(লিবারেশন, জানুয়ারি ১৯৮৪ থেকে)

এতদিনে প্রায় সকলেই জেনে গিয়েছেন যে জাতীয় পর্যায়ে একটি গণফ্রন্ট গড়ে তোলা সম্পর্কে আমাদের পার্টির ধারণার উপর বিলোপপন্থী এবং নৈরাজ্যবাদী উভয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই তীব্র আক্রমণ নেমে এসেছে। বিলোপপন্থী দৃষ্টিকোণ থেকে বিরোধিতার ভিত্তি হল এই যে ইন্দিরা গান্ধীর কর্তৃত্ববাদ/ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে ফ্রন্ট মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদের কিছু কিছু অংশকে এবং সংসদীয় বিরোধী গোষ্ঠীকে নিজের পরিধির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেনি। অন্যদিকে পুরোনো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভাঙ্গার ‘বুনিয়াদী লাইন’ অনুসরণের নামে নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ যে কোনো রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনেরই বিরোধিতা করে থাকে। ফ্রন্ট গঠনের বিরোধিতার এই দুই ‘চরম’ দৃষ্টিকোণের মিলে যাওয়ার নিদর্শনও নেহাৎ কম নেই। সিওসি (পার্টি ইউনিটি) নামক পার্টি গোষ্ঠী তাদের পার্টি ইউনিটি পত্রিকার আগস্ট, ১৯৯৩ সংখ্যায় তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসের লাইনের যে সমালোচনা করেছেন তাই নিয়ে এখানে আমরা আলোচনা করব। আমাদের বিশ্বাস, নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁদের এই সমালোচনার উদ্ভব। এই সমালোচনামূলক পর্যালোচনা করতে গিয়ে গণফ্রন্ট গঠন সংক্রান্ত তাত্ত্বিক সূত্রগুলি আরও বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে বলে আমাদের আশা।

জাতীয় রাজনৈতিক মোর্চা কেন প্রয়োজন?

পার্টি ইউনিটি (পি ইউ) গোষ্ঠীর দাবি তাঁরা সংকীর্ণ স্থানীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে এসেছেন এবং এ ব্যাপারে তাঁরা একমত যে ‘জাতীয় পর্যায়ে আংশিক চরিত্রের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক গণআন্দোলনে জনগণকে সংগঠিত করা ও নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য উত্তরণশীল চরিত্রের বিভিন্ন জাতীয় মঞ্চ গড়ে তোলা সম্ভব এবং উচিত’। (বাঁকা হরফ আমাদের)

আর, “শ্রেণীসংগ্রাম নির্দিষ্ট তীব্রতা লাভ করলে এবং জনগণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (পিডিএফ) গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলি অর্জিত হলে” তখন কী ঘটবে – এই প্রশ্রের কোনো উত্তর তাঁরা দেননি।

তারপর দেখা যাক। “সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে এক সময় বৈপ্লবিক কর্মধারা এবং সশস্ত্র সংগ্রামকে সংগ্রামের প্রধান রূপ হিসাবে নিয়ে পিডিএফ আত্মপ্রকাশ করে” এবং এই পিডিএফ আবার “জাতীয় পর্যায়ে আংশিক সংগ্রামগুলিকে পরিচালনা করার মঞ্চ হিসাবেও কাজ করতে পারে।”

পিডিএফ গড়ে তোলার প্রশ্নে তাঁরা দাবি করেন যে সত্তরের পার্টি লাইনকে তাঁরা দুটি দিক থেকে শুধরে নিয়েছেন। প্রথমত “দেশের অন্তত কয়েকটি এলাকায় লাল রাজনৈতিক ক্ষমতা” – এই কঠোর শর্তটিকে পাল্টে নিয়ে তাঁরা নতুন শর্ত আরোপ করেছেন “গ্রামাঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা থাকা চাই, তবে এই এলাকাগুলি মুক্তাঞ্চল নাও হতে পারে।” ঈশ্বরই জানেন এই দুই শর্তের মধ্যে পার্থক্যটা কী দাঁড়ালো। ‘সশস্ত্র সংগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা’ যদি থেকে থাকে তবে কি এটি স্বাভাবিক নয় যে তার মধ্যে কয়েকটি এলাকা লাল এলাকা হয়ে উঠবে? অথবা ঘুরিয়ে বলতে গেলে, কয়েকটি লাল এলাকা গড়ে না তুলে সশস্ত্র সংগ্রামকে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়াটা কি আদৌ সম্ভব?

দ্বিতীয়ত, সত্তরের পার্টি লাইনে যুক্তমোর্চা গঠন সম্পর্কে যে সঙ্কীর্ণ কর্মনীতির কথা বলা হয়েছিল তার বিপরীতে তাঁরা একটি সার্বিক কর্মনীতি হাজির করছেন। এই সামগ্রিকতার সংজ্ঞা হল : “এসমা, এনএসএ, প্রেস বিল, মূল্যবৃদ্ধি, সাম্রাজ্যবাদী শিবিরগুলি কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া অসম্মানজনক বিভিন্ন শর্তের কাছে নতি স্বীকার ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই গড়ে তুলতে সংসদীয় বিরোধীগোষ্ঠী সমেত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।”

এক কথায়, হয় আপনার থাকবে জাতীয় পর্যায়ে আংশিক চরিত্রের গণতান্ত্রিক গণআন্দোলন সংগঠিত করা ও সেগুলিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সংসদীয় বিরোধীগোষ্ঠীকে নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় মঞ্চ নতুবা সশস্ত্র সংগ্রামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি পিডিএফ।

পিডিএফ সম্পর্কে তাঁরাই স্বীকার করে নিয়েছেন যে পরিস্থিতি এখনও পেকে ওঠেনি এবং ধরে নেওয়া যেতে পারে যে অন্তত অদূর ভবিষ্যতে পেকে ওঠার কোনো সম্ভাবনাও নেই। আমাদের পার্টি কোনোমতেই পরিস্থিতি পেকে ওঠেনি এই অজুহাতে স্বতস্ফূর্ততার আরাধনা করতে রাজি নয় – রাজি নয় “আংশিক চরিত্রের গণতান্ত্রিক গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটি জাতীয় মঞ্চ” নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে। ঘটনা হল, এই সশস্ত্র সংগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা যেমন আমাদের নেই তেমনই আবার দেশের বিভিন্ন অংশে কৃষকদের প্রতিরোধ সংগ্রামের বেশ কয়েকটি এলাকা আমাদের রয়েছে। ভারতীয় জনগণের বেশি কিছু অংশের উপর আমাদের রয়েছে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক প্রভাব। আমরা, ভারতের বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের মধ্যে একটি জরুরি রাজনৈতিক কর্মধারা ঠিক করে নিই তাহলে আমরা প্রকৃতই একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হয়ে উঠতে পারি, পারি সংশোধনবাদীদের সমেত সমগ্র সংসদীয় বিরোধীপক্ষকেই গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার জন্য কার্যকরী প্রচেষ্টা চালাতে, পারি সাধারণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে একটি বিপ্লবী গণতান্ত্রিক ছাপ রেখে যেতে, জাতীয় রাজনীতির জ্বলন্ত প্রশ্নগুলি সম্পর্কে আমাদের বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি জোরের সাথে তুলে ধরতে। আর এইভাবেই পিডিএফ গড়ে তোলার লক্ষ্যেও আমরা এক ধাপ এগোতে পারব। লক্ষ্য করুন আমরা বলেছি পিডিএফ-এর লক্ষ্যে একটি ধাপ – পিডিএফ নয়। পিডিএফ গড়ে তোলা হল একটি প্রক্রিয়া; আপাতত যা কিছু আমাদের হাতে আছে, আসুন তাই নিয়েই সেই লক্ষ্যে প্রথম পদক্ষেপ আমরা নিই। এই প্রথম পদক্ষেপ নিছক জাতীয় পর্যায়ে “আংশিক চরিত্রের গণআন্দোলন” নিয়েই মাথা ঘামাবে না, বরং “স্বাধীনভাবে জনগণের সমাবেশ ঘটানো” ও দেশব্যাপী রাজনৈতিক সংগ্রামের ওপর গুরুত্ব আরোপ করবে।

অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং জীবন্ত বর্তমানের মধ্যে বাস করে আমাদের পার্টি ভবিষ্যতের দিকে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর এই একটি পদক্ষেপকে ঘিরেই শুরু হয়ে গেছে যত বাকবিতণ্ডা। আর পিডিএফ সম্পর্কে যাবতীয় বাক্যবিস্তার সত্ত্বেও বাস্তব জীবনে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে ‘বুর্জোয়া বিরোধী পক্ষের’ হাতে স্বৈরতন্ত্র-বিরোধী রাজনৈতিক উদ্যোগকে সঁপে দেওয়া এবং ‘জাতীয় পর্যায়ে আংশিক চরিত্রের গণতান্ত্রিক গণআন্দোলন পরিচালনা ও সংগঠিত করার জন্য সংসদীয় বিরোধীপক্ষকে নিয়ে জাতীয় স্তরের মঞ্চ’ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার মধ্য দিয়ে বিলোপপন্থী ও নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এক জায়গায় মিলে যাচ্ছে।

যে গণফ্রন্টের কথা আমরা বলেছি, তার মধ্যে কেবল নয়া গণতন্ত্রের সামাজিক শক্তিগুলিই থাকবে। এটি হল একটি নীতির প্রশ্ন। দেশপ্রেম ও জাতীয় ঐক্যের পতাকা তাকে বৃহৎ বুর্জোয়া ও বৃহৎ জমিদারদের প্রভাবাধীন জনগণকে জয় করে নিতে সাহায্য করবে মাত্র এবং আলোকপ্রাপ্ত জমিদার ও কিছু কিছু বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরও সমর্থন এনে দেবে। তবে ‘বুর্জোয়া ও সংশোধনবাদী বিরোধীপক্ষের’ অন্তর্ভুক্ত দল ও গণসংগঠনগুলির সাথে ইস্যুভিত্তিক যৌথ কার্যকলাপের সম্ভাবনাকে আমরা কখনই নাকচ করে দিচ্ছি না। এই যৌথ কার্যকলাপের রূপ কেমন হবে, তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে কীভাবে কাজে লাগিয়ে নেওয়া যাবে, তাদের মধ্যে কী ধরনের ফাটল ধরানো যাবে, সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে ছোটোখাটো দলগুলিতে এবং নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি নেতার মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটবে – এ সবই নির্ধারিত হবে ফ্রন্ট তাদের সম্পর্কে কী কৌশল অবলম্বন করছে তার দ্বারা। এই বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা খুবই কম এবং এটি স্বাভাবিক যে কিছু ভুলভ্রান্তিও ঘটবে। আমরা এই ভ্রান্তিগুলি থেকে শিক্ষা নেব এবং আমাদের কর্মনীতিগুলিকে উত্তরোত্তর নিখুঁত করে তুলব।

ফ্রন্ট ও ঘাঁটি এলাকা

নকশালবাড়ি থেকে শুরু করে কৃষক সংগ্রামগুলির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে নকশালবাড়ি, শ্রীকাকুলাম বা বীরভূম কোনোখানেই সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম এক বা দুই বছরের বেশি স্থায়ী হয়নি। আর ১৯৭৬ সালের মধ্যে সম্ভবত একমাত্র বিহারের ভোজপুর বাদে আর সর্বত্রই কৃষক সংগ্রামের এলাকাগুলি ধাক্কার সম্মুখীন হয়। ১৯৭৭ সালের পরেই আবার নতুন করে এই ধরনের এলাকা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা শুরু হয়। পার্টি লাইনকে ঠিকঠাক করে নেওয়ার দরুণ কৃষক সংগ্রামের এলাকাগুলি এখন আরও বেশি সময় ধরে টিকে থাকছে। বিহারের পাটনা-গয়া-ভোজপুর বলয়ে, কোথাও অগ্রগতি, কোথাও পিছু হটার মধ্যে দিয়ে কৃষকদের প্রতিরোধ সংগ্রামগুলিকে টিকিয়ে রাখা গেছে, বিশেষত পাটনা-নালন্দা-গয়া অঞ্চলের কৃষক অভ্যুত্থান সাম্প্রিতককালে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। ভারতের অন্যান্য বহু স্থানেও আমরা এ ধরনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছি, অন্যান্য গোষ্ঠীগুলিও চেষ্টা চালাচ্ছে এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাফল্যও অর্জিত হয়েছে।

কিন্তু তবুও বিহারে কৃষক সংগ্রামের সবচেয়ে অগ্রসর এলাকাকেও অদূর ভবিষ্যতে ঘাঁটি এলাকায় পরিণত করার কাজ হাতে নেওয়া যাবে না। মধ্য কৃষকদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং জমিদারদের প্রতাপশালী জাতের মধ্য ও উচ্চ-মধ্য স্তরের ব্যাপক অংশকে জয় করে নিয়ে আসার জন্য জাতপাতের সংস্কারকে নির্মূল করার প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য কোনো সাফল্য এখনও লাভ করা যায়নি। সশস্ত্র সংগ্রামকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া ও লাল এলাকা গড়া শুরু করার আগে জনগণকে রাজনৈতিকভাবে সমাবেশিত করা ও শ্রেণীগত ও সামাজিক ভারসাম্যকে আমাদের অনুকূলে নিয়ে আসার পথে আমাদের আরও বহুদূর এগোতে হবে। আনন্দের কথা, জাহানাবাদে কর্মরত পিইউ গোষ্ঠীর কমরেডরা তাঁদের গোড়ার দিকের কয়েকটি উদ্ভট ধারণাকে বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং কিছু বাস্তব সিদ্ধান্তে তাঁরা পৌঁছাতে পেরেছেন। পার্টি ইউনিটি পত্রিকার অক্টোবর ১৯৮২ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি সারসংকলনে তাঁরা বলছেন “সশস্ত্র কার্যকলাপের প্রকৃতি ও মাত্রাকে অবশ্যই গণআন্দোলনের বর্তমান স্তরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ও তার আরও বিকাশের পক্ষে সহায়ক হতে হবে।” আর “বর্তমানে সাধারণভাবে আংশিক ইস্যুগুলিতেই আন্দোলন চলছে। আইনি সুযোগ-সুবিধাগুলিকে এবং শত্রুশিবিরের বিভিন্ন দ্বন্দ্বকে দক্ষতার সঙ্গে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক জনগণকে সমাবেশিত করা তাই এই পর্যায়ে অত্যন্ত জরুরি।” সুতরাং সশস্ত্র সংগ্রামকে বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া বা লাল এলাকা গড়ে তোলার লক্ষ্যে নির্ধারক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বর্তমানে তথা আগামী বেশ কিছুদিনের জন্য যেটা প্রয়োজন তা হল আমাদের শক্তিগুলিকে সংরক্ষিত রাখা, ধাপে ধাপে তাদের বিকশিত করে তোলা এবং সংগ্রামের এলাকাগুলিতে শ্রেণীশক্তিগুলির ভারসাম্যকে আমাদের অনুকূলে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করা। ভারতের সমস্ত চিন্তাশীল বিপ্লবীরাই, যাঁরা শত প্ররোচনা সত্ত্বেও নিশীথ-আজিজুলদের পথে যেতে নারাজ, এ বিষয়ে একমত।

তবে এই উপলব্ধিটুকুই যথেষ্ট নয়। ঘাঁটি এলাকা গড়তে হলে বা সশস্ত্র সংগ্রামকে বিস্তৃত এলাকায় ছড়িয়ে দিতে হলে অনুকূল জাতীয় পরিস্থিতিও প্রয়োজন। চেয়ারম্যান মাওয়ের ভাষায় চীনে লাল এলাকা সমূহের অস্তিত্ব ও বিকাশের অন্ত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ছিল শাসকশ্রেণীগুলির বিভিন্ন অংশের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সংঘাত ও যুদ্ধ। কিন্তু ভারতবর্ষের পরিস্থিতি অন্যরকম।

উত্তরাধিকার সূত্রে ভারতীয় শাসকশ্রেণীগুলি একটি কেন্দ্রীভূত ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোর অধিকারী। পার্লামেন্টের মাধ্যমে তাদের দ্বন্দ্বগুলিকে তারা মোটামুটি একটি সীমানার মধ্যে আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছে। সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্রের’ বহিরঙ্গসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানগুলিও জনগণের বিদ্রোহকে ঠাণ্ডা করে রাখে এবং সোশ্যাল-ডেমোক্রেসীর জন্মের ঊর্বর ভূমি রচনা করে। থেকে থেকে বর্তমান রাজনৈতিক ব্যাবস্থাকেও তীব্র টানাপোড়েনের সম্মুখীন হতে হয়েছে এবং বিপ্লবী ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলি এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে এগিয়ে এসেছেন। বর্তমান পর্যায়ে শাকশ্রেণীগুলির বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংঘাত বেড়ে চলেছে, নতুন সামাজিক শক্তিগুলি ক্ষমতার কাঠামোয় নতুন ভারসাম্যের দাবি জানাচ্ছে, বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে ও জাতীয় সংহতির পক্ষে আকাশ ফাটিয়ে আওয়াজ উঠছে, জাতীয় দলগুলির বিপরীতে আঞ্চলিক দলগুলি তাদের সরব অস্তিত্ব ঘোষণা করছে এবং সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় উত্তেজনা আরও তীব্র হয়ে উঠছে। বর্তমান প্রতিষ্ঠানগুলির কাঠামোর মধ্যে এইসব সংঘাতকে আটকে রাখা ক্রমেই দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক, রাষ্ট্রের এককেন্দ্রিক বনাম যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্র, রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি বিতর্ক রাজনৈতিক সংকটেরই বিভিন্ন বহিঃপ্রকাশ – যা সাংবিধানিক সংকট রূপে নিজেকে প্রকাশ করছে।

এই ক্রমবর্ধমান রাজনীতির সংকটের পর্যায়ে নিছক নিষ্ক্রিয় দর্শক হিসেবে বসে না থেকে তৃতীয় পার্টি কংগ্রেস এই দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে যে সামাজিক শক্তিসমূহের ভারসাম্যকে বিপ্লবের অনুকূলে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য জাতীয় রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে আমাদের সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে। আর এই কারণেই গণফ্রন্ট গড়ে তোলার পরিকল্পনাতেও পার্টি কংগ্রেস সম্মতি জানিয়েছে।

পিইউ কমরেডরা এ বিষয়ে একমত যে পার্টি কংগ্রেসের রিপোর্ট যে দুটি ধারার (কৃষকদের প্রতিরোধ সংগ্রাম ও ভারতীয় জনগণের বিভিন্ন অংশের গণতান্ত্রিক গণআন্দোলন – সম্পাদক) উল্লেখ করা হয়েছে সে দুটি আজ আমাদের দেশে সমান্তরালভাবেই এগিয়ে চলেছে। কিন্তু পার্টি কংগ্রেস যখন ঘোষণা করে যে দুটি ধারাকে মেলাতে হবে তখনই দেখা যায় তাদের আপত্তি। এখন, এই মেলানো বলতে কী বোঝাচ্ছে? গ্রামাঞ্চলে ঘাঁটে এলাকা গড়ে তোলা আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কর্তব্য এবং মুহূর্তের জন্যও পার্টি এ প্রশ্নে এতটুকু শৈথিল্য দেখাবে না। আর গণফ্রন্টেরও অক্ষরেখা হবে ঠিক এটিই। জাতীয় স্তরে রাজনৈতিক মোর্চা গড়ে তোলা ঘাঁটি এলাকা গঠনের কাজ থেকে বিচ্যুত হওয়া নয়; বিপরীতে, ভারতের বর্তমান নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে সম্ভবত গণফ্রন্টের এই ঘোরা পথের মাধ্যমেই কেবল এই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।

গণফ্রন্টের চূড়ান্ত কর্মসূচিতে অবশ্যই নয়াগণতন্ত্রের কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে (শুধু যদি সেদিকে লক্ষ্য করার মতো যথেষ্ট ধৈর্য আপনাদের থাকে আর আপনারা যদি এই নীতিটুকু মেনে চলেন যে ভালোভাবে কোনো লেখাকে পড়ে নিয়ে তবেই একমাত্র তার সমালোচনা করা চলে)। ফ্রন্ট সংসদ-বহির্ভূত সংগ্রামগুলিকে সংগ্রামের প্রধান রূপ হিসেবে ঘোষণা করেছে আর সশস্ত্র সংগ্রাম নিশ্চয়ই তার মধ্যে পড়ে। তবে যেহেতু ফ্রন্টকে তার যাত্রা শুরু করতে হচ্ছে আজকের পরিস্থিতিতে, যে পরিস্থিতি পরিপক্ক নয় বলে আপনারাই স্বীকার করে নিয়েছেন, তাই বর্তমানে আশু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবিতে রাজনৈতিক সমাবেশের উপরেই ফ্রন্টকে বেশি জোর দিতে হবে। তাকে জোর দিতে হবে সরকার প্রদত্ত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও সেগুলি দেওয়ার আপাত গণতান্ত্রিক রূপগুলির মুখোশ উন্মোচিত করার উপর, ঘোষণা করতে হবে যে ফ্রন্ট তার দিক থেকে সংগ্রামের শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিগুলিতেই বেশি আগ্রহী তবে জনগণের আন্দোলনগুলি শেষপর্যন্ত কোন চেহারা নেবে তা নির্ভর করছে সরকার এইসব আন্দোলনকে কিভাবে দেখছে তার উপর। জাতীয় পর্যায়ে শ্রেণীশক্তিগুলির পারস্পরিক অবস্থানে ফ্রন্ট যা কিছু পরিবর্তন ঘটাতে পারবে তাই ঘাঁটি এলাকা গঠনের সংগ্রামে নতুন প্রেরণা যোগাবে। ঐ পরিবর্তিত পরিস্থিতি আবার দাবি জানাবে যে ফ্রন্ট তার সর্বোচ্চ কর্মসূচি ও তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য বিভিন্ন জঙ্গী পদক্ষেপের উপর বেশি বেশি করে গুরুত্ব দিক – এই সবকিছুই অভ্যুত্থান ও সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া তথা পুরোনো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভেঙ্গে ফেলা অবধি এগিয়ে যাবে। এই প্রক্রিয়ায় গণফ্রন্ট নিজেকে একটি পরিপূর্ণ পিডিএফ-এ পরিণত করবে। আমাদের পার্টি কংগ্রেসের মতে এটিই হবে ফ্রন্টের মৌলিক দিশা।

আর এটিই হল পুরো বিষয়টির আসল সারমর্ম – যা কেউ কেউ বুঝতে অস্বীকার করেন, কেননা তাঁরা নিজেদের অতীতের বাঁধনে বাঁধা পড়ে রয়েছেন।

ফ্রন্ট ও নির্বাচন

পিইউ সমালোচনী আমাদের পার্টি কর্মসূচিতে ‘সংসদীয় সংগ্রাম’-এর বিষয়টি যুক্ত করার নির্মম সমালোচনা করেছে এবং ভবিষ্যৎ বাণী করেছে যে আমাদের পার্টি অবশ্যই ‘সংসদীয় পাঁকে নিমজ্জিত হবে’। একথা ঠিকই যে ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এই ধরনের অধঃপতনের ভুরি ভুরি নিদর্শন রয়েছে আর এ বিষয়ে জনগণ যদি আমাদের পার্টি সম্পর্কে আশঙ্কা পোষণ করেন তবে তাঁদের দোষ দেওয়ার কিছু নেই, বরং এক দিক থেকে আমাদেরও এ নিয়ে কিছু আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু কীভাবে এই বিপদ থেকে মুক্ত হওয়া যাবে? আবার ব্যাপক গেরিলা কার্যকলাপ শুরু করে, এই মুহূর্তেই বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে? মহাদেব মুখার্জী সর্বাত্মক গেরিলা এ্যাকশনে নেমেছিলেন, নিশীথ গোষ্ঠী বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল – কিন্তু এত সব করে শেষে তাঁরাই ডুবলেন জঘন্যতম সুবিধাবাদের পাঁকে। পুরোনো কাসুন্দি আমরা ঘাঁটতে চাই না, তবে এটি অনেকেরই জানা আছে যে আমাদের বিরোধিতা করে ঐ মহাদেব-নিশীথদের প্রতিই আপনারা আপনাদের সহানুভূতি উজাড় করে দিয়েছিলেন।

প্রতিকার তাহলে কোথায়?

সত্তরের দশকে আমরা ‘নির্বাচন বয়কটের’ মহান পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিলাম, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম সশস্ত্র সংগ্রামের বিকাশ সাধন আর লাল এলাকা গড়ে তোলার কাজে। সেই মহান অভ্যুত্থানই উত্তর-সাতচল্লিশ ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম তথাকথিত ‘বুর্জোয়া গণতন্ত্রে’র প্রত্যেকটি প্রচলিত প্রতিষ্ঠানের সামনে এক জোরদার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল, জনগণের ক্ষমতার বিকল্প কেন্দ্রগুলি গড়ে তুলতে সচেষ্ট হয়েছিল। আর এখানেই নিহিত রয়েছে সেই সময়ের বিরাট অভ্যুত্থানের সুগভীর তাৎপর্য। ‘নির্বাচন বয়কট’-এর আওয়াজ ছাড়া এত কিছু কোনোমতেই সম্ভবপর ছিল না। এটা আমাদের পার্টি এবং শহীদদের এক গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। যে দলত্যাগীরা অতীতের ভুল সংশোধনের নামে মহান ঐতিহ্যে কলঙ্ক লেপে দিতে চায়, তারা যতই বিরক্ত হোক না কেন আমরা চিরকাল এই ঐতিহ্যকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছি।

কিন্তু আমাদের সেই বিপ্লবী প্রচেষ্টা পরাজিত হল, আমাদের সকলকেই মানিয়ে নিতে হল সমকালীন সমাজের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ধাক্কার প্রথম আভাস পাওয়ার সাথে সাথে এই মানিয়ে নেওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো শুরু করলেন। বিপ্লবী ঐতিহ্য, বিপ্লবী শহীদদের মর্যাদা তাঁরা ধুলোয় লুটিয়ে দিলেন, এমনকি সিপিআই(এমএল)-এর মহান লাল পতাকাকে পরিত্যাগ করতেও দ্বিধা বোধ করলেন না। শত্রুর কাছে এভাবে নির্লজ্জের মতো হাঁটু গেড়ে যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের দলত্যাগী ছাড়া আর কি-ই বা বলা যায়? তাঁরা যতই ‘সবার আগে এবং পুরোপুরি সমস্ত ভুল সংশোধন করে ফেলার’ বড়াই করুন না কেন আমরা তাঁদের সঠিকভাবেই ঘৃণা করি। আমাদের মধ্যে রয়েছেন অন্যরাও, যাঁরা বিপ্লবী, যাঁর শেষ অবধি লড়াই চালিয়ে গেছেন, লড়তে লড়তেই চিরশয্যা নিয়েছেন কিন্তু শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। আজ তাঁরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের হৃত শক্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় এবং আরও একবার চূড়ান্ত আঘাত হানার অপেক্ষায় রত, তাঁরা আজ বাধ্য হচ্ছেন সমাজের প্রচলিত প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে। যথেষ্ট ইস্ততত করে এবং ধাপে ধাপেই এই আপোশ তাঁরা করছেন এবং এই কারণেও বিভিন্ন কোণ থেকে (এর মধ্যে আপনারাও রয়েছেন) নেহাৎ কম ব্যঙ্গ বিদ্রুপ তাঁদের সহ্য করতে হয়নি। তাঁদের আজকের কৌশল হল অতীতের কৌশলেরই ধারাবাহিক ও যুক্তিপূর্ণ বিকাশ।

সংসদের চরিত্রের উপর ভিত্তি করে অর্থাৎ এই সংসদ আধা-ঔপনিবেশিক নাকি স্বাধীন বুর্জোয়া দেশের সংসদের মতো এই বিচারের ভিত্তিতে সংসদ সম্পর্কিত কৌশল নির্ধারণ করতে যাওয়া হল এক নিছকই তাত্ত্বিক পণ্ডশ্রম। আমাদের সংসদ আধা-ঔপনিবেশিক – শুধু এই কারণে এর মুখোশ খুলে দেওয়া ও একে ভাঙ্গার কাজ এতটুকুই গুরুত্ব হারায় না, বিশেষত যখন সেই সংসদ সংশোধনবাদের বিকাশে এক অনুকূল বিষয়ীগত শর্ত যোগাচ্ছে। অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি আছে না নেই কেবলমাত্র এই ভিত্তিতেই আমাদের সংসদ সংক্রান্ত কৌশল নির্ধারণ করা যেতে পারে।

সংসদ সম্পর্কে মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন হল মূলত কৌশলগত প্রশ্ন। আধা-ঔপনিবেশিক দেশে যেখানে আশু বিপ্লবী পরিস্থিতি সর্বদাই বিরাজমান এবং তাই কমিউনিস্টরা সর্বদাই ঘাঁটি এলাকা গঠনের পথে এগোতে পারেন বলে ধরে নেওয়া হয় সেখানে এই কৌশলগত প্রশ্নে রণনীতিগত মাত্রার সংযোজন ঘটে বলে মনে করা হয়। কিন্তু এটি মাথায় রাখতে হবে যে চীন বিপ্লবের পর তা থেকে শিক্ষা শুধু বিপ্লবীরাই নেননি, বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদও নিয়েছে। ভারতকে সে বেছে নিয়েছে তার পরীক্ষাগার তথা প্রদর্শনকেন্দ্র হিসাবে। ভারতীয় পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যসমূহের সঙ্গে একযোগে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের এই চক্রান্ত এবং সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদে অধঃপতন সহ অন্যান্য বহু বিষয়ের সম্মিলিত ফল হিসাবে তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির তুলনায় ভারতে সংসদ এবং অনুরূপ প্রতিষ্ঠানগুলি অনেক বেশি সময় ধরে টিকে থেকেছে। মৌলিক পথ মূলগতভাবে এক হলেও নির্দিষ্ট কৌশলের বহু প্রশ্নেই ভারতীয় বিপ্লবী চীন বিপ্লবের নিছক নকল হতে পারে না। অন্যান্য কারণ বাদ দিলেও শুধু এই একটি কারণেই তা হওয়া সম্ভব নয় যে আমাদের বিপ্লব ঘটছে আশির দশকের ভারতবর্ষে, চল্লিশের দশকের চীনে নয়। এই সমস্ত বিষয় এবং বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথায় রাখলে, যে পরিস্থিতি সমস্ত চিন্তাশীল বিপ্লবীর মতেই, এই মুহূর্তে লাল এলাকা গঠনের কাজে নামার মতো উপযুক্ত নয়, এই প্রয়োজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে আমাদের নির্বাচন সংক্রান্ত কৌশল পুনর্বিবেচনা করে দেখতে হবে। নীতিগতভাবে অন্তত নির্বাচনের প্রশ্নকে কৌশল সংক্রান্ত প্রশ্ন হিসাবেই দেখা উচিত। বাস্তব পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো করে আমাদের সাধারণ কৌশলকে ঠিকঠাক করে নেওয়ার সাথে সাথে নির্বাচনের ব্যাপারে ঠিক কী করা দরকার – এই নির্দিষ্ট কৌশল সম্পর্কেও আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তা করার সময় পশ্চিমী ধরনের সংসদের সঙ্গে ভারতীয় সংসদের চরিত্রগত পার্থক্যগুলিকে উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়েই খেয়াল রাখতে হবে। এই নীতিগত স্বীকৃতির অর্থ কিন্তু এই নয় যে যত্রতত্র এখনই আমরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য ছুটে যাব বা যাবতীয় অনীতিনিষ্ঠ আপোশ করার পথে পা বাড়াব। এই প্রশ্নে পিসিসি তার নেতিবাচক দৃষ্টান্তের দৌলতে এক ভালো শিক্ষক হিসেবে আমাদের সামনে রয়েছে। কর্মনীতিতে পুনর্বিন্যাসের অর্থ বিপ্লবী সংগ্রাম বর্জন করা নয় বা পশ্চিমের দেশগুলির মতো পার্লামেন্টের ভেতর থেকে কাজ চালিয়ে যাওয়া তথা দীর্ঘদিন ধরে দেশব্যাপী অভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুতি চালানোর কর্মনীতি অনুসরণ করাও নয়।

বর্তমানে যখন জনগণের ক্ষমতার বিকল্প মডেল আপনার হাতে নেই এবং এই মুহূর্তে তা গড়ে তোলার কাজেও আপনি যখন নামতে পারছেন না, তখন জনগণের রাজনৈতিক চেতনার মানকে ক্ষমতা দখলের রাজনীতির উপলব্ধির স্তরে উন্নীত করতে হলে এই নেতিবাচক পথকে উপেক্ষা করা নিজেদের ধ্বংসের ঝুঁকি নেওয়ারই সামিল। আপনার প্রতিনিধিরা শত্রুপক্ষের সংসদের ভেতরে যান, সেখানে বক্তৃতা দেন, আর বাইরে থেকেও চলে প্রচার – এই দুইয়ের মধ্যে দিয়ে সংসদের স্বরূপ উদ্ঘাটিত করা হয়। অর্থাৎ জনগণকে আমাদের এটি বুঝিয়ে দিতে হবে শাসকশ্রেণীর কোন নির্দিষ্ট জোট সংসদের মধ্যে দিয়ে শাসন চালাচ্ছে এবং কীভাবে। এই কাজ বাইরে থেকেও ভালোভাবেই চালানো যায়। তবে ভেতর থেকে কমিউনিস্ট প্রতিনিধিদের কাজ, যদি তা ঠিকভাবে সংগঠিত করা যায়, এই মুখোশ উন্মোচনকারী প্রচার অভিযানের ধার আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

আপনি ‘নির্বাচন বয়কট’-এর ডাকও দিতে পারেন, কিন্তু তাহলে আপনাকে এখনই সর্বশক্তি নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে, নামতে হবে ঘাঁটি এলাকা গঠনের কাজে। তত্ত্বে আপনি আপনার কল্পজগতে বাস করতে পারেন কিন্তু বাস্তব রাজনীতিতে তো কোনো মাঝামাঝি রাস্তা নেই। আপনি যদি একদিকে নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানান আর অন্যদিকে আন্দোলনের বর্তমান পর্যায়কে আংশিক সংগ্রামের (তা যে মাত্রাতেই হোক না কেন) পর্যায় বলে বর্ণনা করেন, তাহলে বলতে হবে আপনি নিজেকেই ঠকাচ্ছেন – মিথ্যা তর্কের জাল বুনছেন। এই ক্ষেত্রে বয়কটের আহ্বান হবে নিছকই এক নিষ্ক্রিয় আহ্বান এবং বাস্তব বিচারে এতে জনগণকে কোনো না কোনো বুর্জোয়া কর্মনীতির পেছনে চলতেই বাধ্য করা হবে।

কৃষকদের প্রতিরোধ সংগ্রামের এলাকা গঠনে একনিষ্ঠভাবে নিয়োজিত একটি গোপন পার্টি কাঠামো, সংসদ-বহির্ভূত সংগ্রামকেই সংগ্রামের মূল রূপ হিসেবে তুলে ধরে এমন একটি গণফ্রন্ট, সরকারি বিভিন্ন ছাড় ও সংস্কারের মুখোশ খুলে দেওয়ার স্বার্থেই কেবলমাত্র নির্বাচনী অভিযানকে কাজে লাগানো, এবং শুধুমাত্র গণউদ্যোগের দ্বার উন্মুক্ত করা তথা গণআন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়েই কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা – এই শর্তগুলিই পারে একটি পার্টিকে সংসদ-সর্বস্বতার পাঁকে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে রাখতে। এছাড়া অন্য কোনো সহজ পথ নেই আর বামবুলি-সর্বস্বতা কেবল অধঃপতনকেই ত্বরান্বিত করতে পারে।

বারবার শুধু ‘মৌলিক পথ’-এর কথাই বলে গেলে আপনি কখনোই কাঙ্খিত লক্ষ্যের এতটুকুও কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবেন না। সময় এসেছে নতুন পরীক্ষায় নামার। আর কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের মধ্যে সুস্থ বিতর্ক প্রকৃত অগ্রগতির পথই সুগম করে দেবে, তার মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠবে যথার্থ পার্টি ইউনিটি।

পিইউ গোষ্ঠীর মাননীয় নেতৃবৃন্দ, বন্যার জলে পথ যখন ডুবে থাকে তখন, কখনও কখনও উত্তরে যাবার জন্য দক্ষিণগামী গাড়িতেই কিছুদূর পর্যন্ত যেতে হয়। বামবুলি-সর্বস্বতা ও বাম ভান করার মধ্যে (পার্টি ইউনিটির সমালোচক আমাদেরকে বাম ভান করে চলার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন, তবে বামবুলি আউড়ানো থেকে রেহাই দিয়েছেন) বিশেষ কোনো পার্থক্য আছে কিনা আমাদের জানা নেই; যদি থাকে তাহলে উভয় অপরাধেই আপনারা অপরাধী।