও অমীমাংসিত, তাই তার সমাধার উপরই আমাদের সর্বাধিক মনোনিবেশ করতে হবে। বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্রের সাম্প্রতিক বিপর্যয় প্রমাণ করেছে যে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজগুলিকে পাশ কাটিয়ে সমাজতন্ত্র গঠনের তাড়াহুড়ো আমাদের কোনো বাড়তি সুবিধা এনে দেয় না।

ভারতবর্ষে পুঁজি তার আধুনিক শিল্পীয় রূপে কিছু পরিমাণে বিকাশ লাভ করেছে এবং কৃষিতে তার অনুপ্রবেশ যথেষ্ট। শ্রমের শোষণ প্রায়শই পুঁজিবাদী রূপ গ্রহণ করে। সংবিধান, প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদ এবং বিচারব্যবস্থা – বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আধুনিক সমস্ত প্রতিষ্ঠানই এখানে রয়েছে। অনেকেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দেওয়ার প্রলোভন সংযত করতে পারবেন না। কিন্তু এটি বিষয়টির একটি দিক মাত্র।

অন্যদিকে রয়েছে মধ্যযুগীয় অবশেষ, সামন্ততান্ত্রিক ও আধা-সামন্ততান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, প্রতিক্রিয়াশীল ব্রাহ্মণ্যবাদী জাতি ব্যবস্থা, ধর্মীয় মৌলবাদ। এককথায় পুরোনো ব্যবস্থার লক্ষণসমূহ। তাছাড়া রয়েছে এই ব্যবস্থার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অত্যন্ত শক্তিশালী আমলাতন্ত্র, আর এসবই পুঁজিবাদী শোষণের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে। পক্ষান্তরে পুঁজি এক বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, কিন্তু ভারতবর্ষের পুঁজি গাঁটছড়া বেঁধে রয়েছে পুরোনো সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির সঙ্গে।

এছাড়াও আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির উপর ভারতীয় পুঁজির মাত্রাধিক নির্ভরতা হল ভারতীয় পুঁজির আর একটি বৈশিষ্ট্যমূলক দিক।

ভারতবর্ষে সমস্ত আধুনিক বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানই তৃণমূলে তামাশা হয়ে দাঁড়ায়। গোটা পরিবেশই শ্রেণী সচেতনতার বিকাশকে প্রচণ্ডভাবে অবরুদ্ধ করে এবং সমস্ত স্তরের জনগণের মধ্যেই রাজনৈতিক চিন্তার বিকাশকে ব্যাহত করে। ফলে এমনকি শহুরে ও গ্রামীণ সর্বহারাকে সংগঠিত করা ও কমিউনিস্ট ধারায় তাদের সংহতি গড়ে তোলা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।

এই পরিস্থিতিতে সাধারণ গণতান্ত্রিক দাবিগুলি পূরণ করা ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করা ব্যতীত সমাজতন্ত্রের জন্য প্রকৃত কোনো সংগ্রামে নামা সম্ভব নয়। আর বুর্জোয়া শ্রেণীর কোনো অংশের পক্ষেই যেহেতু গণতন্ত্রের জন্য এই সংগ্রামে সম্পূর্ণরূপে ও দৃঢ়ভাবে নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব নয়, তাই এই সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া সর্বহারা ও তার পার্টি কমিউনিস্ট পার্টির ঐতিহাসিক কর্তব্য। দীর্ঘস্থায়ী এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি সমাজতন্ত্রের জন্য চূড়ান্ত সংগ্রামের শর্তাবলী সৃষ্টি করে ও সুগম করে তোলে।

ইউরোপের মধ্যে সর্বাপেক্ষা পশ্চাদপদ ও মূলত আধা-সামন্ততান্ত্রিক দেশ রাশিয়ায় লেনিন বারংবার এই বিষয়টির উপর জোর দিয়েছিলেন এবং শ্রমিক ও কৃষকের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের ধারণাকে সূত্রবদ্ধ করেছিলেন। আধা-সামন্ততান্ত্রিক চীনে মাও এই লেনিনীয় তত্ত্বের সফল রূপায়ন করেন। তিনি চারটি শ্রেণীর (যথা শ্রমিক, কৃষক, পেটিবুর্জোয়া ও জাতীয় বুর্জোয়া) একনায়কত্বের ধারণা সামনে নিয়ে আসেন এবং এর নামকরণ করেন নয়া গণতন্ত্র।

উপরের আলোচনা থেকে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। প্রথমত স্বাধীন ও দৃঢ় নীতিনিষ্ঠ একটি কমিউনিস্ট পার্টির আমাদের প্রয়োজন, যে পার্টি সমাজতন্ত্রের বিজয়ের জন্য একমাত্র প্রতিশ্রুতিই নয়, গণতান্ত্রিক বিপ্লবের চূড়ান্ত বিজয়ের জন্যও অপরিহার্য।

দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রের গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের বিস্মৃত হলে চলবে না, এবং যে কারুর চেয়ে বেশি জোরের সাথে আগে গণতন্ত্রের পতাকা তুলে ধরতে হবে। স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, প্রতিক্রিয়াশীল জাতি ব্যবস্থা, ধর্মীয় মৌলবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে সংক্ষেপে পুরোনো ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লবী গণতন্ত্রের সমস্ত শক্তিগুলির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রচেষ্টা সবসময়েই চালাতে হবে।

বিপ্লবী গণতান্ত্রিক শক্তি বলতে আমরা বুঝি সেই সমস্ত শক্তিকে যারা কমিউনিস্ট পার্টির গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে স্বীকার করে এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে দৃঢ় ও সক্রিয় কিন্তু কমিউনিস্ট শ্রেণী-চেতনার অভাব আছে। এই শক্তিগুলি বিবিধ চরিত্রের এবং তারা সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের বিভিন্ন উত্তরণের পর্যায়ে থাকে। শুরুতে, বিভিন্ন অ-পার্টি রূপে তাদের আবির্ভাব ঘটে, অথবা তাঁরা কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের ভিতরে প্রেসার-গ্রুপ হিসাবে কাজ করে। তাদের বিপ্লবী গণতন্ত্রী হিসাবে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কমিউনিস্ট পার্টির গণতান্ত্রিক কর্মসূচির স্বীকৃতির বিষয়টিকে নিছক আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি হিসাবে বুঝলে চলবে না বরং তাদের সঙ্গে চুক্তি একটি অলিখিত সংগ্রামী চুক্তিই হতে পারে। আমাদের কর্তব্য হল এই সব শক্তিগুলিকে চিহ্নিত করা, বিপ্লবী গণতন্ত্রী হিসাবে তাদের বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করা এবং তাদের সাথে সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তোলা।

আইপিএফ হল আমাদের পার্টির ঐ প্রয়াসের প্রতীক। তাছাড়া আইপিএফ শুধুমাত্র আমাদের পার্টি কর্তৃক যান্ত্রিকভাবে গড়ে তোলা একটি সংগঠনই নয়, তা শক্তিশালী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্যে থেকেই বেড়ে উঠেছে এবং এক বিশিষ্ট চরিত্র গ্রহণ করেছে।

আমাদের দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে বিপ্লবী গণতন্ত্রীদের দ্বারা একটি স্বতন্ত্র সংগঠিত গণতান্ত্রিক পার্টি গড়ে তোলার কোনো প্রচেষ্টাই এযাবৎ ফলদায়ক হয়নি। একটি অ-পার্টি রাজনৈতিক সংগঠন নিয়ে স্বামী অগ্নিবেশের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চাষিদের সংগঠনগুলির একটি জাতীয় সমন্বয় মঞ্চ এবং এমনকি ডিপিএফ-এর আবির্ভাব – এসবই আমরা অত্যন্ত আগ্রহের সাথে নিরীক্ষণ করেছি। তাদের মধ্যে কেউই এমন একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক পার্টিতে বিকাশলাভ করতে পারেনি যাদের সঙ্গে আমরা একটি সংগ্রামী ঐক্য গড়ে তুলতে পারতাম, আর বিপ্লবী ও উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মধ্যে দোদুল্যমান এই শক্তিগুলি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জনতা দলের বিভিন্ন উপদলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।

বেশ ভালো সংখ্যক বিপ্লবী গণতন্ত্রী আইপিএফ-এ যোগ দেন এবং আইপিএফ হয়ে দাঁড়ায় কমিউনিস্ট পার্টি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে আসা অ-পার্টি গণতন্ত্রীদের এক সম্মিলিত ফ্রন্ট। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে আইপিএফ যদি তার কর্মসূচি ও কর্মতৎপরতার প্রতি অবিচল থাকে তবে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে বিশেষত জনতা দল থেকে গণতন্ত্রীদের নতুন স্রোত আইপিএফ-এ যোগ দেবে। পরবর্তী স্তরে আইপিএফ-কে তার স্লোগানগুলি পুনর্বিন্যাস করতে হবে, অধিকতর নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে এবং তার সামাজিক ভিত্তিকে প্রসারিত করার জন্য তার কর্মসূচি ও কাঠামোয় প্রয়োজনীয় বিন্যাস ঘটাতে হবে। তার বিকাশের প্রক্রিয়ায় এসবই অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু তার ভবিষ্যৎ অবশ্যই উজ্জ্বল।

দুই কৌশলের সংগ্রাম

প্রথমেই স্পষ্ট করে বলে নেওয়া যাক যে নকশালবাদ কোনো বিশেষ ধারা নয়, আর সেভাবে একে গড়ে তোলার কোনো অভিপ্রায়ও আমাদের নেই। সমগ্র বুর্জোয়া প্রচার এবং সিপিআই(এম)-এর প্রচারও নকশালবাদকে একটি বিশেষ, ভারতের মূলধারার আন্দোলন থেকে বিজাতীয় ‘নয়া বাম’-বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি ধারা হিসাবেই চিত্রিত করে। যেহেতু ১৯৭০ দশকে নকশালবাদ এক জনপ্রিয় বিপ্লবী আন্দোলন হিসাবে বিকাশলাভ করে তাই স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন পেটিবুর্জোয়া ধারাগুলি এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় এবং তাদের কেউ কেউ একে এক বিশেষ ‘নয়া বাম’ ধারায় রূপান্তরিত করার চেষ্টা চালায়। ধাক্কা ও অজস্র ভাঙ্গনের একটি পর্যায়ের পর এই পেটি বুর্জোয়া ধারাগুলি অবশেষে পৃথক হয়ে যায় এবং পরবর্তীতে নৈরাজ্যবাদে পরিণতি লাভ করে, আর আন্দোলনের মূল অংশটি ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী ধারা হিসাবে পুনরায় তার অস্তিত্ব ঘোষণা করতে সমর্থ হয়।

প্রতিটি দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনই, অন্ততপক্ষে বিপ্লব সমাধা হওয়ার আগে পর্যন্ত, সবসময়েই বিপ্লবী ও সুবিধাবাদী ধারায় বিভক্ত হয়ে থাকে, আর ভারতবর্ষও তার ব্যতিক্রম হতে পারে না।

আমাদের প্রথম পর্যায়ের সমগ্র নেতৃত্ব সাধারণভাবে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে কৌশলগত দুই লাইনের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম এবং বিশেষভাবে সিপিআই(এম)-এর সঙ্গে সংগ্রামের মধ্য থেকে উঠে এসেছিলেন। আমাদের পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড চারু মজুমদার বারবার বলেছেন, যে কমিউনিস্ট পার্টির পতাকাতলে কমিউনিস্টরা পুন্নাপ্রা ভায়লার, তেভাগা ও তেলেঙ্গানায় বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছেন এবং শহীদত্ব বরণ করেছেন, আমরা সেই কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরাধিকারী।

‘নয়া বাম’ বলে আমাদের যতই অস্বীকার করা হোক না কেন, ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সুবিধাবাদী ধারার, যার প্রতিনিধিত্ব করছে সিপিআই(এম), বিপরীতে আমরা সবসময়ই বিপ্লবী ধারা হিসাবে ছিলাম, এবং ভবিষ্যতেও থাকব।

কিছু কিছু ব্যক্তি আমাদের ছেড়ে গেছেন এবং ভবিষ্যতেও ঐ ধরনের দলত্যাগের ঘটনা আমরা উড়িতে দিতে পারি না। কিন্তু যে ধারার আমরা প্রতিনিধিত্ব করি তাকে ধ্বংস করা যাবে না, কেননা ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের ৭০ বছরের ইতিহাসের গভীরে তার শিকড় প্রোথিত এবং বিপ্লবী সমাধানের জন্য দাবি জানাচ্ছে যে বাস্তব পরিস্থিতি, তা ঐ ধারাকে আরও শক্তিশালী করছে।

মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। সিপিআই(এম)-এর কৌশলগত লাইন তিনটি উপাদান নিয়ে গঠিত, যে উপাদানগুলিকে নেতৃত্ব যান্ত্রিকভাবে একটি সমগ্রে মেলাতে সচেষ্ট।

প্রথমত, পশ্চিমবাংলার বামফ্রন্ট সরকারকে দেশের সর্বাপেক্ষা উন্নত বাম সংগঠন এবং এই মডেলের সৃষ্টি ও স্থায়িত্বকে প্রধান সাফল্য বলে মনে করা হয়।

দ্বিতীয়ত, কংগ্রেস(ই)-র প্রত্যাবর্তনকে রোখা ও বিজেপির সাম্প্রদায়িক চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করার জন্য বাম ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির, অর্থাৎ জনতা দল ও ন্যাশনাল ফ্রন্ট-এর ব্যাপক ঐক্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।

তৃতীয়ত, জাতীয় ঐক্যকে রক্ষা করাই বামেদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে বিবেচনা করা হয় এবং এই অছিলায় কংগ্রেস(ই) ও বিজেপির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অলিখিত সমঝোতায় পৌঁছানো হয়।

সিপিআই(এম)-এর কৌশলগত লাইনকে কী দিয়ে বিচার করব? প্রধান সাফল্য অথবা অগ্রাধিকার অথবা সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভিত্তিতে? আসুন প্রকাশ কারাতের সাহায্য নেওয়া যাক।

তিনি বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষ মঞ্চে বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের অধিকাংশ দলগুলিকে সমাবেশিত করা, যে মঞ্চ রাজনৈতিক জোট গঠনে সাহায্য করবে এবং ঐ জোট বিরোধীপক্ষের মধ্যে ফাটল ধরানোর কংগ্রেস(ই)-র কূটকৌশলের মোকাবিলা করবে এবং বিজেপি-বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পিছনে সাম্প্রদায়িক সমাবেশের গুরুতর বিপদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে – এই সন্ধিক্ষণে সিপিআই(এম) ঐ কাজে সফল কিনা তার ভিত্তিতেই সিপিআই(এম)-এর কৌশলগত লাইনকে বিচার করতে হবে।’ ১৯৯০-এর অক্টোবরের আগেই প্রকাশ[১১] ঐ কথা লিখেছেন। যেহেতু বিষয়টি বর্তমান আলোচনার পরিধির বাইরে, তাই প্রকাশের ঐ রচনার পর থেকে ঐ লাইনের সাফল্য অথবা বিপরীতকে বিচার করার প্রলোভন আমরা সম্বরণ করব।

সোজা কথায় বলতে গেলে, প্রকাশ যা বলেছেন এবং সিপিআই(এম) যা বিশ্বাস করে তা হল বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিপদের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের দলগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করাই বর্তমান সন্ধিক্ষণে বামেদের প্রধান কৌশল। মঞ্চটি মূলত যদি ধর্মনিরপেক্ষ হয় এবং বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষকে যদি মূলত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি হিসাবে বর্ণনা করা হয়, তবে এটা স্পষ্ট যে সমগ্র সমাবেশটিই বিজেপি যে সাম্প্রদায়িকতার প্রতিনিধিত্ব করে তার বিরুদ্ধেই পরিচালিত। কংগ্রেস(ই)-কে যেহেতু সাম্প্রদায়িক দল হিসাবে বিবেচনা করা হয় না তাই এই কৌশলের যুক্তিযুক্ত সম্প্রসারণ হবে কংগ্রেস(ই)-কে অথবা অন্ততপক্ষে তার একটি শক্তিশালী অংশকে অন্তর্ভূক্ত করে ধর্মনিরপেক্ষ মঞ্চটির বিস্তার ঘটाনো।

রাজনৈতিক পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় বর্তমান মুহূর্তে তাঁরা ঠিক এটিই করছেন। সমগ্র কৌশল যে রণনীতিগত উপলব্ধি থেকে উদ্ভূত হচ্ছে তা হল, ভারতবর্ষ যেহেতু বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে রয়েছে তাই এটি স্পষ্ট যে মৌলবাদ ও ধর্মীয় গোঁড়ামিবাদের প্রাচীন শক্তিগুলির বিরুদ্ধে সংগ্রামে বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষকেই নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসতে হবে। বামেরা দুর্বল এবং এই সন্ধিক্ষণে দুর্বল থাকাই তাঁদের নিয়তি এবং খুব বেশি হলে তারা যা করতে পারেন তা হল এগিয়ে যাওয়ার জন্য বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করা। গুরুত্বপূর্ণ হিন্দিবলয়ে পার্টি জনতা দলের লেজুড়বৃত্তি করেই অগ্রগতির কথা ভাবতে পারে, এবং অন্ধ্রে তেলেগু দেশম ও তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-র সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করা হয়। ভারতবর্ষে তার ভাগ্য এইভাবে বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের উত্থান-পতনের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, ত্রিপুরা বাদে – যেখানে কোনো বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষ নেই বললেই চলে। মজার কথা হল, কয়েক দশক ধরে বামপন্থার স্বাধীন আত্মঘোষণা ও শক্তিশালী গণআন্দোলনের প্রক্রিয়াতেই কমিউনিস্টদের ঐতিহ্যবাহী এই শক্তিশালী দুর্গগুলি তৈরি হয়েছিল।

সিপিআই(এম) ও তার ছোটো ভাই সিপিআই সব সময়ই আমাদের এই বলে নিন্দা করে যে আমরা কংগ্রেস(ই) ও বিজেপির বিপদকে ছোটো করে দেখি। ঘটনা হল যে, সিপিআই(এমএল) তার সমগ্র ইতিহাসে, বিজেপি অথবা কংগ্রেস(ই)-র সাথে কখনই খোলা অথবা গোপন কোনো চুক্তি করেনি। ঐ ধরনের চুক্তির ‘কৃতিত্ব’ সিপিআই ও সিপিআই(এম)-এর মতো বামেদেরই প্রাপ্য। আর সেই জন্য সঠিকভাবেই তাঁদের ‘সুবিধাবাদী’ বলে অভিহিত করা হয়। জনতা দলের পিছু পিছু চলার তাঁদের কৌশলের যথার্থতা প্রমাণের লক্ষ্যেই আমাদের বিরুদ্ধে ঐ বিপদকে ছোটো করে দেখার অভিযোগ আনা হয়। একইভাবে আমাদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ করা হয় যে আমরা জাতীয় ঐক্যের প্রতি বিপদকে ছোটো করে দেখেছি। এটিও আবার কংগ্রেস(ই) ও বিজেপির সঙ্গে তাঁদের সমঝোতার যৌক্তিকতা প্রমাণের প্রয়াস। আমাদের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ যে বিভিন্ন বর্ণের বুর্জোয়া দলগুলির মধ্যে পার্থক্য করি না এবং একটি একক প্রতিক্রিয়াশীল সমষ্টি হিসাবেই তাদের দেখি। নিজেদের লেজুড়বৃত্তিকে ঢাকার উদ্দেশ্যেই এই সমস্ত কুৎসামূলক অভিযোগের অবতারণা।

১৯৮৯-র নভেম্বরে ভি পি সরকার যখন আস্থা ভোট চায়, সংসদে আমাদের একমাত্র প্রতিনিধি ভোটদানে বিরত থাকেন, তা মূলত এই কারণে যে ঐ সরকার বিজেপির সমর্থনে দাঁড়িয়েছিল। কংগ্রেস(ই)-বিজেপি জোটের কাছ থেকে যখন ঐ সরকারের বিপদ এলো ঐ একই সদস্য তখন সরকারের পক্ষে ভোট দিলেন। কংগ্রেস(ই)-বিজেপি বিরোধিতার মুখে আমরা বিহারের লালু সরকারকে সমর্থন করেছিলাম, তা করেছিলাম নীতিগত দিক থেকে, প্রকাশের অভিযোগ মতো বাধ্য হয়ে নয়। এই সংসদেও আমাদের একমাত্র সাংসদ কংগ্রেস(ই) সরকারের আস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন।

বুর্জোয়া দলগুলির মধ্যে আমরা অবশ্যই পার্থক্য করি আর তাই কংগ্রেস(ই) ও বিজেপির বিরুদ্ধে জনতা দলের মতো দলের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনে অংশ নিয়েছি।

বিষয়টি হল যে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের শক্তিগুলির মধ্যে আমরা আরও একটি পার্থক্য করি, অর্থাৎ উদারনৈতিক ও বিপ্লবী গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্যকরণ। বিপ্লবী গণতন্ত্রের শক্তিগুলিকে আমরা সমস্ত ধরনের উদারনীতিবাদী মোহ থেকে মুক্ত করে বিপ্লবী শিবিরের দিকে জয় করে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। বিপ্লবী ও সুবিধাবাদী কৌশলগত লাইনের মধ্যে স্বাধীন বাম অগ্রগতি এবং বুর্জোয়া বিরোধী দলগুলির অধিকাংশকে ধর্মনিরপেক্ষ মঞ্চে তথাকথিত সমাবেশিত করার নীতির মধ্যে, গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সর্বহারা আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা ও বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষের পিছন পিছন চলার প্রচেষ্টার মধ্যে এই হল মূল পার্থক্য। এই দুই লাইনের সংগ্রামই ভারতীয় বিপ্লবের ফলাফল নির্ধারণ করবে এবং হিন্দি বলয়ই ঐ বিতর্ক সমাধানের আদর্শ ক্ষেত্র। দুই কৌশল সম্পর্কে লেনিন যা বলেছেন তা দিয়ে রাজনৈতিক কৌশলের উপর এই বিতর্কের ইতি টানা যাক ...।

“বুর্জোয়াদের কোন অংশগুলি সর্বাহারার সাথে মিলে রাশিয়ার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব শেষপর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারে, এটা বুঝতে না পারাই সামগ্রিকভাবে মেনশেভিকবাদের মূল ভ্রান্তি। বুর্জোয়া বিপ্লব করতে হবে “বুর্জোয়াদেরই” (“বর্ণ” নিরপেক্ষ সাধারণভাবে বুর্জোয়া শ্রেণী) আর সর্বহারা শ্রেণীর কাজ হবে তাকে সাহায্য করা – এই জাতীয় চিন্তা আজও মেনশেভিকদের বিপথে চালিত করছে। ... বলশেভিকরা বলে এসেছে এবং আজও বলে যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যুগে (যতদিন না সেই বিপ্লব জয়ী হচ্ছে) সর্বহারার একমাত্র দৃঢ় ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু হল কৃষক। কৃষকরাও হচ্ছে “বুর্জোয়া শ্রেণী,” কিন্তু কাডেট বা অক্টোবরবাদীদের চেয়ে “বর্ণে” সম্পূর্ণ আলাদা। ... জমিদার সত্তার খোদ বনিয়াদের বিরুদ্ধে এবং তার সাথে যুক্ত পুরাতন রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামতে এই বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরা হলেন বিপ্লবী গণতন্ত্রী।” (কমরেড প্লেখানভ সমাজগণতান্ত্রিক কৌশলের প্রশ্নে কেমনভাবে বিতর্ক করেন রচনা থেকে।)

আমাদের কর্মীদের মধ্য থেকে যে কোনো বুর্জোয়া দলের সঙ্গে কোনোরকম জোট বাঁধার প্রধান বিরোধিতা যে যুক্তি নিয়ে হাজির হয় তা হল, কমিউনিস্ট হিসাবে সমস্ত বুর্জোয়া দলগুলিকেই উন্মোচিত করা আমাদের মৌলিক কর্তব্য; কাজেই তাদের কারো সাথেই কোনোরকম এমনকি সাময়িক জোটও বাঁধি কী করে। লেনিনকে পুনরায় উদ্ধৃত করা যাক, “সমস্ত দেশে এবং সব সময়েই সকল বুর্জোয়া দলগুলিকে উন্মোচিত করা সমাজতন্ত্রীদের কর্তব্য। বুর্জোয়া বিপ্লবের কালে ‘সমস্ত বুর্জোয়া দলগুলিকে উন্মোচিত কর’ বলার অর্থ কিছুই না বলা, এবং অবশ্যই অসত্য বলা, কেন না নির্দিষ্ট বুর্জোয়া দলগুলি যখন ইতিহাসের পুরোভূমিতে প্রবেশ করে, কেবলমাত্র তখনই তাদের আন্তরিক ও সম্পূর্ণভাবে উন্মোচিত করা যায়।” (কমরেড প্লেখানভ সমাজগণতান্ত্রিক কৌশলের প্রশ্নে কেমনভাবে বিতর্ক করেন রচনা থেকে)

উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক দলগুলি সম্পর্কে আমাদের কৌশল

উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের মতো রাজ্যগুলিতে ঐতিহাসিকভাবে সমাজবাদী ধারার শক্তিশালী উপস্থিতি ছিল। সময়ের ধারায় এবং রাজনৈতিক স্রোতের সঙ্গে সংমিশ্রণের জটিল প্রক্রিয়ায় এখন তা জনতা দলের রূপ পেয়েছে এবং কৃষক জাতিগুলির মধ্যে তার যথেষ্ট প্রভাব আছে। তার ঘোষণার মধ্য দিয়ে সে উদারনীতিবাদী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তুলে ধরে এবং গণতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী ও মুসলিম সংখ্যালঘুদের এক বড় অংশকেও সম্প্রতি প্রভাবিত করতে পেরেছে। এ সমস্তই তার সঙ্গে আমাদের আন্তঃক্রিয়াকে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। লেনিন বলেছেন “নিজেদের ওপর যাদের আস্থা নেই, তারাই কেবল অবিশ্বস্ত লোকেদের সঙ্গে সাময়িক জোট বাঁধতে ভয় পায়; ঐ ধরনের জোট ছাড়া কোনো রাজনৈতিক পার্টি বেঁচে থাকতে পারে না।”

জোট বাঁধার অবশ্য দুটি পন্থা আছে। একটি হল সিপিআই ও সিপিআই(এম) অনুসৃত সুবিধাবাদী পথ, যে পথে উদারনীতিবাদ ও গণতন্ত্রের কোনো শ্রেণী বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন হয় না। কংগ্রেসের পুর্বতন পর্যায়ের ‘সমাজতান্তিক’ স্লোগান হোক অথবা ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে মুলায়ন সিং যাদবের আড়ম্বরপূর্ণ বুলিসর্বস্বতা হোক আর ভি পি সিং-লালু যাদব ইত্যাদির ‘সামাজিক ন্যায়’ই হোক, সুবিধাবাদীরা প্রশংসায় তাদের আকাশে তোলে। বুর্জোয়া রাজনীতিবিদদের শুভ অভিপ্রায়, সদাশয়তা, চমৎকার কথাবার্তা ও মনোরম শ্লোগানের উপরই ভিত্তি করে রয়েছে ঐ দৃষ্টিভঙ্গি।

বিপ্লবী পন্থা বুর্জোয়া রাজনীতিবিদদের বিশ্বাসযোগ্যতার উপরো ভিত্তি করে না আবার তারা যে তাদের সত্তার অবিচ্ছেদ্য উপাদান – বুলিসর্বস্বতা ও ধূর্তামি ত্যাগ করবে, তাও প্রত্যাশা করে না। উদারনীতিবাদ ও গণতন্ত্রের শ্রেণী বিশ্লেষণের উপরই সে ভিত্তি করে, কোনো নির্দিষ্ট বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ বা দল বাস্তবে তার সঙ্গে যতটুকু যেতে পারে ততটুকুই সে সনাক্ত করে এবং সংগ্রামের ময়দানেই সহযোগিতা চায়। আর চুক্তি সম্পাদনের যোগ্য এমন সৎ ও দয়ালু বুর্জোয়াদের মানদণ্ড নির্ধারণ করার পরিবর্তে, লেনিনের কথায় “যে কোনো, এমনকি সবথেকে নিকৃষ্ট বুর্জোয়াকেও সমর্থন করে, আর ততটুকুই করে যতটুকু সে স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রকৃত সংগ্রাম করে।” লেনিন আরও বলেছেন, “সর্বহারার স্বাধীন সমাজ-বিপ্লবী লক্ষ্যকে অর্জন করার স্বার্থেই ঐ সমর্থন জরুরি।” (শ্রমিকশ্রেণী ও বুর্জোয়া গণতন্ত্র থেকে)

কেন্দ্রে জনতা দলের এগারো মাসের শাসককালে সংসদে আমরাই একমাত্র বামপন্থী বিরোধীপক্ষ ছিলাম, বিহার ও আসাম বিধানসভায় এবং সংসদে এখনও আমরা ঐ ভূমিকা পালন করে চলেছি। বিহারে উচ্ছ্বাসের বন্যা বয়ে যাওয়া সত্ত্বেও মণ্ডল অভিযানের শোভাযাত্রিকদের দলে যোগ দিতে আমরা অস্বীকার করেছি, আর যখন এমনকি জনতা দল কর্তৃক বিস্তারিত ‘সামাজিক ন্যায়’-এর উদারনৈতিক মোহ ব্যাপক সংখ্যক গণতান্ত্রিক মানুষকে অভিভূত করে ফেলল, তখনও আমরা বিপ্লবী গণতন্ত্রের স্বাধীন পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছি। জনতা দলের মণ্ডলায়িত রাজনীতির প্রতি নিঃশর্ত ও সমালোচনাহীন সমর্থন দিতে অস্বীকার করেছি এবং তার সীমাবদ্ধ শ্রেণী লক্ষ্য, ‘কাজের অধিকারের’ প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ও তার পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বাপেক্ষা নিপীড়িত জনগণের উপর সামাজিক অন্যায় চাপিয়ে দেওয়াকেও উন্মোচিত করেছি।

১৯৮৯-এর নির্বাচনে মুসলিম সংখ্যালঘু জনগণের কংগ্রেস(ই)-র কবল থেকে বেরিয়ে এসে বাম দলগুলি ও জনতা দলের সঙ্গে যোগ দেওয়া যদি নিশ্চিতভাবে মুসলিম রাজনীতির ধর্মনিরপেক্ষকরণের ইঙ্গিতবাহী হয়ে থাকে, বিপরীতে ১৯৯১-এ জনতা দল নেতৃবৃন্দের মুসলিম মৌলবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে এক নীতিহীন চুক্তিতে পৌঁছনো মুসলিম জনগণের উপর ঐ শক্তিগুলির কব্জাকে আরও শক্তিশালী করেছে মাত্র। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঝুঁকি নিয়েও বাম ও গণতান্ত্রিক শিবির থেকে কেবলমাত্র আমরাই জনতা দলের এই অন্ধকারাচ্ছন্ন দিককে উন্মোচিত করেছি।

যে বিষয়ের ওপর আমি জোর দিতে চাইছি তা হল, আমাদের পার্টি কখনই বিপ্লবী গণতন্ত্রের পতাকার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি এবং সিপিআই-এর মতো জনতা দলের সহযোগিতায় নিছক একটি সংসদীয় আসনের জন্য আমাদের ধারাবাহিক নীতিগত অবস্থান ত্যাগ করতে অস্বীকার করেছি।

পরিস্থিতি গুণগত পরিবর্তন ঘটেছে। কংগ্রেস কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে, বিজেপি তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করেছে, জনতা দল তার প্রথাগত বিরোধীদলের ভূমিকায় ফিরে গেছে এবং তার দুর্গগুলিতেই ফিরে গেছে। কংগ্রেস(ই) ও বিজেপির বিরুদ্ধে জনতা দলের সঙ্গে যৌথ আন্দোলনের সম্ভাবনাগুলির অনুসন্ধান করতে হবে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে জনতা দল একটি পাঁচমিশেলী ধরনের পার্টি এবং বিভিন্ন প্রবণতা ও উপদল তার মধ্যে কাজ করে। যে কোনো ধরনের যৌথ কার্যকলাপ এবং সাময়িক মৈত্রী তার সঙ্গে গড়ে তুলি না কেন, আমাদের লক্ষ্য হবে তার মধ্যে ভাঙ্গন ঘটানো এবং বিপ্লবী গণতন্ত্রের অভিমুখী শক্তি ও উপদলগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলা।

দলিত ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার আন্দোলনগুলি সম্পর্কে আমাদের কৌশল

ভারতবর্ষে বিভিন্ন রাজ্য ও অঞ্চলে বিভিন্ন প্রকারের রাজনৈতিক শক্তিগুলি উঠে এসেছে এবং তাদের প্রতি আমাদের সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণ করতে হবে।

উদাহরণস্বরূপ দলিতদের স্বার্থকে তুলে ধরছে এমন একটি পার্টি বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) উত্তরপ্রদেশে এক স্থায়ী ভিত্তি অর্জন করেছে। তাদের নেতৃত্ব চরম বাম বিরোধী, রাজনৈতিকভাবে চরম সুবিধাবাদী এবং দলিত আমলাতন্ত্রের স্বার্থেরই মূলত প্রতিনিধিত্ব করে। ব্যাপক দলিত জনতা যারা আবার ভূমিহীন ও দরিদ্র কৃষক তাদেরকে ঐ নেতৃত্বের নির্দিষ্ট কিছু দেওয়ার নেই। তবুও তারা দলিত জনগণের আকাঙ্খা ও জঙ্গীভাব জাগিয়ে তুলেছে, বিপ্লবী গণতান্ত্রিক দিশা গ্রহণ করার সম্ভাবনা তাদের যথেষ্ট রয়েছে। কাজেই বিএসপি সম্পর্কে আমাদের কৌশলের পুনর্বিন্যাস করতে হবে, নির্দিষ্ট ইস্যুতে সাময়িক জোট বাঁধা এবং ঐ প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক অংশটিকে প্রভাবিত করে জয় করে নিয়ে আসার সম্ভাবনাগুলি অনুসন্ধান করতে হবে।

তামিলনাড়ুতে পিএমকে-র প্রতি একই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারি। তার যদিও দলিত বিরোধী একটি ঝোঁক আছে, তবুও তা অনগ্রসর জাতিগুলির জোটে এবং প্রথাগত দ্রাবিড় রাজনীতি থেকে ভাঙ্গনের প্রতীক।

কার্বি আংলং-এ স্বশাসনের প্রশ্নের সঙ্গে সমাজের অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপান্তরণের বিষয়টি যুক্ত করার অভিজ্ঞতা, যদিও খুবই ক্ষুদ্র স্তরে, কিছু বিস্তারিত উল্লেখের দাবি রাখে।

ঐ একই জাতিসত্তা থেকে উদ্ভূত কমিউনিস্ট ও জাতিসত্তা আন্দোলনের গণতান্ত্রিক ব্যক্তিদের সাধারণ ফ্রন্ট এএসডিসি একটি জনপ্রিয় গণআন্দোলনের মধ্য থেকে উঠে আসে। কংগ্রেস(ই) নিয়ন্ত্রিত জেলা পরিষদের দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হয়েছিল ঐ আন্দোলন। ওখানে কংগ্রেস(ই)ও একটি স্বশাসিত রাজ্যের দাবি তুলে ধরে। একেবারে শুরু থেকেই আন্দোলনের মধ্যে শ্রেণীসংগ্রামের একটি উপাদান ছিল যা মূলত কংগ্রেস(ই)-র মদতপুষ্ট মহাজন, জমিদার ও অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে মূলত ব্যাপক সংখ্যক ভূমিহীন, দরিদ্র ও মধ্য কৃষকদের সংগ্রাম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিক্রিয়াশীলরাও ছিল একই জাতিসত্তার লোক। কমিউনিস্টরাই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন, ঐ কমিউনিস্টরা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আন্দোলনের সামগ্রিক প্রভাব থেকেই কমিউনিস্ট শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন এবং আন্দোলনকে প্রবাহিত করেন কার্বি অন্দোলনে, উল্টোটা নয়। শক্তিশালী ও জঙ্গী গণআন্দোলনের উদ্দীপ্ত শিখার মধ্যেই জেলা পরিষদের নির্বাচনে সাফল্য আসে। সামাজিক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াশীলদের উপর আগেই বিজয় অর্জন করা হয়েছিল। আর তারপর থেকেই গণকার্যকলাপকে গভীরতর করা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করা ও শ্রেণীসংগ্রামকে তীব্রতর করে তোলার প্রচেষ্টা চলছে। জাত্যাভিমানের ঝোঁক থেকে মুক্ত এএসডিসি অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তাগুলির উপর প্রভাব প্রসারিত করতে পেরেছে, বিহারীদের মধ্যে মেরুকরণ ঘটিয়ে এবং ঐ অঞ্চলের বাঙালি ও অসমীয়া জনগণের অংশের সমর্থনও ভোগ করে।

আমাদের পার্টির কৌশলে শুধুমাত্র জেলা পরিষদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার পরিবর্তে আসাম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য উপজাতিগুলির জাতিসত্তা আন্দোলনে বিপ্লবী গণতন্ত্রী দিশা প্রদানের জন্য এবং অসমীয়া সমাজের গণতান্ত্রিক পুনর্বিন্যাসের জন্য এএসডিসি-কে উল্লম্ফন মঞ্চ হিসাবে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা আছে। এএসডিসি-র এই পুরোদস্তুর রাজনৈতিক ভূমিকা এবং বিভিন্ন স্তরের জনগণ ও অন্যান্য অঞ্চলের উপর তার ক্রমবর্ধমান প্রভাব তাকে বিশিষ্টরূপ প্রদান করেছে।

কার্বি আংলং-এর অভিজ্ঞতার আলোকে যে প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে উঠে আসে তা হল ঝাড়খণ্ড, উত্তরাখণ্ড এবং ঐ ধরনের অন্যান্য আন্দোলনগুলি সম্পর্কে আমাদের কৌশলের পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে কী না।

কমরেড এ কে রায় যখন ভেবেছিলেন যে উপজাতিদের রাজ্য ঝাড়খণ্ড, যার সমাজের মধ্যে আদিম সাম্যবাদের বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তা নিজের থেকেই লালভূমিতে রূপান্তরিত হবে, সেটা তাঁর ভ্রান্তিই ছিল। ঐ প্রক্রিয়ায় তিনি একজন আদিম বুর্জোয়া শিবু সোরেনকে সৃষ্টি করতে পেরেছেন মাত্র।

প্রশ্ন হল ঝাড়খণ্ডকে লালভূমিতে রূপান্তরিত করার এবং ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলির বিপক্ষে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েই তা করা সম্ভব। ঝাড়খণ্ডীদের মধ্যে এক শক্তিশালী কমিউনিস্ট গ্রুপের উপস্থিতি সম্বলিত একটি শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষেই ঐ কৌশল অনুসরণ করা সম্ভব।

ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা নিজেই তার দাবি নামিয়ে এনে এখন শুধুমাত্র বিহার রাজ্যের জেলাগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ ঝাড়খণ্ড রাজ্যের দাবি রাখছে, এমনকি বিহারের মধ্যেই স্বশাসিত ধরনের এলাকার কথাও বলছে। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা বিভিন্ন শক্তিশালী গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং ঝাড়খণ্ড সমাজে কর্মরত রাজনৈতিক শক্তিগুলি ও সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে এই গোষ্ঠীগুলির মধ্যে রয়েছে পার্থক্য। আমাদের পার্টির প্রভাবও ঐ অঞ্চলে বেড়ে চলেছে এবং সক্রিয় হস্তক্ষেপের নীতি গ্রহণ করার পক্ষে আমরা ভালো অবস্থানে রয়েছি। এই হস্তক্ষেপের নীতি ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা বা তার মধ্যে কোনো গোষ্ঠীর সঙ্গে সাময়িক ঐক্যকেও নাকচ করে দেয় না।
উত্তরাখণ্ডে বিজেপি তার অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটিয়েছে এবং তার অগ্রগতিকে রোধ করার জন্য একটি স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবিকে সক্রিয়ভাবে তুলে ধরে সেখানে আমাদের কৌশলের পুনর্বিন্যাস করতে হবে।

স্থানীয় ও রাজ্য স্তরে সরকার গঠনের কৌশল

মার্কস বলেছিলেন যে, আমাদের কোনো সরকারি দলের পরিবর্তে ভবিষ্যতের বিরোধী দল গঠন করতে হবে। এই নীতিগত অবস্থানকে আমরা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে থাকি। ভারতীয় পরিস্থিতিতে অবশ্য নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির সঙ্গে জোট বেঁধে কমিউনিস্টদের আঞ্চলিক এমনকি রাজ্য স্তরেও সরকার গঠনের সুযোগ আছে। আমাদের কৌশলগত লাইন এই কৌশলকে নাকচ করে দেয়নি এবং অন্তত এক ব্যতিক্রম হিসাবেও একে বিবেচনার মধ্যে রাখা হয়েছে। অবশ্য গণআন্দোলনকে আরও ব্যাপক ও উন্নত স্তরে নিয়ে যাওয়ার অংশ করে তুলতে হবে এই কৌশলকে।

শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে গণআন্দোলনের স্তরকে উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার এবং সর্বভারতীয় স্তরে প্রভাব বাড়ানোর জন্য সিপিআই(এম)-এর কৌশলগত লাইনে, এই কৌশলের গুরুত্ব অপরিসীন। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও ত্রিপুরায় সরকার গঠন করতে তাঁরা সক্ষম হয়েছেন। পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকার একনাগাড়ে চৌদ্দ বছরের অধিক সময় ধরে চলছে। ভাগ্যের পরিহাস! এমনকি একটি দুর্দান্ত সাফল্য রের্কডই বটে, কিন্তু পার্টিকে তা গভীর এক তাত্ত্বিক সংকটের মধ্যেই ফেলে দিয়েছে।

সিপিআই(এম)-এর ঘোষণা  ও প্রত্যাশার বিপরীতে সর্বাপেক্ষা অগ্রগতি সম্পন্ন বাম সংগঠনটি এমনকি কোনো সীমান্তবর্তী রাজ্যেও প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, সর্বভারতীয় স্তরের কথা আর না বলাই ভালো। পশ্চিমবাংলার প্রতিটি বিজয় যে তার সর্বভারতীয় তাৎপর্যকে আরও বেশি বেশি করে হ্রাস করছে এবং তাকে নিছক পশ্চিমবাংলার ব্যাপার বানিয়ে ফেলেছে।

হিন্দি বলয়ে বিস্তার সাধনে পার্টিকে জনতা দলের স্লোগানগুলি অবিকল অনুসরণ করতে হয় এবং জনতা দলের জোট সঙ্গী হিসাবে চলতে হয়। বামফ্রন্ট সরকারের একমাত্র সাফল্য হিসাবে পার্টি সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলিকে সংযত রাখার দাবি করে থাকে। পশ্চিমবাংলায় বিজেপি ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠায় এই প্রচারও ধাক্কা খেয়েছে।

সিপিআই(এম) তাত্ত্বিকেরা পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট সরকারের সাফল্য নিয়ে প্রচুর কথা বলেন, কিন্তু তাদের কৌশলগত লাইন অনুযায়ী দেশের সর্বাপেক্ষা উন্নত বাম সংগঠনের উল্লম্ফন মঞ্চ হিসাবে যে অভিপ্রেত ভূমিকা নেওয়ার কথা ছিল তা চেপে যান।

জার্মানিতে কৃষক যুদ্ধ রচনায় এঙ্গেলস যা বর্ণনা করেছেন, সিপিআই(এম)-এর দুরবস্থার সঙ্গে তা মিলে যায়, “একটি চরমপন্থী দলের নেতার পক্ষে সর্বাপেক্ষা খারাপ যে ঘটনা হতে পারে তা হল, এমন এক যুগে সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করা যখন ঐ কর্তৃত্ব দিয়ে যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার কথা সেরকম আন্দোলন এখনও পরিপক্ক হয়ে ওঠেনি।”

এঙ্গেলসের মতে এমতাবস্থায় চরমপন্থী দলের নেতাকে “বিজাতীয় শ্রেণীর স্বার্থেই কাজ করে যেতে হবে এবং তার নিজের শ্রেণীকে বুলি ও প্রতিশ্রুতি দিয়েই সন্তুষ্ট রাখতে হবে এবং এই আশ্বাসই দিয়ে যেতে হবে যে ঐ বিজাতীয় শ্রেণী স্বার্থই তাদের স্বার্থ। ঐ অবস্থায় যে পড়বে তার সর্বনাশ অনিবার্য।”

নিয়মিত কি আমরা শুনতে পাই না যে বামফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ পশ্চিমবঙ্গে কলকারখানা খোলার ব্যাপারে টাটা, বিড়লা, গোয়েঙ্কাদের যে স্বার্থ আছে তাকে পশ্চিমবাংলা শ্রমজীবী জনগণের স্বার্থ বলেই চালিয়ে যাচ্ছেন?

প্রকাশ কারাত স্বীকার করেন যে পশ্চিমবঙ্গে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে তা সমাজগণতন্ত্রী ধাঁচেরই, কেননা বুর্জোয়া-জমিদার ব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করা সম্ভব নয়। তিনি আমাদের বুঝতে অনুরোধ করেছেন যে ঐ ধরনের রাজ্য সরকারগুলির যে পরিধি ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাতে দেশী ও বিদেশী একচেটিয়া পুঁজির সঙ্গে সহযোগিতায় যেতে তারা বাধ্য। তিনি স্বীকার করেছেন যে বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলিতে সরকারের ব্যর্থতা ও ত্রুটি রয়েছে। আমাদের বিরুদ্ধে প্রকাশের অভিযোগ, আমরা বামফ্রন্ট সরকারকে কার্যত অন্যান্য অ-কংগ্রেসী সরকারের পর্যায়ে ফেলি। আমাদের কাছে তাঁর দাবি আমরা অন্তত সমালোচনামূলক সমর্থন তো করতেই পারি, অন্য কথায় এক ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণেই বা আমাদের অসুবিধা কোথায়।

প্রিয় কমরেড, সমস্ত সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধেই আমরা যথেষ্ট অবহিত। এই সরকারের কাছ থেকে আমরা কোনো বিপ্লবী ভূমিকা আশাও করি না। ‘রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা’কে জাতীয় স্তরে হস্তক্ষেপের একমাত্র কর্মসূচি বানিয়ে এবং শুধু একাধারে অ-কংগ্রেসী সরকারগুলির সঙ্গে মিতালী করে আপনারাই আপনাদের সরকারকে অন্য যে কোনো অ-কংগ্রেসী সরকারের স্তরে নামিয়ে এনেছেন।

তবু আমরা কংগ্রেস(ই) ও তার চক্রান্তের বিরুদ্ধে নির্বাচনেই হোক বা কেন্দ্র-বিরোধী সংগ্রামেই হোক, আপনাদের সমর্থন জানিয়ে এসেছি। আপনারা যে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলে আমরা অবশ্যই সমালোচনামূলক সমর্থন জানাতে সর্বদাই তৈরি। কিন্তু যদি আমরা এই তথাকথিত সবচেয়ে এগিয়ে থাকা বাম সংগঠনের অতিকথার স্বরূপ উদ্ঘাটন না করি এবং এই সরকারের জনবিরোধী কার্যকলাপের বিরোধিতা না করি, তাহলে বিপ্লবী কমিউনিস্ট হিসাবে আমাদের যা কর্তব্য তা পালনে আমরা ব্যর্থ হব। পার্টিরই একটি অংশের দ্বারা পরিচালিত নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলনের দমন দিয়েই তো বামফ্রন্ট ধরনের সরকারের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল। তাই এই ধরনের সরকার যে গণআন্দোলনে কখনই প্রেরণা সঞ্চার করতে পারে না, বিপরীতে তাকে স্তিমিত করতে পারে মাত্র। এই সত্য তুলে না ধরলে ভারতীয় বিপ্লবের প্রতি এক অপরাধই করব।

ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে ‘সবচেয়ে এগিয়ে থাকা বাম সংগঠন’ দীর্ঘ চৌদ্দ বছরেও পশ্চিমবাংলার বাইরে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ নকশালবাড়ি আন্দোলন, তার আদি ভূমি পশ্চিমবাংলায় দমিত হলেও, সর্বভারতীয় স্তরে ছড়িয়ে পড়ল। প্রথমে অন্ধ্রে ও পরে বিহারে ঘাঁটি গাড়ল, যদিও তাকে কত না দমন সহ্য করতে হয়েছে এবং কত ভাঙ্গনই না পেরিয়ে আসতে হয়েছে। নকশালবাড়ি আন্দোলন এমনকি প্রতিবেশি নেপালেও প্রভাব সৃষ্টি করে, এবং সেখানকার কমিউনিস্ট আন্দোলনে নতুন জীবন সঞ্চার করে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই রূঢ় কঠোর সত্য খোদ কমরেড সুরজিৎ-কেই স্বীকার করতে হয়েছে।

নির্বাচনী কৌশল

যখনই নির্বাচন আসে, রং-বেরং-এর সমস্ত উদারনৈতিকরা আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে, আমরা কংগ্রেস(ই) ও বিজেপির বিপদকে ছোটো করে দেখছি। এরা আমাদের পরামর্শ দেন বিরোধী ভোট যাতে ভাগ না হয়, তার জন্য আমরা   যেন নির্বাচনী লড়াই-এ অংশগ্রহণ না করি বরং বিপরীতে উদারনৈতিক বুর্জোয়া বিরোধীপক্ষকে যেন নিঃশর্ত সমর্থন জানাই। এই ধরনের যুক্তিগুলি আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা পেটি বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী ও আমাদের পার্টির ভিতরে একাংশের মধ্যে সমর্থন পেয়ে যায়। দরকষাকষি করে যে দু-একটি নির্বাচনী আসন পাওয়া যাবে তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার জন্য তাঁরা আমাদের উপদেশ দেন, কেননা আসনগুলিই নাকি মূল ব্যাপার।

আমরা বারংবার ব্যাখ্যা করেছি যে আমাদের নির্বাচনী কৌশলগুলি কোনো স্বতন্ত্র ব্যাপর নয়, এগুলি কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আমাদের সাধারণ রাজনৈতিক কৌশলগুলিরই প্রয়োগ। এছাড়াও ভোট ভাগাভাগির প্রশ্নকে আনুষ্ঠানিক কোনো পাটিগণিতীয় সম্ভাবনা হিসাবে দেখার পরিবর্তে আমাদের বরং রাজনৈতিক সম্ভাবনা হিসাবেই দেখা দরকার। এবারের নির্বাচনেও এটি যান্ত্রিক বলে প্রমাণ হয়েছে যে আমাদের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে অঙ্কের নিয়মে কংগ্রেস(ই) ও বিজেপির নির্বাচনী বিজয়ের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। যদি কোনো ক্ষেত্রে এরকম ঘটেও, তবে তা ব্যতিক্রম মাত্র। এই উদারনৈতিক চাপের কাছে যদি আমরা নতিস্বীকার করতাম, তবে ব্যাপকমাত্রায় স্বাধীন রাজনৈতিক প্রচার অভিযান চালানো ও আমাদের ভবিষ্যৎ অগ্রগতির অবস্থা সৃষ্টির সুযোগ নিশ্চিতভাবেই আমরা হারাতাম। লেনিন ও বলশেভিকদেরও মেনশেভিকদের পক্ষ থেকে একই অভিযোগ শুনতে হয়েছে যে তাঁরা ব্ল্যাক হান্ড্রেড (কৃষ্ণশত) বিপদকে এড়িয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যুত্তরে লেনিন পাল্টা বলেছেন, “... সমস্ত দেশে সর্বত্রই নির্বাচনী প্রচারকাজে সমাজগণতন্ত্রীদের প্রথম স্বাধীন অংশগ্রহণের সময় উদারনৈতিকরা এই বলে শোরগোল ও চিৎকার শুরু করে দেয় যে সমাজতন্ত্রীরা ব্ল্যাক হান্ড্রেডদের সুযোগ করে দিচ্ছে।

“... কাডেটদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে অস্বীকার করে আপনারা সমাজগণতন্ত্রীদের নেতৃত্বে পরিচালিত হতে ইচ্ছুক প্রোলেতারিয়েত ও আধা-প্রোলেতারিয়েত জনগণকে ক্যাডেট মতাদর্শের প্রভাবে রেখে দিচ্ছেন। আজ হোক কাল হোক, যদি না আপনারা সমাজতন্ত্রী অবস্থান পরিত্যাগ করেন, তবে ব্ল্যাক হ্যান্ড্রেড বিপদ থাকা সত্ত্বেও আপনাদের স্বাধীনভাবেই নির্বাচনে লড়াই করতে হবে। তাই ভবিষ্যতের পরিবর্তে এখনই তুলনায় সহজ ও অধিক প্রয়োজনীয় সঠিক পদক্ষেপ আপনাদের গ্রহণ করতে হবে।” (ক্যাডেটদের সঙ্গে ব্লক গঠনের প্রশ্নে)

লেনিন আরও বলেছেন, “একটি যৌথ তালিকার (ক্যাডেটদের সঙ্গে) প্রকাশ সমাজগণতন্ত্রীদের সমগ্র স্বাধীন শ্রেণী নীতির সঙ্গে তীব্র দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে। জনগণের কাছে এই যৌথ তালিকা হাজির করলে শ্রেণী ও রাজনৈতিক বিভাজনগুলি সম্পর্কে আরও বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। ডুমাতে একজন উদারনৈতিককে জয়ী করার বিনিময়ে তা আমাদের প্রচার অভিযানের নীতিগুলি ও সাধারণ বিপ্লবী তাৎপর্যকে নস্যাৎ করে দেবে। আমাদের সংসদবাদকে শ্রেণী-নীতির অধীনে রাখার পরিবর্তে তা আমাদের শ্রেণী-নীতিকেই সংসদবাদের অধীনস্থ করে ফেলবে। এর ফলে আমরা নিজস্ব শক্তিকে পরিমাপ করার সুযোগ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করব। সমস্ত নির্বাচনেই যে স্থায়ী ও দীর্ঘকালীন লাভ – সমাজতান্ত্রিক সর্বহারার শ্রেণী সচেতনতা ও শ্রেণী ঐক্য বৃদ্ধির সুযোগ আমরা হারাবো। আর আমাদের যে লাভ হবে তা হল অস্থায়ী, আপেক্ষিক ও অসত্য – অক্টোব্রিস্টদের তুলনায় ক্যাডেটরা উৎকৃষ্ট।” (সমাজগণতন্ত্র ও নির্বাচনী সমঝোতা)

কমরেড লেনিন বারবারই কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচনী প্রচার কর্মসূচির পূর্ণ স্বাধীনতার উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, “কোনো অবস্থাতেই অন্য কোনো বিরোধী দল বা বিজয়ী পার্টির সঙ্গে কমিউনিস্ট স্লোগান ও কৌশলগুলিকে মিলিয়ে ফেলা উচিত নয়। ... এই নিয়মের ব্যতিক্রম একমাত্র চূড়ান্ত কোনো প্রয়োজনে ও আমাদের আশু রাজনৈতিক সংগ্রামের মূল স্লোগানগুলিকে পুরোপুরি গ্রহণ করেছে এমন কোনো পার্টির ক্ষেত্রেই কেবল অনুমোদন করা যেতে পারে।”

আমাদের দেশের নির্দিষ্ট অবস্থায় গ্রামাঞ্চলে আমাদের কাজের মূল কেন্দ্রগুলি এই একই শ্রেণীভুক্ত।

আমাদের নির্বাচনী কৌশলগুলি লেনিনের শিক্ষাকেই জোরালোভাবে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে, একটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির পক্ষে এটিই একমাত্র মূল্যবান বিষয়।

যেহেতু নির্বাচনী কৌশলগুলি সাধারণ রাজনৈতিক কৌশলগুলির একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে প্রয়োগ ব্যতীত অন্য কিছু নয় তাই খুবই স্বাভাবিক যে, অসংসদীয় সংগ্রামের প্রক্রিয়ায় যে রাজনৈতিক আঁতাতগুলি গড়ে ওঠে, তারই স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে আসন সমঝোতা ও আন্যান্য নির্বাচনী বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে। আমাদের নীতিগুলির সীমানার মধ্যে এই প্রশ্নে আমরা সর্বদাই নমনীয় থাকার চেষ্টা করছি।

বাম ব্লক গঠনই একমাত্র উপযুক্ত কৌশল

আগামী দিনগুলিতে আমাদের সামনে রয়েছে এক দীর্ঘস্থায়ী লড়াই। কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূল তিনটি ধারা, ছোটো বাম পার্টিগুলি, নৈরাজ্যবাদী কার্যকলাপ পরিত্যাগ করে রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দিয়েছে এমন নকশালপন্থী গোষ্ঠীগুলি ও তৃণমূল আন্দোলনের প্রতিনিধিরা, জনতা দল, দলিত, সংখ্যালঘু ও জাতিসত্তার আন্দোলনের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক অংশগুলি এবং বিপ্লবী পেটি বুর্জোয়া ও বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের কাছাকাছি নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠবে সেই বাম ব্লক বা যাকে আমরা বলি বাম গণতান্ত্রিক কনফেডারেশন (মহাজোট)। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সোভিয়েত ব্লকের অপসারণ এবং কংগ্রেস সরকার অনুসৃত নতুন অর্থনৈতিক নীতিগুলি যা একদিকে ভারতীয় পুঁজির আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির উপর নগ্ন নির্ভরশীলতাকে দেখিয়ে দিচ্ছে ও অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র তার কর্তৃত্বমূলক অবস্থান খোয়ানোর সাথে সাথে সুবিধাবাদীরা তাদের রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে করুণ তাত্ত্বিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদ বনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে পরিচালিত সমাজতান্ত্রিক ব্লকের দ্বন্দ্বই প্রধান দ্বন্দ্ব, ভারত সরকারের ‘প্রগতিশীল’ বৈদেশিক নীতির উচ্চকিত প্রশংসা, ভারতীয় বুর্জোয়াদের জাতীয় চরিত্রকে এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন ক্ষেত্রগুলির বিপরীতে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলির ভূমিকাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা ইত্যাদি বিষয়গুলি আজ এইসব সুবিধাবাদীদের পক্ষে রক্ষা করা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বামফ্রন্ট ও রাষ্ট্রীয় মোর্চার আঁতাতের মাধ্যমে তৃতীয় যে রাজনৈতিক বিন্যাস গড়ে উঠেছিল ও যারা কেন্দ্রে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখেছিল, যে সরকারে যোগ দিতে সিপিআই আগ্রহ প্রকাশ করেছিল ও সিপিআই(এম) ‘সেতু অতিক্রমে’ প্রস্তুত হচ্ছিল, সেই আঁতাত নির্বাচনে প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে। বামেদের পক্ষে কংগ্রেসের সঙ্গে যাওয়া যেমন কঠিন, ঠিক তেমনি বহুধাবিভক্ত বুর্জোয়া বিরোধী পক্ষের সঙ্গে হাঁটাও অস্বস্তিকর হয়ে পড়েছে। কংগ্রেস(ই)-র মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি খুঁজে ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রন্টকে বিস্তৃত করার প্রয়াসই সম্ভবত তাঁরা চালাবেন। কিন্তু পরিস্থিতির চাপ ক্রমশই তাদের বেশি বেশি করে স্বাধীন অবস্থান গ্রহণ ও সরকারের অর্থনৈতিক নীতিগুলির বিরুদ্ধে জনপ্রিয় আন্দোলনগুলিতে সামিল হতে বাধ্য করবে।

ভারতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় বাম ব্লকের উদ্ভব যেমন প্রয়োজনীয় তেমনি অবশ্যম্ভাবী, যা বিপ্লবের সমগ্র প্রক্রিয়াকেই পরিবর্তিত করে দেবে। আমাদের রাজনৈতিক কৌশলগুলির মৌলিক দিশা এই লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে পরিচালিত, যার বস্তুগত শর্তগুলি প্রতিদিনই পরিপক্ক হচ্ছে।

রাশিয়ার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পর্কে লেনিন বলেছিলেন, “এই বিপ্লবে বিপ্লবী সর্বহারা সর্বশক্তি নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়বে, আর ভাসিয়ে নিয়ে যাবে ন্যক্কারজনক লেজুড়বৃত্তি ও বিপ্লবী বুলিসর্বস্ব রাজনীতির প্রতিনিধি গোষ্ঠীগুলিকে। বিভ্রান্তির ঘটনাবলীর ঘুর্ণাবর্তে এরা নিয়ে আসবে শ্রেণী নির্দিষ্টতা ও শ্রেণী সচেতনতা। অকুতোভয় ও দ্বিধাহীন চিত্তে এরা অগ্রসর হবে। ভয়শূন্য কিন্তু বিপ্লবী গণতান্ত্রিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার দুর্দম আকাঙ্খা নিয়ে এরা প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও পূর্ণাঙ্গ নাগরিক স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালাবে। পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য লড়াই চালানোর মাধ্যমে এরা নিজের জন্য প্রস্তুত করবে এক বিস্তৃত আঙ্গিনা। বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে মানানসই এই বিস্তৃত আঙ্গিনায় এরা সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।”

বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্বে এসে আমাদের শুধু সময়কে একবিংশ শতাব্দী হিসাবেই পাল্টে নিতে হবে, কিন্তু লেনিনের অন্য সমস্ত কথাই ভারতীয় সর্বহারাদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য।

টীকা

১০. ১৯৮৮-র পার্টি কংগ্রেসে যা দেখা দেয় সেই বিলোপবাদী ধারার প্রবক্তাদের কথা এখানে বলা হয়েছে।

১১. ‘দি মার্কসিস্ট’ পত্রিকার অক্টোবর-ডিসেম্বর, ১৯৯০ সংখ্যায় প্রকাশ কারাতের লেখা “সিপিআই(এমএল)/আইপিএফ – বাম ভূমিকার অন্বেষণে।”