(ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপোর্টের পরিশিষ্ট থেকে)

পেশাদারী খুনীদের এই ভ্রাম্যমান সেনা ভোজপুরের ভূমিহার জাতের কাছ থেকে এবং বিহার জুড়ে, এমনকি উত্তরপ্রদেশেরও কোনো কোনো অংশে ছড়িয়ে থাকা এই জাতের লোকজনের কাছ থেকে খুবই জোরদার সমর্থন ভোগ করে আসছে। পার্টি-নির্বিশেষে বড় বড় সরকারি অফিসার এবং রাজনীতিবিদরাও একে মদত দিয়েছেন। ভোজপুরে রাজপুতদের কাছ থেকেও রণবীর সেনা কিছুটা সমর্থন পেয়েছে। কুলাকদের কৃষি-সংক্রান্ত দাবি-দাওয়া তুলে ধরার অজুহাতে এবং প্রধানত কংগ্রেসের উদ্যোগে এর সূচনা হয়েছিল। কিন্তু দ্রুতই এর নেতৃত্ব চলে যায় বিজেপির হাতে এবং এটি হয়ে দাঁড়ায় ভোজপুর থেকে মালে-কে নির্মূল করার ঘোষিত লক্ষ্যে মরীয়া এক সশস্ত্র বাহিনী। অন্তত শুরুর দিকে জনতা দলের নেতারাও এর সঙ্গে দহরম মহরম চালাচ্ছিলেন। আমাদের বিরুদ্ধে যাদব কুলাকদের সঙ্গে সমঝোতা গড়ার দিকেও এরা বিশেষ নজর রাখে। আমাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মোর্চার ব্যাপারও ১৯৯৬ সালের সংসদীয় নির্বাচনে সামনে চলে আসে, যখন দেখা যায় বিজেপি সমর্থিত সমতা প্রার্থী এবং কংগ্রেস ও জনতা দল প্রার্থী – সকলেই রণবীর সেনার সমর্থন আদায়ে রেষারেষি শুরু করেছে। নির্বাচনে জয়লাভ করে জনতা সাংসদ সেনার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি জানান। এদের সকলের মধ্যেকার আঁতাত আবার প্রকাশ হয়ে পড়ে যখন বাথানিটোলা গণহত্যার পর ডিএম ও এসপি-র বদলির বিরুদ্ধে এরা যুক্তভাবে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করে। এ ব্যাপারে সিপিআই-সিপিআই(এম)-এর ভূমিকাও মোটেই ভালো ছিল না। তারা লাগাতার এই প্রচারই চালিয়ে যায় যে, মালে-র জাতপাতের রাজনীতি, মজুর আর চাষিদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বকে বাড়িয়ে দেখা এবং হঠকারী কার্যকলাপই রণবীর সেনার উত্থানের জন্য মূলত দায়ী।

পার্টির বিরুদ্ধে রণবীর সেনার প্রচারধারাতেও বিজেপির কণ্ঠস্বর পরিষ্কার শোনা গেছে। তারা ভারতের সামাজিক বিন্যাস অর্থাৎ জাতপাতভিত্তিক সামাজিক বিন্যাসকে ধ্বংস করতে উদ্গ্রীব বিদেশী শক্তি অর্থাৎ চীন ও পাকিস্তানের চর হিসাবে মালে-কে চিহ্নিত করে এবং কেবল ভোজপুর নয়, ভারতের মাটি থেকেই লাল পতাকা উৎখাত করার শপথ নেয়। তাদের প্রতীকের রঙও গৈরিক।

সশস্ত্র জমিদারদের হামলাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে বেলাউরের বুকে কয়েক মাস ধরে চলতে থাকে অবস্থানগত যুদ্ধ। লড়াকু মনোভাব তখনও তুঙ্গে। আরায় এক জবরদস্ত সমাবেশে আকাশ কাঁপানো স্লোগান ওঠে – ‘বিহটা-একোয়ারি ধ্বংস হল, এবার পালা বেলাউরের।’

পিছনের দিকে তাকিয়ে অনেক কমরেড মনে করেন, কেবল আত্মরক্ষার বদলে আমরা যদি বেলাউরের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে নির্মূল করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তাম, তবে হয়তো রণবীর সেনাকে অঙ্কুরে বিনাশ করা যেত। একথা ঠিক যে, সেই সন্ধিক্ষণে আমরা ব্যাপারটির তাৎপর্য পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। বেলাউরের লড়াইকে আমরা একটি গ্রামের স্থানীয় ব্যাপার হিসাবে নিয়েছিলাম। আসলে কিন্তু জাতপাতভিত্তিক জোট বাঁধার প্রক্রিয়া খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল। অল্পদিনের মধ্যেই সন্দেশ ব্লকের অনেক গ্রামে সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেল, এতকাল চুপচাপ থাকা সাহারের গ্রামগুলিতেও জমিদাররা সক্রিয় হয়ে উঠল। তারা যাকে তাকে খুন করতে লাগল। জনগণের শক্তিগুলি কিন্তু বাছাই করা লক্ষ্যেই আঘাত হানতে থাকে।

এরপর আসে ১৯৯৫-এর নির্বাচন এবং আমরা সাহার ও সন্দেশ উভয় আসনেই বিজয়ী হলাম। এইভাবে সর্বপ্রথম জমিদার ও কুলাকদের আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হল। এই দুই ব্লক ঐতিহাসিকভাবে ভোজপুরে আমাদের সবচাইতে শক্তিশালী ঘাঁটি হলেও ১৯৯০-এর নির্বাচনে এখান থেকে আমরা জিততে ব্যর্থ হয়েছিলাম। এই বিজয় জমিদার এবং আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলিকে মরীয়া করে তোলে। উত্তেজনা বাড়তে থাকে এবং আরাতে আমরা যে ‘মহাধর্ণা’ চালাচ্ছিলাম তাতে গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। এতে একজন কমরেড নিহত ও আরও অনেকে আহত হন। এই ঘটনা শিশু ও মহিলাদের বাদ দিয়ে রণবীর সেনার সঙ্গে ক্ষীণ সম্পর্কযুক্ত ভূমিহার সহ সাধারণভাবে সমস্ত ভূমিহারদের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার আহ্বানকে জাগিয়ে তোলে। একইদিনে রণবীর সেনার আটজন লোককে গণরোষের শিকার হতে হয়। হত্যা, পাল্টা হত্যা চলতেই থাকে, এবং এর পরিণতিতে ১৯৯৬-এর সংসদীয় নির্বাচনের ঠিক আগে নারহিতে জনগণের বাহিনীর আক্রমণে ৯ জন রণবীর সেনা সমর্থক নিহত হয়। এই পর্যায়ে প্রশাসন আমাদের পার্টিকে নিষিদ্ধ করে ব্যাপক নিপীড়ন নামিয়ে আনার প্রস্তাব করে। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে আমরা অবশ্য সাহার ও সন্দেশে আমাদের আধিপত্যকে মোটামুটি ধরে রাখতে সমর্থ হই।

ইতিমধ্যে সংঘাতের কেন্দ্র পরিবর্তিত হয়ে বাথানিটোলা ও তার আশেপাশে কেন্দ্রীভূত হয়। “কারবালা”র জমি মুক্ত করা নিয়ে করপাহাড়ি ও নওয়াডিতে এক আন্দোলন শুরু হয় এবং এই প্রক্রিয়ায় দুই প্রভাবশালী রাজপুত নেতা জনরোষের শিকার হয়। রণবীর সেনার সংগঠকরা ও বিজেপির রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের প্রিয় সাম্প্রদায়িক তাসকে কাজে লাগিয়ে রাজপুত ও ভূমিহারদের ঐক্যবদ্ধ করে। এটি শেষপর্যন্ত বাথানিটোলা গণহত্যায় পরিণতি লাভ করে। স্থানীয় জনগণের স্কোয়াডগুলি বাথানি, চৌরি এবং নিকটবর্তী অন্যান্য গ্রামগুলিতে ঐ ধরনের অনেক আক্রমণকেই প্রতিহত করেছিল। বিভিন্ন গ্রামের মানুষ ছুটে গিয়ে অন্যের পাশে দাঁড়ানোর একটা ধারাও গড়ে উঠেছিল। বাথানিটোলায় দুর্ঘটনার দিন স্থানীয় স্কোয়াড আক্রমণকারীদের ঠেকিয়ে রেখেছিল, কিন্তু একজন যোদ্ধা আহত হন (পরে তিনি মারা যান), গোলাগুলি ফুরিয়ে যায় এবং তাঁরা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন। কিছু বিভ্রান্তির জন্য অন্যান্য গ্রাম থেকে শক্তি এসে পৌঁছায় অনেক দেরীতে। বাথানিটোলার ঘটনায় আমাদের বিধায়ক রামেশ্বর প্রসাদের আমৃত্যু অনশন সহ এক শক্তিশালী রাজনৈতিক বিক্ষোভ আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল।

বাথানিটোলার গণহত্যা সত্ত্বেও জনগণ লড়াকু মেজাজেই ছিলেন। কিন্তু ভালোরকম বিভ্রান্তি থাকার জন্য দ্রুত ও তাৎক্ষণিক বদলা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এক দিশাহীন পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে এবং সুসজ্জিত রণবীর সেনার সঙ্গে লড়াই করার জন্য উন্নত আগ্নেয়াস্ত্র, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে।

রণবীর সেনার সশস্ত্র দলকে ধ্বংস করার জন্য একবার একটি দুঃসাহসিক প্রয়াস গ্রহণ করা হয়, কিন্তু তা পুরোপুরি সফল হয় না। জনগণের দিক থেকে বাছাই করা যে কোনো বদলার প্রতিক্রিয়ায় রণবীর সেনা নির্বিচারে বহু মানুষকে হত্যা করছিল। সুস্পষ্ট জাতপাতের মেরুকরণের দরুণ শত্রুর মধ্যকার খবর সংগ্রহের জাল পুরোপুরি অকেজো হয়ে থাকে, ফলে তাদের মূল সশস্ত্র দলটির গতিবিধি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট খবরাখবর সংগ্রহ করতে আমরা ব্যর্থ হই।

রণবীর সেনা ও তার সামাজিক ভিত্তি প্রচণ্ড উৎফুল্ল হয়ে ওঠে এবং জনগণের মনোবল দুর্বল হয়ে পড়ে। ধাক্কার এই পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই কিছু বিভ্রান্তি ও বিতর্কের জন্ম দিল। একটি নির্দিষ্ট মতামত ছিল এই যে, সাবর্ণদের (উচু জাতি) সামন্ততান্ত্রিক আধিপত্যকে চূর্ণ করার আমাদের স্লোগান এবং ব্যাপকভাবে উচ্চবর্ণের জমিদারদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে তোলাই তাদের উঁচু মাত্রায় জাতভিত্তিক মেরুকরণের দিকে নিয়ে গেছে। কিন্তু এই মতামত অতিসরলীকরণ ও একপেশেপনার শিকার বলে মনে হয়। আমাদের স্লোগান ভোজপুরে বিদ্যমান সামন্ততান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলির বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করেছে। জোয়ালা সিং-এর নেতৃত্বে উচ্চবর্ণের সমাবেশকে আমরা চূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছি এবং এই স্লোগান সত্ত্বেও বিহটার রাজপুতদের কাছে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে পার্থক্য করার আমাদের নীতিকে বারবার ব্যাখ্যা করে রাজপুতদের একটি ভালো অংশকে নিরপেক্ষ করতে আমরা সমর্থ হই।

বস্তুত, রণবীর সেনার বিষয়টি যখন দেখা দিতে শুরু করে তার আগেই আমরা আমাদের স্লোগানকে পরিবর্তিত করে সাম্প্রদায়িক-সামন্ততান্ত্রিক আধিপত্যের (যা উচ্চবর্ণের সামন্তদের বিজেপির অনুকূলে সমাবেশিত হওয়ার রাজনৈতিক বিকাশকেই প্রতিফলিত করেছিল) বিরুদ্ধে চালিত করি। কিছু ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি হয়েছিল এবং সেগুলির অবশ্যই কিছু ভূমিকা ছিল, কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই তা নির্ধারক হয়ে ওঠেনি। লিফলেট প্রকাশ করে আমরা ভূমিহারদের মধ্যে বিশেষ প্রচারাভিযান চালাই এবং শান্তি অভিযানের মাধ্যমে মধ্যবর্তী অংশটির সঙ্গে সম্মানজনক সমঝোতায় পৌঁছাই। আমরা আলোচনাসভাও সংগঠিত করি যাতে ভালোসংখ্যক ভূমিহার বুদ্ধিজীবী অংশগ্রহণ করেন। সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ভোজপুরের নির্ভীক কমরেডরা সংগ্রামে অবিচল থাকেন।

রণবীর সেনার আক্রমণাত্মক অবস্থা এখন এক স্থিতাবস্থায় পরিণত হয়েছে। আমরা ধাপে ধাপে আমাদের উদ্যোগকে পুনরুদ্ধার করছি। কিন্তু তাদের মূল সশস্ত্র শক্তি এখনও অটুট এবং গুরুত্বপূর্ণ পার্টি নেতাদের হত্যা করাই এখন তাদের ঘোষিত লক্ষ্য। ঝামেলা পাকিয়ে তোলা এবং গণহত্যা সংগঠিত করার সামর্থ্য এখনও তাদের রয়েছে। কাজেই আত্মসন্তুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রেখে আমাদের আক্রমণাত্মক অবস্থানে যেতে হবে। জেলা কমিটি বিস্তৃত আলাপ-আলোচনা এবং একের পর এক ক্যাডার সম্মেলনের মাধ্যমে রণবীর সেনার সঙ্গে সংগ্রামের সমগ্র প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা করেছে, তার ঐক্যকে শক্তিশালী করেছে এবং বিজয় অর্জন পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর আগেও ভোজপুর অনেকবারই এটি করেছে এবং আরও একবার বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করছে।